ভাণ পত্রিকা
চল্লিশতম সংখ্যা || একত্রিশতম ই-সংস্করণ || আগষ্ট ২০২৩
সম্পাদক :
সম্পাদনা সহযোগী :
প্রচ্ছদ :
নক্সা পরিকল্পক :
অন্যান্য কাজে :
ভাণ-এর পক্ষে:
পার্থ হালদার
কর্তৃক
৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬
( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )
৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) bhaan.kolkata@gmail.com ( ই – মেল )
Reg. No : S/2L/28241
সম্পাদকের কথা
।। সম্পাদকের কথা।।
।। আগষ্ট ২০২৩।।
আপনি যদি বাসে ওঠেন, ট্রামে চড়েন, মেট্রো কিংবা অটোর লাইনে দাঁড়ান, আর আপনি যদি চালু আধুনিকতার মাথা খেয়ে মানুষের মুখ দেখতে দেখতে যান, আমি নিশ্চিত; অসংখ্য মানুষের মধ্যে হাজার হাজার জোয়ান বেকার দেখতে পাবেন। যাদের অনেকের চোখে ধান্দার দানা দানা ঘাম। সে ঘাম তাদের চোখের দৃষ্টিকে কিছুটা ম্লান করেছে। কেউ শিকারীর চোখ নিয়ে বড়দা কে খুঁজে চলেছে। বড়দারা দেশের চেয়ে বড়। দেশের চেয়ে ভালো। দেশের কাজ দেওয়ার ক্ষমতা নেই, কিন্তু বড়দাদের হাতে কাজ আছে। হোক চুরি-প্রতারনা- রাহাজানির কাজ। তবু কাজ তো। জোয়ান পেশী কাজ চায়। জোয়ান মন চায় উত্তেজনা। আল্লা-ভগবান-গড সব দিলেন। শরীর জুড়ে শিরা- উপশিরা আর বৈদ্যুতিন স্নায়ু। এতো রকমারি হরমোনের হাজারো ইচ্ছা,সাধ এবং স্বপ্ন। শুধু কাজ দিলেন না। তেমন কাজ যে কাজ নাকি রাষ্ট্র মোতাবেক আইনী। অথচ জোয়ান ছেলে-মেয়ে কাজ চায়। শক্তি খরচ না করতে পারলে তাদের খুব কষ্ট। নিজেকে মৃত মনে হয়।
মেট্রোর ঠাণ্ডায় পাশের ষন্ডা মার্কা যুবক দেখতে দেখতে আমি কল্পনা করি সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে ও বোম বেঁধে থাকতে পারে কিনা, ভোট লুটের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে কিনা , নাকি এই চেহারার মধ্যে লুকোনো পুরুষ টা বড্ড কোমল। যদি সে বোম বেঁধেও থাকে, হয়তো ভয়ের ঘামে ওর শরীর সবসময় ভিজে থাকছিল। ওই মেদিনীপুরের মায়ের মতো। এগ্রার সরল বাচ্চাটা জানিয়েছিল, ওর মা বাধ্য হয়ে ওই বোম বাঁধার কাজ করতো। আমরা এতটুকু জানি। তারপর সেই অসৎ ব্যবসায়ীদের কী সাজা হলো আমরা জানি না। জানি না মানে সুমন দে আমাদের জানান নি । মিডিয়াকে জানা আমার ফুরবে না। বছরের পর বছর কেমন রাজনৈতিক খেউড়ে মজে থাকবো, যেহেতু সেই খেউড় আমার হেরে যাওয়া কেরানী-মন কে মস্তি বিলোবে!
আমরা যে ছাত্রীরা ভাঙড় থেকে আসে আমি তাদের গল্প শুনি। কতটা ভয়, কেমন ভয়, কেন ভয় – কল্পনায় ছোঁয়ার চেষ্টা করি। একটা অ্যানিমিক শীর্ণ মেয়ে আমাকে কল্পনা দেয়। ভাবি তেল চিটচিটে বালিশে শুয়ে ও যে মোটামুটি দিন চলে যায় গোছের রোমান্টিক-সংসার এর স্বপ্ন দেখতো,সেটা ও আর দেখার সাহস করে কিনা!
ওর সব মেনে নেওয়ার নেশা ধরে গেছে কিনা! স্বপ্ন দেখাতে রুচি উঠে গেছে কিনা! যাত্রাগাছির এক ছাত্রের কাছে আমি জানতে চাই পড়াশোনাতে সে একটুও মন দেয়না কেন?– ছেলেটি হাসে। বিজ্ঞের মতো হাসে। আমার মাস-মাইনের নিশ্চিত চোখ সে হাসি সইতে পারে না।তবে আমাকে কল্পনা দেয়। আমি শিক্ষামন্ত্রীর কথা ভাবি। শিক্ষা সচিব, উপাচার্য, পর্ষদ সভাপতির নোংরা মনটাকে আমি কল্পনায় দেখতে পাই। গরাদ থেকে ওরাও আমাকে কল্পনা ছুঁড়ে মারে । সে কল্পনায় ভর করে আমি চারপাশে আরোও অসংখ্য নোংরা মানুষকে, চোর জোচ্চোরদের জেলের বাইরে দেখতে পাই। অগনন তারা সংখ্যায়। কল্পনার চাপে আমার ঘুম পায়। কল্পনা ছাপানো বাস্তব ঘুম ভাঙায়। আরও গ্রেপ্তার। ভুয়ো ডাক্তার- মাস্টার- কর্মচারী। বদমাইশ লোভী আচার্য উপাচার্যরা আমাকে ঘুমাতে দেয় না।আমার লজ্জা হয়। কিন্তু ওরা জেলে টিভি দেখে। শারদার শুভেচ্ছা শুভকামনা জানায় আমাদের মিডিয়ার সূত্রে। আমরা মাথা পেতে নিই সে শুভেচ্ছা, ডাকতদের শুভকামনা।স্বপ্নে দেখি, ধর্মতলায় তলিয়ে গেছে ধর্ম। যারা ন্যায্য চাকরির জন্য লড়েই চলেছিল। তারা সব গান্ধীর পায়ের কাছে, লেনিনের পায়ের কাছে মরে পড়ে আছে। ঘুম থেকে উঠে আমি কল্পনা করি। যদি এমন হয়, ওই মৃতদেহ রাষ্ট্রের হয়ে সংস্কার করছি আমরা। সরকারের পাঠানো শোকবার্তা পাঠ করছি তাদের শোকসভায়। শোকও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন। আমি কল্পনা করি, আমার নাতি পিএইচডি টপিকে এসবকে বিষয় করে দেদার প্রশংসা পাচ্ছে এদেশে-ওদেশে।
বোম মারতে এসে একটি বেচারা ছেলে দলছুট হয়। জনতার হাতে ধরা পড়ে। তাকে গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। ধোলাই দিতে সে ছেলে সব বলে দেয়। সরল বিশ্বাসে সে জানায়, সে বোম মারার কাজ নিয়ে সুদূর ক্যানিং থেকে ভাঙড়ে এসেছিল ওমুকের নির্দেশে। ঠিক নির্দেশ নয় পাঁচশ টাকা আর একদিন জমিয়ে বিরিয়ানি যে তার দরকার ছিল না এমন নয়। টিভিতে আমি তার গরুর মতো নিরীহ শান্ত দুটো সুন্দর চোখ দেখি। ও বুঝে উঠতে পারে না ওর অন্যায় কী! মালিকের কথামতো সে কাজ করছে। এতে অন্যায় কোথায়? আমি কল্পনায় দেখি এ তো আমাদেরও এথিক্স। ও তো আইনী কাজ, “মূল্যবান সামাজিক কাজ” প্রত্যাখ্যান করেনি। সরকার কাজ না দিলে, দাদার কাজ করতে হয়। কেননা খিদে পায়, এবং খেতেই হয়। হিরোসিমা বোম ফেলে মাত্র একটি বোমায় যখন লাখো মানুষ কে ঝলসে দিয়েছিলন, পঙ্গু বানিয়ে ছিলেন হাজার হাজার মানুষ কে।এই সর্বনিম্ন সময়ে সর্বাধিক খুন করে কি মনে হয়েছিল সেই মানুষটির? মনে হয়েছিল এক কথা। উনি ওনার চাকরির কর্তব্য করেছেন মাত্র। আমাদের মতো!!
আমি আরও নানা জিনিশ কল্পনায় দেখে নিই। যে ছেলেটি ভোট লুটে করলো। মেশিন নিয়ে দাঁড়ালো। সেই আমার মেয়েকে ওলাতে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দিচ্ছে কিনা । দুর্গা পুজার ম্যারাপ বাঁধছে কিনা। রাত দুপুরে আমাদের জিভ রসনায় পরিতৃপ্তি চাইলে, সুইগি জোমাটো অবতার সেজে কলিং বেল বাজাচ্ছে কিনা। আমি দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি ওরা বুঝতে পারছে, সময়ে সময়ে অন্যায় করতে না পারলে ওরা অতীত হয়ে যাবে। ওরা সমাজে টিকতে গিয়ে কীভাবে কাদের জন্য, কী রহস্যে সমাজ বিরোধী বনে যাচ্ছে কল্পনার ঝাপসা কাটিয়ে আমি দেখবার চেষ্টা করি। আমি আমার সেই যাত্রাগাছির ছাত্রের চোখে যে উপহাস দেখেছিলাম। তার অর্থ বুঝতে পারি। আমাদের বানানো শিক্ষার সিলেবাস, আমাদের ভাড়ামো সে তাচ্ছিল্যের হাসিতে নিয়ে গেছে। প্রত্যাখ্যানের প্রতিবাদে।
আপনারা যারা কল্পনা করেন তারা আমার সঙ্গে অনেকাংশে একমত হবেন। যারা করেন না তারা অভ্যাস করলে এসব ছোট ছোট গল্পের আস্বাদ অনায়াসে পাবেন। কল্পনা ছাড়া সাহিত্য কেন, বিজ্ঞান-ইতিহাস-সমাজ কোনোকিছুই পাওয়ার জো নেই । রবীন্দ্রনাথ আইনস্টাইন এর মতো উচ্চমেধারা সে বচন দিয়ে গেছেন। আমাদের কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের আক্ষেপ ছিল – ” কখনো তোমার করে তোমাকে ভাবিনি” … অন্য কে তার জায়গা থেকে, তার দিক দিয়ে বুঝতে চাওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে দামী কাজ। সে কাজ কবে শুরু হবে!?
যাপিত নাট্যের চতুর্দশ কিস্তি লিখলেন - কুন্তল মুখোপাধ্যায়
কুন্তল মুখোপাধ্যায়
‘শূদ্রায়ণ’ প্রযোজনাটির সঙ্গে আমার এবং সংলাপের অনেক আনন্দ, বিষাদ জড়িয়ে আছে। পশ্চিমবঙ্গ নাট্য একাডেমী সে বছর শূদ্রায়ণের জন্য আমাকে শ্রেষ্ঠ নাট্যকার আর অঞ্জনকে শ্রেষ্ঠ অঙ্গ-বিন্যাসের পুরস্কার দেয়। ইজেডসিসি তাদের বার্ষিক উৎসবে শূদ্রায়ণকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং আঞ্চলিক উৎসবে আমাদের চেন্নাইয়ে অভিনয় করতে পাঠায়। ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্তক ১৯৯৯-এ অস্ট্রিয়ার সজলবার্গ শহরে সজলবার্গ ইউনিভার্সিটিতে ‘রোল অব আর্ট এন্ড রিলিজিয়ান ইন বিল্ডিং কালচার’ শীর্ষক একটা কোর্স ওয়ার্কে আমাকে তিন সপ্তাহের জন্য পাঠায়। পুরো খরচ বহন করেছিল ওই বিশ্ববিদ্যালয়। পরে আমি বার দুই এক ওয়েস্ট ও ইস্ট ইউরোপ ভ্রমণ করেছি। তবে নাটক ও পড়াশোনার জন্য স্কলারশিপ পেয়ে যাওয়ার আনন্দ যে অন্যরকম তা বলাই বাহুল্য। শূদ্রায়ণ নিয়ে অনেক সেমিনার বলেছি। তবে এক্স যাদবপুর, কলকাতা ছাত্র যারা পরে অনেকেই শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের আহ্বানে স্টুডেন্ট হলে একটা আলোচনায় এবং গুরুদাস কলেজে শাঁওলী মিত্রের সঙ্গে আলোচনায় (বন্ধু নৃসিংহপ্রসাদ ও অমিতাভর সৌজন্যে) শূদ্রায়ণ বিষয়ে কথা বলা আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল। আনন্দবাজারে সৌমিত্র বসু, দেশ-এ শেখর সমাদ্দার, টেলিগ্রাফে আনন্দ লাল, আজকালে জ্যোতি চ্যাটার্জি, প্রতিদিনে শ্যামল ঘোষ, গণশক্তিতে পার্থর রাহা শূদ্রায়ণের ইতিবাচক রিভিউ করেছিলেন। সিপিআইএম পার্টির ন্যাশনাল কংগ্রেসে শূদ্রায়ণ আমন্ত্রণ পেয়েছিল। প্রতুল মুখোপাধ্যায় শূদ্রায়ণের প্রশংসা করে গান বেঁধে আমায় পাঠিয়েছিলেন। দেশ-এর রিভিউয়ের পর মল্লিকা সেনগুপ্ত অভিযোগ করেন যে শূদ্রায়ণ ওঁর সীতায়ন-এর নাট্যরূপ। আমি দেশ পত্রিকায় চিঠি লিখে জানাই যে আমাদের লিফলেটছ সোর্স হিসেবে মধুসূদনের বীরাঙ্গনা কাব্য, বি. দি. সানকালার মিথ এন্ড রিয়েলিটি অফ রামায়ণ, কম্বন রামায়ণ (আর কে নারায়ণ অনূদিত) সঙ্গে সীতায়নের উল্লেখ আছে। কিন্তু এই নাটকটি শুধুমাত্র সীতায়নের নাট্যরূপ নয় এমনকি শূদ্রায়ণ শব্দটিও রামশরণ শর্মা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় একটি সেমিনারে উল্লেখ করেন যা তাঁর ‘প্রাচীন ভারতের শূদ্র’ গ্রন্থে উল্লেখিত আছে। তাছাড়া জি.এস. ঘুরে এসে এই বিষয়ে ট্রাইবাল অ্যাবসরপশনের তুলনা করে এর স্বীকৃতি দিয়েছেন। শূদ্রায়ণের অর্থ হল শূদ্র হওয়ার পদ্ধতি, অনার্যদের আর্য জাতে তুলে নিয়ে আসার এক পদ্ধতি। শ্রদ্ধাভাজন শঙ্খ ঘোষ, মাস্টারমশাই বিষ্ণু বসু, মনোজ মিত্র, দর্শন চৌধুরী, অনিল আচার্য সব্যসাচী দেব এবং আরো অনেক মানুষজন আমায় সমর্থন দেন। তবু খারাপ লাগে এমন একটি বিতর্কের জন্য। মল্লিকার লিঙ্গ নির্মাণ ভিত্তিক লেখা আমার খুবই পছন্দ। প্রয়াত কবিকে সম্মান জানাই ১৯৯৮ থেকে ২০০১ অবধি শূদ্রায়নের বিভিন্ন অভিনয় আমাকেও সংলাপকে সমৃদ্ধ করেছে সে-বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। শূদ্রায়ণের অভিনয়ের মাঝে অনেক অনেক মজার ঘটনা আছে। একবারে শুরুতে উৎপল যখন খাবার নিয়ে আসতো তখন ‘খাদ্য এসেছে’ বলতে বলতে সকলে বুভুক্ষ জনতার মত একটা হৈ হৈ হাহাকার করে এগিয়ে যেত। যদিও তার মধ্যে একটা ডিসিপ্লিন থাকতো। প্রত্যেকদিন দীপক বিতানদাকে কাঁধে তুলত আর উইংয়ের বাইরে আমি টেনশন করতাম। একদিন একাডেমী মঞ্চে দীপক পা পিছলে পড়লে, বিতানদার দাঁত ভাঙলো। প্রণবদা আর তিতলিকে (কথাকলি) পিঠে নিয়ে মানিক রথ হয়ে আসতো। রনোর কাজ ছিল কুটির নিয়ে দর্শকের আড়ালে বসে থাকা। তখন দীপক পিছন থেকে ওকে চিমটি কাটতো, কিন্তু বেচারা নড়তে চড়তে পারত না। তবে মঞ্চ মায়ার সব অপরূপ ছবি তৈরি হতো। সুরঞ্জনা ছদ্মবেশে মাটির পাত্র ফেরি করতে এসে, হাতে আয়নার মুদ্রা করে নিজের কামাবলির রূপের প্রকাশ ঘটাতো, আর সীতার বিস্ময় ভরা মুখের সামনে নারী স্বাধীনতা নিয়ে একটি ডিসকোর্স তৈরি করত। বাঁকুড়ায় শো করতে গিয়ে প্রচন্ড ঠান্ডায় মানিকের শাল গায়ে মঞ্চে ঢুকে পড়া ও সবার অজান্তে সেটিকে শরীর থেকে খুলে পিছনে ছুঁড়ে ফেলা। শূদ্রায়ণের প্রচুর শো হয়েছে শহরতলীতে। বাঁকুড়ার ওন্দা যখন আমাদের বাস ঢুকছে তখন শুনিই ঘোষণা হচ্ছে, ‘এসে গেছে এসে গেছে কলকাতার বিখ্যাত দল সংলাপ, নাটক শূদ্রায়ণ, শ্রেষ্ঠাংশে কুন্তল কুমার। তখন আমি শংকরকে কুন্তল কুমার সাজিয়েছি। আবার বীরনগরে যাত্রার মঞ্চ, রনো (দুন্দুভি) মারা যাওয়ার পর কীভাবে বের হবে? আমি যাত্রার আঙ্গিকের কথা মাথায় রেখে বললাম, ভল্লর আঘাতটা হাত দিয়ে ঢেকে আর্তনাদ করতে করতে বেরিয়ে আয়। বহরমপুরে আমি আগের দিন গিয়েছি। সেমিনারে বলেছি পরের দিন। দল আসতে গিয়ে বাস অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। তাও পরিতোষদা, প্রণবদা, হরদের প্রচেষ্টায় বেলা চারটে বাস এলো। আধ ঘন্টা রেস্ট নিয়ে ঠিক দেড় ঘণ্টায় সেট লাইট লাগিয়ে মেকআপ শেষ করে হাউসফুল শো ভালোভাবে উৎরে দিলে ছেলে-মেয়েরা। বাংলাদেশ যাওয়ার সময় হিলি বর্ডার দিয়ে যেতে হল, বন্যার কারণে পেট্রোপল বন্ধ ছিল সেখানে মাঝ রাস্তায় নেমে পুকুরের চান। বর্ডারের লোকজনদের সঙ্গে মজা করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়লাম। দলে সুরঞ্জনা, চুমপা ছাড়া সৌমিতা, মৌসুমী, সাথী, এনা (ওরা সবাই তখন সদ্য কিশোরী)। ওদের বলা ছিল সব সময় আমার বা বড়দের সঙ্গে থাকবি। হিলি বর্ডারে একজন আমায় বলেছিল, ‘কর্তা এই চারখান সুন্দরী কন্যা আপনার মাইয়া?’ আমি গম্ভীর বাবার মত মাথা নেড়ে বললাম হ্যাঁ। আসলে তখন এই ছোটদের দলের কাছে আমি সত্যিই বাবার মত হয়ে উঠেছিলাম। বাস ছাড়ার সময় সৌমির মাছ বলে চেঁচিয়ে ওঠা, আর সবার সমস্বরে বলে ওঠা, সমবেত গানের মাঝে বিতানদার ‘ভালো হচ্ছে ভালো হচ্ছে’ বলে নেচে ওঠা এখনো চোখে ভাসে। শূদ্রায়ণে আমরা অনেক মানি গুণী লোকের প্রশংসা পেয়েছে। নাটকের লোকের বাইরে অন্নদাশঙ্কর রায়, সলিল চৌধুরী, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্যামল চক্রবর্তী, সুভাষ চক্রবর্তী, অমল দত্ত, দীপেন্দু চক্রবর্তী, চিন্ময় গুহ, নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি, পবিত্র সরকার, শমিক বন্দ্যোপাধ্যায় খুব প্রশংসা করেছিলেন। নাটকের শ্রদ্ধাভাজন বিভাসদা, অরুণদা, অশোকদা, নীলকণ্ঠদা, তড়িৎদা, অসিত মুখার্জিদা, মেঘনাদদা, দ্বিজেনদা, দেবাশিসদা ঊষাদি, সোহাগদি, বন্ধুদের মধ্যে সংগ্রাম, রমা, বুলু, প্রকাশ, গৌতম, হরিমাধবদা আরো অযুত মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। এই সবই আমাদের পথ চলার পাথেয়। তবে বিতর্কও হয়েছে, সে প্রসঙ্গে পরের বার।
দর্শককে ভাবাবে নীরজের 'খাকি : দ্য বিহার চ্যাপ্টার'
‘খাকি : দ্য বিহার চ্যাপ্টার’-এর পরিচালক ভব ধুলিয়া। প্রযোজক শীতল ভাটিয়া। ফ্রাইডে স্টোরিটেলর্স-এর ব্যানারে প্রযোজিত হয়েছে সিরিজটি। করণ ট্যাকার, অবিনাশ তিওয়ারি, অভিমন্যু সিং, যতীন সর্ন, রবি কিষেন, আশুতোষ রানা, নিকিতা দত্ত, ঐশ্চর্য সুস্মিতা ও অনুপ সোনি অভিনয় করেছেন ‘খাকি : দ্য বিহার চ্যাপ্টার’-এ।
রকি অঔর রানি কী প্রেমকাহানি, বলিউডি ধামাকা এবং ২০২৩-এও কিছু জরুরি পয়েন্ট অব ভিউ ~ বিতান দে
এন্টারটেইনমেন্ট, এন্টারটেইনমেন্ট এবং এন্টারটেইনমেন্ট… এই প্রচলিত কনসেপ্টের আওতাভুক্ত করণ জোহর ও তাঁর সিনেমা; এমনটা সিনেমা দেখনেওয়ালা অনেক দর্শকই মনে করেন। করণ জোহরের সিনেমা নির্মাণ ও চলচ্চিত্র দর্শন নিয়ে ফিল্ম স্টাডিজে তাত্ত্বিক আলোচনার জায়গা নেই বলেই কারও কারও ধারণা।
তাঁরা ঠিক কী ভুল, জোহর সাহেবকে নিয়ে সেইসমস্ত আলোচনার প্রেক্ষিত ভিন্ন, তবে এন্টারটেইনমেন্ট বিষয়টা নিয়ে প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা চলে, করণ জোহর মানে একদম ‘টিপিকালি বলিউডি সিনেমা’ বলতে যা বোঝায়, তা থেকে দর্শকরা বঞ্চিত হবেন না। দর্শক আলাদা আলাদা, তাই তাদের সিনেমার স্বাদও আলাদা আলাদাই হবে এবং করণ জোহর সেইসমস্ত টার্গেট অডিয়েন্সের কথা ভেবেই ফিল্ম তৈরি করেন।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, একটা বাণিজ্যিক সিনেমার ভিতর গোটা ভারতীয় সমাজের খুঁটিনাটি বিষয়কে তুলে ধরার প্রচেষ্টা করাটা মোটেই খুব সহজসাধ্য নয়। করণ জোহর নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন, তাই তিনি গালি বয় বা গুলাল তৈরির প্রচেষ্টা করেন না, বরং তিনি নির্মাণ করেন রকি অঔর রানি কী প্রেম কাহানি।
আদ্যন্ত গোটা সিনেমা জুড়ে হুল্লোড় এবং হাসির ফোয়ারা হলজুড়ে, আর তার মাঝেমাঝেই চাবুকের মতন কিছু প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া। ধনলক্ষ্মীদের বিপুল লাড্ডু বিক্রির ব্যবসা মিসেস ধনলক্ষ্মীকে কেন্দ্র করেই চলতে থাকে। তাঁর কথাই শেষ কথা। একজন মহিলা হয়ে তিনি কোনোদিনই পরিবারের অন্য মহিলাদের কথা ভাবেননি। তাঁদের পারিবারিক ঐতিহ্য মহিলাদের কোনো স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না।
তিনি নিজেও সেই স্বাধীনতা পাননি ফলত অন্যরাও তা থেকে বঞ্চিত হবেন এমনটাই বিশ্বাস করেন মিসেস ধনলক্ষ্মী। এই পরিবারেই একেবারে ছন্নছাড়া সৃষ্টিহারা গোছের ক্যারেক্টার রকি। পড়াশোনা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো বালাই নেই তার। নাচ-গান-জিম-পোশাক-দামি গাড়ি, এইসব নিয়েই বংশের খাড়া করা ইমারতে রকির বিলাসী জীবন।
কিন্তু বংশের ইজ্জত রাখতে হলে বৌ হতে হবে ফর্সা; এই ধারণার বাইরে কোনোদিন যেতেই পারে না রকির পরিবার। রকির বাবা মি. তিজোরির ধারণাও পুরোপুরি ব্যবসাকেন্দ্রিক। পুরুষমানুষের আবার আবেগ-অনুভূতি কীসের? তাই নিজের অসুস্থ বাবার কাছে তিজোরিকে ঘেঁষতে দিতেন না মিসেস ধনলক্ষ্মী। তিনি নিজেও তাঁর অসুস্থ স্বামীর কবি প্রতিভা আর অনুভূতির জগৎকে প্রশ্রয় দেননি। ব্যবসার ভিতর এইসব ঠুনকো অনুভূতির কোনো জায়গা নেই।
এহেন রকি তার অসুস্থ ঠাকুর্দার কথায় কোনো এক যামিনীর প্রসঙ্গ শুনতে পায় আর তাঁর ছবিও খুঁজে পায় ঠাকুর্দার ডায়ারিতে। যামিনীর সন্ধানেই আলাপ হয় রানির সঙ্গে এবং প্রায় দেখার সঙ্গে সঙ্গেই রকি প্রেমে পড়ে রানির। তারপর জানা যায় যামিনী হল রানির ঠাকুমা। কোনো এক কবি সম্মেলনে সেই যামিনীর সঙ্গে রকির ঠাকুর্দার আলাপ হয়েছিল এবং তারপর আস্তে আস্তে তৈরি হয়েছিল এক গাঢ় ভালোবাসা। কিন্তু দুজনের কেউই নিজেদের পরিবার এবং আমাদের সমাজকে অস্বীকার করে বেরিয়ে আসতে পারেননি।
রকি এবং রানি এই দুজনের মধ্যে আবার এক মেলবন্ধন তৈরি করে দেবে এবং নিজেরাও এক গভীর প্রেমের ভিতর এগোতে থাকবে। তবে সবটাই কি এত সহজে সম্ভব? কীভাবেই বা দুজনের পরিবার এই সমীকরণকে মেনে নিতে পারে? স্বাভাবিকভাবেই সেই সমীকরণ অনেক জটিল এবং প্রত্যেকটা স্তর করণ জোহর তাঁর এই বাণিজ্যিক সিনেমার ভিতর তুলে ধরেছেন। সব খুঁটিনাটি বলে দিলে সিনেমার গোটা গল্পটাই বলা হয়ে যায়, তাই সেই বিষয়ে আর বিশদে কিছু বলব না, তবে কিছু জায়গা অবশ্যই আলাদা করে বলতে হয়।
বিয়ের আগে ছেলে, মেয়েদের বাড়িতে গিয়ে থাকবে এবং মেয়ে গিয়ে থাকবে ছেলের পরিবারে; এই ধারণা ২০২৩-এর ভারতের সমাজেও সচরাচর হয়ে উঠবে না। সেই ধারণাকে সিনেমায় কেবল বাস্তবায়িত হতে দেখা যায়নি, তার সঙ্গে জুড়ে গেছে আরো শাখা-প্রশাখা। মেয়েদের অন্তর্বাসের দোকানে একটি ছেলে যাচ্ছে, যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই অন্তর্বাসের মাপ নিতে তার অস্বস্তি হচ্ছে অথচ দিনের পর দিন ছেলেদের অন্তর্বাস কেচে, ধুয়ে শুকাতে দেয় মেয়েরা। এটাই যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কেন হয়ে উঠেছে এই অভ্যাস? কেবলমাত্র পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বলে? লাড্ডুর অ্যাডে কেবল মেয়েরা থাকবে কারণ সনাতন অভ্যাস বলে, ছেলেরা ঘর-গৃহস্থালির কাজে বিশেষ হাত লাগাবে না। ২০২৩-এর ভারতবর্ষেও এই ছবির বিশেষ ব্যতিক্রম ঘটতে দেখা যায় না। নাচের অভ্যাস নিয়েও এইরকম কিছু সনাতনী ধারণা আমাদের সমাজে বদ্ধমূল হয়ে আছে। নাচের অধিকারী মেয়েরা, পুরুষরা নাচের অভ্যাস বা স্কুল তৈরি করলে সমাজ তাকে এখনও ব্রাত্য হিসেবেই গণ্য করে। ছেলেরা নাচলে নাকি ‘মেয়েলি’ হয়ে যায়! আবার ছেলেরা শিক্ষাগত যোগ্যতায় পিছিয়ে আছে, পড়াশোনা করে ডিগ্রি অর্জন করছে না, এও কী সম্ভব! এইরকম নানান বাইনারিতে বিভক্ত এবং ক্ষতবিক্ষত ভারতের সমাজ। পুরুষতান্ত্রিক আবহে নারী-পুরুষ বিপরীত যুগ্মক; এই ধারণা যেখানে এখনও বদ্ধমূল সেখানে ২০২৩-এর নিরিখে মেইনস্ট্রিম বলিউডি সিনেমায় এই সমস্ত প্রশ্নগুলোকে সিনেমার বিভিন্ন স্তরে দর্শকদের সামনে হাজির করাটা যথেষ্ট তারিফযোগ্য।
এই সমস্ত বিষয়-বিন্যাস নিয়েই ধামাকেদার ফিল্ম রকি অঔর রানি কী প্রেমকাহানি। অভিনয় নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার নেই, সকলেই এক কথায় লা জবাব। রনভীর সিং নিজের চরিত্রে প্রায় ১০০ শতাংশ ঢুকে পড়তে পারেন, এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। আলিয়া ভাট এক কথায় দুর্দান্ত, যতক্ষণ সিনেমার পর্দায় ছিলেন, সমস্ত ফোকাস নিজের দিকে ধরে রাখতে পেরেছিলেন। শাবানা আজমী, জয়া বচ্চন, ধর্মেন্দ্র প্রমুখের কথা আলাদা করে বলার নেই। বিশেষ করে বলতে হয় টোটা রায়চৌধুরী এবং চূর্ণী গাঙ্গুলির কথা। তাঁরা যতটুকু চরিত্রে ছিলেন, একেবারে উপযুক্ত ভাবে সেই চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। অন্যান্য চরিত্রে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা প্রত্যেকেই পিকচার পারফেক্ট। ঈশিতা মৈত্র, শশাঙ্ক খয়তান এবং সুমিত রয় এক অসাধারণ গল্প তৈরি করেছেন। নাচের প্রত্যকটি দৃশ্য এবং কোরিওগ্রাফি বড়ো পর্দায় অসাধারণ ফুটে উঠেছে। সিনেমার প্রত্যেকটি গান সুর এবং কথায় আমার মতন দর্শককে মুগ্ধ করেছে। প্রীতম প্রায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে মিউজিক ডিরেকশনে। তা সবমিলিয়ে আমার মতন সিনেমা অ-বোদ্ধা দর্শককে আনন্দ দিতে পেরেছেন করণ জোহর। ভাবিয়েছেন, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন অনেককিছুকেই। ২ ঘণ্টা ৪৮ মিনিটের দীর্ঘ চলচ্চিত্রও একবারের জন্য মনোটোনাস মনে হয়নি। হোয়াট আ কামব্যাক বলিউড!
‘কলকাতার গালগপ্পো’-এর প্রথম পর্ব লিখলেন - কিশলয় জানা
।।কলকাতার গালগপ্পো।।
পর্ব ১
অলিনগর, কলিকাতা
কলকাতা নিয়ে আবার একটি সিরিজ দেখে সহৃদয় পাঠককুল আতঙ্কিত হয়ে পড়বেন বুঝতে পারছি। নেই নেই করে কলকাতা নিয়ে আজ অবধি কম জন তো লিখলেন না। একটি শহর, যার কৌলীন্য নেহাতই হাল-আমলের, তার আগে সে ছিল জলা-জঙ্গল, বাঘ-সাপ-হাতি ইত্যাদি পরিবৃত সুন্দরবনের নিতান্ত এক টুকরো, তাকে নিয়ে ঐতিহাসিক- অনৈতিহাসিকদের অনুমান-প্রমাণ ও কৌতুহলের শেষ নেই। ফলে টুকরো প্রবন্ধ থেকে খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত আস্ত গ্রন্থমালা—সবারই এক লক্ষ্য—কলকাতাকে ধরতে চাওয়া। সে কত প্রাচীন, তার এমন নামটিই বা কী করে হল, তার ভূপ্রাকৃতিক চেহারাই বা আদতে কীরকম ছিল, তার নির্মাতা কে—ইত্যাদি আরো অনেক কিছু। অধম সেই ধারায় নবতম সংযোজন নয়, সে-পাণ্ডিত্যও আমার নেই। নিতান্ত না-বললেই নয়, এমন কিছু চর্বিতচর্বণ এবং কিছু কিছু ভুলে যাওয়া কথা ও কাহিনির পুনঃকথনের মধ্যে দিয়ে আমরা আসলে কলকাতাকে নিয়ে গপ্পো করতে বসেছি। পাদটীকার দায়হীন, পাণ্ডিত্যের ভারহীন বিশুদ্ধ গালগপ্পো।
কলকাতা যে কত প্রাচীন, সে-বিষয়ে নানা মুনির নানা মত ; ঠিক যেমন তাঁরা একমত নয় “কলকাতা” নামটি কোথা থেকে এল, সে-বিষয়ে। আমরা আগেই বলেছি, পণ্ডিতি প্রবন্ধের লেশমাত্র চিহ্ন এখানে থাকবে না, অতএব সরাসরি বলা যায় যে, কলকাতা কত প্রাচীন—সে-বিষয়ে নিঃসংশয়াতীত ভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে আজ থেকে হাজার পাঁচ বছর আগে না ছিল কলকাতা, না ছিল গোবিন্দপুর-সূতালুটি। কারণ, তখন কলকাতা ছিল বিস্তীর্ণ সুন্দরবনের অংশ এবং সুন্দরী গাছের জঙ্গলে আকীর্ণ, সাপ-বাঘ-হাতি ইত্যাদির স্বাভাবিক বাসস্থান। কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় মাটি খুঁড়ে যেমন কার্জন পার্ক, শিয়ালদা স্টেশন, ঢাকুরিয়া লেক থেকে হাল আমলের সল্ট লেক পর্যন্ত সর্বত্রই জলে ডোবা সুন্দরী গাছের শিলীভূত কাণ্ড ইত্যাদি পাওয়া গিয়েছে। অতএব কলকাতার অস্তিত্ব অনেক পরের ঘটনা। তাছাড়া যে যতই গা-জোয়ারি অনুমান-প্রমাণ করুন না কেন, কলকাতার প্রাচীনত্ব নিয়ে বলতে গেলে স্বীকার করতেই হবে যে, সমুদ্র ধীরে ধীরে সরে যাওয়ায়, পরিত্যক্ত অংশে বসতি স্থাপিত হয় এবং একটি জনপদ গড়ে ওঠে।
কলকাতা যে আদতে পরিত্যক্ত সমুদ্র-খাঁড়িতে গড়ে উঠেছে তার প্রমাণ, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কলকাতার নিম্নতলে অবস্থান। ষষ্ঠ শতাব্দীতে লেখা বরাহমিহিরের ‘বৃহৎ সংহিতা’তে বাংলার নিম্নভাগকে “সমতাতা” বলা হয়েছে, যার অর্থ সমুদ্রপৃষ্ঠ। তখনও এ-অঞ্চলে কোন জনপদ গড়ে ওঠা কার্যত অসম্ভব। তাছাড়া জোব চার্ণকের মৃত্যুর ( ১৬৯৩ ) পাঁচ বছর পর ( ১৬৯৮ ) ইংরেজরা ডিহি গোবিন্দপুর-সুতালুটি মৌজার সত্ত্ব লাভ করে, তার প্রমাণ পাওয়া গেলেও বাদশাহী ফরমানে কলকাতা নাম অনুপস্থিত ছিল। ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জুনের আগে কোন দলিল বা চিঠিপত্র কিংবা বাদশাহী ফরমানে ‘কলকাতা’ নামের অনুপস্থিতি দেখে অনুমান করা অসঙ্গত হবে না যে, হয় তখনো ‘কলকাতা’ নামের জনপদটি এতই ক্ষুদ্র ছিল যে, তা কোম্পানির হাতে এলেও আলাদা করে উল্লেখ করা হয় নি দলিলে। একইসঙ্গে ওই ক্ষুদ্র জনপদের হাল-হকিকত দেখে প্রাথমিকভাবে কোম্পানি সূতানুটিতেই তাদের কার্যালয় স্থাপনের কথা ভেবেছিলেন। সেই কারণেই ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ মার্চ অবধি ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির আঞ্চলিক কার্যালয়ের ঠিকানা ছিল সূতানুটি। ৮ জুনের পর তা ‘কলকাতা’ হিসেবে উল্লেখিত হতে থাকে। তবে কি, কলকাতা নামক অংশটিতে তেমন লোকবসতি না থাকায়, সেখানে নিজেদের মতো করে কেল্লা নির্মাণ এবং বসতি গড়ে তোলা সহজ ছিল বলে কোম্পানি সেই স্থানেই সরে আসে ? সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিকে যথাস্থানে অনুমতি নিয়ে পাকা কুঠিবাড়ি তৈরি করেছিল ইংরেজরা। ফোর্ট উইলিয়মের সেই কুঠিবাড়ির চারদিকের জলবায়ু ছিল বিষাক্ত। ফোর্ট উইলিয়মে আসা ইংরেজদের সিংহভাগেরই কিছুদিনের মধ্যে আশ্রয় হতো নিকটবর্তী সিমেট্রিতে। বিশপ হ্বেবার তো ১৮৩০-এ এসেও চৌরঙ্গীর নিকটবর্তী জঙ্গলে হাতির দেখা পেয়েছেন। অতএব অষ্টাদশ শতকের কলকাতা যে নিতান্তই নাবালক মাত্র, সে-ব্যাপারে অনুমান করাই যায়।
১৫৯৬ খ্রিষ্টাব্দে লেখা আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে কলকাতার নাম রয়েছে বলে জানা যায়। এটি ছিল আদিতে টোডরমল্ল কর্তৃক প্রস্তুত বাংলার জমি জরিপের বিবরণ “ওয়াশিল-ই-তুমার’-এ। ধরে নেওয়া সঙ্গত যে তখন কলকাতা নামক অঞ্চলের অস্তিত্ব ছিল, তবে তা সমৃদ্ধ জনপদ ছিল না কি জঙ্গলাকীর্ণ পাণ্ডববর্জিত স্থান ছিল—তা জানার উপায় নেই। তবে, সন্দেহ নেই, এই উল্লেখ কলকাতার প্রাচীনত্বের পরিচয় বাহী। অনেকে ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যের কোন কোন পুথির দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বলেন, ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত কাব্যে আরো নানা স্থানের সঙ্গে “কলিকাতা এড়াইল বেনিয়ার বালা”-র উল্লেখ প্রমাণ দেয় কলকাতার প্রাচীনত্বের। এখন ‘চণ্ডীমঙ্গল’ আনুমানিক ওই সময়ে রচিত হলেও, পুথির লিপিকার আধুনিক কি না সে-বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তাছাড়া কলকাতা যদি তখন থেকেই কালীক্ষেত্র হত কিংবা অন্য সূত্রী মহিমাব্যঞ্জক হত, তাহলে তাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোন প্রশ্নই ছিল না। কিন্তু যাঁরা মনে করেন, কালীক্ষেত্র শন্দ থেকে কলিকাতা এসেছে, কালীঘাটের কালীই হচ্ছেন কলিকাতার আদি-দেবতা, তাঁরা সম্ভবত ভুলে যান যে, তেমন হলে বেনিয়ার পক্ষে কলিকাতা এড়িয়ে না গিয়ে সেখানে নেমে দেবতার আশীর্বাদ প্রার্থনা করা সঙ্গত ছিল, বিশেষ করে বাণিজ্য যাত্রার প্রারম্ভে। আমাদের মনে হয়, শাল্কে কিংবা চিৎপুর কিংবা কলকাতা এড়িয়ে যাওয়ার অর্থ এখানকার অস্বাস্থ্যকর জলবায়ু এড়িয়ে থাকার প্রাণান্তকর চেষ্টা। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেও এই অঞ্চলের অস্বাস্থ্যকর জলবায়ুর কারণে প্রচুর মানুষের মৃত্যু ঘটত। মশা-মাছি-ম্যালেরিয়া—এই তিনের সঙ্গে কলকাতায় বেঁচে থাকার যে দুঃখের কথা লোকমুখে প্রবাদে পরিণত হয়েছিল, তা থেকেই আগের সময়ে কলকাতার স্বাস্থ্য কেমন ছিল তা সহজেই অনুমেয়।
আমরা কিন্তু ‘কলকাতা’ নামক অঞ্চলের অস্তিত্ব ইতিপূর্বে ছিল—সে বিষয়ে সন্দিহান নই। আমাদের বক্তব্য এই যে, কলকাতা নামক অঞ্চলটিতে তখন মনুষ্য বসবাস করতে, না কি করত না ? ইংরেজরা এসে যে কলকাতার শ্রীবৃদ্ধি ঘটালেন নিজেদের স্বার্থে, জঙ্গলের পর জঙ্গল রাতারাতি গায়েব হয়ে গেল, কাঠগুলি চলে গেল দেশের না বিদেশের কোন্ আড়তে, তা আমাদের জানা নেই, কিন্তু তাদের হাত ধরে কলকাতার ইকোসিস্টেম যে বদলে গেল, তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। এককালে যে কলকাতা ছিল সমুদ্রের অংশীভূত অঞ্চল, যার মাটির তলায় ১৮ ফুট থেকে ৩৫ ফুট খননের ফলে পাওয়া গিয়েছে পিট ( গাছপালার অবশিষ্টাংশ, যা কয়লায় রূপান্তরের প্রাথমিক পর্য্যায় বলা চলে ), পুরানো শামুক, ঝিনুকের আস্তরণ, সামুদ্রিক গাছপালার অংশাবশেষ ; পরে সেই কলকাতার কাছ থেকে সমুদ্র দূরে সরে যাওয়ায় ধীরে ধীরে দ্বীপভূমি গড়ে উঠেছিল এবং সম্ভবত প্রতিকূল পরিবেশ হওয়া সত্ত্বেও কোন এক সময় মানুষেরা এখানে এসে বসবাস করতে শুরু করে। এর একটা প্রমাণ হিসেবে কেউ কেউ উল্লেখ করেন, জলাভূমিতে যে হাজার বছরের পুরানো ধান গাছের ফসিল পাওয়া গিয়েছে, তার দ্বারাই মনে করা যায় যে, একসময় প্রাচীন মানুষেরা, যারা কৃষিকাজ জানত, তারা কলকাতা নামক অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করে। তবে কলকাতায় না বসবাস করে করুক, তার পার্শ্ববর্তী গোবিন্দপুর-সূতানুটিতে যে মানুষ বসবাস করতে, সে-বিষয়ে আমরা নিঃসংশয়াতীত। পরবর্তীকালে জঙ্গল ঘনীভূত হয়ে উঠলে হাতি, কৃষ্ণসার হরিণ, এমনকি শিং-যুক্ত রাইনোর অস্থিও পাওয়া গিয়েছে। বাঘ তো ময়দান অঞ্চলে এই উনিশ শতকের গোড়ার দিকে দেখা মিলেছে। ওয়ারেন হেস্টিংস অবশ্য তার আগেই হাতির পিঠে চড়ে আজকের ময়দান অঞ্চলে তখন যে জঙ্গল ছিল, সেখানে বাঘ শিকার করে সব বাঘেদেরই সাবাড় করেছিলেন। কলকাতার জীববৈচিত্র্য এ ভাবেই হারিয়ে গিয়েছে তার স্বাভাবিক গাছপালার সঙ্গে সঙ্গে।
একটা কথা বলি, কলকাতার কিন্তু চিরকালই এক নাম ছিল না। মাঝখানে তার নাম হয়েছিল— হসন ও হুষয়ন্–মহরম্-খ্যাত এই দুই ভাইয়ের পিতা চতুর্থ খলিফা অলীর নামানুসারে অলিনগর, অপিচ আমাদের বাংলা উচ্চারণে আলিনগর। রেখেছিলেন সেই এক ও অদ্বিতীয় সিরাজদৌল্লাহ্। সে একটা কাণ্ড বটে ! মোগল বাদশাহের ফরমান বলে ইংরেজরা তখন মুর্শিদাবাদের নবাবদের প্রায় উপেক্ষা করে ধীরে ধীরে কলকাতাকে কেন্দ্র করে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি করছিল। তখন অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধের প্রায় শেষ দিক। অনেক আগে থেকেই, সেই ১৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট্ ফারুকশিয়রের দস্তখত করা ফরমান-বলে তখন থেকেই কলকাতায় নিজেদের প্রায় স্বাধীন ও স্বতন্ত্র জমিদারী পত্তন করেছিল তারা। প্রথমত তারা বেশ পাকাপোক্ত কেল্লা তৈরি করে তার চারদিকে গড়খাই কেটে বড় গাঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে ফেলেছিল। এতেও রক্ষে ছিল, কিন্তু তারা করল কী, মুর্শিদাবাদ থেকে নবাবের রোষে কিংবা অন্য কোন কারণে শাস্তিপ্রাপ্ত পলাতক প্রজাদের নিজেদের অধিকৃত কলকাতায় বসবাসের ব্যবস্থা করে দিল। এমনকি বাদশাহী আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেদের আইন মোতাবেক বিচারের জন্য মেয়ার্স কোর্ট পর্যন্ত চালু করে দিয়েছিল তারা। তার উপর ঢাকার খাজনা-সহ পলাতক রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাসকে অপরাধ করছে জেনেও নিজেদের এলাকায় আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু যেদিন তারা বাদশাহী ফরমানের জুজু দেখিয়ে কোম্পানির বাণিজ্যের পাশাপাশি নিজেদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যও বিনা শুল্কে করতে লাগল, সেদিন সিরাজের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল একেবারে। প্রথমে কাশিমবাজারে ইংরেজদের যে কুঠি ছিল তার কুঠিয়াল ওয়াট্স্কে ধরে আনা হল, এবং তিনি নবাবের পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলে, তাঁকে শর্ত সাপেক্ষে ছেড়ে দেওয়া হল। তার মধ্যে তিনটি হল—নবাবের পলাতক প্রজাদের স্থান না দেওয়া, কলকাতায় তৈরি করা কেল্লা ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া এবং পুরানো আইন মোতাবেক মাশুল দিয়ে ব্যবসা করা। নবাবের সামনে বেকায়দায় পড়ে ওয়াট্স্ মেনে নিলেও বাস্তবিক পরে তা তাঁরা উপেক্ষা করলেন। ফলে ক্রুদ্ধ সিরাজ কলকাতা আক্রমণ করে ইংরেজদের এমন তাড়া দিলেন যে, তারা ফলতায় পালিয়ে গিয়ে কোনমতে প্রাণে বাঁচল। তখনই সিরাজ কলকাতার নতুন নাম দিলেন—অলীনগর। ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জুন সিরাজ কলকাতা দখল করেন এবং ২১ জুন ফরমান জারি করা হল প্রকাশ্য রাজপথে ‘টম্ টম্’ বাজিয়ে যে, এখন থেকে এই স্থানকে আর ‘কলকাতা’ বলা যাবে না, বলতে হবে ‘অলীনগর’। এই নামটিই বহাল থাকবে দলিল-দস্তাবেজ-দানপত্র থেকে সর্বত্র। অবশ্য নামটির আয়ু ছিল মাত্র সাত মাস মতো। পরের বছরেই ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়ায় নবাবের সঙ্গে ক্লাইভের নতুন চুক্তিতে শেষবার অলীনগর নাম উল্লেখিত হল, তারপর আবার সে পুরানো নামেই ফিরে গেল—কলকাতা। যার সম্পর্কে নানা গালগপ্পো শুনবো আমরা আগামী পর্ব থেকে।
(চলবে )