ভাণ পত্রিকা
৪৩ তম ই-সংস্করণ ।। ৫৪ তম সংখ্যা ।।ডিসেম্বর ২০২৪
সম্পাদক :
সম্পাদনা সহযোগী :
প্রচ্ছদ :
নক্সা পরিকল্পক :
অন্যান্য কাজে :
ভাণ-এর পক্ষে:
পার্থ হালদার
কর্তৃক
৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬
( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )
৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) bhaan.kolkata@gmail.com ( ই – মেল )
Reg. No : S/2L/28241
সূচিপত্র
সম্পাদকের কথা
।। সম্পাদকের কথা।।
ডিসেম্বর , ২০২৪
রাগ, ক্ষোভ, ক্রোধ- এসব শেষত সাংঘাতিক বস্তু। সংবরণ করতে না পারলে, নিয়ন্ত্রণে না রাখা গেলে, একটা গোটা দেশকে পর্যন্ত উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে, জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছা করে অন্যকে, অসহায় মানুষ দেখে আহ্লাদে চিৎকার করতে ইচ্ছে করে। বীভৎস রসের কারবার মানুষকে মৌলবাদী বানিয়ে দেয়। অথবা মৌলবাদী মন তাকে ধ্বংসাত্মক,ধর্ষকামী নিষ্ঠুর জগতের বাসিন্দা করে তোলে। যে বানিয়ে তোলা ‘অপর’ ছাড়া বাঁচতে পারেনা। অপরকে ঘৃণা না করলে নিজেকে খুঁজে পায় না। শাস ভি কভি বহু থি– এ কথা শাশুড়ি বিস্মৃত হন। বউ যে ক্রমে শাশুড়ি হয়ে উঠবে এ-সত্য বউ আবার ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেন না। এই অসম্পূর্ণ বোঝাবুঝি ঘৃণার সহায় হয়। যদিও সবাই যেন কতো ন্যায় কাতর! ভাব দেখায় ,- এইসব ঘৃণা আসলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে। নইলে মানুষ আমি সাধারণ, বিরিয়ানির প্রেমে পড়ে অ্যান্টাসিডে ভক্তি রাখি। একদিন রাস্তার চা এর দোকানের প্যালাসটিকের জাগে বাধ্যত এক ঢোক জল গিলে সারাদিন বিজানু চিন্তায় নতজানু থাকি! সন্তানের চিন্তার উজাগর থেকে অন্য দেশের সন্তানদের স্রেফ একতাল মাংস পিন্ড ভাবি সেই একই ‘আমি’। আমাকে একথা ভাবায় আমার মৌলবাদী মন। কে জানে ঈর্ষা আমাদের কীভাবে আরাম দেয়, হিংসা আমাদের কোন প্রজাতির আহ্লাদ জাগায়। মুণ্ডহীন ধড়ের কথা ভেবে কীভাবে আহ্লাদে চিৎকার করি আমরা – আমি জানি না। আমরা একই আহ্লাদে রবীন্দ্র – গান্ধী – বুদ্ধ জয়ন্তী করে ছোটো কে, আলাদা কে, পৃথক কে দাবিয়ে-দমিয়ে- নামিয়ে রাখতে চাই। দেশে-দেশে, যুগে-যুগে, নানা ভঙ্গিতে রকমারি কারসাজিতে এই বিভাজনের “আমরা-ওরা” ফিরে আসে। আমরাই ফিরিয়ে আনি। আর ফরাসী বিপ্লবের সাম্য – মৈত্রী – স্বাধীনতার কাহিনী লিখতে গিয়ে সন্তান কম নম্বর পেলে হাহুতাশ করি।
আমার দেশের একটা সত্যিকারের ভালো হল,এমনতর বৈচিত্র্যের মধ্যে যুগান্তরের ঐক্য – সে সব গৌরব মিথ্যে করে নিজেদের বোঝাই, ওরা যদি এতো খারাপ তবে আমরা কেন দ্বিগুণ খারাপ হব না? আমরা কী খারাপ হবার ক্ষমতা হারিয়েছি? এইসব উল্টো হাহাকার কে সোজা ও স্বাভাবিক ভেবে নিজেদের কবর খুঁড়ে চলি আমরা। প্রতিটি ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ অনেকদূর পর্যন্ত স্বতন্ত্র জেনেও, ওরা পাকিস্থানী ওরা হিন্দুস্থানী ভেবে জ্ঞান করি।ওই ভূগোলের ভেতরে সবাই বোধহয়, সবটা মিলিয়ে মনে হয় একটাই ঘৃণিত ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে! ন্যায্যত প্রত্যাঘাতের প্রস্তুতি রেখেও আমরা প্রতি-উস্কানির গানে নিজেদের গন্যমান্য গায়ক বানাতে চাই। ক্ষমা মানে দুর্বলতা নয় একথা মনে থাকলেই যেখানে চলে, তারপরেও কী সহজে, কী দ্রুততায় অবিশ্বাস -ঘৃণা- অ-ক্ষমা-অসহিষ্ণুতার চাষ করে ফেলি। সেই চাষাবাদের কারবারিরা আজকের দেশ-নায়কদের ঢালাও সাহায্য ও প্রশংসা লাভ করেন! পরিস্থিতি বিষিয়ে ওঠে। গরিব দেশবাসীর পক্ষ নিয়ে বিপুল দায় দায়িত্ব কেবল ওপর চালাকি আর স্বান্তনা পুরস্কারের নেশা দিয়ে দূরগত করে রাখা সম্ভব হয় অতঃপর।
দূরের প্রতি ঘৃণা যে বড় করে তোলা যাবে সেটা বুঝতে বেগ পেতে হয় না। যখন বুঝি, পড়শী জ্ঞাতি গুষ্টির প্রতি আমাদের কী অবিমিশ্র ঘৃণা। সদরের দোরে প্রীতিময় অনুষ্ঠানের চমক, পেছনে বাঁশ পেরেকের আকাড়া বাস্তব। অপ্রাপ্তি যদি দুঃখের বদলে ঘৃণা ছড়ায়, তবে বুঝতে হবে তা অপক্ক অপ্রাপ্তবয়স্ক সভ্যতার লক্ষণ। নাদের আলি, আমরা আর কবে বড় হব? প্রাক্তন প্রেমিকার( অথবা প্রেমিকের ) প্রতি কেন কড়া ঘৃণা প্রদর্শিত হচ্ছে না এই অভিযোগে বর্তমান প্রেমিকার প্রাক্তন হয়ে ওঠার কাহিনী নিয়ে যে কয়জন বড় হন, তারা বুঝতে পারেন, প্রেমিকা মানে প্রেম নয়, প্রেম প্রেমিকের থেকে অনেক বড়ো, খন্ড-বিখন্ড, চূর্ণ-বিচূর্ণ নয় সে। ভালো মানুষ সব দেশে সব ধর্মে। বিভাজনের শিকার সব দেশ সব সমাজ। লুটেরা ধর্ষকামী মানসতাই কেবল অধর্ম। ঘৃণার যাথার্থ্যতা সেখানেই। অন্য কোথাও নয়। ঘৃণা-অবিশ্বাস-তাচ্ছিল্য দিয়ে ক্ষণিক আরাম ফূর্তি অথবা বোকা-তৃপ্তি পাওয়া সম্ভব হয়তো, তার বেশি নয়। বিশ্বমানব যেদিন একথা ভেতর থেকে জানবে, যত তাড়াতাড়ি বুঝবে, মঙ্গল তত কাছে ঘেঁষবে। কল্যাণ, পিঁড়ি পেতে দেবে। প্রতিহিংসার হুঙ্কার আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে লাগাতার সংগ্রাম– কথা দুটো কিন্তু এক নয়। প্রথমটাতে দায়হীন উল্লাস। দ্বিতীয়টিতে পরিণত দায়ের শুভ-অভিব্যক্তি। যে হিংসা ঘটেছে ধরিত্রীতে – তা দিয়ে হিংসা একমাত্র সত্য বলে সিদ্ধান্ত টানা যায় না। মানুষের শুভময় আকুতির জোরে কত হিংসা যে হার মেনেছে আমরা যেন সেকথা কখনো ভুলে না যাই।
থিয়েটারের মহাকাশে "স্পেস"-এর গুরুত্বকর্ষণ বোঝালেন - কুন্তল মুখোপাধ্যায়
পিটার ব্রুক বলেছিলেন, “একটা খালি জায়গায়- একজন মানুষ হেঁটে গেলেও, থিয়েটার সম্ভব হতে পারে।” একইভাবে স্তানিস্লাভস্কিকে লেখা চেকভের চিঠিতে (থ্রি সিস্টার্স-এর প্রযোজনা প্রসঙ্গে) দেখি তিনি বলছেন-“তৃতীয় অঙ্কে নাতাশা যদি একটা জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে নিয়ে আশে পাশে কোনোদিকে না তাকিয়ে মঞ্চের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সোজা সরলরেখা বরাবর হেঁটে যায়, অনেকটা লেডি ম্যাকবেথের মতো”… আবার রিচার্ড শেখনার ‘প্রদর্শন স্থান’- তার ভাষা, পরিবেশের ভাষা, তীর্থযাত্রার ভাষা, বিশেষ কোনও দৃশ্যের নাট্যভাষা প্রভৃতির সমন্বয়ে ‘রামলীলা’-র মধ্যে দিয়ে নিজের এনভায়রনমেন্টাল থিয়েটারকে- একটা খোলা জায়গায় বা ওপেন স্পেস্কে ব্যবহার করে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। থিয়েটার যে একটা স্পেস্-ভিত্তিক শিল্প, সেটা কেউই অস্বীকার করবেননা। খোলা জায়গায়, বাক্স কাঠামোয়, চাতালে, গ্যারেজে, বড় হলঘরে, চারপাশে দর্শকের মাঝখানে, বিভিন্ন স্পেসে থিয়েটার অভিনীত হয়ে চলেছে তার প্রায় জন্মলগ্ন থেকে আজকের দিন অবধি। স্পেস্-এর ব্যবহার অনুযায়ী থিয়েটারের কাঠামো ও চরিত্রও পালটে যায়। আমাদের কৈশোরে বাদল সরকারকে আকাদেমীর ওপরে অঙ্গন মঞ্চে, থিয়েটার লাইবয়কে হিন্দ সিনেমার উল্টোদিকে একটা কর্পোরেশন স্কুলে (অধুনা লুপ্ত)-র প্রাঙ্গণে এবং ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সাম্প্রতিক শাখাকে (পরাণ দা, শংকরদা, দিলীপ দা) সেন্টার সিঁথির এক বাড়ির বারান্দায় (৬০-৭০-এর দশকের রকে) নাটক করতে দেখেছি। প্রায় ওই একই সময়ে মিনার্ভায় ওথেলো, অঙ্গার, কল্লোল-এর স্পেস্ ও স্পেক্টাকল দেখে চমকিত হয়েছি। সিঁথির পেয়ারাবাগান মাঠে বাঁধা মাচায় শম্ভু মিত্রের রক্তকরবী দেখে বিমোহিত হয়েছি। আরও ছোটোবেলায় বহরমপুরের খাগড়ায় পূজামণ্ডপে নট্রকোম্পানীর চাঁদবিবি যাত্রাপালায় অরুণ দাশগুপ্ত- চপলরানির, খোলা মঞ্চকে ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে কণ্ঠ ও শরীর দিয়ে মানুষকে বিমোহিত করে রাখতে দেখেছি। কৈশোর ও যৌবনের প্রারম্ভে নানা নাট্য প্রদর্শনের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন স্পেস্-এর থিয়েটারের একটা মিল খুঁজে পেয়েছিলাম। নাট্য টেক্সট্ এবং অভিনয় যদি জোরালো হয় তবে থিয়েটার- এর গুণগত উৎকর্ষ কেউ রুখতে পারে না; কারণ নিশ্চিত ভাবেই থিয়েটারের জীবন্ত সংযোগ সূত্র। বোধহয় সেই কারণেই যাত্রাপালায় সমুদ্র শাসন, অঙ্গনমঞ্চে আৰু হোসেন, বাক্স মঞ্চে
রক্তকরবী বা টিনের তলোয়ার এখনও আমার কাছে নাট্যরস আস্বাদনে সম সমাদৃত হয়। থিয়েটারের স্পেস্-এর পরিবর্তনশীল ধারণাটি খুব জরুরি এবং প্রয়োজনীয় মনে হয় থিয়েটারের সংযোগসূত্রের প্রেক্ষাপটকে চিহ্নিত করতে। থিয়েটারে সব সময়-
কে বলছে?
কী বলছে?
কাকে বলেছে?
কীভাবে/ কেমন করে বলছে?
এই সংযোগ সূত্রটি বিধিবদ্ধ ভাবে মেনে চলা হয়। গ্রোটোহস্কি-র দরিদ্রের থিয়েটার প্রভাবিত বাদল সরকারের থার্ড থিয়েটার-এ মঞ্চ থিয়েটার থেকে স্পেসের ব্যবহারিক প্রয়োগ পৃথক করা, তারও আগে গণনাট্যের ছেঁড়া চটের মঞ্চসজ্জা থেকে দানশেঙ্কো, ভার্তাঙ্গভ প্রভাবিত ত্রিমাত্রিক মঞ্চসজ্জার ব্যবহারের কারণে শম্ভু মিত্রের নিউ এম্পায়ারে নাট্যপ্রদর্শন বা অদি সাম্প্রতিক সময়ে কৌশিক সেনের আকাদেমী মঞ্চ ত্যাগ করে সুজাতা সদনে নিজের প্রয়োজনমতো মঞ্চ ও প্রেক্ষাগৃহ সাজিয়ে, সুমন মুখোপাধ্যায়ের পদাতিক মঞ্চে কাঙাল মালসার্ট নিয়ে অন্তরঙ্গ থিয়েটার করার স্পেস ব্যবহার সবই কাকে-কীভাবে বলবো সংযোগের এই তৃতীয় ও চতুর্থ সূত্রকেই নির্দিষ্ট করে। কৌশিক সুজাতা সদনে নিজের মতো করে একটা থিয়েটার নিরীক্ষা চালিয়ে যেতে পারছে- একান্ত ভাবেই তার থিয়েটারের জোরে। শওলী- সুমন উত্তম মঞ্চে বা শাঁওলী রাণীকুঠির অরবিন্দ মঞ্চে বা হাওড়া নাট্যসমবায় হাওড়ার রামগোপাল মঞ্চে থিয়েটার স্পেসের সেই থিয়েটারি পরীক্ষা করতে পারল না বলেই বোধহয় সেগুলি তেমন জমাট বাঁধল না। ঢাকায় মহিলা সমিতিতে প্রাচ্য দেখার অভিজ্ঞতায়, সম্প্রতি সরলা মোমোরিয়ালে টোটাল থিয়েটারের ব্যাস-এর অভিনয়ে দেখেছি থিয়েটার স্পেসের পরীক্ষা হয়েছে, কিন্তু অভিনয়ের গুণগত অবনমন হেতু সেই পরীক্ষা সফল হয় নি। অথচ মনীশ রায়টে, গৌতম সোজন বাদিয়া-য়, সুমন মেফিস্টো ও তিস্তাপারের বৃত্তান্তে, কৌশিক প্রাচ্য ও ভালো রাক্ষসের গল্প-তে বাঁধা মঞ্চকে ভেঙ্গে ত্রিমাত্রিক মঞ্চমায়াকে অতিক্রম করে থিয়েটার স্পেসের এক অনাস্বাদিত পরীক্ষা বাস্তাবায়িত করে নাট্যের নান্দনিকতাকে এক অন্যমাত্রা দিয়েছে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের উদ্যোগে মার্কোপোলোর জার্নি দেখতে গিয়ে টলি ক্লাবে মাইল পাঁচেক কাদা জলে ঘুরে ঘুরে নাটক দেখতে গিয়ে তাপস সেন প্রায় জীবন দিতে বসেছিলেন। পরে তাপস সেন বলেছিলেন, নাটকের জন্য মরলে আক্ষেপ থাকত না, কিন্তু নাটকের নামে কখনও গাছে, কখনও বাঁশ বনে, কখনও বালি মাটিতে নিছক শরীর প্রদর্শন ও অঙ্গসঞ্চালন দেখতে গিয়ে মরলে আক্ষেপের শেষ থাকত না। দেশ-কাল-সময়-সমাজ-সংস্কৃতি ভেদে থিয়েটারের চরিত্র পালটায়। থিয়েটার ওপেন স্পেসে না প্রসেনিয়ামে না অঙ্গন মঞ্চে কোথায় হবে, কীভাবে হবে তার অনেকটাই নির্ভর করে অর্থনীতি ও সমাজনীতির পারস্পরিক সম্পর্কের উপর। টিম সুপলের নির্দেশনায় ব্রিটিশ কাউন্সিল ও হাচের আর্থিক সামাজিক বদান্যতায় টলিক্লাবের মুক্তময়দান মঞ্চে হিন্দি, মারাঠি, ইংরেজি, বাংলা, ওড়িয়া, সিংহলিজ, মালয়ালম এই সপ্ত ভাষা সমন্বিত মিডসামার নাই টড্রিম-এ যে থিয়েটার স্পেক্টাকেল দেখা গেল তার অনেক কিছুই বাংলা থিয়েটার চর্চায় ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু আর্থিক সামর্থের অভাব হেতুই সেগুলি ততটা চমক সৃষ্টি করতে পারে নি।
মঞ্চ নাটকেই আমি বেশি দক্ষ, মঞ্চমায়ার ত্রিমাত্রিক স্পেস-এ আমার মনে হয় এরিয়েল স্পেস-কে আমরা কখনই খুব একটা ব্যবহার করিনি; তবে প্রশ্ন হল উচ্চতলের এই স্পেস নাট্য-নন্দনতত্ত্বের প্রয়োজন হেতু ব্যবহার করতে হবে। কোনো কার্যকারণ হেতু ছাড়া স্পেস এর ব্যবহার একান্তই অনাটকীয়। মনে পড়ে যায় মেফিস্টো নাটকের শেষদিকে সুমন গৌতমকে দর্শকের মাঝে নামিয়ে দিয়েছেন, বিশাল ল্যাডার/মই-এর উপরে পেছন দিয়ে উঠে যাচ্ছে ফ্যাসিশক্তির প্রতিভূ হিসেবে সুপ্রিয়, তখন মঞ্চের অবতল ও উপরিতলের স্পেস ব্যবহারে চমকিত হতে হয়, কিন্তু ওই নাটকেই দর্শক ডানের লাইটের পার্চ থেকে সুজন কেন যে লাফিয়ে নামে (এবং, যেহেতু শরীরের ভারসাম্য রাখতে অনেক কসরত করতে হয়) তার কোনো থিয়েট্রিক্যাল লজিক খুঁজে পাওয়া যায় না। বহরমপুর ঋত্বিকের ব্যাস ও মেঘবর্তী নাটক দুটিতে প্রসেনিয়াম মঞ্চের স্পেসকে নানাভাবে নাট্য-নন্দনতত্ত্ব মেনে সুন্দর ভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। ‘বিভাস চক্রবর্তী আজ কাল পরশু নামে একটা ছোটো নাটকে বিশাল মাপের কিছু তীরচিহ্ন ব্যবহার করে প্রসেনিয়াম স্পেসের এক নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। ‘অস্তরাগ নাটকে সঞ্চয়ন ঘোষের সহায়তায় ভিনাইলের ফটোফ্রেম-এর মধ্যে দিয়ে ত্রিমাত্রিক মঞ্চ মায়ার এক অদ্ভুত স্পেস তৈরি হয়। আপ সেন্টারে একটু উঁচু (সমতলের তুলনায়) একজিট্ সেট তৈরি করে মঞ্চের স্পেসটাকে একটু অন্যরকম ভাবে দেখার যে পরীক্ষা করা হয়েছে তা দর্শকানুকূল্যের কারণেই সার্থক রূপ পেয়েছে, থিয়েটারের লজিক বাদ দিয়ে থিয়েটার স্পেসকে ব্যবহার করার চিন্তা একান্তই বাতুলতা। আর্থিক দীনতা, সামাজিক এলিট গোষ্ঠীর শীতল মনোভাব, মিডিয়ার আনুকূল্যহীনতা প্রভৃতি নিয়েও বাংলা প্রসিনিয়াম থিয়েটার যেভাবে স্পেসকে ব্যবহার করতে চাইছে তা একান্তই শ্লাঘার। জগন্নাথ-এর শেষ দৃশ্যে- ফাঁসির মঞ্চে উঠতে উঠতে (এরিয়েল স্পেস্ ব্যবহার) অরুণ মুখোপাধ্যায় যখন ঈষৎ ঘাড় বেঁকিয়ে বলেন “তোমরা পাশে থাকলে (বিপ্লবীরা) আমিও পারতাম, নন্দ পারবে অন্যের ছেলের বাপ হতে-হুঁ;”- তখন বুঝতে পারি এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাসে আমাদের বুকের ভেজা বারুদে কেউ বুঝিবা দেশলাই জ্বালিয়ে দিয়েছে। ভালো করে ঠিক থিয়েটার করতে পারলেও থিয়েটার স্পেসকেও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ব্যবহার করা যাবেই যাবে।
কলকাতার গালগপ্পোর একাদশ পর্ব লিখলেন - কিশলয় জানা
ঘাটের কথা,১১ পর্ব
কিশলয় জানা
সেকেলে কলকাতার পূজাপার্বণ
সদ্য বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব শেষ হয়েছে। আকাশে-বাতাসে এবং আমাদের মনের মধ্যে এখনও তার রেশ রয়ে গেছে। কারুর মনে পুজো শেষ হয়ে যাওয়ার দুঃখ তো কারুর মনে যাক্ বাবা বাঁচা গেছে—এই দুই ভাব বৈষ্ণব ও শাক্তের দ্বন্দ্বের মতো ঘোরাফেরা করছে এবং সমন্বয়ের পথ খুঁজছে। এমন অবস্থায় সেকেলে কলকাতার পূজাপার্বণ নিয়ে দু’চার কথা বললে আশা করি উভয় দল রাগ করবেন না। আর আমি বরং দুর্গাপূজার কথা কম বলব এখানে, কারণ, সে-সব কথা যত্রতত্র, নির্বিচারে বহুবার বহুজন বলেছেন, আমি আর ক্ষুদ্র মুষিক হয়ে কেন সেই রাজপথে ঢুকবো ? তার উপর কলকাতার কথার ভগীরথ হুতোমের পর ওই ব্যাপারে আর-কিছু বলা মানেই বাহুল্য। নেহাত বাঙালি হয়ে দুর্গাস্মরণ না করে সেকালের উৎসবের কথা পাড়লে সুধীজন রাগ করতে পারেন, সে-কারণে এই পর্বে অতি সংক্ষেপে দুগ্গা দুগ্গা করে পরের পর্বে আমরা চলে যাব অন্যান্য উৎসবের প্রসঙ্গে।
আজ যেখানে অলিতে-গলিতে বারোয়ারি দুর্গাপূজা হয়, করের টাকায় অনুদান পাওয়ার পর যার সংখ্যা প্রতি বছর ক্রমে বেড়েই চলেছে, সেকালে তেমন না হলেও খাস কলকাতায় পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল দুর্গাপূজার সংখ্যা। প্রথম দিকে কলকাতার ‘হঠাৎ নবাব’ গোছের কিছু বাড়িতে পারিবারিক দুর্গাপূজার প্রচলন হয়। নবকৃষ্ণ যেমন পলাশীর যুদ্ধের বছরই প্রথম তাঁর কলকাতার বাড়িতে দুর্গাদালান গড়ে দুর্গাপূজা শুরু করেন। সমসাময়িক আরও অনেক ভুঁইফোড় বাবুরাই একইভাবে দুর্গাপূজার সূচনা ঘটান। এই পারিবারিক পূজাগুলি নিজেদের মধ্যে রেষারেষি করে এ-ওকে টেক্কা দিতে চেষ্টা করায় নানা সময়ে নানা কাণ্ড ঘটত। নবকৃষ্ণের পূজায় লাট-বড়লাট অনেকেই আসতেন। উভয়মুখী কৃতজ্ঞতা স্বীকার আর কী ! তা দেখে চুঁচুড়াড় হঠাৎ-নবাব প্রাণকৃষ্ণ হালদারের সেই ঐতিহাসিক দুর্গাপূজার সূত্রপাত, ১৮২৫ সালে প্রথমবার, দু’ বছরের মাথায় ‘ক্যালকাটা গেজেটে’ দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে দু’দিন ধরে “গ্র্যান্ড নচেসে”র রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে কলকাতার বাবু-মহলে রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দেওয়া। এই নাচের আসরে সবাই স্বাগত, প্রাণকৃষ্ণ বাবু যাঁদের চেনেন এবং যাঁদের চেনেন না—সক্কলে। ছিল ‘টিফিন’ এবং রাজকীয় ‘ডিনারে’র ব্যবস্থা। খাদ্যের সঙ্গে ছিল ঢালাও বিলিতি মদের ব্যবস্থা। সেদিন কলকাতা থেকে অনেক সাহেব-মেমরাও স্বভাবতই চুঁচুড়ামুখী। কয়েকবছর, মাত্র কয়েকবছর প্রাণকৃষ্ণের এই জ্বলে ওঠা। তারপর ১৮২৯-এ জানা গেল, নোট জাল করেই প্রাণকৃষ্ণের এই বাবুয়ানি। ‘ক্যালকাটা গেজেট’ জানায় মিথ্যা কোম্পানির কাগজ দিয়ে নানা জনের কাছ থেকে পঞ্চাশ-ষাট লক্ষ টাকা ধার করে এই খানাপিনার ব্যবস্থা, এই বিপুল বৈভব। জালিয়াতির অপরাধে প্রাণকৃষ্ণ সাত বছরের জন্য দ্বীপান্তরে গেলেন। তাঁর চুঁচুড়ার পাঁচখানা বাড়ি সমেত সমস্ত সম্পত্তি, খাস কলকাতায় আটখানা বাড়ি, চন্দনগরের বিশাল বাগানবাড়ি সব নিলামে তুলেও দেনা মেটাতে পারেননি বাড়ির লোকেরা। অনান্য জেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সম্পত্তিও আস্তে আস্তে নিলামে উঠতে থাকে। পাঠক আজকের দিনের আজকের দিনের কারুর কারুর সঙ্গে মিল পাচ্ছেন কি ? পেলে মনে রাখবেন, প্রাণকৃষ্ণ তাঁদের সকলের আদিপুরুষ। খাস কলকাতায় এত বড় জালিয়াত তাঁর আগে আর কেউ ছিলেন না। যাই হোক, প্রাণকৃষ্ণ ব্যতিক্রম। কলকাতার বড় মানুষদের মধ্যে নববকৃষ্ণের বাড়ির পূজার জাঁকজমক ছিল স্বভাবতই বেশি, তবে বাকি বাবুরাও পিছিয়ে ছিলেন না। যাঁর যত জাঁক, তত প্রচার বেশি। কারণ, কলকাতায় সেদিন দূরদূরান্ত থেকে ভাগ্যসন্ধানী যাদের ভীড়, তাঁদের বেশিরভাগই ছাপোষা মধ্যবিত্ত কিংবা দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী। জাঁক দেখিয়ে তাঁদের হাঁ করিয়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতেহ্। মুখে মুখে বাবুর কীর্তির কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে আর কতক্ষণ ?
অবশ্য উনিশ শতকের গোড়ার দিক থেকেই পারিবারিক দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে এত জাঁকজমক, সেই পূজায় লাট-বে-লাটের যোগদান ও মোচ্ছব নিয়ে সাহেবি সংবাদপত্রগুলি খড়গহস্ত। যদিও তখনও ইংরেজ প্রভুরা দ্বিধাগ্রস্ত, স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে যতদূর সম্ভব সখ্যতা বজায় রেখে চলবার পক্ষপাতী। কিন্তু আসরে নেমে পড়লেন, খ্রিস্টান মিশনারীরা। তাঁরাও ‘জেন্টুদের দুর্গোৎসবে’র নামে কুৎসিত মূর্তিপূজার ঘোর বিরিদ্ধাচরণ করতে লাগলেন। ফলে ১৮১৯-এও কোন কোন পারিবারিক পূজায় যেখানে সরকারের তরফ থেকে তোপধ্বনির অনুমতি দেওয়া হয়, সরকারি ফৌজ শোভাযাত্রায় অংশ নিত, ১৮৪০-এর দশ নম্বর আইনের প্যাঁচ পড়ে সব বন্ধ হয়ে যায়। এই আইনে সরকার স্থানীয়দের যাবতীয় ধর্মাচরণ থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। সরকারী কোন কর্তাব্যক্তি আর স্থানীয়দের ধর্মাচরণের সঙ্গে কোনরকম সংস্রব রাখতে পারবেন না এ-কথা এই আইন মোতাবেক্ সাফ্ জানিয়ে দেওয়া হয়। পারিবারিক পূজাগুলি এই সময় থেকেই জৌলুস হারিয়ে ফেলে। অবশ্য মফস্সলে তখনও পারিবারিক পূজাগুলিই ছিল একমাত্র পূজা। ব্যতিক্রম যে ছিল না এমন নয়, সে-ব্যতিক্রম শুরু হয়েছিল গুপ্তিপাড়া থেকে।
গুপ্তিপাড়া ছিল বারোয়ারি দুর্গাপূজার আঁতুড়ঘর। কলকাতা কিন্তু এ-ব্যাপারে তার অনুগামী। কলকাতায় যখন উনিশ শতকের গোড়ার দিকেই বাবুরা ইতিহাসের পাতায় ঢোকবার তোড়জোর করছেন, তার অনেক আগে থেকেই, সেই ১৮৯০-এর আশেপাশে হুগলীর গুপ্তিপাড়ায় বারোয়ারি দুর্গাপূজা শুরু হয়। বারো জন ব্রাহ্মণ অধ্যক্ষ হিসেবে এই পূজার প্রচলন করেন। গঙ্গার ওপারে শান্তিপুর, এপারে সংস্কৃত-চর্চার জন্য প্রসিদ্ধ গুপ্তিপাড়া। এই অঞ্চলের অনেক পণ্ডিত নবদ্বীপে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেখান থেকেই দুর্গাপূজা দেখে এই পূজা করার ইচ্ছে তাঁদের কারুর কারুর মনে জাগতে পারে। অবশ্য তাঁদের কাছে শুনে স্থানীয় অন্যদের মনেও এই ইচ্ছা হতে পারে। যাই হোক, বারো জন ব্রাহ্মণ অধ্যক্ষ হয়ে এই পূজা করেছিলেন বলে এর নাম বারোয়ারি হয়েছে কি-না তা জানা নেই। যদিও ‘ফ্রেণ্ড অফ ইণ্ডিয়া’ ( মে, ১৮২০ ), যাঁরা এই তথ্য প্রথম জানান, তাঁরা এ-কথাও জানিয়েছেন যে, একটি অ্যাসোসিয়েশন বারো জন অধ্যক্ষকে নির্বাচিত করে পূজার ভার দেয়। সুতরাং বারো জনের সিদ্ধান্ত অর্থেও বারোয়ারি কথাটির উদ্ভব হয়ে থাকতে পারে। আশেপাশের গ্রামগুলিতে এই মর্মে চাঁদা তোলা হয় এবং তা-থেকে প্রথম বছর ৭০০ টাকা পাওয়া যায়। শোনা যায়, আরও অনেক টাকাই উঠেছিল, কিন্তু তা সংগ্রহকারীদের হাত থেকে আর কর্মসমিতির ফাণ্ডে জমা পড়েনি। তবে ‘ফ্রেণ্ড অব ইণ্ডিয়া’র প্রতিবেদনে, দুর্গাপূজার পরিবর্তে জগদ্ধাত্রী পূজা করার কথা বলা হয়েছে। সাত দিন ধরে এই পূজার মোচ্ছব চলেছিল। লোকমুখে এই জগদ্ধাত্রী পূজাই দুর্গাপূজা এবং ৭০০ টাকাই ৭০০০ টাকা হয়ে থাকবে। যাই হোক, এই দৃষ্টান্তে উৎসাহিত হয়ে ক্রমে বারোয়ারি পূজা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং তুলোর বীজের মতো চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। হুতোম জানিয়েছেন, অপর পাড়ের শান্তিপুর গুপ্তিপাড়াকে টেক্কা দিতে পাঁচ লক্ষ টাকার সংস্থান করে যে দুর্গাপূজার সূচনা করে, তা সাত বছর ধরে চলেছিল, প্রতিমার উচ্চতা ছিল ষাট হাত। শেষ বিসর্জনের দিন প্রতিমা কেটে কেটে তবে বিসর্জন করা সম্ভব হয়েছিল। এই দেখে গুপ্তিপাড়ার লোকেরা ‘মা’-র অপঘাত মৃত্যু হয়েছে এই কথা বলে গণেশের গলায় কাছা বেঁধে বহুব্যয়ে ফিরতি এক বারোয়ারি পূজা করেন। চুঁচুড়াতেও বারোয়ারিপূজা এত জনপ্রিয় হয় যে, অনেকগুলি বারোয়ারি পূজা সেখানে হত। এর মধ্যে ধরমপুর দক্ষিণপাড়ার পূজাটি সর্বাধিক প্রাচীন বলে জানা যায় এবং বারোয়ারি এই দুর্গাপূজার জনপ্রিয়তা থেকে গ্রামটির নামই হয়ে যায় মহিষমর্দ্দিনীতলা। বর্তমানে এর স্থায়ী মন্দির আছে। তবে এর পূজার সময়টি ভিন্ন। অরণ্যষষ্ঠী বা জামাইষষ্ঠীর দিন প্রতিমা তৈরি করে দশহরা পর্যন্ত এর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। ফলে এই পূজাটিকে শারদীয়া পূজা বলা যায় না।
কলকাতার প্রথম বারোয়ারি কে করেছিলেন, তা জানা যায় না। তবে সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বাড়ির ছেলেরা পথিকদের কাছ থেকে জোর-জুলুম করে টাকা আদায় করে বেহালায় শারদীয়া পূজা করতেন বলে সেকালের সংবাদপত্র থেকে জানা যায়। হুতোমও সে-কথা জানিয়েছেন তাঁর নক্শায়। এমনকি পালকি করে মহিলারা গেলেও, তাঁদেরকেও ছাড়া হত না। টাকা আদায় করে তবেই যেতে দেওয়া হত। শেষে এই চাঁদা-আদায় এতটাই ভয়-ভীতি এবং উষ্মার সৃষ্টি করে যে, কাগজে কাগজে, বিশেষ করে ‘সমাচার দর্পণে’র মত সাহেবী কাগজে লেখালেখি শুরু হয়। পেটন সাহেব জেনানার ছদ্মবেশে পালকি করে গিয়ে ওই বাড়ির কয়েকটিকে পাকড়াও করে নিয়ে আসেন, সেই থেকে সাবর্ণ চৌধুরীদের বাড়িতে বারোয়ারি পূজার হুজুগ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
খাস কলকাতার বারোয়ারি পূজার আদি পাণ্ডা ছিলেন শিবকৃষ্ণ দাঁ। হুতোম যাঁকে রহস্য করে ‘বীরকৃষ্ণ দাঁ’ বলে জানিয়েছেন। এঁর বাড়ি ছিল জোড়াসাঁকোয়। এঁর কয়লাখনি ছিল, সেইসঙ্গেই বড়বাজারে লোহার ব্যবসা, ইস্ট ইণ্ডিয়া ও ইস্টার্ণ বেঙ্গল রেলওয়ের ঠিকাদারির ব্যবসা ছিল। এঁর চালু করা প্রতিমার সাজসজ্জা হত দেখবার মতো। আসল গয়নায় প্রতিমাকে সাজানো হত। নট-নাট্যকার অমৃতলাল বসু তাঁর স্বাদু স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন, সে-সময় কলকাতায় একটা কথা বলা হত যে, মা এসে সাজসজ্জা পরেন জোড়াসাঁকোয় শিবকৃষ্ণ দাঁ-র বাড়ি, ভোজন করেন কুমারটুলীর অভয়চরণ মিত্রের বাড়ি, আর রাত্রি জেগে নাচ দেখেন স’বাজার অর্থাৎ শোভাবাজার রাজবাড়িতে। অভয়চরণ কলিকাতার প্রথম ব্ল্যাক জমিদার গোবিন্দরাম মিত্রের বংশধর ছিলেন। ইনি ধূমধাম করে কালীপূজাও করতেন। তবে তাঁর ছিল পারিবারিক পূজা, বারোয়ারি নয়। বারোয়ারি পূজায় সেকালে সং বেরুতো। এই সং নিয়ে পাড়ার পাড়ায় রেষারেষি হত বটে, তবে কাঁসারিপাড়ার সং-কে কেউ হারাতে পারেনি আজও।
সে-সময় বারোয়ারি পূজার চাঁদা নিয়ে যেমন জোর-জুলুম চলত, তেমনই কৌশলেও চাঁদা আদায় হয়। হুতোম এই রকম একটি কৌশলের কথা জানিয়েছেন। গল্পটি বানানো হতে পারে, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অপরিসীম। সে-কালে চাঁদা-আদায়কারীরা যে বিলক্ষণ রসবোধসম্পন্ন ছিলেন, এই গল্পটি থেকেই তার প্রমাণ মেলে। হুতোমের অনুনকরণীয় ভাষাতেই বলি— “এক দল বারোইয়ারি পূজোর অধ্যক্ষ সহরের সিংগি বাবুদের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত, সিংগি বাবু সে সময় আফিসে বেরুচ্ছিলেন, অধ্যক্ষরা চার পাঁচ জনে তাঁহাকে ঘিরে ধরে “ধরেছি” “ধরেছি” বলে চেঁচাতে লাগ্লেন। রাস্তায় লোক জনে গ্যালো—সিংগি বাবু অবাক্–ব্যাপারখানা কি ? তখন এক জন অধ্যক্ষ বললেন, “মহাশয় ! আমাদের অমুক জায়গায় বারোইয়ারি পূজোয় মা ভগবতী সিংগির উপর চড়ে কৈলাশ থেকে আস্ছিলেন, পথে সিংগির পা ভেঙে গ্যাছে; সুতরাং, তিনি আর আস্তে পার্চ্চেন না, সেই খানেই রয়েচেন; আমাদের স্বপ্ন দিয়েছেন, যে যদি আর কোন সিংগির জোগাড় কত্তে পার, তা হলেই আমি যেতে পারি। কিন্তু মহাশয় ! আমরা আজ এক মাস নানা স্থানে ঘুরে বেড়াচ্চি, কোথাও আর সিংগির দেখা পেলাম না; আজ ভাগ্যক্রমে আপনার দেখা পেয়েচি, কোন মতে ছেড়ে দোবো না—চলুন ! যাতে মার আসা হয়, তাই তদ্বির কর্বেন।” সিংগি বাবু অধ্যক্ষদের কথা শুনে সন্তুষ্ট হয়ে বারোইয়ারি চাঁদায় বিলক্ষণ দশ টাকা সাহায্য করেন।” এই গল্পটি অবশ্য অন্যত্রও প্রচলিত। কুমুদনাথ মল্লিকের ‘নদীয়া কাহিনী’তে তিনি হেস্টিংসের দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ। কলকাতার সিংগি বাবুটি কে, তা অরুণ নাগ মহাশয়ও সন্ধান দিতে পারেন নি। সেকালে কলকাতার সম্ভ্রান্ত সিংগি বাবুরা কয়েক ঘর ছিলেন। তাঁদের মধ্যে গল্পের সিংগি বাবুর আফিসে যাওয়ার প্রসঙ্গ থেকে অনুমান করা যেতে পারে, ইনি সেই সময়কার ট্রেজারির খাজাঞ্চি প্রাণকৃষ্ণ সিংহ হতে পারেন। প্রাণকৃষ্ণ পাটনার চীফ্ মি. মিডল্টন্ ও স্যার টমাস রামবোল্ডের দেওয়ান শান্তিরাম সিংহের পুত্র ছিলেন। যাই হোক, একালে এমন রসিক চাঁদা-আদায়কারি দুর্লভ। তার উপর যবে থেকে রাজনীতির কারবারিরা দুগ্গা পুজোয় অধ্যক্ষ-সভাপতি-জুড়িদার ইত্যাদি হতে শুরু করেছেন, রস নেহাতই বধ হয়ে চলেছে।
যাত্রাভিনয়ের উপভোক্তাদের গল্প শোনালেন- তরুণকুমার দে
যাত্রাভিনয়ের উপভোক্তা তথা শ্রোতা বা দর্শক,২য় পর্ব
তরুণকুমার দে
ব্রজেন্দ্রকুমারের প্রয়াণের আড়াই বছর আগে ১৯৭৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার যাত্রা উৎসব তথা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন। নট্য কোম্পানি যাত্রাপার্টির প্রযোজনা ‘নটী বিনোদিনী’ প্রথম পুরষ্কার পেয়েছিল। এরপরেই নট্য কোম্পানির প্রতি যাত্রাভিনয়ের অর্থমূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রথম দিকে সাধারণ আয়োজকদের আয়ত্তের মধ্যে থাকলেও, পরে তা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছিল। পাশাপাশি অন্যান্য দলেরও প্রতি অভিনয় পিছু অর্থমূল্য দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল। দুটি প্রত্যক্ষ ফল হয়েছিল:
ক) Free যাত্রাভিনয়ের সংখ্যা ক্রমশই কমছিল;
এবং
খ) যাত্রাভিনয়ের প্রবেশমূল্য (তথাকথিত চ্যারিটি শোয়ের ক্ষেত্রে) যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল।
এইসময়ে তিনি বলতেন: ‘যাত্রাভিনয়ের আসরে উপস্থিত হওয়া অদূর ভবিষ্যতে হয়তো দরিদ্রের প্রায় অধরা বিষয়ে পরিণত হবে।’
‘নটী বিনোদিনী’র বছরের নট্য কোম্পানি যাত্রাপার্টি বজেন্দ্রকুমারের ‘পাহাড়ের চোখে জল’ প্রযোজনা করেছিলেন। কিন্তু আগের মরশুমের ‘আঁধারের মুশাফির’-এর পরের মরশুমেও চাহিদা ছিল। আর সেই মরশুমে তো অধিকাংশ জায়গাতেই ‘নটী বিনোদিনী’-রই আমন্ত্রণ হতো। ফলে ‘পাহাড়ের চোখে জল’ খুব অল্পরাত্রিই পরিবেশিত হয়েছিল। পালানাটকটি আমতাবাসীদের বিশেষ অনুরোধে ব্রজেন্দ্রকুমার রচনা করেছিলেন। কিন্তু তিনি নিজেও আমতাবাসীদের মতোই ওই পালানাটকের অভিনয় দেখবার সুযোগ পাননি। উদ্ধৃত পালার ভূমিকায় তিনি বলেই ফেলেছিলেন: ‘যাঁদের জন্য লেখা, তাঁদের সাথে আসরে বসে নট্য কোম্পানির অভিনয় দেখব বলে আশা করে বসেছিলাম। তা আর সম্ভব হয়নি। কারণ, নট্য কোম্পানির দর তখন সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে।‘
১৯৭৫-য়ে তাঁরই বাসস্থান থেকে হাঁটাপথে কুড়ি-পঁচিশ মিনিটের দূরত্বে ‘নটী বিনোদিনী’ অভিনয় করেছিলেন নট্য কোম্পানি যাত্রাপার্টি। আয়োজকেরা ব্রজেন্দ্রকুমারকে আমন্ত্রণ জানালেও তিনি যাননি।
প্রকাশ না করলেও আন্দাজ করা যায় যে, সাধারণ মানুষের শিক্ষা এবং প্রমোদমাধ্যম যাত্রা নিম্নবিত্তের কাছে মহার্ঘ্য হওয়াই হয়তো তার বেদনার কারণ ছিল। নিম্নবিত্ত মানুষের সঙ্গচ্যুত হয়ে হয়তো তিনি যাত্রা উপভোগ করতেও চাননি। কারণ তিনি তো নিম্নবিত্ত পরিবারেরই সন্তান ছিলেন।
যাত্রার শ্রোতা/দর্শকদের ব্রজেন্দ্রকুমার কতখানি শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলেন, তাঁর একটি নিদর্শন রাবণবধের কাহিনি নিয়ে রচিত তাঁর দ্বিতীয় পালা নাটক ‘পুরুষোত্তম’-এর ভূমিকাতে আছে। পালানাটকটি প্রভাস অপেরা পার্টিতে সাফল্যের সাথে অভিনীত হবার পরে মুদ্রিত হলে তিনটি সংস্করণ (যাত্রানাটকের ক্ষেত্রে সংস্করণ সাধারণত পুনর্মুদ্রণ সূচকই হয়) নিঃশেষিত হয়েছিল। ব্রজেন্দ্রকুমার ভূমিকা শুরুই করেছিলেন এইভাবে: ‘রামায়ণের কয়েকটি বিশিষ্ট চরিত্র সম্বন্ধে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির অসাধারণ পরিবর্তন ঘটিয়াছে। ত্রিশ বছর আগের যে বিভীষণকে দেখিয়া যাত্রা থিয়েটারের দর্শকেরা ভক্তিভরে অভিনন্দন জানাইত, আজ তাহাকে দেশদ্রোহী বলিয়া সকলেই ঘৃণা করে।… যে রাবণকে আমরা আশৈশব মহাপাপী কামান্ধ রাক্ষস বলিয়া দূর-ছাই করিয়া আসিয়াছিলাম, আজ পরিবর্তিত যুগের নতুন দৃষ্টি দিয়া তাহাকে আমরা অন্যভাবে দেখিতেছি।’
ব্রজেন্দ্রকুমারের বক্তব্যের মধ্যে লক্ষণীয় বিষয়
ক) তিনি ‘আমাদের’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। বৃহত্তর অর্থে ওই শব্দটি যাত্রা শ্রোতা/দর্শকদের শিল্পী-পরিবেশকদের এবং স্বয়ং ব্রজেন্দ্রকুমারকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিল। তিনি ভাবেননি যে, শ্রোতা দর্শকদের থেকে তাঁর বৌদ্ধিক পরিণতি বেশি।
খ) ১৯২৫-য়ে অভিনীত হয়েছিল ‘স্বর্ণলঙ্কা’, যেটি ছিল তাঁর প্রথম অভিনীত যাত্রাপালা। পালাটির পনেরোটি মুদ্রণ হয়েছিল। তা সত্ত্বেও ওই পালাভিনয়ের তিন দশক পরে ব্রজেন্দ্রকুমার রাবণ চরিত্রকে ভিন্ন দৃষ্টিতে বিচার করেছিলেন ‘পুরুষোত্তম’-য়ে। রাবণের যে ত্রুটি ওই পালায় নির্দেশ করেছিলেন, তা বাল্মীকি-অনুসারী: ‘… রাবণ লঙ্কায় প্রতিগমন কালে পথিমধ্যে হৃষ্টচিত্তে রাজর্ষিকন্যা ও দেবদানব-দূহিতা সকল হরণ করিতে লাগিল।’ [১] এই ত্রুটি বাদ দিলে রাবণ ওই পালানাটকে মহীয়ান রূপেই চিত্রিত হয়েছিল। জীবনের শেষ পালানাটকে রাবণ এক আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক রূপেই প্রতিষ্টিত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে তাঁর চিন্তা ‘করুণাসিন্ধু বিদ্যাসাগর’ পালাতে প্রকাশিত হয়েছিল :
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।। ‘রাবণের দশটি মাথা দাওনি তো?
মধুসূদন।। পাগল হয়েছো?… আমার রাবণের একটিমাত্র মাথা, আর সে মাথায় তোমার মতো দশটা মানুষের মেধা।’
রাবণকে তিনি অসাধারণ মেধা এবং প্রভূত মানসিক শক্তি সম্পন্ন রাজনীতিবিদ্রূপেই এনেছিলেন। ১৯২৫-য়ে ‘স্বর্ণলঙ্কা’, ১৯৫৮-তে ‘পুরুষোত্তম’ এবং ১৯৭৬-য়ে ‘পরাজিত মেঘনাদ’ পালানাটকে রাবণ চরিত্রে যে ক্রমবিবর্তন তিনি এনেছিলেন, তার পেছনে ছিল যাত্রামোদী শ্রোতা/দর্শকের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা। ‘পরশমণি’ পালার ভূমিকাতে তো তিনি বলেই ফেলেছিলেন: ‘গত দশ বছরে শ্রোতার মন বিশ বছর আগাইয়া গিয়াছে। ‘যাত্রামোদীদের চিন্তার এই অগ্রগমনে তাঁর আজীবন শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস ছিল।’
(চলবে )
‘ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর’ ফেলুদা জ্বরে বাঙালি আপামর, ব্যাখ্যায় -অজন্তা সিনহা
ওটিটি হলো আজকের অতি জনপ্রিয় বিনোদন প্ল্যাটফর্ম। সবার হাতেই মুঠোফোন। আর স্পর্শ করলেই ওয়েব দুনিয়ার রামধনু রঙ চোখের সামনে। ওয়েব সিরিজ, স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি, তথ্যচিত্র–আয়োজনের শেষ নেই। এই বিভাগে তারই তত্ত্বতালাশ প্রতি মাসে একবার। লিখছেন অজন্তা সিনহা
বছর শেষে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ধামাকা নিয়ে হাজির টিম ফেলুদা
রচনাকাল ১৯৮৭। বাংলার একটি বিখ্যাত পাবলিশিং সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয় এই গল্প। এ বছর সেই গল্পের ৩৭ বছর পূর্তি, অর্থাৎ প্রায় চার দশক সময়। তা হোক, সত্যজিৎ রায় সৃষ্ট প্রদোষ সি মিটার, থুড়ি ফেলুদার জনপ্রিয়তা যে এতটুকু কমেনি, তার প্রমাণ পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের আসন্ন ফেলুদা সিরিজ ‘ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর’ ঘিরে ওয়েব দর্শকের ঘনিয়ে ওঠা আগ্রহ, উন্মাদনা ! ভূস্বর্গ অর্থাৎ কাশ্মীরের পটভূমিতে তৈরি এই সিরিজে ফেলুদা, তোপসে ও জটায়ুর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন যথাক্রমে টোটা রায়চৌধুরী, কল্পন মিত্র এবং অনির্বাণ চক্রবর্তী। বিনোদনপ্রেমী বাঙালি দর্শকের অতি প্রিয়, গোয়েন্দা সাহিত্যের আইকনিক চরিত্র ফেলুদা কাহিনি নিয়ে তৈরি ‘ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর’ ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি সিরিজের দ্বিতীয় সিজনের অংশ। আগামী ২০ ডিসেম্বর হইচই-এ মুক্তি পাবে ‘ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর’।
প্ল্যানচেট, অপরাধবোধ, বিভ্রান্তি, একটি হীরের আংটি, কাশ্মীরের মায়াবী সৌন্দর্য–এমন একাধিক রহস্য ও সেই রহস্যের কেন্দ্রে থাকা ফেলুদা-তোপসে-জটায়ুর তৎপরতায় অপরাধের পর্দা ফাঁস। বলা বাহুল্য, কাশ্মীরের তুষারাবৃত কাশ্মীরের মনোরম প্রেক্ষাপটে ‘ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর’ হতে চলেছে এক জমজমাট অভিজ্ঞতা। কাশ্মীরের পহেলগাঁও, খিলানমার্গ এবং গুলমার্গের অপরূপ ক্যানভাসে হয়েছে সিরিজের শুটিং। সিরিজে অন্যান্য চরিত্রে আছেন রজতাভ দত্ত (সিদ্ধেশ্বর মল্লিক/অবসরপ্রাপ্ত বিচারক), শাওন চক্রবর্তী (বিজয় মল্লিক/সিদ্ধেশ্বরের ছেলে), ঋদ্ধি সেন (সুশান্ত/ বিচারকের সেক্রেটারি) প্রমুখ।
প্রসঙ্গত, ফেলুদার এই নতুন সিরিজ নিয়ে সৃজিত মুখোপাধ্যায় দু’বছর পর দর্শক দরবারে ফিরে এলেন। সৃজিতের কাজের স্টাইল বাংলার মানুষের যথেষ্ট প্রিয়। সেই প্রেক্ষিতেই বলা যায়, টোটা রায়চৌধুরীর ফেলুদা লুক এবং বরফে মোড়া কাশ্মীরের পটভূমি ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। সংবাদ মাধ্যমকে এই সূত্রে সৃজিত জানিয়েছেন, কাস্টিং থেকে শুরু করে শুটিং লোকেশন, সব কিছুই দর্শকদের মুগ্ধ করবে। তিনি আরও বলেছেন, প্রত্যেক অভিনেতা নিজেদের নিংড়ে দিয়েছেন, ফলে, তাঁদের করা চরিত্রগুলো অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। কাশ্মীরের অপরূপ সৌন্দর্যের মাঝে শুটিং করাটা আমাদের সকলের অভিজ্ঞতাকে দারুণ সমৃদ্ধ করেছে। ফেলুদাপ্রেমীদের জন্য এটি একটি দারুণ উপহার হতে চলেছে। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, দর্শক এই সিরিজটিকে কীভাবে গ্রহণ করবেন, সেই বিষয়ে।
সৃজিত ২০২০ সালে প্রথম ফেলুদা সিরিজ ‘ফেলুদা ফেরত’ তৈরি করেছিলেন, যেখানে ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ গল্পটি দর্শকদের প্রভূত প্রশংসা কুড়িয়েছিল। পরবর্তীকালে হইচই প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তিনি আনেন ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’, যার প্রথম গল্প ছিল ‘দার্জিলিং জমজমাট’। সেটিও চূড়ান্ত সফল হয়। ২০২২ সালে ঘোষণা করা হয় যে ফেলুদার পরবর্তী অভিযান হবে ‘ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর’। যদিও এই সিরিজের শুটিং ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু, কিছু কারণে তা বিলম্বিত হয়। অবশেষে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে প্রসারণের জন্য ‘ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর’ রেডি। বছরের শেষে, ছুটির মেজাজে, উৎসব রঙিন পরিবেশে ফেলুদার এই নতুন সিরিজ যে অন্যতম আকর্ষণ হতে চলেছে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।