ভাণ পত্রিকা
৩৯ তম ই-সংস্করণ ।। ৪৯ তম সংখ্যা ।।জুন ২০২৪
সম্পাদক :
সম্পাদনা সহযোগী :
প্রচ্ছদ :
নক্সা পরিকল্পক :
অন্যান্য কাজে :
ভাণ-এর পক্ষে:
পার্থ হালদার
কর্তৃক
৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬
( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )
৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) bhaan.kolkata@gmail.com ( ই – মেল )
Reg. No : S/2L/28241
সম্পাদকের কথা
।। সম্পাদকের কথা।।
জুন , ২০২৪
রাষ্ট্র নাকি আমাদের শিক্ষার কথা ভাবে। সমাজ ভাবে না। সমাজ- নামাজ নিয়ে ভাবে, হিজাব নিয়ে ভাবে। ছোঁয়াছুঁয়ি ঠেলাঠেলি, বিয়ে থেকে বিয়ানো, মৃতদেহের কবর নাকি আগুন, ডিভোর্স নিয়ে গুনগুন – ইত্যাদি প্রভৃতির কথা ভাবে। একটা যৌথ উৎসব পার্বন খেলা ধুলা যাত্রা-থেটার— এসবও আজকাল ভাবে না সমাজ। এসব পার্টি করে, পার্টির পো ধরা ক্লাব করে। কোম্পানি টাকা দেয়। সরকার ভাতা দেয়। ফলে আগের সমাজ আগেই ভেঙেছে। চন্ডীমণ্ডবে দেবু পণ্ডিতদের আর দেখা মেলে না। জ্যাঠারা আর ‘সরস্বতী’ বানান জিজ্ঞাসা করেন না। বড়দা আর ট্রান্সলেশন করতে বসায় না। কামার পাড়ার আন্দুকে ‘ছোট জাত’ বলার পর মা বলেন না— ঠাস করে একটা চড় মারব, এমন ভাবতে আছে!? অর্থাৎ সামাজিক পাঠচক্র মোটের ওপর বন্ধ হয়ে গেছে। এখন শিক্ষা বলতে সরকার পরিচালিত শিক্ষা। সে সরকার অনেক আগেই বুঝিয়ে দিয়েছে সরকারি শিক্ষার চাইতে বেসরকারি শিক্ষা ভালো। মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের মাধ্যমের চাইতে হিন্দি-ইংরেজি ভালো। প্রকৃত দেশজ জ্ঞান ভাণ্ডার নির্মাণের চাইতে বাজারের প্রয়োজনীয় লেবার এবং আরও বড় লেবার হওয়ার চেষ্টা করা ভালো। ২১ ফেব্রুয়ারিতে আবেগাপ্লুত অশ্রুসিক্ত গদগদ হওয়া ভালো। তারপর মাতৃভাষায় সরকারি কাজ করার উদ্যোগ বানচাল করে দেওয়া ভালো। এদেশের শিক্ষা কুক্ষিগত করে রাখতে ঘনঘন ইউরোপ ট্রিপ ভালো। ওদেশের মডেল এদেশের পক্ষে আদৌ উপযোগী নয় জেনেও চাপিয়ে দেওয়া ভালো। গরিব হেরে যাওয়া মানুষের ভাষা মাতৃভাষা-বাংলা। সাফল্য আর অহংকারের ভাষা ইংরেজি। সরকার বাহাদুরের অশেষ কৃপাতে সরকারি চাকুরি কমতে কমতে তলানিতে। বেসরকারি চাকরির বাজারে জীবনের অনিশ্চয়তা শ্রম আইনকে কবেই বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে।
এরপরও সরকারের ঘুম নেই। সরকারের স্বস্তি নেই। দেশে এখনও দু দশটা জায়গাও থাকবে কেন, যেখানে ছাত্র ছাত্রীরা ইচ্ছে মতো ভাবতে পারবে! তারা এমন কি যুক্তি গঠন করতে শিখবে! জ্ঞানকে সমকালীন বাস্তবতার সঙ্গে মেলাতে পারবে! কেন তারা নির্ভয়ে বাবা-জ্যাঠা-কাকাদের অপকর্মকে চোখে চোখ রেখে বলতে পারবে! আবার সরকারের বেতন নিয়ে কিছু শিক্ষক পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় গুরুবাদী সনাতনী ধারার গোপনীয় ছ্যাচড়ামোর বিরুদ্ধে ছাত্রদলের সঙ্গে হাত মেলাবেন!? ওদের কী গুরু হওয়ার ইচ্ছে নেই! নাকি কৃতজ্ঞতা বোধ লুপ্ত হয়ে গেছে!!
ঘুম আবার একেবারে লুপ্ত হয় তাদের, যারা অশিক্ষার মূর্তিমান প্রতীক হয়ে আপন পুচ্ছে নড়বড়ে ময়ূর পালক গুঁজে ‘কাকত্ব’ ঢাকার বৃথা চেষ্টা করেন! দেশের প্রধান প্রধান পদে থেকে যারা জ্বাল সার্টিফিকেট জোগাড় করে ডিগ্রী জারি করেছেন তারাই আমাদের দেশ নায়ক। তারা তো চাইবেনই সবাই জাল করুক। জুয়াচুরিতে দেশ ভরে যাক। ভুয়োতে ভরে যাক চরাচর। প্রকৃত শিক্ষিত জন দেখলে এরা কমপ্লেক্স তাড়িত হবেন, আতঙ্কে ভুগবেন— এতে আর আশ্চর্য কী! রাজ্য ও কেন্দ্রের পরিচালকদের ইতিহাসে নেহেরু থেকে মনমোহন, বিধান চন্দ্র থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য– এঁদের নানা মাত্রার সমালোচনা করা গেলেও এরা কেউই নিজেদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কে লুকোননি। মিথ্যা বলেননি। এবং তাঁদের সরকারের শিক্ষানীতি নিয়ে হাজারো প্রশ্ন থাকলেও এরা নীতি নিয়েছিলেন শিক্ষা বিস্তারের। সাহিত্য-শিল্প,সমাজ-ইতিহাস, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিস্তার ছিল ওদের লক্ষ্য। আর আজকের সরকারের শিক্ষানীতির হিডন এজেন্ডা হল শিক্ষা সঙ্কোচন, শিক্ষার ব্যবসা, শিক্ষার্থীদের মনে রাজনৈতিক দলের প্রতি বশ্যতা উৎপাদন। ডিগ্রি কলেজ গুলোতে নিয়মিত ডিগ্রিধারী বেকার তৈরি সরকারের অ্যাজেন্ডা। জিজ্ঞাসার মৃত্যু ঘন্টা বাজিয়ে স্কিলড লেবার বানানো– যারা দক্ষ হবে কাজে। কিন্তু কাজের নৈতিকতা নিয়ে, উচিত-অনুচিত নিয়ে একটি কথাও ভাববে না।
বোধে পঙ্গু, কাজে দক্ষ লেবারও আর সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তৈরি হবে না । ওসব হবে ম্যানেজমেন্ট গোছের প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান দিয়ে। সরকার ওদের জমি দেবে, ছাড় দেবে, ওদের তৈরি করা ফি-স্ট্রাকচারে নাক গলাবে না। বিনিময়ে ওরা ইলেকশনে জেতার টাকা দেবে। সরকারি পার্টি পেটি পেটি মদ কিনবে। বাইকের তেল কিনবে। বিরিয়ানি আর পেটোর বারুদ কিনবে। অনেক টাকা দিয়ে অনেক অনেক মিথ্যা প্রচার করবে। ভোটের আগে পাঁচশো টাকা দেবে। ভোটে না জেতালে সেটা বন্ধ করার থ্রেট দেবে। ওদিকে সরকার পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে বশংবদ রুচিহীন আনুগত্যে অশ্লীল পরিচালক বসাবে। আমলারা মুখে বিদ্যাসাগরের ভাব নিয়ে ক্ষমতার চটি চেটে একশা হবে। একটু ট্রান্সফার, ক্ষমতা, ফূর্তি ফার্তার জন্য বড় একাগ্র হয়ে শিক্ষায় ছাইভস্ম কী ঘটছে— তার থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিশ্চিন্তে ২৬ জানুয়ারি পালন করবেন। শিক্ষামন্ত্রী দুই বছরে পিএইচডি পাবেন। তিনি যে ডক্টরেট করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন এটাই যথেষ্ট। বাকি কাজ তার চাকর বাকর ভিসি টিসিরা পরমানন্দে করে দেবেন। সেই মন্ত্রী হয়ত সেই জন্যই শিক্ষকদের লোভী কুকুর বলবেন। মাস্টার দের জন তোষণের সরকারি কাজ দেবেন। পাঁচ দফা ভোটের জন্য সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোকেই অধিকৃত করা হবে। জনমানসের শতকরা নব্বই শতাংশের বেশি মানুষ মনে করবে ঘুষ ছাড়া চাকুরি অসম্ভব। সেই দেশেই বিদ্যাসাগরের দুশো বছর পূর্তি হবে। ঘুষখোর মন্ত্রীর ছবির তলায় ছোট করে, অল্প করে ‘বিদ্যাসাগর’ ঝুলে থাকবেন!!!
বছর তিন যাবত শিক্ষা দপ্তরের অলংকার হয়েছে ক্রমান্বয়ে দুর্নীতি। এমন দুর্নীতি যা দ্রৌপদীর শাড়ির থেকেও লম্বায় অধিক। শেষ দশটা বছর এমন কোন পরীক্ষা, এমন কোন ইন্টারভিউ, শিক্ষা সংক্রান্ত এমন কোন আয়োজন দুর্নীতিকে না নিয়ে সম্ভব হয়নি। দুর্নীতি হোক। চুনোপুঁটিরা ধরা পড়ুক। কোর্টে কেশ চলুক। সরকারের নাকি চাকরি প্রদানের সদিচ্ছা আছে। যারা নীতি-নীতি করছে তারাই তাদের চাকরি আটকে রেখেছে। কী কাণ্ড! কী অসহ্য! কী অদ্ভুত, কেমন শয়তান!
দুর্নীতি ঘুষ নীতি চাটুকার নীতি ইত্যাদিই চলছে। কিসের ওপর চলবে তাই ভর করার জন্য শিক্ষা দপ্তর এবং প্রতিষ্ঠান গুলোকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। ফোপরা হয়ে গেছে শিরদাঁড়া। রাজ্য কেন্দ্র কে কত ফেরেববাজ তাই নিয়ে ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতা এখন।
অথচ পথেঘাটে যোগ্য ছেলেমেয়েদের হাহাকার। ছাত্রছাত্রী গবেষক গবেষিকারা বিজ্ঞান ছেড়ে ল্যাব ছেড়ে রাজপথে গরিব হাবিলদার দের সঙ্গে লড়াই করছেন। সম্প্রতি নিট পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসে মানুষ দেখেছে ঘুষের পাহাড়। এদিকে নেট পরীক্ষা প্রশ্ন ফাঁস। বাতিল হয়ে গেছে পরীক্ষা। হতাশার করাল গ্রাসে চলে যাচ্ছে একটা প্রজন্মের যোগ্যতমরা। এ প্রান্তে হাজার দিন ছাড়িয়েছে অনশনের। যোগ্য প্রার্থীরা কোন সুরাহা পাননি। তার মাঝে চূড়ান্ত দুর্নীতিগ্রস্তরা দুই প্রান্তে ফের ক্ষমতায় আসীন। এর মানে এই নয় যে জনগণ দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিতে শিখেছে। এর মানে এই জীবনের ইসু অনেক, ভোট একটি। কিন্তু এটি পরিষ্কার দেশকে ধ্বংস করতে অ্যাটম বোম লাগে না। শিক্ষার পরিবেশকে লাগাতার দূষিত ও ব্যাধিগ্রস্ত করে রাখাই যথেষ্ট।
আমার উজ্জ্বল ছাত্র-ছাত্রীদের দিকে আর চোখে চোখ রেখে তাকানো সম্ভব হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, আমিও ওদের ঠকিয়েছি। অন্তত ওদের থেকে বয়েসে বড় হয়ে সময় থাকতে থাকতে বাগিয়ে নিতে পেরেছি একটা অমূল্য চাকরি। একথা কি অনেকের মনে হচ্ছে? যদি হয়, তবে বদল আসবেই।
যাপিত নাট্য ' এর দ্বিবিংশ কিস্তি লিখলেন - কুন্তল মুখোপাধ্যায়
কুন্তল মুখোপাধ্যায়
আগের সংখ্যার লেখায় একটু আক্ষেপ ছিল, এই সংখ্যার স্মৃতিচারণ ঠিক তার বিপরীত। শ্রদ্ধেয় পবিত্র সরকারের সহায়তায় আমি শ্রী মনোজ মিত্র ও শ্রী বিষ্ণু বসুর তত্ত্বাবধানে ‘থিয়েটার ও রাজনীতি ‘ নিয়ে আমার গবেষণার কাজ শুরু করি বিগত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি। রাজনীতি বিজ্ঞানের ছাত্র ও অধ্যাপক আমি, তাই রাজনীতি চর্চার পদ্ধতি, কীভাবে, কোন বিষয়কে রাজনীতির আওতায় ফেলব, সেগুলি আমার শিক্ষকদের বিশেষ করে প্রেসিডেন্সির প্রশান্ত রায়, সেন্টার ফর সোশ্যাল সায়েন্সের পার্থ চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, রাখহরি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখদের কাছ থেকে বোঝার ও চিহ্নিত করার সদুপদেশ পেয়েছি। কিন্তু ফলিত নাট্য চর্চার ইতিহাস জানার জন্য প্রায় গোটা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গুণী নাট্যজন, নাট্য ব্যক্তিত্ব ও নাট্যদলগুলির যে সহায়তা পেয়েছি, কোনো বিশেষ কেই সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা যায় না। শ্রদ্ধেয় শম্ভু মিত্রের কাছে দুই দিন যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। তিনি তখনই তাঁর মত করে এবিষয়ে আলোচনা করেছেন। তুলনায় শ্রদ্ধেয় উৎপল দত্ত ও শ্রীমতি শোভা সেনের কাছ থেকে পেয়েছি প্রভূত সাহায্য ও উৎসাহ। সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়,কুমার রায়, শিশির সেন শুধু যে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, তা নয় বরং নানাবিধ তাত্ত্বিক বিতর্ক মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে আমার প্রশ্নের ভাঁড়ারকে আরও সমৃদ্ধ করেছেন। সুধী প্রধান, চিন্মোহন সেহানবীশ, মণিকুণ্ডলা সেন, জলি কাউল, হীরেন ভট্টাচার্য প্রমুখ মনীষীদের স্মৃতিচারণ ভারতীয় গণনাট্য সংঘের গঠন ও ভঙ্গুরতার তথ্য জানিয়েছেন। এবং সেগুলি প্রামাণ্য গ্রন্থ, সংবাদপত্র, জার্নালের মাধ্যমে যাচাই করতেও শিখিয়েছেন । সুধী প্রধানের ‘মার্ক্সসিস্ট কালচারাল মুভমেন্ট’ এর তিনটি খন্ড, মণিকুন্তলা সেনের সেদিনের কথা এক্ষেত্রে খুবই কাজে দিয়েছে। বিদেশী বই-এর ক্ষেত্রে পারফরম্যান্স পলিটিক্স ইন পপুলার ড্রামা, পারফর্মাটিভ সার্কামটেন্সেস থিয়েটার এন্ড দি ডাবল, দি পলিটিক্যাল থিয়েটার ও ব্রেখটের প্রভূত লেখা এবং রিহের্সাল অফ রেভোলিউশন বইটি খুব কাজে দিয়েছে। গ্র্যান্ড হোটেলের নিচে ফরেন বুক পাড়া ও তার সর্বময় ব্যক্তি বন্ধু তপনের বিদেশি বই নিয়ে আসার কুশলতা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। বাংলা বইয়ের মধ্যে শ্রদ্ধেয় অজিত ঘোষ, ঋত্বিক ঘটক, উৎপল দত্ত, দর্শন চৌধুরী, বিষ্ণু বসু , জিয়া হায়দার, পবিত্র সরকারের বইগুলো খুবই সহায়তা করেছে। বিদেশি জার্নালের মধ্যে দি ড্রামা রিভিউ, ওয়ার্ল্ড থিয়েটার,পারফর্মেন্স আর্ট জার্নাল যেমন নিয়মিত দেখেছি, তেমনি বাংলায় বহুরূপী অভিনয়, গ্ৰুপ থিয়েটার, গণনাট্য, থিয়েটার বুলেটিন প্রভৃতি পত্রিকার সাথেও ছিল নিবিড় সম্পর্ক। তথ্যভিত্তিক তত্ত্ব নির্মাণে এই গ্রন্থ ও জার্নাল খুব কার্যকরী ভূমিকা নেয়।
কলকাতায় নীলকণ্ঠ সেনগুপ্ত, অরুণ মুখোপাধ্যায়, বিভাস চক্রবর্তী, মেঘনাদ ভট্টাচার্য, দেবাশিস মজুমদার, দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়, তড়িৎ চৌধুরী, জোছন দস্তিদার, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, অসিত বসু, অশোক মুখোপাধ্যায়, সোহাগ সেন, চিত্রা সেন, এবং আমার দুই অন্তরঙ্গ বন্ধু সংগ্রামজিৎ সেনগুপ্ত ও রথীন চক্রবর্তী আমার গবেষণায় সর্বোতভাবে সহায়তা করেছেন। প্রায় প্রত্যেকটি দল তাদের গঠন ও মেমোরেন্ডামের কাগজপত্র দেখিয়েছেন । কলকাতার বাইরে শান্তিপুর, বহরমপুর,শিলিগুড়ি, কুচবিহার, জলপাইগুড়ি, বর্ধমান, নৈহাটী, হাওড়া, কাঁচরাপাড়া, গোবরডাঙ্গা, বারাসাত, টাকি, নবদ্বীপ, রায়গঞ্জ প্রভৃতি জায়গায় নাট্যদলগুলির ইন্টারভিউ, সাখ্যাৎকার ভিত্তিক প্রশ্নোত্তর জানতে ভ্রমণ করেছি। হরিমাধব মুখোপাধ্যায়, জগমোহন মজুমদার,শ্যামলতনু দাসগুপ্ত, রবীন্দ্র ভট্টাচার্য বাড়িতে অতিথি হিসেবে বরণ করেছেন। বহরমপুরের প্রদীপ, গৌতম, দমদমে নটরাজ দাস প্রভৃতির সহায়তা ভোলবার নয়। দীর্ঘসময় কলকাতা ও শহরতলিতে তথ্য সংগ্রহের জন্য ঘুরে বেরিয়ে বুঝেছি পশ্চিমবঙ্গের গ্রুপ থিয়েটার আসলে মধ্যবিত্তের থিয়েটার। সদস্যদের শ্রেণিবিভাগ করলে জানা যায় সরকারি চাকরি, আধা সরকারি চাকরি যেমন ব্যাঙ্ক, বিমা, শিক্ষক-অধ্যাপক-শিক্ষাকর্মী, ছোট উদ্যোগপতি, ছাত্র-ছাত্রী, পেশাদার অভিনেতা (সংখ্যায় কম) এবং বেকার যুবক-যুবতীদের নিয়েই গ্রুপ থিয়েটারের শারীরিক গঠন, এবং গ্রুপ থিয়েটার একান্ত ভাবেই প্রতিষ্ঠান বিরোধী, নেতৃত্বের ধরণ ক) হায়ারর্নীকাল খ) গণতান্ত্রিক, এই দুইধরনের। অর্থাৎ নির্দেশককে কোথাও নেতা বা গুরু হিসেবে ভাবা হয়, কোথাও বা সহকর্মী বন্ধু । দোল ভাঙ্গাভাঙ্গিও গ্রুপ থিয়েটারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কোথাও নির্দেশক কিছু সদস্যকে নিয়ে অন্য গোষ্ঠী তৈরি করেন। যেমন থিয়েটার ওয়ার্কশপ ভেঙে অন্য থিয়েটার, আবার কোথাও বা কিছু গুরুত্বপূর্ণ সদস্য দোল ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে অন্য গোষ্ঠী তৈরি করেন, যেমন নান্দীকার ভেঙে থিয়েটার ওয়ার্কশপ। ৪০-এর দশক থেকে ৮০-এর দশক অবধি নাটক পছন্দের ঝোঁক ছিল, ক) দুর্ভিক্ষ খ ) উদ্বাস্তু সমস্যা গ) সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ঘ) শ্রমিক আন্দোলন ও সমস্যা ঙ) কৃষক আন্দোলন ও জন আন্দোলন চ) শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনচর্চা ছ) প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক নাটক জ) রূপকধর্মী-ইঙ্গিতবাহী ঝ) বিদেশি নাটকের রূপান্তর ঞ) ভারতের প্রাদেশিক নাট্যের অনুসৃজন, এবিষয়গুলি। উগ্রবিপ্লবীয়ানা, সীমিত প্রতিবাদ, বাস্তবের উপযুক্ত রূপায়ণ- গ্রুপ থিয়েটারের নাটকে যাই প্রতিফলিত হোক না কেন— পশ্চিমবঙ্গের গ্রুপ থিয়েটার আসলে মধ্যবিত্তের জন্য, মধ্যবিত্তের দ্বারা, মধ্যবিত্তের থিয়েটার।
কলকাতার গালগপ্পো'র অষ্টমপর্ব লিখলেন - কিশলয় জানা
কিশলয় জানা
কলকাতার স্বাস্থ্য
না না, শিরোনাম দেখে পাঠক যদি ভেবে থাকেন, এই অধম আদার ব্যাপারি হয়ে জাহাজের কারবারে নেমেছে, তাহলে ভুল করবেন। আমি বেশক্ দু’-কান কাটা গণ্ডমুর্খ হতে পারি, কিন্তু বুঝদিল্ ইনসান নয়, ফলে সেকেলে কলকাতার স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে লিখবার জন্য কলম ধরিনি। শ্রীযুক্ত বিনয়ভূষণ রায়ের অসামান্য গবেষণার পর ওই নিয়ে আমার কিছু বলার অর্থই হল, হঠকারিতা। আমি জাতে মাতাল তালে ঠিক, ফলে ও-পথে হাঁটার কথা ভাবিই নি। আমি বলছি, কলকাতার স্বাস্থ্যের কথা। আমি-আপনি-আপনারা যারা যারাই এই লেখার উপর চোখ রেখে সরে যাচ্ছেন, তাঁরা কলকাতাকে ভালোবাসেন বলেই মুহূর্তের জন্য হলেও চোখ রাখতে কসুর করেন নি। আর তাঁদের কাছে কলকাতা নিশ্চয়ই ইঁট-কাঠ-পাথরের স্তুপমাত্র নয়, তাঁদের কাছে কলকাতা এক জীবন্ত অনুভূতি, আবেগে ভরা অস্তিত্বময় এক সত্তা। এ হেন কলকাতার যে নিজের স্বাস্থ্য বলে যে কিছু থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। আমি বলতে চাইছি সেই স্বাস্থ্যের কথা। খোদ কলকাতার স্বাস্থ্যের কথা।
প্রথম থেকেই কলকাতার স্বাস্থ্য যে খুব ভালো ছিল, তা নয়। আজকের দিনে যে যে অসুবিধাগুলির সম্মুখীন হই আমরা, সেগুলির কোন কোনটি তখন দ্বিগুণ ছিল, কোনটি অন্য রূপে ছিল। তার কারণ যে কলকাতার গড়ন ও অবস্থান, তা আজকের দিনে আমরা অনেকেই জানি। এককালে সুন্দরবনের গর্ভে বড় হতে থাকা কলকাতা যখন থেকে ভূমিষ্ঠ হল, অর্থাৎ ডাঙা পেল, তখন থেকেই সে অসুখে ভুগছে। সে অসুখ চাইলেও সে লুকাতে পারে নি কোনদিন, অদূর ভবিষ্যতেও যে পারবে, এমন মনে হয় না।
আজকে আমরা যে মেট্রোপলিটন কলকাতার বাসিন্দা, তারা কল্পনাও করতে পারব না, আজ থেকে শ’ তিনেক বছর আগেও কলকাতা ছিল নেহাতই গণ্ডগ্রাম। তবে গণ্ডগ্রাম হলেও ‘কলকাতা’র অস্তিত্ব ছিল। অন্তত কলকাতা যে জোব চার্ণকের আবিষ্কার নয়, এ-কথা মর্মান্তিকভাবে সত্য। না হলে আবুল ফজল সেই ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে ‘আইন-ই-আকবরী’ লিখতে বসে আকবরের রাজত্বের অন্তর্গত ‘সরকার’ ও ‘মহাল’ বা পরগণার তালিকা দিতে বসে সাতগাঁও সরকারের অন্তর্গত ‘কলিকাতা’ মহালের উল্লেখ করতেন না। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে, কলকাতা তখন সপ্তগ্রাম সরকারের অধীনস্থ একটি গ্রাম এবং আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও তা দিল্লীর মোগল দরবারের অজানা নয়। কিন্তু কেমন ছিল সেই সময়কার ‘কলকাতা’ নামক পরগণা ? সে-সম্পর্কে কোন স্পষ্ট ধারণা দেওয়া মুশকিল। তবে আবুল ফজলের প্রশাসনিক রিপোর্ট তৈরির একশো বছর পরেও কলকাতা যে ছিল নেহাতই একটি ক্ষুদ্র গ্রাম, তা জানা যায় উনিশ শতকের একেবারে শেষ দিকে টাউন কলকাতার সেন্সাস রিপোর্ট থেকে। ১৬৮৬-র দিকে চার্ণককে সেই গ্রামে একটা বাণিজ্য-কুঠি তৈরি করতে ল্যাজেগোবরে হতে হয়েছিল। ব্লকম্যান সাহেব জানিয়েছেন, আওরঙ্গজেব যখন তিনটি পরগণার অধিকার হস্তান্তর করেন, তার একুশ বছর পরে, ১৭০৭-এর দিকেও আজকের চাঁদপাল ঘাটের কাছে ছিল ঘোর অরণ্য। হ্যামিলটন সাহেব তাঁর বিখ্যাত ইস্ট-ইণ্ডিয়া গেজেটিয়ারে ১৭১৭-এর যে কলকাতার ছবি দিয়েছেন, সেখানে জঙ্গলাকীর্ণ পরিবেশে বেশ কয়েকটি ডোবা এবং তার চারপাশে এক-এক জায়গায় দশ-বারোটি মাটির বাড়ির জটলা দেখতে পাওয়া যায়। এই ঘরগুলিতে যাঁরা বাস করেন, তাঁদের জীবিকা ছিল মূলত চাষআবাদ করা বলে হ্যামিলটন জানিয়েছেন। তবে, মাছ ধরাও যে তাঁদের জীবিকানির্বাহের অন্য আর একটি পথ ছিল, সে-বিষয়ে আর-এক সাহেব অর্মে জানিয়েছেন। আর ভারত তথা বাঙালি-প্রেমিক রেভারেণ্ড জেমস্ লঙ জানিয়েছেন, সপ্তদশ শতকের শেষ দিকেও কলকাতা ছিল, “a place of mists, alligators and of wild boars” ; কুয়াশা, কুমীর আর বন্য বরাহের বিচরণক্ষেত্র। এখন যেটি ক্রীক রোড, সেখানে আগে ছিল মারাঠা ডিচ, সেটি ছিল ইংরেজ আমলের কলকাতার দক্ষিণ সীমা। কারুর কারুর বিবরণ থেকে দেখা যায়, গঙ্গাতীর থেকে বর্তমান চিৎপুর পর্যন্তই কেবল লোকালয় ছিল, বাকি অংশে ছিল ভেদ্য-দুর্ভেদ্য উভয় প্রকার জঙ্গল। মেকলে তাঁর রিপোর্টে চৌরঙ্গীকে জলা-জঙ্গলময় স্থান বলে উল্লেখ করে ইংরেজদের হাতে তার প্রাসাদময়ী রূপ লাভের কথা বলেছেন। তিনিও লং-এর মন্তব্যকে সমর্থন করে বলেছেন, জঙ্গল, তৃণভূমি এবং নানা বিপদ্জনক জীবজন্তু দিয়ে ঘেরা ছিল কলকাতা নামক পরগণা। এই রিপোর্টগুলি পড়ে এক জায়গায় খটকা লাগে। তাহলে আবুল ফজল যখন কলকাতা পরগণার উল্লেখ করেছিলেন, তখন কলকাতা যদি আরও গভীর জঙ্গল হয়, তাহলে জনপদ আছে, এমন স্থানের নামে মহালের নাম না রেখে, কলকাতার নামোল্লেখই বা করলেন কেন তিনি ? এ-বিষয়ে এ-অধমের একটি-দু’টি অনুমান আছে, বেশক্ সাহস দেন তো বলি !
ভৌগোলিক কারণেই বঙ্গোপসাগরের গর্ভ থেকে উঠে আসা এই নিম্নবঙ্গ ঝড়ঝঞ্ঝাপ্রবণ। মৌসুমী বায়ু আসার আগে এবং বিদায় নেওয়ার সময় তুমুল ঝড়ঝঞ্ঝা-সাইক্লোন এখানে স্বাভাবিক ঘটনা। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে এইরকম এক সাইক্লোনের সংবাদ মেলে, যার দরুন নিম্নবঙ্গের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, বহু গ্রাম এবং অগণিত মানুষ জলের তোড়ে চিরকালের মতো ভেসে যান। সাগরসংলগ্ন এলাকায় এই ক্ষয়ক্ষতি বেশি হলেও, নিকট প্রতিবেশী কলকাতা এবং তৎসংলগ্ন গ্রামগুলি রক্ষা পেয়েছিল, এমন মনে করার কারণ নেই। নগর পুড়লে কি আর দেবালয় বাদ থাকে ? এই রকম কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে প্রাচীন কলকাতা পরগণায় অবস্থিত জনপদের অধিকাংশই বিনষ্ট হয়, এবং অবশিষ্ট মানুষ অন্যত্র সরে যান কিংবা কায়ক্লেশে ওই জায়গাতেই বাস করতে থাকেন। পরিত্যক্ত হওয়ার আগেও এখানে জঙ্গল ছিল। সে জঙ্গলে বাঘ, বুনো হাতি, বন্য বরাহ ইত্যাদি যে ছিল সে তো বিশপ হেবারের উনিশ শতকের তিরিশের দশকের ভ্রমণকথা পড়লেই জানা যায়। অতএব তারও দেড়শো-দু’শো বছর আগে কেমন অবস্থা ছিল সহজেই অনুমেয়। আবুল ফজলের রিপোর্ট পেশের সময় যে কলকাতা পরগণা ছিল, তা পরবর্তীতে বিনষ্ট হয় বলেই আমাদের অনুমান। এই কারণে, তার পর দীর্ঘকালের জন্য কলকাতার নাম ইতস্তত পাওয়া গেলেও, সেগুলির প্রাচীনত্ব বিষয়ে অনেকেই সন্দিহান। আর কালীঘাটের প্রাচীনত্ব যে নিতান্তই অর্বাচীন কালের, সে-বিষয়ে আগেই আলোচনা করা হয়েছে বলে এখানে আর চর্বিতচর্বণ করলাম না।
আর একটি প্রাকৃতিক কারণের কথাও বলব, সেটি হল নদীখাতের পরিবর্তন। যে কোন নদীই চিরকাল একই খাত দিয়ে বয়ে যায় না। গঙ্গা তো নয়ই। অনেককাল আগে গঙ্গার প্রধান স্রোত পদ্মা ছিল না, ছিল ভাগীরথী। ওই নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল বাংলার নিজস্ব সমৃদ্ধ গ্রাম, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও ধর্মীয় তীর্থগুলি। কাটোয়া, অগ্রদ্বীপ, নবদ্বীপ, ত্রিবেণী ইত্যাদি এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়। এককালে এই গ্রামগুলি ছুঁয়েই বাণিজ্য করতে যেতেন বাস্তবের শ্রীমন্ত বা চাঁদ সওদাগরেদের দল। পরবর্তীকালে গঙ্গানদীর সঙ্গে কুশী নদী এসে মিলিত হয়ে পদ্মা নামক নতুন খাত দিয়ে গঙ্গা প্রবাহিত হতে থাকে। পুরানো খাতটি শুকিয়ে আসে, নাব্যতা হারায়। জীর্ণ খাতটি আদিগঙ্গা নামে কলকাতা ছুঁয়ে গড়িয়া হয়ে রাজপুর, হরিনাভি, বারিপুর ( অধুনা বারুইপুর ), জয়নগর ইত্যাদি হয়ে দক্ষিণে ডায়মণ্ডহারবার হয়ে সমুদ্রে গিয়ে মিশেছিল। রেনেলের আঁকা মানচিত্রে অনুযায়ী, সরস্বতীর সঙ্গে ভাগীরথীর প্রাচীন ধারা হুগলীর কাছে সাঁকরাইলে মিলিত হয়ে একক নদী হিসাবে প্রবাহিত হয়েছে। এই প্রাচীন ধারাটিই যে আদিগঙ্গা কিংবা ‘বুড়িগঙ্গা’-সে-বিষয়ে অনেকেই একমত হয়েছেন। এই কারণে দীর্ঘকাল পর্যন্ত কলকাতার দক্ষিণপ্রান্তের গ্রামের হিন্দুরা টালিগঞ্জে এসে শবদাহ করতেন। পরবর্তীকালে এই প্রাচীন খাতটিকেই টালিসাহেব সংস্কার করেন এবং তার নাম হয়ে পড়ে টালি সাহেবের নালা অপিচ টলিনালা। পার্শ্ববর্তী জনপদটি সেই সময়েই গড়ে ওঠে এবং টালি সাহেবের নামানুসারে টলিগঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। ১৭৭৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর করা একটি চুক্তি অনুযায়ী সরকার তাঁকে ১৭৭৮ সালের ১ জুলাই থেকে বারো বছরের জন্য এই খাল এবং তার চার পাশের জমি লীজ হিসেবে দেয় এবং এক লক্ষ টাকা ঋণও দেওয়া হয় খালটি খনন করার জন্য। পরে তালির মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীকে আরও পনেরো বছরের জন্য লীজ দেওয়া হয়। ১৮৩৩ সালের আগে পর্যন্ত এই টালি নালাই ছিল হুগলী ও সুন্দরবনের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের একমাত্র নদীপথ এবং কলকাতা থেকে পূর্ববঙ্গে যাতায়াতের জন্য পোর্ট ক্যানিং হয়ে যাওয়ার একটি জনপ্রিয় নৌপথ। টালি এই পথে যাতায়াতকারী নৌকা ইত্যাদি থেকে ১% হারে পণ্যমাশুল সংগ্রহ করতেন এবং বাৎসরিক কিছু রাজস্ব সরকারকে দিতেন। তবে মনে রাখতে হবে, টালি সাহেব কিন্তু এই ব্যাপারে প্রথম নয়, তাঁর অনেক আগে। নদী তার খাত পরিবর্তন করায় নিম্নবঙ্গ থেকে লোকালয় হ্রাস পেতে থাকে, তা আবার জঙ্গল ও বুনো জন্তুর আখড়া হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ইংরেজরা এসে যে কলকাতা লিজ নেয়, তা ছিল যেমন অস্বাস্থ্যকর, তেমনই বিপদসঙ্কুল। কলেরা আর ম্যালেরিয়ায় কত যে সিভিলিয়ান হওয়ার স্বপ্ন দেখা সাহেবের শেষ শয্যা রচিত হয়েছে এর মাটিতে, তার ইয়ত্তা নেই।
এর সঙ্গেই আর-একটি যুক্তি প্রণিধানযোগ্য। বার বার প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিক্ষয় ইত্যাদি কারণে কলকাতা এবং তৎসংলগ্ন ভূমির অবনমনের ফলে কলকাতা ও সন্নিহিত মহালগুলিতে কোনদিনই জনপদ বিকশিত হতে পারে নি। এই অবনমন তত্ত্বটি প্রথম দিকে অনেকের সন্দেহ উদ্রেক করলেও, পরবর্তীকালে নানা পাথুরে প্রমাণ থেকে আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য। নগরায়ন শুরু হওয়ার পরে কলকাতার মাটি খুঁড়ে সেই সত্যের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে বার বার। বিভিন্ন স্থানে ভূত্বকের আশি ফিট নীচে পিট স্তরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, যার সিংহভাগ সুন্দরী গাছের অবশেষ বলেই প্রমাণিত হয়েছে। ফোর্ট উইলিয়ম তৈরির সময় সেখানে ৩৫০ ফিট গভীরতায় গবাদী পশুর অঙ্গারীভূত হাড়, ৩৬০ ফিট নীচে কচ্ছপের খোলা, ৩৯২ ফিট নীচে কয়লা ও গাছের নমুনা, ৪০০ থেকে ৪৮১ ফিট নীচে সমুদ্রের তীরে যে বালি দেখা যায়, তা পাওয়া গিয়েছিল। শিয়ালদহ অঞ্চলের একাধিক জায়গায় পিট স্তরে সিধে দাঁড়ানো অবস্থায় একাধিক সারিবদ্ধ সুন্দরী গাছের অবশেষ, আরও নীচের স্তরে প্রাণীর হাড় ইত্যাদি পাওয়া গিয়েছে, যা ধারাবাহিক অবনমনের নিদর্শন।
তবে রাজ্যের সুরক্ষার স্বার্থে আবুল ফজলকে এই জনপদগুলি বাধ্য হয়েই গণ্য করতে হয়েছিল। তা না হলে, সেই সময় থেকেই কলকাতা নামক জনপদের আলাদা কোন মাহাত্ম্য ছিল না। সমুদ্রতল থেকে নীচুতে অবস্থিত, একখানা পেয়ালা বা পিরিচের আকার এর। একবার জলে ডুবলে সেই জল বার করার কোন উপায় নেই। সেই কারণেই এখনও জলমগ্ন হলে প্রাকৃতিক ভাবে সেই জল বেরিয়ে যেতে পারে না। অতএব জল বেরুতে না পেরে বদ্ধ জলার সৃষ্টি হয়েছিল। যাঁরা শিবনাথ শাস্ত্রীর সুখপাঠ্য বই ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ বইটি পড়েছেন, তাঁরাই জানেন, সেকেলে কলকাতার কী অদ্ভুত সুন্দর কিন্তু যথাযথ রূপটি তিনি এঁকেছেন সেখানে। কলকাতায় ছিরিছাঁদহীন বাড়িঘর এবং প্রতিটি বাড়ির পাশেই এক-একখানি পারিবারিক এঁদো ডোবা-যা ছিল ম্যালেরিয়া ও কলেরার আঁতুড়ঘর, উনিশ শতকেও তা বহালতবিয়তে ছিল। কলের জল আসার পরেও সেগুলি ব্যবহৃত হত এবং প্রতিবছর সেই দুর্গন্ধময় পচা জলে স্নান ও বাসনপত্র ধোওয়া থেকে শুরু করে রান্নায় ব্যবহার করায় কাতারে কাতারে মানুষ মারা যেত। সেই সঙ্গেই ছিল আর্দ্র-অস্বস্তিকর বায়ু। এই বায়ুর ফলে হাঁপানি থেকে শুরু করে সর্দিকাশি-জ্বর ইত্যাদি লেগেই থাকত, অথচ চিকিৎসা-ব্যবস্থা ছিল নামে মাত্র। প্রায়ই মড়ক দেখা দিত, কলেরায় গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যাওয়া এমনিতেই বাংলার গ্রামগুলির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ছিল, কলকাতাও তার ব্যতিক্রম ছিল না। সব মিলিয়ে কলকাতার স্বাস্থ্য ছিল পিলের জ্বরে ভোগা রুগীর মতনই। সাহেবসুবোরা নাচতে নাচতে এসে অনেকেই এই আবহাওয়া যহ্য করতে না পেরে হয় এখানেই দেহরক্ষা করতেন, নয়তো ফিরতি জাহাজেই ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি করে পালাতেন। একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতেই পারে। ১৬৮৯ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় ইংরেজদের সংখ্যা ছিল বারশো। ওই বছর সংক্রামক জ্বরের প্রাদুর্ভাব হয় এবং পরের বছর জানুয়ারি মাসের মধ্যে চারশো ষাট জন মারা যান। হিকির গেজেট অনুযায়ী, ১৭৭০ সালে মহামারী এবং দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে খাস কলকাতায় ১৫ জুলাই থেকে ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ছিয়াত্তর হাজার দেশীয় এবং দেড় হাজার ইংরেজ মারা যান। এই বছর সর্বাধিক সংখ্যক মানুষ অজানা জ্বর এবং আমাশয় রোগেই মারা যান। ইওরোপীয়ানদের জন্য তখন নাহয় হাসপাতাল ছিল, কিন্তু দেশীয়দের জন্য গুটিকয় কবিরাজ এবং দৈবই ছিল ভরসা। বেচারা এখানকার দুর্ভাগা অধিবাসীরা ! কেউ কেউ স্থানান্তরে যেতেন, কেউ মহানগরীর মায়ায় পড়ে পতঙ্গের মতো পুড়ে মরবেন জেনেও এখানেই পড়ে থাকতেন, আর যাঁদের আর অন্য কোথাও যাওয়ার উপায় ছিল না, তাঁরা আর কী করবেন ? ভাগ্যে যা আছে হবে ভেবে নিয়ে এখানেই মশা-মাছি-ম্যালেরিয়া-কলেরার সঙ্গে ঘরগেরস্তি করতেন !
চেতনার মরদেহ: ‘লাশ’ ময়নাতদন্তে মৌলিকা সাজোয়াল
মৌলিকা সাজোয়াল
বাংলাদেশের বিশিষ্ট লেখক তারেক রেজ বরাবরই সমাজের বাস্তব ছবি এবং মানবিকতার মর্মস্পর্শী দিকগুলো চোখের সামনে তুলে ধরে পাঠককে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করেন। ‘লাশ’ তাঁর লেখা এমনিই একটি গল্প যেটা পড়ার পর সমাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। এই গল্পে বাস্তব জীবনের কঠিন সত্য এবং ন্যায়বিচারের অভাবের করুণ কাহিনি মনের গভীরে এমন এক ঘা দেয় যে, যে কোনো সহৃদয় পাঠক বাধ্যত নিজের যাপনের সুখ–স্বপ্নের বিবর থেকে বেরিয়ে আসেন। এই ‘লাশ’ গল্পটির একটি সার্থক প্রযোজনা করেছে নিত্যনাট্য নাট্যগোষ্ঠী।
‘লাশ’ শব্দটা উচ্চারণ করার পর সাধারণত আমাদের চোখে ভেসে ওঠে একটা নিথর নিষ্প্রাণ দেহ। লাশ বনে যাওয়ার পর সে দেহের আর কোনও পরিচয় থাকে না। তার আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড এবং অন্যান্য যাবতীয় পরিচয়বাহী, অর্থবাহী কার্ডও নিষ্প্রয়োজনীয় হয়ে যায়। কিন্তু এই গল্পের লাশ কেবল দেহের মৃত্যু মাত্র নয়, এই লাশ চেতনার মৃত্যু, শুভ বোধের মরদেহ। ইদানীংকালে আমরা সন্দেশখালির ত্রাস শেখ সাজাহানদের নৃশংস শাসন সম্পর্কে কম–বেশি সবাই ওয়াকিবহাল। কিন্তু এই ঘটনা তো নতুন নয়। যুগ যুগ ধরে মাৎস্যন্যায়ের এই কাহিনি পুনরাবৃত্ত হয়েছে। ‘লাশ’এইরকমই একটি হৃদয় বিদারক কাহিনির শিল্পিত প্রয়াস, যা ভানুমতী শীট, বাসন্তী শীট এবং গৌরী শীটদের চিরপরিচিত দুর্বার লড়াইয়ের গল্প বলে।
নাটকটি দেখায় কীভাবে ভানুমতীর মতো একজন অসীম মানসিক শক্তিধারী মা নিজের দুই মেয়েকে দুর্দান্ত প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে বড় করে তুলেছে, কীভাবে সমাজ নির্ধারিত ন্যায়–অন্যায়ের মাপকাঠিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে অজ্ঞাত কুলশীল একজন পলাতক আসামীকে ঘরে ঠাঁই দিয়েছে। ভানুমতী এবং তার মেয়েদের পরিণতি কী হল, তা জানতে গেলে আপনাদের অবশ্যই নাটকটি দেখতে হবে। শুধু এইটুকু বলা যায়, ভানুমতী তার মেয়েদের ‘ভালো মেয়ে’ নয়, ‘ভালো মানুষ’ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। বেঁচে থাকার জন্য তারা লাশ বয়েছে কিন্তু নিজের সম্মান বিক্রি করেনি। ভাগ্যের পীড়নে যাতে লাশ বনে যেতে না হয় তার জন্য লাশ বওয়ার কাজকেই তারা বেছে নিয়েছে। আজন্মকাল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতেও তারা ক্লান্ত হয়নি, অশুভ শক্তির কাছে মাথা নত করেনি। বরঞ্চ বারবার বিদ্রোহ করেছে শাসকের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। শাসক শ্রেণির চিহ্নিত করা ডাকাত লাটু পর্বতকে ভানুমতী নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে, শুধু তাই নয় লোকলজ্জা, লোকনিন্দার মতো বিষয়কে তুচ্ছাতিতুচ্ছ গণ্য করে নিজের অবিবাহিত মেয়েদের সঙ্গে তার মেলামেশায় কোনো বিধিনিষেধ জারি করেনি। ভানুমতীর মতো দুঃসাহসিক, অনমনীয় মানসিকতার প্রকৃত বিপ্লবীর ভূমিকায় পদ্মা সরকারের অভিনয় প্রশংসনীয়। একদিকে ভানুমতীর চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং অন্যদিকে মাতৃস্নেহের করুণ কোমল রস দুটো দিকই পদ্মা সরকারের অভিনয়ে যথার্থভাবে ফুটিয়ে উঠেছে। লাটু পর্বতের ভূমিকায় রাজু খাঁ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন। বিশেষত, নাটকের সেট ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে তার অভিনয়ের সাযুজ্য চমৎকার। নাটকের অন্যান্য অভিনেতারাও নিজ নিজ জায়গায় যথাযথ। নাট্যরূপ নির্মাতা অতনু সার্বজনীন প্রয়াসে একটি অত্যন্ত সময়োপযোগী নাটক তৈরি করেছেন। নাটকে সেটের ব্যবহার চমকপ্রদ। নাটকের বিভিন্ন পর্যায়, ঘটনা পরম্পরা, মানসিক উত্তেজনা এবং আবেগের নানান স্তর তুলে ধরার জন্য মঞ্চে, সেটের সুচারু ব্যবহার দেখা যায়। আবহ পরিকল্পনা নাটকের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। নাটকে ব্যবহৃত গানগুলি যথেষ্ট ভালো হলেও, গানের কথায় পুনরাবৃত্তি রয়েছে। তবে সব মিলিয়ে নাটকটি ‘লাশ’ গল্পের একটি সার্থক প্রয়াস হিসেবে দর্শকের অন্তঃকরণকে তোলপাড় করার ক্ষমতা রাখে।
‘দিল দোস্তি ডিলেমা’কে সিনেমাটিক লেন্সে ফেলে যাচাই করলেন - বৃতা মৈত্র
স্মার্ট, বুদ্ধিদীপ্ত ও মানবিক ‘দিল দোস্তি ডিলেমা’
গরমের ছুটিতে পরিবারের সঙ্গে কানাডা বেড়াতে যাবে এমনই এক জবরদস্ত প্ল্যান করেছিল আসমারা (অনুষ্কা সেন)! কিন্তু টগবগে এই কিশোরীর পরিকল্পনা সম্পূর্ণ ভেস্তে গিয়ে যেটা দাঁড়ালো, তাকে কাটাতে হলো তার দাদু-দিদার (মায়ের বাবা-মা) সঙ্গে, যে জায়গাটা আসমারা ও তার বন্ধুদের ভাষায় ‘ডাউন মার্কেট এবং ট্যাকি’! যদিও, একদা এখানেই জন্ম ও শৈশবের দিনগুলি কেটেছিল আসমারার। তিন বন্ধু মানে অসাম থ্রিসাম (Awesome Threesome)–
আসমারা, নয়না (রেবথী পিল্লাই) ও তানিয়া (এলিশা মেয়র)। এরা তিন উচ্চবিত্ত পরিবারের পোশাক-আশাক ও চলনে-বলনে আধুনিক ফ্যাশন সচেতন কন্যা। পরিবারগুলির ক্ষেত্রে পৃথক পরিবেশ, পরিস্থিতি ও সম্পর্কের রসায়ন এগিয়ে নিয়ে যাবে ওয়েব সিরিজ ‘দিল দোস্তি ডিলেমা‘র কাহিনি, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আসমারার কথা।
বস্তুত বেঙ্গালুরুর টিব্বরি রোডের প্রাচীন গন্ধমাখা বাড়িটিতে নিতান্ত বাধ্য হয়েই যেতে হয় আসমারাকে। বলা যায়, তাকে শাস্তিস্বরূপ পাঠানো হয় সেখানে। কেন এই শাস্তি, সে তো আপনারা ‘দিল দোস্তি ডিলেমা‘র প্রথম পর্বেই জানতে পারবেন! গল্প আগে থেকে বলে দিলে, সব মজা মাটি! প্রাইম ভিডিওতে ইতিমধ্যেই স্ট্রিমিং শুরু হয়ে গিয়েছে সমকালীন ভাবনার এই ওয়েব সিরিজের। আর শুরু থেকেই দর্শক নিজেদের রিলেট করতে পারছেন এর সঙ্গে। প্রতি ভারতীয় মধ্যবিত্ত পরিবারেই রয়েছে আসমারার মতো কিশোর-কিশোরী আর তাদের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ায় হিমশিম খাওয়া অভিভাবকবৃন্দ।
একে আমরা নিছক জেনারেশন গ্যাপ বলব না অন্য কিছু, তাই নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। এটাও ঠিক, দোষ পুরোটাই নতুন প্রজন্মেরও নয়! তবে, সমস্যাটা যে তীব্র থেকে তীব্রতর হওয়ার পথে, সেই বিষয়ে দ্বিমত নেই। এই সিরিজে অবশ্য এহেন বিষয়টি প্রচ্ছন্ন বলা যায়। এমনকী উচ্চ ও নিম্নবিত্তের মধ্যেকার চিরন্তন লড়াইও নয়। পরিচালক ডেব্বি রাও এইসবের প্রেক্ষাপটে খুব সুন্দরভাবে বুনেছেন এক গভীর মানবিক উপলব্ধির গল্প। একেবারে বিপরীত পরিবেশে কার্যকারণে পৌঁছে কীভাবে এক কিশোরীর মনোজগতে আলোড়ন ঘটে যায়, পর্বে পর্বে সেই অনবদ্য পরিবর্তনের ছবি আমরা দেখি ‘দিল দোস্তি ডিলেমা‘য়।
দাদুর বাড়িতে নির্বাসিত হওয়ার পরও আসমারা নিজের মেজাজ-মর্জির হিসেবে নানা ফন্দিফিকির আঁটার চেষ্টা করে। তার প্রাণের দুই বন্ধু নয়না ও তানিয়ার কাছে একটা মিথ্যে ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করে সে, যেন কানাডাতেই আছে আসমারা। এভাবেই নিজেকে খুশি রাখার কথা ভাবে সে। কিন্তু দাদুর বাড়ির ওয়াইফাই কানেকশন না থাকায় সেটা সহজে সম্ভব হয় না। বাধ্য হয়ে তাকে মেলামেশার জন্য বেছে নিতে হয় প্রতিবেশী দুই ভাইবোন, রুকসানা (বিশাখা পান্ডে) ও ফরজানকে (কুশ জোটওয়ানি)। এরই পাশাপাশি আমরা পাই সুহেলকে (ঋতিক ঘানসানি), যার সঙ্গে চলছে রুকসানার মন দেওয়া-নেওয়ার পালা। এই যাবতীয় মেলামেশা কোনদিকে চালিত করে আসমারাকে, ওদের সঙ্গ কতটা বদলে দেয় এই কিশোরীকে–গল্পের সেই দুর্দান্ত টুইস্ট দেখবার জন্য শেষ পযর্ন্ত এই সিরিজ দেখতেই হবে আপনাকে।
এমন এক সিরিজের ক্ষেত্রে কাহিনি এক গুরুত্বপুর্ণ বিষয়। আর এর জন্য কলম ধরেছেন অনুরাধা তিওয়ারি, বাগস ভার্গব কৃষ্ণ, রাঘব দত্ত ও মঞ্জিরি বিজয়। সিরিজের মেরুদণ্ড ওঁরাই তৈরি করে দিয়েছেন। লেখক আন্দালিব ওয়াজিদের ‘Asmara’s Summer’ উপন্যাস অবলম্বনে সৃষ্ট এই সিরিজে বর্ণিত তিন প্রজন্মের মানসিক ও ব্যবহারিক আদানপ্রদান আপনার খুব চেনা মনে হবে। খুব স্মার্ট, ছোট ছোট অথচ গভীর সংলাপে এই আদানপ্রদানের ছবি উঠে আসে সিরিজের পর্বে পর্বে। পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ইত্যাদি মূল্যবান বিষয়ের মাঝে এক কিশোরীর আত্মোপলব্ধি বড় সুন্দরভাবে উঠে আসে প্রত্যেক অভিনেতার কাজে।
এক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মের নামগুলি তো আগেই বলেছি। প্রত্যেকে চরিত্রের মাপে স্মার্ট, সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ। এরই পাশাপাশি সাত পর্বের এই সিরিজকে চূড়ান্ত উপভোগ্য করে তোলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে প্রথমেই বলতে হবে শিশির শর্মা (আসমারার দাদু/নানা) ও তনভি আজমি (আসমারার দিদা/নানি)-র নাম। পৃথকভাবে অসাধারণ দুজনেই, সঙ্গে উল্লেখ্য ওঁদের অনস্ক্রিন কেমিস্ট্রি। এছাড়াও নিখুঁত চরিত্র চিত্রনে মন ভরান সুহাসিনী মূলে, প্রিয়াংশু চ্যাটার্জি, মহেশ ঠাকুর, অর্জুন বেরি, শ্রুতি শেঠ, খালিদ সিদ্দিকি, পরিণীতা শেঠ, দিলনাজ ইরানী, সমবেদনা সুয়ালকা, কানন গিল প্রমুখ।