ভাণ পত্রিকা
৪১ তম ই-সংস্করণ ।। ৫১ তম সংখ্যা ।।অগাস্ট ২০২৪
সম্পাদক :
সম্পাদনা সহযোগী :
প্রচ্ছদ :
নক্সা পরিকল্পক :
অন্যান্য কাজে :
ভাণ-এর পক্ষে:
পার্থ হালদার
কর্তৃক
৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬
( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )
৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) bhaan.kolkata@gmail.com ( ই – মেল )
Reg. No : S/2L/28241
সম্পাদকের কথা
।। সম্পাদকের কথা।।
অগাস্ট , ২০২৪
আমরা যারা রাষ্ট্রকে সম্মান করি এবং সমালোচনা করি, আমরা যারা পতাকা রক্ষা করি এবং পতাকার অসম্মান হলে লালকেল্লার মহাজনদের বিরুদ্ধেও কামান দাগি; তখনও মোটের ওপর আমরা এসব দেশপ্রেম মানবপ্রেমের জোরেই করি। রাষ্ট্র নায়করা তাদের ওপর আক্রমণকে দেশের ওপর আক্রমণ বলে দেখাতে চান, অন্যদিকে দেশকে সুস্থ রাখবার কারণে এই অপদার্থ দেশ নায়কদেরকে আমরা নাজেহাল করতে চাই মানবতার স্বার্থেই।
করতে চাই বটে। কিন্তু সব সময় পারি কি? পারি না যে তার বড়ো কারণ, আমরা সকলে একত্রে এক জায়গায় একই রকম বিচারে আসতে পারি না। মজা এই, আসতে পারলেই যে ভালো হত গভীর বিবেচনায় তেমনটাও মনে হয় না। খুব সহজে একই জায়গায় পৌঁছানোর বিপদ আছে। তখন পৌঁছানোটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। কীভাবে পৌঁছলাম, কোথায় পৌঁছলামি— তেমন করে আর বিবেচনার মধ্যে থাকে না। অথচ বিবেচনা যদি অতিরিক্ত করি তাহলে রাষ্ট্রনায়কদের পোয়াবারো। আমরা কোনটা, কতটা, কতটুকু এর বিচার করতে থাকব, আর ওরা সেই সুযোগে তাদের মতো করে রাষ্ট্রীয় নখ দাঁত থাবা আমাদের ভেতরে বদ্ধমূল করতে থাকবেন। যেন মনে হবে, এ দেশটা তাদের। আমরা ভাড়া নিয়েছি মাত্র। ঠিক সময় ভাড়া চুকিয়ে দিতে হবে, অর্থনৈতিক কর্তব্য, সামাজিক কর্তব্য, হাজারো আইন পালন করে যাওয়াটাই আমাদের নাগরিক গৌরব। এমনকি যে একটিমাত্র নির্ণয়ের জায়গা, নাগরিকদের ভোটাধিকার, সে সম্পর্কেও আমরা নিশ্চিত হতে পারব না। অনেক নির্দয় চক্রান্তের জাল সেখানেও বিছানো থাকবে। তথাপিও দিনের পর দিন আমরা রাষ্ট্রকে আনুগত্য দেখাব— এটাই আদতে রাষ্ট্র নায়কদের বাসনা। এই কাজে তারা সফল হন আমাদের মধ্যে নানা পার্থক্য আছে বলে নয় শুধু, আমাদের মধ্যে আছে এই ফারাক জনিত অসুহিষ্ণুতা। আমাদের মধ্যে আছে পারস্পরিক বৈরিতা, অসূয়া। রাজ্যে-রাজ্যে, ভাষায়-ভাষায় জেলায়-জেলায়, পাড়ায়-পাড়ায়, ধনীতে-দরিদ্রে, কালচারে-কালচারে, শহরে-গ্রামে, মফস্বলে-বস্তিতে, ব্রাহ্মণ-অব্রাম্মণে, হিন্দু-মুসলমানে, ইংরেজিয়ানার গৌরব-অগৌরবে— হাজারো রকমের ফারাকের ভেতর দিয়ে টিকে থাকে রাষ্ট্রীয় ইমারত। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এগুলির অবলুপ্তি চায় না। এগুলি তাদের আমানত। প্রতি ভোটে নিজেদের পক্ষে জনমত তৈরিতে এই আমানত ভাঙ্গিয়ে তারা টিকে থাকে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ততক্ষণ এই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিরোধিতা করে, যতক্ষণ তারা ক্ষমতায় আসীন না হচ্ছে!! ক্ষমতায় গেলে সেও মোটের ওপর আনুগত্য চাইবে। জনমোহিনী নীতি যত কমে যাবে আনুগত্য আদায়ের তীব্রতা বাড়বে তত। তখন সে অল্প সল্প সমালোচনাতে অসহিষ্ণু হয়ে উঠবে। একজন সচেতন ব্যক্তির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যাবে একটা গোটা রাষ্ট্র তন্ত্র। এটা ভয়ের থেকে হবে। তবু আইন প্রয়োগের ক্ষমতা যেহেতু রাষ্ট্রে হাতেই, তাই ব্যক্তিকে লাঞ্ছিত করবার হাজারো রাস্তা তার সামনে খোলা।
তাই একটি তৃতীয় শক্তি দরকার যে ভোট লড়বে না। যার ক্ষমতার প্রতি মোহ নেই। কিন্তু যার সুবিচারের প্রতি মোহ আছে। ন্যায়ের প্রতি মোহ আছে। স্বাধীনতার প্রতি মোহ আছে। সমানাধিকারের প্রতি মোহ আছে। সংখ্যালঘুদের স্বর শোনার কান অথবা হতদরিদ্রের কষ্ট বোঝার মন আছে। যা কিছু সুন্দর যা কিছু কল্যাণময় তার প্রতিই আছে এক অনিঃশেষ আবেগ।
এখন এই তৃতীয় শক্তি সামাজিক রাজনৈতিক ও পরিস্থিতির নানা কারণে মধ্যবিত্তদের দখলে। সেই সমস্ত নাগরিক, দলীয় রাজনীতির ক্ষমতা বদলে যাদের ব্যক্তিগত জীবনের অর্থনীতিতে সামাজিকতায় বা কালচারে- তেমন প্রভাব পড়ে না। এদের সম্মিলিত শক্তি কম না। দ্রোহে-বিদ্রোহে, সরকারকে মেরামত কিংবা প্রয়োজনে বদলে দেবার কাজে এরা অনুঘটকের কাজ করে যেতে পারেন। মেহনতি খেটে খাওয়া মানুষের চিন্তার কাছে পৌঁছে যেতে পারেন। একটা চেতনার দেওয়া-নেওয়া এর মধ্য দিয়ে ভীষণ শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেন। এমন শক্তিশালী যখন রাষ্ট্র অবদমনে দ্বিধান্বিত হবে। মানে, সরকার বুঝবে এই অবদমন জনমতকে প্রবল ভাবে তাদের বিরুদ্ধে নিয়ে যাবে। বিরোধী দল গুলি এই নাগরিক ন্যায়বিচার এর স্লোগানের সঙ্গে গলা মেলাবে কেননা সেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে চায়।
তাহলে তো নাগরিক সমাজের একটা সচেতন স্তরের লেনদেন হওয়া খুব দরকার। সর্বদা চালু থাকা দরকার সচেতনতার একটা সংহত রূপের খোঁজ। গভীরতর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার খোঁজ চালানো দরকার। দলীয় রাজনৈতিক বিযুক্তির মধ্যে থেকেও দরকার, সময়ের সংকেতকে, সংবেদকে ধারণ করবার রাজনৈতিক অভীপ্সা। সেসব ক্ষমতাবান নাগরিককূল অনেকদূর পর্যন্ত নিজেকে ও চারপাশকে সমৃদ্ধ করেও শেষত রিপুর তাড়নার বশবর্তী হয়ে পড়েন প্রায়শই। তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সামাজিক জ্ঞান, প্রখর যুক্তিবোধ বহু সময় তাদের সুবিধাবাদি চরিত্রের আড়াল হিসেবে কাজ করে যায়। ব্যক্তিত্বের সংকট যে প্রায়শই ঘটে এ কথা আমাদের অচেনা নয়। আমিত্ব তাকে মিলতে দেয় না, অহং তাকে একলা করে, দম্ভ তাকে দরিদ্রের কাছে পৌঁছোতে দেয় না। আমার আলোকিত মনের যাবতীয় চিন্তা এবং দেখা প্রশ্নের উর্ধ্বে। একজন বাড়ির পরিচালক দিদি অথবা রিক্সাওয়ালা দাদার অনুভব যে আমার শিক্ষক হয়ে উঠতে পারে একথা স্বীকার করার কোনও প্রস্তুতি না রাখা। ক্রমশ বাস্তবতার রক্ত ঘামের ডাককে চিনতে না পারা। মস্তিষ্ক অনেক সময় হৃদয় বিযুক্ত হয়ে পড়ে। জ্ঞান তাকে অসহিষ্ণু করে। অসহিষ্ণু মানুষ বোঝা বাড়ান, বাস্তব জীবনের রকমারি উপপ্লব থেকে দূরে সরে যান।
সেই কবে থেকে অপরাধ প্রিয় সরকার, অপরাধী ভরা পার্টি, নির্লজ্জ মিথ্যাচারে মোড়া প্রশাসনের বিরুদ্ধে যখন নাগরিক সচেতনতার একটা সংহত রূপ উদ্ভাসিত হচ্ছে একটা নারকীয় পৈশাচিক অসভ্য অকথ্য ঘটনার অগ্নুদ্গমে, তখন আমরা আবার সেই আমিত্বের, আমার অহংকৃত ধারণার তোষামোদ করব নাকি নিজের অর্জনকে সহিষ্ণুতার সঙ্গে অন্যদের অনুভবের সঙ্গে মেলাব? সে আন্তরিকতা অথবা লোক-দেখানো মিলন ঠিক করে দেবে আমরা রাষ্ট্রকে মেরামত করার যোগ্য কিনা!
কলকাতার গালগপ্পোর দশমপর্ব লিখলেন - কিশলয় জানা
ঘাটের কথা,১০ পর্ব
কিশলয় জানা
আগের পর্বে আমরা ঘাট নিয়ে ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করেছিলাম। এই পর্বেও তার জের যে চলবে, তা বোঝাই যায়। গতবার আমরা প্রায় ছ’টি ঘাটের কথা বলেছিলাম। এই পর্বে আরও কিছু ঘাটের কথা বলব। মোটের উপর বারো ঘাটের জল না খাইয়ে এই অধম যে আপনাদের রেহাই দেবে না, আশা করি তা বুঝে গেছেন। অতএব আগেভাগেই মার্জনা প্রার্থনীয়।
আগের পর্বে ছোট্টুলাল-দুর্গাপ্রসাদ ঘাট থেকে অভিশপ্ত সেন্ট লরেন্স জাহাজ ছাড়ার কথা বলা হয়েছিল, তা দেখে কেউ যেন না মনে করেন, সে-সময় জাহাজগুলি ঘাটে এসে নোঙর ফেলত এবং যাত্রীরা সেখান থেকেই জাহাজে চড়তেন। এমনটি একেবারেই নয়, কারণ, এগুলি নিতান্ত সাধারণ ঘাট-ই ছিল, কোন ডক্ইয়ার্ড ছিল না। সে-সময় সাধারণ যাত্রীবাহী জাহাজ-স্টিমার মাঝনদীতে অপেক্ষা করত, ঘাটগুলি থেকে এক-একটি জাহাজের নিজেদের নৌকা যাত্রীবহন করে একে একে মাঝনদীতে দাঁড়ানো জাহাজে যাত্রীদের তুলে দিত। এই ব্যবস্থা বিশেষভাবে করা হত, দেশের মধ্যে যাত্রীবহনের ক্ষেত্রে। বিলাত যাওয়ার জন্য প্রথম যুগে, রেলপথ তৈরির আগে পর্যন্ত যাত্রীরা গঙ্গাসাগরে গিয়ে জাহাজে উঠতেন। ১৮২২ সালের জানুয়ারি মাসের ‘সমাচার দর্পণে’ দেখা যায় যে, স্যার এডওয়ার্ড ইস্ট চাঁদপাল ঘাট থেকে পিনেসে চড়ে গঙ্গাসাগর যাচ্ছেন, সেখান থেকে ইংল্যাণ্ডগামী জাহাজে উঠবেন। রেলপথ তৈরির পরে অবশ্য সাহেবসুবো থেকে দেশীয়রা কেউ ইংল্যাণ্ড যেতে হলে বোম্বাই পর্যন্ত রেলপথে গিয়ে সেখান থেকে ইংল্যাণ্ডগামী জাহাজে উঠতেন। প্রথম ভারতীয় মহিলা এবং প্রথম বাঙালি মহিলা হিসাবে ইংল্যাণ্ডে যাওয়া কৃষ্ণভাবিনী দেবী তাঁর স্বামীর সঙ্গে রেলে করে বোম্বাই গিয়ে সেখান থেকেই ইংল্যাণ্ড যাওয়ার জন্য জাহাজে উঠেছিলেন। তবে কলকাতার ঘাটগুলি তার পরেও গুরুত্ব হারায় নি। পূর্ববাংলার সঙ্গে নদীপথে যাতায়াতের জন্য নৌকা, ভাউলে ইত্যাদি এই সমস্ত ঘাট থেকেই ছাড়ত। এই সমস্ত ঘাট থেকেই শ্রীরামপুর, চন্দননগর থেকে নিত্যযাত্রীরা কলকাতায় এসে ‘আপিস’ করে আবার বাড়ি ফিরতেন। উনিশ শতকের শেষ দিকেও কেশব সেন থেকে শুরু করে নরেন্দ্রনাথ দত্তের মতো আরও অনেকে (তখনও স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে ওঠেননি) বরানগর, দক্ষিণেশ্বর ইত্যাদি নানা জায়গায় যাতায়াত করতেন।
সেকালে যে কেবল যাতায়াতের জন্য কিংবা স্নানের জন্যই এই সকল ঘাট ব্যবহার করা হত এমনটি নয়। হিন্দুরা তাঁদের পারলৌকিক কাজের জন্যও ঘাট ব্যবহার করতেন, তবে সেই সমস্ত ঘাট ছিল নির্দিষ্ট। এই ব্যাপারে সবচেয়ে পুরানো ঘাটগুলির অন্যতম হচ্ছে কাশী মিত্রের ঘাট। কাশী মিত্র সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া মুশকিল। হরিহর শেঠ তাঁকে কেবল প্রসিদ্ধ ব্যক্তি বলেছেন এবং শবদাহের জন্য যে তিনি একটি ঘাট প্রতিষ্ঠা করেন তা জানিয়েছেন। কাশী মিত্র প্রতিষ্ঠিত ঘাট বলেই হয়ত জনসাধারণের মুখে মুখে ঘাটটি কাশী মিত্রের ঘাট বলে পরিচিতি পেয়েছিল, তা-না হলে নিজের নামে শবদাহের ঘাট প্রতিষ্ঠা ব্যাপারটি কিছুটা অস্বাভাবিক। ঘাটটি ছিল বহুকালের। শোনা যায়, বাগবাজারের নবকৃষ্ণ দেবেরা এই ঘাটেই তাঁদের পারলৌকিক কাজ সম্পন্ন করতেন। অতএব কাশী মিত্র যিনিই হন না কেন, হয় তিনি নবকৃষ্ণের সমসাময়িক ছিলেন কিংবা তাঁরও পূর্ববর্তী কেউ ছিলেন। হরিহর শেঠ জানিয়েছেন, এই কাশী মিত্র ছিলেন রাজা রাজবল্লভের ভাগ্নে। কাশী মিত্রের ঘাট সংলগ্ন রাস্তাটি আজও কাশী মিত্রের ঘাট স্ট্রীট নামে পরিচিত। যদিও রাধারমণ মিত্র এঁর সম্পূর্ণ নাম কাশীশ্বর মিত্র বলে জানিয়েছেন। তাঁর মতে আপজনের ম্যাপে ভুল করে কাশীরাম মিত্রের ঘাট বলে উল্লেখ করা আছে। টালার বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার নীলমণি মিত্রের বৃদ্ধ প্রপিতামহের ভাই ছিলেন এই কাশীশ্বর। ব্যবসা করে তিনি প্রভূত সম্পত্তি করেছিলেন। চারটি বিয়ে করা সত্ত্বেও নিঃসন্তান থাকায় শেষ বয়সে পুণ্য অর্জনের বাসনায় তিনি এই শবদাহের ঘাটটি স্থাপন করেন। এই কথাগুলি সত্যি বলে মেনে নিলেও বলতে হয় যে, নিছক ধর্মাচরণ নয়, সম্ভবত সম্ভ্রান্ত মানুষদের নিজেদের জন্য একটি শবদাহের ঘাটের প্রয়োজন ছিল বলেই কাশী মিত্র ঘাটটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে অবশ্য ঘাটটি সাধারণ মানুষদের ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। কাশী মিত্রের ঘাটটি সেকালে ব্যস্ততম শবদাহের ঘাট হিসাবে পরিচিত ছিল।
সেকালে মৃতদেহ দাহ করা খুব ঝক্কির কাজ ছিল। ধনী ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের হয়তো ততটা অসুবিধা হত না, কারণ যে কোন ঘাটেই (এখানে ঘাট সংলগ্ন শ্মশানঘাট বুঝতে হবে) তাঁদের অগ্রাধিকার দেওয়া হত। এমনকি পরে মৃতদেহ পৌঁছালেও, ধনীরাই সুযোগ পেতেন। ফলে সাধারণ মানুষদের শবদেহ নিয়ে প্রায়শই দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হত। কাশী মিত্রের ঘাটে যে অত্যন্ত ভীড় হত, এতে কোন সন্দেহ নেই। ‘সমাচার দর্পণে’র পাতায় ১৮২৬ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত দীর্ঘ প্রতিবেদনে দেখা যায়, কাশী মিত্রের ঘাটে প্রতিদিন গড়ে দশ জন থেকে বিশ-পঁচিশ জনের দাহ হত। মহামারীর সময় এবং বর্ষাকালে ওলাওঠা ইত্যাদি রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেলে দিনে আগের হিসাবের চতুর্গুণ পর্যন্ত শবদেহ এসে দাহের অপেক্ষায় বসে থাকত। জোয়ারের সময় কাশী মিত্রের ঘাট সম্পূর্ণ ভেসে যেত, ফলে ভাটার অপেক্ষা করতে হত। পরের বছরের জানুয়ারি মাস নাগাদ অবশ্য ওই সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, মানুষের এই অসুবিধা দূর করার জন্য নিমতলা থেকে বাগবাজার পর্যন্ত আরও তিনটি শ্মশান স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তবে কাশী মিত্রের ঘাটে একসময় সতীদাহ হত বলে একে সতীদাহের ঘাট বলা হত বলে কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন। ১৭৭৪ সালের দিকে নির্মিত এই ঘাটটিতে সতীদাহ হওয়া বিচিত্র নয়। তবে সতীদাহের ঘাট হিসাবে পরিচিতি থাকলে উত্তরকালের ইতিহাস-লেখকেরা নিশ্চয়ই সে-কথা কেউ-না-কেউ উল্লেখ করতেন। এ-ব্যাপারে অধিকাংশ ঐতিহাসিকের নীরবতা দেখে বিষয়টি সঠিক কি-না তা নিয়ে সন্দেহ জাগে।
উত্তর কলকাতার আরও একটি ঘাট সেকালে বিখ্যাত ছিল, সেটি হল— রথতলা ঘাট। এই ঘাটটির প্রতিষ্ঠাতা কে, সে-বিষয়ে অবশ্য ঐক্যমত্য হয় নি। কোন কোন মতে এই ঘাটটি তৈরি করেন শোভাবাজারের হরচন্দ্র মল্লিক। আবার অন্য মতে, হরচন্দ্র নয়, এই ঘাটটির প্রতিষ্ঠাতা নন্দরাম সেন। নন্দরাম ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার প্রথম কালেক্টর রাল্ফ্ শেল্ডনের দেশীয় সহকারী ছিলেন, যদিও শেল্ডনের পরবর্তী কালেক্টর নন্দরামকে তহবিল তছরূপের অপরাধে পদচ্যুত করেন। ১৭০৭ সালে তিনি আগের পদ ফিরে পেলেও, তাঁর অপরাধের জন্য তাঁকে শাস্তিভোগ করতে হয়। নন্দরাম প্রতিষ্ঠিত এই ঘাটে শোভারাম বসাকের পারিবারিক রথ সারা বছর রাখা থাকত বলে এটি লোকমুখে রথতলার ঘাট বলে পরিচিত হয়।
লীলা মজুমদারের লেখায় যে আহিরিটোলার ঘাট ঘুরেফিরে দেখা দেয়, সেই ঘাটটি উত্তর কলকাতার একটি জনপ্রিয় ঘাট। ঘাটটি আহিরিটোলা অর্থাৎ আভিরটোলা তথা গোয়ালাপাড়ার নিজস্ব ঘাট ছিল। পরে অবশ্য বসবাসের সূত্রে সম্ভ্রান্ত মানুষজনও এই ঘাট ব্যবহার করতে শুরু করেন। ঘাটটি গোয়ালাদের নিজস্ব উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়, না-কি অন্য কারুর দানে, তা জানার উপায় নেই। তবে সেকালে অন্যতম ব্যস্ত ঘাট হিসেবে এটির পরিচিতি ছিল যথেষ্ট।
সেকালে বিখ্যাত বাবুদের বেশিরভাগই ঘাট প্রতিষ্ঠা করে নাম-যশ অর্জনের সহজ রাস্তাটি ধরার লোভ সম্বরণ করতে পারেন নি। সে কলকাতার প্রথম ব্ল্যাক জমিদার গোবিন্দরাম মিত্রের পুত্র রঘুনাথ মিত্রই হোক কিংবা বনমালী সরকার, মদনমোহন দত্ত, তাঁর পুত্র রামতনু দত্ত, বৈষ্ণবচরণ শেঠ, দুর্গাচরণ মুখোপাধ্যায় হোক—সকলেই ঘাট প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সামিল। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে সেকেলে কলকাতায় যিনি হাতে মাথা কাটতেন, পলাশীর যুদ্ধ নামক প্রহসনে হেস্টিংস-এর সেই স্বনামধন্য দেশীয় সহচর নবকৃষ্ণ মুন্সীর নামাঙ্কিত কোন ঘাটের সন্ধান পাওয়া যায় না। হয়ত বাকি বড়লোকেরা যে-রাস্তায় হাঁটতেন, তিনি সে-রাস্তায় হাঁটার প্রয়োজন বোধ করেন নি। ঘাট প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কেবল অর্থবান বাঙালি হিন্দুরাই এগিয়ে এসেছিলেন এমন নয়, অবাঙালিরাও অনেকেই, মায় অনেক সাহেবও ছিলেন। মীরজাফর যখন প্রথম কলকাতায় আসেন, তখন তাঁর জন্য যে ঘাট তৈরি করা হয়, তা নবাবের ঘাট নামে পরিচিত ছিল। পুরানো টাঁকশালের উত্তরদিকে যে রাস্তা বর্তমানে অপরিসর হয়ে পড়েছে, তারই নীচে গঙ্গার বুকে এই ঘাটটি গড়ে ওঠে। ঘাটটি কেউ কেউ বলেন মীরজাফর স্বয়ং তৈরি করেছিলেন, যদিও কেউ কেউ বলেন, কোম্পানিই ঘাটটি তৈরি করে দেয়। যদিও মীরজাফর ছিলেন কোম্পানির হাতের পুতুল মাত্র, ফলে তাঁর জন্য কোম্পানির নতুন ঘাট তৈরি করে দেওয়ার গরজ থাকা কিছুটা আশ্চর্যের কথাই বটে। পরবর্তীকালে এই ঘাটের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ মুর্শিদাবাদের নবাবি তোষাখানা থেকেই দেওয়া হত বলে অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে, এই ঘাটটি নবাবি অর্থেই তৈরি হয়েছিল। এর পাশেই আর একটি ঘাট ছিল, যেখানে নবাবের সঙ্গে আসা নৌবহরের প্রধান এবং অন্যান্য কর্তাব্যক্তি নেমেছিলেন, মীরজাফরের নৌ-বহর ভিড়েছিল বলে একে মীরবহর ঘাট বলা হত।
ক্লাইভ ও হেস্টিংসের আস্থাভাজন লাহোর থেকে আসা পাঞ্জাবি হিন্দু কাশীনাথ ট্যাণ্ডন, যিনি সামান্য ব্যবসায়ী থেকে লর্ড কর্ণওয়ালিশের দপ্তরে দেওয়ানি লাভ করে প্রভূত ধনসম্পত্তির মালিক হন, তিনিও একখানি ঘাট তৈরি করেন, যা আজ কাশীবাবুর ঘাট নামে পরিচিত। এই কাশীনাথ মহারাজা নন্দকুমারের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে হেস্টিংসের ষড়যন্ত্র সফল করতে মূল উদ্যোগীদের মধ্যে একজন ছিলেন। শোনা যায়, জুম্মা শাহ্ নামে এক ফকিরকে সেবাশুশ্রূষা করে তাঁর প্রাণ রক্ষা করায় সেই ফকিরের আশীর্বাদে এবং পরামর্শে কাশীনাথের এত উন্নতি হয়। আজও ক্লাইভ স্ট্রিটে জুম্মা শাহ্ পীরের দরগা রয়েছে। এই পীরের দরগার পাশেই ছিল কাশীনাথের বাড়ি। ১৭৯২ সালে কাশীনাথের মৃত্যুর সময় তাঁর গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল ষাট লক্ষ। পরবর্তীকালে এঁদের উত্তরপুরুষেরা ট্যাণ্ডন পদবী ত্যাগ করে বর্মন পদবী গ্রহণ করেন। চাঁদনী চকের অনেকখানি মালিকানা এঁরা ভোগ করেন। লটারি কমিটির টিকিট কেটে চাঁদনী চকটি এঁরা পেয়েছিলেন। কেবল একালে নয়, সেকালেও কিন্তু লটারি কেটে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অনেক কিছু পেতেন !
রুস্তমজী-কাওয়াসজীও ঘাট তৈরি করেছিলেন। সাহেবদের মধ্যে জনৈক রসবিবি (ইনি কি রসা রোড যাঁর নামে, তাঁর কেউ হন?), পোর্তুগিজ ব্যবসায়ী জোসেফ ব্যারেটো, ব্যবসায়ী (?) জ্যাকসন সাহেব, জনৈক ফোরম্যান সাহেব, জাহাজ-ব্যবসায়ী ব্লাইথ সাহেব প্রমুখ সাহেবসুবোরাও ঘাট তৈরিতে পিছিয়ে ছিলেন না। গঙ্গার পূর্বকূল ঘেঁষে ঘাট তৈরির যেন প্রতিযোগিতা পড়ে গিয়েছিল। কোন কোন ঘাট পরবর্তীকালে অন্য তাৎপর্য পেয়েছে। যেমন কাশীপুরের ঘাট, যেখানে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের দেহাবসানের পর তাঁকে দাহ করা হয়। নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ীকেও এই ঘাটেই দাহ করা হয়। নিমতলা ঘাটে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, শহীদ ভগৎ সিং, বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, মেঘনাথ সাহা প্রমুখ অনেকের অন্ত্যোষ্টি সম্পন্ন হয়। সব ঘাটের কথা বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে, কিস্সা ফুরাবে না। সে-কারণে একটি দুটি ছোট কিস্সার কথা বলেই এই পর্বে ইতি টানবো।
পাথুরিয়াঘাটায় যে একখানা ঘাট ছিল, সে-কথা সকলেই জানে। কেউ কেউ বলেন, সে-ঘাট পাথর দিয়ে তৈরি হয়েছিল বলে, সেই থেকে পাথুরিয়াঘাটা নাম হয়েছিল। তবে অন্য মতে, কথাটি এসেছে হিন্দী শব্দ ‘পাথুরিয়া’ থেকে, যার অর্থ ছিল বেশ্যা। সেকালে বেশ্যাদের জন্য পৃথক কোন স্নানের ঘাট ছিল না, অথচ সাধারণের স্নানের জন্য তৈরি ঘাটে তাঁদের স্নান করা প্রায় অসম্ভব ছিল। এ-কারণেই কোন সহৃদয় রসিক এই ঘাটটি নির্মাণ করিয়ে দেন। বলা বাহুল্য, এর কাছেই রয়েছে ডিহি কলকাতার সবচেয়ে পুরাতন গণিকাক্ষেত্রটি। পরবর্তীকালে অবশ্য এই ঘাটে সকলেই স্নান করতেন।
অবশেষে যে-চাঁদপাল ঘাটের কথা আগের পর্বে বলে এই ঘাটকাহিনি শুরু করেছিলাম, তার সম্পর্কে একটি গালগপ্পের কথা বলেই ইতি টানবো। ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্ট অনুযায়ী কলকাতায় বিচার ইত্যাদির জন্য একটি সুপ্রিম কোর্ট এবং গভর্ণর জেনারেলের একটি সুপ্রিম কাউন্সিল গড়ে তোলা হয়। কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের অনেকেই প্রজাদের উপর অত্যাচার করে, তাদের কাজকর্মও নিয়মানুগ নয়, সে-ব্যাপারে কোম্পানি সচেতন ছিল। ফলে সুপ্রিম কোর্টের জজেদের পাঠানর সময় বলে দেওয়া হল, তাঁরা যেন কড়া নজর রাখেন এবং কোথাও কোন উৎপীড়ন-অত্যাচার দেখলে তার প্রতিবিধান করেন। গালগপ্পো এই যে, প্রথম যাঁরা জজিয়াতির কাজ নিয়ে চাঁদপাল ঘাটে পিনেস থেকে নামলেন, তাঁরা নেমেই দেখলেই একদল কালো মানুষ খালি পায়ে হাঁটছে। তখন দেশীয়দের পায়ে জুতো পরে হাঁটার রেওয়াজ ছিল না। রামমোহন সর্বপ্রথম সভা-সমিতিতে যেতেন জুতো পায়ে দিয়ে। যাই হোক, সে-খবর তো সাহেব-জজেরা রাখতেন না। তাঁরা নিশ্চিত হলেন যে, কোম্পানির কর্মচারীদের মাত্রাতিরিক্ত শোষণের ফলেই এদেশীয় লোকেরা জুতো পর্যন্ত কিনতে পারে না। তাঁরা সেখানেই প্রতিজ্ঞা করলেন, ছয় মাসের মধ্যে এর শেষ দেখে ছাড়বেন। ব্যস্, প্রথম দিন থেকেই কোর্ট ও সুপ্রিম কাউন্সিলের মধ্যে মারমার-কাট্কাট্ লেগে গেল ! আমাদের ঘাটের কথাও এখানেই ফুরাল।
'চিঠির জুবান' অকপট আলোচনায় -সায়ন ভট্টাচার্য
কোথায় লেখা আছে বিভাজনের নাম? কেমন করে মাটি ভাগ হয়ে গেল— ভাগ হয়ে গেল আকাশ! পৃথিবীর সব দেশ কেন ভাগাভাগি না হয়ে একটাই পৃথিবী হৃদয় নিয়ে এক-আকার হয়ে থাকতে পারলাম না? এ প্রশ্ন অলীক হলেও মানবের উষ্ণতার মতো সত্য। আমাদের অসীম লোভ নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম অনিশ্চিতের হাত ধরে। ভাগ হল দেশ, কাঁটা তারের ঘষটানিতে ফালাফালা হল হৃৎপিণ্ডের নরম মাংস। রেডিও জেগে উঠে জানান দিল—“অভিযোগ আসিয়াছে কংগ্রেস আর হিন্দুমহাসভার কোনও কোনও স্থানীয় নেতা তাহাদের প্ররোচনা দিবার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। প্রতিরোধ বাহিনী গঠনের নামে এই নেতাবৃন্দই একসময় অস্ত্র তুলিয়া দিয়াছিলেন অপরাধীযুবকদের হাতে, পরবর্তীতে ইহারা সকলে অনিয়ন্ত্রিত হইয়া খুন-জখম-লুঠপাট চালাইয়া যাইতেছে…” পৃথিবীর রেডিও সব জায়গায় বেজে ওঠে যাকে আজও কেউ বন্ধ করতে পারেনি।
ধ্বংসস্তূপের উপর রাখা ভবিষ্যতের স্মৃতি নিয়ে চিঠির উপর লিখে রাখছে একটি মেয়ে, ধরা যাক তার নাম সোহাগ, তার কোমল মনের ভীমপলাশীমনের জুবান। বৃষ্টি, আলোর রেখার চারপাশ আর সম্পূর্ণ সাদাকালো জীবনের মাঝেও নির্ভুল বানানের ক্যানভাস তৈরি করে সিদ্ধার্থ— তার জন্য পোস্ট অফিসের মধ্যে অপেক্ষা করে কতশত কাঁটা তার পার হওয়া শব্দের মিছিল। সেখানে কত রহস্য— কত নামের আড়ালে থাকা মানুষের বিভিন্ন বয়ান। আপাতভাবে যে কাহিনির বুনটে লেখা থাকে হারিয়ে যাওয়া প্রেমের কাছে ফেরা আর্তি— কিন্তু সেই প্রেমের অভিঘাত ভেঙে, ঘরের দেওয়াল ভেঙে, দাম্পত্যের একদম মাঝবরাবর এসে দাঁড়ায় বিদ্যুৎরেখার মতো অবিশ্বাস! এই অবিশ্বাস— এক একটা সমকালীন পটের ছবি মেলে ধরে, মেলে ধরে স্বৈরাচারী সরকারের উত্থান ও পতনের গোপন আঁতাত।
পৃথিবীর রঙের মতো, বহুকৌণিক স্পেসে— বিরল টুনিবাল্ব সদৃশ ভঙ্গুর এপার-ওপার বিভাজন, যে লৌহ জবনিকার নাটকীয় চ্যলেঞ্জকে ভেঙে খানখান করে দেয় মানুষের ফেলে আসা দরদের জোর দিয়ে। তাই তো গোপনে আসতে হয়— ক্ষমতার চূড়ান্ত অবিশ্বাস দিয়ে স্পাই হিসেবে ঢুকতে হয় সংসারের মধ্যে। কারণ তার আগেই তো মেঘ বলে—
“অগ্রাধিকার? আমি পার্টির জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলাম।আমি সেদিন কেন গিয়েছিলাম শহর ছেড়ে জানো? ছাড় বাদ দাও… ভালই হয়ে ছে । ওদের মুখোশটা সরে গিয়ে আসল মুখগুলো বেরিয়ে এসেছে।” সত্য ও উত্তর-সত্যের গোলকে আবর্তিত এই মানববন্ধন কখন দৃঢ় হবে, আর কখন তার স্খলন ঘটবে তার চাবিকাঠি অনেক গোপনে লোকনো থাকে। ঠিক যেভাবে চিঠির আড়ালে লুকিয়ে থাকে মানুষের হৃদয়।
বাঙালি সাধারণত যে থিয়েটার দেখতে প্রস্তুত – ‘চিঠির জুবান’ তার চলার পথ একটু অন্যরকম। নাটকের কর্মকাণ্ড ও গল্প বলার ঢং আমাদের স্মৃতি ও বাস্তবের সিম্ফনি সহযোগে চলতে থাকে। নাটকের মঞ্চে যে সত্যের কল্পরাজ্য তৈরি করার চেষ্টা করার হয় খুব সচেতন ভাবেই এখানে সেই পথে হাঁটেন নি ‘এবং ঈপ্সিতা’।
অভিনয়ের যে স্টাইল এই নাটকে ব্যবহার করা হয়েছে – আজকের বাংলা থিয়েটারের অভিনয়ের যে নিত্যনৈমিত্তিক প্যাটার্ন, তাকে ভাঙতে চাওয়া হয়েছে সব রকম ভাবে। যদিও ঈপ্সিতা বলেন –
“রিয়েলিস্টিক একটিং করার চেষ্টা করেছি। প্যাটার্ন ভাঙব বা এরকম কিছু ভেবে নয়। অন্তরঙ্গ পরিসরে মঞ্চের মত লাউড অভিনয় ভাল লাগবে না ভেবেই নিচু সুরে অভিনয় বাঁধার চেষ্টা করেছি।”
আজকের গ্লোবাল চালচিত্রে ‘বাংলা ইন্টিমেট থিয়েটার’ -এর গুরুত্ব কোথায়? ‘চিঠির জুবান’ ঠিক কোন কারণে ‘ইন্টিমেট’ নবনাট্য – কারণ এই নাটক আপনাকে এমন একটা অন্ধকারে টেনে আনবে, আপনি পিপিলিকার মতো আসবেন, অবিশ্বাসকে ভাঙতে চেষ্টা করে আসবেন, রাষ্ট্র যেভাবে নাকটা ঢুকিয়ে দেয় আমাদের বেডরুম পর্যন্ত – সেটাই আমাকে টেনে নিয়ে যাবে আপনার নিজস্ব ইন্টিমেট স্পেসে। সেখানে অনির্বাণ, অর্ঘ্য , সৌম্যজিৎ আপনাকে টেনে আনবেই ওদের বয়ান দিয়ে, অভিনয় নয়।
রাষ্ট্রের কাছে জবাব চাইবার সময় এসেছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তায় স্বাচ্ছন্দ্যে থিয়েটার কখনও একটা ফ্যাক্টর হতে পারে না, শতাব্দী শেষের বিচ্ছিন্ন রায়ট তার প্রমাণ দিয়েছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী দাঙ্গা, চা-বাগান লুঠ, গোর্খা আন্দোলন থেকে কামতাপুরী, নন্দিগ্রাম আন্দোলনের যথার্থতা নিয়ে অবস্থান স্পষ্ট করে দিতে পারত থিয়েটার। হয়নি! স্বাধীনতা থেকে নকশাল আন্দোলন কতটা প্রাসঙ্গিক এ প্রজন্মের কাছে, শত প্রশ্নের পরও শুধু নীরবতার উপহাস জুটেছিল এক একজন নির্দেশকের কাছে। এমনকী যে শহরের মঞ্চে সংস্কৃতির অবস্থান, সেখানেও নতুন নাটক হরতাল ঘোষণা করতে পারলো কই! শেষ করছি ঈপ্সিতার কথা দিয়ে,”আমি কোথাও দর্শককে এক ধরণের ভয়ারিস্টিক প্লেজার দিতে চেয়েছি, মানুষ তো লোকের বাড়ির ভিতর কি হয় সেটায় নাক গলাতে পছন্দ করে রাষ্ট্রের মতো।
"মেডিকেল স্ক্যাম"-এর ভয়াবহতা তুলে ধরলেন - বৃতা মৈত্র
ভয়াবহ মেডিকেল স্ক্যাম উঠে এসেছে ‘হিউম্যান’-এ
বৃতা মৈত্র
অতীত আর বর্তমান হাত ধরাধরি করে চলে মধ্যপ্রদেশের ভোপাল শহরে। উন্নত ও আধুনিক পরিকাঠামো-যুক্ত বহুমুখী সুবিধার হাসপাতাল মন্থন গড়ে উঠেছে এখানেই। শহরের ধনী সম্প্রদায়ের কাছে মন্থন দারুণ নির্ভরযোগ্য। আর বিত্তহীন মানুষের কাছে একেবারে বিপরীত!! মন্থনের মালিক ডা. গৌরী নাথ– বাইরে থেকে এই মহিলা মানবতা ও করুণার প্রতিমূর্তি।
আসলে তার মতো অর্থ ও ক্ষমতালোভী মানুষ হয় না। ডা. গৌরী নাথের পরিচালনায় রমরমিয়ে চলছে মন্থন। ব্যবসায় উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে। এখানে জেনে রাখা ভালো, তার সব অপকর্মের যোগ্য সাথী ডা. গৌরী নাথের স্বামী প্রতাপ। ডা. গৌরী নাথের স্বপ্ন একটি নিউরোসায়েন্সের হাসপাতাল গড়ে তোলা। এর জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন।
এরই পাশাপাশি ঘটছে অন্য কিছু। প্রবীণ ডা. মোহন বৈদ্য ও তাঁর চতুর ছেলে অশোকের পরিচালনায় প্রতিষ্ঠিত বায়ু ফার্মাসিউটিক্যালস এই মুহূর্তে বিরাট এক বিপর্যয়ের মুখে। তাদের প্রস্তুত কোভিড ১৯ ভ্যাকসিন ব্যর্থ হওয়ায় এই বিপর্যয়। অবস্থা সামাল দিতে মরিয়া এই প্রতিষ্ঠান ব্যান করা ওষুধ S93R নতুন ভাবে প্যাকেটজাত করে বাজারে নিয়ে আসে যুগান্তকারী চিকিৎসা বাজারে এসেছে, এই কথা বলে। আর এই কাজে তাদের আইনকানুন সংক্রান্ত যাবতীয় জট ছাড়াবার ব্যবস্থা করে ডা. গৌরী নাথ। দু-পক্ষের অশুভ আতাতে সাদা-কালোর বিভেদ দূর হয়ে যায়। ডা. গৌরী নাথের স্বপ্নের প্রোজেক্ট তৈরির টাকার ব্যবস্থাও হয়ে যায় এভাবেই।
পরিকল্পনা করা হয়, ট্রায়ালের জন্য গরীব মানুষজনকে ব্যবহার করা হবে। পুরো কাজটাই হবে গোপনে। আর গরীব মানুষের মৃত্যু এদেশে শুধু সংখ্যাতেই আটকে থাকে। কেউ মাথাই ঘামায় না! এক্ষেত্রে দালালের ভূমিকায় নামল বাবলু। বস্তি থেকে অসহায় মানুষদের খুঁজে আনতে সে। এভাবেই মঙ্গু এসে পৌঁছয় এই কুচক্রী কব্জায়। তার ওপর S93R প্রয়োগের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয় মারাত্মক, যা শেষ হয় মৃত্যুতে! একদিকে সক্রিয় এই চক্র, অন্যদিকে বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত মেধাবী ও দক্ষ কার্ডিয়াক সার্জন ডা. সায়রা সাভারওয়াল। প্রথম দিকে সে ছিল ডা. গৌরী নাথের অন্ধ ভক্ত। রহস্যময় পরিস্থিতিতে একের পর এক রোগীর মৃত্যুর পর সন্দেহ দেখা দেয় ডা. সায়রার মনে। সে তদন্ত করতে শুরু করে ও ডা. গৌরী নাথের অসাধু চক্রের হদিশ পায়।
এমনই বাস্তবধর্মী ও জ্বলন্ত এক বিষয় আমরা দেখি ‘হিউম্যান’-এ, ওয়েব পর্দায় যা নিয়ে এসেছে ডিজনি হটস্টার! শেষ পর্যন্ত এই কুচক্র কী ধরা পড়ে? ডা. গৌরী নাথের মুখোশ কী খুলতে পারে ডা. সায়রা? দরিদ্র মানুষগুলির ভাগ্যেই বা কী ঘটে? এই সবকিছুই আপনারা সিরিজে দেখবেন। এদেশে মেডিকেল স্ক্যামের ঘটনা নতুন নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিচারের বানীকে নীরবে কাঁদতে দেখি আমরা! রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে সব ওলটপালট হয়ে যায়। ছাড়া পেয়ে যায় অপরাধী। এখানেও কী এমনটাই ঘটবে? এই কাহিনির শেষে যেটাই থাক, এমন এক সিরিজের উপস্থাপনা নিঃসন্দেহে কুর্নিশযোগ্য। সৃজন ও পরিচালনা বিপুল অম্রুতলাল শাহ এবং মোজেজ সিং। সিনেমাটোগ্রাফি শীর্ষ রায়। মুখ্য ভূমিকায় শেফালি শাহ (ডা. গৌরী নাথ), মোহন আগাশে (ডা. মোহন বৈদ্য), আদিত্য শ্রীবাস্তব (অশোক বৈদ্য), কীর্তি কুলহারি (ডা. সায়রা), বিশাল জেঠোয়া (মঙ্গু), রাম কাপুর (প্রতাপ), শিব কানুনগো (বাবলু) প্রমুখ।
এছাড়াও আছেন রাজনৈতিক নেতার ভূমিকায় অভিজিৎ লাহিড়ী ও সঞ্জীব বৎস। কাল্ট লিডার রোমি মায়ের চরিত্রে সীমা বিশ্বাস, যার সঙ্গে আবার ডা. গৌরী নাথের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন গৌরব দ্বিবেদি, ঋদ্ধি কুমার, ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, শ্রুতি বাপনা, আসিফ খান, সন্দীপ কুলকার্নি, অংশ সঈদ, সিদ্ধান্ত কার্নিক, প্রণালী ঘোগরে, জগৎ রাওয়াত প্রমুখ। ১০ পর্বের প্রথম সিজনের স্ট্রিমিং চলছে। স্মার্ট, গতিশীল এই সিরিজ দর্শককে এতটুকু অন্যমনস্ক হতে দেবে না, গ্যারান্টি। অভিনয়ে সকলেই নিখুঁত। আর সেরার সেরা যে শেফালি, সেটা বোধহয় আর নতুন করে বলে দেবার দরকার পড়ে না। বলিউড তাঁকে ব্যবহার করতে পারেনি, ক্লিশে হয়ে গেলেও অভিযোগটি আর একবার না করে পারলাম না। ডা. গৌরী নাথকে একশভাগ রক্তমাংসের করে তুলেছেন শেফালি!
সাঁওতালদের সমাজব্যবস্থার অন্দরমহলে উঁকি দিলেন - ঊষা মুর্মু
জন্ম : গ্রামে কোনো শিশুর জন্ম হলে সমস্ত গ্রাম অশুচি বলে মানে সাঁওতাল সমাজ। যতদিন না অশৌচ কাটে, গ্রামে কোনো পূজা-অনুষ্ঠান হয় না এবং গ্রামের কেউ এ বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করে না। মেয়ে হলে তিন দিনে আর ছেলে হলে পাঁচ দিনে শুদ্ধিকরণ অনুষ্ঠান হয়। সেই দিন গ্রামের সবাই ওই বাড়িতে চুল, দাড়ি, নখ কাটে, নবজাতকের মাথাও মুণ্ডন করা হয়। ধাই মা নবজাতকের মাথার চুল শালপাতার তৈরি বাটিতে রাখে। নবজাতকের চুল নিয়ে অন্যান্য মহিলাদের সঙ্গে স্নানে যায়। জলে ঐ শালপাতায় মোড়া চুল ভাসিয়ে দেয়। এরপর বাড়ি ফিরে ধাই মা উঠোন গোবর দিয়ে পরিষ্কার করে, তারপর আতপ চালের গুঁড়ি জলে গুলে উপস্থিত সকলের বুকে ও বাড়িতে ছিটিয়ে দেয়। মা ও সন্তানের বুকেও ছিটিয়ে দেয়। নামকরণে প্রথম সন্তান পিতৃকুলের নাম পায়— মেয়ে হলে ঠাকুরমার এবং ছেলে হলে ঠাকুরদার নাম। পরের সন্তান মাতৃকুলের নাম পায়, এছাড়া অন্যান্য সন্তানরা পিসি-মাসি ইত্যাদির। ধাই মাকেই নবজাতকের নাম ঘোষণা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। জন্মের পর থেকে নবজাতকের খাটিয়ায় কাজললতা, লোহার কোনো অস্ত্র যেমন, দা ঝুলিয়ে রাখা হয়। সাঁওতালরা বিশ্বাস করে যে ঐ অস্ত্র দিয়ে নবজাতকটি অপশক্তির সঙ্গে লড়াই করবে এবং কাজললতার জন্য কোনো কুনজর তার গায়ে লাগবে না। নামকরণের দিন আতপচাল ও নিমপাতা দিয়ে খিচুড়ি বানানো হয়, বাড়ির পূর্বপুরুষদের নামে হাড়িয়া উৎসর্গ করা হয়। গ্রামের সবাইকে তা খেতে দেওয়া হয়। এইভাবে গোটা গ্রাম শুদ্ধ হয়। মুখে ভাতের অনুষ্ঠান ছোট্ট করে হয়, যেটা মামাবাড়ির লোক করে থাকে।
বিবাহ : সাঁওতাল সমাজে স্বগোত্রে বিয়ে কখনোই হয় না। বাল্যবিবাহও না। পাত্রী বা পাত্র নির্বাচনে বংশপরিচয় এবং পাত্রের জমিজমা আছে কিনা তার উপরেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এখন দিন বদলেছে, সময় বদলেছে। পাত্র-পাত্রী শিক্ষিত কিনা চাকুরি করে কিনা তা দেখা হচ্ছে, কোনো কারণে স্ত্রী অথবা স্বামী মারা গেলে শালিবরণ, দেবরবরণ প্রচলিত। ভাসুর কখনোই ছোট ভাইয়ের বউকে বিয়ে করতে পারে না।
সাঁওতাল সমাজে সাতরকম বিয়ে প্রচলিত। স্বাভাবিকভাবে পাত্রী নির্বাচন করেই বিয়ে হয়ে থাকে। সাঁওতাল সমাজে কখনোই কন্যার পিতাকে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা মানা হয় না। বিবাহ-সম্বন্ধ ঠিক করার ব্যাপারে ঘটকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ছেলে বিবাহযোগ্য হলেই ছেলের বাবা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে দায়িত্ব দেয় পাত্রী দেখার। পাত্রী-নির্বাচন থেকে বিয়ে পর্যন্ত ঘটককে অনেকখানি দায়িত্ব পালন করতে হয়। কনে বা পাত্র দেখার সময় কোনো অশুভ ঘটনা দৃষ্টিপথে পড়লে সে বাড়িতে বৈবাহিক সম্পর্ক হয় না। জলভরা কলসী শুভ লক্ষণ এবং স্ত্রীলোকের মাথায় জ্বালানি কাঠের বোঝা, গোরুর গাড়ি হল অশুভ লক্ষণ। মেয়ে দেখে পছন্দ হলে বাড়ি থেকে একটু দূরে গিয়ে সকলের মতামত নিয়ে দ্বিতীয়বার সে বাড়িতে আসন গ্রহণ করে ও জলস্পর্শ করে। কনে পছন্দ না হলে সেখানে জলস্পর্শ করে না। সঙ্গে-সঙ্গে ফিরে আসে। এই নিয়ম পাত্র দেখার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দুইপক্ষের পছন্দ হলে আশীর্বাদ ও বিয়ের দিন ধার্য করা হয়। যতদিন পরে বিয়ের দিন ঠিক হয়, সুতোয় ততগুলো গেরো বাঁধা হয় এবং হলুদ লাগানো হয়। ঐ সুতো শালপাতার বাটিতে হলুদ দূর্বাঘাস, আতপচালের সঙ্গে মুড়ে ঘটকের মাধ্যমে বরের বাড়িতে পাঠানো হয়। আত্মীয় বন্ধুদেরও নিমন্ত্রণ করা হয় শালপাতার মধ্যে এরকম গেরো সুতো পাঠিয়ে। বিয়ের মণ্ডপ তৈরি করা হয়, বিয়ের পাশে একটি গর্ত তৈরি করা হয় বর বা কনেকে স্নান করানোর জন্য। বাড়ির পূর্বপুরুষদের নামে হাঁড়িয়া উৎসর্গ করা হয়, যারা ভবরু, জাহের, আয়োর তাদের উদ্দেশ্যে তিনটি মুরগি উৎসর্গ করা হয়, যাতে শুভকাজ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়। গ্রামের ছেলে-মেয়েরা ধামসা-মাদোল ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বিবাহে নাচ-গান করে। এদিকে বরযাত্রীরা সব বাড়ি থেকে বেরোবার আগে পাত্রের বাবা পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে হাঁড়িয়া উৎসর্গ করে যাতে সব কাজ নির্বিঘ্নে ঘটে। বরযাত্রীরা সঙ্গে চাল, ডাল, তেল, নুন, মশলাপাতি সব নেয়। ঘটক বরযাত্রীদের সঙ্গেই থাকে। তারা গ্রামের সীমানায় পৌঁছে অপেক্ষা করে এবং কনেপক্ষ বরকে ধামসা-মাদোল বাজিয়ে নাচতে-নাচতে বরণ করে মণ্ডপের মধ্যে নিয়ে যায়। বরকে স্নান করানো হয়, স্নানের পর বরের ভগ্নীপতি বরকে কাঁধে নেয়, কনের ভাইকেও কাঁধে তুলে আনা হয়। পরস্পর পরস্পরকে আলিঙ্গন করে পাগড়ি, পান উপহার দিয়ে প্রীতি-সম্বন্ধ স্থাপন করে। এরপর কনেকে একটি বড় ডালার মধ্যে বসিয়ে মণ্ডপে নিয়ে আসা হয়। ঐ ডালাটি বরের দাদারা বহন করে। বিবাহ-মণ্ডপে তিনবার বৃত্তাকারে ঘুরবার সময় বর ও কনের আঁচলে আতপচাল রাখা হয় এবং তারা পরস্পর পরস্পরের দিকে তা ছোঁড়াছুঁড়ি করে। পূর্বদিকে মুখ করে সূর্যসাক্ষী রেখে শালপাতায় মোড়া সিন্দুর মাটিতে তিনবার খেলে কনের সিঁথিতে তিনবার সিন্দুর লেপে দেয়। বর নিজে কনেকে ডালা থেকে নামিয়ে নেয়। কনের মা মাঙ্গলিক থালা নিয়ে বরণ করে ঘরে নিয়ে যায়। সেদিন সারারাত নাচগান চলে। রাত্রে ভোজ ও নানারকম পানীয় গ্রহণের ব্যবস্থা থাকে।
মৃত্যু : অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশুর মৃতদেহ ছাড়া সাঁওতালরা মৃতদেহ দাহ করে। শ্মশানে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার আগে মৃতদেহটিতে তেল-হলুদ মাখানো হয়, কপালে সিন্দুর দেওয়া হয়। মৃতদেহ খাটিয়ায় করে রাস্তার চৌমাথায় নিয়ে যাওয়া হয়, মৃতদেহ কিছুক্ষণের জন্য রাখা হয়, শববহনকারীরা কিছু খই ও তুলাবীজ ছড়িয়ে দেয়। সাঁওতালদের বিশ্বাস অশরীরী আত্মা তাহলে মৃতদেহ সৎকারে কোনোরকম বাধা সৃষ্টি করে না। শ্মশানেও মৃত ব্যক্তির হাত-পা-মুখ ধোওয়া হয় ও তেল-হলুদ মাখানো হয়। নতুন কাপড় দিয়ে মৃতদেহটি ঢেকে দেওয়া হয়। দক্ষিণ দিকে মাথা করে চিতায় তোলা হয়। এই সময় একটি মুরগির বাচ্চা বলি দেওয়া হয়। মৃতের জ্যেষ্ঠপুত্র মুখাগ্নি করে, দেহ দাহ করা হয়ে গেলে মাটির ভাঁড়ে সযত্নে অস্থি সংগ্রহ করে রাখা হয়। এরপর ঐ অস্থি কোনো গাছের নীচে পুঁতে দিয়ে সকলে মিলে পুকুর বা নদীতে স্নান করে বাড়ি ফিরে আসে। পরদিন ছোট করে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। ঐ দিন মৃত ব্যক্তির আত্মাকে ঠাকুররূপে ঘরে আনা হয়। তখন তারা ভুবরু ও পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে মুরগি ও হাঁড়িয়া উৎসর্গ করে। আবার ঐ দিন চুল, দাড়ি কেটে স্নান করে অশৌচ মুক্ত হয়। দামোদরে অস্থি বিসর্জনের দিন তারা সময় ও সুযোগ নিয়ে করে থাকে, এর কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তারা দলবদ্ধভাবে অস্থি বিসর্জন করতে যায়। সেখানে বিসর্জনের আগে মৃতব্যক্তির প্রিয় জিনিস, খাবার ইত্যাদি দান করা হয়। অস্থিবিসর্জনের দল ফিরে আসার পরের দিন বড় শ্রাদ্ধ হয়ে থাকে। আত্মীয়-স্বজনেরা আসে, মৃত ব্যক্তির সম্বন্ধে আলোচনা হয়। ভুবরু ও পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে ছাগল, মুরগি উৎসর্গ করে আত্মার শান্তি কামনা করা হয়। একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে অশৌচ ক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।