magazines

চৌত্রিশতম সংখ্যা || পঁচিশতম ই-সংস্করণ || ফেব্রুয়ারী ২০২৩

ভাণ পত্রিকা

চৌত্রিশতম সংখ্যা || পঁচিশতম ই-সংস্করণ || ফেব্রুয়ারী ২০২৩

সম্পাদক :

সম্পাদনা সহযোগী :​

প্রচ্ছদ :

নক্সা পরিকল্পক :

অন্যান্য কাজে :

ভাণ-এর পক্ষে:

পার্থ হালদার

কর্তৃক

৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬

( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )

৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) bhaan.kolkata@gmail.com ( ই – মেল ) ​

Reg. No : S/2L/28241

সূচি

সম্পাদকের কথা

অভিজ্ঞ মাত্র জানেন মন থাকলে মন খারাপ হবে। এর অন্যথা হবার জো নেই। আবার জীবনভর মন খারাপ করে রাখলে চলে না। সময়ান্তরে মন বিচিত্র পরিক্রমা করতে করতে পথ চলবে, কখনো খুশি হয়ে, কখনোবা দুখী হয়ে। কখনো আবার ভালো মন্দের মাঝের আলপথ ধরে চলবে মন। আলাদা করে ভালো বা মন্দ বলা যাবে না। বরং কী নয় তাই – দিয়ে বুঝতে হবে তাকে! মন ভালোও না , মন্দও না। মন-সত্তা-আত্মা-শরীর নিয়ে অনেক কূটিল দর্শন আছে। আমরা আপাতত সে পথে ভিড়তে রাজি নই। আমাদের এটুকু মাথায় রাখলে চলবে, – আমি এবং আমার মন এক নয়। শুধু মন কেন , দেহটাকেও ‘আমি’ বলা চলে না। নইলে আমি হাওয়া হলে দেহটাও উবে যেত। পোড়া পোঁতার ব্যবস্থা করতে হতো না। আমার মন হারায়,(মন) মরা হয়ে ফের জেগে ওঠে, মেতে ওঠে, আবার মন ভাঙে, ঘেঁটে যায়, কেমন কেমন করে – ইত্যাদি ইত্যাদি।

যা দিনকাল তাতে আমি হরদম মন খারাপের গল্প শুনি এখন। চতুর্দিকে হাহাকার হাহুতাশ আশাহীন ক্রন্দন। ধনীর মনস্তত্ত্ব বুঝিনা, হদ্দ গরিবগুর্বোদেরও নয়। মধ্যবিত্ত এবং তার উচ্চে-নিম্নেই আমাদের মন-বিচরণ। সম্ভবত মধ্য পদলোভী ও একইসঙ্গে জীবনবাদী হওয়ার কারনে টানাটানি তে পোড়েন বেশি। ইদানিং এই শ্রেণির হতাশার অবিরল মন্ত্র বড় বেশি কানে বাজছে। মেয়েটি চাকরি পায়নি, ছেলেটি বেকার, কাজ চলে গিয়েছে, ব্যবসা লাটে, প্রেম চলে গিয়েছে, কাটমানি কমে গিয়েছে, প্রিয় নেতা জেলে গিয়েছে, তোলার বাজারে মন্দা, মায়ের কোল খালি হয়েছে – এসবের তো কোনো সান্ত্বনা নেই; – কাজে কাজেই এসব কারণে মন-কষ্টের কথা আমরা শুনতে বাধ্য। এতে আমাদের অসুবিধে হলেও কিছু করার নেই।

কিন্তু আমরা ভাবছি মন খারাপের ফ্যাশন নিয়ে আর মন খারাপের বেঁটেত্ব নিয়ে। একটা স্তরের মানুষ জনের কাছে মন খারাপ যেন একটা ‘মর্যাদা’ বিশেষ। মন খারাপ লুকাবো না একথা যেমন ঠিক, তেমনি “আমার মন খারাপ, মন খারাপ”- বলে অষ্টপ্রহর চিৎকৃত কীর্তন কাজের কথা নয়। স্বঘোষিত ডিপ্রেশসড দুই মহিলার কথাবার্তা শুনে বুঝেছি, এর থেকে বেরিয়ে আসার ইচ্ছের বদলে দুজনেই ব্যক্তিগত মনখারাপকে ক্রমশ অলঙ্কার থেকে অহংকারে নিয়ে যাচ্ছেন। মধ্যশ্রেণির শহর মফস্বলের ছেলেমেয়ের দল মনখারাপের প্রতিযোগিতায় একে অপরকে টেক্কা দেবার খেলাতে মেতেছে। আমার মন ভালো নেই। আমার জীবনে আলো নেই, প্রেম নেই – একথা কিছু ক্ষেত্রে, এবং ক্ষেত্র বিশেষে সত্য হলেও, জানান দেওয়ার তৎপরতা এক অদ্ভুত নব্য সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। আমার মন যদি সবচেয়ে খারাপ হয়, কেউ আমার মনকে ছুঁতে পারছে না বলে যেকারোর কাছে কাঁদুনে গাওয়া যায়; তবে অন্যের ভালো করার দায় থেকে,অন্যের মন খারাপের খোঁজ থেকে, সহজে মুক্তি মেলে!! মনে হয়, অন্তত শহর মফস্বলের সমাজ মনের এটি একটা বড় সংবাদ।

** একে যদি একপ্রকারের কমপ্লেক্স বলি, তবে এর প্রকৃতি কেমন? ব্ল্যাক এর কমপ্লেক্স সে ‘সাদা’ হতে পারেনি ‌। বুদ্ধিমান ব্ল্যাক জানে, এই পৃথিবীটাকে যদি কালোরা চালাতো তাহলে কালো হবার ধুম লাগতো। ফলে এই কমপ্লেক্স আমাদের বোঝা। কিন্তু আমার মনখারাপের দেখনদারির খেলায় প্রতিপক্ষ কে? কার জন্য কার কমপ্লেক্স? তলিয়ে দেখলে বুঝবো এর প্রতিপক্ষ বড় বিপদজ্জনক। ‘বাইরের আমি’র সঙ্গে ‘ভেতরের আমি’ এর। মন খারাপকে বাইরে – সে-ই বিজ্ঞাপিত করতে চাইবে, যার নিজের ভেতরের শুশ্রূষা তলানিতে। যোগাযোগ ক্রমশ ক্ষীণতর। বাইরের আমি টিকে, উপরিতলের ইগোটিকে সাজিয়ে গুছিয়ে আকর্ষণীয় করার খেলায় তিনি এমন মজে যে, ভেতরের ঘরের কপাট খোলাই হচ্ছে না। কারোবা চাবি হারিয়েছে , অথবা মরচে পড়া চাবিতে তালা আর খোলে না!
ছোটো মন খারাপ, মানে কি ছোটো মনের মন খারাপ? খাটো মন খারাপ তাই,- যা কেবল নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। নজর করি একজন সমাজের গণ্যমান্য মনখারাপের মানে বলতে নিজের মন খারাপ বোঝেন। কথাটা একদিক দিয়ে ঠিক। মন আমার, অতএব খারাপ হলে আমারই হবে। কিন্তু সর্বদা তা‌ নিজের জন্য হতে যাবে কেন? পরের জন্য মনখারাপের অভ্যাস কি অন্তরীণ হচ্ছে ক্রমশ? আমার মন কেবল আমার কারণে খারাপ হবে এই যুক্তির ঘুপচিতে শ্বাস রোধ হবার জন্য আমার এক বন্ধু প্রেমিকা ত্যাগ করেছিল। জানিয়েছিল, বিচ্ছেদের পক্ষে এ এক গৌরবময় মুক্তি! সত্যি কথা চারপাশের মারাত্মক ইতরতা দেখে ঘেন্নায় কুঁকড়ে যাওয়া, বিষাদ মাখার উপায় নেই। পাশের মানুষ বিশ্বাসই করে না যে সমষ্টির ট্র্যাজেডি ব্যক্তিকে অবসন্ন অথবা রিক্ত করতে পারে!!

ভাবুন তো কজন বিশিষ্ট লেখক, চিন্তক, পাথর ভাঙা শ্রমিকদের ফুরিয়ে আসা ফুসফুসের কথা ভেবে কষ্ট পান? নাকি তার গরিব মানুষের জন্য লেখা উপন্যাসটি মেলার অমুক হলে উদ্বোধনে জায়গা পেল না বলে বেশি কষ্ট পান? কজন নাটককার ঘুষদেওয়া চাকরি খোয়ানো কয়েকবছরের মিথ্যা শিক্ষকের মনদ্বন্দ্ব স্পর্শ করছেন, নাকি দলে সরকারি গ্র্যান্ড মিলবে কিনা ভেবে দ্বন্দ্বে ভুগছেন বেশি? কজন গায়ক, বাংলা গান বাঙালি কেন কম শুনছেন বলে মনখারাপ করছেন নাকি হিন্দি তামিল দেশ বিদেশের সুরে তাপ্পি দিয়ে গানকে ভাইরাল করতে পেরে আনন্দ পাচ্ছেন বেশি? উদাহরণ না বাড়িয়ে বলা চলে আমাদের সিংহভাগের বেঁটে আনন্দ, ছোটো মনখারাপ। ঘুপচি এঁদো মনের গলির ব্যক্তিগত হিৎকার। কখনও আবার তাও নয়। পুরো মন খারাপের ব্যাপারটিই একটি পোষাকি আবরণ!
নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা অথবা আকর্ষণীয় করার সাজগোজ বিশেষ!!

মনখারাপ তো যুগ যুগান্তর ধরে মহৎ মানুষের কাজ। যীশু খ্রিস্ট থেকে গৌতম বুদ্ধ হয়ে একালের গান্ধী রবীন্দ্রনাথ- কী মহৎ উচ্চতার মন খারাপ এঁদের! তেমনি তার মহত্তম প্রকাশ। বিষয়ে মন এমন বিষিয়ে উঠল, মন এমন ক্লান্ত হল, গৌতম সমস্ত বৈভব তুচ্ছ করে জ্ঞান মার্গে ভর করে মনকে মুক্তির কাছে নিয়ে গেলেন।
অন্যদিকে ভারতের সবচেয়ে বড় জননেতার প্রিয় হল,সবচেয়ে বড় কবি দার্শনিক রবীন্দ্রনাথের গান। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে..’।
মহানদের কথা ছেড়ে বরং অতিসাধারণ আমার ঠাম্মির গল্প শুনুন। আলোকায়নের ভাষ্যে তাকে আধুনিক বলা যাবে না। অসাম্প্রদায়িক বলা চলত না তাকে। সাঁওতাল মুনিস বসন নিজের জামবাটি নিজেই ধুতো আমাদের বাড়িতে । কিন্তু যেদিন বসনের মেয়ের টিবির খবর পেলেন ঠাম্মি। সেদিন তার সেকি মনখারাপ। সে কি কান্না। মন খারাপ নিজের চৌহদ্দি চৌকাঠ ছাড়িয়ে গেলে ব্যক্তির মুক্তি, সমাজেরও। আমাদের শিক্ষিত মন কি আমার ঠাম্মিদের বটবৃক্ষের মতো মনখারাপের গল্প শুনতে একটু মন দেবে??

এশীয় থিয়েটার : পরিসর চিন্তা ও অন্বেষণ

 

সায়ন ভট্টাচার্য

যে মুহুর্ত থেকে শিল্পকলা ও পুঁজি মানবজীবনের মধ্যে সম্পৃক্ত হবে এবং একটা নতুন সমাজকাঠামো তৈরি করবে, যেখানে সমাজের অবনত শ্রেণির আত্মপ্রকাশ করার জোর পাবে, তখন একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের রূপরেখা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা অবশ্যই তৈরি হবে। চিন্তার সূত্রটি মাথায় আসে ঐতিহাসিক বার্নাভের ফরাসি বিপ্লবের তত্ত্বের একটা ভাবনার মধ্যে থেকে। সমাজকাঠামো ও আত্মপ্রকাশ যে একে অপরের উপর নির্ভরশীল তা আর বলে দিতে হয় না, শিল্প সংস্কৃতির স্রোত আপন গতিতেই বহমান হয়ে ওঠে সমসাময়িক রূপ।
আমি যে থিয়েটারটা চর্চা করি সেটা বাংলা থিয়েটার। ভূগোল ও ভাষা এই দুইয়ে বাংলা। কিন্তু বৃহৎ কাঠামোর মধ্যে এই থিয়েটার ভারতীয় এবং এশীয় তো বটেই। তাহলে আমার থিয়েটার চর্চার আইডেন্টিটিটা কি?
মানচিত্রটা অনেক বড়, কিন্তু আমাদের এখানে অধিকাংশই ক্ষুদ্র একটা আঞ্চলিকতা থেকে বাংলা থিয়েটারকে নিয়ে গর্ব করে। করতেই পারে, কিন্তু তাতে কোনও ভাবেই লাভ হয় না। বিশ্বের কাছে আমাদের একটা দেশীয় ও মহাদেশীয় পরিচয় আছে। অনেকে বলবে থাকতেই পারে, এত রাজনৈতিক একরকম দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে গেল। কিন্তু তাদের দেখার ‘অর্থ’টা কি, সেটা বোঝার দায় কিন্তু আমাদের থেকে যায়। সহজ কথায় হলো, আমরা কি বৃহৎ এশীয় থিয়েটারের অংশীদার নাকি দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতির অন্যতম সদস্য আমাদের বাংলা থিয়েটার?
তাহলে এখন দেখতে হয় এশীয় থিয়েটারের সংস্কৃতি পাঠ করার আগে কতগুলো তর্ক আমাদের সামনে উঠে আসছে। ভারতবর্ষের শিল্প ও সংস্কৃতির উন্নতমানের ছবি একটা সময় ঔপনিবেশিক শাসকরা বিশ্বের সামনে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছিল। তবে তার মধ্যে অনেক বেশি প্রকট ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জাত্যাভিমান। আন্তর্জাতিকতার নামে এই প্রকল্প অনেক বেশি ছিল সাম্রাজ্যের পরিসীমা দীর্ঘাযিত করা। তবে এক্ষেত্রে দ্বিমুখী চলন তৈরি হলো – একটি যদি সাম্রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি হয় অন্যটি অবশ্যই এশিয়া সম্পর্কে ধারনা।
এশিয়া মানে তো ঔপনিবেশিক শাসকের শাসনক্ষেত্রটুকু নয় – এই বৃহৎ মহাদেশীয় প্রকাশ বিপুল বৈচিত্র্যময়। এটা তো মানতেই হবে ব্রিটিশ সাংস্কৃতিক সীমানা উত্তর ভারত ও পূর্ব ভারতে, দক্ষিণ ভারতের বুকের উপর ঔপনিবেশিক আঁচড় ততটা গভীর নয়। কীভাবে বুঝবো? প্রধানত থিয়েটারের মধ্যে দিয়ে।
খুব ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় ব্রিটিশদের ধাঁচা নিয়ে ভারত তথা এশিয়ার বুকে সবচেয়ে বেশি চর্চা হয় উত্তর ভারতীয় অংশে, সবচেয়ে বেশি ভারতের মেট্রোপলিটন সংস্কৃতির থিয়েটারের মধ্যে।
কিন্তু সামগ্রিক এশীয় থিয়েটারের চিত্র কিন্তু তাই বলছে না। তাই শাসকের মানদণ্ডকে সরিয়ে বিশ্ব সংস্কৃতির চর্চার মধ্যে দিয়ে প্রাচ্যকে ‘অপর’ হিসেবে নয় বরং ১৮ ও ১৯ শতকে ব্রিটিশ ও জার্মান জ্ঞানচর্চার রোমান্টিকতার মধ্যে দিয়ে এশিয়ার সংস্কৃতি আসতে আসতে ইউরোপভূমিতে উন্মোচিত হয়।
থিয়েটারের চর্চায় আমরা বাংলার থিয়েটার কর্মীরা ভারতের অন্যান্য প্রদেশের সঙ্গে আদান প্রদান করে একটা থিয়েটার ভাবনা/নির্মাণ কাঠামো কি তৈরি করতে পেরেছি? জ্ঞানীজনদের কাছে উত্তর প্রাপ্তি আশা করি…..
ভৌগলিক অবস্থান অনুসারে সংস্কৃতির আদান প্রদান অনেক সহজ ও সুলভ হয়। মনিপুরী নাট্য বা অহমিয়া নাট্যে, চিন দেশের নাট্যকলার অনেক বেশি প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়, যা কখনি মারাঠি নাটকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে প্রভাব থাকবে না। জাপানের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই আধুনিকতার সূচনা হয় মেইজি সংস্কার যুগ ১৮৬৮ সালের সময় থেকে। সংস্কার যুগের মধ্যেই গড়ে ওঠা থিয়েটার চর্চা আধুনিকতার সংলাগুলো তৈরি করে। দেখা যাচ্ছে জাপানে তৈরি হচ্ছে এনজেকি-কাইরো-কাই(Theatre Reform Society) এবং সরকারি সহায়তায় নির্মাণ হচ্ছে। কাবুকির স্টাইল পাল্টা তৈরি হচ্ছে “কাট্সুরেকি” নাট্ট। নাট্যকার দানুজুরো “কাবুকির” আঙ্গিকের বার করে আনতে চাইছেন “কাটসুরেকি” নাট্য আঙ্গিক।
তাহলে এশিয়ার থিয়েটার বলে কি কিছু হতে পারে আলাদা করে? আমার কি সমস্বত্ত ভাবে (homegenious) কয়েকটি বৈশিষ্ট্য তৈরি করতে পারে পৃথিবী বৃহৎ মহাদেশের নাট্য প্রকল্পের? পারি না হয়তো, কারণ “….. The term is used more to denote a land mass whish is neither Europe nor Africa. Indeed, was there ever a meaningful reality called Asia? ” (G.P.Deshpande /’Asia’ as western Dominance)

‘হাশ হাশ’ ওয়েবসিরিজের খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা করলেন - বৃতা মৈত্র

 
চার মহিলার গোপন রহস্যে টানটান ‘হাশ হাশ’: বৃতা মৈত্র

ইদানীং একটা অভিযোগ খুবই প্রকট, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম মানেই ক্রাইম থ্রিলার। অনেকেই বলছেন, এই জায়গাটা থেকে আর বের হতে পারছেন না এই মাধ্যমের লেখক-প্রযোজক-পরিচালকরা। অভিযোগ অহেতুক নয়, সেটা যেমন ঠিক, তেমন, দর্শক চাহিদাই সম্ভবত এর অন্যতম কারণ, এটাও বুঝতে অসুবিধা হয় না। তবে, পরিচালক তনুজা চন্দ্রের বিষয়টা এক্ষেত্রে একটু আলাদা। তনুজা পরিচালিত দুর্দান্ত হিট ‘দুশমন’ ও ‘সংঘর্ষ’ আদ্যন্ত থ্রিলার মেজাজের ছবি। প্রসঙ্গত, যশ চোপড়ার মারকাটারি হিট ‘দিল তো পাগল হ্যায়’-এর স্ক্রিনপ্লে-র সহলেখক ছিলেন তনুজা। ব্যতিক্রমী ‘জখম’ ও ‘তমান্না’ ছবির চিত্রনাট্যও তাঁরই লেখা। এগুলি থ্রিলার না হলেও অন্যধারার ও নাটকীয় উপাদানে ভরপুর। অর্থাৎ, দর্শককে টানটান আকর্ষণে ধরে রাখার ম্যাজিকটা জানেন তিনি।
ছবি সৌজন্যে : অ্যামাজন প্রাইম 
এই কারণেই তনুজা আমাজন প্রাইমের জন্য ‘হাশ হাশ’ তৈরি করছেন জানার পর থেকেই ওয়েব দর্শক বেশ কিছুটা নড়েচড়ে বসেছিল। এখানে একটা জরুরি কথা। এখন সকলেই জেনে গিয়েছেন, ওয়েব সিরিজের ক্ষেত্রে কনটেন্ট খুব গুরত্বপূর্ণ একটা দিক। আর তনুজার তো রক্তেই লেখালেখি। প্রখ্যাত লেখক কামনা চন্দ্রের কন্যা তনুজার বাকি দুই ভাই-বোন লেখক বিক্রম চন্দ্র এবং বোন চিত্র সাংবাদিক অনুপমা চোপড়া। এই ঘরানা, পরম্পরায় বেড়ে ওঠা তনুজার। অর্থাৎ কলমের জোর তাঁরও সহজাত। এই সব মিলিয়েই ‘হাশ হাশ’-কে ঘিরে আগ্রহের পারদ ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে। দুর্দান্ত হিট আমেরিকান সিরিজ ‘বিগ লিটল লাইজ’ থেকে নেওয়া হয়েছে ‘হাশ হাশ’-এর গল্প। বলা যায়, আমেরিকান সিরিজটির ভারতীয়করণ যথেষ্ট সফল ভাবেই করেছেন তনুজা ও তাঁর টিম। প্রসঙ্গত, ‘হাশ হাশ’-এর ক্রিয়েটর তনুজা চন্দ্র। স্ক্রিনপ্লে লিখেছেন আশিস মেহতা। গল্প শিখা শর্মা ও জুহি চতুর্বেদী। তনুজার পরিচালন সঙ্গী আশিস পান্ডে ও কোপাল নাইথানি। প্রযোজনা শিখা শর্মা, তনুজা চন্দ্র, বিক্রম মালহোত্রা।
ছবি সৌজন্যে : অ্যামাজন প্রাইম
২০২২-এর সেপ্টেম্বরে দেখানো হয় সিরিজের প্রথম সিজন। বেশ অন্যরকম ধাঁচের এই ওয়েব সিরিজ এতটাই জনপ্রিয় হয়, যে, ইতিমধ্যেই দর্শকমহলে দ্বিতীয় সিজনের জন্য তীব্র অপেক্ষা শুরু হয়ে গেছে। ৭ পর্বের প্রথম সিজনে রয়েছে চার মহিলার গল্প, যারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং এদের কিছু একটা বিষয় গোপন রয়েছে বহির্জগতের কাছে। এই গোপনীয়তার কারণ কী ? বিষয়টার পিছনে কী কোনও গভীর অপরাধ লুকিয়ে আছে ? পর্বে পর্বে সেই প্রশ্ন আর রহস্য ঘন হয়ে উঠবে ক্রমে। এখানে একটা কথা বলা দরকার, তনুজা এই সিরিজে সামাজিক জটিলতার আবর্তের সঙ্গে থ্রিলার মেজাজটি দিব্যি মিলিয়েছেন। পটভূমি গুরগাঁওয়ের ধনী এলাকা। ওই চার মহিলা সম্পর্কে আশপাশের লোকজন, বিশেষত পুরুষকুল খুব একটা ভালো ধারণা পোষণ করে না। আদতে প্রবল পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গিয়ে এই চার মহিলা তাদের দাবি, অধিকার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করে। বলা বাহুল্য, এই প্রতিষ্ঠার পথটা যে সরল ছিল না, তা বোঝা যায়, ওই মহিলাদের গোপন রহস্য লুকোনোর চেষ্টায়।
ছবি সৌজন্যে : অ্যামাজন প্রাইম
‘হাশ হাশ’-এর প্রধান আকর্ষণ যদি তার কাহিনি ও পরিচালনা হয়, দ্বিতীয় কারণ অবশ্যই জুহি চাওলার ওয়েব দুনিয়ায় পা রাখা। বলিউডের সুপার তারকা, এক সময়ের বহু হিট ছবির নায়িকা জুহি বেশ কিছুদিন ধরেই চরিত্রাভিনেতা হিসেবে বড় পর্দায় নিজের মাটি শক্ত করেছেন। যদিও জুহি এর আগে অল্ট বালাজিতে একটা কাজ করেন। তবে, বেশ বড় স্তরে তাঁর ওয়েব দুনিয়ায় উদ্বোধন ‘হাশ হাশ’-এই। এর পরেই বলতে হয় আয়েশা জুলকার কথা। আয়েশাও যথেষ্ট পরিচিত মুখ। মাঝে অনেকদিন কাজের বাইরে থেকে ‘হাশ হাশ’-এর হাত ধরে ফিরলেন তিনি। এই সিরিজের অন্যতম প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে সাহানা গোস্বামীর অভিনয়। সোহা আলি খানও নিজেকে নতুন অবতারে মেলে ধরেছেন। হিন্দি সিরিয়ালের অত্যন্ত জনপ্রিয় মুখ করিশমা তান্না ও কৃতিকা কার্মা। ওঁরা নিজেদের চরিত্রে যথাযথ। নিশা জিন্দাল এঁদের তুলনায় নতুন। এই মুহূর্তে সিনেমায় কেরিয়ার গড়ার লক্ষ্যে। তবে, তিনিও পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন বাকিদের সঙ্গে। শোনা যাচ্ছে, এই বছরেই হাশ হাশ’-এর দ্বিতীয় সিজন স্ট্রিমিং হবে আমাজন প্রাইমের পর্দায়।
 
 

প্রেম সপ্তাহ এবং ৯০-এর দশকের সিনেমার গভীর যোগাযোগের কথা বললেন - জিনিয়া রায়

জিনিয়া রায়
সিনেমার ফ্রেম, বাঙালির প্রেম

প্রেম দিবস। ছাপোষা বাঙালির কাছে এই সেদিনও প্রেম দিবস গোছের কিছু একটা বলতে বোঝাত সেই ফেব্রুয়ারির দুপুর বেলায় “সরস্বতী মহাভাগে…”, আর সেই বাঙালি যখন হলদে শাড়ির আঁচল আর সাদা পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে ভরদুপুরের ঘাম মুছে চোখ তুলে চাইলো তখন পাড়ার মোড়ে মোড়ে স্টেশনারি দোকানের এক-একটা ডেডিকেটেড দেওয়ালে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে আর্চিস, হলমার্কের নানান আকার ও আকৃতির ফুটফুটে গ্রিটিংস কার্ড, যাতে নানান নকশার মধ্যে দিয়ে সেই চিরন্তন শব্দবন্ধনী বুক চিতিয়ে সোচ্চার করছে- “আই লভ ইউ”। হাতের লাল গোলাপ আর মনের ভিতর সুড়সুড়ি তখন গাইছে “বসন্ত এসে গ্যাছে…”।

বসন্ত তো আগেও আসত, ঠিক যেমনটা নিউটনের আপেল পড়তে দেখা ও তা নিয়ে প্রশ্ন জাগার আগেও আপেল ভূলুণ্ঠিত হতো; কিন্তু নব্বই-এর দশকের মাঝামাঝি এই গ্রীষ্মপ্রবণ দেশে বসন্ত আসতে শুরু করল একটু অন্যরকম ভাবে। হাতে আর এখন শুধু লাল গোলাপ নয়, বরং কম, মাঝারি কিংবা বহুমূল্য কার্ড ও সঙ্গে আরো কিছু উপহার। বছরের দ্বিতীয় মাসের প্রথম ক’দিন যেতে না যেতেই প্রেম-পার্বণের ঢক্কানিনাদ বেজে গেল। রোজ দে (ডে) দিয়ে শুরু যে মহাপার্বণী হপ্তার, তা সাজিয়ে দেওয়া হল পরপর প্রোপোজ, চকোলেট, টেডি, প্রমিস, হাগ, কিস দেওয়ার প্রলোভনে। এই এতোসব ‘ডে’-র চোদ্দগুষ্টি পেরিয়ে তবে এলো চোদ্দই ফেব্রুয়ারি, ভ্যালেন্টাইন্স ডে! তা কে এই ভ্যালেন্টাইন, এই প্রেম দিবসে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের কী অবদান, কেনই বা আমি তোমার, কিংবা তুমি আমার ‘ভ্যালেন্টাইন’ হবে- এইসব সরল প্রশ্নের তরল জবাব দিয়ে আমাদের কী?

 ইতালি আমাদের পিৎজা, পাস্তা, স্প্যাঘেটি দিয়েছে, দিয়েছে ভিঞ্চি দা, ভ্রূ-বিহীন মোনালিসা। আর কী চাই? রোমান্স শিখতেও যদি রোমের হাত ধরতে হয় তাহলে ধিক আমাদের! আমাদের প্রেমের গীতা-বাইবেল সবই তো আসলে বলিউড! আর নব্বইয়ের দশকের প্রেমের অ-আ-ক-খ তো একেবারে হাতে ধরে শিখিয়েছিল ঐ রাজ, রাহুল, প্রেমই। আর সেই দশকটাও তো ছিল তেমনি অন্যরকম। একদিনে উদার অর্থনীতির ঢেউ আর অন্যদিকে খান-ত্রয়ীর দিল-এ-নাদান মুচড়ে দেওয়া প্রেমের জোয়ারে আপামর দেশবাসীর হৃদয় তখন পালতোলা নৌকো। গাঢ় রঙের খাটো জ্যাকেট, চোস্ত কিংবা পেপার ব্যাগ প্যান্ট ছেড়ে মোটা জুলপির রাগি-রাগি চেহারার ছেলেরা তখন ব্যাগি সোয়েটার, ডার্ক শেডের ট্রাউজার-জিন্স-শোভিত হয়ে মিষ্টি হেসে প্রেম নিবেদন করছে, আর মেয়েরাও আনারকলি আর দুই-বিনুনি ছেড়ে হাঁটুর বয়সী থুড়ি হাঁটু-স্পর্শী স্কার্ট কিংবা শিফন-জর্জেটের পাল্লুর সিলুয়েটে আমাদের ইউরোপের বরফ আর পাঞ্জাবের সর্ষেক্ষেত দর্শন করাচ্ছে। ঠিক এমন সময়েই গোলাপি শালওয়ারের দুপাট্টা উড়িয়ে খোলা চুলের মায়ায় জড়িয়ে হুড়মুড়িয়ে হাজির হল মাধুরী দীক্ষিতের ‘পূজা’! উফ, সে যেন সত্যিই অসময়ের পুজো, শুধু রাহুল কেন, ভারতের তামাম যুবমনের দিল তখন পাগল-পাগল! ১৯৯৬-এ মুক্তি পেল যশরাজ ব্যানারের সুপারহিট ‘দিল তো পাগল হ্যায়’ আর ভারতের প্রেমও আরো একটা নতুন মাত্রা পেল। বলিউডের চিরন্তন দুর্বলতা ত্রিকোণ প্রেমের ক্যানভাসে তৈরী ‘দিল তো পাগল হ্যায়” ছবিতেই আমরা প্রথম ভ্যালেন্টাইন্স ডে উদযাপনের সাক্ষী হই।

’৯০-এ বেড়ে ওঠা কিশোর-যুবাদের স্মৃতিতে আজও নিশ্চয়ই জ্বলজ্বল করছে ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র সেই পার্টি! হৃদয়াকৃতির লাল বেলুন, লাল গোলাপের সমারোহ, তার মাঝে বুক দুরুদুরু হৃদয়ের কথা বলে ফেলার কাতরতা- সব মিলিয়ে হিন্দি সিনেমা সেই প্রথমবার পেল পশ্চিমী প্রেম-পার্বণের এক আশ্চর্য স্বাদ। যাতে দেখনদারি আছে, অকপটতা আছে, আবার বুকের ভিতরের শিরশিরানি আছে, আছে ‘ভালোবাসা অনেকবার হয়, কিন্তু প্রেম একবারই হয়’-এর মত ভাবনাও! এই ছবিতে ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালনের এও কিন্তু একটা দিক যেখানে প্রেমকে শুধুই এক স্বর্গীয় উপহার কিংবা ভাগ্যের বদান্যতা অথবা কেড়ে-কুড়ে নেওয়ার ‘প্যাশন’ থেকে কিছুটা সরিয়ে, হয়তা বা আরো কিছুটা মনের কাছাকাছি নিয়ে এসে হৃদয়ের অনাবিল অনুভূতির উদযাপন হিসাবে দেখানো গেল। ‘দিল তো পাগল হ্যায়’-এর প্রেমের এই নতুন ঘরানার একটা নবতর ও আরও উচ্ছ্বাসিত রূপ দেখতে পাওয়া গেল ১৯৯৮-এ মুক্তি পাওয়া আর এক সুপারহিট রোম্যান্টিক ছবিতে। ধর্মা প্রডাকশনসের ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’-এর কাহিনী ও চিত্রনাট্য সংক্রান্ত নানাবিধ সমস্যাকে উপেক্ষা করেও শুধু ‘পেয়ার দোস্তি হ্যায়’-এর মত একটা আশ্চর্য ভাবনার সূত্রপাত ঘটানোর জন্যই এই ছবির একটা পিঠ চাপড়ানি প্রাপ্য। সত্যি তো, এর আগের কোনো হিন্দি ছবির মুখ্য চরিত্রদের তো বলতে শুনিনি প্রেমের এই ডাইমেনশনের কথাটা! ছবির এক জায়গায় ‘দ্য নীলম শো’-এ ভ্যালেন্টাইন্স ডে উদযাপন করা হচ্ছিল। বিচিত্র এক সেট, রং-বেরংয়ের প্রচুর মানুষ আর বিশেষ মানুষের উদ্দেশ্যে বার্তা ছুঁড়ে দেওয়ার এক দৃশ্যে জনৈক যুবা সুপর্ণা নাম্নী বিশেষ কাউকে একটা বার্তা দেয়- “আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ কোরো না, আমি অন্য একজনকে পেয়ে গিয়েছি”! অর্থনীতির বিশ্ববাজারে প্রতিদ্বন্দ্বী চেহারার ভারতের এও কি ছিল এক প্রতিস্পর্ধী চিত্র? কথা হচ্ছিল ছবিতে ভ্যালেন্টাইন্স ডে উদযাপন নিয়ে, আসলে কুছ কুছ হোতা হ্যায় তো আগাগোড়া সবটাই প্রেমদিবস উদযাপনই। প্রেম-বন্ধুত্বের জটিল আবর্তে ঘূর্ণায়মান তিনটি জীবন, তাদের মিলন, বিচ্ছেদ এবং আবারও মিলনের মাঝে বাড়ে বাড়ে উঁকি দিয়ে গেছে “তুম নহি সমঝোগি, অঞ্জলি, কুছ কুছ হোতা হ্যায়”… হৃদমাঝারে ওই “কুছ কুছ” হওয়ার অনুভূতিটাই তো চোদ্দই ফেব্রুয়ারির নির্যাস।
রোমান্সের বাদশা শাহরুখের গালের ভাঁজে কিংবা প্রসারিত বাহুতে গোটা ভারতের মনের হদিশ পাওয়া যাবে এই আশাতেই তৈরী যশরাজ ব্যানারেরই বেশ বড়সড় ছবি ছিল ‘মোহব্বতেঁ’। নতুন সহস্রাব্দের প্রথম বছরেই মুক্তি পাওয়া বহু নক্ষত্রের পাঁচমিশালী এই ছবির মুখ্য বিষয় মোহব্বত অর্থাৎ প্রেম তো বটেই, বরং মূলত চার যুগলের ভিন্ন স্বাদ-গন্ধের চার রকমের প্রেম আর তার পরিণতি। ১৯৮৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ও রবিন উইলিয়ামস অভিনীত ইংরাজি ছবি Dead Poets Society-র সাথে ইতিউতি সাদৃশ্য থাকলেও মোহাব্বতেঁ ভীষণ ভাবেই নারায়ণ শঙ্করের ‘নফরত’-এর বিরুদ্ধে রাজ আরিয়ান মালহোত্রের ‘মোহাব্বতেঁ’-র চ্যালেঞ্জ আর পরিশেষে জয় লাভেরই কাহিনী। ছবিতে দেশি-বিদেশী রঙে ও রূপে ভ্যালেন্টাইন্স ডে উদযাপনের দৃশ্য আছে ঠিকই, তবে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের প্রেমের খাতিরে কথিত আত্মত্যাগই যেখানে ‘মোহাব্বতেঁ’-রও ট্যাগলাইন সেখানেই তো প্রেমদিবসের প্রকৃত উদযাপন।
বসন্ত আরো একবার প্রায় এসে গেছে। কাদের যেন প্রেমে পড়া বারণের বারংবার নিষেধাজ্ঞা জারি করার পরেও পাড়ায় পাড়ায় রাহুল-অঞ্জলিরা বার বার প্রেমে পড়বে আর তাদের সঙ্গে থাকবে দিল পাগল করা সেই কুছ কুছ অনুভূতি যার অনেক, অনেকটা দায় বম্বের ‘ফিলাম’ পাড়ার। ফেব্রুয়ারির প্রেম দিবস তাই হিন্দি ছবিগুলি ছাড়া অসমাপ্ত, হিন্দি ছবিগুলি ছাড়া ঠিক যেরকম অসমাপ্ত নতুন প্রেমে ভিজে থাকা মনগুলির মনের কথা…“জিন্দেগি প্যার দেনে অউর প্যার লেনে কা নাম হ্যাঁয়…অউর কুছ নহি…”। দীর্ঘজীবী হউক লির প্রেম দিবস; দীর্ঘজীবী হউক হিন্দি সিনেমায় প্রেমের উদযাপন!

 

যাপিত নাট্যের অষ্টম কিস্তি লিখলেন - কুন্তল মুখোপাধ্যায়

কুন্তল মুখোপাধ্যায় 
 
যাপিত নাট্যের অষ্টম কিস্তি
 
আমার ছাত্র জীবন, বিশেষ করে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট – পোষ্ট গ্র্যাজুয়েট পড়ার সময় কলেজ স্ট্রীটের সঙ্গে শুরু হ’ল প্রেমপর্ব। যদিও আমি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়তাম তবুও প্রেসিডেন্সীর রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি বিভাগের নিজস্ব পাঠাগারের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক ধ্রুব পাল ও স্যার অমল মুখোপাধ্যায় এর সৌজন্যে আমি প্রেসিডেন্সীর লাইব্রেরীও ব্যবহার করতে পারতাম, এমন কি দু-চারটে ক্লাসও করেছি। ওই সময়ই প্রথম দেখি মহীনের ঘোড়াগুলির স্রষ্টা গৌতম চট্টোপাধ্যায়কে, যদিও তখন তিনি কলেজ ছেড়ে দিয়েছেন তা সত্ত্বেও মাঝেমাঝে কলেজস্ট্রীট চত্বরে দেখা মিলতো এই সময়ই ১৯৭৪ সালে কাউন্সিল ফর পোলিটিক্যাল স্টাডিজের ছাত্র ইউনিট একটা ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট ফোরাম গঠন করে, যার মূল হোতা ছিলেন সেই সময়ের প্রখ্যাত গণসংগঠনের নেতা মন কুমার সেনের ছেলে ভাস্কর দা। অন্য সদস্যরা প্রায় সবাই পোস্ট গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট, আমি পোস্ট গ্র্যাজুয়েটে ঢোকার অপেক্ষায়। আমাকে মৃণাল সে ও উৎপল দত্ত’র সাক্ষাৎকার গ্রহণের দায়িত্ব দেওয়া হল। আমি অশোক মুখোপাধ্যায়ের সহায়তায় একটা প্রশ্নমালা তৈরি করে, দুজনের সঙ্গেই আগে থেকে সময় স্থির করে দুই ভিন্ন ভিন্ন দিনে সাক্ষাৎ করা ধার্য করলাম। মৃণাল সেন তাঁর ছবি করার নানা স্ট্যাগল, ছবির এ্যাসথেটিকস্ ও নিওরিয়ালিজম্ নিয়ে কথা বলার পর বললেন, অনেক ভারী ভারী কথা বললাম বটে, আসলে আমি কিছুই জানি না। আমাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে হেসে বললেন, শোনো মৃগয়ার শুটিং হচ্ছে আদিবাসী গ্রামে, গৌরাঙ্গ (মিঠুন) তীর ছোঁড়ার পর আমার দিকে তাকাতে আমি প্রশংসা সূচক ঘাড় নাড়লাম। আদিবাসী যে মানুষেরা শ্যুটিং দেখছিল তাদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলাম কেমন দিলাম। কিন্তু ওদের যখন জিজ্ঞাসা করলাম, কি ঠিক হয়েছে তো? ওরা মাথা নেড়ে বললেন কিছুই হয়নি। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ওরা জানাল তীর ছোঁড়ার সময় বুড়ো আঙ্গুলের কোনও ব্যবহার লাগে না। ইনডেক্স ফিঙ্গার আর মিডল ফিঙ্গার মুঠো করে তীর ছুঁড়তে হয়।
আমার অহঙ্কারের বেলুন ফেটে ঘেঁটে গেল। বুঝলাম কিছুই শিখিনি। আমার বোবা মুখের দিকে তাকিয়ে মৃণাল সেন বললেন, কখনও ভাববে না তুমি সব জানো, জানার ভাঁড়ার শূন্য মনে করে কাজ করবে, দেখবে অনেক নতুন সত্য আবিষ্কৃত হবে।
উৎপল দত্তের বাড়ী যাওয়ার সময় আমার ডিপার্টমেন্টের এক সিনিয়র দাদা জহর দা আমার সাথী হলেন, ‘’কল্লোল’’ (উৎপল দত্তের বাড়ীর নাম) ঢুকে বাইরের ঘরে বসেছি, মিনিট পাঁচেক পরে উপরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন উৎপল দত্ত। আমার সেই সিনিয়র দাদা চোখের সামনে উৎপলবাবুকে দেখে একেবারে মূক ও স্থির। উনি বসতে বললেন ‘’স্ট্যান্ড স্টিল’’। আমি শেষে হাত ধরে বসালাম। আগে থেকে এ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া ছিল, আর উনি আমাকে শেখর গাঙ্গুলীর ভাগ্নে বলে চিনতেন। আমার পড়াশোনার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। নতুন কী বই পড়েছি সেই খবর নিলেন, রিয়াজেনডের ভাষ্যে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো পড়ার উপদেশ দিলেন। এরপর খুব সাবলীল ভাবে প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকলেন। অশোকদা একটা প্রশ্ন দিয়ে বলেছিলেন যদি সাহসে কুলোয়, তাহলে প্রশ্নটা করো। আমি সেই প্রশ্নটা করার আগে বলে নিলাম, আমি তো কিছুই জানি না, তাই ভুল হলে বকবেন, এরপর প্রশ্নটা করলাম, ‘’আপনার মত একজন নাট্য কর্মীর কাছে কোনটা বেশি গুরুত্ব পাবে, অর্থ, যশ না রাজনৈতিক সচেতনতা?’’ উনি দু-মিনিট আমার মুখের দিকে বড়বড় চোখে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর উচ্চকন্ঠে হেসে বললেন, রাজনৈতিক সচেতনতা আর নাটক করতে গিয়ে যশ এলে তাকে তো ফেরাতে পারি না। তারপর একটু থেমে গলাটা খাদে নামিয়ে টিপিকাল উৎপলীয় সুরে বললেন, আর অর্থ না হলে খাবো কি? তারপরই খুব সিরিয়াসলী বললেন, ‘’The work of theatre is ideological, whether it consciously exposes the cause of a class or not, it must willy-hilly, Participate the class struggle of ideas.’’ চা-জলখাবার খেয়ে ওঁনাকে প্রণাম করে উঠে পড়ি।
মৃণাল সেনও উৎপল দত্তের ইন্টারভিউ দুটো তখনকার ‘’ইউথ টাইমস্’’ পত্রিকায় (অধুনালুপ্ত) ছেপে বেরিয়েছিল। আমি দুটো লেখার জন্য পাঁচশো টাকা পেয়েছিলাম। সেটাই আমার প্রথম উপার্জন। দুজন প্রণম্য শিল্প-সংস্কৃতির মানুষের আশীর্বাদই ছিল আমার পাথেয়।
এই সময়েই বাণিক রায় সম্পাদিত ‘’লাপয়েজি’’ পত্রিকার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। ‘’লাপয়েজি’’ আয়োজিত কবিতা পাঠের আসার স্বরচিত কিছু ছড়া পাঠ করার পর, সেই সভার সভাপতি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমাকে প্রশ্ন করেন, ‘’তুই নাটক করিস?’’ আমি বলি কেন পড়াটা নাটকীয় হয়ে গেল? উনি বললেন, না ঠিক ভাবেই পড়া হয়েছে।‘’ এই সভাতেই আমার সঙ্গে প্রখ্যাত ছড়াকার সৃজন সেনের আলাপ হয়, যা পরবর্তীতে গভীর সখ্যে পরিণত হয়। এই সময়ই সূর্য সেন স্ট্রীটে একটা পুরোনো মেস বাড়ির এক তলায় আমার স্কুলের বন্ধু প্রবীরের উৎসাহে আমি, পাড়ার বন্ধু গৌতম, হবু ডাক্তার বিবেকব্রত দাস, এবং ওই মেসের বাসিন্দা অসিত কয়েকদিন নাটকের মহড়া দিই। প্রথমে রবীন্দ্রনাথের ‘’বিনি পয়সার ভোজ’’ ও পরে ব্রেখটের ‘’সম্রাট ও ভিখিরি’’ নাটক দুটি নারকেলডাঙ্গা, বেলেঘাটা ও দমদম কালীচরণ শেঠ লেনে অভিনয় করি। মহড়ার আগে বা পরে ফেভারিট কেবিনের ভিমের চপের স্বাদ মুখে এখনও লেগে আছে।
 
 

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published.