magazines

বত্রিশতম সংখ্যা || তেইশতম ই-সংস্করণ || ডিসেম্বর ২০২২

ভাণ পত্রিকা

বত্রিশতম সংখ্যা || তেইশতম ই-সংস্করণ || ডিসেম্বর ২০২২

সম্পাদক :

সম্পাদনা সহযোগী :​

প্রচ্ছদ :

নক্সা পরিকল্পক :

অন্যান্য কাজে :

ভাণ-এর পক্ষে:

পার্থ হালদার

কর্তৃক

৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬

( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )

৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) bhaan.kolkata@gmail.com ( ই – মেল ) ​

Reg. No : S/2L/28241

সূচি

সম্পাদকের কথা

বাঙালির অধঃপাতে গিয়াছে। অন্তত আর বড় বাকি নাই। এ যেন বাঙালি নহে। বাঙালির ভূতের কেত্তন। ন্যায় নীতির বারোটা কবে বাজিয়াছিল। এই চাক্ষুস করিতেছি পাহাড় প্রমান দুর্নীতি কাহারে কয়। পাতাল হইতে পাহাড় উঠিল। জনরোষের কারণে ততটা নহে। এক বিচারক সিস্টেমের কোন্ ফাঁকে গলিয়া বাসর গৃহে নাগিনী প্রবেশের ফুটা করিয়া দিলেন। তাহার পর কেত্তন শুরু হইল। বালি-সুগ্রীব, কয়লা-ময়লা, সোনা-মোনা, গরু-গোপাল, পার্থ-স্বার্থ, হনুব্রত-অমাত্য, মিলিয়া কাকারা সমস্বরে জানিতে চাহিলেন – খাইপো পেট ভরি খাইসো??
 
 আপনারা ভুল বুঝিবেন না। খাইপো আসলে এক দৈত্যের নাম। সেকি খাওয়া রে বাপধন, ছোট মোটো বহু দৈত্য বিপুলাকার দৈত্য বনিয়া সোনা রূপা টাকা পয়সা জীবজন্তু খনিজ খাইয়াও সন্তুষ্ট হইল না। বলিল -“আমু পুরা সিস্টেম খামু”
আড়ালে বাৎসল্যে ভরপুর জগজ্জননী মুচকি হাসিয়া সায় দিতেই, সে দৈত্য পুলিশ খাইল, প্রশাসন খাইল, আই পি এস খাইল, আই এ এস খাইলো, ডি এম, এমডি, দপ্তর, পর্ষদ সব খাইলো; খাইয়া ঢেকুর তুলিল। ঢেকুর তুলিয়াই মা কে বলিল অদ্যাপি খিদা মিটে নাই। হায় খোদা, এ কাহারে পাঠাইলে, জগম্মাতা রাগিয়া বলিলেন,- তুই মাটি খা। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে তোকে আর কী আনিয়া দিব? শুনিয়া দৈত্য মাটি খাইলো, বালি খাইলো, যে খাইবার ভাগ না পাইয়া রোষে তাতিয়া গেল, দৈত্য সে মানুষ খাইল। এতো খাইলে বাকিরা খাইবে কী? – বলিয়া নিন্দুকেরা প্রশ্ন তুলিলে, দৈত্য তাহাদের বন্দী করিল, আর বহু লোভী নিন্দুককে ভাগ দিয়া সন্ধি করিল। তাহার পর কবি- চাকর, ছবি- চাকর, সব-ই চাকর এর দেশ হইয়া গেল! দৈত্যের অভিশপ্ত খিদা, সে হরিণ ভাবিয়া অশিক্ষার গুণে মায় ডিয়ার লটারি অবধি খাইলো!! তাহার পর দৈত্য অন্য সকল পুঁটে দৈত্যকে বলিল ..এবার চিৎকার শুরু করিয়া জনগণের কান ঝালাপালা করিয়া দাও। উহারা জানিতে চাহিল, আমরা কী বলিয়া চ্যাচাইবো। আদেশ আসিল, “আমরা খাই নাই, খাই নাই” বলিয়া চ্যাচাও। এবং “উহারা খাইয়াছে, উহারা খাইয়াছে” বলিয়া চ্যাচাও। এক কিশোর দৈত্য বিস্ময়ের সঙ্গে বলিল, কিন্তু আমরা তো সত্যি খাইয়াছি! বিশাল দৈত্য বলিল, ওটা না বলিলে আর খাইতে পাইবি না। ভোট আসিতেছে। এবার পেট ভরিয়া গণতন্ত্রকে চাট বানাইয়া আমরা ভোট খাইবো। গরিবের অধিকারকে জোরের অধিকার বলে দখল করিয়া লইবো।
 
ক্ষমতার অন্যপীঠ বলিল, শালারা খাইতে জানে না। খায় কম, ছড়ায় বেশি। আমরা ৬০০ হাজার কোটি হজম করিয়া দিব, টয়লেট পর্যন্ত নোংরা হইবে না, আর উহারা ৬০০ কোটি লইয়া হম্বিতম্বি করিতেছে। হা হা হা । 
 
যাহারা এই খাওয়া খাওয়ি হইতে যোজন দূরে তাহারা জানে এই দুর্দৈব উৎপাত সর্বদা চলিতে পারে না। কিন্তু একটা ভয়ও কুরিয়া কুরিয়া খাইতে থাকে। মারিয়া লুটিয়া টানিয়া ছিনিয়া এর কারবার টিকিবে না সত্য। কিন্তু ইহাকি আমাদের কালচারের অঙ্গীভূত হইয়া যাইতেছে না?? তা হইলে বিপদ বিষম। অসংখ্য দরিদ্র এবং সৎ মানুষেরা পরিত্রাণের পথ বাতলাইতে পারে। কিন্তু কলকাতার ফ্ল্যাট বাড়িতে বসিয়া আজকের আমি উহাদের মন বুঝি না।

‘গুল্লাক’ ওয়েব সিরিজ দেখে মতামত জানালেন - বৃতা মৈত্র

গুল্লাক শব্দের ইংরিজি প্রতিশব্দ পিগি ব্যাঙ্ক। বঙ্গ সংস্করণে যেটা লক্ষ্মীর ভাঁড়। এহেন লক্ষ্মীর ভাঁড় থুড়ি ‘গুল্লাক’ নিয়েই দুর্দান্ত এক ওয়েব সিরিজ দেখানো হচ্ছে সোনি লিভ এ। স্ত্রী শান্তি এবং দুই ছেলে আনন্দ ও আমনকে নিয়ে সন্তোষ মিশ্রর পরিবার। নিতান্তই ছাপোষা মধ্যবিত্ত এই পরিবারের যাপন আমাদের খুব চেনা। যথারীতি নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। ছেলেদের পড়াশোনা, চাকরি-বাকরির চিন্তায় বিপর্যস্ত শান্তি। একের পর এক চাকরির পরীক্ষাগুলিতে বিফল শান্তির বড় ছেলে আনন্দ ওরফে অন্নু। মায়ের সঙ্গে এই নিয়েই তার পদে পদে সংঘাত। শান্তি সারাক্ষণ খোঁটা দিয়ে চলেছে ছেলেকে। একদিন অন্নুর সঙ্গে তার ছোট ভাই আমনের মারামারি বেধে যায় টিভির ভলিউম বাড়ানো-কমানো নিয়ে। আমন মায়ের কাছে আবদার করে, শান্তি যেন অন্নুকে বলে আমনের বোর্ড প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার চার্ট বানিয়ে দিতে। এই নিয়ে আর একপ্রস্থ অশান্তি হয়। 
 
এক রবিবারের ঘটনা। স্বামী সন্তোষের ঘড়ির এলার্মে সকালে ঘুম ভাঙলো শান্তির। মধ্যবিত্তের রবিবার মানে তো একটু ভালোমন্দ খাওয়া। ছুটির আমেজে দিন কাটানো সবাই মিলে। সপ্তাহের নানা টানাপোড়েনে ক্লান্ত শান্তি। কিন্তু ঘরের কাজ তো করতেই হবে। অন্যদিকে সন্তোষ চায়, কিছুটা বিশ্রাম। কীভাবে রবিবার কাটাবে মিশ্র পরিবার? নির্ভেজাল ছুটি আর খানাপিনায়? নাকি অন্যরকম কিছু ঘটবে? আর একটি দিন। আমন হঠাৎই আবিষ্কার করে, বেশ দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু, অন্নু ঘরে ফেরেনি তখনও। সন্তোষ অবশ্য তেমন টেনশন করে না। ছেলের জন্য অপেক্ষা করে। অন্নু অনেক দেরি করে ফেরে এবং দাবি তোলে একটি স্কুটির। তার অজুহাত ও যুক্তি, স্কুটি নেই বলেই দেরি হয়েছে ঘরে ফিরতে। 
 
 
রাখিবন্ধন উৎসব। ঘরে পুজো, উদযাপনের আয়োজনে সারাদিন খাটা-খাটনি করে ক্লান্ত শান্তি। এদিকে অন্নুর রেজাল্ট বেরিয়েছে এবং সে ফেল করেছে। কথাটা অন্নু আমনকে জানালে, সে তাকে পালাবার পরামর্শ দেয়। নাহলে, মা অন্নুকে মেরেই ফেলবে। যথারীতি অন্নুর ফেলের সংবাদে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় শান্তির। সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তারপর জ্ঞান ফিরলে, সন্তোষ ও শান্তি দুজনেই অন্নুকে ক্ষমা করে দেয়। এভাবেই আজ ছেলেদের পড়াশোনা, কেরিয়ার তো কাল বাজারের আগুন দশা। আজ কিটি পার্টি তো কাল বিয়েবাড়ি। প্রতিবেশীদের মধ্যেও তো প্রতিযোগিতার অন্ত নেই। একদিকে সামাজিক মেলামেশা। অন্যদিকে সামাজিক স্তরভেদ। কোনদিকে যাবে সন্তোষ ও শান্তি? 
 
‘গুল্লাক’-এর নির্মাতা শ্রেয়াংশ পান্ডে। দ্য ভাইরাল ফিভার-এর ব্যানারে তৈরি এই ফ্যামিলি ড্রামার কাহিনি চেনা হলেও একে মোটেই একেবারে সাদামাটা ভাববেন না। মজার খোরাক যেমন আছে, তারই পাশাপাশি উঠে এসেছে মধ্যবিত্তের চিরন্তন লড়াই। ‘গুল্লাক’-কে কেন্দ্র করে তাদের অপূর্ণ ইচ্ছের পূর্ণ হওয়ার গল্প। এই কারণেই দর্শক খুব সহজে নিজেদের মিলিয়ে দিতে পারছে ‘গুল্লাক’-এর কাহিনির সঙ্গে। প্রথম সিজন দেখানো হয় দ্য ভাইরাল ফিভার-এর স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ও সোনি লিভ-এ। ২০১৯-এর জুনে প্রথম সিজন। একই সঙ্গে দুটি চ্যানেলে চালু প্রথম সিজন ছিল বাম্পার হিট। দর্শকরা বিপুল হারে সাড়া দেয়। বিশেষত, ক্রাইম আর সেক্স দর্শনে ক্লান্ত ওয়েব দর্শক কিছুটা ভিন্ন স্বাদ পাচ্ছেন এই সিরিজে। 
 
দ্বিতীয় সিজন দেখানো হয় সোনি লিভ-এ ২০২১-এর জানুয়ারি মাসে। এই সিজন সেই অনুপাতে কিছুটা কম সাড়া পায়। কারণ, সম্ভবত ক্রু মেম্বারদের পাল্টে যাওয়া। সবাই সব বিষয় হ্যান্ডেল করতে পারেন না। প্রথম সিজনে গল্প লেখেন নিখিল বিজয়, দ্বিতীয় সিজনে দুর্গেশ সিং। পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রথম সিজনে অমৃত রাজ গুপ্তা। পরেরটি পলাশ বাসোয়ানি। গত এপ্রিল থেকে সোনি লিভ-এ দেখানো শুরু হয়েছে তৃতীয় সিজন। এখনও পর্যন্ত দর্শক ভালোই সাড়া দিয়েছে। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন জামিল খান, গীতাঞ্জলি কুলকার্নি, বৈভব রাজ গুপ্তা, হর্ষ মেয়র। এঁরা প্রত্যেকেই হিন্দি বিনোদন জগতের চেনা মুখ। জমিয়ে দিচ্ছেন পর্বগুলি। তাঁদের অভিনয়ের রসায়ন এই সিরিজের সেরা প্রাপ্তি। প্রসঙ্গত, মোট ১৫টি পর্বে দেখবেন ‘গুল্লাক’।
 
 
 
 
 

যাপিত নাট্যের ষষ্ঠ কিস্তি লিখলেন - কুন্তল মুখোপাধ্যায়

কুন্তল মুখোপাধ্যায়
 
সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে বঙ্গ সাহিত্য সমিতি, আর ইংরেজি সাহিত্য সমিতি নামে দুটি সংগঠন ছিল, সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার জন্য। শুনেছি শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, অনিল চট্টোপাধ্যায় এবং এন. বিশ্বনাথন প্রমুখেরা এই সংগঠনগুলির সদস্য ছিলেন। পরে এন. বিশ্বনাথনের ইংরেজি ক্লাসও করেছি। স্বাভাবিকভাবেই আমি বঙ্গসাহিত্য সমিতির সঙ্গে যুক্ত হলাম। ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে বঙ্গ সাহিত্য সমিতির নেতৃত্বে তখন অঞ্জন ঘোষদা (পরে সেন্টার ফর সোস্যাল সায়েন্সের সমাজ তত্ত্বের অধ্যাপক, গবেষক) সঞ্জয়দা, তন্ময়দা, প্রত্যেক বুধবার ৮.৪৫ থেকে ৯.৩০টা অবধি সভা হত। সেখানে প্রবন্ধ পাঠ, সাহিত্য আলোচনা, গল্প-কবিতা পাঠ প্রভৃতি নিয়মিত অনুষ্ঠান হত। সদস্য হবার একমাসের মধ্যেই আমি “অবিন ঠাকুর ছবি লেখেন, কথা আঁকেন” এই শিরোনামে একটি স্বরচিত প্রবন্ধ পাঠ করি এবং তন্ময়দা আর অঞ্জনদার সুনজরে পড়ে যাই। ক্লাসে আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে উঠে অর্ণব, সুশোভন, সুমন, সঞ্জয়, ভাস্কর। তবে অর্ণবের সঙ্গে আমার আত্মীয়তা দাঁড়িয়ে যায়। আমরা নিজেদের মধ্যে কবিতার বই, প্রবন্ধের বই,গল্পের বইয়ের নানান আলাপ করতাম । এই সময়েই আমি “বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধমালা”, “ছন্দের বারান্দা”, “কবি ক্লাস”, “মধ্যবিত্ত মন ও মেট্রোপলিটন সমাজ”, এই সমস্ত বই পড়ে ফেলি। এরপর পুজোর আগেই বঙ্গসাহিত্য সমিতির বার্ষিক অনুষ্ঠানে রতন ঘোষের মহাকাব্য নাটকের মহড়া শুরু হয় অরুনদার ক্যান্টিনে। সেন্ট জেভিয়ার্স তিন মাস অন্তর এলিমিনেশন টেস্ট হয়, তাতে উত্তীর্ণ হতে না পারলেই অনার্স কাটা যাবে। প্রথম এলিমিনেশন টেস্ট দিয়েই আমি গেলাম অরুনদার ক্যান্টিনে অডিশন দিতে। সঞ্জয়দা একটা স্ক্রিপ্টের অংশ আমায় দিয়ে অভিনয় করতে বললেন। চরিত্রটির প্রথম সংলাপ ছিল, “যুদ্ধ নয় , শান্তি চাই, বিবাদ নয় শান্তি চাই”। এই সময়ই লোকনাট্য যাত্রাদলে মামাদের উৎপল দত্ত “সমুদ্র শাসন”এর মহড়া দেওয়াচ্ছেন। সমুদ্র গুপ্ত মঞ্চে ঢোকার সময়ে হাত দুটো জোড় করে নমস্কারের ভঙ্গিতে রেখে, যেভাবে মাথাটা একটু ঘাড়ের উপর ঠেকিয়ে ফেলে ডায়াসে উঠলেন, আমি ঠিক সেই রকম করে মঞ্চে ঢুকে প্রথম সংলাপটা বললাম। হটাৎ শুনলাম সঞ্জয়দার গলা ‘ঠিকআছে যায় বোস’। গিয়ে বসলাম সঞ্জয়দা, অঞ্জনদার চেয়ারের পাশে। তন্ময়দার পরেই আমি, তারপর নিলয়, হীরক গুপ্ত, মহড়া শেষের পরেই সঞ্জয়দা বললেন, চল তোকে জাতে তুলে আসি। তারপর সঞ্জয়দা, আমি, নিলয় তন্ময়দা, নিলয় মিলে পার্কস্ট্রিট মল্লিকবাজারে রহমনিয়ায় নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণ করি। সঞ্জয়দাকে মধ্যমনি করে এরপরেই তন্ময়দা, নিলয়, হীরক, আমি বঙ্গসাহিত্য সমিতির পঞ্চ পাণ্ডব হয়ে উঠি। সেন্ট জেভিয়ার্সে এরপরেই অঞ্জনদা ,সঞ্জয়দার নেতৃত্বে আমরা বেকেটের “ঈশ্বর বাবু আসবেন” ও ব্রেখটের “সম্রাট ও ভিখারি” নাটক দুটি মঞ্চস্থ করি। এই সময় দমদমে আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু তাপসীর দাদা জ্যোতিপ্রকাশদা’র সঙ্গে আমার হৃদ্যতা গড়ে ওঠে, এবং জ্যোতিদার সূত্রেই তার বন্ধু বিভাস চক্রবর্তী, অশোক মুখোপাধ্যায়ের কাছে মৌখিক নাট্য পাঠ শুরু করি। অশোকদাই আমাকে প্রথম এরিক বেন্টলির লেখার সঙ্গে পরিচিতি করান। কলেজে পড়ছি হ‍্যারেন্ড লাস্কি, অশোকদা পড়াচ্ছেন ম্যাকবেথ, জ্যোতিদা বুঝিয়ে পড়তে দিচ্ছেন লেনিনের রাষ্ট্র ও বিপ্লব । বিভাসদার অনুমতি নিয়ে দেবাশীষ দাশগুপ্তর ওয়ার্কশপ করেছি, আর রাজরক্ত, পাঁচু ও মাসী-৮ গাজীর বিচার, চাক ভাঙা মধু’ র অভিনয় দেখেছি। এদিকে লোকনাট্য যাত্রা দলে দেখছি উৎপল দত্তের মহড়া। নাট্যরসে এখন আমর ডুবুডুবু অবস্থা। এই সময়েই কলেজে ঘটে গিয়েছিল এক অপূর্ব নাট্যঅভিজ্ঞতা। ইংরেজির ক্লাসে পি.কে.ভি(প্রদীপ কুমার ভট্টাচার্য) ১৩ নং ঘরে একদিন ঢুকলেন হাতে দুটো লং প্লেয়ার রেকর্ড নিয়ে। আর একজন বেয়ারা নিয়ে এসেছে একটি রেকর্ড প্লেয়ার। ‘জুলিয়াস সীজার’-নাটক পড়ানোর আগে আমাদের হাতে তুলে দেওয়া হল সিন-ওয়াইজসিগেজসিস্। আর তারপর চালানো হল রেকর্ড। মুগ্ধ হয়ে শুনলাম লরেন্স অলিভিয়ার কণ্ঠে জুলিয়াস সীজারের অভিনয় টানা দুঘণ্টা। তারপরের দিন স্যার শুরু করলেন নাটকটি পড়ানো। পড়ায় ইতিমধ্যে আমি বড়দের সঙ্গে ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘সাংবাদিক’; কিরণ মৈত্রের ‘বারো ঘন্টা’ নাটকের অভিনয় করেছি। পড়ার বন্ধু সোমনাথ, জগৎ এদের নিয়ে সেই সময়ই রবীন্দ্রনাথের রাজর্ষি আর কর্তার ভূতের নাট্যরূপ দিয়ে ‘কিমভূতপুরাণ’ নামে দুটি নাটকের নাট্যরূপও পরিচালনা করে অভিনয় করি। এই সময় আমার স্কটিশ চার্চ কলেজের কিছু বন্ধু মারফৎ আলাপ হয় কেয়া চক্রবর্তীর সঙ্গে। 

এই বিয়ের মরশুমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ের গল্প শোনালেন - আবীর কর

আবীর কর
 
বিয়ের মরশুম শুরু হয়ে গিয়েছে। বিয়ের বাজি ও বাজনায় চারদিক মুখরিত। প্রত্যেকেই তার নিজের নিজের বিয়েকে স্বাতন্ত্র্যের একেবারে শিখরচুড়ায় রাখতে অতীব ব্যস্ত। বিয়ের নিমন্ত্রণ-পত্র, মেনুকার্ড, আলো, বাজনা, সাজপোশাক, এমনকি ফুলশয্যার সাজসজ্জাতেও বীভৎস নতুনত্বের ছোঁয়া। ইদানীং তার সঙ্গে জুড়ে গেছে প্রিওয়েডিং- ওয়েডিং- পোস্ট ওয়েডিং ফটোশুট্যের হরেকরম্বা আয়োজন এবং সময় সুযোগ মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় সেইসব সিন-সিনারির প্রদর্শন। 
আজকের এই আগাগোড়া আমুদে বিয়েবাড়ির জগঝম্প থেকে প্রায় একশো চল্লিশ বছর আগের এক বিয়েবাড়ির নথিপত্রে চোখ রাখলে দেখা যাবে, সেই বিয়েও ছিল সেদিনের বিচারে স্বাতন্ত্র্যসূচক, এক ব্যতিক্রমী বিয়েবাড়ি। সেদিনের সেই হাই-প্রোফাইল বিয়ের আমন্ত্রণ-পত্র, বরানুগমন, বিয়ের সাজ, বাসর সব আজকের আয়োজনের নিরীখে ভীষণ সাদামাঠা হলেও এক অনন্য স্বাতন্ত্র্যে ছিল উজ্জ্বল। চলুন, বহুচর্চিত সেই ব্যতিক্রমী বিয়েবাড়ির অন্দরে আর একবার ঢুকে ‘পড়া’ যাক… 
 
পরিচয়:-
 
পাত্র                                                                      শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পিতা- শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
মাতা-  ঁশ্রীমতী সারদা দেবী
ঠিকানাঃ- জোড়াসাঁকো, কলিকাতা।
 
 পাত্রী
ভবতারিণী রায়চৌধুরী     
পিতা- শ্রীযুক্ত বেণীমাধব রায়চৌধুরী
 মাতা- শ্রীমতী দাক্ষায়ণী রায়চৌধুরী
 ঠিকানা- ফুলতলা,দক্ষিণডিহি, খুলনা, পূর্ববঙ্গ।
 
 শুভবিবাহ :- ২৪ শে অগ্ৰহায়ণ, ১২৯০(ইংরেজি- ৯ডিসেম্বর, ১৮৮৩)রবিবার।
  বিবাহ বাসর :-ব্রহ্মোৎসব দালান বাড়ি, ৬নং জোড়াসাঁকো, কলিকাতা।
 
তখন রবীন্দ্রনাথ বাইশ বছরের খ্যাতনামা তরুণ। বিবাহযোগ্য।খোঁজ চলছে পাত্রীর। সেই সময় ঠাকুরবাড়ির অধিকাংশ গৃহিণীরা আসছেন পূর্ববঙ্গের যশোর থেকে। তাই প্রাথমিক ভাবে সেখানেই খোঁজ চলল। কিন্তু বহু অনুসন্ধানেও খুব একটা সুন্দরী পাত্রী মিলল না। ইন্দিরা দেবীর ভাষায়’…বোধহয় তখন যশোরে সুন্দরী মেয়ের আকাল পড়েছিল, কারন এত খোঁজ করেও বউঠাকুরানীরা মনের মতো কনে খুঁজে পেলেন না।’ তারপর অনেক খুঁজে-পেতে সন্ধান মিলল এক পাত্রীর। পাত্রীর বাবা আবার জোড়াসাঁকোর কাছারি বাড়িরই কর্মচারী। বাড়ি খুলনা জেলার দক্ষিণডিহির ফুলতলা গ্রামে। পাত্রীর নাম ভবতারিণী, ডাকনাম ফুলি, বয়স এগারো। ভবতারিণী নামটি সেকেলে, ঠাকুরবাড়ির পছন্দ হয়নি। বিয়ের পর নাম পাল্টে নতুন নামকরণ হয় মৃণালিনী। মৃণালিনী নামকরণ কে করেন, কী ভেবে করেন সে নিয়ে নানান মতভেদ আছে। তবে চিঠিপত্রে প্রমাণ রবীন্দ্রনাথ ডাকতেন ‘ছোট বউ’, ব্যক্তিগত চিঠিপত্রে লিখতেন ‘ভাই ছোট বউ’, ‘ভাই ছোট গিন্নী’, লিখতেন ‘ভাই ছুটি’… 
 
পাকা দেখা / আশীর্বাদ
রবীন্দ্রনাথের বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন তাঁর মামা ব্রজেন্দ্রনাথ রায়ের পিসিমা আদ্যাসুন্দরী দেবী, অর্থাৎ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দিদিমা। পাত্রী সুন্দরী তো নয়ই, তারপর আবার ভীষণ রোগা-দুবলা। কুটুম হিসেবে বেণীমাধব রায়চৌধুরীর পরিবার ঠাকুরবাড়ির তুলনায় কিছুই না। তা সত্ত্বেও উভয় পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে বিয়ের কথা চূড়ান্ত হলে, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তার কর্মচারী সদানন্দ মজুমদার মারফৎ কন্যার জন্য শাড়ি গয়না ও খেলনা ‘উপহার’ স্বরূপ পাঠালেন। এবং আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি মিষ্টিমুখের বন্দোবস্ত করলেন।
 
আমন্ত্রণ পত্র
ঠাকুরবাড়ির স্মৃতিচারণমূলক লেখা থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথের বিয়েতে ঘনঘটা কিছুই ছিল না। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির বিয়ের জাঁকজমকের কাছে সে বিয়ে অত্যন্ত সাদামাঠা। কিন্তু পাত্রের নাম যেখানে রবীন্দ্রনাথ, সেখানে তাঁর অভিনবত্বই তো সেরা সৌন্দর্য। নিজের সময়ের থেকে অনেক অনেক এগিয়ে থাকা রবীন্দ্রনাথ, নিজেই নিজের বিয়ের আমন্ত্রণপত্র লিখেছিলেন। অসাধারণ অভিনব সেই চিঠিতে স্বয়ং পাত্র লিখছেন — 
” প্রিয় বাবু
        আগামী রবিবার ২৪শে অগ্রহায়ণ তারিখে শুভদিনে শুভলগ্নে আমার পরমাত্মীয় শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভবিবাহ হইবেক। আপনি তদুপলক্ষে বৈকালে উক্ত দিবসে ৬নং যোড়াসাঁকোস্থ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভবনে উপস্থিত থাকিয়া বিবাহাদি সন্দর্শন করিয়া আমাকে এবং আত্মীয়বর্গ কে বাধিত করিবেন।” প্রিয়নাথ সেন-সহ অন্যান্য বন্ধুদের আমন্ত্রণ পত্রের শিরোদেশে লেখা ‘আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু তব হায়’। কবির প্রিয় কবি মাইকেল মধুসূদনের ‘আত্মবিলাপ’ এর এই আরম্ভ পংক্তিকে কবি তার বিবাহিত জীবনের শুভারম্ভে কি স্মরণ করলেন নিছকই বন্ধুত্বপূর্ণ রসিকতার? বা সেই চিঠির মাথায় আড়াআড়িভাবে লিখলেন, ‘আমার motto নহে’, -এর আভ্যন্তরীণ বক্তব্য দ্বিমাত্রিক, এক তাঁর ভাবী স্ত্রী তার ‘মতো’ নন, আবার ইংরেজিতে ‘motto’ অর্থে লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। বন্ধুদের উদ্দেশ্যে লেখা এহেন এক লাইনের উদ্দেশ্যও কি শুধুই সুরসিকতা? 
 
 
শুভবিবাহ
রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয় শীতকালে। ২৪শে অঘ্রান, ইংরেজি ৯ ডিসেম্বর। বিয়ের ক্ষেত্রেও ছিল অভিনবত্ব। বিয়ে হয়েছিল ছেলের বাড়িতে, বিয়ের রীতি মেনে বর-রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করতে যাননি।  শ্রীযুক্ত বেনীমাধব রায়চৌধুরী মহাশয় তাঁর একাদশ বর্ষীয়া কন্যা ভবতারিণী-সহ আত্মীয়-স্বজনদের কলিকাতায় নিয়ে এসেছিলেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ বিয়ের কথাবার্তা চলাকালীনই সেকথা জানিয়েছিলেন, তাঁর বক্তব্য ছিল– “কলিকাতায় আদি ব্রাহ্মসমাজের নিয়মানুসারে ব্রাহ্মমতে বিবাহ হইবে।” তাঁর প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন জোড়াসাঁকোর কাছারিবাড়ির কর্মচারী বেণীমাধব, মহর্ষির ভাবী বেয়াই। সেই কথামতো জোড়াসাঁকোর বাড়ির ব্রহ্মোৎসব দালানে, ঠাকুরবাড়ির আচার-আচরণ মেনেই কবির বিয়ে হয়। হেমলতা ঠাকুরের বক্তব্য অনুযায়ী, সাধারণ ঘরোয়াভাবেই রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয়েছিল, কোনরকম ধুমধামের বালাই ছিল না, মা নেই ‘আড়ম্বরে উদাসীন’ দেবেন্দ্রনাথ তখন হিমালয়ে। ‘বিয়েতে ঘটা করে কে।’ পারিবারিক পরম্পরায় বিয়ের একখানি বেনারসি শাল ছিল, তা গায়ে জড়িয়ে নিজের বাড়িতেই পশ্চিমের বারান্দা ঘুরে রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করতে এলেন নিজের বাড়িরই অন্দরমহলে। যেখানে স্ত্রী-আচারের সরঞ্জাম সাজানো, সেখানে বরবেশী রবীন্দ্রনাথ এসে দাঁড়ালেন বিয়ের পিঁড়িতে। মেয়ের বাড়ির এক আত্মীয়া বরণ করলেন রবীন্দ্রনাথকে। এরপর কনেকে এনে সাতপাক ঘোরানো হল। তারপর বর-কনেকে নিয়ে আসা হল ব্রহ্মোৎসব-দালানের সম্প্রদান স্থলে। এবং সেখানেই সুসম্পন্ন হল রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনীর বিবাহোৎসব।
 
 
 
বাসর
বিয়ের পর বর-কনেকে নিয়ে আসা হল বাসর ঘরে। যে ঘর আগে থেকেই নতুন বৌয়ের জন্য গোছানো ছিল। সেখানেই বসল বাসর। বাসরে বসেই রবীন্দ্রনাথ ‘দুষ্টুমি’ আরম্ভ করলেন। বাসরের একটি স্ত্রী-আচার ‘ভাঁড়-খেলা’ অর্থাৎ বর-কনে উভয়েই চাল ভর্তি ভাঁড় একবার ঢালবে, আর একবার ভরবে, — এই হল খেলার নিয়ম। তা সেই খেলায় রবীন্দ্রনাথ ‘দুষ্টুমি’ করে সব ভাঁড় ধরে ধরে উপুড় করে দিতে লাগলেন। স্ত্রী-আচারের ব্যত্যয় দেখে রবীন্দ্রনাথের ছোট কাকিমা বলে উঠলেন “ও কি করিস রবি? এই বুঝি তোর ভাঁড়-খেলা? ভাঁড়গুলো সব উল্টে পাল্টে দিচ্ছিস কেন?”
সংকোচহীন রবীন্দ্রনাথের দ্ব্যর্থ উত্তর, “জানো না কাকিমা – সব যে উলট পালট হয়ে যাচ্ছে– কাজেই আমি ভাঁড়গুলো উলটে দিচ্ছি। “
ছোট কাকিমা ত্রিপুরাসুন্দরী বুঝলেন, রবির সঙ্গে তিনি কথায় পেরে উঠবেন না, তাই কথা ঘোরালেন, বললেন-  “তুই একটা গান কর। তোর বাসরে আর কে গাইবে, তুই এমন গাইয়ে থাকতে? “
রবীন্দ্রনাথ গান জুড়লেন–
“আ মরি লাবণ্যময়ী/ কে ও স্থির সৌদামিনী, /পূর্ণিমা-জোছনা দিয়ে/ মার্জিত বদনখানি। নেহারিয়া রূপ হায়/ আঁখি না ফিরিতে চায়… 
গান গাইতে গাইতে বৌয়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দুষ্টুমিও চলছে।অন্যদিকে ওড়নায় মুখ ঢেকে, লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে, মাথা নিচু করে বসে আছেন নববধূ মৃণালিনী।
রবীন্দ্রনাথ গানের পর গান ধরলেন। কবির নিজের বাসর সুরে সুরে ভরে উঠলো, কবিরই গানে।
 
 

পুরনো পৌষমেলা- খগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ( অনুবাদ দেবাঙ্গন বসু)

দেবাঙ্গন বসু
 
১৯৪১ সালে শান্তিনিকেতন পৌষমেলার অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে যে সমীক্ষা করা হয়েছে তা রীতিমতো আগ্রহব্যঞ্জক। সাধারণ দোকান এবং নানা জিনিস বিক্রির জন্য যেসব ফেরিওয়ালা এসেছিল সব মিলিয়ে তার সংখ্যা ১৯৪। বিক্রিবাটা সর্বমোট আনুমানিক ১২,৫০০/- টাকার হয়েছে।
   মিঠাই জাতীয় খাবার সর্বোচ্চ বিক্রি হয়েছে যার আর্থিক পরিমাণ ৩,৩০০/- টাকা। সামগ্রিক বিক্রয়ের ২৫% এই খাতেই আয় হয়েছে। ১০টি চায়ের দোকানেও বেশ ভালোই ব্যবসা করেছে এবং সর্বমোট ১০৫০/- টাকার বিক্রি করে দ্বিতীয় স্থানে আছে। পান-সিগারেট বিক্রিতে ৯৬০/- লাভ হয়েছে। সাঁওতাল এবং সাধারণ শ্রেণীর ক্রেতাদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় হল তেলেভাজা নামক জিনিসটি— এটি বেশ ভালোই বিক্রি হয়েছে, প্রায় ৪০০/- টাকার। তিরিশজন ফেরিওয়ালা প্রত্যেকে ডালমুট বিক্রি করেছে ৫/- টাকা লাভ রেখে,   সবমিলিয়ে ১৫০/- রোজগার হয়েছে। 
   উপরের সবকটি সংখ্যা যোগ করলে মোট ৫৮৬০/ টাকা দাঁড়ায় এবং এটি হল মেলার দর্শনার্থীরা মিলে, যাকে বলা যায় খাদ্যদ্রব্য তার জন্য ব্যয় করেছেন। সুতরাং, সামগ্রিক বিক্রেয় দ্রব্যের মধ্যে সর্বাধিক বেশি লাভ হয়েছে খাদ্যবস্তুর মাধ্যমেই, মোট অঙ্কের ৪৮%। সত্যি বলতে কী এটাই স্বাভাবিক, কারণ অনেকের কাছেই – বিশেষত দরিদ্র শ্রেণির মানুষের কাছে গতানুগতিক দিনযাপনের মাঝে এই মেলাই হল একমাত্র ভিন্ন স্বাদের একটু সুযোগ। আর সেক্ষেএে, নিজেদের সামান্য কিছু সঞ্চয়কে খরচ করার প্রথাগত পদ্ধতি হল একটু মিষ্টিমুখ করা। শিশু এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের মহিলাদের প্রসঙ্গেও একই কথা প্রযোজ্য।
সুতরাং ময়রা জাতীয় দোকনীরাই সবথেকে ব্যস্ততায় ছিল, এবং অনেক সময়েই দেখা গেছে নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে ক্রেতার দল চাক বেঁধে মিঠাইয়ের দোকান ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

           

খাবার দোকানের পরেই ছিল, জনপ্রিয়তার নিরিখে দ্বিতীয় স্থানে, তিরিশটি দোকানের সারি- যেখানে বেলোয়ারি গয়নাগাটি বিক্রি হচ্ছিল এবং এখানে প্রায় ১০০০/- টাকার কেনাবেচা হয়েছে। এখানে উঁচু নিচু সব শ্রেণীর মহিলা ক্রেতাই এসে ভিড় করেছিলেন। এইসব দোকানে সোনার মতোই দেখতে নকল গয়না পাওয়া যাচ্ছিল, কিছু কিছু গয়নার ডিজাইন তো আসল সোনার গয়নাকেও হার মানাবার মতো! অনেকেই হয়ত জানেন না এই রাং-এর গয়নার বেশিরভাগটাই আশে প্রতিবেশী অঞ্চল– বর্ধমান জেলার বনপাস থেকে। তবে কিনা বনপাসে তৈরি গয়নার ডিজাইন বেশ জবড়জং। এছাড়া সূক্ষ্ম ডিজাইনের যেসব গয়না আসে, যার নাম ফিরোজাবাদী, সেগুলি পশ্চিমভারত থেকে আমদানী করা। দোকানগুলিতে আরো নানা জিনিস পাওয়া যায়, যেমন কাঁচের চুড়ি, সস্তা মাথার তেল, লিপস্টিক, আলতা এবং সস্তা মনিহারী দ্রব্য।
মুর্শিদাবাদ থেকে নিয়ে আশা শাঁখাও এই মেলার অন্যতম দ্রষ্টব্য বস্তু ছিল। একথা জেনে আমরা বেশ বিস্মিতই হই যে রেশমের জন্য বিখ্যাত মুর্শিদাবাদ, শাঁখার জন্যও বিখ্যাত ছিল। যদিও ঢাকার শাঁখার সঙ্গে তুলনা করলে নক্সার দিক থেকে মুর্শিদাবাদের শাঁখা অনেক মোটাদাগের আর গুণমানেও কম। এই জিনিসটি বেশিরভাগ খরিদ করেছে সাঁওতালরা, মধবিত্ত্য শ্রেণীও মাঝে মধ্যে কিনেছে, সবমিলিয়ে ২৫০/- টাকার কেনাবেচা।
জামাকাপড়ের দোকান ছিল ২৮টি, ফ্রক, পুলোভার, রঙিন শাড়ির সাজে এই দোকানগুলি মেলাকে রঙিন করে তুলেছিল। এখানে সবমিলিয়ে ৯০০/- টাকার বিক্রি হয়েছে। চারটি  মনোহারী দ্রব্যের দোকান বসে, খেলনা, বাঁশি, চিরুনী, মাথার তেল ইত্যাদি নিয়ে সেখানেও বেচাকেনা মন্দ হয় নি, প্রায় ৫০০/- টাকার। সাঁওতালদের ছিল ১৫টি নিজস্ব ছোটো ছোটো দোকান। সেখানে বীজ, পুতির মালা, ছোটো আয়না বিক্রি হয়েছে। শিল্প দ্রব্যের মধ্যে ছবি, ফটোগ্রাফ এবং ফটোগ্রাফের সরঞ্জাম বিক্রি হয়েছে প্রায় ৩০০/- টাকার। মানভূম জেলার চক্রধরপুরের মাটির বাসন বেশ ভালোমত বিক্রি হয়েছে। গালার জিনিস ইলামবাজার থেকে আসে— খুব ভালো বিক্রি হয়নি। গরম কোট, সুন্দর দেখতে সেকেন্ড হ্যান্ড, এক্কেবারে গরম কচুরীর মতোই বিক্রি হয়েছে। ম্যাজিক শো আর নাগরদোলার তো কাজে বিরাম ছিল না— শেখানে ২o০/- টাকার রোজগার হয়েছে। একটি সার্কাস কোম্পানি টিকিট বিক্রি করে ৩০০/- টাকা লভে করেছে।
মেলার উত্তরপশ্চিম দিকে হট্টগোল ছাড়াই বসেছিল কাঠের আসবাবপত্রের দোকনে। সেখানে দরজা, খাট, টুল এইসব পাওয়া যাচ্ছিল— পালিশ না করা কাঠের সাদামাটা আটপৌরে জিনিস। এই আসবাব পত্রগুলি দেখলই বোঝা যাচ্ছিল যে এগুলি শুধুমাত্র ব্যবহারিক প্রয়োজনের তাগিদেই কেনার মতো। প্রথমদর্শনে একটু অবাক লাগার কথা এই ভেবে যে, এখানে উৎসবের সূত্রে আয়োজিত মেলায় এসব জিনিস কি আর বাজার ধরতে পরবে! অথচ অত্যন্ত আশ্চর্যর বিষয়, এইসব সামগ্রীর অস্বাভাবিক চাহিদা লক্ষ করা গেল এবং বিক্রি হল ২৩৭৫/- টাকার! সম্ভবত আশেপাশে যে সব অস্থায়ী চালাঘর ধরনের বাড়ি তৈরি হয়েছে আগত উদ্বাস্তু পরিবারের জন্য— সেই কারণেই এইসব আসবাবের এতটা চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। [অল্প কিছুদিন আগে এক প্রলয়ঙ্কর ঝড় হয় এই অঞ্চলে, সেই সূত্রে এই কথা বলা হয়েছে।
 
তথ্যসংগ্রহ করতে যাওয়ার যে অভিজ্ঞতা, সেটাও বেশ আগ্রহব্যঞ্জক। আমাদের প্রশ্নগুলি শুনে বেশিরভাগ দোকানদারই বেশ সন্দেহ ও অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ব্যাপারটাকে দেখেছে। তাদের এই মনোভাবের কারণ হল, হয়তো বাড়তি কর তাদের ওপর চাপানো হবে। দোকানী যদি মহিলা হন, তাহলে তাঁর কাছ থেকে তো তথ্য আদায় করা প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে। কিছু কিছু দোকানদার আবার আমাদের সব প্রশ্ন-টশ্ন নস্যাৎ করে দিয়ে, কোথা থেকে তারা আসছে এবং সেখানে তাদের বিষয়ে লোকে কত সুখ্যাতি করে—এইসব গল্প বিশদভাবে বলতে শুরু করে দিয়েছিল।
আমাদের প্রস্তাব হল দোকনদারদের বোঝাতে হবে, যে এইসব তথ্যগুলি দেওয়া জরুরি এবং দোকান ভাড়া দেওয়ার পূর্ব শর্ত হিসাবে এই প্রস্তাব তাদের শুনিয়ে রাখতে হবে।
ক্রেতাদেরকেও একটু সচেতন করে তোলা প্রয়োজন, যাতে তাঁরা তাঁদের অর্থের সদ্ব্যবহার করতে শেখেন। যতই যাই হোক, একথা স্বীকার করতেই হবে যে মিষ্টির দোকানের সংখ্যাটা মাত্রাতিরিক্ত হয়েছে। আর এর পিছনে এত টাকা খরচ করাটা তো খুবকিছু ফলপ্রসূ বিষয়ও নয়, যে ধরণের জিনিসপত্রের একটা শিক্ষামূলক দিক আছে অথবা জাতীয় স্বার্থের পক্ষে যা অনুকূল এমন জিনিস কেনাবেচায় উৎসাহ দেওয়া দরকার। সংক্ষেপে বলা যায় যে, সময় এসছে, যখন আমরা ভেবে দেখতে পারি– কীভাবে এই মেলার মধ্যে একটা নতুন, ভবধারার প্রচলন ঘটিয়ে একে এই জাতীয় মেলার মধ্যে আদর্শস্বরূপ করে তোলা যায়।
Sidelight On Pous Mela – খগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। বিশ্বভারতী নিউজ, ডিসেম্বর ১৯৪২ থেকে অনূদিত।
 

কলকাতার দুরন্ত এক নতুন "হাওয়া" র ছায়া-ছবি আঁকলেন - রিন্টু মান্না

 রিন্টু মান্না

সম্প্রতি কলকাতার বাতাসে বয়ে গেল পূর্ববঙ্গের চঞ্চল হাওয়া।হাওয়াটি চঞ্চলই বটে কেননা, এ হাওয়া তরুণ, যুব এবং বৃদ্ধ সকল প্রজন্মকেই উত্তেজনা, উন্মাদনায় স্থির হতে দেয়নি। বর্তমান সময় ‘বাংলা’ ছবি দেখার জন্য সিনেমা হলের বাইরে দর্শকের ঢল নামবে, এ ছিল কল্পনার অতীত কিন্তু সেই কল্পনাকেই বাস্তবায়িত করে দিল ‘হাওয়া’। নন্দন চত্তরে সকাল ১০টা-র শো এর ভিড় জমে ভোর ৬টা থেকে আবার সন্ধ্যে ৬টা-র শো দেখার জন্য দর্শক লাইনে দাঁড়িয়েছে দুপুর ১টা থেকে।

মেজবাউর রহমান সুমনের ‘হাওয়া’ প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি। প্রচলিত চাঁদ সওদাগর ও মনসার কাহিনিকে অবলম্বন করতে চেয়েও নির্মাতা নান্দনিকতার পরিচয় রেখেছেন। প্রথম ছবিতেই দর্শককে অনেক কিছু দিলেন, দিলেন কেচ্ছা, রহস্য, প্রেম, আনন্দ, ভয়, নিঃসংশ্রতা ও পরিণতি। ছবির পোস্টার, ট্রেলারই টানটান থ্রিলারের জন্ম আগেই দিয়েছিল, এরপর ছবিতে দেখা গেল ক্যামেরার দূর্দান্ত চলাচল। ছবির গান ‘সাদা সাদা কালা কালা’ এর জনপ্রিয়তাও দেশের গণ্ডি পেরিয়ে গত কয়েক মাসেই আপামর বাঙালির মুখে মুখে ছুটছে।

‘হাওয়া’ শুরু হয় অসম্ভব ঝাঁকুনি দিয়ে। প্রথমেই পরপর কয়েকটি শটে ক্যামেরা দ্রুত গতিতে চলতে থাকে। একাধিক মানুষের অস্বাভাবিক ক্লোজআপের ছেঁড়া-ছেঁড়া ইমেজ, মাছ কেনাবেচার দৃশ্য, কখনও ক্যামেরায় নীল সাগর, বিশাল আকাশে কখন ও বা পাখির উড়ে যাওয়া এবং ব্যস্ত জনতার কোলাহল– প্রথম তিন-চার মিনিট যখন ভেবে কূল পাওয়া যাবে না কী হচ্ছে ততক্ষণে নৌকা ছেড়ে দিয়েছে চান মাঝি আর তার দলবল উর্কেস, পার্কেস, নাগু, মোরা, ফনি, এজা এবং ইব্রাহীমদের নিয়ে মাঝদরিয়ার উদ্দেশ্যে। নৌকায় সকলকেই চলতে হত চান মাঝির কথা মতন। কেবলমাত্র বেঁকে বসে টাকার সমান ভাগ চেয়ে ইঞ্জিনঘরের দায়িত্ব প্রাপ্ত ইব্রাহীম ওরফে ইবা। তবে চানের কূটনৈতিকতার কাছে ইবাকে খানিকটা দমে থাকতেই হয়েছে। আসলেই মাঝিমল্লারদের জীবন-যাত্রার বাস্তব দিকটি ধরা পড়েছে পর্দায়।

ছবির সৌজন্য: গুগল

গল্পের মোড় ঘোরে এক রাতে জালে এক সুন্দরী যুবতীর ধরা পড়ার পর। সেই মেয়ে কোনো কথা বলে না এমনকি কোনো প্রশ্নের জবাবও দেয় না। নৌকা বোঝাই পুরুষ মাঝি-মল্লারদের মাঝে হঠাৎ এক জলজ্যান্ত নারীর উপস্থিতি যেমন এক নতুন উপদ্রব ঠিক তেমনভাবেই নাম- পরিচয়হীন এই সুন্দরীর আকস্মিক আগমন অনেক বেশি রহস্যের। ঠিক এখান থেকেই দানা বাঁধে ছবির মূল রহস্য, যা ছবি এগানোর সমান্তরালে খানিক অলৌকিকতার দিকে যাত্রা করে। তার সঙ্গে তৈরি হয় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের অতীত এক জগৎ।

ছবির সৌজন্য: গুগল ছবির প্রথম পর্যায়ে রহস্য কম, যৌন উৎকন্ঠা বেশি। স্বাভাবিকভাবেই নৌকা ভর্তি পুরুষের মাঝে এক যুবতীর আবির্ভাব। প্রায় সকলেই চায় তার শরীর। পুরুষের দৃষ্টিতে সে কেবল সম্ভোগের বস্তুমাত্র। তথাকথিত পৌরুষ পরিসরে এক নারীর উদ্বেগ ও অস্বস্তি বিভিন্ন ভাবে ফুটে উঠেছে ‘হাওয়া’য়। যুবতীর মুখে কথা না থাকায় সে তার শারীরিক অঙ্গভঙ্গি দ্বারাই লোলুপ পুরুষদের প্রতি প্রতিবাদ হেনেছে। ভাষ্যহীন কঠিন জবাব দিয়েছে প্রত্যেককেই। এ পর্যন্ত ‘হাওয়া’ পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক চমৎকার রাজনৈতিক সমালোচনার ভাষ্য তৈরি করে। ক্যামেরার বিবিধ অ্যাঙ্গেল দ্বারা পুরুষের বাসনা-লালিত উগ্র দৃষ্টির প্রতি দর্শককে সচেতন করেছে। তবে ইবা-র চোখে-মুখে ছিল না কোনো লোলুপতা, কোনো পৌরষিক লালসা। দ্বিতীয় পর্যায় ইবা-র সঙ্গে প্রথম কথা বলতে দেখা যায় যুবতীকে। এখান থেকেই রহস্যের শুরু। জানা যায় যুবতীর নাম গুলতি। সে এক বেদিনী। বাবার খুনের প্রতিশোধ নিতেই সে দেবীর আদেশে নৌকায় এসেছে। তারপর থেকেই নৌকায় একের পর এক অনিষ্ট— জালে মাছ না পড়া, ইঞ্জিন খারাপ হওয়া, তেলের ট্রাঙ্ক ফুটো হয়ে যাওয়া অদ্ভুত সব কাণ্ড। ক্রমাগত অস্বাভাবিক ঘটনার মধ্যে দিয়েই ছবিটি রহস্যের টানটান উত্তেজনা রেখে দ্রুত এগিয়ে চলে। ঘটতে থাকে একের পর এক খুন। শেষে খুন বোঝাই নৌকায় একাকিত্ব ক্ষুধার্ত চান যখন তার পোষ্য শালিককে পুড়িয়ে খায় এবং অদ্ভুদভাবে কদাকার দাঁত বার করে নাগুর উদ্দেশ্যে বলে— “ভয় পাসসিস ?” এ দৃশ্য মুহুর্তে কুৎসিত শিহরণ জাগিয়ে তোলে।

ছবি সৌজন্য: গুগল চঞ্চল চৌধুরী চানের মতন খল ভূমিকায় অতুলনীয়। তাকে দেখে মনে হবার জো নেই যে তিনি একজন অভিনেতা, যিনি চানের চরিত্রটিতে অভিনয় করছেন; বরং মনে হবে নিকৃষ্ট ভয়ঙ্কর চান মাঝিই সে। নিজেকে তিনি যেভাবে চরিত্রটির জন্য ভেঙেছেন গড়েছেন তাতে করে সব প্রশংসাই তুচ্ছ। এছাড়া ইবা-র ভূমিকায় সরিফুল রাজ এবং পরাবাস্তবতায় মোড়া, গুলতির চরিত্রে নাজিফা তুশি নজর কেড়েছে। নাসিরুদ্দিন খানের নাগু চরিত্র এক কথায় ফাটাফাটি। আসলে ছবির প্রত্যেক

অভিনেতাই তাঁদের স্ব-চরিত্রে অনবদ্য। কোনো একজনকে বাদ দিলে হাওয়া এইভাবে সফলতার চূড়ায় হয়ত বইতে পারত না। তবে আবারও বলতে হয় ‘হাওয়া’ ক্যামেরার কাজে কথা বলেছে, বলা চলে কামারুল হাসান খসরুর ক্যামেরার চলন বাজিমাত করেছে। প্রথমবারে নোঙর ফেলার দৃশ্যে নোঙরকে অনুসরণ করে ক্যামেরার প্রবলবেগে জলে অবতরণ, বাঁচার তাগিদে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া পার্কেস যখন মরীচিকা ধরতে মাঝসমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন ক্যামেরায় ঢেউ এর ওঠা-নামা, অস্তগামী সূর্যের করুণ প্রতিফলন আর নিচে অতল জল। এছাড়া রাতের বেলা নেওয়া শটগুলি যেখানে ইবা আর গুলতি সমুদ্রে নেমে দেখা করত সেই দৃশ্য সহ গুলতির মাঝ রাতে চাঁদের আলোয় হাওয়ায় কাপড় মেলার দৃশ্যগুলিও অভূতপুর্ব। এমনকি সব শেষে ইবার মৃত দেহকে জড়িয়ে থাকা গুলতিরূপী সাপকে যেভাবে পর্দায় প্রকাশ করা হয়েছে তা একপ্রকার চমকে দেয়। ছবির উপান্তে ড্রোন শটে নৌকা উপর দিয়ে ফ্রেমের বাইরে চলে গেলে আবার যখন ক্যামেরা উপরে ওঠে তখন নৌকা নিশ্চিহ্ন। কেবল অনন্ত দরিয়া। ‘হাওয়া’ নিমার্ণে কিছু ভুল ত্রুটি থাকলেও অভিনয় ও সিনেমাটোগ্রাফির সুচারুতায় সেসবকে মাথাচাড়া দিতে দেয়নি। এত চোখধাঁধানো চিত্রগ্রহণের কাজ শেষ কবে বাংলা ছবিতে হয়েছে তা বলা দূরহ। এছাড়া সিনেমা হল থেকে বের হওয়ার পরে চিত্রায়নের মূর্চ্ছনা লেগে থাকে চোখে। দু-ঘন্টা দশ মিনিট কোনোভাবেই চোখ ফেরানোর যেমন জায়গা রাখেনি তেমন ভাবেই দমকা হাওয়ায় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের, লৌকিকতা-অলৌকিকতার উর্দ্ধে এক অনুভূতির দোলায় দুলিয়ে দিয়েছে ‘হাওয়া’। সর্বোপরি বঙ্গোপসাগরের বুকে তৈরি হওয়া ‘হাওয়া’ দুই বঙ্গকে যে উষ্ণতায়, যে শীতলতায় মাতিয়েছে তা প্রশংসার দাবি রাখে বইকি। ‘হাওয়া’র মুগদ্ধতা অনুভবে, এ হাওয়া একবার হলেও প্রত্যেককে গায়ে মাখতেই হবে।

‘ঝিল্লি’ সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন - পার্থ হালদার

ঝিল্লি : রিভিউ নয় অভিজ্ঞতার জন্য কলম ধরা
 
“…
মেথর: মাপ করবেন বাবু।
বেণি: ঠিক আছে, ঠিক আছে।
মেথর: কলকাতার গরীবদের বিষ্ঠা বাবুর গায়ে দিলাম।
বেণি: দেখুন ওটা পড়তে পারছেন?
মেথর: পড়তে জানি না।
বেণি: ভাবছিলাম কেমন লেখা হয়েছে, সেটা –। আপনি থিয়েটার দেখেন? 
মেথর: না।
বেণি: কেন?
মেথর: বুঝি না।
বেণি: দেখতে না গেলে কি করে জানেনে বোঝেন না?
মেথর: আমি কলকাতার তলায় থাকি।
(ম্যানহোলের ভিতর আংগুলি নির্দেশ করে)”
[নাটক টিনের তলোয়ার: নাট্যকার উৎপল দত্ত]

ঈশান ঘোষের প্রথম সিনেমা, ঝিল্লি এই তথাকথিত যারা কলকাতার তলায় থাকে অর্থাৎ কলকাতার প্রান্তিক বা অপাঙক্তেয় শ্রেণীদের একটি ক্লেদাক্ত, রগরগে গল্প নিয়েই তৈরি হয়েছে। 
গল্পের মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে কলকাতার ধাপা। যার চারিপাশ দিয়ে যখন সাধারণ মানুষ পারফিউমে আবৃত হয়ে নিজেদের গন্তব্যে যায়, তখন নাকে রুমাল দিয়ে এবং একটা বাঁকা বক্তব্য না করে আজ অব্দি কেউ যায় না। যেতে পারে না। কারণ বহু প্রজন্ম ধরে এটাই চলে আসছে। ‘অস্পৃশ্য’, ‘কাছে যাওয়া বারণ’, ‘নোংরা’ এখন আবার ‘আন-হাইজনিক প্রো ম্যাক্স’, এইসব শব্দবন্ধ জোটে সেইসব মানুষদের জন্য, যাদের ঘর-সংসার ওখানেই। গোটা সিনেমাতেই শুধু তাদেরই গল্প। সঙ্গে আড়ালে আবডালে ব্যঙ্গ করেছে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে। ধাপার জীবন এক অন্য জীবন। তাঁদের নিজেদের একটা অন্য পৃথিবী আছে। সেই পৃথিবীতে চট করে কেউ ঢুকতে পারে না। ওখানেও ইন্টারভিউ হয়, সিলেকশন হয়, ছাঁটাই হয়। কিন্তু তা নিজেদের মতো করে। ওখানে প্রকৃত অর্থেই সকলেই রাজা। তাদের আলাদা কোনো রাজা নেই, কারণ সকলের নিজস্ব ব্যক্তি পরিচয় আছে। সকলেই সকলের থেকে আলাদা। মূল চারটি চরিত্র: বকুল, গণেশ, চম্পা, শম্ভু দা – এদের ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে গোটা সিনেমা। সকলেরই কোনো না কোনোভাবে নিজেকে নিজের মতো করে বাঁচিয়ে রাখার নিরন্তর চেষ্টা। সেই চেষ্টা এবং সফলতা-অসফলতার গল্পই বলে ঝিল্লি। 
গল্প নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। এই ধরনের সাহসী কাজ খুব কম হয়েছে। কিন্তু গল্প বলার ধরন কেমন ছিল? প্রথমেই যদি ক্যামেরার কাজ নিয়ে কথা বলি, তাহলে অবশ্যই এই সিনেমা আন্তর্জাতিক স্তরের সিনেমাটোগ্রাফিকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। ক্যামেরা সামলেছেন স্বয়ং পরিচালক। লং বা ওয়াইড শট সিনেমাই নেই বললেই চলে। একটাই আছে, তাও সেটা ক্রেনেই সঙ্গে ক্যামেরা জুড়ে যতটা অপূর্ণ বা ত্রুটিযুক্ত করা যায় তারই একটা প্রয়াস দেখা গিয়েছে। ওটাই হয়তো তাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি। সঙ্গে কালার কারেকশন এতোটাই পারফেক্ট যে, সিনেমার প্রতিটি ফ্রেমের যে আলাদা একটি বর্ণন আছে, তা ফুটে উঠবে। কিন্তু মিউজিকের ভারসাম্য হারিয়েছে। কোথাও খুব বেশি, কোথাও নেই। কিন্তু সাউন্ড ডিজাইন‌ আপনাকে চমকে দিতে পারে। এই সিনেমা তৈরি করতে যে শ্রম, যেভাবে নিবেদিত প্রাণ হতে হয় তা কিন্তু বেশি সময় ধরে অনেকেই ধরে রাখতে পারে না। কিন্তু এই ছবির ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি কলাকুশলীদের অদম্য প্রয়াসকে কুর্নিশ না জানিয়ে পারা যায় না। তিন বছর ধরে একটা গোটা সিনেমা বানানো এবং তার যে নিরন্তর পরিবর্তন তা এক সূত্রে বেঁধে রাখা কিন্তু খুব শ্রমসাধ্য! কিন্তু ঈশান এইদিকটি বেশ পোক্ত হাতেই সামলেছেন।
সমস্যা অন্যদিকে। সিনেমা শুরু হয় এক ধাক্কা দিয়ে। এমন এক সত্য দিয়ে যা আমরা জেনেও জানি না, দেখেও দেখি না, মেনেও মানি না। এই ধাক্কা আপনাকে বেশ কিছুক্ষণ আঁকড়ে ধরে রাখবে। কিন্তু তারপর থেকেই গন্ডগোল! গন্ডগোল বলছি এই কারণে, কারণ এই সিনেমা সকলের জন্য নয়। সেটা জেনেই হয়তো পরিচালক এগিয়েছেন। এই গল্প আপনাকে শেষাবধি আটকে রাখবে না। কারণ, একই বৃত্তের মধ্যে এই গল্প ঘোরাফেরা করে। আপনার অবচেতনে যে চিত্রগুলি, যে চিত্রকল্পগুলি এই মানুষদের নিয়ে থাকে, তাই বারংবার পর্দায় ফুটে ওঠে। খিস্তি, নেশা, যৌনতা, – এগুলোই যে ওদের জীবন; তা আমরা না বুঝলেই জানি, না দেখলেও মানি। তাই কিছুক্ষণ পর হয়তো অনেকেরই সিনেমার কথনটা গোল গোল পুনরাবৃত্তি মনে হবে। কারণ আমরা বুঝতেই পারি শেষে গিয়ে কী হতে চলেছে। উত্তরণ হবে না কারোর জীবনে এটাই তাদের নিয়তি‌। নিজের হাতে গড়া নিয়তি। চেষ্টা করেও তারা নিয়তির অদৃষ্ট টান থেকে মুক্তি পায়নি। সকলের আলাদা আলাদা বাসনা, ভিন্ন কামনা- কিন্তু সেগুলো অপূর্ণ রেখেই পরিচালক পোয়েটিক জাস্টিস থেকে এই সিনেমাকে যোজন দুরত্বে রাখে। 

শেষে এইটুকু কথা বলতেই হয়, এই সিনেমার আঙ্গিক, ধরন এবং কথন বেশ‌ আলাদা। কারোর ভালো লাগবে, কেউ সমালোচনায় বিদ্ধ করবে। এটাই স্বাভাবিক। আমি দুটো দিক ধরার স্বল্প প্রয়াস করলাম। কিন্তু যদি অন্যধারার সিনেমার সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে চান, তাহলে অবশ্যই ঝিল্লি দেখুন। নিজের মতো করে ভাবুন। এই সিনেমা ভাবতে শেখায়। কারণ কবে শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর, এক হতচ্ছাড়া যুদ্ধ চাই কবিতায় লিখে গিয়েছেন যে, 
“মাঝে মাঝে মনে হয় কলকাতার পয়ঃপ্রণালীর
মধ্যে থেকে উঠে আসে, আজীবন যে শুয়ে রয়েছে… 
শিশু যারা সামাজিক মাতা-পিতা নয় স্তম্ভিত ক্রিড়ায়
যে বোঝে সবার মধ্যে লক্ষ্যণীয় স্থান নেই তার—
নিতে হবে ছলে বলে, কেড়ে ও কৌশলে
রক্তে ও চোখের জলে ভেসে যাবে গাঙ্গেয় কলকাতা
শিরার সড়ক খুলে ঢালা হবে প্রসিদ্ধ বিদ্যুৎ
জ্বলবে ও জ্বালাবে তাকে এবং কলকাতা জ্বলে যাবে।”
 
 
 

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published.