ভাণ পত্রিকা
৪০ তম ই-সংস্করণ ।। ৫০ তম সংখ্যা ।।জুলাই ২০২৪
সম্পাদক :
সম্পাদনা সহযোগী :
প্রচ্ছদ :
নক্সা পরিকল্পক :
অন্যান্য কাজে :
ভাণ-এর পক্ষে:
পার্থ হালদার
কর্তৃক
৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬
( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )
৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) bhaan.kolkata@gmail.com ( ই – মেল )
Reg. No : S/2L/28241
সম্পাদকের কথা
।। সম্পাদকের কথা।।
জুলাই, ২০২৪
ভালো চাইলেই কি সর্বদা ভালো হয়? ভালো হবে মনে করলেই কি জোর করে চাপিয়ে দেওয়া চলে? তখন কি চাপিয়ে দেওয়াটাই ভালোর চাইতে বড় হয়ে ওঠে না? আমি যে ভালো চাইছি, সেটা যে এই সময়ে, এই বাস্তবতায় একান্ত করে ভালো— সেটিই বা ঠিক করে কে? যদি ঠিক করার চেষ্টাও কেউ করে ফেলে, তবে হাজারো মেথডের মাঝে কোন মেথডটি ভালো, তার মালুম হবে কেমন করে?
না, না গুলিয়ে দিতে আসিনি, আমার সহজ কথাটি হলো, আমার মনে হওয়াতে ‘ভালো’ ভালো হবে, আর ‘মন্দ’ হবে মন্দ— এই সহজ সমীকরণটি হিতকরী নয়। মা যে ছেলেটির ভালোর জন্য গিটার ভেঙে রসায়নের সূত্র গিলতে বললেন, জ্যাঠা যে ছাদ থেকে আমার জোৎস্না-প্রিয় বোনটিকে নিচে নেমে আসতে বললেন, বাবা যে দাদার চরম অনিচ্ছা সত্ত্বেও সায়েন্স পড়ানোর ব্যবস্থা করলেন– সে সবই মা, বাবা, জ্যাঠার দৃষ্টিতে ছেলেমেয়েদের ভালো করবার জন্য। এই যুক্তিতেই ইংরেজদের দল, অসভ্য ভারতবাসীকে শাসন করেছিল। যে যুক্তিতে আমরা শহুরে উন্নতি আর তথাকথিত সাফল্যের দৃষ্টি দিয়ে গ্রামকে, গোষ্ঠীকে সবক শেখাতে চাই। যে যুক্তিতে সাঁওতালদের ভালোর জন্যই ওদের আমরা অপমান করি, নিচু চোখে দেখি!
আমরা খুব ভালো গান গাই, ভালো কবিতা লিখি, ভালো সিনেমা— থিয়েটার বানাই। অথচ কী পোড়া কপাল এমন ভালোর প্রেমে মজবে, তেমন ভালো মানুষ কই? খারাপদের, অসহায়দের সহায় হতে আমাদের চেষ্টায় খামতি নেই, অথচ এত খারাপ, এমন আনকালচার্ড– ভালোর হাত পেয়েও পচা কাকার পচা হাতের দিকে ওদের নজর। এসব বোঝায়, খারাপের ভালো করা মুশকিল! তাই এত সুর আর এত গান ওদের জানা হয় না, এত রঙ আর আলো ওদের দেখা হয় না। এত তত্ত্ব ও সত্য ওদের চেনা হয় না। এ যেন ওদের অর্দিষ্ট। একে খণ্ডানো যায় না! সাধে কী বলে— লোকের ভালো করতে নেই!
অথচ এর একটা উল্টো কথাও আমরা কম আওড়াই না– পাগলেও নিজের ভালো বোঝে। তাহলে ওদের নির্বাচনে, আমাদের ‘ভালো’ যে পাত্তা না পেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়, তারও একটা যুক্তি আছে। ওই যুক্তিটা খুঁজে পেলেই মুক্তি! কেন না প্যাসিভ রিডার বলে কিছু নেই। প্যাসিভ-ই তার স্পেসিফিক প্রতিক্রিয়া। সেই প্রতিক্রিয়ার পেছনের কারণ গুলিকে খুঁজে পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে।
তো, কারা করবেন এই চেষ্টা? যারা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোকে নেগেটিভ অর্থে দেখেন না। ঘরকে খাওয়ানোর স্বীকৃতিটুকু দিয়ে, কৃতজ্ঞ থেকে; যারা বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন। যারা বুঝতে পারেন সৎ লড়াইয়ের বারংবার পরাজয়ের গভীরেও কীভাবে মিশে থাকে অল্প অল্প ভালোর ঝিলিক। বিদ্যাসাগরের কথা কজন শুনল– এই হাহাকারের গভীরে দেখি মুক্তোর মতো ঝলমল করে আলো ছড়াচ্ছে সাদিয়া, সর্বানী, আয়েশা অনুত্তমারা– আমাদের কলেজ রুমে, যে মেয়েদের মায়েরা কেউ বড় স্কুলে যাননি কখনও।
আমাদের ভালো ভালো চেষ্টার সৎ উদ্যোগ খাজাঞ্চি খাতার হিসেবে হেরে যায়। কালের খাতায় ওড়ায় সাদা পায়রা– জীবনে ভাতের গন্ধের সঙ্গে মিশিয়ে দেয় ভালোবাসার ঘ্রাণ। আজকাল এই একদা আশা-ঝলমল মানুষগুলোকে বিমর্ষ দেখি। দেখি ভেতরে ভেতরে ক্লান্ত অবসন্ন কিছুটা বা অসহায় হয়ে আছেন ওরা সব। ওদের চোখ কেমন ঘোলাটে আর দৃষ্টিহীন। পথে নেমে চেনা পথ অচেনা যেন, চেনা সুরে আর কণ্ঠ মেলে না, চেনা হাসিকে অচেনা মানে। মনে হয় সব বদলে গেল বোধহয়। সবাই বোধহয় পাঁকের গন্ধে বুঁদ হয়ে আছে। সবাই বোধহয় কোনোমতে বেঁচে থাকতে চায়। কেউ বোধহয় আর নীতি-নৈতিকতা নিয়ে ভাবে না। সকলে বোধহয় হার মেনে ছেড়ে দিয়েছে হাল। অনেক দিন ধরে শান না দিতে দিতে ভোঁতা হয়ে গেছে বিবেকের ধার! তাই আমাদের কেবল বলে যেতে হবে, লিখে যেতে হবে, এঁকে যেতে হবে, রেখে যেতে হবে কিছু চিহ্ন আসছে দিনের ভালোর নেশায় পথ খুঁজবে যে পথিক, তার জন্য।
আর এ জীবনেও কিছু নতুন উদ্যম তৈরি করতে হবে আমাদের। এই যে শয়ে শয়ে ‘ঠিক কথা’ যথাযথভাবে বলছে বামপন্থী তরুণী, তবু ও যে ভরসার ক্ষেত্র হতে পারছে না। মানুষ শেষত ফিরিয়ে নিচ্ছে মুখ। সে তরুণী হতাশ না হয়ে উদ্যমী হয়ে ভাবুন, ভালো করার চাইতে ভালো করার নেশা তাকে পেয়ে বসেছে কিনা! এই যে মন-মেধা দিয়ে বানাচ্ছি লড়াকু মানুষের থিয়েটার, পরিচালক ভাবুন যাদের জন্য এ ছবি এ থিয়েটার তা তাদের বাস্তবতার স্পর্শ নিয়ে গড়ে উঠছে কিনা! চিত্রকর ভাবুন যাদের মন পেতে ব্যাকুল তার হৃদয় সেই মানুষগুলির মনোজগতে এগুলির অর্থ কী– অন্তত এই দুঃসময়ে। আমি যে সাহসিকতার আহ্বান জানাচ্ছি তার কতটুকু আমি নিজে অর্জন করেছি সত্যি করে– একথা ভাবুন প্রতিবাদী। যাদের পক্ষে আমি দাঁড়াচ্ছি শিল্পে সাহিত্যে রাজনীতিতে, একথা কি আমি ভাবতে পারতুম অর্থনৈতিক এবং সামাজিক চরম দুরবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে? এ জরুরি প্রশ্ন তোলা দরকার। আমাদের তত্ত্ব আর বাস্তবের মাঝে একটা কালো বেড়াল মুচকি হাসছে, একটা অকর্মণ্য হনুমান ভেঙচি কাটছে। সমাজ-সময়লগ্ন ব্যক্তি মানুষের অন্দর মহলের লুকিয়ে রাখা ক্ষত, অস্বস্তি আর দ্বন্দ্বকে চিনতে পারাটা প্রথম কাজ, ফুটিয়ে তোলার পরিশ্রম ও প্রতিভা তো অনেক পরের কথা।
আজকাল মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের যাবতীয় কলা, এমনকি ক্ষমতার বিরুদ্ধে যে কোনো দ্রোহের গভীরে রয়ে যাচ্ছে আত্মরতি, নিজেকে উচ্চমার্গের মানুষ প্রমাণের পাহাড়প্রমাণ লোভ। উদ্দেশ্যের প্রতি প্রীতি নেই কোনো, আছে মহৎ উদ্দেশ্যকে আলম্বন করে, প্রয়োজনে মুখোশ করে একটা সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার খেলা। একথা যদি সর্বাংশে সত্যি নাও হয়, এই খেলা ক্রমশ বড় হচ্ছে দেখতে পাই। যাঁরা প্রকৃত পথের প্রত্যাশায় প্রাণান্তকর, তাঁদেনকেও এরা আরও ক্লান্ত করে দেন। একই মঞ্চে বসে থাকা আগামীর চোখ খুঁজে নেওয়ার মতো ভালো চোখ আর কয়টা? সে চোখের সন্ধান পেলেই ঘুম পাড়ানোর ব্যবস্থা করবে ক্ষমতা, তার সহায় হচ্ছেন এই পরজীবী এঁটো-কাঁটারা— আমার ঘোলাটে চোখেও আমি তা দেখতে পাচ্ছি।
যাপিত নাট্য-এর ত্রয়োবিংশ কিস্তি লিখলেন - কুন্তল মুখোপাধ্যায়
[২৩ পর্ব ]
কুন্তল মুখোপাধ্যায়
এই সময়ের কিছু আগে শূদ্রায়ন-এর রাষ্ট্রীয় পুরস্কার লাভ-এর পর আমেরিকান লাইব্রেরি আর ICSSR-এর সৌজন্যে আমি একটা স্কলারশিপ পেয়ে অস্ট্রিয়ার সোলোজবুর্গ ইউনিভার্সিটিতে ৪৫দিনের জন্য পড়াশোনা করতে চলে আসি। সেবারের কোর্স ওয়ার্ক-এর থিম ছিল, Role of Art and Religion in building culture। পৃথিবীর ৪০টি দেশের প্রতিনিধিরা এসেছিলেন। আমার রুম মেট ছিলেন আব্রাহাম আক্রম ঘানার থেপসিয়ান। রোজই আলোচনা হত, ওয়ার্কশপ চলত, লাইভ পারফরমেন্স হতো, এবং বাইরে নিয়ে গিয়ে লাইভ পারফরমেন্স দেখানো হতো। শহর ভ্রমণ তো ছিলোই। ক্যাম্পাসটা ছিল, সাউন্ড অফ মিউজিক-এর প্রাসাদটা। আমার সঙ্গে সকলেরই হৃদ্যতা হয়েছিল, তবুও স্পেনের হেলেন, বুলগেরিয়ার জন, আমার রুম মেট, পাকিস্তান এর সাইদা দিদি, আমেরিকার জনাথন আর ব্রিটেন-এর রবার্ট-এর কথা আলাদা করে বলতে হয়। চার্চ নিয়ে গিয়ে চার্চ সংগীত, বা রাশিয়ার ফিল্ম মেকার এর ছবি তৈরির কথা, বা জাপানি শিল্পীর ৬টা ছবি এঁকে তারপরে প্রশ্ন উত্তর মনে থাকবে অনেকদিন। আমি ও শূদ্রায়ন-এর নির্মাণ এবং তার সমাজ তাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আলোচনা করেছিলাম। স্বীকার করতেই হবে এসবই শূদ্রায়ন-এর সৌজন্যে ঘটেছিল।
কলকাতার গালগপ্পোর নবমপর্ব লিখলেন - কিশলয় জানা
ঘাটের কথা,৯ পর্ব
কিশলয় জানা
কেউ কেউ ভুলবশত এই লেখাটির একটি দুটি পর্ব পড়ে আমাকে ব্যক্তিগতভাবে জিজ্ঞাসা করেছেন, কলকাতার ইতিহাস আমি নতুন করে লিখতে প্রয়াসী হয়েছি কি-না। সবিনয়ে বলি, সে দুঃসাহস দেখানোর কথা সুখস্বপ্নেও আমি ভাবতে পারি না। আমি কেবল ‘পক্ষী রাঙাটুনি’র মতো তেষ্টা মেটাতে কলকাতা নামক বড় গাঙের দু-এক বিন্দু জল পান করতে চাইছি মাত্র। বড় গাঙের কথা যখন উঠলই, তখন তাতে ঘাট থাকবে না এমন কি আর হতে পারে ? যেখানে রাধারমণ মিত্র মহাশয় জানিয়েছেন, নেই নেই করে কলকাতার বড় গাঙের বুকে সেকালে ঘাটের সংখ্যা ছিল প্রায় ৮২ টি। তার সবকটিই আর নেই, অনেক আগেই হয় নদীগর্ভে, নয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সলিল সমাধি ঘটেছে, কয়েকটি অবশ্য এখনও আছে এবং যে কোনদিন সকাল-বিকেল সেই সব ঘাটে ঘুরে আসুন, দেখবেন ব্রাহ্মণ, শুদ্র, পাগল, ফকির, সাধু-সন্ন্যাসী, হিন্দুস্থানী পুণ্যার্থিনী মহিলা, অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ, ভবঘুরে, বেকার, কোথাও বসতে না-জায়গা পাওয়া প্রেমিক-প্রেমিকা থেকে ঘটি গরম, ঘুঘনিদাদা, রসিক চা-ওয়ালা—সে যেন এক মেলা ! ঘাটগুলিকে তখন আপনার মনে হবে, মহামানবের মিলনক্ষেত্র !
এইসব ঘাটের আগেও ঘাট ছিল, তাদের ইতিহাস আর খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে, কালীঘাটের কাছাকাছি আদি গঙ্গার বুকে একটি ঘাটের কথা প্রাচীন কাব্য ইত্যাদিতে জানা যায়, যেখানে নেমে কালীঘাটে পূজা দিতেন বাণিজ্য করতে যাওয়া বণিকেরা। ‘কালীক্ষেত্র দীপিকা’তে সাধারণ মানুষেরও এই ঘাটে নেমে পূজা দিতে যাওয়ার কথা আছে। সেই প্রাচীন ঘাটকে যথাযোগ্য সম্মান জানিয়েই আমরা আঠারো-উনিশ শতকের দিকে তৈরি কয়েকটি ঘাটেই ঘুরি বরং। সে-সব ঘাটের কথাও তো ক্রমে হারিয়ে যেতে বসেছে !
ইতিহাসের পাতায় ঢুকে পড়া ঘাটগুলির কথা উঠলেই সবার আগে মনে পড়ে চাঁদপাল ঘাটের কথা। পলাশীর যুদ্ধের আগে চাঁদপাল ঘাটের কোন অস্তিত্ব ছিল কি-না জানা যায় না। তবে কোথাও এই ঘাটের উল্লেখ দেখা যায় না। কিন্তু পলাশী-পরবর্তীকালে কলকাতায় আগত গণ্যমান্য রাজপুরুষদের সকলেই প্রায় এই ঘাট দিয়েই এ-দেশে অপিচ কলকাতার মাটিতে পা রাখতেন। সে বড়লাট হোক, কিংবা হাই কোর্টের বিচারপতি হোক কিংবা অন্যান্য সিভিলিয়ানরা। বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস যেমন এই ঘাটে পা রেখেই বাংলায় আসেন, তেমনই পরবর্তীকালে তাঁর পরম শত্রু ফিলিপ ফ্রান্সিসেরও এই ঘাট দিয়েই ফোর্ট উইলিয়মে প্রবেশ। শোনা যায়, একমাত্র লর্ড এডিনবরা বাদে যত জন গভর্ণর জেনারেল রেলওয়ে স্থাপনের আগে এ-দেশে আসেন, তাঁদের সকলেরই প্রবেশপথ ছিল চাঁদপাল ঘাট। এই ঘাটটি কে তৈরি করেছিলেন, তা নিয়ে মতভেদ আছে। একদলের মত, ঘাটটির নাম চাঁদপাল থেকে মনে করা সঙ্গত যে, কোন দেশীয় গণ্যমান্য এই ঘাটটি নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর নাম কালের প্রবাহে হারিয়ে গেছে। অন্যদল বলেন, ঘাটটি ইংরেজদেরই তৈরি করা। এ-দেশে আগত রাজপুরুষেরা যাতে অবতরণের জন্য একটি স্থায়ী এবং মজবুত ঘাট পান, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই চাঁদপাল ঘাটটি তৈরি করা হয়। করেন ফোর্ট উইলিয়মের কর্তাব্যক্তিরাই, অবশ্যই ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির অনুমতি নিয়েই। তবে ঘাটটির আসল নাম ছিল সেন্ট পলস্ ঘাট। সেই সেন্ট পল সাধারণের মুখে মুখে চাঁদপাল ঘাটের উদ্ভব। এমনটি হওয়া বিচিত্র কিছু নয়, স্বাভাবিক। কিন্তু তৃতীয় মতটি অভিনব। এই মত অনুসারে, ইংরেজরা ঘাটটি যখন তৈরি করা শুরু করে, তখন কুলি-মজুর ইত্যাদির খাবারদাবারের জন্য চন্দ্র পাল নামের এক মুদী সেখানে একটি দোকান দেন। পরবর্তীকালে ঘাট তৈরির কাজ সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পরেও মুদীর দোকানটি থেকে যায়। চন্দ্র পালের ঘাট কথাটি তখন থেকেই মানুষের মুখে মুখে নির্দিষ্ট স্থান বোঝাতে ব্যবহৃত হতে থাকে, সেই থেকেই অপভ্রংশে চাঁদপাল ঘাট নামটির আবির্ভাব। এটি দীর্ঘকাল অন্যতম প্রধান ঘাট হিসেবে বিবেচিত হত, পরে প্রিন্সেপ ঘাট হওয়ার পর এই ঘাটটি রাজপুরুষদের কাছে গুরুত্ব হারায়। তবে, আকর্ষণীয় বিষয় এই যে, চাঁদপাল ঘাট থেকেই পাম্পে করে গঙ্গার জল কলকাতা শহরে সরবরাহ করা হত। ১৮২২ নাগাদ এই কলটি প্রথম চাঁদপাল ঘাটে বসানো হয়, বসান বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার হেনরি জেসপ, যাঁর জেসপ অ্যাণ্ড কোং বহুকাল পর্যন্ত অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি হিসাবে পরিচিত ছিল। তবে প্রথম দিকে এই কলের জলের ব্যাপারে অনেকেরই সন্দেহ ছিল। বিশেষ করে হিন্দুরা মনে করতেন, কলবাহিত জল হিন্দুদের জাত-মারার ধান্দা ছাড়া আর কিছুই না। ১৮৭০-এও দেখি এই সন্দেহ যায় নি, ফলে কেশব সেনের ‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকাতে রামপ্রসাদী সুরে গান লিখে আশ্বস্ত করা হয়, “থাকবে হিন্দুয়ানি খেলে পানি শরীরের সুখের তরে।”
প্রিন্সেপ ঘাটটি তৈরি হল অনেক পরে, ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে। নিকটবর্তী ফোর্ট উইলিয়মের ওয়াটার গেট এবং সেন্ট জর্জ গেটের মধ্যবর্তী স্থানে এই ঘাটটি তৈরি করেন ব্রিটিশ স্থপতি ডব্লিউ ফিজগেরাল্ডস্। বর্গাকার ভিতের উপরে গ্রীসীয় স্তম্ভগুলি সে-যুগেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। ঘাটটির প্যালাডিয়াম পোর্চটি ৪০ ফিট উঁচু। ঘাটটির নাম দেওয়া হয় অশোকের শিলালিপির পাঠদ্ধার করে বিশ্ববিখ্যাত হয়ে যাওয়া পণ্ডিত জেমস্ প্রিন্সেপের নামে। প্রিন্সেপ ১৮৩২ থেকে ১৮৩৮ পর্যন্ত এশিয়াটিক সোসাইটির সেক্রেটারি ছিলেন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি ব্রিটিশ থেকে দেশীয় শিক্ষিত সব মানুষদের কাছেই বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। মাত্র একচল্লিশ বছর বয়সে ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর জীবনাবসান হয়। সেই কারণেই ১৮৪১-এ যখন ঘাটটির কাজ শেষ হয়, তখন প্রিন্সেপের নামেই এর নাম রাখা হয়। এই ঘাট অবশ্য অনেককাল দেশীয়দের ব্যবহার করতে দেওয়া হত না, সংরক্ষিত ছিল ইংরেজ সাহেবসুবোদের জন্যই।
আর-একটি প্রাচীন ঘাট হল আর্মেনিয়ান ঘাট। আর্মানিরা কিন্তু কলকাতায় ইংরেজদের আসার অনেক আগে থেকেই বাস করতেন। মূলত ব্যবসাবাণিজ্যের সূত্রেই তাঁদের কলকাতায় আগমন এবং বসতিস্থাপন। মেসরভ জে. শেঠ সাহেবের বিখ্যাত ‘হিস্টরি অব দ্য আর্মেনিয়ান ইন ইণ্ডিয়া’ বইটির মত মানলে বলতে হয়, অষ্টম শতকের দিক থেকে আর্মানিরা এ-দেশে আসতে থাকেন। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষদিকে মোগল দরবারে আসেন মি. থমাস নামের এক আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ী। তিনি আগ্রায় ব্যবসা করার অনুমতি পান। স্বয়ং আকবরের সঙ্গে একজন আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ী মি. জ্যাকবের পরিচয় হয় কাশ্মীরে। পরবর্তীকালে তাঁর মৃত্যু হলে জ্যাকবের কিশোর পুত্রকে আকবর দত্তক নেন। তবে কলকাতায় আর্মানিদের আগমন যে-যাই বলে বলুক, ১৬৯৯ সালের আগে নয়। এই বছরই ২২ জুন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে তাদের এক চুক্তি হয়, যার শর্ত অনুযায়ী ১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজরা একটি কাঠের ছোট গির্জাঘর তৈরি করে দেয় আর্মানিদের জন্য। প্রথম সাত বছর যাজকদের বেতন হিসেবে বাৎসরিক পঞ্চাশ পাউণ্ড করে দিতেও থাকে। পরবর্তীকালে ব্যবসা সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে আর্মানিরা আজকের বৈঠকখানার কাছেই নিজেদের পল্লী এবং নিজস্ব স্থায়ী গির্জা তৈরি করে সেখানে বসবাস করতে থাকে। ১৭২৪ খ্রিষ্টাব্দে এই স্থায়ী গির্জা গড়ে তোলেন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথের ‘সহজ পাঠ’ দ্বিতীয় ভাগের কল্যাণে বিখ্যাত হয়ে যাওয়া আর্মানি গির্জের ঘড়ি ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দে বিখ্যাত আর্মানী ব্যবসায়ী আগা ক্যাটচেক আরাকিয়েলের দান। আর আমাদের আর্মানি ঘাটটিও গড়ে ওঠে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্দ্ধে। অন্যতম সম্ভ্রান্ত আর্মানি ব্যবসায়ী ম্যানুয়েল হাজারমালিয়াঁর প্রদত্ত অর্থে আর্মেনিয়ান ঘাটটি তৈরি হয়। যদিও কলকাতায় আর্মেনিয়ানদের সংখ্যা কোনদিনই বেশি ছিল না, তবুও অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে, দীর্ঘদিন এই ঘাটটি নিজেদের বাণিজ্যিক প্রয়োজনেই ব্যবহার করতেন তাঁরা। সেকালে ইংরেজ, পর্তুগীজ, আর্মানি প্রমুখের স্বারা প্রতিষ্ঠিত ঘাটগুলির কোনটিই সর্বসাধারণের ব্যবহার্য ছিল না। সাধারণ মানুষও, বিশেষ করে বর্ণহিন্দুরা ধর্মীয় সংস্কারের কারণে এই সমস্ত ঘাট এড়িয়ে চলে এসেছেন দীর্ঘকাল। তবে পরে এই সামাজিক ট্যাবু দূরে সরিয়ে রেখে যে-সমস্ত ঘাট সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, সেই ঘাটগুলি তাঁরা সানন্দে ব্যবহার করতে থাকেন।
কলকাতার ঘাট বলতেই বর্তমানকালে যে ঘাটটির কথা প্রথমেই আমাদের মাথায় আসে, সেটি স্ট্যান্ড রোডে গঙ্গাতীরের বাবুঘাট। নতুন প্রেমিক-প্রেমিকা তো বটেই, যাঁদের চাকুরিসূত্রে জলপথে এপার-ওপার করতে হয়, যাঁদের দূরদূরান্তে বাসযাত্রা করতে হয়, তাঁদের সকলের কাছেই বাবুঘাট একেবারে ঘরের আত্মীয়ের মতো। এই ঘাটটির সঙ্গে কিন্তু কলকাতার বাবু-কালচারের কোন সম্পর্ক নেই। এটির প্রতিষ্ঠাতা শ্রুতকীর্তি রানি রাসমণি। ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে স্বর্গত স্বামী বাবু রাজচন্দ্র দাসের নামে এই ঘাটটি তিনি নির্মাণ করান। প্রথমদিকে এর নাম ছিল বাবু রাজচন্দ্র দাস ঘাট, পরে যা স্বাভাবিক নিয়ম, তা-ই হয়। বাবু রাজচন্দ্র দাস ঘাট সংক্ষেপে হয়ে ওঠে বাবুঘাট। কোন কোন মতে আলোচ্য কালপর্বে প্রতিষ্ঠিত এই ঘাটটি দ্বিতীয় প্রাচীনতম ঘাট। এর আগে চাঁদপাল ঘাটটিই ছিল প্রাচীন। যদিও এই মত গ্রহণযোগ্য কি-না সে-বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। চাঁদপাল ঘাটের সমসময়ে কিংবা তার কিছু পরে আর-একখানি ঘাটের কথা জানা যায়। বর্তমান কয়লাঘাটায় ছিল যে ঘাটটি, তার নাম ছিল নিউ ওয়ার্ফ ঘাট ( New Wharf Ghat )। এই ঘাটের উপরেই ছিল পুরানো কাস্টমস্ হাউস। এই ঘাটের উত্তরে ছিল ইংরেজদের সেই পুরানো দুর্গটি, যেটি নবাব সিরাজদ্দৌলা ধ্বংস করে দেন। অবশ্য সিরাজ এটি ধ্বংস না-করলে ফোর্ট উইলিয়ম গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা ইংরেজরা অনুভব করত কি-না সন্দেহ। অতএব বাবুঘাটকে দ্বিতীয় প্রাচীন ঘাট বলা কোনমতেই ঠিক নয় বলেই আমাদের বিশ্বাস। যাই হোক, রাসমণির তৈরি করা ঘাটটি বাবু রাজচন্দ্র দাসের ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি-প্রীতির কথা মাথায় রেখে ডোরিক-গ্রীক শৈলীতে নির্মিত। দেশীয় জনসাধারণের জন্য নির্মিত এই ঘাটটি প্রথম থেকেই ‘নিজেদের ঘাট’ হিসেবে খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে। কলকাতার অন্যতম প্রধান ল্যাণ্ডমার্ক হয়ে ওঠে অবশ্য বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে। তার আগে ঘাটটি থাকলেও স্বতন্ত্র কোন বিশিষ্টতা ছিল না।
সেকালে ধনী বাবুরা অনেকেই অর্থ-প্রতিপত্তি প্রদর্শন, পুণ্য অর্জন, সামাজিক খ্যাতিলাভ ইত্যাদি কারণে ঘাট নির্মাণ করে জনসাধারণের নামে উৎসর্গ করতেন। এইরকম অনেক ঘাট আজ কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে, কিছু এখনও টিকে থেকে বাবুদের যশঃকীর্তি নীরবে ঘোষণা করে চলেছে। মিত্র মশাই নানা সূত্র থেকে যে-সব ঘাটের তালিকা জোগাড় করেছেন এবং তাঁদের সম্পর্কে যথাসম্ভব সংবাদ দিয়েছেন, সেই তালিকাগুলি নির্ভরযোগ্য হলে বোঝা যায়, প্রতিষ্ঠিত বাবুরা তো বটেই, যাঁরা অবস্থাগতিকে ‘হঠাৎ নবাব’ হয়ে উঠেছিলেন, তাঁরাও কেউ ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য, কেউ টাকার গরম দেখানোর জন্য ঘাট তৈরি করে গেছেন। কেউ কেউ আবার শুধুমাত্র পুরুষের ব্যবহারের নিমিত্ত ঘাট বানিয়েছেন, কেউ আবার কঠোরভাবে মেয়েদের ব্যবহারের জন্য ঘাট বানিয়ে গেছেন। নীরবে সেই সব ঘাট যে কত ইতিহাস বুকে নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে, তার ইয়ত্তা নেই। তাও তো হারিয়ে যাওয়া ঘাটের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। বড়বাজারের কাছে অবস্থিত জগন্নাথ ঘাটটি এইরকম একটি প্রাচীন ঘাট। এটি প্রতিষ্ঠা করেন শোভারাম বসাক। কোন শোভারাম ? পলাশীর ষড়যন্ত্রের অংশীদার শোভারাম, যাঁদের ছিল সুতি ও রেশম কাপড়ের পারিবারিক ব্যবসা। আদিতে এঁরা সপ্তগ্রামে ব্যবসা করতেন। পরে সপ্তগ্রাম থেকে মুর্শিদাবাদ হয়ে সুতানুটিতে বসবাস শুরু করেন। কলকাতার শ্যামবাজার এলাকার বাজারটির এঁদেরই অধিকারে ছিল এবং এর নামও তাঁদের এক নিকট আত্মীয় শ্যাম বসাকের নামে । হলওয়েল এসে বাজারটির নাম পাল্টে চার্লস বাজার করলেও, শোভারামের অক্লান্ত চেষ্টায় আবার সেটি তার পূর্বনাম ফিরে পায়। যাই হোক, এঁদের গৃহদেবতা ছিলেন জগন্নাথ। সুতানুটিতে এসে বসবাস শুরু করার পর প্রথমে গঙ্গার ধারে পারিবারিক জগন্নাথজিউর মন্দির, পরে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে মন্দিরের কোল ঘেঁষে এঁরা যে ঘাটটি তৈরি করেন, সেটিই আজকের ব্যস্ততম জগন্নাথ ঘাট। কলকাতার সর্ববৃহৎ পাইকারি ফুলের বাজার আজও এই ঘাটের উপরেই বসে।
এরই কাছ ঘেঁষে রয়েছে সাধারণের ব্যবহার্য ছোট্টুলাল-দুর্গাপ্রসাদ ঘাট। এই ঘাটের দক্ষিণ দিকে ঘাটে ওঠানামা করার যে সিঁড়ি রয়েছে, তা দিয়ে নামবার সময় একটি মার্বেল-ফলক কারুর চোখে পড়ে, কারুর পড়ে না। যদি পড়ত, তাহলে তাঁরা এক মর্মান্তিক ইতিহাসের সন্ধান পেতেন। ১৮৮৭ সালে এই ঘাট থেকে পুরীর পথে ৭৫০ জন যাত্রী নিয়ে যাত্রা করে স্যার জন লরেন্স নামের বাষ্পীয় জাহাজ। আবহাওয়া দপ্তরের সতর্কবাণী ছিল, বঙ্গোপসাগরে ঘনীভূত প্রবল সাইক্লোন আছড়ে পড়তে চলেছে মেদিনীপুর এবং কটকের মাঝামাঝি জায়গায়। সতর্ক করে দেওয়া হয় জাহাজ এবং নৌকাগুলিকে। সে-নিষেধ না শুনে সেন্ট লরেন্স জাহাজটি যাত্রা করে এবং অচিরেই ঝড়ের কবলে পড়ে নদীগর্ভে ডুবে যায়। ক্যাপ্টেনসহ জাহাজে থাকা কোন যাত্রী, মাঝিমাল্লা কেউ বাঁচেনি। পরের দিন নদীতে ক্যাপ্টেন ও আরও অনেকের মৃতদেহ ভাসতে দেখা যায়। অনেকের মৃতদেহের তো আর কোনদিন সন্ধানই মেলেনি। সেদিনের সেই অভিশপ্ত যাত্রায় মৃত যাত্রীদের স্মরণে গুটিকয় ইংরেজ মহিলা এই শোকস্মরণিকা খোদাই করে রেখে দেন এই ঘাটের দেওয়ালে। কারণ এই ঘাট থেকেই অভিশপ্ত জাহাজের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন সমস্ত যাত্রীরা। সাহেবরা পরবর্তীকালে চেষ্টা করেছিলেন, নেটিভমৃত্যুর যে ইতিহাস মুছে দিতে, ছোট্টুলাল-দুর্গাপ্রসাদ ঘাট আজও তা ঘোষণা করে চলেছে। আপাতত এই পর্বে এখানেই ইতি টানা যাক। পরের পর্বে আরও কয়েকটি ঘাটের কথা না-হয় বলা যাবে।
প্যারাগ্রাফে ‘পারিয়া’-কলমে রিন্টু মান্না
প্যারাগ্রাফে ‘পারিয়া’
রিন্টু মান্না
পারিয়া পথকুকুরদের নিয়ে তৈরি একটি বাংলা ছবি। এই ছবিতে আমরা মুখ্য চরিত্র হিসেবে বিক্রম চট্টোপাধ্যায়কে দেখেছি এছাড়া শ্রীলেখা মিত্র, অঙ্গনা রায়, অম্বরীশ ভট্টাচার্যের মতন দক্ষ অভিনেতাদেরও পেয়েছি।
৯ ফেব্রুয়ারি সিনেমা হলে রিলিজ-এর পর আমরা কম-বেশি অনেকেই পারিয়ার ভলিউম ১ দেখে ফেলেছি। সুতরাং সে সম্পর্কে দু-এক কথা বলা যেতে পারে; সেক্ষেত্রে প্রথমেই বলতে হয় একটি সিনেমা তৈরির পিছনে থাকে বিশেষ একটি ঘটনা বা কাহিনি। সেই কাহিনিকেই কেন্দ্র করে গোটা সিনেমাটি উপস্থাপিত হয়ে থাকে। তবে সেই কাহিনি বা ঘটনাকে হতে হয় বাস্তবসম্মত এবং যুক্তিযুক্ত। পারিয়াও সেই গোছেরই ছবি। রাস্তার সারমেয়দের বাংলা সিনেমার কেন্দ্রীয় অংশে নিয়ে আসার কথা ভাবার জন্য পরিচালক তথাগত মুখোপাধ্যায়ের কৃতিত্ব অনস্বীকার্য।
তবে পরিচালক পথকুকুরদের প্রতি সংবেদনশীলতার বার্তা দিতে চেয়ে এই ছবিটি করলেন ঠিকই, তার এই উদ্দেশ্য অবশ্যই সৎ কিন্তু সেই সংবেদনশীলতা দেখাতে গিয়ে রক্তারক্তির তীব্রতা কোথাও যেন সেই দিকটিকে ঢেকে দিয়েছে। অত্যাধিক অ্যাক্সন, শতাধিক ফুটের কাটআউট কিছু সংখ্যক দর্শকের থেকে হাততালি কুড়লেও ছবিটি তার লক্ষ্য ভ্রষ্ঠ হয়েছে। যে সারমেয়দের নিয়ে ছবি তাদেরই উপস্থিতি, অ্যক্টিভিটি ছবিতে কম ধরা পড়েছে। সারমেয়দের মাংস নিয়ে করা কুৎসিত চক্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে গিয়ে ছবিটি শুধুমাত্র একটি অ্যাক্সন মুভিতে পরিণত হয়ে গেছে। তবে বর্তমান সময়ে বাংলা ছবির যে করুণ পরিণতি সেক্ষেত্রে এই ধরণের থ্রিলার বা বলা ভালো পথকুকুরদের নিয়ে চলা নোংরা চক্রকান্তের দিকগুলি ছবির মাধ্যমে জনসাধারণের সামনে তুলে ধরার প্রচেষ্টা প্রসংশার দাবি রাখে।
চলচ্চিত্র নির্মাণের কিছুটা খামতি স্বীকার করে নিলেও, সভ্য সমাজের এই সিনেমার সঙ্গে পরিচয় থাকা কর্তব্য, সামাজিক দায়িত্ব। বিক্রিত রাজনীতির কুম্ভীপাকে মানুষ ছাড়িয়ে পশু অবধি নিতান্ত অসহায়— এই ঘৃণ্য সমাজ বাস্তবতা জানতে একবার দাঁড়ানো প্রয়োজন পারিয়ার সামনে।
‘কেমিস্ট্রি মাসি’র রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া অম্লান ভাবে লিখলেন - বৃতা মৈত্র
চটপট দেখে ফেলুন ‘কেমিস্ট্রি মাসি’
বৃতা মৈত্র
বাংলা ছবির প্রথম সারির অভিনেত্রী দেবশ্রী রায় বড়পর্দার পর ছোট পর্দাতেও নিজের আধিপত্য বজায় রেখেছেন। কম কাজ করেছেন, কিন্তু, বুঝিয়ে দিয়েছেন নিজের ক্ষমতা। জাতীয় স্তরে ‘মহাভারত’-এর সত্যবতী থেকে বাংলা টিভি চ্যানেলে ‘দেনা পাওনা’, ‘বিরাজবউ’, ‘নগরপারে রূপনগর’ থেকে সাম্প্রতিককালের ‘সর্বজয়া’– দেবশ্রী স্থায়ী ছাপ রেখেছেন দর্শক মননে। এহেন এক অভিনেত্রী যখন ওয়েব আঙিনায় ডেবিউ করেন আর সেটাও নাম ভূমিকায়–আমাদের প্রত্যাশা স্বভাবতই তীব্র হয়ে ওঠে।
বলতে দ্বিধা করব না, হইচই চ্যানেলে দেবশ্রী অভিনীত ‘কেমিস্ট্রি মাসি’ পুরোমাত্রায় সেই প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হয়েছে।
সাধারণ গেরস্তবাড়ির গৃহবধূ সুচরিতা স্থির করেন, তিনি কেমিস্ট্রি পড়ানোর জন্য একটি ক্লাস শুরু করবেন অনলাইন চ্যানেলে। ভাবনা মতোই নিজের ভ্লগ তৈরি করে ফেললেন তিনি। শুরুতে সবাই তাঁকে নিরুৎসাহিত করে। সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক! ঘরের গৃহিণী নিছক ঘরসংসার করবেন, এটাই তো সবাই আশা করে। তার বাইরে কিছু করতে গেলেই তো তাকে দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে। তবে, ‘কেমিস্ট্রি মাসি’র গল্প শুধু এই চিরায়ত সামাজিক প্রশ্নে জর্জরিত নয়, এখানে রয়েছে তার থেকেও বড় ও প্রাসঙ্গিকতায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ! সুচরিতার কেমিস্ট্রি ক্লাস খুব অল্পদিনেই দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠতেই মৌচাকে ঢিল পড়ে।
বস্তুত পরিচালক সৌরভ চক্রবর্তীর এই সিরিজ প্রথম থেকেই দর্শককে চূড়ান্ত আকর্ষণ করে মেধাবী ভাবনার গুণে। আজকের শিক্ষা জগতের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতির বিষয়ে আমরা সকলেই অবহিত। সেই রাজনীতির শিকার হন সুচরিতা। একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দিয়েছেন তিনি, এই অপরাধে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। সুচরিতাকে যখন কর্তৃপক্ষ এই বাবদ জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে, তখনই একে একে আমরা জানতে পারি তাঁর অতীত–ভ্লগ শুরু হওয়ার পর থেকে যা যা ঘটেছে, সেই বৃত্তান্ত! উঠে আসে সুচরিতার পরিবার– তাঁর স্বামী, কন্যা, পুত্র-পুত্রবধূর কথা। সুচরিতা জানান, কেমন করে স্বামীর দ্বারা প্রতিনিয়ত অপমানিত হতে হতে একটা সময় তিনি ঠিক করেন, নিজের কেমিস্ট্রির জ্ঞানকে খুব সহজলভ্য পথে ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌঁছে দেবেন।
জানা যায়, ছাত্রছাত্রী মহলে সুচরিতার চূড়ান্ত জনপ্রিয়তা কেমন করে তাঁর চারপাশে এক বিপুল সংখ্যক শত্রুর জন্ম দেয়। বহু লোকের স্বার্থে ঘা লাগে। তাদের টার্গেটে পরিণত হন সুচরিতা। বলা বাহুল্য, এখান থেকেই কাহিনি দ্রুত নাটকীয় মোড় নেয়। নাটকীয় কিন্তু আরোপিত নয়, সৌরভ বিষয়কে বিন্যস্ত করেছেন বাস্তবের ভিত্তিতে। তিনি বাকি চরিত্রগুলির আচার-আচরণকে সাজিয়েছেন মুখ্য চরিত্রের সঙ্গে সুন্দর এক সমন্বয় সৃষ্টির মাধ্যমে। দ্রুতগতির স্মার্ট এই ওয়েবসিরিজ আগাগোড়া দর্শক আগ্রহ টেনে রাখতে সক্ষম হয় এই কারণেই।
দেবশ্রীর কথা তো শুরুতেই বলেছি। অভিনয়ে অন্যান্যদের মধ্যে আছেন শঙ্কর চক্রবর্তী, ঋত্বিকা পাল, সপ্তর্ষি মৌলিক, সৌম্য মুখার্জি প্রমুখ। সুচরিতার ভূমিকায় দেবশ্রী আরও একবার বুঝিয়ে দেন নিজের পারদর্শিতা। তাঁর ব্যুরোক্র্যাট স্বামীর চরিত্রে শঙ্কর চক্রবর্তীর দাপুটে অভিনয় দারুণ মানানসই। ঋত্বিকা যথাযথ পুলু অর্থাৎ সুচরিতার মেয়ের ভূমিকায়। বাকিরা প্রত্যেকেই চরিত্রের মাপে নিখুঁত। দুর্দান্ত সিনেমাটোগ্রাফি ও এডিটিং, কাহিনির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর। সব মিলিয়ে ‘কেমিস্ট্রি মাসি‘ একেবারে জমে গিয়েছে। আপাতত সিজন ওয়ান, দেরি না করে চটপট দেখে ফেলুন।