magazines

৩৫ তম ই-সংস্করণ ।। ৪৫ তম সংখ্যা ।।ফেব্রুয়ারি ২০২৪

৩৫ তম ই-সংস্করণ ।। ৪৫ তম সংখ্যা ।।ফেব্রুয়ারি ২০২৪

ভাণ পত্রিকা


৩৫ তম ই-সংস্করণ ।। ৪৫ তম সংখ্যা ||ফেব্রুয়ারি ২০২৪

সম্পাদক :

সম্পাদনা সহযোগী :​

প্রচ্ছদ :

নক্সা পরিকল্পক :

অন্যান্য কাজে :

ভাণ-এর পক্ষে:

পার্থ হালদার

কর্তৃক

৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬

( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )

৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) bhaan.kolkata@gmail.com ( ই – মেল ) ​

Reg. No : S/2L/28241

সম্পাদকের কথা

।। সম্পাদকের কথা।।

।।ফেব্রুয়ারি  ২০২৪।।

বিদ্যার দেবীর পুজার সহিত ভালোবাসার দিন খানি মিলিয়া গেল। পাঁজি মিলাইল। কিন্তু বিদ্যার সঙ্গে ভালোবাসা মিলিল কি? কিংবা ভালোবাসার সহিত বিদ্যা? বিদ্যার প্রতি ভালোবাসা, ভালোবাসার প্রতি বিদ্যাময় দৃষ্টি– এ সব মিলিল কি?
কিশোরীরা শাড়ি পরিল। কিশোরেরা পাঞ্জাবি হাঁকাইল। চিড়ে মোয়া খিচুড়ি চাটনি— সবাই চাটিয়া পুটিয়া খাইল। পার্কে পার্কে গড়ের মাঠে বনবিতানে প্রেমের কলরোল উঠিল। স্কুলে কলেজে সেল্ফির ঝলকানিতে চরাচর কাঁপিল। এই সুযোগে ইতিউতি প্রেমের গানের আসর বসিল। নতুনেরা নাচিল। নাচিতে নাচিতে মধুর ভবিষ্যত দেখিল। কল্পনায় ঘি দিতে কেহ ভুলিল না। দিনের শেষে কেউ সুখী হইল। কাহারো প্রেম-গীতে তাল-ভঙ্গ হওয়ায় হইল দুঃখী। কাহারও চোখ ভিজিল। কেহ প্রাণপণের চেষ্টায় কষ্টকে অশ্রু হওয়া হইতে আটকাইল। কোথাও দুটি হৃদয়ের সবুজ ক্ষেত নীল দিগন্তে গিয়া মিলিল– তবু কেহ বিদ্যার কথা ভাবিল না। কেবল কাঁচা প্রেমের কথা ভাবিল। কাঁচা মিলনের আবেশে বুঁদ হইয়া রহিল। তবু কেহ কবির কথা ভাবিল না। কালজ্ঞানী কবি সেই কবে লিখিয়াছিলেন— ‘জ্ঞানের বিহনে প্রেম নাই’ …

আমার বয়স বাড়িয়াছে। আমার স্বভাব আর পূর্বের মতো নাই। অন্যেরা কী করিতেছে, কী ভাবিতেছে জানিতে মন চায়। আমি মেট্রোতে চড়িলাম, বাসে চড়িলাম, বর্ধমান গামী লোকাল ট্রেনে চড়িলাম। সরস্বতীর নব্য ভক্তদের, যাহাদের শিক্ষায় দীক্ষা নেওয়া বড়জোর এক দেড় দশক হইয়াছে, উহাদের বিদ্যা প্রীতি দেখিব। উহাদের মনের ভাব জানিব। এমনিতে বসন্ত পঞ্চমীর পিছমোড়া শীতের নব্য বসন্তে, বসন্ত-বাসন্তীদের দেখিতে পুলক হয়। আমিও পুলক-ভাগী হইতে বাহির হইয়াছিলাম। আমি কান পাতিয়া শুনিলাম। চোখ মেলিয়া দেখিলাম। কথা বিনিময় করিবার জন্য যাচিয়া আলাপ জমাইলাম। যাহাতে আমার জ্ঞান জন্মে। যাহাতে আমি বিদ্যার্থীদের মন বুঝিতে পারি। যাহাতে আমি আমার কালের প্রেমানুভবের সহিত এই কালের প্রেমানুভবের একটি তুলনা আঁকিতে পারি। দেখিলাম ইহারা নিজের বিষয়ে সচেতন বটে। কিন্তু দেশের দশের ব্যাপারে নহে। অধিকারে সচেতন, দায়ে সমূহ ফাঁকি। প্রেম যে অন্তরের বিষয় ছিল তাহা হইতে একালের প্রেম অনেকাংশেই কেবল দেখাইবার বিষয়ে রূপান্তরিত হইয়াছে। সকলে ভাবিতেছে, যাহা দেখা যাইতেছে, তাহাই আছে‌। যাহা দেখানো যাইতেছে উহাই আমি। যাহা দেখা যাইতেছে না তাহা লইয়া চিন্তা করা মূর্খতা। অর্থাৎ উহারা বস্তুবাদী মন লইয়াই প্রেমবাগীষ সাজিয়াছে।

আমি সঙ্গীহীন একাকী ভ্রমণ করিতে ছিলাম, জীবন্ত সন্তান সন্ততিদের চলমান চকমকি প্রত্যক্ষ করিয়া ভালো যেমন লাগিল, একটা ঘোরতর চিন্তাও চাপিয়া বসিল। বোধ হইল, আমরা ছোটবেলায় পড়িতাম, বড়বেলায় পড়িতাম কেননা আশা ছিল। দেশ চাহিত যাহাতে আমরা পড়ি। সরকার চাহিতেন যাহাতে আমরা পড়ি। পিতা-মাতা চাহিতেন যাহাতে আমরা পড়িয়া মানুষের মত মানুষ হইতে পারি। বোধ হইল, ইহারা তো বুঝিতে পারিতেছে না, রাষ্ট্র এখন চাহে না যে উহারা শিখে অথবা জানে। কেননা সরকার জানে যাহারা বেশি জানে, তাহারা কম মানে! সরকার চাহিতেছে উহাদের মস্তিষ্কের বিকাশ ততদূর পর্যন্ত হউক, যাহাতে রাষ্ট্রকে ঈশ্বর বলিয়া বোধ হয়। শাজাহা- আরাবুল-বালুদা-পার্থদার অপশাসন চলিতে পারে। ঘৃণার রাজনীতিকে, যাহাতে পবিত্র মনে হয়। ক্ষুধার ইনডেক্সে ১২৫ এ ১১১ স্ট্যান্ড করিয়াও যাহাতে দেশোন্নতির মিথ্যা মদে উহাদের চোখ ঝলসাইয়া যায়। যাহাতে উহারা প্রশ্ন করিতে না শিখে। প্রশ্ন জন্মিলে যাহাতে ভয় পাইতে শিখে। যাহাতে সত্যান্বেষীকে দেশদ্রোহী দাগাইয়া সরকার জেলে পুরিলেও দেশের নামে অপদার্থ দেশ নায়কদের প্রতি গদগদ ভক্তি উহাদের অপরিবর্তিত থাকে! গরিব মধ্যবিত্ত পিতা মাতা ভাবিতেছেন, দেশে হাহাকার পড়িয়াছে। বড়লোক আরো বড়লোক হইতেছে। গরিব যদি যোগ্যতার উপর ভর করিয়া ভবিষ্যত অনুসন্ধান করে, তবে কি সে ‘আদর্শ’ খাইয়া বাঁচিবে? অতএব যে করিয়া হোক চারটি কাজে সন্তানদের জুতিয়া দেওয়াই মঙ্গল। দাদারা ঘুরিতেছে। ছেলেধরারা ঘুরিতেছে। পার্টি দুর্নীতি-ইন্ডাস্ট্রিতে সরস্বতীর ইতর সন্তানদের কাজ দিতেছে, মদ দিতেছে। বাইক বিরিয়ানি উপরি পাওনা- সব দিতেছে। পেটে ক্ষুধা লইয়া তুমি আপিসের চাকুরিতে যে তথ্য ভরিতেছ, তাহা হয়তো মার্কসীটের নম্বর বদলাইয়া দিবার চাকুরি!! দুই নম্বরি, চার নম্বরিতে দেশ ছাইয়া গিয়াছে। গরিবরা গিগ শ্রমিক হইয়া রেপিডো চালাইতেছে, সুইগিতে অলস ধনীর রসনার সারথী বনিতেছে। বিগবাসকেটে মাল বাটিতেছে। নেল পার্লারে, বিউটি পার্লারে, স্পা পার্লারে শোষকের হাত পা মসৃণ করিতেছে, নখে ফুল আঁকিতেছে। ধনীর বাচ্চারা বড় এক্জামিনে পাশ দিয়া নিজেই সরকার বনিয়া যাইতেছে। দেশ শাসন করিতে ভালোবাসা লাগিতেছে না, সহমর্মিতা লাগিতেছে না। দেশটাকে উপলব্ধিতে আনিতে হইতেছে না। দিল্লিতে বসিয়া টাকা খরচ করিয়া কাড়ি কাড়ি পুঁথি মুখস্থ করিলেই চলিতেছে! কনসেপ্ট-এর প্রয়োজন নাই। বোধপরীক্ষণের দরকার নাই। নতুন চিন্তার দরকার নাই । বদলাইবার অভিলাস তো কঠিন দেশদ্রোহীতা। এত রঙবেরঙের কিশোর-কিশোরী যুবক-যুবতী দেখিয়া মনে হইল উহাদের কেহ কি এই সব দরকারি কথা পুষ্পাঞ্জলি কালে সরস্বতী কে জানাইয়াছে?!

স্কুল উঠিয়া যাইতেছে। আর সরস্বতীর প্যাণ্ডলে ডিজে বাজিতেছে। মাতৃভাষা ভুলাইয়া দেওয়ার বন্দোবস্ত সারা হইয়াছে। বাঙালি বগল বাজাইতেছে। মাতৃভাষাকে হীন করা হইতেছে, সে প্রকল্পে আমরা নিজেরাই আত্মঘাতী। প্রকৃত বিজ্ঞানচর্চাকে উৎসাহ দেওয়া হইতেছে না। বিজ্ঞানীর দল গরুর দুগ্ধে স্বর্ণ আবিষ্কর্তা অ্যালকেমিস্ট গেরুয়াজীবদের সঙ্গে আটিয়া উঠিতে না পারিয়া, প্রকৃত বিজ্ঞানচর্চা আর শান্তি লাভের আশায় বিদেশে সংসার পাতিতেছেন। ইতিহাসচর্চার সঙ্গে ধর্মচর্চা ও পুরাণ কল্পনাকে এক মানিয়া ঘোঁট পাকাইতেছে খোদ রাষ্ট্র। ইতিহাস কে মনমতো পলিটিক্যাল করিয়া সেই বিষ গিলাইবার চক্রান্ত করা গিয়াছে। বাজারমুখী সাহিত্য হইতে বাজারটুকুই অবশিষ্ট আছে। সাহিত্যিকের পসার বাড়িলেও সাহিত্য পিছু উঠিতেছে। লুঙ্গি ডান্স মেঘ-মল্লারকে চিরকাল পরাস্ত করে। কিন্তু বর্তমান সমস্যা ঘোরতর। লুঙ্গি, বীণা-তানপুরাকে সহবত শিখাইতেছে। নৃত্য-বাদ্য-গীতাদি উহাদের অর্থে উহাদের উদ্দেশ্যে বাজিতেছে। মঞ্চের ভাড় পর্যন্ত বাজারমুখী হাসাইতেছেন। হাসি না পাইলেও অর্থের লোভে আমার প্রিয় নায়ক অর্থহীন হাসিতেছে। সবই যদি বাজারের জন্য হয়, মানুষের জন্য কি অবশিষ্ট থাকিল? বাজার যে একমাত্র হইয়া উঠিয়া বিদ্যা-বুদ্ধি-সম্পর্ক-সমন্ধ-প্রেম-ভালোবাসার নিয়ন্ত্রক হইয়া বিকট কাণ্ড ঘটাইতেছে ইহা কী সরস্বতী জানেন??

সরস্বতীর ইতর সন্তানের দল কেন্দ্র রাজ্য পরিচালনা করিতেছে। একদল আইনের শাসন তুলিয়া মগেরর মুল্লুক বানাইতেছে। যাহা ইচ্ছা তাহা করিতেছে। অজ্ঞানীরা দাপাইতেছে। অখ্যাতরা খ্যাতি পাইতেছে। অনায়করা নায়ক বিবেচিত হইতেছে। চাটুকারদের দল সর্বত্র আলো করিয়া বিরাজ করিতেছে। অন্য দল আইনকে ইতরতার সঙ্গে ব্যবহার্য করিয়া আইনী মোড়কে ফ্যাসিবাদ আনিতেছে। আইনের পথেই বেআইনি ভাবে লুটিতেছে। গরিবের নামে গরিব, গণতন্ত্রের নামে গণতন্ত্রকে খুন করিতেছে। আইনের পথ ধরিয়া কতদূর বেআইনি, অমানবিক, নিষ্ঠুর কদাকার ও বিকৃত হিংসা ঘৃণা এবং ধর্মোন্মাদনা ছড়ানো যায় ইহার দৃষ্টান্ত উহারা।

হে মা, এমন নরকে ডুবিয়া যাইতে যাইতেও আমরা তোমাকে স্মরণে আনিতেছি না। আমরা বহি খাতা লইয়া বসিতেছি না। আমরা কোন কিছু তলাইয়া ভাবিতেছি না। আমরা ভবিষ্যতের জন্য কিছু রাখিয়া যাইতেছি না। আমরা রিল দেখিতেছি। কাহার বউ কাহার সঙ্গে পালাইল ইহাই আমাদের জীবনে সর্বোচ্চ শিহরণকারী ঘটনা। হে মা সরস্বতী তোমাকে ত্যাগ করিয়া আমরা লক্ষীর হাতও ধরি নাই। আমরা অলক্ষীর হাত ধরিয়াছি। সরস্বতীর পথে যে লক্ষ্মী সেই প্রকৃত লক্ষ্মী। অবিদ্যার হাত ধরিয়াছি, অন্ধকারের হাত ধরিয়াছি। অন্ধকারে বসিয়া আমরা অন্ধকারের গৌরবে মশগুল হইয়া আছি। আলোর গান গাহিতে ভুলিয়া গিয়াছি। তুমি আবার পরের বছর আসিবে। তুমি আবার ভালোবাসার দিন বলিয়া পরিগণিত হইবে। তোমাকে বিদ্যার দেবী বলিয়া আমরা অর্চনা করিব। কিন্তু প্রতিদিন তোমার সঙ্গে সম্বন্ধ না রাখিলে আমরা কোথায় তলাইয়া যাইব তাহা অনুমান করিতে গেলে সন্ত্রস্ত হইয়া উঠি। এই যে কিশো-কিশোরী যুবক-যুবতীদের চোখে স্বপ্ন দেখিতেছি, বক্ষে প্রেম দেখিতেছি— এই স্বপ্ন এই প্রেম কোথায় মিলাইয়া যাইবে। ভবিষ্যতে উহারা ক্রমশ রোবট হইয়া যাইবে। মন মরিয়া যাইবে। প্রাণ মরিয়া যাইবে। কেবল কঙ্কাল বাঁচিবে, কঙ্কালকে প্রাণ বলিয়া প্রতিভাস রচনা করা হইবে। হে মা সরস্বতী। আমরা কবে আর এসব কথা বুঝিব? হে মা কবে আর অলস-ভীত-অসহায়-পরনির্ভর-ঈর্ষাজর্জর জীবনে আগুন দিয়া বিদ্যার ভুবন গড়িব?

যাপিত নাট্য ' এর অষ্টাদশ কিস্তি লিখলেন - কুন্তল মুখোপাধ্যায়

কুন্তল মুখোপাধ্যায়

১৯৭৯ সালের ২৭ নভেম্বর সংলাপ-এর জন্মদিন হলেও সংলাপ-এর রিহার্সাল শুরু হয়েছিল ১৯৮০-র জানুয়ারি থেকে। প্রথম দু-একদিন আমার সেন্টার সিঁথির ফ্ল্যাটে, আর তারপর হেমন্ত, জয়ন্তদের স্টুডিও অঞ্জলি-তে, পদ্মনাভ মিত্র লেন শ্যামবাজার পোস্ট অফিসের ঠিক পেছনে। ওখানেই আমি আর শঙ্করী নিমতলা থেকে কাঠ নিয়ে এসেছিলাম। আর বিজয়, মনি মনুদার ডাইরেকশনে সেট বানিয়েছিল। ওখানেই ভয়েস রেকর্ডিং করতে এসে বিপ্লব চ্যাটার্জী ‘ইস্পাত’ নাটকে স্তালিনের ভয়েস্ দিয়েছিলেন। স্টুডিও অঞ্জলিতে বড় বড় ভারী পর্দা ছিল, ‘ইস্পাত’-এর একটা দৃশ্যে দু’জন পার্টিজানের আড়ালে যাবার কথা, হঠাৎ দেখি দীপঙ্কর আর শান্তি (যার ডাক নাম দাঙ্গা) সেই ভারী পর্দার আড়ালে গিয়ে নিজেদের আড়াল করছে। স্টুডিও অঞ্জলির ব্যস্ততা বাড়ায় আমরা হেদুয়ার পাশে বসন্ত কেবিনের দোতলায় কোনার ঘরটায় রিহার্সাল করতাম। অন্য তিনটে ঘরে শেখর সরকার, বিদ্যুৎ নাগ আর কয়েকটা দল অল্প দিনের জন্য মহড়া দিত। ওখানে মাস ছয় থেকে ১৯৪২-এ আমরা উঠে এলাম শিয়ালদহ কোলে মার্কেটের পেছনে বাণীমন্দির স্কুলের তিন তলায় ৮ বাই ১৪-র ঘরে। ওখানে আমরা ছিলাম ১৯৯৪ অবধি। শিয়ালদহ স্টেশনের কাছে থাকায় আমি, বিতানদা, দেবেশ, বুলা, মেঘু, দীপঙ্কর সবাই কলেজ বা চাকরি থেকে ট্রেনে করে এসে রিহর্সাল দিতাম, আর আমাদের যে বন্ধুরা ডালহৌসি বা কলকাতায় অফিসে চাকরি করত তারাও অফিসের পর রিহার্সাল করে ট্রেনে বাড়ি ফিরত। পরিতোষদা, প্রণবদা, সুপ্রকাশদা কেউ মশাট, রাণাঘাট, হাবড়ায় অফিস করে রিহার্সাল করে আবার একসঙ্গে বাড়ি ফিরতাম। বাণীমন্দিরের স্পেশাল আকর্ষণ ছিল বৃন্দাবন, ওই বাড়ির কেয়ারটেকার। ১৫ বছর বয়সে কলকাতায় এসে এই স্কুলের। দারোয়ানগিরি, পরে কেয়ারটেকার হয়েছিল। আমরা যখন ওকে দেখি তখন ওর প্রায় ৬০ বছর বয়স। কোঁকড়ানো চুল, নেশার গুণে নিমীলিত চোখ আর গাঁজা খাওয়া সিরসিরিংগে চেহারা। আমাকে খুবই ভালোবাসত, কেউ ওর সঙ্গে দুষ্টুমি করলেই বলত কুন্তলবাবুকে বলে দেব। অনেক পুরনো কথা, স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা, আর বানিয়ে বানিয়ে ওর কীর্তি-কলাপের গল্প করত। প্রশ্ন করলে একটা খেনখেনে হাসি উপহার দিত। পুজোর সময় দীপক ইচ্ছে করে ওর জামা-কাপড় দিতে দেরি করত আর ও আমার কাছে নালিশ করত। রোজ রিহার্সালের সময় ও চা এনে দিত আর দামের পরে বাকি পয়সা রেখে দিত। তাছাড়া আমাকে মাঝেমাঝে বৃন্দাবনকে টাকা দিতে হত (অবশ্যই ভালোবাসায়)। বাড়ির মালকিনকে ভাড়া দিতে দীপক রেগুলার দেরি করত আর সেই বৃন্দাবন আমার কাছে নালিশ করত। ওই রিহার্সাল ঘরে কত ঘটনা ঘটেছে। একবার খুব বৃষ্টি, তার মাঝে আমি ভরশিলোভের লেখা রুশ বিপ্লবের ইতিহাস পড়ে চলেছি, শুনছে ৬ জন, তার মধ্যে একজন সীমা ঘোষ (এখনকার সীমা মুখার্জী)। এই ঘরে এসেছেন অনেক গুণী লোক। স্যাস-এর সম্পাদকমন্ডলী বসত পাশের ঘরে, কলেজ ছাত্র ব্রাত্য, রাজা মিত্র, রাজা সেন, এই ঘরে বসে আলোচনা করেছেন। অনেক সুখ-দুঃখের সাক্ষী এই ঘর, দলে নতুন কত ছেলে-মেয়ের আসা যাওয়ার সাক্ষী এই ঘর। অনেক বিলাপ, প্রলাপ ও স্বপ্ন দেখার সাক্ষী এই ছোট্ট ঘরটা। আমাদের অন্তরে এই ঘরটার একটা আলাদা জয়গা আছে। এর পরে যাই মেট্রোপলিটন স্কুলের তিন তলায় (সৌজন্যে চুমপার মা)। ওখানে ১৯৮৮ সাল থেকে ২০১৮ অবধি রিহার্সাল করি। ওখানেও এক কেয়ারটেকার ছিল রাম, বৃন্দাবনের মতো না হলেও রামও একটা চরিত্র ছিল। ‘ঘরে ফেরা’ পরবর্তী সময় থেকে ‘নিরাশ্রয়’ অবধি এখানে ছিলাম। এই জায়গাটা কলকাতার সেন্ট্রালে বলে সবারই সুবিধা হত যাতায়াতের। তবে এখানে অনেক সময় প্রণবদা, পরিতোষদা-র দৌলতে গাড়িতে বাড়ি ফিরতাম, তা না হলে শেয়ারে ট্যাক্সি বা মেট্রো ধরতাম। স্কুল বা কলেজ বিল্ডিংয়ের যে প্রভাব ছাত্রছাত্রীদের উপর পরে আমার মনে হয় রিহার্সাল বাড়িরও সেইরকম প্রভাব থাকে নাট্যদল ও নাট্যকর্মীদের মধ্যে।
আমরা ইছাপুরে কত ক্যাম্প করেছি, বাগবাজার রিডিং লাইব্রেরি, তৃপ্তি মিত্র সভাঘর, যুব কেন্দ্র, মধুসূদন মঞ্চের বেসমেন্টে প্রচুর রিহার্সাল করেছি। কিন্তু সংলাপ-এর রিহার্সাল বললেই ভেসে ওঠে বাণী মন্দির আর বৃন্দাবন, মেট্রোপলিটন আর রামের চেহারা। তারকদের ছাদে, যোধপুর পার্কে, পদ্মপুকুরের পাশে কত মহড়া হয়েছে, তবু এখনও ওই দুই মানুষকে ভুলতে পারি না। এখন এসেছি দমদম কিশোর ভারতীর হলঘরে, মনে হয় আর স্থান ত্যাগ হবে না।

                                          (চলবে )

শ্রীলা মজুমদারকে স্মরণ করে কলম ধরলেন - নীল আকাশ

 

কৃষ্ণবর্ণের চাবুক হরিণী

 নীল আকাশ

১.
প্রত্যেক শিল্পী তাঁর সাম্রাজ্য গড়ে তোলে নিজস্ব আবিষ্কার দিয়ে। মৃণাল সেনের সাম্রাজ্যে শ্রীলা মজুমদার তেমনই এক আবিষ্কৃত উপদ্বীপ। যদিও ছেলেবেলা থেকে রেডিওর নানা বিজ্ঞাপনে, সার্কাসের বিজ্ঞাপনে, আবৃত্তিতে নিজের কণ্ঠ দিয়ে বিশেষ পরিচিতি গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু চলচ্চিত্রে এক উপদ্বীপের মতন তাঁকে আবিষ্কার করা হয়। এই আবিষ্কারে মৃণাল সেন তার সবটুকু শেকড় ছড়িয়ে দিলেও শ্রীলা নিজেকে ফাটিয়ে চৌচির করে নতুন আকার নিয়েছে। ভারতীয় চলচ্চিত্র পেয়েছে এক কৃষ্ণবর্ণের চাবুক হরিণীকে। সেখানে আপনামাংসে আপনি বৈরী নয় সে বরং তার সাবলীল অভিনয়, তীক্ষ্ণ উচ্চারণ, ঋজুকণ্ঠ তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে মননশীল দর্শকের আঙিনায়।

ঋতুপর্ণের ‘চোখের বালি’র বিনোদিনী অসম্পূর্ণ থাকতো শ্রীলার কণ্ঠ ছাড়া। ঐশ্বর্য্য রায়-এর লাবণ্যকে, বিনোদিনীর বৈধব্যকে শ্রীলা তার কণ্ঠে ধারণ করে ভারতীয় চলচ্চিত্রে নীলকন্ঠ হয়ে উঠেছেন। যিনি তাঁর কণ্ঠ দিয়ে দুঃখ এঁকেছেন, সুখও। ‘একদিন প্রতিদিন’-এ যখন বাড়ির বড়ো মেয়ে রাতভোর হয়ে গেলেও বাড়ি ফেরে না তখন মিনু ওরফে শ্রীলার মনোলগ আমাদের চমকে দেয়– ‘এতদিন আমরা দিদির কথা ভাবিনি। এতদিন আমরা স্বার্থপরের মতো চলেছি।‘ সংসারের দায়িত্বে ন্যুব্জ হয়ে যাওয়া এক নারীর কথাও যে ভাবতে হয়, তারও যে আলাদা করে চাওয়া-পাওয়া থাকে শ্রীলার মনোলগ যেন সেই নারীবাদী স্বরের অনুরণন। আর এখানেই ‘মেঘে ঢাকা তারা’র থেকে ছবিটি আলাদা হয়ে যায়। ওখানে নীতার বাঁচতে চাওয়ার চিৎকার নীতাকেই করতে হয়েছিল। আর ‘একদিন প্রতিদিন’এ একইভাবে দায়িত্ব নেওয়া বড়ো মেয়েটির পাশে দাঁড়ায় তার বোন। সেখানেই তারা কমরেড হয়ে যায়, দুই নারীর হাতে উঠে আসে প্রতিবাদের তরবারী। এরপর যে দীর্ঘ মনোলগে নারীজন্মের হতাশা তুলে ধরে চরিত্রটি সেখানে এক মুহুর্তে খসে পড়ে নিম্নবৃত্ত পরিবারটির মর্যাদার সমস্ত পলেস্তারা।

২.
শ্রীলা মজুমদারকে প্রথম যে ছবিতে দেখেছিলাম সেই ছবিটি ‘আকালের সন্ধানে’। এই ছবিতেই প্রথম দেখেছিলাম সিনেমার ভিতরে সিনেমার চলন। এই ছবিতেই প্রথম দেখেছিলাম চরিত্ররা কোনো ভেক ধরেনি। তাঁদের নামও প্রায় অপরিবর্তিত। ছবির ভেতরের ছবিতে দেখা যায় স্মিতা পাতিল যখন চাল সংগ্রহ করে নিয়ে আসে আর তার স্বামী সেই চাল কোথা থেকে পেল জানতে চায় এবং শেষমেশ নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রন করতে না পেরে কোলের শিশুকে আছাড় মারতে যায় তখন শ্রীলার চিৎকার আমার সম্বিৎ ফেরায়। ধাক্কা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে যায় সিনেমার জোর কতখানি। শ্রীলা মজুমদারকে বহুদিন আমি ওই চিৎকার দিয়ে মনে রেখেছি। সমগ্র ছবি জুড়ে ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে সে ঘুরে বেরিয়েছে। সমগ্র ছবি জুড়ে নির্বাক হয়ে দেখেছে শহরের বাবুদের সিনেমা করতে আসা। এতোটা নির্বাক, জোরালো ছাপ ফেলে যাওয়া চরিত্র ভারতীয় চলচ্চিত্রে খুব কম এসেছে।

৩.
‘একদিন প্রতিদিন’ দেখে শ্যাম বেনেগাল শ্রীলা মজুমদার ‘আরোহণ’ ছবিতে কাস্ট করেন। এছাড়া শ্যামের আরও একটি উল্লেখযোগ্য ছবি ‘মান্ডি’ তেও শ্রীলা মজুমদার অভিনয় করেছিলেন। ‘আরোহন’-এ বর্গাদার চাষি হরিমলের বোন প্রাচীর চরিত্রে শ্রীলার অভিনয় সমালোচকদের নজর কেড়েছিল। এক গ্রাম্য নারী থেকে কলকাতায় এক মধ্যবয়সী লোকের রক্ষিতা এবং শেষমেশ চরিত্রটির উন্মাদ হয়ে যাওয়া– এই তিনটি পর্যায়ে যেভাবে রূপান্তর ঘটেছে তা অনায়াসেই সমালোচকদের প্রশংসা এবং সিনেপ্রেমীদের দরদ কুড়িয়ে নিয়েছিল। আবার ‘মান্ডি’তে এক বোবা মেয়ের পাচার হবার চরিত্রে শ্রীলা মজুমদার স্বল্প পরিসরে তাঁর সিগনেচার দিয়ে যান। উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর ‘চোখ’-এও শ্রীলার কাজ প্রসংশিত হয়। অঞ্জন দত্তকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে শ্রীলা জানায়, এক বাস কন্ডাকটর তাকে বাসে দেখে বলে ‘চোখ’ সিনেমায় সে শ্রীলাকে দেখেছে। একজন শিল্পীর এই মামুলীকথা মনে রেখে দেওয়া আসলেই প্রমান করে স্টারডমের কোনো মরীচিকা তাকে বিভ্রান্ত করেনি। ‘সমান্তরাল’ ছবিতে কাজ করলেও ওঁ পৌঁছতে চেয়েছিল সাধারণ মানুষের আঙিনায়। তবে ওঁর শেষ কাজ কৌশিক গাঙ্গুলির ‘পালান’। ছবিটি ব্যক্তিগত ভাবে আমার বিশেষ পছন্দের। ছবিটি দেখতে দেখতে মনে হয়েছে কৌশিক গাঙ্গুলি একই সঙ্গে মৃণাল সেন এবং রমাপদ চৌধুরীকে ট্রিবিউট দিয়েছেন। কিন্তু শ্রীলা মজুমদারের অকাল মৃত্যু নিয়ে এই লেখা লেখবার সময়ে মনে হচ্ছে সেই সারিতে শ্রীলা মজুমদারও জুড়ে গেলেন। একচল্লিশ বছরের ব্যবধানে দুটি ছবি তৈরি হল এবং সেই ছবিটি শ্রীলা মজুমদারের শেষ ছবিও বটে। কি আশ্চর্য সমাপতন! শেষ ছবিতেও মিশে রইল মৃনালীয় আমেজ, ‘খারিজ’-এর নস্টালজিয়া।

 

ক্যান্সারের কামড় শ্রীলা মজুমদারকে কেড়ে নিল এই কর্কশ সত্যি মানতে ইচ্ছে করে না আমার বরং বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় প্রবল উষ্ণায়নের দাপটে একটি দ্বীপ ডুবে গেল কেবলমাত্র। সেই ডুবে যাওয়া দ্বীপটি কোনো এক ডুবসাঁতার দিয়ে উঠবে তাঁকে আবিষ্কার করা মানুষটির কাছে। হয়তো পা দুলিয়ে দুলিয়ে সিনেমা পাড়ার গল্প করবে কিম্বা পাঠ করবে কোনো আধুনিক কবিতা।

কলকাতার গালগপ্পো'র চতুর্থ পর্ব লিখলেন - কিশলয় জানা

আবারো কালীঘাটের কলকাতা

কিশলয় জানা 

আগের পর্বে কালীঘাটের কালী নিয়ে কিছু কথা বলা গেছে। বলাই বাহুল্য, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, এই নাদান পাপী নিতান্ত ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে কলকাতার সূত্রে কালীঘাট ঘুরে বেড়ানোর দুঃসাহস দেখিয়েছে। ধার্মিক পাঠকেরা মার্জনা করবেন, এই পর্বে আবার একবার কলকাতার সূত্রে কালীঘাটের কথা পাড়ার জন্য। আগের পর্বে আমরা দেখেছিলাম, কালীঘাটের কালীর স্বরূপ-পরিচয় নিয়ে নানা মুনির নানা মত, সেই মতে নতুন সংযোজন হচ্ছে, সাম্প্রতিককালের একটি অনুমান। সেই অনুমান অনুযায়ী, কালীঘাটের কালী আসলে যশোরের প্রখ্যাত যশোরেশ্বরী কালী। সাধারণ ইতিহাস বলে, বারোভুঁইয়া-খ্যাত প্রতাপাদিত্যের পিতা বিক্রমাদিত্য বৃদ্ধাবস্থায় উপলব্ধি করেছিলেন যে, তিনি চোখ বুঝলেই সম্পত্তি ও রাজ্যশাসনের অধিকার নিয়ে তাঁর কনিষ্ঠ অর্থাৎ প্রতাপাদিত্যের খুড়ো বসন্ত রায় এবং প্রতাপাদিত্যের মধ্যে বিরোধ অনিবার্য। অতএব বুদ্ধি করে তিনি তাঁর সম্পত্তি দশ আনা-ছয় আনা ভাগ করে প্রতাপকে দশ আনা এবং বসন্ত রায়কে বনগাঁ বাদ দিয়ে গোটা চব্বিশ পরগণার অধিকার প্রদান করেন। কিন্তু নানা কারণে এলাকা দখল নিয়ে দুজনের বিবাদ শত্রুতায় পরিণত হতে দেরি হয় নি এবং বিশেষ অবকাশে প্রতাপ বসন্ত রায়কে হত্যা করেন। কিন্তু নতুন গপ্পো অনুযায়ী, বিক্রমাদিত্যের বৃদ্ধাবস্থায় বসন্ত রায় যশরে যশোরেশ্বরী কালীর প্রতিষ্ঠা করেন এবং পাশেই গোবিন্দের মন্দির গড়ে দেন। কালীর সেবাপূজার ভার দেন তরুণ ভুবনেশ্বর ব্রহ্মচারীর উপরে। প্রতাপ এবং তাঁর মধ্যে সম্পত্তি ভাগাভাগি হয়ে গেলে বসন্ত রায় যশোরেশ্বরী কালীকে নিয়ে চলে আসেন বেহুলা তথা আজকের বেহালায়। প্রতাপ সিংহবাহিনী অষ্টভূজা নতুন যশোরেশ্বরী দেবীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। বসন্ত রায় নাম পরিবর্তন করে আদি বিগ্রহকে দক্ষিণাকালী নাম দিয়ে পূজা করতে থাকেন। ভুবনেশ্বর ব্রহ্মচারীই তাঁর সেবায়েত ছিলেন। গোবিন্দজীর মূর্তি মুরলীধর নামে পূজিত হতে লাগলেন। অর্থাৎ মানসিংহ আদি যশোরেশ্বরীকে নিয়ে যেতে পারেন নি। পরে পরে জমিদার লক্ষ্মীকান্ত রায়ের দ্বিতীয় পুত্র গৌরী মজুমদার জমিদারির দায়িত্ব নিলে দক্ষিণা কালীকে তিনি স্বীয় মন্দিরে নিয়ে আসেন এবং গঙ্গার ধারে বর্তমান দক্ষিণেশ্বরের কাছাকাছি কোন জায়গায় মূর্তি পূজিত হতে থাকেন। এ সময় সেবায়েত ভুবনেশ্বরকে সাহায্য করতেন তাঁর জামাতা রামচন্দ্র চক্রবর্তী। হরিহর শেঠ তাঁর ‘প্রাচীন কলিকাতা পরিচয়’ বইতে ভুবনেশ্বরকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগের লোক বলে মনে করেছেন। মানসিংহ-প্রতাপাদিত্য ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত ভুবনেশ্বর এবং কালীঘাট মন্দিরের সেবায়েত ভুবনেশ্বর এক বয়কটই হলে মন্দিরের প্রাচীনত্ব আরো কিছুটা বাড়ে সন্দেহ নেই। তবে সবই অনুমান-প্রমাণের ধোঁয়াশায় ঢাকা। সেই সত্য যা রচিবেন আপনি! ভুবনেশ্বর পরলোকগমন করলে সেবাপূজার সুবিধার জন্য দক্ষিণেশ্বরী এবং মুরলীধরকে কলকাতা কাছারি বাড়ির উত্তরে নির্মিত সুদৃশ্য মন্দিরে নিয়ে আসা হয়। রামচন্দ্র ছিলেন নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব, তান্ত্রিক শাক্ত নয়। একটি মত এই যে, তাঁর আমলে দোলের সময় উক্ত দীঘির জল ফাগের রঙে লাল হয়ে যেত বলে দীঘিটি ক্রমে লালদীঘি বলে খ্যাতি অর্জন করে। পরে ইংরেজরা এই দীঘির সংস্কার করে এর নাম রাখেন ‘গ্রেট ট্যাঙ্ক’, পরে নাম বদলে তা হয় ‘ডালহৌসী স্কোয়্যার’।
যাই হোক, দেবী অবশ্য এখানেও বেশিদিন থাকেন নি, কেশব রায় বড়িষায় তাঁর জমিদারি এলাকার সীমার মধ্যে দেবীমূর্তি ও মুরলীধরকে আনবার ব্যবস্থা করেন এবং এই সূত্রে গোবিন্দপুরের দক্ষিণে গঙ্গাতীরে বর্তমান বলরাম বসুর ঘাটের কাছে ছোট মন্দির নির্মাণ করে কালীমূর্তি স্থাপন করেন, যা ভবানী নামে পরিচিত হতে থাকে। এর থেকেই ভবানীপুর অঞ্চলের নামকরণ হয় বলে কারুর কারুর অনুমান। বর্তমান মন্দিরটি কেশব রায়ের দেওয়া জমিতে সাবর্ণ চৌধুরীর অনুরোধে তাঁর বন্ধু ফতে চাঁদ জগৎশেঠের দেওয়া অর্থে নির্মিত হয় অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে। পরে এই স্থান কালীঘাট নামে পরিচিত হতে থাকে।
লক্ষণীয় এই গপ্পোকে বিশ্বাস করলে কিন্তু কালীঘাটের আর সতীপীঠের কোন মহিমা থাকে না বা ওই সম্পর্কিত বিশ্বাসও ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। তাছাড়া যে বসন্ত রায় পূর্ববঙ্গেই প্রতাপের হাতে নিহত হন, তিনি যশোরেশ্বরী কালী ও গোবিন্দজীকে নিয়ে চলে এলেন এবং প্রতাপ বিনা বাধায় তাঁকে আসতে দিল— এই গল্প আদৌ বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না। সেকালে গৃহদেবতাকে অন্য কেউ, সে জ্ঞাতিকুটুমদের মধ্যে কেউ হলেও, তা পারিবারিক মর্যাদাহানির সামিল ধরা হতো এবং এই ঘটনা প্রতিরোধ করার জন্য সার্বিক চেষ্টা হতো। এই গল্পে কিন্তু সেরকম কোন ইঙ্গিত নেই। এত সহজে বসন্ত রায় বেহুলায় চলে এলেন আবার প্রতাপের বাড়ির নিকট গিয়ে থাকলেন কেন, সে বিষয়ে ঐতিহাসিক নীরব। কিন্তু একটা কথা বুঝতে হয় না, কালীঘাটের কালী আগে বর্তমান স্থলে ছিলেন না। অন্য কোথাও ছিলেন, পরে কেউ তাঁকে নিয়ে আসে এবং স্থাপন করে। বিষয়টিকে পুরাণের মহিমা দেওয়ার জন্য পরে সতীর অঙ্গভাগ হিসেবে গপ্পোও এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। পুরানো লেখাতেও জোর গলাতে কালীঘাট যে সতীপীঠ— সেই দাবি কাউকে করতে দেখছি না। সম্ভবত, কৌলীন্য অর্জনের জন্য কালীঘাটের ভক্তদের এই নতুন বিনির্ম্মান ! আর গোটা ঘটনাটাই সপ্তদশ শতকের কোন এক সময় থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে ঘটেছিল বলেই আমাদের অনুমান। অবশ্য তার পরে হওয়াও বিচিত্র নয়। কারণ, কোম্পানিত্র দলিল-দস্তাবেজে উনিশ শতকের প্রথম ভাগের শেষাশেষি কালীঘাট মান্যতা পাচ্ছে, তার আগে কাব্যকবিতার প্রক্ষিপ্ত অংশ ছাড়া আশ্চর্যজনকভাবে কালীঘাট নিরুদ্দেশ।
কালীঘাটের উৎপত্তি নিয়ে আরো অনেক গপ্পো প্রচলিত আছে। তার একটির মতে, জঙ্গলগিরি নামে কোন এক সন্ন্যাসীর গভীর বনের মধ্যে একটি গাভীকে মৃত্তিকার উপর দুগ্ধধারা ফেলতে দেখে সেখানে খনন করে কালীর পাষাণময় মুখমণ্ডল পান । সেই মুখমণ্ডলই বর্তমানে পূজিতা কালীঘাটের কালী। মজার ব্যাপার, এই গল্পটি আরো অনেক জায়গায় শোনা যায়। আমার বাল্যকালে, আজ থেকে বছর পঁয়ত্রিশ আগে বীরভূমের একটি শিবস্থান ‘ভুঁইফোড় শিবে’র মন্দিরে ঠিক একই গপ্পো শুনেছিলাম। পরবর্তীকালে এই গপ্পো শুনলেই আমার শিবরাম চক্রবর্তীর ‘দেবতার জন্ম’ গল্পের কথা মনে পড়ে যায়।
কালীঘাটের মন্দিরের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন জন বিভিন্ন সময়ে তৈরি করে দেন। এ নিয়েও মতভেদ প্রচুর। হরিহর শেঠ তাঁর বইতে এর একটা হিসেব দাখিল করেছেন। কৌতূহলী পাঠকদের জন্য এখানে তা সংক্ষেপে উল্লেখ করা হল। কোন কোন মতে বর্তমান মন্দির ১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দে বড়িষার জমিদার প্রাগুক্ত কেশব রায়ের পুত্র সন্তোষ রায় তৈরি করে দেন, অন্য মতটি তো আগেই বলেছি, সেখানে আছে ফতে চাঁদ জগৎ শেঠের নাম। খরচ হয়েছিল, পঁচিশ মতামতরে ত্রিশ হাজার টাকা। মন্দিরের নিকটে যে ঘাট আছে, তা ১৭৭০-৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি করে দেন ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে পঞ্জাবের অধিবাসী হুজুরিমল্ল। মন্দির-সংলগ্ন নকুলেশ্বর শিনের মঠ-মন্দির তৈরি করে দেন পঞ্জাবের তারা সিংহ। ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দে শ্যামরায়ের মন্দির তৈরি করে দেন বাওয়ালীর জমিদার উদয়নারায়ণ মণ্ডল এবং সিপাহী বিদ্রোহের পরের বছর ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে সাহানগরের বাসিন্দা মদন কল দোলমঞ্চ তৈরি করে দেন।
পুরানো কলকাতা বললে কালীঘাটের কথা অনিবার্যভাবে উঠে আসে। কারণ, কালীঘাট তো কেবল কালীসংস্কৃতির সঙ্গে কলকাতাবাসী তথা সুদূর মফস্বলবাসীকে যুক্ত করে নি, কালীঘাটের সূত্রে আরো অনেক রকম সংস্কৃতি কলকাতার নিজস্ব ল্যাণ্ডমার্ক হিসেবে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল, আজও আছে। সেকালে একখানা প্রবাদ লোকমুখে খুব ঘুরে ফিরে বেড়াত, বটতলা থেকে ওই নামে একখানা তরল প্রহসনও আছে ; প্রবাদটি হল—
“রাঁড়, ভাঁড়, মিথ্যেকথা—
এই তিন লয়ে কলকেতা!”
কলকাতার পক্ষে যদিও এটি সুনাম নয়, কিন্তু এই প্রবাদ একটি সমাজ-ইতিহাসের সাক্ষ্য দিচ্ছে সন্দেহ নেই। কলকাতা মানেই ফন্দিফিকির— যেন-তেন-প্রকারেণ বড়লোক হওয়ার ধান্দা, অতএব সেদিনের সেই কলকাতা ফেরেপবাজ-শঠ-প্রবঞ্চকদের ভিড়ে ভিড়াক্কার। হালকা চটুল আনন্দফূর্তিরও (ভাঁড়) অন্ত ছিল না এ-শহরে, আর ছিল রাঁড় তথা বেশ্যাদের ভিড়। আর কলকাতার পুরাতন যৌনপল্লী হিসেবে যে স্থানের নামটি সকলের কলমে উঠে আসে, তা কিন্তু সোনাগাজি থেকে জন্ম নেওয়া পরবর্তীকালের সোনাগাছি (সোনাগেছে) নয়, সেটি হল কালীঘাটের অনতিদূরে বাদ্যগলির মুখ থেকে শুরু হওয়া যৌনপল্লী। কলকাতা তথা বাংলার আর কোন ধর্মীয় স্থানকে কেন্দ্র করে যৌনপল্লীর এমন বাড়বাড়ন্ত সচরাচর দেখা যায় না। তবে কবে কোন সময়ে সঠিকভাবে এই যৌনপল্লীর সূচনা হল, তা জানা যায় না। তবে ‘রাঁড়’ এই শব্দটির মধ্যে হয়ত কিছু ইঙ্গিত থাকতে পারে। ‘রাঁড়’ শব্দের অর্থ যেমন বিধবা, তেমনি উপপত্নী বা বেশ্যা। তবে দুটি অর্থ ভিন্ন হলেও সম্ভবত সংযোগ আছে। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস এই প্রসঙ্গে সেদিনের কলকাতায় আর একখানি চালু প্রবাদের কথা উল্লেখ করেছেন, ‘রাঁড় হয়ে ষাঁড় হওয়া’ অর্থাৎ বিধবা হওয়ার পর স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ান ও যা-খুশি তাই করা। এখানে ‘যা-খুশি-তাই’ বলতে বেশ্যাবৃত্তি করাকেই বোঝানো হচ্ছে। সবার পক্ষে তো কাশী কিংবা বৃন্দাবনে বিধবাকে ফেলে রেখে আসার যুযোগ কিংবা ‘সৌভাগ্য’ হয় না, তাঁদের অনেকেই সেকালে কালীঘাটে আসার নাম করে বাড়ির বিধবাদের এখানে ফেলে দিয়ে যেতেন। বাঁচার তাগিদে সহায়সম্বলহীন বিধবাদের যৌনবৃত্তি করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। মাদাম বেলেনেসের সেই বিখ্যাত ছবিতে আমরা দেখি, কালীঘাট থেকে পাঁঠাবলি দিয়ে ফেরার পথে দেশীয় যুবক অপাঙ্গে দেখছে বারাঙ্গণাদের। কালীঘাটের প্রতীকই হয়ে উঠেছিল এই বেশ্যাপল্লী। অনেকে ঠাকুর দেখার নাম করে এই বেশ্যাপল্লীর টানেই এখানে এসে ভিড় জমাত। অনেকে অবশ্য সস্তায় বিয়ে করার কিংবা অনেকসময় লোকদেখানো বিয়ে করার জন্যও কালীঘাটে এসে সামান্য টাকা খরচ করে মালাবদল করে বিয়ে সারত। আজও সেই চল রয়েছে, যদিও সেই বিয়ের সামাজিক স্বীকৃতি নিয়ে সে-যুগে কম বিতর্ক ছিল না, আর এ-যুগে তো ও বিয়ে আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে বিয়েই নয়। তবে বেশিরভাগ অবশ্য বাইরে থেকে গণিকা ভাড়া করে নিয়ে এসে কালীঘাটে বাসা ভাড়া করে ক’দিন থেকে ফূর্তি করে যেত। রামমণি এবং তাঁর মেয়ে চন্ননবিলাসীর কথাই ধরা যায়। রামমণি জাতে বাইতি বা বাগদী। গাত্রবর্ণ কালো। এককালে গেরস্ত ঘরের বউ ছিল। কিন্তু তার স্বামী মারা যেতে প্রথমে কিছুদিন দু’ টাকা দশ আনা মাইনের ‘চাকরাণীগিরি’ করে, পরে এক বাবুর নজরে পড়ে যাওয়ায় সে লাইনে নাম লেখায়। অল্পদিনের মধ্যেই তার অবস্থা ফেরে। চন্ননবিলাসী তারই মেয়ে। যশোচন্দ্রবাবুর নজরে পড়েছে। মাঝেমধ্যেই বাবু তাকে নিয়ে কালীঘাটে যান। এবারে একেবারে রামমণিসহ চন্ননবিলাসীর সখীরা, চন্ননবিলাসী, নিজের ইয়ারদোস্ত সকলকে নিয়ে এসেছেন। কালীঘাটে বাড়ি ভাড়া করে ফূর্তির খরচ যেখানে ধার্য হয়েছে আড়াই’শ টাকা, সেখানে চন্ননবিলাসী এক টাকা আর বাবু একটি শিকি দিয়ে কালী দর্শন করেছেন। বাকিরা দুটি চারটি পয়সা দিয়ে দর্শন করলেন। নাহ্‌, চন্ননবিলাসী, যশোচন্দ্র কিংবা রামমণি ঐতিহাসিক চরিত্র নয়, কিন্তু আদতে কালীঘাটের সূত্রে তারা নিজেরাই ইতিহাস। তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে, ভোলানাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘আপনার মুখ আপুনি দেখ’-তে। বস্তুত এই বইতে কালীঘাটের জীবনযাপনের এমন বাস্তব চিত্র আছে যে, যাঁরা সেকেলে কালীঘাটের বাস্তব হালহকিকত্‌ জানতে চান, তাঁদের এই বই পড়তেই হবে।
যে কালীঘাট নিয়ে কলকাতাবাসিদের এত রবরবা, সেই কালীঘাট নিয়ে খ্যাতনামা হুতোম যে কেন নীরব, তা বোঝা যায় না! সেকেলে বাবুরা জাতে ওঠার পর রাঁড় নিয়ে একবার, বাড়ির গিন্নিসহ মেয়েদের নিয়ে আর-একবার অন্তত আসতেন এখানে। তা নাহলে যেন জাত থাকে না। অথচ, হুতোম সেকেলে কলকাতার এত জায়গা, এত চরিত্রের বিবরণ দিলেন, কিন্তু তাঁর বইয়ের কোথাও কালীঘাটকে বিষয় করে তুললেন না। এ কী বিস্মৃতি, না কি উপেক্ষা, তা সঠিক করে আর কে বলবে? তবে কালীঘাট না হলে যে সাহেবদের কাছে পরবর্তীকালের ‘ফেমাস’ কালীঘাটের পটশিল্প যে আমরা পেতাম না, তা-নিয়ে আমাদের কোন সন্দেহ নেই। যদিও যে কালীঘাটের পটশিল্প নিয়ে কলকাতাবাসীর এত গর্ব, তা আদতে মেদিনীপুর অঞ্চল থেকে আগত পটোদের নিজস্ব শিল্প, কেবল কলকাতার বিমিশ্র পরিবেশে সেখানে মহাকাব্য, পুরাণ কিংবা মঙ্গলকাব্যের অতিরিক্ত ঢুকে পড়েছিল বাবু-বিবিদের জীবনযাপন তথা কলকাতার ইঙ্গবঙ্গ সমাজের জীবনাচরণ। এই উপাদান তুলে সিয়েছিলেন, সেকালের বাবু-বিবিরা স্বয়ং। কালীঘাটের পটোদের আঁকা পট এক দিক থেকে দেখতে গেলে, সেকেলে কলকাতার সমাজজীবনের জীবন্ত ইতিহাস। পোশাকআশাক, পছন্দ-অপছন্দ, রুচি-সংস্কৃতি, দেশজ ঘরানার সঙ্গে সাহেবিয়ানার মিশ্রণের গল্প— সব পটোরা ধরে রেখেছেন। আক্ষেপ এই যে, সাহেবরা, এমনকি ভারতবর্ষের অন্য প্রদেশের শিল্পবিদ-ঐতিহাসিকেরা যখন কালীঘাটের পট নিয়ে এত রকম আলোচনা করছেন, তার হাত ধরে উঠে আসছে কলকাতার নানা অজানা ইতিহাস, তখন বাংলায় এক শ্রীপান্থ ছাড়া আর গুটিকয় ইংরাজি ছোট প্রবন্ধ ছাড়া কালিঘাটের পটের নিরিখে কলকাতার ইতিহাস রচনা করতে কোন বাঙালি লেখক এগিয়েই এলেন না। বঙ্কিম ঠিক বুঝেছিলেন, ‘বাঙালির ইতিহাস নাই’; ইতিহাস লেখার পিছনে উৎসাহই নেই!

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ভিন্ন স্বাদের লেখা পরিবেশন করলেন - সুপর্ণা দাস

সুপর্ণা দাস

১.
– ‘‘হোয়াট ডিড ইউ সে স্যার? প্রফেসর ম্যাগ্যান সেন! রাইট?’’
– ‘‘ম্যাগ্যান!!!!!!!!! ওটা মগন হবে! মগন সেন! অধ্যাপক! বিষয়— বাংলা ভাষা ও সাহিত্য!’’
– ‘‘আই সি! ওকে স্যার। রুম নাম্বার ফর্টি টু ইজ রেডি ফর ইউ বোথ স্য়ার! ‘ডিন’ উইল শো ইউ দ্য ওয়ে!’’
– ‘‘ডিন! কোথাকার?’’
– ‘‘সরি স্যার?’’
– ‘‘তুমিই তো বললে ‘ডিন’ আমাদের ঘর পর্যন্ত নিয়ে যাবেন! তা তিনি কোথাকার ডিন?’’
– ‘‘অ্যাকচুয়ালি স্যার, হিজ নেম ইজ ডিনেশ! ডিনেশ ঢার! বাট উই কল হিম ‘ডিন’! ইউ নো, শর্ট অ্যান্ড সিম্পল!’’
– ‘‘বোঝো!’’
খানিকক্ষণ চুপ করে সামনের সুপুরুষ রিসেপশনিস্ট ছোকরাটিকে ভালো করে জরিপ করলেন অধ্যাপক সেন। বুকে সাঁটানো নেমপ্লেট বলছে, ছোকরার নাম— এস সামন্ত! অতঃপর তাঁর প্রশ্ন…
– ‘‘মি. সামান্টা? হোয়্যার আর ইউ ফ্রম?’’
মি. সামান্টা হাসিমুখে সামনের কম্পিউটারে নতুন দুই বোর্ডারের তথ্য ভরতে ভরতে বললেন…
– ‘‘আই অ্যাম ফ্রম গোবারডাংগা স্যার!’’
এতক্ষণে কমলাকান্তের উপস্থিতি টের পাওয়া গেল! পুরো নাম কমলাকান্ত বসু। একলা মানুষ এবং অধ্যাপক মগন সেনের আন্তরিক বন্ধু। ছোটখাটো চেহারা, মাথা ভর্তি টাক ও সুন্দর করে আঁচড়ানো গোঁফ! ‘‘আই অ্যাম ফ্রম গোবারডাংগা স্যার!’’ শুনে কোনও মতে হাসি আর কাশি সামলানোর চেষ্টা করতে গিয়ে বিচ্ছিরি একটা বিষম খেয়ে বসলেন ভদ্রলোক! সঙ্গে সঙ্গে মিস্টার সামান্টা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন! একটি জল ভর্তি সুদৃশ্য কাচের বোতল বাড়িয়ে দিয়ে বললেন…
– ‘‘স্যার, প্লিজ হ্যাভ সাম ওয়াটার!’’
কমলাকান্ত ততক্ষণে কাঁধের শান্তিনিকেতনি ঝোলা থেকে জলের বোতল বের করে ফেলেছেন! কিছুটা জল গলায় ঢেলে শান্তি পেলেন। হাসি মুখে হোটেলের তরুণ কর্মীটিকে বললেন…
– ‘‘হ্যাভ ভাই! ওয়াটার হ্যাভ! মানে, ইয়ে… জল আছে!’’
কমলাকান্ত নিজেও কিন্তু উচ্চশিক্ষিত। ইংরেজিও ভালোই জানেন! তবে, নিজে বলতে গেলে, কিংবা কাউকে গড়গড়িয়ে ওই ভাষা বলতে শুনলে কেন জানি ঘামতে শুরু করেন! সবকিছু যেন ঘেঁটে ঘ হয়ে যায়! আসলে তাঁদের সময় ক্লাস ফোর পর্যন্ত ইংরেজি পড়ানো হত না। চারবছরের এই দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে ইংরেজি নিয়ে সেই যে এক বিরাট ভয় বুকে-মাথায় জাঁকিয়ে বসল! আজও সেই জড়তা কাটিয়ে উঠতে পারেননি কমলাকান্ত! এদিকে, অধ্যাপক মগন সেন এতক্ষণ প্রিয় বন্ধুটির দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে ছিলেন। এবার মি. গোবারডাংগা, থুড়ি মি. সামান্টাকে উদ্দেশ করে বললেন…
– “মে আই নো ইয়োর এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড মি. সামান্টা? আই অ্যাম জাস্ট ফিলিং কিউরিয়াস অ্যাবাউট ইউ অ্যাজ ইয়োর ইংলিশ ইজ প্রিটি শার্প!”
এবার মনে হল সামান্টা সাহেব খুশি হলেও একটু অপ্রস্তুত! তবুও প্রশ্নের উত্তর দিলেন! আসলে অধ্যাপক সেনের ভদ্র কিন্তু গম্ভীর কণ্ঠস্বর, সম্ভ্রান্ত চেহারা আর পদমর্যাদা চটপটে, বাকপটু, স্মার্ট তরুণটিকে কিছুটা হলেও যেন আনস্মার্ট করে দিয়েছে! তিনি বললেন…
– ‘‘আই হ্যাভ কমপ্লিটেড মাই হায়ার সেকেন্ডারি ফ্রম ক্ষীরাড মোহান হাই স্কুল অ্যান্ড দেন কমপ্লিটেড মাই গ্র্যাজুয়েশন ফ্রম ব্যারাস্যাট ইউনিভার্সিটি স্যার।’’
– ‘‘সাবজেক্ট?’’
এবার যেন অস্বস্তি আরও বাড়ল মি. সামান্টার! হালকা করে একটা ঢোঁক গিলে বললেন…
– ‘‘বেঙ্গলি স্যার!’’
অধ্যাপক সেন হোটেলের রেজিস্ট্রারে স্বাক্ষর করছিলেন। তাঁর সাধের ঝর্ণা কলমটি থমকে গেল! মি. সামান্টার উত্তর শুনে তাঁর মতো সপ্রতীভ মানুষও যেন কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে রিসেপশনিস্টের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন! কমলাকান্তের অবস্থা আরও শোচনীয়। তাঁর হাঁ করা মুখ বন্ধ হয়েছিল পাক্কা সাড়ে তিন মিনিট পর! সই-সবুতের পর রিসেপশন ছাড়ার মুহূর্তে তরুণ রিসেপশনিস্টটি অত্যন্ত আন্তরিক গলায় বললেন…
– ‘‘স্যার, ইউ ক্যান কল মি স্যান্ডি! অ্যাকচুয়ালি মাই সেল্ফ স্যানডিপ সামান্টা!’’

২.
এরপর বিয়াল্লিশ নম্বর ঘরে ঢোকা পর্যন্ত হোটেলের নতুন দুই বোর্ডার মুখে কোনও রা কাড়েননি। কমলাকান্তের অবশ্য সেই উপায়ও ছিল না। কারণ, তখনও সাড়ে তিন মিনিট সম্পূর্ণ হয়নি! দুই বন্ধুর আগে আগে ঘরে ঢুকলেন ‘ডিন’! নতুন বোর্ডারদের লটবহর নামিয়ে রেখে তিনি বললেন…
– ‘‘স্যার কিছু দরকার হলেই বেল টিপবেন! আমি চলে আসব। না হলে পটলাকে পাঠিয়ে দেব।’’
সাড়ে তিন মিনিট সম্পূর্ণ হল। কমলাকান্তের হাঁ স্বাভাবিক হল। মাতৃভাষার ফেরত দেখে বুকের লুপ্তপ্রায় বল ফেরত পেলেন তিনি! বলললেন…
– ‘‘পটলা?!’’
‘ডিন’ কান এঁটো করা হাসি হেসে বললেন…
– ‘‘আজ্ঞে ওঁর নাম পল্টুকুমার পাইন। আমার ভাগ্নে। আমি আদর করে পটলা বলে ডাকি!’’
একথা শুনে অধ্যাপক সেন আর তাঁর বন্ধুবরের মুখে স্মিত হাসি দেখা গেল। পরক্ষণেই কমলাকান্তের ঝটিতি প্রশ্ন…
– ‘‘তা এই হোটেলে সকলেই কি আপনার ভাগ্নেকে ওই নামে ডাকেন?’’
– ‘‘আজ্ঞে স্যার, আমরা ক’জন নিজেদের মধ্যে তাই বলি। কিন্তু, বাকিদের সামনে ওকে ‘প্যাল্টি’ বলে ডাকতে হয়! স্যান্ডি স্যারের হুকুম!’’
এবার অধ্যাপক সেনেরই বিষম খাওয়ার জোগাড়! তার মধ্যেই কমলাকান্ত বললেন…
– ‘‘অ্যাঁ! পল্টু থেকে পাল্টি!’’
‘ডিন’ তৎক্ষণাৎ ‘ভুল’ শুধরে দিলেন…
– ‘‘আজ্ঞে না স্যার। পাল্টি নয়। ও তো তেনারা খান! আমাদের পটলার নাম প্যাল্টি!’’
‘ডিন’ চলে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ কী মনে হতে অধ্যাপক সেন বলে উঠলেন…
– ‘‘আপনার নাম সম্ভবত…’’
– ‘‘আজ্ঞে, দীনেশ ধর! আমার দাদু স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন স্যার! জেল খেটেছিলেন! বড় সাধ করে নাতির নাম রেখেছিলেন দীনেশ! ভাগ্যিস তিনি আর নেই!’’
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন দীনেশ। একটা অদ্ভূত ভালো লাগায় মনে ভরে গেল দুই বোর্ডারের!

৩.
– ‘‘কী বুঝলে হে মগন? কী বলেছিলাম? বলেছিলাম না আজকাল আর বাংলা-ফাংলা খুব একটা চলে না! তুমি তো অধ্যাপনা কর! ভাষা নিয়ে গবেষণা কর! তোমার ছাত্র-ছাত্রীদের দেখেও কি বোঝ না কিছু?’’
– ‘‘ওদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু একেবারে সঠিক বাংলায় একজন খাঁটি বাঙালির মতোই কথা বলে। কারও কারও লেখার হাতও বেশ ভালো!’’
– ‘‘হম! ‘ওদের মধ্যে অনেকেই’! মানে সবাই নয়! তাই তো?’’
– ‘‘সেটা কি আশা করা উচিত? সবাই তো অঙ্কে একশোয় একশো পায় না!’’
– ‘‘ঠিক! কিন্তু, তাতে অঙ্কটা হাসজারু হয়ে যায় না। কিন্তু, আমাদের বাংলা ভাষাটি এখন বাংলা থেকে বাং-হি-লিশ হয়ে গিয়েছে!’’
– ‘‘কী?!’’
– ‘‘আরে বাবা বাং-হি-লিশ! মানে বাংলা-হিন্দি-ইংলিশের জগাখিচুড়ি!’’
– ‘‘হম! কিন্তু, তোমার ওই সংক্ষিপ্তসার শুনতে ইলিশ-ইলিশ লাগল!’’
– ‘‘বোঝো!’’
– ‘‘আর বোঝাবুঝিতে কাজ নেই। চলো, বেরিয়ে পড়ি। এই মফঃস্বলে এসেই যা অভিজ্ঞতা হল, দুপুরে জমিয়ে ইলিশ না খেলে আমার হজম হবে না!’’
– ‘‘সে তো বটেই। বাঙালের পোলা বলে কথা! তোমার কথায় কথায় ইলিশ না হলে চলে?’’
– ‘‘কী কথার কী মানে! বিশ্বাস করো, এই বাঙাল-ঘটি করে করেই আমাদের আর বাঙালি থাকা হল না!’’

৪.
– ‘‘বেক্ড হিলসা আর বোনলেস হিলসা ব়্যাভিওলি আমাদের স্পেশালিটি স্যার! বলতে পারেন, দুটোই আমাদের সিগনেচার ডিশ! এই এলাকায় এ জিনিস আর কোথাও পাবেন না!’’
পদের নাম শুনেই ভ্রু কুঁচকে গিয়েছিল অধ্যাপক সেনের। ব়্যাভিওলির মধ্যে কাঁটাছাড়া ইলিশ কেমন লাগতে পারে, দিব্য অনুভূতিতে তা বোঝার চেষ্টা করে কমলাকান্তের মুখটাও কেমন জানি বিস্বাদ লাগছিল! বিরক্তি চেপে অধ্যাপক সেন রেস্তোরাঁর এই ওয়েটারটিকে প্রশ্ন করলেন…
– ‘‘ইলিশ ভাজা, ভাপা, পাতুরি কিংবা সরষে ইলিশ – এসব পাওয়া যাবে কি?’’
ওয়েটার বাবাজি একটু অবাক! মানসিকভাবে কিছুটা আহতও বটে! ছোকরা ভেবেছিল, এঁরা দু’জন বিলিতি বাঙালি! আদতে ভেতো বাঙালি! যাক গে যাক! যে ক’দিন কনফারেন্স চলবে, আরও অনেক শাঁসালো খদ্দের আসবে। তাতে খান কয়েক আসল বিলিতিও পাওয়া যেতে পারে। তাঁদেরই না হয় বেক্ড হিলসা আর বোনলেস হিলসা ব়্যাভিওলি খাওয়ানো যাবে! যাই হোক, দুপুরের খাওয়াটা কিন্তু জব্বর হল! দুই বন্ধুতে মিলে ইলিশের মোট পাঁচটা পদ ভাগাভাগি করে খেলেন! কমলাকান্তের ভারী কৌতুহল হচ্ছিল। বেরোনোর মুখে ক্যাশে বসে থাকা লোকটিকে (বোঝা যাচ্ছিল, তিনিই রেস্তোরাঁর মালিক) তিনি জিজ্ঞেস করলেন…
– ‘‘আপনার হোটেলের নাম দেখছি ‘দিল আ গ্যান্দি’! মানেটা ঠিক বুঝলাম না!’’
প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোক ভারিক্কি চালে বললেন…
– ‘‘স্যারের মনে হয় বেণীমাধব পড়া নেই! আর হ্যাঁ, এটা হোটেল নয়। রেস্টুরেন্ট!’’
কমলাকান্ত ফের একবার হাঁ হওয়ার আগেই অধ্যাপক সেন হাঁক পাড়লেন…
– ‘‘চলে এস কমলা!’’
কমলাকান্তের মনে একরাশ প্রশ্ন! কিন্তু, তার আগেই অধ্যাপক সেন বললেন…
– ‘‘ওটা টেনিমাধব, মানে টেনিদা হবে। আর ‘দিল আ গ্যান্দি’ হল ‘ডি লা গ্র্য়ান্ডি’র অপভ্রংশ কিংবা আজকালকার চলতি পঞ্জাবি রকের ফিউশনও হতে পারে! চলো, এবার এখানকার বাজারটা ঘুরে দেখি!’’

৫.
দুই বন্ধুই খেয়াল করলেন বাজারের অধিকাংশ দোকানেই বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড প্রায় নেই বললেই চলে। বরং ইংরেজিই বেশি। সেই গুটিকতক বাংলা সাইনবোর্ডের মধ্যেই একটা বেশ বড় সাইনবোর্ড তাঁদের চোখে পড়ল! বিরাট হরফে লেখা— ‘মা মনসা ষ্টেশনারী’! দেখে অধ্যাপক সেন বললেন…
– ‘‘যাক! মনসা বানানটা অন্তত সঠিক লিখেছে। আর যেহেতু তিনি লোকদেবী, তাই অবশ্যই তিনি নারী!’’
এর ঠিক পাশেই একটি দোকানের সাইনবোর্ড বলতে যেটা রয়েছে, তা হল নামজাদা নরম পানীয় সংস্থার বিরাট বিজ্ঞাপন। এক পাশে নিতান্তই ছোট হরফে লেখা, ‘মোদির দোকান— এখানে সবরকমের মোদিখানা আর স্টেশনাড়ি সামগ্রি শুলাভে পাবেন’! অধ্যাপক সেন পুরোটা পড়লেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলেন। পাশাপাশি এগোতে থাকলেন কমলাকান্তও! বাজারের প্রায় সর্বত্রই বিভিন্ন দোকানে বাংলা ভাষার এহেন অসংখ্য নমুনা তাঁদের নজর এড়াল না! একটি মুরগীর মাংসের দোকানে দেখলেন একটি কালো ছোট বোর্ড টাঙানো আছে। তাতে গোলাপী, হলুদ, সাদা চকে মোটা করে লেখা— ‘চিকেন উইন, বর্নলেস চিলি চিকেন পিস, চিকেন ডামইস্টিক’ ইত্যাদি! বোঝা গেল, কপাল শুধু বাংলা ভাষারই পোড়েনি! বাজার থেকে বেরোনোর মুখেই দুই বহুরূপীর দেখা মিলল! একজন কালীবেশী, দ্বিতীয় জন সেজেছেন হনুমান। দু’জনের সামনেই একটা করে পুরনো গামছা বিছানো রয়েছে। তাতে বেশ কিছু খুচরো পয়সা পড়ে রয়েছে। তবে, হনুমানজির সামনে মুদ্রার পরিমাণ কিঞ্চিৎ বেশি! খান কয়েক ১০ টাকার নোটও চোখে পড়ল!

পরিশিষ্ট
বাঙালির মহানায়ক তাঁর জীবনের শেষ ছবিতে একজন বাংলা ভাষাবিদ এবং বাংলা ভাষাপ্রেমীর সার্থক চরিত্র চিত্রায়ন আমাদের উপহার দিয়ে গিয়েছেন। যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন বন্ধুর ভূমিকায় থাকা আরও এক কিংবদন্তী শিল্পী। তাই, একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে বাংলা ভাষার অবক্ষয় নিয়ে লেখার যখন একটা সুযোগ পেলাম, বাঙালির মনের মণিকোঠায় চিরস্থায়ী সেই চরিত্র দু’টিকে নতুনভাবে অনুসরণ করার লোভ সামলাতে পারলাম না! সেটা করতে গিয়ে যদি কোনও ত্রুটি হয়ে থাকে, তার জন্য আগেভাগেই পাঠকের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি!

এখানে তথ্য-পরিসংখ্যানের ওজনে ওজনদার কোনও উপস্থাপনা করতে চাওয়া হয়নি। বরং, একজন ছাপোষা বাঙালির প্রতিদিন বাড়িতে, পথে-ঘাটে যে অভিজ্ঞতা হয়, সেগুলিই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এবার বাংলা নিয়ে আমার প্রত্যক্ষ একটি অভিজ্ঞতা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি।
পারিবারিক একটি মামলার প্রেক্ষিতে আমার মায়ের একটি লিখিত সাক্ষীনামা কলকাতার একটি আদালতে পেশ করা হয়। সেটি বাংলায় টাইপ করা ছিল। কারণ, আমার মা অন্য কোনো ভাষা লিখতে, পড়তে বা বলতে পারেন না। ‘মজা’ হল, আমাদের আইনজীবী সেটি আদালতে পেশ করার আগেই তুলনায় প্রবীণ ও অভিজ্ঞ এক আইনজীবী বিষয়টির বিরোধিতা করেন! তাঁর যুক্তি ছিল, এই ধরনের বাংলা লেখা জেলার কোর্ট-কাছারিতে চলতে পারে। কিন্তু, শহর কলকাতায় নাকি চলে না! ওই আইনজীবী নিজেও কিন্তু বাঙালি এবং পরবর্তীতে দেখলাম তিনি বেশ বাংলার মতো করেই বাংলার টানে এবং বাংলার সুরে ইংরেজি বলেন! যাই হোক, তাঁর অদ্ভূত যুক্তি বিচারক পাত্তা দেননি। তিনি বাংলায় লেখা ওই সাক্ষীনামাই গ্রহণ করেন।
আমার এক পেশাতুতো দাদা বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত। তাঁর কাজ বাংলা ভাষা নিয়েই। তাঁর সঙ্গে এবং অনুবাদের কাজের সঙ্গে যুক্ত এমন একাধিক বন্ধু ও সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে আজকাল অধিকাংশ সংস্থাই কৃত্রিম মেধার উপর নির্ভর করছে! এমনকী, যাঁরা অনুবাদের কাজ করেন, তাঁরাও অনেকে সময় ও শ্রম বাঁচাতে অনলাইন বিভিন্ন অনুবাদ ব্যবস্থাপনার সাহায্য নিচ্ছেন! ফলে হিন্দি, ইংরেজি-সহ বিভিন্ন ভাষা থেকে বাংলায় যা অনুবাদ হচ্ছে, তা এককথায় উদ্ভট!
কিছুদিন আগে পর্যন্ত একটি বিখ্যাত ব্র্যান্ডের অ্যান্টি ড্যানড্রফ শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনের ভয়েস ওভারে শোনা যেত – ‘সস্তা শ্যাম্পু ভারী পড়ে গেল?’ সম্প্রতি অবশ্য সেটি সংশোধন করা হয়। সরকারি বিভিন্ন দপ্তর থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ-আদালতের সাইনবোর্ড কিংবা নোটিস বা বিজ্ঞপ্তি, অথবা বাস-ট্রেন-দেওয়ালে সাঁটানো নানা ধরনের কম দামি বিজ্ঞাপন কিংবা বহুজাতিক নানা সংস্থার বিরাট বিরাট বিপণনী হোর্ডিং— বাংলার বেহাল দশা ধরা পড়বে সর্বত্রই! আজকাল পড়ুয়াদের একটা বড় অংশ বাংলা পড়তে বা লিখতে পারে না। কারণ, ইংরেজিমাধ্যম বেশিরভাগ স্কুলেই বাংলা ‘অপশনাল সাবজেক্ট’! আর বাঙালি বাবা-মায়েদের একটা বড় অংশ দায়িত্ব নিয়ে ছেলেমেয়েদের হিন্দি বা সংস্কৃত (আজকাল এই ট্রেন্ড শুরু হয়েছে) পড়তে উৎসাহ দিলেও বাংলা নিয়ে তাঁদের ঘোরতর অ্যালার্জি! ছোটরা এখন আর বিশপের গল্প, ঠাকুরমার ঝুলি বড় একটা পড়ে না। বদলে মোবাইল গেম খেলে খেলে চোখে চশমা এঁটে বসে! সেই চশমার দোকানের বাংলা বিজ্ঞাপনেও একাধিক ভুল চোখে পড়বে! আবার সেই চশমা পরেই জনপ্রিয় কোনও বাংলা সিরিয়ালের কোনও চরিত্রকে যখন ‘খাবার’কে বারবার ‘খাওয়ার’ বলতে, কিংবা কোনও খবরের চ্যানেলের উপস্থাপক বা উপস্থাপিকাকে ‘বাংলাজুড়ে সবাই দোল মানাচ্ছে’ বলতে শোনা যায়, তখন যে অনুভূতিটা প্রকট হয়ে ওঠে, তা হল নিখাদ বিরক্তি! তবে, এসবেরই মধ্যেই যখন কোনও ভাইরাল রিলে সদ্য বুলি ফোটা এক শিশুকে ‘আতা গাছে তোতা পাখি’ মুখস্থ বলতে দেখি এবং শুনি, তখন মনে হয়, এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি!

সকলের প্রিয় পঞ্চায়েত - ৩ সিজনের অপেক্ষার প্রহর গুনলেন - বৃতা মৈত্র

পঞ্চায়েত ৩ নিয়ে আগ্রহ তীব্রতর

বৃতা মৈত্র

ওটিটি প্ল্যাটফর্মের যে ক’টি ভারতীয় নিবেদন শুরু থেকেই রিয়ালিস্টিক ভাবনা ও পরিবেশনে আপামর ভারতীয় দর্শকের ভিতর আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, ‘পঞ্চায়েত’ নিঃসন্দেহে তার অন্যতম সেরা। সিরিজের সিজন ২-এর শেষ পর্বে ছিল এই প্রশ্ন, এবার কী অভিষেককে ফুলেরা ছাড়তে হবে? কারণ, চন্দ্র কিশোর মনে করে, গ্রামের সমস্ত অশান্তির পিছনে রয়েছে অভিষেক। এদিকে রাহুলের খুনকে কেন্দ্র করে পুরো ফুলেরা গ্রাম শোকাচ্ছন্!! পঞ্চায়েত প্রধান মঞ্জু দেবী মনে করেন, প্রহ্লাদকে অপমান করে মৃত রাহুলকে শ্রদ্ধা জানানো অর্থহীন।

আমাজন প্রাইম ভিডিওতে ‘পঞ্চায়েত’-এর প্রথম সিজন স্ট্রিমিং হয় ২০২০-তে। আর শুরুতেই টানটান চিত্রনাট্য ও দুর্দান্ত অভিনয়ের গুণে আপামর দর্শকের হৃদয় জয় করে নেয় এই সিরিজ। এই সুযোগে দেখে নেওয়া দরকার এর অভিনেতা তালিকাটি। পঞ্চায়েত সেক্রেটারি অভিষেক ত্রিপাঠীর চরিত্রে অভিনয় করছেন জিতেন্দ্র কুমার। ওয়েব দুনিয়ায় জিতেন্দ্র নিজেকে অপরিহার্য করে তুলেছেন ইতিমধ্যেই। ‘পঞ্চায়েত’-এর আগে তাঁর দুর্দান্ত অভিনয় দেখেছেন ওয়েব দর্শক ‘কোটা ফ্যাক্টরি‘-তে। আক্ষেপ, তাঁকে বলিউড তেমন ব্যবহার করেনি এখনও। বড় পর্দায় ‘শুভ মঙ্গল ইয়াদা সাবধান’ ছাড়া জিতেন্দ্র কুমারের তেমন কোনো কাজ দেখার সুযোগ হয়নি আমাদের।

এছাড়াও এই সিরিজে অভিনয় করছেন নীনা গুপ্তা (পঞ্চায়েত প্রধান মঞ্জু দেবী দুবে), রঘুবীর যাদব (মঞ্জু দেবীর স্বামী ব্রিজ ভূষণ দুবে), চন্দন রায় (অভিষেকের ডান হাত বিকাশ, পদে অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট), ফয়সাল মালিক (উপ প্রধান প্রহ্লাদ পান্ডে), সনভিকা (রিংকি, মঞ্জু দেবীর মেয়ে) প্রমুখ। দ্বিতীয় সিজনের আমরা পাই সুনীতা রাজোয়ার (ক্রান্তি দেবী, মঞ্জু দেবীর শত্রু), পঙ্কজ ঝা (এমএলএ চন্দ্র কিশোর সিং), অশোক পাঠক (বিনোদ) এবং অন্যান্য। আদতে দুটি সিজন ধরে অভিনয় করেছেন এক বিরাট অভিনেতা টিম, স্বল্প পরিসরে এত নাম দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু, প্রত্যেকেই নিখুঁত অভিনয়ে এই সিরিজকে পর্দায় জীবন্ত করে তুলেছেন।

আমাজন প্রাইম ভিডিও-র জন্য ‘পঞ্চায়েত’ নির্মাণ করেছে দ্য ভাইরাল ফিভার। চিত্রনাট্য লিখেছেন চন্দন কুমার। পরিচালনা দীপক কুমার মিশ্র। সাউন্ড ট্র্যাক ও মিউজিক তৈরি করেছেন অনুরাগ সাইকিয়া। সিনেমাটোগ্রাফার অমিতাভ সিং ও এডিটিং অমিত কুলকার্নি। জনপ্রিয়তার পাশাপাশি ‘পঞ্চায়েত’ দারুণভাবে সমালোচকদের প্রশংসাও কুড়িয়ে নিয়েছে। ভারতের ৫৪তম আন্তর্জাতিক ফিল্ম উৎসবে (IFFI) ‘পঞ্চায়েত’ সিজন ২ সেরা ওয়েব সিরিজের পুরষ্কার পায়। প্রসঙ্গত, এদেশে এই পুরস্কার চালু হল ‘পঞ্চায়েত’-কে কেন্দ্র করেই।

কয়েক সপ্তাহ আগে আমাজন প্রাইম ভিডিও ইনস্টাগ্রামে প্রকাশ করেছে সেটের ভিডিও ও স্টিল ছবি–মূলত ‘পঞ্চায়েত’ সিজন ৩ স্ট্রিমিংয়ের ঘোষণার পার্টি! অর্থাৎ, ‘পঞ্চায়েত’ ভক্তদের জানিয়ে দেওয়া, অপেক্ষার পালা এবার শেষ! সিজন ৩ নিয়ে টিম নিয়ে ‘পঞ্চায়েত’ প্রস্তুত পর্দায় আসার জন্য। প্রাইম ভিডিও কর্তৃপক্ষ ভালোই জানে আগের দুটি সফল সিজন দেখার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ ‘পঞ্চায়েত’ ভক্তরা কী পরিমাণ উতলা হয়ে রয়েছেন! ইনস্টাগ্রাম পোস্টে সবার আগে চোখে পড়ে বাইক চড়া জিতেন্দ্র কুমারকে। অন্যান্যদের মধ্যে আছেন নীনা গুপ্তা, অশোক পাঠক, দুর্গেশ কুমার, ফয়সল মালিক, প্রমুখ। এটা বলতেই হবে এই সিরিজের অন্যতম প্রাপ্তি বলিউডের অত্যন্ত ক্ষমতাশালী অভিনেত্রী নীনা গুপ্তাকে মঞ্জু দেবীর চরিত্রে পাওয়া।

সিজন ৩-এ থাকছে মোট ৮টি পর্ব। গ্রাম্য পটভূমিতে পল্লবিত ‘পঞ্চায়েত’ নিয়ে প্রথম সিজন থেকেই আগ্রহ তুঙ্গে, আগেই বলেছি। এদিকে সিজন ৩-এর প্রদর্শনের তারিখ যে কোনও কারণেই হোক পিছিয়ে যাওয়ায় দর্শকমহলে তীব্র অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। সোস্যাল মিডিয়ায় ট্রোলিং ও মেমে বিতরণ চলছে। সিরিজের মুখ্য অভিনেতা জিতেন্দ্র কুমারও শুটিং স্টিল শেয়ার করে জানিয়েছেন, আমরাও প্রবলভাবে ‘পঞ্চায়েত ৩’-এর স্ট্রিমিংয়ের অপেক্ষায়। এই লেখা যখন লিখছি, তখনকার খবর, মার্চের প্রথম সপ্তাহে শুরু হবে ‘পঞ্চায়েত ৩’। বাকি দুই সিজনের মতোই দর্শকচিত্ত জয়ে সফল হবে ‘পঞ্চায়েত’, এমনটা প্রত্যাশা করা যেতেই পারে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published.