ভাণ পত্রিকা
চুয়াল্লিশতম সংখ্যা || চৌত্রিশতম ই-সংস্করণ || জানুয়ারি ২০২৪
সম্পাদক :
সম্পাদনা সহযোগী :
প্রচ্ছদ :
নক্সা পরিকল্পক :
অন্যান্য কাজে :
ভাণ-এর পক্ষে:
পার্থ হালদার
কর্তৃক
৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬
( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )
৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) bhaan.kolkata@gmail.com ( ই – মেল )
Reg. No : S/2L/28241
সম্পাদকের কথা
।। সম্পাদকের কথা।।
।।জানুয়ারি ২০২৪।।
ছোটবেলায় আমাদের গ্রামে যাত্রা হত। চরিত্রাভিনেতার মন আবেগাপ্লুত হলে সুর লাগিয়ে স্বরকে দীর্ঘতম করে এককথা তিনবার বলার রেওয়াজ ছিল। তার সঙ্গে কনসার্ট পার্টির প্যা প্যা প্যা প্যা— সে হৃদয় মোচড়কে করে তুলত অনির্বচনীয়। চিৎপুরের যাত্রা এখন সে বাড়াবাড়িকে কমিয়ে আনলেও টিভি সিরিয়াল- সুন্দরীর হিংসা, অপমান, ফান্দে-পড়া ইত্যাদিতে উচ্চস্বরে ব্যাকগ্রাউণ্ড স্কোরে ‘ধুম-তা-না-না-না’— আসলে সেই ফেলে আসা ‘যাত্রা’-এর ডিজিটাল প্রকাশ। কিন্তু এহ বাহ্য। খবরের চ্যানেকেও উচ্চগ্রামের আলোঝলমলে বাজনা-বাদ্যিতে ভরপুর সে যাত্রাপালার উত্তরাধিকার মনে হচ্ছে! সংসারের সবচেয়ে তুচ্ছ ঘটনাকে বড় করে দেখানো আর ভয়ংকর ভয়াল যুদ্ধের মতো, দাঙ্গার মতো নিষ্ঠুরতাকে পলকা করে উপস্থাপন সমাজের পক্ষে বিপদসংকুল। এবং সে উপস্থাপনায় মানবসভ্যতার লেলিহান লোভকে না দেখিয়ে, তাকে জাতীয়তার স্বাভাবিক প্রকাশ বলে দেখানো অমার্জনীয়— মোটের ওপর তাই দেখাচ্ছে সর্বত্র। মোটের ওপর তাই গিলছে সাধারণ মানুষ।
একটি শিশু বিকেলে একটা বল চেয়েছিল। অন্তত বলের মতো কিছু। যা দিয়ে সুয্যি মামার এলিয়ে পড়ার সময়টুকুকে সে উপভোগ্য করে তুলতে পারে। কিন্তু সে দৌড়ে যা তুলে নিল সে বল নয়— বলশালী একটা প্রকাণ্ড আগুন। যে আগুন আমরা আমাদের ধর্ষকামী ক্ষমতার বারুদ দিয়ে বানিয়েছিলাম। শিশুটি পুড়ে গেল। শিশুটি মরে গেল। সেতার বাজল খবরের চ্যানেলে। করুণ রসের হাঁড়ি তাড়ির দরে বিকলো। একটু আগে ওই পর্দায় অভুক্ত দেশের ধনী মায়ের আধিখ্যেতা মূলক বেবিফুড বিকোচ্ছিল। অপত্য বিকোচ্ছিল। বিকোচ্ছিল বাৎসল্য, প্রতিবাৎসল্য।একটু আগে বডিসপের নামে বাৎসায়ন বেচেছে চ্যানেল, তারপর প্রাণীকে ভালোবাসুন-এর ঢঙে ক্যাটস ফুডের বিজ্ঞাপন, তারপর হয়তো এসব-কে মশলাদার করতে সানরাইজ গুঁড়ো মশলা।
খবর ‘শুনব’ থেকে ‘দেখব’— হয়েছে সেই কবে! এখন খবর ‘স্টোরি’ হয়ে গাছে উঠছে, সস্তা বিনোদনে বদলে গেছে। সব বিনোদন এখন। পঞ্চ রস, নবরস, চৌষট্টি রস-কে জড়িয়ে শরীর, স্বাস্থ্য, হৃদয়, মিলন, বিরহ, জন্ম, মৃত্যু অপত্য মাতৃত্ব, রাষ্ট্র, রাজনীতি— সব বিনোদনের উপাদান। জনতা তার গ্রাহক। আসলে কী ঘটেছে সত্যি কী ঘটেছে এসব এখন অতীত— সততা এখন বিজ্ঞাপন, সততা এখন বিনোদন, সততা এখন মধ্যরাতের বার-ডান্সার। সততা এখন খেউড়ে চাপা পড়া মৃতবৎ আচ্ছন্ন ও ম্রিয়মান। জবর খবর আসলে ‘সত্য’-কে ভুলিয়ে দেওয়ার পুঁজি আশ্রিত বাজারী বিনোদন। হায় কী দেখানোর কথা ছিল। কী দেখাচ্ছে। কী দেখার কথা ছিল, আর কী দেখছি আমরা!!
যারা খবরওয়ালা তারা ঠিক করে দিয়েছে কোন্ খবরের কোন্-টুকুতে জনতাকে আটকে রাখা যাবে। কোন খবরটিকে গুরুত্ব দেওয়ার ভাণে অন্য প্রকৃত সত্যকে চাপা দেওয়া যাবে। একটা রঙচঙে ফাঁপা কিছুকে সামনে এনে তার আড়ালে কীভাবে মানুষ-বিরোধী, সভ্যতা-বিরোধী আসল ভিলেনদের আড়াল করা যাবে। কেননা খবরওয়ালারা পুঁজির পোষ্য। খবরকে কেমনভাবে আড়ালে পাঠাতে হয়, কী করে একচোখামিকে সম-দৃষ্টি করে দেখানো সম্ভব— এ সব প্র-কৌশল যে যত আয়ত্ত করতে পারবে, তার দাম নিলামে উঠবে তত। যার বিবেক টিবেক জাগবে, এবং যিনি সে বিবেককে লোভের খড়গে কোতল করতে পারবেন না, তিনি বা সে কতিপয় ব্যক্তি-ট্যক্তিকে হাপিস হয়ে যেতে হবে। খবরের চ্যানেল কখনো বলে না সে কীভাবে চলে, কার টাকায়, কী তার প্রভুর মতাদর্শ, তার শ্রেণিস্বার্থ কেমন?— অথচ সমস্ত শ্রেণি তাদের গ্রহীতা। সমস্ত শ্রেণির মনস্তত্ত্বের গভীরে উদ্দেশ্যমূলক খবরের মিহি ও মার্জিত স্বাদ, বিনোদনের অছিলায় তার বিষক্রিয়া শুরু করে দেয়। যার বিরুদ্ধে লড়াই, সে আমার গভীরে ঢুকে বসলে যুদ্ধ করতে হয় নিজের বিরুদ্ধে। সেভাবে প্রস্তুত হচ্ছে ক-জনা?
জনতার কানে খবর শোনানো, সাধারণের চোখে খবর দেখানো, খবরওয়ালাদের কাজ নয় আর। ওঁরা স্টাডি করে দেখছেন, জনতা কী দেখতে চায়, কেমন ভাবে দেখালে খবর ভেবে ‘না-খবরে’ ‘অ-খবরে’ চলে যাবে মন। কী দেখালে সে মজে যেতে পারে খবরাশ্রয়ী বিনোদনে। যা ঘটেছে তাকে যত্ন করে না তুলে কখনও মানুষের ইচ্ছেপূরণ কখনও মানুষের উদ্বেগ, আতঙ্ক-কে বেচে ব্যক্তিকে সঙ্কীর্ণ ও একা করে দেওয়ার বড় মাপের কাজ চালায় রাক্ষুসে রঙিন চকচকে খবর। আদতে মানুষের কিছু করার নেই, তার নিজেকে ও সমাজকে বদলানোর কোনও ক্ষমতা নেই। মেনে নেওয়াই ভবিতব্য। চোর ডাকাত ছিঁচকে এর মধ্যে নিজের স্বার্থ ঘনিষ্ঠ মন্দের ভালো বেছে নেওয়াই সচেতনতা। কম্প্রমাইজ-ই একমাত্র রাস্তা। ন্যায়ের জন্য আন্দোলনে আসলে জীবন বরবাদ করার নরক-পথ। যারা তবু করেন তারা ভেতরে ভেতরে অসৎ হতে বাধ্য। নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নেওয়াই একমাত্র বিকল্প। খবর থেকে বিজ্ঞাপন আমাদের এই খতরনাক পথে নিয়ে যায়। মানুষ কে বামন করে দেয়। চিন্তা কে ঘুপচিতে ঠেলে দেয়। স্বাধীন ও মুক্তি— এ সব শব্দ স্বপ্নাতীত মনে হয়! যা করতে হবে এই গণ্ডির মধ্যে করতে হবে। এই চৌহদ্দির বাইরে বেরোলেই নির্বাসন। আধ্যাত্মিক গুরুরা কীভাবে এইসব সহ্য করবেন তার কৌশল বাতলান। সাইকোলজিস্টরা ব্যবস্থা বদলের টিপস দিয়েছেন বলে শুনিনি। ধর্মের মানুষরা অর্থ সাম্যের দাবির মিছিলে হাঁটছেন বলে দেখিনি। রাষ্ট্র কেও তারা সহজে আক্রমণ করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত ধর্মের সারবত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে খোদ সরকার! তেমনি খবর-ব্যবসায়ী, নিউজ-ইন্ডাসট্রিয়ালিস্টরা খবর তৈরির মূল কারণে পৌঁছতে চান না। এবং মূল কারণটি যাতে প্রকাশ্যে না আসতে পারে তাই নিয়ে ঘোরতর বুদ্ধি শ্রম এবং অর্থ লগ্নি করেন।
সারাদিন ধরে এত চ্যানেল আমাদের বিব্রত বিরক্ত বিষন্ন করে। তার কারণও আছে। তার মাঝে কখনোই আমরা চারটে কাজের প্রতর্ক তুলতে দেখি না। সর্বোচ্চ স্তরের স্বক্ষেত্রে উজ্জ্বল বিশেষজ্ঞদের ডেকে শিষ্টভাবে বিচার বিশ্লেষণ করি না। বিজ্ঞানের কাজে বাঙালি কী করছে!? ইতিহাস চর্চা কোন পথে এগোচ্ছে!? কৃষি লাভজনক হওয়ার পথে বাধা কোথায়? শিল্প না তৈরি হওয়ার কারণ কী? সরকারি উদ্যোগে যা দেওয়া হচ্ছে তা মাঝপথে খোওয়া যায় কেন? যেটুকু অনুদান পৌঁছায় অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে তার কি কোনও ভূমিকা থাকে? ভোট লুঠ আটকানোর উপায় কী হতে পারে? পরিবেশ রক্ষায় কী উদ্যোগ জরুরি? কোম্পানিদের পরিবেশ রক্ষায় কী ভূমিকা পালন করতেই হবে, আনঅরগানাইজ সেক্টরের শ্রমিকদেরও নূন্যতম কী অধিকার দিতেই হবে, স্কুল শিক্ষার মান কোন্ পথে কীভাবে বাড়বে— নাহ। রাত দিন চতুর্থ শ্রেণির কবির লড়াই-এর খেউড়-খিস্তি, ব্যক্তি আক্রমন, সেলিব্রিটির জ্বর, ফুসকুড়ি কিংবা রান্নাঘরের মেনুর খবর। উনি সকালবেলা মর্নিং ওয়াক করেন। উনি পোস্ত বড়া ভালোবাসেন। উনি ঊটিতে উটে চড়ে বিয়ে করতে যাবেন— এতে আমাদের এবং আমার পিতৃদেবদের কী!!
২৪ ঘন্টা ধরে অশেষ খবর আমার সন্তানকে দশজন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীর নাম শেখাতে পারে না। চোর চিটিংবাজ চতুর্থ শ্রেণির ধান্দাবাজদের নাম বারংবার উচ্চারণে মনে হয় এই কুৎসিত সময়ে এরাই একমাত্র পরিত্রাতা। বীরভূম বললে আজকের স্কুল-কলেজ-পড়ুয়াদের রবীন্দ্রনাথ মনে পড়ে না। বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতন মনে আসে না। বীরভূম মানে অনুব্রত। একজন জোকার এম,এল.এ-এর ঘনঘন দীর্ঘ ইন্টারভিউ নেওয়া হয়। দেশের মুক্তি বাতলাতে বসে জুয়াচোর মাতালের দল। তার নাকি ভয়ঙ্কর টি.আর.পি। যাদবপুরের উঠতি বিজ্ঞানী মোবাইলে ওই চালাতে চালাতে লেট্রিনে ঢোকেন। ওর নাকি হেব্বি রগড় লাগে এইসব জোকারি। ওতে ওর পেট পরিষ্কার হয়। যে কবিরা দালাল, যে নাট্যকার চাটুকার, যে লেখক উমেদার— খবরে শুধু তারা। তারাই নক্ষত্র। ওরা বাদে বাকি কিছু নেই। মহাশূন্য। এইটা বোঝাতে মিডিয়ারা লেগে থাকে।
একটি পার্কে বোম ফাটলো। একটি বাসে চুলোচুলি হল। একটি অফিসে একটা মাতাল হুজ্জুতি করল— বার বার দেখাও এসব। দেখিয়ে ভাবাও, ভয় পাওয়াও। বোঝাও এসব তোমার পার্কে-অফিসে-বাসে ঘটতে পারে। অতএব বায়োমেট্রিক, সিসিটিভি, অতএব ব্যাগ খোলো, ফোনের ওটিপি দাও। অতএব নিজের সব ব্যক্তিগত সরকারের কাছে, শিল্পপতিদের কাছে উন্মুক্ত করে দাও। যাতে ওরা চিনতে পারে, কে ভাবছে, কী ভাবছে। চিন্তাশীলদের যাতে আলাদা করা যায়। যাতে মানুষের মন বুঝে প্ল্যান ছকা যায়। ঠিক করা যায় কোন পথে পুঁজির নিয়ন্ত্রণকে অটুট রাখা যাবে!
অথচ জানুয়ারিতে যে লোকটা গুলি চালালো, মে তে তার খবর কি? সরকার যে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার কতটুকু কে পাচ্ছে, কারা পাচ্ছে না, কেন পাচ্ছে না— তার হিসেব মিডিয়া চায় না। মিডিয়া দেখায় অমুক যাত্রায় কত তাঁবু, কত দামী হোটেল, কত ফুল, কত লাঠি, কত হুল্লোড় , কত সিটের বাস, কেমন ধারার বাঁশ। ইনসাফ কীসের, জনতা কতটা নির্ভয়ে ইনসাফ চাইতে পারছে, এসব সরজমিনে দেখার বদলে বাম নেত্রীর গলা ব্যথা, দেখা হল তমুকের সঙ্গে, ফুল ছুঁড়তে গিয়ে পড়ে গেলেন বৃদ্ধার মতো, আপাত বোকামো পাঁঠামোর অন্তরালে থাকে পুঁজির নিদারুণ ছক। জনাদশেক ঘুষখোর পেটমোটা অপদার্থ অসভ্য নেতাদের প্রত্যহ বার দশেক করে দেখালে সাধারণের মগজে তাকে নেতা বলে গুঁজে দেওয়া যায়। সংবাদ মাধ্যম বিশেষত ডিজিটাল মিডিয়ার শক্তি নিয়ে সন্দেহ নেই। পরমাণু শক্তি দিয়ে সবুজ বিপ্লব সম্ভব এবং হিরোসিমাও। আজকের বিগক্যপিটাল খবর-কারবারীরা যে, মানুষের মগজকে হিরোসিমার পোড়োভূমিতে পরিণত করতে চান; এ বিষয়ে সন্দেহ রাখা মগজওয়ালার কাজ নয়।
এটা আঁচ করেই একটা যুদ্ধ শুরু হয়েছে। খবরের গর্ভগৃহে গৃহযুদ্ধ। পুঁজিবাজারের বিরুদ্ধে ব্যক্তি মানুষের অসম লড়াই। মুক্তধারার প্রত্যাশী অভিজিৎ-এর মতো অনেক বড় প্রতিভার সাংবাদিক লড়ছেন। ব্যক্তি জীবনের সুখ শান্তি অর্থ-যশ-ক্ষমতা-প্রতিপত্তির প্রলোভনকে প্রতিপক্ষ করে একটা লড়াই শুরু হয়েছে। মিথ্যে মামলা, ভয়-ভীতি জেল জরিমানা সম্মানহানি এবং প্রাণহানিকে তুচ্ছ করে আওয়াজ উঠছে। সে আওয়াজ আমরা শুনতে পাব কিনা, সেটি নির্ভর করছে বোকা টিভির সেটিং নিউজের, আবেগাক্রান্ত যাত্রার ভলিউমের নভের মাত্রা আমরা কততে রেখেছি!!
যাপিত নাট্য ' এর সপ্তদশ কিস্তি লিখলেন - কুন্তল মুখোপাধ্যায়
কুন্তল মুখোপাধ্যায়
আমাদের কলেজের কৃষ্ণা জি, কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়, বাংলার অধ্যাপিকা একদিন ওঁনার একমাত্র সন্তানের (মানসিক ও শারীরিকভাবে বিশেষ সক্ষম) ভুল চিকিৎসার ঘটনাটা আমাদের কয়েকজনের কাছে গল্পচ্ছলে আবেগ বিসর্জন দিয়ে বিবৃত করেছিলেন। বই-এর পড়া থাকলেও, সেদিন স্পষ্ট বুঝেছিলাম এ্যলিয়েনেশন-বিচ্ছিন্নতা কাকে বলে। আবেগের সত্য, ব্যক্তিগত সত্যের বাইরে সামাজিক বাস্তবের যে সত্য, যার কথা ব্রেখট বলেছেন, কৃষ্ণাদির মুখের কথায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। মানুষ একটা বড় স্রোতের সঙ্গে জড়িত, আবার সে বিচ্ছিন্ন মানুষও। ‘শিখেছিলাম’, যত পারো প্রয়োজনীয় তথ্য মাথায় ঢুকিয়ে নাও, বোধকে সমৃদ্ধ করো, ব্রেখট বলেছেন অভিনেতা যেন মঞ্চে তার দুটি সত্ত্বার কথা স্মরণ রাখেনক, একটি তাঁর নিজের অন্যটি তার অভিনীত চরিত্রটির সত্ত্বা। আবেগ ও ভাবালুতা যা ‘এমপ্যাথি অপারেশন’ বলে অনেকেই গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন, যাকে ব্রেখট অস্বীকার করেছেনক, কৃষ্ণা দির বিবৃতির মধ্যে তাই ধরা পড়েছিল। ব্রেখটক-এর মতে অভিনেতার দৃষ্টিভঙ্গী হবে একজন সমাজ বিশ্লেষকের— সোশ্যাল ক্রিটিকের মতন। আবার ছাত্রজীবনে উৎপল দত্তের লেখা ‘স্তালিস্লাভস্কির পথ’ বইটা পড়লেও স্তালিস্লাভস্কির পদ্ধতিটা ভালো বুঝেছিলাম অশোক মুখোপাধ্যায়ের কাছে। পরে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্য বিভাগে পড়ানোর সময় (১৯৯৫-২০০৫) অভিনয়-এর গ্ৰুপে উনিই আমাকে স্তালিস্লাভস্কি-ব্রেখট পড়াতে দিয়েছিলেনক। ইতিমধ্যে নিউইয়র্ক রাউটলেজ থেকে প্রকাশিত জাঁ বেনেদিত্তর লেখা স্তালিস্লাভস্কির বই পরে ফেলেছি, ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং ব্রেখট’ও পড়ে ফেলেছি, তবু স্বীকার করতে দ্বিধা নেই এ বিষয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষা পেয়েছি অশোক মুখোপাধ্যায় ও সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় (পি. এল. টি)-এর কাছেই। স্তালিস্লাভস্কি ফোর্থ ওয়াল- চতুর্থ দেওয়াল মানতেন, আর ব্রেখট এইক ফোর্থ ওয়ালকে পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন ।
মনোজ মিত্র তখন ‘ছায়ার প্রাসাদ’ নাটক লিখেছেন, আমাকে একদিন বললেন, ‘কুন্তল কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র বইটি চাই।’ আমি যে কলেজে পড়াতাম, উত্তরপাড়া রাজা প্যারিমোহন কলেজের লাইব্রেরি খুবই সমৃদ্ধ এবং এইসময়ই শতবর্ষ অতিক্রান্ত বলে পুরোনো মূল বইটিও ছিল। আমার শিক্ষককে ঠিক সময়ে সংগ্রহ করে দিলাম। এর সুফল হল নাটকটি যেদিন প্রথম পাঠ হল সেদিন উপস্থিত থাকার অনুমতি পেলাম। প্রথম পাঠের পর বিভাস চক্রবর্তী, অশোক মুখোপাধ্যায়, তাপস সেন, বিষ্ণু বসুর সঙ্গে আমিও নাটক পাঠের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলাম, এবং অবাক হয়েছিলাম আমার মতামতকে মনোজবাবু নাট্য সম্পাদনায় গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কল্যাণীতে ২০০৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য একাডেমী আয়োজিত আবাসিক নাট্য রচনা প্রশিক্ষণ শিবিরে আমার সুযোগ হয়েছিল শ্রদ্ধেয় মনোজ মিত্র, চন্দন সেনদের সঙ্গে প্রশিক্ষক রূপে কাজ করায় ।
সেখানে রোজ সকালে একঘন্টা আগের থেকে বেছে নেওয়া কোনো একটি নাটক পাঠ করা হত। শিক্ষার্থীদের সেই নাটক শুনে প্রতিক্রিয়া জানাতে হত। এই প্রতিক্রিয়াতে নিছক ‘ভালো/খারাপ/মোটামুটি/ভালোই তো/মন্দ নয়’ এই বহিঃপ্রকাশকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। নাটক শুনে ভাবনার কথা, কোনো কবিতা, কোনো গান বা কোনো ছবি এঁকে তার প্রতিক্রিয়া জানাতে হত। ওই আবাসিক শিবিরেই রচিত নাটক অভিনীত নাট্যে রূপায়িত হতে গেলে নাট্যপাঠের সময় মনোজ বাবু বলতেন, ‘নাট্যপাঠ হবে এমন যাতে ‘চোখের ভাষা’ বেরিয়ে আসে। চোখের ভাষা না থাকলে অভিনয় হয় না।’ অভিনয়ের সময় অন্যান্য চরিত্রের অভিনেতার অভিব্যক্তির উপর নির্ভর করে নিজের অভিব্যক্তির, মনে রাখা দরকার, অভিনয় একটা বিজ্ঞান। তার একটা ব্যাকরণ আছে।
(চলবে )
উস্তাদ রশিদ খানের স্মৃতিকে আধার করে কিছু প্রশ্ন তুললেন সুপ্রতীম মুখার্জি
রাশিদ, এক বাঁচার রসদ
সুপ্রতীম মুখার্জি
‘বিলম্বিত’ ‘স্থায়ী’ হল না বেশিক্ষণ, বড় ‘দ্রুত’ চলে গেলেন উস্তাদজী না ফেরার ‘দেশ’-এ। আচ্ছা উস্তাদজি, কেউ কি সে দেশে ‘পায়েলিয়া ঝংকার’ বা ‘ইয়াদ পিয়া কি’ শোনার প্রতীক্ষায় বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা? আপনার প্রতিটি তান শোনার পর ‘বাহ, বাহ’ ‘ক্যা বাত’ ‘ক্যা কেহেনে’ শব্দে আখ্যায়িত করার মানুষ পান তো? সেদেশে আপনার আওয়াজ কানে বসত করে কি ঘুমের দেশে যায় কেউ কেউ? হয়তো হ্যাঁ। তাইতো এত সহজে চলে যেতে পারলেন, শুধু রেখে গেলেন আপনার এই নৈসর্গিক অধরা গলা, ফাঁকা ডোভারলেন আর সুরমণ্ডলটুকু। ৯ জানুয়ারি, ২০২৪ ভারতীয় মার্গসংগীত-এর এক নক্ষত্রখচিত ভাস্কর উস্তাদ রাশিদ খান ইহলোক ছেড়ে সুরলোক-এ পারি দিলেন। রামপুর-সহসওয়ান ঘরানার এক উজ্জ্বল পুত্র ছিলেন তিনি।
উস্তাদ রাশিদ খান উত্তর প্রদেশের বুদাউনের সহসওয়ানে জন্মগ্রহণ করেন। উস্তাদ ইনায়েত হোসেন খানের প্রপৌত্র মাত্র ৬ বছর বয়সে তাঁর মামা উস্তাদ নিসার হোসেন খানের কাছে প্রথম তালিম শুরু করেন। তারপর কলকাতা ITC সংগীত রিসার্চ একাদেমিতে দীর্ঘ ২৫ বছর যাত্রার সাথে তাঁর গুরুগম্ভীর কণ্ঠ ছড়িয়ে পরে সারা বিশ্বে। ছোট থেকেই সংগীত-এর প্রকৃত নাড়াবাঁধা নিয়মমাফিক শিক্ষার ক্ষেত্রে উস্তাদজীর অতটা আগ্রহ ছিল না বরং বেশি ছিল ক্রিকেট খেলার প্রতি। তারপর তার দাদু এবং মামার অদম্য প্রচেষ্টা আর কঠোর শৃঙ্খলা এই বিরল প্রতিভাকে কিংবদন্তি করে তোলে এবং রামপুর ঘরানার প্রকৃত উত্তরসূরি তৈরি করেন। বিভিন্ন সংস্করণে বলা একটি গল্পে, পণ্ডিত ভীমসেন জোশী একবার মন্তব্য করেছিলেন যে উস্তাদ রাশিদ খান হলেন ‘ভারতীয় শাস্ত্রীয় কণ্ঠ সঙ্গীতের ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা’। এগুলো ছিল উইকিপেডিয়া সংগৃহিত তথ্য। এবার ফিরি সেই মনের সংগ্রহশালায়, যেখানে শিল্পীর গলায় ‘বাগেশ্রী’ ‘ইমন’ ‘কল্যাণ’ ‘পুরিয়া’ বাস করে চলেছে সেই ছোটবেলা থেকে। ছেলেবেলা থেকে বাড়িতে ছিল গানের চর্চা। তাই সুর সংক্রামক ছিলাম সেই ছোট থেকেই। কতটা জানা বা বোঝার নিরিখে না গিয়ে শুধু এক নির্ভেজাল সঙ্গীতপ্রিয় মানুষ হিসেবেই আমার এই ছোট খসড়া।
‘আয়োগে যাব তুম সাজনা’ ‘সাজনা বারসে রে কিউন আঁখিয়া’ কিউন? সত্যি আমার কাছে কোনো উত্তর নেই। ৯০ শতাংশ ভারতীয় শুধু মনে রেখেছেন উস্তাদজীকে শুধু এই ফিল্মি গানগুলোর জন্য। ভাগ্যিস রাশিদজি এই অল্প সংখক বাণিজ্যিক ছবিগুলোর জন্য কাজ করেছিলেন নাহলে হয়তো ৯ তারিখ উন x -হ্যান্ডেল এ ট্রেন্ডিও হতে পারতেন না, বা অন্যদিকে আফগানিস্থান-এর বিখ্যাত স্পিনার বেচারা ‘রাশিদ খান’ ভুরি ভুরি RIP সংগ্রহণ করতেন। যদিও কিছুক্ষেত্রে সে ঘটনারও সম্মুখীন হয়েছি আমরা। সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক ।
এই ৯০ শতাংশ মানুষকে বিষয়টি বুঝতে হবে ভারতবর্ষের মধ্যে খাজুরাহো যেমন সত্যি, আর্যভট্ট যেমন সত্যি, রামায়ণ-গীতা-মহাভারত যেমন সত্যি তেমন ভরা বর্ষায় বা চরম বিচ্ছেদে উস্তাদজীর গলায় মল্লার বা পুরিয়াধানেশ্রীও সত্যি, যা ভারতবর্ষকে চিত্রিত করে বিশ্বের দরবার-এ। যাকে কোনো
বাণিজ্যিক ঘেরাটোপে আবদ্ধ করা যায় না। সেতো উস্তাদজীর চরম উদারতা যে উনি নিজেকে ভেঙে ফিউসান মাধ্যমেও নিজেকে উজাড় করতে পেরেছেন।
আসুন না আমরাও একটু শিল্প সংস্কৃতি ভাবাবেগে একটু বৈচিত্র আনি। যেদিন ওই পাড়ার মোড়ের সেই ছেলেটা রক সঙ্গীতের কনসার্টে গান শোনার পাশাপাশি একটু ডোভারলেনেও যাতায়াত শুরু করবে সেদিন হয়তো আবার কোনো উস্তাদজী জন্মাবে, আবার কোনো মিউজিক্যাল অর্গানাইজার অলিতে গলিতে ক্লাসিকাল মিউজিক্ কনফারেন্স এরেঞ্জ করার সাহস দেখাবে, আবার ভারতবর্ষে ‘বারসেগা সাওয়ান-বারসেগা সাওয়ান’…
ওয়েবসিরিজ দুগ্গা দুগ্গা'র বিশ্লেষণ করলেন বৃতা মৈত্র
ওটিটি হলো আজকের অতি জনপ্রিয় বিনোদন প্ল্যাটফর্ম। সবার হাতেই মুঠোফোন। আর স্পর্শ করলেই ওয়েব দুনিয়ার রামধনু রঙ চোখের সামনে। ওয়েব সিরিজ, স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি, তথ্যচিত্র–আয়োজনের শেষ নেই। এই বিভাগে তারই তত্ত্বতালাশ প্রতি মাসে একবার। লিখছেন বৃতা মৈত্র
‘দুগ্গা দুগ্গা’য় নজর কেড়ে নেবে বাদশা-অমৃতার অভিনয়ের মরমি রসায়ন
ওয়েব সিরিজে বাবা-মেয়ের সম্পর্কের রসায়ন, বিষয় হিসেবে অভিনব নিঃসন্দেহে। ওটিটি মানেই হরর ও থ্রিলার এমন একটা ধারণা দর্শকমহলে তৈরি হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। সামান্য কিছু পারিবারিক কাহিনি পাওয়া গেলেও পরিচালক জিৎ চক্রবর্তীর ছয় পর্বের ওয়েব সিরিজ ‘দুগ্গা দুগ্গা’য় যে কাহিনি পাওয়া যাবে, তা একেবারেই ভিন্নস্বাদের। তবে, বাবা-মেয়ের চিরায়ত কাহিনির মধ্যেও রয়েছে টুইস্ট। কিছুদিন আগে এই সিরিজের শুটিংকে ঘিরেই শীতের কলকাতায় পুজোর আবহ তৈরি করলেন পরিচালক জিৎ চক্রবর্তী। সেই অনুষঙ্গেই দৃশ্য রচনা করলেন পরিচালক।
অনামিকা বিদেশে থাকে। সেখানেই লেখাপড়া করছে সে। অনামিকার মা মারা যাওয়ার পর তার বাবা অবনী এই শহরে একাই থাকে। বাবার একাকীত্বের কথা জেনেও শহরে ফেরে না অনামিকা। এরপর অবনী অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং এই খবর জানতে পেরে, দেরি না করে কলকাতায় ফেরে অনামিকা। কেন অনামিকার কলকাতা বিমুখতা? অবনীর অসুস্থতাই বা এই অবস্থায় কী পরিবর্তন আনে? এরপর কী ঘটে অবনী আর অনামিকার জীবনে, তাই নিয়েই সিরিজের পরের পর্বগুলির গল্প এগিয়ে যাবে। বাবা-মেয়ের সম্পর্কের নিরিখে অভিনেতা বাদশা মৈত্র ও অমৃতা চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়ের এক মরমি সমীকরণ দেখবেন দর্শক ওয়েব-পর্দায়।
বাংলা থিয়েটার, সিনেমা ও টেলিভিশনের পরিচিত অভিনেতা বাদশা মৈত্র। অত্যন্ত ক্ষমতাশালী বাদশা বিভিন্ন মাধ্যমে একটা লম্বা সময় ধরে নানা চরিত্রে নিজের সাবলীল অভিনয়ের ছাপ রেখেছেন। প্রমাণ করেছেন নিজের অপরিহার্যতা। এহেন বাদশার সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করেছেন নবীন প্রতিভা অমৃতা চট্টোপাধ্যায়। প্রসঙ্গত, অমৃতা বেশ কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করে ইতিমধ্যেই চেনা মুখ। মূলত ভিন্নধারার ছবিতেই দেখেছি আমরা মিষ্টি চেহারার এই মেয়েকে। ‘দুগ্গা দুগ্গা’য় ওঁরা ছাড়াও আছেন ফাহিম মির্জ়া, ময়না মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
একটি বাংলা সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অমৃতা জানিয়েছেন, “এর আগে অনামিকার মতো কোনও চরিত্র করিনি আমি। আজকাল প্রচুর ছবি ও সিরিজ তৈরি হচ্ছে রহস্য, রোমাঞ্চ এবং অলৌকিক গল্পকে কেন্দ্র করে। কিন্তু, সম্পর্কের গল্প সব সময় দর্শকের ভালোলাগে।” বুঝতেই পারা যায়, এই সিরিজ নিয়ে অমৃতার প্রত্যাশার পারদ বেশ উর্ধ্বমুখী। অনামিকার চরিত্রের শেডগুলি একজন অভিনেত্রীর কাছে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। নবীনা এই প্রতিশ্রুতিময়ী সেই চ্যালেঞ্জে জয়ী হবেন বলেই বিশ্বাস আমাদের।
বাবা অবনীর ভূমিকায় বাদশার অভিনয় নিয়েও যথেষ্ট প্রত্যাশা রয়েছে বাংলার ওয়েব দর্শকমহলে। চরিত্র নির্বাচনে বরাবরই যথেষ্ট খুঁতখুঁতে ও সাবধানী তিনি। এই সিরিজের ক্ষেত্রেও বোঝা যায়, কাহিনির গভীর অর্থবহ দিকটাই তাঁকে আগ্রহী করে তুলেছে। তাঁর রিয়ালিস্টিক অভিনয়ে অবনী প্রাণময় হয়ে উঠবেন নিশ্চয়ই। অর্থাৎ, বাবা-মেয়ের এই কাহিনিতে আরও একবার আমরা বাদশার অভিনয়ে কাঙ্ক্ষিত মাত্রাটি খুঁজে পাব। কবে, কোন চ্যানেলে স্ট্রিমিং শুরু ‘দুগ্গা দুগ্গা’র এখনও জানা যায়নি। আপাতত অধীর অপেক্ষা!!
কলকাতার গালগপ্পো তৃতীয় পর্ব লিখলেন কিশলয় জানা
কিশলয় জানা
।।কালীঘাটের কলিকাতা।।
তৃতীয় পর্ব
কলিকাতার গালগপ্পো যখন এই অধম শোনাতে বসেছে, তখন কালীঘাট দিয়েই শুরু করা যাক। সেই কবে, ইংরেজ আমলের গোড়ার দিক থেকে কলকাতা বলতে কালীঘাট কিংবা কালীঘাটের সূত্রে কলকাতার কথা কতজন কতবার যে বলেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। তাহলে এই পাপী নাদানই বা বাকি থাকে কেন? বস্তুত, সেকেলে কলকাতা নিয়ে যত না গালগপ্পো, তার চেয়ে বেশি গালগপ্পো কালীঘাট নিয়ে। কেউ বলছেন, কালীঘাট সতীপীঠ—এখানে দেবীর দক্ষিণ পদাঙ্গুলি পড়েছিল, সেইকারণে এখানে দ্বাররক্ষক হিসেবে নকুলেশ্বর মহাদেব উপস্থিত আছেন; আর একদল বলছেন, কালীঘাট আসলে শক্তিপীঠ। এখানে সাধনা করলে সিদ্ধিলাভ অবশ্যম্ভাবী। আর কোনো কোনো অর্বাচীন তন্ত্রে তো এমন কথাও ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, কালীঘাটে যেহেতু দেবীর দক্ষিণ পদাঙ্গুলি পড়েছিল, অতএব কালীঘাট মহাতীর্থ, এখানে মরলে কাশীক্ষেত্রে মরার সমান ফল মেলে অর্থাৎ কীটের পর্যন্ত নির্বাণ প্রাপ্ত হয়, মানুষ তো কোন ছার !
ভেবে দেখুন, এই যে সারা দেশে মোট ৫১টি সতীপীঠ রয়েছে, আর কোথাও কিন্তু এত মতভেদ, এত বাগবিতণ্ডা, এত ইতিহাস-পুরাণের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা-টেষ্টা দেখবেন না আপনি। যত কাণ্ড কালীঘাটে! তার একটা কারণ সহজেই অনুমান করা যায়, অন্য সব কটি স্থান বহু প্রাচীনকাল থেকে জনগণের বিশ্বাস কিংবা অন্য যে কারণেই হোক, সতীপীঠ হিসেবে নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কালীঘাট যেহেতু অর্বাচীন অর্থাৎ নিতান্ত পরবর্তীকালের সৃষ্টি, অতএব নিজেকে প্রাচীন প্রমাণে তার এত বেশি তৎপরতা, এত প্রচণ্ড বোলবোলাও।
কালীঘাট নিয়ে যত গালগপ্পো আপনি শুনবেন, তার মধ্যে একটি জনপ্রিয় গপ্পো হচ্ছে, বর্তমান কালীঘাটের চারপাশে তখন গভীর জঙ্গল ছিল। এক ব্রাহ্মণ বাণপ্রস্থ অবলম্বন করে সেখানে সামান্য কুঁড়ে তৈরি করে বাস করতেন এবং ঈশ্বরের নামগান করতেন। একদিন সন্ধ্যাবেলা ভাগীরথীতে (আদিগঙ্গা) স্নান করতে গিয়ে তিনি দেখেন নদীপ্রবাহের পথে সৃষ্টি হওয়া একটি অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ থেকে উজ্জ্বল আলো বেরিয়ে আসছে (দহ যখন, তখন আলেয়া হওয়াই বিজ্ঞানসম্মত)। পরের দিন দিনের বেলায় সেই স্থানটি সরেজমিনে দেখতে গিয়ে ব্রাহ্মণ এক মানুষ সমান একটি প্রস্তরীভূত অঙ্গুলি খুঁজে পেলেন। পরে স্বপ্নে তিনি জানতে পারলেন, ওই অঙ্গুলি সতীর দক্ষিণাঙ্গুলি, কাছেই নকুলেশ্বর মহাদেবের মুর্তিও রয়েছে, যা পরে তিনি খুঁজে পান এবং একসঙ্গে উভয়েরই পূজা করতে থাকেন। অনেক পরে সাধারণ মানুষেরা সে-কথা জানতে পারে এবং কালীঘাট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
মজার ব্যাপার, এই গপ্পো থেকে আপনি জানতে পারবেন না, ব্রাহ্মণ ঠিক কোন সময়ে অঙ্গুলিসদৃশ কালীকে খুঁজে পান। তবে একটা ব্যাপার বোঝা যায়, এটি সতীপীঠ হোক বা সাধনপীঠ, উভয়দিক থেকেই নেহাতই অর্বাচীন। কারণ, এই গপ্পের একটি সিজন টু এপিসোডও রয়েছে। বড়িষার সাবর্ণ চৌধুরী, সন্তোষ রায় একদিন নৌকা করে ভাগীরথী দিয়ে যাওয়ার সময় কালীঘাটের কাছে অরণ্যে শঙ্খ ঘণ্টার আওয়াজ শুনে কৌতূহলী হয়ে কোন এক ব্রহ্মচারীকে কালীমুর্তি পূজা করতে দেখেন এবং সেই মূর্তি আসলে সতী অঙ্গ তা জানতে পারেন। এর পর থেকে মাঝে মাঝে তিনি আসতেন এবং সেই থেকে জমিদার মশাইয়ের আসা-যাওয়ার সূত্রে জনসাধারণও আসতে থাকে। এই কাহিনির একটি দুস্রা ভার্সানও আছে। ভার্সানটি প্রথম জনসমক্ষে আনেন দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পিতামহ, তাঁর বিখ্যাত ক্ষিতীশ-বংশাবলী চরিত বইতে। পরে এটি ‘ক্যালকাটা রিভিউ’-তে এই গপ্পোটিকে কিংবদন্তী করে তোলেন। সেই গপ্পে অবশ্য সন্তোষ রায় নেই। আছেন, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র এবং নবাব আলিবর্দ্দি খাঁ। বারো লক্ষ (মতান্তরে বত্রিশ লক্ষ) টাকা খাজনা বাকি নিয়ে একসময়ে অবশ্য সাপে-নেউলে সম্পর্ক ছিল দুজনের, কৃষ্ণচন্দ্রকে কারাগারেও কাটাতে হয় কিছুদিন। পরে কোনো কারণে আপোষ-রফা হয়ে গিয়ে দু-জনের বেশ হৃদ্যতার সম্পর্ক তৈরি হয়। একদিন জলপথে মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা আসার সময় কৃষ্ণচন্দ্র নবাবের সঙ্গী হন। সেই যাত্রার সময় কৃষ্ণচন্দ্র এবং নবাব দক্ষিণ তীরস্থ বাদাবনে প্রবেশ করেন, বাকি গপ্পো আগের গপ্পের অনুরূপ এবং সন্তোষ রায়ের পরিবর্তে কৃষ্ণচন্দ্র সেখানে বর্তমান মন্দিরের মূল কারিগর। নবাব মহারাজার অনুরোধে তক্ষুনি ওই অংশটি কালীর সেবার নামে দান করে দেন। হরিসাধন মুখোপাধ্যায় সম্ভবত এই মিথকে প্রামাণ্য বলে বিশ্বাস করতেন, সেই জন্য গৌরদাসের মূল ইংরাজি লেখাটিকে তিনি অনুবাদ করে তাঁর ‘কলিকাতা সেকালের ও একালের’ বইতে জুড়ে দেন। লক্ষণীয়, কালীক্ষেত্র হিসেবে যে কালীঘাটের প্রসিদ্ধি, নানা গল্পের সৃষ্টি হলেও কোনোভাবেই সেই কাল সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের পূর্বে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। অতএব কালীঘাটের মন্দির যদি পুরাতনও হয়, তবে তা তিনশো বছর মতো হবে। পৌরাণিক কালের বিচারে নেহাতই শিশু বলতে হয়। তাছাড়া লক্ষণীয় যে, কালীঘাট নামক স্থান কিন্তু কলকাতার গ্রামসীমানার বাইরে ছিল, পরবর্তীকালে কলকাতার ক্রমপ্রসারের সঙ্গে সঙ্গে স্থানটি কলকাতার অন্যতম প্রতীক হিসেবে উঠে আসে। সম্ভবত একারণেই ইতিপূর্বে কলকাতার নামের সঙ্গে কালীর কোনো মহিমার কথা কখনো শোনা যায় নি। গোবিন্দপুর অঞ্চলের যে কালীমন্দিরে ভক্তদের আসা-যাওয়ার কথা আগে বলা হয়েছে, তা নিশ্চয়ই কোন সতীপীঠ ছিল না। থাকলে ‘ভবিষ্যপুরাণে’র মতো অর্বাচীন পুরাণ সেই সুযোগ ছেড়ে দিত না। অবশ্য এ-ব্যাপারে নানা মুনির নানা মতের অন্ত নেই। সকলেই যে-যার মতো করে কল্পনা করে নিয়েছেন, কার সাধ্য রোধে তার গতি? কেউ কেউ গুপ্ত রাজাদের সময় থেকে এখানে কালীমূর্তি পূজিত হন বলেছেন, কেউ কেউ পাল রাজাদের সমসাময়িক বলেছেন, কেউ বলেছেন এই মূর্তি দুই হাজার বছরের কম পুরানো নয়, কেউ কেউ কালীঘাটের কালীর স্থাপত্যে বৌদ্ধ যুগের পূর্বের স্থাপত্যের গঠন লক্ষ করে তাকে প্রাক্-বৌদ্ধ যুগের বিনির্মাণ বলেছেন। অথচ এত পুরানো এবং প্রসিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কেন তা আদি শংকরাচার্যের মতো গুরুর চোখ এড়িয়ে গেল, কেনই বা তা জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে হারিয়ে গেল অনেককালের জন্য— সেই সব প্রশ্ন কেউ তোলেন না। কেউ ‘গঙ্গাভক্তিতরঙ্গিণী’ কিংবা ‘তন্ত্রচূড়ামণি’র সাক্ষ্য উদ্ধার করে সতীপীঠের প্রাচীনত্ব প্রমাণ করছেন, কেউ ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গলে’র দৃষ্টান্ত তুলে এনে বলছেন, এই তো দ্যাখো, খোদ ভারতচন্দ্রই বলে গেছেন যে এখানে দেবীর ডান পায়ের চারটি আঙুল পড়েছিল! এতক্ষণ আমরা একটি আঙুল নিয়ে হিমসিম খাচ্ছিলাম, ভারতচন্দ্র অধিকন্তু ন দোষায়ঃ বিবেচনায় আরও তিনটি আঙুল সংযোজন করলেন, তাতে সংশয় বাড়ল বই কমল না! উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ক্ষুদ্র লৌহ সিন্দুকের মধ্যে ওই আঙুল চারটি রক্ষিত আছে, যা প্রতি বৎসর স্নানযাত্রার দিনে স্নান করিয়ে পূজা করা হয়। আগের এক মানুষ প্রমাণ আঙুল যে শেষ পর্যন্ত লোহার ছোট্ট সিন্দুকে ধরেছে, এটাই দেখার বিষয়। প্রতাপাদিত্যের সমসাময়িক বৌদ্ধ পরিব্রাজক কবিরামের দিগ্বিজয়প্রকাশ গ্রন্থে আবার বলা হয়েছে, সতীর বাম হাতের আঙুল ভাগীরথীতটে পড়েছিল, তবে সে তট যে কোথায় ছিল, তা ভাগীরথীর খাত পরিবর্তনের সঙ্গে তার গর্ভেই বিলীন হয়ে গেছে। প্রাণকৃষ্ণ দত্ত আবার তাঁর কলিকাতার ইতিবৃত্ত বইতে সতীর একটি পায়ের আঙুল এবং মস্তক পড়ার কথা বলেন। দেখা যাচ্ছে, ছাপাখানার যুগে যাঁরা যাঁরা কালীঘাট নিয়ে লিখতে বসেছেন, তাঁরা যে-যার মতো কেউ ডান পায়ের আঙুল, কেউ বাম পায়ের, কেউ পা নয় হাতের আঙুল, কেউ আবার মস্তক পড়ার কথা বলেছেন। কেউ কেউ আবার একটি আঙুলের জায়গায় চারটি আঙুলের কথা বলছেন। কারুর সঙ্গে কারুর মতের মিল নেই। এই দেখেই মনে হয়, কালীঘাট আদতে প্রাচীন কোন স্থান নয়, হলে এত ভিন্ন ভিন্ন মিথ ও বক্তব্য গড়ে উঠত না।
শ্রীসূর্য্যকুমার চট্টোপাধ্যায় মশাই তাঁর সুপরিচিত কালীক্ষেত্র দীপিকা-য় কাব্য-পুরাণ ইত্যাদির সঙ্গে কালীঘাটকে যুক্ত করার যে প্রয়াস করেছেন, তা অভিনব সন্দেহ নেই, কিন্তু খুব নড়বড়ে। ‘চূড়ামণি তন্ত্রে’র উদ্ধৃতি চয়ন করে কালীঘাটকে সতীপীঠ প্রমাণ করা যায় না, কারণ উক্ত তন্ত্র প্রাচীন কোন তথ্যসূত্র নয়, আর-এক গালগপ্পের জন্মদাতা মাত্র। তাছাড়া কবিকঙ্কন মুকুন্দ চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গলের ধনপতি-উপাখ্যানে যে কালীক্ষেত্র-প্রসঙ্গ আছে এবং সেখানে পূজা দেওয়ার কথা আছে, তা যে প্রক্ষিপ্ত— সে বিষয়ে একালে সকলেই একমত। নগেন্দ্রনাথ বসু যদিও বিশ্বকোষে প্রাচীনকালে সাগরযাত্রী হিন্দু বণিকেরা এর ঘাটে নেমে কালীপূজা দিয়ে যেতেন বলে উল্লেখ করেছেন, সেই থেকেই কালীর ঘাট বা কালীঘাট শব্দটির জন্ম, কিন্তু তাঁর এহেন অনুমানের পক্ষে কোন প্রমাণ দাখিল করেন নি। আসলে জনপ্রিয় কাব্যগুলির যত সংখ্যক পুথি, তত সংখ্যক পাঠভেদ পাওয়া যায়। সাত নকলে আসল খাস্তা! কোনটা যে মুকুন্দ চক্রবর্তীর আসলি কপিরাইট ছিল, তা জানবার আর উপায় নেই।
তবে, আর একটি মত বলে, কালী আগে খাস কলকাতাতেই ছিলেন। প্রমথনাথ মল্লিক বলেন, বর্তমান পানপোস্তার উত্তরে আগে দেবীর মন্দির ছিল, ছিল পাথর বাঁধানো পাকা ঘাট, যার থেকে পাথুরিয়াঘাটা। তবে পরবর্তীকালে ধর্ম্মানন্দ মহাভারতী পাথুরিয়াঘাটা রাজবংশের ইতিহাস লিখতে গিয়ে স্পষ্টই জানিয়েছেন, পাথুরিয়া শব্দটি এসেছে প্রস্তর থেকে অবশ্যই, কিন্তু সেই প্রস্তরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে, কুলটা হিসেবে অভিশপ্ত অহল্যার কাহিনি। এই কারণে, পঞ্জাব, বিহার, উত্তর প্রদেশ প্রভৃতি অংশে ‘পাথুরিয়া’ শব্দের অর্থ কুলটা রমণী, যাঁরা আসলে বেশ্যাবৃত্তি করে জীবনধারণ করেন। চেন্নাই অঞ্চলেও এর অর্থ ‘কাঞ্চনী’। আর ‘ঘাটা’ অর্থ পাড়া বা মহল্লা। অতএব কালীর ঘাট থেকে নয়, বেশ্যাপাড়া অর্থে পাথুরিয়াঘাটা অঞ্চলটি এসেছে। কলকাতার বিভিন্ন স্থাননামের কিছু কিছু গপ্পো বলে পরে কখনো আসর জমানো যাবে।
তা কালী আগে ছিলেন না কি খোদ আজকের চৌরঙ্গীতেই। তখন অবশ্য চৌরঙ্গী নাম ছিল না, পুরনো দিনের নথিপত্রে সেই নামটি ছিল ‘চিরাঙ্গী’। কেউ কেউ বলছেন, সতীর দেহ বিষ্ণুর চক্রে চিরে ছিন্নভিন্ন হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ায় এই নামটি হয়েছে। সেইসঙ্গে এখানে কোথাও আদিগঙ্গার ধারে কোন এক স্থানে দেবীর অঙ্গুলি পরিমাণ অঙ্গ কিংবা আঙুল পড়েছিল। কেউ কেউ বলছেন, চৌরঙ্গী বা চিরাঙ্গীতেই সেই আঙুল পড়েছিল, পরে স্থানান্তরিত হয়ে তা বর্তমান কালীঘাটে পৌঁছায়। কেউ কেউ অবশ্য নাথ গুরু গোরক্ষনাথকেই কালীঘাটের প্রতিষ্ঠাতা মনে করেন। কেউ আবার চৌরঙ্গী স্বামী নামক নাথ সাধুর দ্বারা পূজিত দেবী হিসেবে কালীকে দেখেছেন। তিনি আবার চৌরঙ্গী অঞ্চলে তখন যে বাঘ-ভালুক অধ্যুষিত অরণ্য ছিল, সেখানে বাস করতেন এবং দেবীর পূজা করতেন। এই কারণে, কেউ কেউ অবশ্য সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, চৌরঙ্গী স্বামী এত জায়গা থাকতে বাঘ-ভালুক অধ্যুষিত অরণ্য— যেখানে আবার বুনো হাতির তাণ্ডব ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার, সেখানে ঈশ্বরের আরাধনা করতে থাকলেন কী করে? তাছাড়া তিনি কি একাই সাধনা করতেন, না কি তাঁর ভক্ত-শিষ্যেরাও ছিল তাঁর সঙ্গে? এই রকম ক্ষেত্রে কোন মন্দির কিংবা আখড়া মতো বানিয়ে নেওয়াই সঙ্গত, সেইরকম কিছু ছিল কি? তাছাড়া এই গল্পে কালপরিচয় একেবারে অনুপস্থিত। কেউই ঠিক করে বলতে পারছেন না, চৌরঙ্গী স্বামী নামক সাধক কবে, কতদিন এখানে সাধনা করেন। তিনি যদি নাথ ধর্মের সাধক হন, তাহলে তাঁর শাখাটি পরে কোথায় হারিয়ে গেল? নিজেদের আরাধ্যা দেবীকে এত সহজে অন্যের হাতে তুলে দিয়ে তাঁরা নিশ্চিন্তে কোথায় চলে গেলেন? যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই, সাধনাকালীন চৌরঙ্গী স্বামীর দেহান্ত হয়, তাহলে তাঁর শিষ্যেরা জঙ্গলের মধ্যে আরাধ্যা দেবীমূর্তিকে ফেলে অন্যত্র চলে গেলেন কীভাবে? এইরকম প্রশ্নের পর প্রশ্ন উঠে আসে। অনেক প্রশ্নেরই উত্তর নেই। তবে সাধক যোগীরা নানা স্থানে তপস্যা করতেন, বিশেষ করে লোকালয় থেকে দূরে বসে যাঁরা সাধনা করতে চাইতেন, তাঁরা একটু অফবিট জায়গা বেছে নিতেন, যাতে কেউ সহজে তাঁকে বিরক্ত করতে না পারে। সেই কারণে, গভীর জঙ্গলে বসে দেবীর সাধনা করা অসম্ভব কিছু না। তাছাড়া কালীঘাটের গপ্পোগাছাতে জঙ্গলের মধ্যে দেবীমূর্তির সাধনা করার বিষয়টি কমন ফ্যাক্টর। অতএব এইরকম কিছু ঘটোলেও ঘটা সম্ভব। জঙ্গল তখন কম ছিল না কলকাতার চোউহদ্দীর মধ্যে। অন্তত, চৌরঙ্গী অঞ্চলে যে গভীর অরণ্য ছিল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। উনিশ শতকের প্রথম দিকে বিশপ হ্বেবার যখন কলকাতায় ছিলেন, তিনি দিনমানে চৌরঙ্গী অঞ্চলের অরণ্যে হাতির তাণ্ডবের কথা বলেছেন, আগে সেখানে বাঘের উপদ্রব ছিল, যদিও সাহেবরা ততদিনে তাদের একেবারে সাবাড় করেছে। যাই হোক, আমাদেরও এই পর্ব এখানে সাবাড় করতে হবে, কলকাতার কালীঘাটের কালী নিয়ে এক পর্বে সব বলা অসম্ভব ব্যাপার, ফলে এই প্রসঙ্গে আরো কিছু ভিন্ন মত এবং মজাদার গপ্পের কথা আবার পরের পর্বে।
ছায়াছবির অশ্বমেধ যজ্ঞ সামনে রেখে, প্রাসঙ্গিক আলোচনায় তংসু কর্মকার
তংশু কর্মকার
উৎসব আসে, উৎসব যায়। মানে বর্তমানে ভারতের বঙ্গীয় জনজীবন গ্রীষ্মের দাবদাহ ও বর্ষার করাল রুপের ঝাল কাটিয়ে ভাদ্র-আশ্বিন মাসের উৎসব প্রনালীর মধ্যে যে ডুব দেয়, তা গিয়ে আসলে সারে, বছরান্তে। তা সেই উৎসবগুলো মূলত ধর্মীয় ভাবাবেগে পরিপূর্ণ, কিন্তু তারই মাঝে কোলকাতার শিল্প উজ্জাপী জনগনের জন্য আসে, একটি চলচ্চিত্র উৎসব, তাও আবার জাতীয় নয়, আন্তর্জাতিক। সেই বিষয় লিখতে বসে, প্রথমেই যা ভাবলাম তা হল, এই প্রবন্ধের বা প্রতিবেদনের নাম কী দেওয়া যায়। কারণ এই লেখাটা ভাবার সময়ে, তার বিভিন্ন রকম রূপ নিয়ে মাথাটা একটু ঝাঝিয়ে তুলেছিল, তার কারণ হল, প্রতি বারের মতো এবারেও আমার অভিজ্ঞতা অম্ল মধুর। সেই ভাবতে ভাবতে মাথায় এল অশ্বমেধ যজ্ঞের কথা। কেন হঠাত অশ্বমেধ? আজকের এই উত্তরাধুনিক সময় ও আস্তিত্ত্ববাদ-উজ্জাপী সমাজে চলচ্চিত্রগুলোও যেন এক একটা অশ্বমেধের ঘোড়া আর চলচ্চিত্র উৎসবগুলো হল, অশ্বমেধ যজ্ঞ। এবং সেই যজ্ঞাগ্নির মধ্যে দিয়ে পার করে এলে এক নতুন জীবন প্রাদান হয়, এবং বিশ্বের আধুনিক জনগন সেই মহা চলচ্চিত্রের রস পান করে সুখী বোধ করেন। এই বলাতে স্লেশ আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু সেই কটাক্ষেরও কিছু ভাবিয়ে তোলার মত কারণ আছে।
আমাদের মত চলচ্চিত্র-প্রেমীদের জন্য ক্যান্স, বার্লিন, ভেনিস এই শব্দগুলোর তাৎপর্যই অন্য রকম। এই জায়গাগুলোতে হয় কিছু বিশ্ব মানের চলচ্চিত্র উৎসব। যার ছোয়া এই ধারণাকে সার্টিফাই করে যে সেই ফিল্মগুলি সেই বছরের এমন কিছু কাজ, যা এক ঘণ্টা বা দু-ঘণ্টা বা কোনো কো্নো ক্ষেত্রে তিন ঘণ্টা ধরে অন্ধকার হলে বহু জনগনের সঙ্গে বসে দেখলে এক অদ্ভুত বৌদ্ধিক স্নান হবে।
এই স্নানের উল্লেখটি এখানে খুব জরুরি। ভারতের সাধারণ জনগনের কাছে স্নান ব্যাপারটা খুবই ব্যবহারিক। তাই একটি বালতী এবং একটি জলের স্রোত হলেই একজন সাধারণ ভারতীয় মানুষের স্নান সম্পন্ন হয়ে যায়। কিন্তু আমরা যখন রাজস্থান বা মহারাষ্ট্র বা দিল্লি আগ্রার দূর্গ ও প্রাসাদগুলোতে ঢুকি তখন ঘুরতে ঘুরতে আমাদের চোখে পরে, বিশাল কড়াই-এর মতো, কিছু পাত্র বা শুকনো কিছু পুকুর গোছের ব্যাপার যাকে অনেকে হামাম বলে। সেইগুলো সব রাজা রাজড়াদের ব্যাপার। এবারে এই দুই স্নানের উদাহরণ থেকে আমি ঢুকতে চাইছি, উত্তর আধুনিক, অস্তিত্ত্ববাদ উজ্জাপী সেই সমাজের সিনেমা হলে। হ্যাঁ এখনকার ভারতীয় হিন্দিভাষী ফিল্ম বিক্রেতা ও নির্মাতাদের পরিকল্পনা একটু অন্যরকম থাকে, সেই স্নানটা থাইল্যান্ডের স্পা-এর মতো না হয়ে জলকেলি করে স্নান করার একটা অনুভূতি দেয়, কিন্তু আমি আবার অন্য এক ধরনের আমোদ পূর্ণ বৌদ্ধিক স্নানের ধারণা তৈরি করতে চাইছি। স্নানের উল্লেখ করার কারণ কম্ফোর্টের ধারনাটাকে বোঝাবার তাগিদে। সেই কম্ফোর্টের একেবারে শুরুতেই দফা রফা করে দেয়, এই চলচ্চিত্র উৎসবের অতি ততপর কর্তৃপক্ষ। সামান্য একটি ফর্ম ফিলাপের জন্য তাদের কাছে ধন্না দিতে হয় ফিল্ম ফেস্টিভালের সাথে সরীক হওয়ার জন্য। এবং এই অশ্বমেধ যজ্ঞ যে শুধুমাত্র এই শহরের মানুষের জন্য; তাকে একদম শীলমোহর লাগিয়ে দেয় এই মান্ধাতার আমলের Physical Form fill up-এর প্রক্রিয়া।
আবার একটু ফেরা যাক এই অশ্বমেধের জাঁক ও সরঞ্জামে। অন্যান্য চলচ্চিত্র উৎসবের সমস্ত পাপারাজ্জি মূলক ব্যবস্থা পেরিয়া মূল অশ্ব হল, অসামান্য কিছু ফিল্ম। আমাদের এই স্থানীয় অশ্বমেধের ঘোড়া দু-রকম এবং যজ্ঞও দুই প্রকার। এক হচ্ছে সরকার বাহাদুরের ও তারকাভোগী জনগণের অন্যটি হল, ফিল্ম-প্রেমীদের সংগঠন, যার জন্ম ও মৃত্যু ওই যজ্ঞ স্থলেই। মানে সংগঠনটি ভেঙ্গে যায় আবার পরের বছর ঠিক ওই সময় তা জেগে উঠবে লড়বে এক একটি বিশ্ব মানের ছায়াছবিকে বড় পর্দায় উপভোগ করতে। সরকার বাহাদুর ও তারকাভোগী জনগণদের জন্য মূল উৎসবটি হল একদম প্রথম দিন। সেদিনের অশ্ব স্বরূপ আমাদের শহরে সুদূর মুম্বাই থেকে প্রতি বছর উড়িয়ে আনা হয় ভারতবর্ষের কিছু জনবন্দিত তারকাদের, যাদের ঠিক শৈল্পিক ফিল্মের সাথে খুব একটা পড়াশোনা বা যোগাযোগ নেই। মঞ্চে শুরু হয় এক অদ্ভূত যজ্ঞের, যেখানে সেই অশ্বরূপী তারকারা বিকৃত বাংলা উচ্চারন ও মাননীয় স্টেট সুপ্রীমোর গুণকীর্তনে মুখর করে তোলেন সেই যজ্ঞ স্থলটিকে। এই দিনটিতে আমাদের মতো ফিল্ম-প্রেমীরা খুব একটা ভিড় করেন না, তারা দম আটকে অপেক্ষা করেন দ্বিতীয় দিনের।
তবে কলকাতা শহরের এই চলচ্চিত্র উৎসবের একটা গুণ বলতে, এখানে এই ফিল্ম-প্রেমীদের ভিড়-এর অভিনব গঠন। কলেজ ছাত্র থেকে শুরু করে, সরকারী চাকুরিজীবী, অবসরপ্রাপ্ত ষাটোর্ধ জনগণ থেকে শুরু করে বিকেল বেলার একাকী মায়েরা (যারা তাদের একটি মাত্র চোখের মণিকে নিয়ে নন্দন চত্তরে চলে আসেন)। এই রকম বিবিধ রকমের ঝোল আমার মনে হয় না অন্য কোন শহরের চলচ্চিত্র উৎসবে দেখা যায় বলে। এই ভিড়ে আবার বহু মানুষই যে সারা বছর খবর রাখছেন শৈল্পিক সিনেমার তাও নয়, কিন্তু ওই যে বাঙালি খুব সহজে উৎসবের জোয়ারে গা ভাসাতে পারে, সেই গুণের জন্যেই হয়তো তারা সহজেই (তাদের জন্য ) কিছু অদ্ভুত ফিল্ম দেখে ফেলেন। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের কোনও রকম হোম ওয়ার্ক থাকে না বলে, অন্ধকার হলে, কিছু ফিল্মের সীন তাদের কিঞ্চিত ঘাম ঝড়িয়ে দেয়, কারণ তাদের কোলে তাদের নন্দের দুলালেরা, বা তারা পড়ে থাকেন এক অদৃশ মোরালিটির চশমা যা এই দেশের ভেসজ একটি প্রডাক্ট।
আগে এই উৎসব-এর চৌহুদ্দি ছিল কেবলই নন্দন চত্তর এখন তা সেই ব্যারাটোপকে ছাড়িয়ে, ছড়িয়ে পড়েছে সারা শহরে। যার জন্য অবশ্যই আমাদের বর্তমান সরকার বাহাদুরকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। যার দরুন নন্দনের আশে পাশে না থাকা জনগণকে বাড়তে থাকা ট্রাফিকের ঝাল মিটিয়ে নন্দনে এসে ফিল্ম দেখতে হয় না। কিন্তু এ-তো উৎসব। উৎসব হলে তার তো একটা আবহ লাগবে না হলে কি সেই বা ফিল্মপ্রেমীরা গা ভাসাবেন? কিন্তু সেই আবহের গুঁতো সামলানো ছিল এক মহাদায়। কারণ অন্যান্যবার যা ছিল কেবল সেতারের ঝংকার, সরদের গমক, ও তবলার রোল, তা এবারে বদলে গিয়েছিল, ৩ মিনিট তেত্তিরিশ সেকেণ্ডের একটি গান, যার শীর্ষক নদ, শহর জুড়ে সিনেমা। এই গানের সঙ্গে লেজুর ছিল অন্ত্যন্ত কাঁচা মননের একটি ভিডিও, যেখানে এই উৎসবের অন্তর্জাতিকতা বোঝাতে সারা ভিডিও জুড়ে কিছু শ্বেতাঙ্গ মানুষকে ঘুরিয়ে বেড়ানো হয়, এবং চলচ্চিত্রের উজ্জাপন বলতে শুধু মাত্র ৬০-৭০ দশকের কিছু ফিল্মের পোস্টার কারণটা হল, সেই সময়ের পর থেকে সেভাবে আন্তর্জাতিক মানের ফিল্ম বানাবার প্রথা বর্তমানে প্রায় বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে বাংলায়।
এই সমস্ত খানাখন্দ পেড়িয়ে সে ফিল্মের লাইনআপটি তৈরি করা হয়েছিল ফিল্ম-প্রেমী জনগণদের জন্য সেটা তবে খুবই মনরম ছিল। প্রতিবারের মতো এবারেও বহু ভালো কাজ এসেছিল উৎসবে। শুরুতেই গণ্ডোলা ফিল্মটি একটা কলরবের সৃষ্টি করে। তার পাশে এবারের অন্যতম আকর্ষন ছিল, পাম ডি’ওর প্তাপ্ত ফিল্ম অ্যানাটমি অফ এ ফল। একটি কোর্টরুম ড্রামা যা তার অভিনয় কৌশলে দর্শককে এক অদ্ভূত বাস্তবের আবহে ঘিরে রেখেছিল। এর সঙ্গে অনুরাগ কাশ্যপের কেনেডি এবং নুরি বিল্গে জালানের ফিল্ম আবাউট দ্য ড্রাই গ্রাসের জন্য প্রায় খণ্ড যুদ্ধ বাধার জোগাড় হয় নন্দন প্রাঙ্গনে। যদিও সে সব মিটে যায় এবং ওই যে বললাম সেই সংগঠন যার জন্ম ও মৃত্যু সেই উৎসব স্থলেই।
এই বারের যজ্ঞের বা উৎসবের অন্যতম আরেকটি উজ্জাপনের জায়গা ছিল মৃণাল সেনের শতবর্ষ। অসামান্য রকম আটপৌঢ়ে এই বাঙালি পরিচালকের প্রতি অনিহা বাঙালির নতুন প্র্যাক্টিস নয়। কিন্তু এবার মনে করেছিলাম, তার কিছু বদল হবে বুঝি। হয়তো প্রধান অতিথীর আসনে দেখা যাবে মৃণাল পুত্র কুনাল সেনকে। কিন্তু সে সব কিছু ঘটল না। হল না সেই মাপের উজ্জাপন, যেখানে একটা সেগ্মেন্ট রাখা যেতে পারত যে— পর পর তার সব কটি কাজ দেখানো হবে। বা তার পুরোনো কাজগুলির কিছু ভালো রেস্টর্ড প্রিন্টের প্রদর্শন হবে। কিন্তু প্রদর্শন হয়েছে মৃণাল সেনের আসবাবের, তার ফোনের, যেগুলো তে আর যাই হোক তার সিনেমা বা তার মননের ছাপ কতটুকু তা প্রশ্ন সাপেক্ষ।