magazines

৪৮ তম ই-সংস্করণ ।। ৫৯ তম সংখ্যা ।। জুন , ২০২৫

৪৮ তম ই-সংস্করণ ।। ৫৯  তম সংখ্যা ।। জুন , ২০২৫

ভাণ পত্রিকা


৪৮ তম ই-সংস্করণ ।। ৫৯ তম সংখ্যা ।। জুন , ২০২৫

সম্পাদক :

সম্পাদনা সহযোগী :​

প্রচ্ছদ :

অন্যান্য কাজে :

ভাণ-এর পক্ষে:

পার্থ হালদার

কর্তৃক

৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা: ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ: ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬

(হোয়াটসঅ্যাপ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ (কথা /হোয়াটসঅ্যাপ)

৮৭৭৭৪২৪৯২৮ (কথা) bhaan.kolkata@gmail.com (ই-মেল) ​

Reg. No: S/2L/28241

সূচিপত্র

সম্পাদকীয় – গৌরাঙ্গ দণ্ডপাট

কলকাতার চড়কের অজানা ইতিহাস – কিশলয় জানা

প্রতি-প্রশ্ন: নিজেকে প্রশ্ন করতে শেখায়- ভাণ-এর প্রতিবেদন

বাংলা ওটিটি প্ল্যাটফর্মের সাড়াজাগানো ওয়েব সিরিজ ‘কাবেরী’ – অজন্তা সিন্হা 

‘অর্ঘ্য’-র আন্তিগোনে, দৃশ্যে-ব্যাখ্যায় এক অন্যতর মাত্রা- সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

ছোটদের ছবি : খায় না মাথায় দেয়? (১ম পর্ব) -অরিত্র দে 

সম্পাদকের কথা

।।সম্পাদকের কথা।।

জুন , ২০২৫

বাঙালি ঝিমুচ্ছে। অন্যায়ের পর্বতের পাদদেশে আশাহীন বাঙালি যেন কোনক্রমে নিজেকে আধ-বোজা চোখে জাগিয়ে রেখেছে মাত্র। অন্যায়কারীদের স্বাভাবিক পতন বারংবার আটকে যাচ্ছে। কিছুই যেন দানা বাঁধছে না। পরিবর্তনের আশা ক্ষীণ। বুকে মনে বল পাচ্ছে না বাঙালি। মেনে নিচ্ছে, মানিয়ে নিচ্ছে, টিকে থাকছে, ভাসিয়ে রাখছে নিজেকে। দেহ মনে অস্বস্তি। কিন্তু  কিছুই করার নেই যেন। মনে হচ্ছে সবই ভবিতব্য। বোধ হচ্ছে ভালো সময় দুরাশা, কষ্ট কল্পনা। সামান্য ভালো কিছু দেখতে পাচ্ছে না সে। গণতন্ত্রে আস্থা হারাচ্ছে আজকের বাঙালি। ভোট ব্যবস্থার গভীরেও ঘুন দেখেছে সে। চাটুকারে ভরে গেছে চরাচর। এমন বেয়াদব ক্ষমতাতন্ত্রের পক্ষে হাজারে হাজারে ডিগ্রিধারী চাটুকার দেখে বেবাক বনে গেছে আপামর বাঙালি। প্রথাগত শিক্ষায় ঘেন্না হচ্ছে। শিক্ষিত মানুষ দেখলে ঘেন্না হচ্ছে। জ্ঞান-গম্ভীর কথা শুনলে রাগ হচ্ছে। সবার সবাইকে সুবিধাবাদী মনে হচ্ছে। ধান্দাবাজ মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমার এ অবস্থার জন্য ‘ও’ দায়ী!  স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছে যারা তাদেরকে শত্রু মনে হচ্ছে। যারা গাল ভরা হাসি নিয়ে রাস্তায় হাঁটছেন তাদের নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে। ভালো কিছু ঘটলে ঈর্ষা হচ্ছে। খারাপ লোক মনে হচ্ছে। অসহ্য লাগছে। এ ভয়ঙ্কর বিষময় কালাকাল। এমনই দুর্দশাগ্রস্থ সময়ের ভেতর দিয়ে পথ হাতড়াতে হাতড়াতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে বাঙালি। সে এখন আড্ডা দেয় না। নিজের ভাষায় নিজেকে রাখতে পারে না। নিজের জোরে সাহিত্য সিনেমা থিয়েটার বানাতে পারছে না।  গুণীজনদের সম্মান দিতে পারে না। যা কিছু গৌরবের, যা কিছু নিজের সব বিকিয়ে বেঁকিয়ে হতশ্বাস ও বেবাক বনে গেছে সে। এখন সে জীবনের কোন অর্থ খুঁজে পাচ্ছে না। কোন নীতি-নৈতিকতার কথা ভালো লাগছে না। কোন প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মিছিল আর তেমন করে টানছে না। কেননা সব কিছুর পরে সবশেষে তারাই জিতছে, যারা সবচেয়ে খারাপ, সবচেয়ে মন্দ, সবচেয়ে শয়তান, সবচেয়ে বিশ্রী। চোর ডাকাতদের টানা জয়-জয়কার দেখে শুধু সমাজের উপরে নয় সময়ের  ওপরে নয়, নিজের উপরে ভরসা হারাচ্ছে  বাঙালি। ইতিহাসে ভরসা হারাচ্ছে। বিজ্ঞানে ভরসা হারাচ্ছে। লেখাপড়ায় ভরসা হারাচ্ছে। যুক্তিতে ভরসা হারাচ্ছে। কেউ সন্দেহাতীত নয়। জীবনের এমন অসার রূপ একমাত্র নিহিলিজম দিয়ে ব্যাখ্যা করে চলে। ঈশ্বর মৃত, নীতি নৈতিকতা মৃত, বিশ্বাস মৃত, বন্ধুত্ব মৃত, আশাহীন জীবনের কোনো অর্থ নেই। এক মহাশূন্যে চলে যাচ্ছে একটা জাতি। ভয়াল এক শব্দহীন নৈরাশ্য গ্রাস করছে তাকে।

 

নেতা খিস্তি করছেন, আবারো খিস্তি করছেন, পুলিশকে খিস্তি করছেন, জনগণকে খিস্তি করছেন, আপনার আমার মা-বোন-মেয়েকে খিস্তি করছেন। খেউড় করছেন। যদি কেউ বলেন এসব ভালো নয়, তাকেও খিস্তি করছেন। যাকে খিস্তি করছেন সেই মানুষগুলিই আবার সেই খিস্তিবাজ বিকৃত অসভ্য নেতার অনুগ্রহ লাভের জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছেন। যারা যোগ্য তাদের চাকরি যাচ্ছে। যারা ঘুষ খেল তারা বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে সৎ সে ভিখারি বনে যাচ্ছে। যে অসৎ সে ভোটে জিতছে। যে অশিক্ষিত সে শিক্ষানীতি বানাচ্ছে। যে ডাক্তারি ফেল করেছে সে ডাক্তারদের সর্দার বনে যাচ্ছে। যে আধিকারিকরা ঘুষ খান না তাদের নামে কমিশন বসছে, নিন্দা প্রস্তাব উঠছে। যারা বদমাইশ তারা সাফল্যের চূড়ায় বসে খুর নাচাচ্ছেন। যে ডাক্তার ছত্রিশ ঘন্টা খাটতে খাটতে হাসপাতালেই অত্যাশ্চর্য ভাবে খুন হয়ে গেলেন। তার খুনিরা দাঁত ক্যালাচ্ছে। বক্তৃতা দিচ্ছে। হরি নাম জপছে। নীতিবাক্য প্রদান করছে। আমরা প্রত্যুত্তরে দাঁত ক্যালাচ্ছি। পোষা কুত্তার অভিমান নিয়ে সেইসব মসনদের মালিকদের প্রশ্রয়ের চিন্তায় গা ঘষছি। আমরা বেঁচে নেই। আমরা মরে গেছি। আমরা বেঁচে আছি কিনা জানি না। আমরা মরে গেছি কিনা জানিনা। অন্ধকারে সব বোঝাবুঝি লুপ্ত হয়ে গেছে। আমরা ভালো নেই। আমরা মন্দ নেই। আমরা তলিয়ে গেছি, হারিয়ে গেছি।

 

অসার জীবনের এই বোধ সম্ভবত একটা বাঁক। একটা  পূর্বাভাস। এক বুক ঝুঁকি নিয়েও যারা পথে তাদের সেলাম। যারা এখনও অভয়ার জন্য বিচার চাইছেন তাদের প্রণাম। আমাদের শক্তি দাও ঈশ্বর। আমরা যাতে মরবার আগে সত্যিকার অর্থে বেঁচে উঠতে পারি। এই বাংলা কবে ভালো হবে আমি জানি না। যদি তুমি জেগে উঠো ঝুঁকি নিয়েও। এক বুক হতাশা নিয়ে জীবনের জয়গান গাও। তাহলে তুমি বেঁচে যাবে। আমি বেঁচে যাব। আমাদের আগে বেঁচে ওঠা দরকার। নইলে আমরা কাউকে বাঁচাতে পারব না।

কলকাতার গালগপ্পোর ষষ্ঠদশ পর্ব লিখলেন - কিশলয় জানা

কলকাতার চড়ক

কিশলয় জানা

চৈত্র মাস পড়ল কী পড়ল না, সেকালে কলকাতার মন পাগল পাগল। না না, আরও গরম পড়বে বলে নয়, ‘নেটিভ’ মানুষেরা গরমকে “আমি কি ডরাই সখি ভিখারী রাঘবে?”-এর মতো থোড়াই কেয়ার করে। তাদের মন উচাটন, নিঃশ্বাস সঘন চড়ক আসছে বলে, আর তার পর পরই হালখাতা। হুতোম তো অনেক পরে লিখেছেন, তার অনেক আগে থেকেই সাহেবসুবোরা চড়ক দেখে কেউ বিস্মিত, কেউ অভিভূত, কারুর কাছে গোটা ব্যাপারটাই ‘ন্যাস্টি’ ইত্যাদি। কিন্তু কেউই ওর আকর্ষণ এড়াতে অক্ষম, অপারগ।

     সেকালে সাহেবরা জানতেন, বাঙালির দুই প্রধান উৎসব—দুর্গাপূজা এবং চড়ক। আর কোন পূজা বা উতসবকে কেন্দ্র করে সেদিনের কলকাতাবাসী এত হুজুগে, এত উন্মত্ত হয়ে উঠত না। ফলে এই  দিন সাহেবরাও চাকর-নফরদের ছুটি দিতে বাধ্য হতেন। সাহেবদের বাংলো খালি করে সকলে ছুটত চড়কের মাঠে। পতঙ্গ যেমন করে ছুটে যায় আগুনের দিকে তেমনি করে। চড়ক, রামনবমী প্রভৃতি কাছাকাছি অনুষ্ঠিত কিছু উৎসব নিয়ে সেকালে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। দোকানপাট বন্ধ, কাজকর্ম বন্ধ, সকলের লক্ষ্য চড়কের মাঠে পৌঁছানো। ১৮২১-এর এপ্রিল সংখ্যা ‘সমাচার দর্পণে’ আক্ষেপ করতে দেখি যে, এই উৎসব উপলক্ষ্যে “বাণিজ্যাদি সকল বন্দ হইয়াছে” বলে।

    কলকাতার নানা জায়গায় চড়কের জন্য নির্দিষ্ট মাঠ ছিল, কালক্রমে সেই সমস্ত স্থান চড়কডাঙা নামে পরিচিত হয়। এই রকম অন্তত তিনটি স্থাননাম দীর্ঘকাল ধরে পরিচিত ছিল। যেমন—বর্তমান টেগোর ক্যাসেল স্ট্রীট ( ২৪ নং ওয়ার্ড ), কবি সুকান্ত সরণি ( ৩৫ নং ওয়ার্ড ) এবং কালীঘাট রোড ও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী রোডের সংযোগস্থল ও সন্নিহিত অঞ্চল তিনটির নামই ছিল চড়কডাঙা। তবে এগুলি ছাড়াও অন্যান্য অনেক জায়গায় চড়ক অনুষ্ঠিত হত। প্রাণকৃষ্ণ দত্ত জানিয়েছেন, উনিশ শতকের গোড়ার দিকে প্রায় প্রতিটি লোকালয়ে এবং বাজারে গাজন হত। চড়কে যাঁরা অংশ নিতেন, তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন হাড়ি জাতিভুক্ত। পরবর্তীকালের যে নন্দ চৌধুরী লেন, সেখানে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়েও ছিল হাড়িদের নিজস্ব বসবাসের অঞ্চল হাড়িপাড়া। প্রধানত এই হাড়িরাই গাজনের সন্ন্যাসী হতেন এবং তাঁদের মধ্যে থেকে একজন হতেন মূল সন্ন্যাসী। তবে সমাজের অন্যান্য নিম্নবর্গীয় মানুষরাও যেমন— মুচি, বাগদী প্রমুখেরাও গাজনের সন্ন্যাসী হতেন। উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণেরা গাজনে অংশ নিতেন না কিংবা সন্ন্যাসী হতেন না। ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্যান্যরা সন্ন্যাসীদের প্রণাম করে আশীর্বাদ নিতেন, তাঁদের প্রাণ ভরে খাওয়াতেন। সেদিন তাঁদের সম্মানই ছিল অন্যরকম। যাঁরা সন্ন্যাসী হতেন, তাঁরা এক মাস ধরে শুদ্ধাচারে থাকতেন, গেরুয়া পরতেন এবং সন্ধ্যাবেলায় একবার মাত্র হবিষ্যান্ন খেতেন। চড়কের কয়েকদিন আগে সন্ন্যাসীরা ঢাক-ঢোল নিয়ে নগর-পরিক্রমায় বেরুতেন। এই পরিক্রমা শুরু হত কালীঘাট থেকে। শহরের রাস্তায় রাস্তায়, অবস্থাপন্ন মানুষের বাড়ির সামনে এবং পথে যেখানে যেখানে শিব-মন্দির আছে, তার সামনে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি সহকারে নাচ করত। নিয়ম ছিল যাত্রাপথের সামনে যদি কেউ দাগ টেনে দেয়, তাহলে সেই গণ্ডি বা দাগ এমনিতে অতিক্রম করে যাওয়া যাবে না। তার জন্য একখানি ধাঁধার উত্তর দিতে হবে। লোকে ছড়া কেটে নানা প্রশ্ন করত, এই রকম একটি ছড়ার নমুনা দিয়েছেন মহেন্দ্রনাথ —

                               “শুনরে সন্ন্যাসি ভাই আমার বাখান

                               উত্তর দিয়া তুমি যাও অন্যস্থান।

                               এরণ্ড আর থাম খুঁটি, ভেরাণ্ডার বেড়া,

                               তার মাঝেতে পড়ে আছে মস্ত এক নোড়া।

                               বাটনা বাটিতে শিবের পুঁটকি হল ক্ষয়

                               সেই শিবকে গড় করিলে কি পুণ্য হয় ?”

বলা বাহুল্য এই প্রশ্নের মধ্যে ছিল অশ্লীল ইঙ্গিত। উত্তর যদি সঠিক দিতে পারেন , তাহলে সেই দাগ মুছে দেওয়া হত এবং সন্ন্যাসীরা বিজয়ী হয়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে এগিয়ে যেতেন। কিন্তু উত্তর না দিতে পারলে যে-পথে তাঁরা এসেছিলেন, সেই পথেই ফিরে যেতে হত।

    কালীঘাট চড়কের দিনে লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠত। মহেন্দ্রনাথ দত্ত জানিয়েছেন, চড়কের দিন ভোরবেলা চড়কের সন্ন্যাসীরা কালীঘাটে যেতেন।  সেখান থেকে তাঁরা বাণ ফুঁড়িয়ে আসতেন। একজন বলবান ব্যক্তি ইচ্ছুক সন্ন্যাসীদের পিঠে জোরে জোরে কিল মারতেন ( কিল মেরে কাঁঠাল পাকানোর মতন ব্যাওয়ার আর-কী ), তাতে পিঠ ফুলে উঠত। তখন সেই পিঠের চামড়া টেনে সেখানে ধারালো বঁড়শির মতো হুক ঢুকিয়ে দেওয়া হত। এতে যে রক্তপাত হত, তা বন্ধ করার জন্য গরম ঘি লাগিয়ে দেওয়া হত, তাতে রক্তপাত বন্ধ হয়ে যেত। কালীঘাট ছাড়া অন্যান্য কালীমন্দিরেও বাণ ফোঁড়া হত। প্রাণকৃষ্ণ হোগলকুড়িয়ার ( আজকের সাহিত্য-পরিষৎ স্ট্রীট ) বাবু শিবচন্দ্র গুহের বাড়ির কালীমন্দিরে এইরকম এক সন্ন্যাসীর জিভে বাণ ফুঁড়তে দেখেছিলেন। শিবচন্দ্র দুঃস্থ বংশে জন্মগ্রহণ করেও মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে ল্যাকারটিন অ্যাণ্ড কোম্পানিতে কেরাণির চাকরিতে ঢোকেন। পরে নিজের ক্ষমতায় তিন-তিনটি সংস্থার মুৎসুদ্দি হয়ে ওঠেন। প্রভূত সম্পত্তি করেছিলেন তিনি। সেই সম্পত্তির কিছুটা তিনি ব্রাহ্মণদের সেবায়, পুকুর খননে এবং মন্দির নির্মাণে ব্যয় করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত নিস্তারিণী কালীর মন্দির এবং পাশেই  শান্তিনাথ শিবের মন্দির আজও আছে। কুস্তগীর অম্বিকাচরণ গুহ এবং যতীন্দ্রচরণ বা গোবর গুহ শিবচন্দ্রের বংশের দুই স্বনামধন্য উত্তরপ্রজন্ম।

   শোভাযাত্রা উপলক্ষে সঙ বার করা হত। দুটি অল্পবয়সী ছেলেকে হরগৌরী সাজিয়ে ঘোড়ায় টানা গাড়িতে কিংবা ঝুড়ির উপর বসিয়ে মাথায় নিয়ে, সঙ্গে বাকি সঙ-শিল্পীরাও নানা রকম সেজে নাচ-গান, অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি করতে করতে শোভাযাত্রা এগিয়ে যেত। ছোট ছোট নাটকও অনুষ্ঠিত হত। জেলেপাড়ার সঙ ছিল সবচেয়ে বিখ্যাত। এক সময় গঙ্গার চাঁদপাল ঘাট থেকে একটি খাল বর্তমানে আনন্দবাজার পত্রিকার বাড়ি যে জমিতে, সেখান দিয়ে আজকের সুবোধ মল্লিক স্কোয়্যার হয়ে ক্রীক রো ধরে শিয়ালদহের কাছে লবণহ্রদে পড়ত। এই খালে মাছ ধরার তাগিদে বিশেষত হুগলীর খানাকুল থেকে একদল জেলে এখানে এসে মলঙ্গা থেকে লবণ হ্রদের মাঝামাঝি জায়গার জঙ্গল কেটে সেখানে বাস করতে থাকেন, তাঁদের হাত ধরেই জায়গাটির নাম জেলেপাড়া হয়ে দাঁড়ায়। সেকালে  সঙ বার করার জন্য বিখ্যাত ছিল যে জেলেপাড়া, সেটি এটাই। যদিও শহরের আরও নানা জায়গায় জেলেপাড়া-চিহ্নিত অঞ্চল ছিল। জেলেপাড়ার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল কাঁসারিপাড়া। সঙ দেখতে এত ভিড় হত যে কখনও কখনও দুর্ঘটনা পর্যন্ত ঘটত। কাঁসারিপাড়ার তারকনাথ প্রামাণিকের সঙ দেখতে গিয়ে ভিড়ের চোটে তাঁর বাড়ির সামনের একটি গ্যাসের বাতি উপড়ে নিচে পড়ে অনেকে আহত হয়।

   ছাতুবাবুর মাঠের চড়ক ছিল দেখবার মতো। সন্ন্যাসী, সঙের দল এরা তো ছিলই, সেই সঙ্গে জুটত নাচওয়ালীরা। ফ্যানি পার্কস থেকে হ্যামিলটন, মিসেস বিশপ হ্বেবার থেকে ওয়ালেশ নামের জনৈক সাহেব—সকলেই চড়কের উৎসব দেখতে গিয়ে এই নাচওয়ালিদের অদ্ভুত নাচের কথা এবং তাঁদের ঘিরে অশ্লীল আমোদ-প্রমোদে মত্ত হয়ে ওঠার কথা বলেছেন। কলকাতার অনেক কিছু ভালো লাগলেও চড়ক উৎসব তাঁর ভালো লাগে নি একেবারেই। এই মাঠটির চারদিকে প্রাচীর ছিল, মাঠের মধ্যে শান-বাঁধানো একটি পুকুর ছিল, যেখানে চড়কগাছ ভেজানো হত বলে তাকে বলা হত চড়কপুকুর। এই মাঠের উত্তর-পশ্চিম দিকে পরে বেঙ্গল থিয়েটারের রঙ্গমঞ্চ তৈরি করা হয়। মাঠের পশ্চিমদিক ঘেঁষে চড়কগাছ স্থাপন করে মূল অনুষ্ঠানটি হত। গাছের নীচে বঁইচি গাছের কাঁটাওয়ালা ডাল, কখনও আগুন ইত্যাদি রেখে তার উপর চড়ক গাছের উপরে উঠে ঝাঁপ দেওয়া হত। এই উপলক্ষে মাঠে মেলা বসত। মেলায় নাগরদোলা, ঘোড়ার চরকি বা চরকা বসত। অমৃতলাল বসু জানিয়েছেন, রঙ্গমঞ্চ গড়ে ওঠবার পরে ছোট করে হলেও এই চড়কের মেলা ও উৎসব হত। মেলায় তিনি ধুচুনি, কুলো, পুতুল ইত্যাদি বিক্রি হতে দেখেছেন।

   সাধারণত, দু-চরকি হলেও কোথাও কোথাও এর চেয়ে বেশিও হত। সবচেয়ে বেশি হত বাগবাজার, যার আগের নাম ছিল বাগুয়া বাজার। সেখানে বাবু নন্দলাল বসুর বাড়ির কাছেই বাগবাজারের বিখ্যাত ষোল চরকি অনুষ্ঠিত হত। এই চড়কটি ছিল রামধন ঘোষের চড়ক। এই বিশেষ চরকিতে চড়ক গাছের উপর চারটি মাচান বেঁধে সর্বোচ্চ মাচানের মাঝখানে একজনকে মহাদেব সাজিয়ে বসান হত, অন্যদিকে প্রতিটি মাচানের প্রতিটি কোণে একজন করে মোট ষোল জন লোককে পিঠে বাণ ফুঁড়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হত। তারপরে চরকা গাছটি ঘোরানো হত। বলা বাহুল্য গোটা ব্যাপারটিই ছিল খুব কষ্টদায়ক, অমানবিক। ভক্তি-প্রদর্শনের প্রথাটি প্রায় নারকীয় বললেও ভুল বলা হয় না। সাহেব-মেমরা সেজন্য প্রথম থেকেই এই উৎসবের প্রতি বিমুখ। উনিশ শতকের গোড়ার দিক এক মেম কৌতূহলী হয়ে চড়ক দেখতে গিয়ে হতভম্ব। কোথায় চড়ক দেখতে গিয়েছিলেন, তা জানা নেই, তবে সে স্থান লোকে লোকারণ্য ছিল, তা ফলাও করে বলেছেন তিনি। সেখানে ছিল বেশ কয়েকটি নাচের দল, প্রায় অর্ধনগ্ন লোকের একত্রে বসে আফিম, মদ, গাঁজা টানার আসর, নাচওয়ালির নাচ দেখতে গোল হয়ে হুঁকা হাতে বসা বিভিন্ন বয়সী মানুষের ভীড়, মেমকে দেখে তারা গা-শিউরে ওঠা দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছিল। চড়ক দেখে ফিরে ভয়ে, ঘেন্নায় মেমের রাতে আর ঘুম আসে না ! ভারতীয় অধ্যাত্মবাদ ও ম্যাজিকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ফ্যানি পার্কস্‌-ও প্রায় একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন, তবে তিনি চড়ক দেখেছিলেন কালীঘাটে, সন্ধ্যার সময়। বলাবাহুল্য মূল ব্যাপারটি তাঁরও ভালো লাগেনি, যদিও ব্যাপারটি তাঁর কাছে চমকপ্রদ বলে মনে হয়েছিল। মিসেস হ্বেবার চড়ক দেখেছিলেন বৈঠকখানায়। তিনি একটি সঙের গানও তুলে দিয়েছেন তাঁর লেখায়, কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই ইংরাজিতে অনুবাদ করে। ফলে সেটি পড়ে মূল গানটির কথা ও ব্যঙ্গ বোঝা সম্ভব নয়। হ্বেবার আলিপুর রোডের চড়কের বর্ণনাও দিয়েছেন, তা থেকে বোঝা যায়, সেখানেও বড় চড়কের সমারোহ হত। হাগিন্স কালীঘাটে চড়ক দেখার পরে একে বলেছিলেন, এই উৎসব হল “practise different modes of self-torture”. বিচ্ছিন্নভাবে সাহেবদের লেখা, সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে বোঝা যাচ্ছিল, চড়ককে তাঁরা কেউই ভালো চোখে দেখছিলেন না। তবে এই ব্যাপারে দেশীয়দের মধ্যে প্রথম আওয়াজ তোলেন রামমোহন রায়, তাঁর সম্পাদিত ‘রিফর্মার’ নামক সংবাদপত্রে। এই সমস্ত লেখালেখির জেরেই সম্ভবত ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে আইন করে চড়ক উপলক্ষ্যে বাণ ফোঁড়া ইত্যাদি নারকীয় প্রথা কোম্পানির অধীন এলাকার মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে এর বিরুদ্ধে আবেদন-নিবেদনও কম হয় নি। চড়ক বন্ধ করে দিতে পারে গভর্ণমেন্ট, এই আশঙ্কায় তার অনেক আগে থেকে, সেই ১৮৩১-এর ‘সমাচার দর্পণে’ চিঠি লিখে জনৈক ব্রাহ্মণের কাতর আবেদন, “আমি ভিক্ষুক জাতি ব্রাহ্মণ নিবাস কালীঘাট মায়ের নিকটে থাকিয়া গুজরান করি অর্থাৎ সরা ধরিয়া খাই হিন্দুরা যদ্যপি আপন ধর্ম্মচ্যুত হন্‌ কিম্বা দেশাচার রহিত করে তবে আমারদিগের উপায় কি হইবেক বান ফোড়ার প্রাতে শ্যামা পূজার রাত্রে মহাষ্টমী পূজার দিবসে ইত্যাদি পূজা পার্ব্বণে যাহা প্রাপণ হয় তাহাতেই আমরা বংশাবলী প্রতিপালন হইয়া আসিতেছি…”। যদিও এত আবেদন-নিবেদনের পরেও শেষ রক্ষা হয় নি। তবে বাণ ফোঁড়া বন্ধ হয়ে গেলেও এবং অনেক চড়ক কোম্পানির গুঁতোয় আর শিক্ষিতদের আপত্তিতে বন্ধ হয়ে গেলেও, কয়েকটি প্রধান প্রধান চড়ক কিন্তু তার পরেও হত। তবে বান ফোঁড়ার ব্যাপারটি আর প্রকাশ্যে হত না। আর সেইসঙ্গেই সঙের গানও কিছুদিনের জন্য বন্ধকরে দেওয়া হয়। মহেন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, কেশব সেনের মেয়ের কুচবিহার-বিবাহকে ব্যঙ্গ করায়, কেশব সেন সঙ নামক অশ্লীলতার বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়ে ওঠেন এবং আবেদন-নিবেদন করে সঙের গানও রদ করে দেন।    

   খাস কলকাতার বুক থেকে উনিশ শতকের শেষ দিক থেকেই চড়ক উৎসবের আমোদ কমে আসতে থাকে। হুতোমের গ্রন্থ প্রকাশের বছর কুড়ি-তিরিশ যেতে না যেতেই চড়কগাছ, বাণ ফোঁড়া ইত্যাদি হয়ে ওঠে ইতিহাসের বিষয়বস্তু। চড়কের সন্ন্যাসীরা এবং অন্যান্য ভক্তেরা কালীঘাট থেকে বাণ ফুঁড়িয়ে চৌরঙ্গী এবং কসাইটোলার রাস্তা ধরে আসত, কিন্তু তাঁদের নাচ-গান-আচরণে অশ্লীলতার অভিযোগ ওঠায়, ওই রাস্তা ধরে শোভাযাত্রা করে তাঁদের ফেরা ১৮৩৯ সালে নিষিদ্ধ করে তাঁদের সারকুলার রোড ধরে ফিরতে বলা হয়। সম্ভবত ওই পথে পুলিশ মোতায়েন করা হত। আস্তে আস্তে এর প্রতি শিক্ষিত জনসাধারণের আগ্রহ কমতে থাকে এবং রামমোহনের পরবর্তীকালে আরও অনেকেই, বিশেষত শিক্ষিত ব্রাহ্মেরা এই উৎসব সরকারের বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ বলে দাবি জানাতে থাকেন। তবে প্রান্তিক মানুষদের উৎসব বলেই এটা এত সহজে বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল, উচ্চবর্ণের হিন্দু ব্রাহ্মণ ও জমিদারেরা এই উৎসবের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না বলেই চড়ক বন্ধে তাঁদের কোন মাথাব্যথা ছিল না। চড়ক অতএব বন্ধ হয়ে গেল অনেকটাই, তবে গাজনের গান ও হালখাতা রয়ে গেল। সঙের গানও ফিরে এল অচিরেই, তবে তখন তার কাঠামো বদলে গেছে।

প্রতি-প্রশ্ন: নিজেকে প্রশ্ন করতে শেখায়- ভাণ-এর প্রতিবেদন

প্রতি-প্রশ্ন: নিজেকে প্রশ্ন করতে শেখায়

ভাণ-এর প্রতিবেদন

নিজেকে প্রশ্ন করো। নিজেকে খোঁজো। রাতদিন আমরা নিজেকে প্রোটেক্ট করছি, নিজেকে জাহির করছি, নিজেকে প্রতিষ্ঠা করছি, কিন্তু প্রশ্ন করছি না, সন্দেহ করছি না। সংশয়হীন ভাবে নিজেকে শংসা করে যাওয়া আসলে কংসের ধর্ম। ভেতরের দুরারোগ্য ব্যাধি গুলোর থেকে পালাচ্ছি। তাকে ফেস করছি না। প্রশ্ন করছি না। নিজের ইচ্ছে, কামনা-বাসনার পক্ষে ব্যবহার করে চলেছি আমাদের যাবতীয় বুদ্ধি-মেধা-ক্ষমতা। বাসনার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না। মোটকথা মোটাসোটা আবরণের পরত ছাড়াতে ছাড়াতে অবচেতনে জড়িয়ে মুড়িয়ে থাকা  রাক্ষুসী খিদেটাকে আবিষ্কার করছি না।


তার সঙ্গে লড়ছি না। চ্যালেঞ্জ করছি না। সম্পর্ক ছেদ করছি না বরং ছাড় দিয়ে দিচ্ছি, তার পক্ষ নিয়েই গলা ফাটাচ্ছি, ভালোবাসছি। আমি নির্দোষ। অথবা আমার অন্যায়ের কারণ ‘আমি’ না, সর্বদা ‘অন্যকেউ’ অথবা ‘অন্যকিছু’।

দুর্গাপুর ভীমরতির ‘প্রতি-প্রশ্ন’ নাটকটি দেখার পর এ সমস্ত কথাই মাথায় আসে। আজকের সভ্যতা যেটুকু অর্জন করেছে বলে আমরা মনে করি,তার অনেকটাই ফাঁকি । আমাদের অভ্যাসে-ব্যবহারে-প্রতিদিনকার যাপনে তার সিকি ভাগও আমরা প্রয়োগ করতে শিখিনি। শিখিনি কেন?- তাই নিয়ে কয়েক দফা প্রস্তাব পেশ করা যায় যা এখানে অসম্ভব। তবু সেসব প্রস্তাবের মর্ম থেকে যে  কথাটি উঠে আসে সেটি হল  নিজেকে প্রশ্ন করতে পারার সক্ষমতা অর্জনই নিজেকে ফিরে পাবার সবচাইতে বড় উপায়।অর্কনীল পারল না। সে মনে করল একবার হ্যাঁ মানে দ্বিতীয়বার তৃতীয়বারও ‘হ্যাঁ’! মুখ ফুটে ‘না’ বললেও ‘হ্যাঁ’! যেহেতু ‘হ্যাঁ’ টাই আমার ‘ইচ্ছে’ তাই ‘না’ বলাটা মেয়েদের ন্যাকামো! সে শিখেছে পুরুষ হিসেবে নিজেকে নির্মাণ করতে গেলে এত প্রশ্নে, প্রতি-প্রশ্নে  নিজেকে বিব্রত করা চলে না, বরং পুরুষালি ইগোর গন্ধে তরতাজা রাখতে হয় নিজেকে। সে জেনেছে তার জন্য যেহেতু রাধা এবং প্রতিমা সহজলভ্য তাহলে বিশাখা কেন সহজলভ্য হবে না!??

নাটকের শেষে অর্কনীল জ্বলতে থাকে, পুড়তে থাকে। কেউ তাকে পোড়ায় না, কোনো আইনি শাস্তি তার জোটে না তবু সে উন্মাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে এ কারণে যে; সে বুঝতে পারেনা সে ঠিক ‘কী’ অন্যায় করল! লাখো লাখো কোটি কোটি অর্কনীল যেমন বুঝতে পারে না। অর্কনীল সোম  ক্রমশ বেঁটে হয়ে যায়, ছোট হয়ে যায়, মেরুদণ্ড শিথিল হয়ে সরীসৃপের মতো‌ হয়ে ওঠে অর্ক। অষ্টপ্রহর আমি জপ করতে করতে, ‘আমি’র ফাঁদেই জড়িয়ে পেঁচিয়ে কাবু হয়ে যায়!

আমাদের নিত্যদিনের আনন্দবাজার কত রকমের অসহিষ্ণুতা অন্যায় বলপ্রয়োগ নিঃশব্দে ঘটে চলে সে কথা প্রয়োগকর্তা নিজেও টের পান কি! মনের ততদূর বিকাশ ঘটার পূর্বেই জীবন ফুরোয় তাদের। এমনতরো একটি সূক্ষ্ম অনুভব অপরূপ নাটকীয় উন্মোচনে আমাদের চমকে দেয়। বাংলার রাজধানীতে এখন যে সমস্ত নাটক হয়ে চলেছে  তার থেকে অনেকটা পৃথক চিন্তার দোত্যনা নিয়ে হাজির হতে দেখি দীপঙ্কর সেনের ‘প্রতি-প্রশ্ন’ নাটকটিকে।

নাটকটির শৈলীর মধ্যেই একটা অভিনবত্ব আছে। তা মোটেও চমৎকারিত্ব তৈরি করার জন্য নয়। বরং এই নাটক সমস্ত ধরনের ম্যাজিকাল কম্পোনেন্ট থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে চায়।
 অত্যন্ত পরিশীলিত একটা পথ সে যদি না ধরত তাহলে মস্তিষ্কের অনেকটা গভীরে  সে তার দর্শকদের নিয়ে যেতে পারত না। প্রজেক্টরের ব্যবহার যে এমন শিল্প- সুষম হতে পারে তাও শেখবার মতো। মঞ্চ একেবারে ছিমছাম।
সৈকত মান্নার আলো অনবদ্য। আবহ এবং মঞ্চও নাট্যের জার্নি ও অভিপ্রায়ের ছায়াসঙ্গী হয়ে উঠতে পেরেছে। সে আমাদের ছায়া-কায়া-মায়াকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে ধরতে চেয়েছে। আর অভিনয় এই নাটকের সম্পদ। প্রত্যেকে বেশ ভালো তবে আলাদা করে উচ্চারণ করতেই হবে বুদ্ধদেব দাস ও নয়নার  কথা। এঁরা মঞ্চে সত্য হয়ে উঠতে জেনেছেন। চরিত্র হয়ে ওঠার মানসিক জার্নিতে এঁরা অগ্রগামী। অর্কনীলের মতো আপাত স্মার্ট শ্রেণিগতভাবে সমাজের উচ্চকোটির মানুষের কথা ভাবলে আমার চারপাশের অনেকের কথাই মনে পড়ে। নিজের কথাও মনে পড়ে। মনে পড়ে ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—”সবাই মনে করছে, সংস্কার আর কোথাও করতে হবে। আর কোথাও না। কোথাও না। কেবল ইচ্ছের মধ্যে ছাড়া।”

 

মধুরিমা – সুপর্ণা দত্ত

নয়না – জয়িতা মিত্র

অভীপ্সা – জয়ন্তিকা দে

সাশ্রীক – বিকাশ সাক্সেনা

কেশব – অরিন্দম মুখার্জি

বাংলা ওটিটি প্ল্যাটফর্মের সাড়াজাগানো ওয়েব সিরিজ ‘কাবেরী’- অজন্তা সিনহা

এক সংগ্রামী নারীর অগ্নিপরীক্ষা ‘কাবেরী’

অজন্তা সিনহা

বাংলা ওটিটি প্ল্যাটফর্মে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে হইচই-এর নতুন ওয়েব সিরিজ ‘কাবেরী’। সৌভিক কুণ্ডুর পরিচালনায় তৈরি এই সিরিজটি শুধুমাত্র একটি থ্রিলার নয়, এটি এক নারীর দুর্বিষহ অতীত থেকে আত্মপ্রতিষ্ঠার এক অবিস্মরণীয় যাত্রা।

কাহিনির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মধ্যবিত্ত গৃহবধূ কাবেরী, যে বছরের পর বছর স্বামীর অত্যাচারের শিকার। চরম নির্যাতনের পর একদিন কাবেরী সেই অন্ধকার জীবন ছেড়ে পালিয়ে যায়।

নতুন জীবনের সন্ধানে সে এক স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করে, যেখানে তার পরিচয় হয় ছাত্রী শম্পার সঙ্গে।

কাবেরী ও শম্পার মধ্যে এক গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়। এরপর শম্পা এক চক্রান্তের শিকার হলে, কাবেরী তাকে রক্ষা করার সংকল্প নেয়। ধীরে ধীরে কাবেরীর এই লড়াই শুধু শম্পার জন্যই নয়, তার নিজের অস্তিত্বের জন্যও এক কঠিন পরীক্ষায় পরিণত হয়। প্রসঙ্গত, এই সিরিজ শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য নয়, এটি সমাজের এক গভীর সমস্যা–গার্হস্থ্য নির্যাতন ও নারীর প্রতি অবিচারের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী বার্তা বহন করে। তাই ‘কাবেরী’ দেখা শুধুমাত্র একটি ওয়েব সিরিজ উপভোগ করা নয়, বরং এটি এক নারীর সাহসী লড়াইয়ের সাক্ষী হওয়া।

বাংলা ছবির শক্তিশালী অভিনেত্রী পাওলি দাম বাংলা ওয়েব সিরিজে অভিনয় শুরু করলেন ‘কাবেরী’র হাত ধরেই। পাওলি তাঁর চরিত্রকে ‘এক ব্যক্তিগত আবেগের সফর’ বলে বর্ণনা করেছেন। শুধু একজন নির্যাতিতা নয়, এই নারী সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের মধ্য থেকে শক্তি খুঁজে বের করে এবং এক দুর্দমনীয় রূপে আবির্ভূত হয়। তার প্রতিশোধ, আত্মরক্ষা ও শক্তিশালী হয়ে ওঠার কাহিনি দর্শককে এক অনন্য অনুভূতির অভিজ্ঞতা দেবে। পাওলি ছাড়াও আছেন সৌরভ চক্রবর্তী, যিনি এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে প্রথমবার পাওলির সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করছেন। শম্পার চরিত্রে অভিনয় করেছে বিয়াস ধর। আছেন চন্দন সেন, বিদীপ্তা চক্রবর্তী, পিনাকী মজুমদার, প্রান্তিক ব্যানার্জি, শঙ্কর দেবনাথ প্রমুখ। 

রহস্যে টানটান, পর্বে পর্বে উত্তেজনায় ভরপুর ‘কাবেরী’। আপাতত ৭ পর্বের প্রথম সিজন, যা যথেষ্টই সাড়া জাগিয়েছে। ফলে, দ্বিতীয় সিজন আসবে কিনা জানা না থাকলেও, দর্শক তীব্র অপেক্ষায়। পরিচালক সৌভিক কুণ্ডুই লিখেছেন সিরিজের কাহিনি। চিত্রনাট্য ও সংলাপ লেখক উৎসব মুখার্জি। সিনেমাটোগ্রাফি অনিমেষ ঘোরুই। সম্পাদনা সৌগত মুখার্জি।

সঙ্গীত ও ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর প্রাঞ্জল দাস। সাউন্ড ডিজাইন তীর্থঙ্কর মজুমদার। প্রযোজনা এক্রোপলিস এন্টারটেনমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড।

'অর্ঘ্য'-র আন্তিগোনে, দৃশ্যে-ব্যাখ্যায় এক অন্যতর মাত্রা- সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

‘অর্ঘ্য’-র আন্তিগোনে, দৃশ্যে-ব্যাখ্যায় এক অন্যতর মাত্রা

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

দুনিয়া জুড়ে সফোক্লিসের এই নাটকের নানাভাবে চর্চা হয়েছে। খানিক রূপবদলও হয়েছে, ফরাসি নাট্যকার জাঁ আনুই-এর হাতে। আবার এই দেশে এই বাংলায় নানাভাবে তার মঞ্চায়ন, এমনকি তাকে দেখেছি মূকনাট্য নিসাবেও। এইবার তাকে পেলাম আরও একভাবে। অর্ঘ্য-র প্রযোজনায় গত ১৭মে অনুচিন্তন আর্ট সেন্টারে। ঠিক আন্তিগোনে নাটকটি নয় বলা যায় এ আন্তিগোনে চরিত্রের প্রতিবাদী সত্তার উদ্‌যাপন, উদ্‌যাপন তার পরম্পরার। নাটকটির নামেও স্বভাবতই সেই ইঙ্গিত— ‘আন্তিগোনে celebration of the protest in the actor’s body’। নির্দেশক মণীশ মিত্র তার প্রয়োগ-কুশলতায় সেই বার্তাই ছড়িয়ে দিয়েছেন। কথায় যেমন এসেছে আন্তিগোনে থেকে চেরনোবিল হয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগণার নারী স্বর, প্রয়োগে সমান্তরালে আলো আঁধারি, চরিত্রদের নিজ নিজ মোবাইল টর্চ ব্যবহার, অভিনেতা অভিনেত্রীর শরীরী বিভঙ্গ-ভাষা, আন্তিগোনে ও ক্রেয়ন সংলাপ কয়েক অভিনেতা ও অভিনেত্রীর মধ্যে ভাগ করে দেওয়া, পুরুষ অঙ্গে নারী অভিব্যক্তির প্রকাশ, এক কথায় ভারি দ্যোতনাময়।

 

নিখুঁত শরীরী ভাষায়, সংলাপে, আলো আঁধারি, আবহ তথা প্রয়োগ সৌকর্যে অর্ঘ্য-র এই আন্তিগোনে নিশ্চিতভাবে এক অন্যতর সফল নিরীক্ষা— অন্যতর নাট্যআখ্যানের ইশারা।

ছোটদের ছবি : খায় না মাথায় দেয়? (১ম পর্ব)- অরিত্র দে

ছোটদের ছবি : খায় না মাথায় দেয়? (১ম পর্ব)

খোকা হয়েছে। চাঁদপানা মুখ। হরিহর রায়ের ঝিটেবেড়ায় লোক ধরছে না। দোরগোড়ায় ইন্দির ঠাকরুন। অভিমান ভুলে অভিযান। ভিড় ঠেলে ভিতরে। ভাঙা কোমর নিয়েই। ‘মুক থেকে কাপড়টা সরা না বউ…মুকটা একটু দেকি…দিব্যি হয়েছে, দিব্যি হয়েছে!’ মুখে হাসি। চোখে জল। বংশের চাঁদ কিরণ দিচ্ছে। সবে প্রতিপদ। সবে একফালি। অথচ একআকাশ মায়া। একগাল পিছুটান। তাই ঠাকরুন ঝুলি ঝেড়ে গল্প শোনায়। আর চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যায়।

আমাদের শৈশবে চাঁদ আসে সেই কবে থেকেই। লালকুমার-নীলকুমার। জোছনাপুরীর রাজকন্যে। কাজলাদিদি। তবে রুপোলি পর্দায় চাঁদ আসে অনেক পরে। ১৯০২ সালে। সৌজন্যে ফরাসি ম্যাজিক। ম্যাজিশিয়ান জর্জ মেলিয়েস। বাস্তবেই ম্যাজিশিয়ান। কত ফরাসি সন্ধ্যা কেটেছে হলে-দিলে-ভোঁদেভিলে। হাততালি। স্ট্যান্ডিং অভিয়েশন। পুষ্পবৃষ্টি। তারপর স্পেল ছেড়ে স্পেসে। সৌজন্যে স্পেশ্যাল এফেক্টস। সদ্যোজাত চলচ্চিত্রই হল তাঁর জিয়নকাঠি। নির্বাক কিন্তু নির্ঘাত। মায়া কিন্তু মারাত্মক। আর গল্প? বেশ! গল্প হোক কল্পবিজ্ঞান। নতুন ভেঞ্চার। নতুন আডভেঞ্চার। জুলে ভার্নের নভেল ‘ফ্রম দি আর্থ টু দি মুন’ (১৮৬৫) এবং তার সিকুয়েল ‘অ্যারাউন্ড দি মুন’ (১৮৭০) মনে মনেই ছিল।মনে ছিল এইচ. জি. ওয়েলস। আমরা পেলাম ‘আ ট্রিপ টু দি মুন’(১৯০২)। হাতে চাঁদ পেল শিশুরা। এবার সামার ভ্যাকেশনে তবে আকাশের চাঁদের পাহাড়ে! এদেশের চলচ্চিত্রে অবশ্য তখনো ‘চাঁদ ওঠেনি সিন্ধুপারে’।             

আমাদের চাঁদ মহাদেবের জটায় জ্বলজ্বল করে। সেই আদিকাল থেকেই। তাই অতো কষ্ট করে আর মহাকাশে যেতে হয় না। শুধু একটু কষ্ট করে পুরাণের পাতা ওল্টালেই হয়। এই যেমন রাজা হরিশ্চন্দ্র। সূর্যবংশী। সুশাসক। সত্যপথগামী। কিন্তু কতটা? পরীক্ষা নিতে এলেন ঋষি বিশ্বামিত্র। রাজা হলেন বচনবদ্ধ। বিশ্বামিত্রের কথায় দিয়ে দিলেন রাজপাট। বেচে দিলেন নিজের ধর্মপত্নীকে। বিক্রি হয়ে গেল প্রিয় পুত্র। পেট চালাতে হলেন শ্মশানবাসী।  জীবনের অভিঘাতে হলেন ডোম। বেঁচে থাকতে মরা পোড়ালেন। তবু ভদ্দরলোকের এক কথা। সত্যভ্রষ্ট হবেন না। এগল্প ছোটবেলার। এগল্প যাত্রাপালার। থিয়েটারের। এইবারে চলচ্চিত্র। ভারতবর্ষের প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘের চলচ্চিত্র। পরিচালক ঢুন্ডিরাজ গোবিন্দ ফালকে। আমাদের কাছে ‘দাদাসাহেব ফালকে’।   

 

চলচ্চিত্রের ফুলবাবু হয়ে ওঠার আগে এক রাজার সঙ্গে ফালকের আলাপ হয়। রাজা রবি বর্মা। পেন্টিং তার রাজপাট। ক্যানভাস তার সাম্রাজ্য। তুলি তার রাজদণ্ড। তবে সে তুলির টান সটান লেগেছিল সমাজের বুকে। পটের দেবদেবী অকপটে এসেছিল তার ক্যানভাসে। এহেন পটপরিবর্তন নেহাতই বীভৎস। দাঁত-মুখ খেঁচানো ভারতবর্ষ বেলজিয়াম গ্লাসের বিশাল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। এই ‘গেল-গেল’র মাঝেই ফালকের সাথে হাই-হ্যালো। তার ফল দেবদেবীদের চলচ্চিত্রে অধিষ্ঠান। সংস্কারী মারাঠীর পুরাণপ্রীতি ছিলই। রবি বর্মার ক্যানভাস ফালকেকে সম্ভাবনা দিল। ক্যানভাসের সাইজ বাড়ল। গল্পের পুরাণ ঝাঁ চকচকে নতুন হয়ে উঠল। ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’র (১৯১৩) পর এল ‘মোহিনী ভস্মাসুর’ (১৯১৩), ‘লঙ্কা দহন’ (১৯১৭), কালীয় মর্দন (১৯১৯)। কিন্তু এই বাড়বাড়ন্ত বাড়ন্ত বাচ্চারা দেখল কি? ছেলেবেলার ‘আষাঢ়ে গপ্পো’ সত্যি হয়ে উঠল কি? আলাদা করে কোনো তথ্য নেই। তবে ছোটরা রুপোলি পর্দায় চলে এল। নিজেরাই শোনা গল্পের একজন হয়ে উঠল। সৌজন্যে ‘দাদাসাহেব’ ফালকে।

 

নিজেই একজন হয়ে ওঠা শিশুমনের স্বাভাবিক গতি। নিজস্ব ছন্দ। যেমন জ্যাকি কুগান। চ্যাপলিনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাড়া-বেপাড়া চষে ফেলছে। ভাগ্যদোষে বড়লোকি খেলনাবাটি জোটেনি। অগত্যা পেট চালাতে গরিবি ছোটাছুটি। হাত মকশো। কাড়াকাড়ি। মারামারি। পেটের টানে নাড়ীর টান ফিকে। কিন্তু জীবননাট্যে ক্লাইম্যাক্স থাকবেই। তাই জন্মদাত্রীর সাথে দেখা। মিলন। হ্যাপি এন্ডিং। কুগান মা পেল। বাবা পেল। হারিয়ে ফেলা শৈশব পেল। আর চাপলিন বাহবা পেল। দুনিয়া পেল ‘দ্যা কিড’ (১৯২১)। আর আমরা পেলাম হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ার পাগলামি। ছোটবেলার একমুঠো আনন্দ। আর ট্রাজেডি প্লটে লেখা জীবননাট্যে অমলিন এক চ্যাপলিন। যে ছবি আট থেকে আশি সবাইকে শৈশবের সোনারকাঠি ছুঁইয়ে দেয় সেটা ‘ছোটদের ছবি’ বই কি!

 

ক্লাসিক উদাহরণও আছে। অলিভার টুইস্ট (১৯৪৮)। চার্লস ডিকেন্সের গল্প। ডেভিড লীনের ছবি। প্লটেও মিল আছে। তবে হাসি কম। শৈশব বেশি। তবে অলিভার তার মাকে দেখতে পায়নি। বাবাকে জানতে পারেনি। শিশুকাল শুরু হয়েছে রাস্তায়। মস্তির বদলে বস্তি। পরিবারের বদলে গ্যাং। স্লেট-পেন্সিলের বদলে ভিক্ষাপাত্র। ঘুম পাড়ানি ছড়ার বদলে কড়া থ্রেট। খেলনার বদলে ফেলনা অনুভূতি। অগত্যা জীবনে ফিরতে জীবন থেকে পলায়ন। শেষে সেই মহামিলন। দাদুর সাথে। মামাবাড়ির সাথে। আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। মামাবাড়ি ভারি মজা কিল চড় নাই। আমরা আবার শৈশবে ফিরে গেলাম। আমরা আবার একটা ‘ছোটদের ছবি’ পেলাম।

 

উলটো পুরাণের উদাহরণও আছে। এই বাংলাতেই। সব পেয়েও না পাওয়ার বিস্বাদ। বাড়ি পেয়েও বাইরের ডাক। কমফোর্ট জোনের বাইরে। বাস্তবটা চেখে দেখতেই কাঞ্চন গেল ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ (১৯৫৮)। শিবরাম চক্রবর্তী লিখলেন। ঋত্বিক ঘটক দেখালেন। আমরা পড়লাম কাঞ্চনের ‘বোকামি’র কথা। আমরা দেখলাম কাঞ্চনের অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় শিশুমন। আমরা জানলাম বাড়ির বাইরেটা শিশুমন নয়। দুয়ে দুয়ে চার নয়। ঝড় ঝাপ্টা এলে মায়ের আঁচল মেলে না। তালপাতার সেপাইদের ছোট মুখে বড় কথা বলা চলে না। কাঞ্চনও জানল। বুঝল। বাড়িই ভাল। বাড়িতেই বাহাদুরি। এবারও বাড়ি ফেরা। এবারও মিলন। তবে পুনর্মিলন। কাঞ্চনের। আমাদেরও। আমরাও ফিরে দেখলাম। আমাদের সেই ‘আমি যাবই’গুলো অচেতন ছিল। অবোধ ছিল। আমরা এতদিনে আবার জানলাম মা বড় ধন। সৌজন্যে এই ‘ছোটদের ছবি’।

 

প্রায় একই সময় আরও একটি চলচ্চিত্র তৈরি হয়। ‘দি বিউটি এন্ড দি বিস্ট’(১৯৪৬)। ক্লাসিক ফেয়ারী টেল। ‘ছোটদের’ গল্প। ককতোর ছবি। আবার ফরাসি ম্যাজিক। রজার এবার্টের প্রশংসা। এবার্ট তো বলেই দিলেন, স্পেশ্যাল এফেক্টস আর ‘মডার্ন ক্রিয়েচার মেকআপ’ আসার আগেও এই ফ্যান্টাসি দিব্যি হেসে খেলে বেড়ায় শুধু চোখধাঁধানো শটের গুণে। মানুষের মতোই একা, পশুর মতোই ভুল বোঝা এক ‘বিস্ট’এ আবিষ্ট আমরা। কবিমানুষ ককতো। পরাবাস্তববাদী। তিনি দিব্যি জানতেন যে তিনি মোটেই ‘ছোটদের ছবি’ বানাচ্ছেন না। বরং এই ক্লাসিক ফ্রেঞ্চ টেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পেরিয়ে এসে সবাইকে বলবে, এমনও শৈশব হয়, যেখানে আনন্দগান বাজে না। যেখানে একবুক ভাঙা স্বপ্ন নিয়ে শিশুরা ‘বিস্ট’ হয়ে যায়। কিন্তু সে ভাষা শিশুমনে ভাসা ভাসা। নেহাতই জটিল জ্যামিতি। দুম করে ঘুম পাড়ানি শৈশব ধরা দেয় না। বরং মনের বয়স বেশ খানিকটা বেড়ে যায়। অগত্যা ছবি হয়েও হইল না ‘ছোটদের ছবি’। (চলবে)

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *