ভাণ পত্রিকা
৪৭ তম ই-সংস্করণ ।। ৫৮ তম সংখ্যা ।। এপ্রিল-মে , ২০২৫
সম্পাদক :

সম্পাদনা সহযোগী :

প্রচ্ছদ :

নক্সা পরিকল্পক :

অন্যান্য কাজে :







ভাণ-এর পক্ষে:
পার্থ হালদার
কর্তৃক
৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা: ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ: ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬
(হোয়াটসঅ্যাপ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ (কথা /হোয়াটসঅ্যাপ)
৮৭৭৭৪২৪৯২৮ (কথা) bhaan.kolkata@gmail.com (ই-মেল)
Reg. No: S/2L/28241
সূচিপত্র
কলকাতার হাটে-বাজারে ঢুঁ দিলেন – কিশলয় জানা
ছোটদের ছবির জীবন্ত দলিল আঁকলেন -অরিত্র দে
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বাংলা থিয়েটার -কুন্তল মুখোপাধ্যায়
‘ডানা’য় লেখো গান, সে গান বেঁচে যাবে – সায়ন ভট্টাচার্য
দেবীর জীবনে ‘কালরাত্রি’র আনাচে কানাঁচে ঘুরলেন – অজন্তা সিন্হা
সেকালের দুটি ব্রাহ্মবিবাহ, ব্যাখ্যায় – তন্ময় দেবনাথ
বাংলা এখন কতটা রবীন্দ্র-সত্যজিৎ-নজরুলের- সরেজমিনে পার্থ হালদার
রেডিও থেকে এফ.এম- সৌমেন বসু
সম্পাদকের কথা
।।সম্পাদকের কথা।।
এপ্রিল-মে , ২০২৫
যুদ্ধ, দাঙ্গা, ঘৃণা, নিষ্ঠুরতা অসংখ্য মানুষের এখন প্রথম পছন্দ। ধর শালাকে, ভরে দে, থেঁতলে দে, গুঁড়িয়ে দে, জ্বালিয়ে দে। শুধু মারলে এ আত্মা শান্ত হবে না, ভয়ানক ভয়াবহ বীভৎস, একেবারে নাড়ি-ভুড়ির সঙ্গে চোখ মুখ দলা পাকিয়ে দিলেই যেন পরম শান্তি, অনাবিল আনন্দ, অফুরন্ত সুখ।
যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই— একথা তারা তো বলেনই না, যুদ্ধ বিরোধী স্বরকেই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবার নিদানে জ্বালা মেটানোর ব্যর্থ চেষ্টা তারা উন্মত্তের মতো করে চলেন। ভাবটা এমন, এই গুঁড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছিল, এই ওমুকের বাচ্চা গুলোর জন্যই সব ভেস্তে গেল! ঘুম থেকে উঠে তাদের প্রিয় রাষ্ট্র যেন তাদের ধর্ষকামী মনের প্রতিনিধি হয়ে রক্তখেকো হয়ে উঠে প্রতিবেশী অথবা যেকোনো ‘অপর’ কে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে— এমন বীভৎস কল্পনায় এরা সমস্ত দিবারাত্রি বুঁদ হয়ে থাকছেন।
এখনও বিশ্বের বহু মানুষ যুদ্ধ পছন্দ করেন না, এই কথাটার মানে ওনারা বুঝতে পারছেন না। আর আমরা বুঝতে পারছি না, ওরা কেন যুদ্ধ চান। যুদ্ধ নাকি অবশ্যাম্ভাবী। ইতিহাসে সময়ে সময়ে সে সত্যিই ফিরে আসে। তাই যদি হয়, শান্তিকামী অলস, নিরীহ, গো-বেচারা, আনস্মার্ট, শান্তিকামী মানুষের কিছু সহজ জিজ্ঞাসায় ওদের মতো ‘প্রকাণ্ড’ রাক্ষসদের ধৈর্য চ্যুতি ঘটছে কেন। যুদ্ধ বিরোধীরা তো ফালতু। আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ, অরি বারবুস, রমা রলা পেরেছিলেন যুদ্ধ আটকাতে? যুদ্ধ অবশ্যাম্ভাবী। কিছু মানুষকে ভয়ঙ্কর শয়তান ধরে নিয়ে আধলা ইঁট দিয়ে থেঁতলে দিলেই ধরিত্রী শান্ত হবে— একথা যাদের কাছে সরল সমীকরণ তাদের এই যুদ্ধ-ভীত, ভেতো, ভোঁতাদের প্রতি এমন বিরাগ কেন? যুদ্ধ না চাওয়া ভীতুদের যুদ্ধোপরাধী দেখানোর এত আয়োজন কেন?
যুদ্ধ পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো শত্রু। যুদ্ধ এড়ানো উচিত। কিন্তু এ তো একপাক্ষিক নয়। অন্যায় সয়ে যাওয়াও কাজের কথা নয়। ক্ষমা মহৎ। কিন্তু ‘ক্ষমা যেথা হীন দুর্বলতা, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি সেথা’, এ কবির কথা। তা-ই হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণের বিরোধী রবীন্দ্রনাথ, জাপানের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে থেকেও জাপানের বিরুদ্ধে চীনের প্রত্যাঘাতের পাশে দাঁড়ান। যুদ্ধ বিরোধী রবীন্দ্রনাথও পক্ষ নেন। আমরা যেমন ক্ষুদিরামের পক্ষে কিন্তু কাসভের বিরুদ্ধে। আমার স্বাধিকার, স্বাধীনতা হরণ করতে এলে লড়তে হবে। হবেই। ক্ষয় রক্ত মৃত্যু হাহাকার এর মধ্যেও লড়তে হয়। তবে একজন সুস্থ মনের মানুষ যুদ্ধ করতে করতেও জানবে যুদ্ধ এই পৃথিবীকে, এই দেশকে মন্দ-মৃত্যু-মন্দা ছাড়া ভালো কিছু দিতে পারে না। যুদ্ধক্ষেত্রে মরে আমাদের ভাই-বোন। যুদ্ধ চিরকাল গরিব মধ্যবিত্ত বিরোধী এবং পরিনামে পুঁজিপতিদের কেল্লাফতে।
যুদ্ধের ময়দানে যে দুটো কাজ করব না— যুদ্ধে উন্মাদ হব না। নেশার ঘোরে অহং-দম্ভ প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করব না। যুদ্ধ আর যুদ্ধ-উন্মাদনা যে এক নয়, যুদ্ধবাজের ‘আঘাত’ আর স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের ‘প্রত্যাঘাত’ যে এক নয়, একথা বুঝব। খারাপের বিরুদ্ধে ভালোর লড়াই একমাত্র মিসাইল মেটাতে পারে এমন ভুল করব না। ঘৃণা আর বিদ্বেষ সমস্যার মেডিসিন নয়, আদতে সর্বরোগের কারণ, একথা বিস্মৃত হব না। ন্যায়যোদ্ধা, ন্যায় বিচারের দেশ যুদ্ধের অবশ্যাম্ভাবী আহ্বানে যুদ্ধে প্রত্যাঘাত করতে করতেও মানবে এসব না করতে হলেই দেশের দশের ভালো হত। যুদ্ধ রোমান্টিক কিছু নয়, হরর মুভি নয়, ভিডিও গেমের বানানো রক্ত নয়, ফ্যান্টাসি নয়, -যুদ্ধ যে নির্মম নিষ্ঠুরতা এবং দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত একথা জানব। একদিকে খড়্গ অন্যহাতে কমল– এ তো আমাদের ভারতাত্মার গোড়ার কথা! অথচ তুমি কেন শান্তির গান গাইছ? এ তো অমার্জনীয় অপরাধ! তুমি কেন উন্মাদের মতো ধ্বংসের জয়গান গাইছ না এও যেন কম অযোগ্যতার বিষয় নয়! একটা মিসাইল কিংবা একটা বোমা যখন পোড়াচ্ছে জ্যান্ত মানুষ, আধখানা পুড়িয়ে নির্বান্ধব ফেলে চলে যাচ্ছে, হাসপাতাল ধ্বংস করে দিচ্ছে, আধপোড়া জীবনের গোঙানির শব্দ অথবা থেঁতলানো পোড়া শরীরের চিত্রকল্পনায় যদি ভয় বা সহমর্মি হতে গিয়ে কাশ্মীর কিংবা রাজস্থানের বর্ডারে গিয়ে আটকে যায় আমার ভয় অস্বস্তি কিংবা হাহাকার— তবে ধিক মানব-জীবন! ওরা আমাদের মনখারাপের অধিকার পর্যন্ত কেড়ে নিতে চায়। ওদের ধর্ষকামী অচেতন যদি গ্রাস করে নেয় এ দেশ এ সময়, তবে হে কবি, এ তোমার-আমার সভ্যতার ঘোরতর সঙ্কট।
যারা কাঁচা জাতীয়তাবাদ, হিংস্র সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক তাদের লড়াই কেবল সমরাস্ত্রের। এর পেছনের দখলের রাজনীতি অথবা আমাদের চিরকালীন দুর্বল এবং পদানত রাখার চক্রান্ত রয়েছে, অতদূর দৃষ্টি প্রসারিত হয় না ওদের। এদের দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে দেখি না, গরিব মানুষ, যেকোনো প্রকার সংখ্যালঘুর মর্যাদার লড়াইয়ে এদের পাই না। কৃষকের হকের অধিকার আদায়ের আন্দোলন যাদের কাছে দেশদ্রোহিতা, যারা সরকারের নীতি বিরোধিতার গণতান্ত্রিক অধিকারকে দেশ-বিরোধিতা ভাবেন, দিবারাত্র যাদের জাত-পাত, উঁচু-নিচুর তফাত করতে করতে ঘৃণা ছড়ানোই যাদের প্রিয় মৈথুন— তারা নাকি দেশভক্ত! উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়লে ওদের পেট ভরে না, একটা জাতি রাষ্ট্রকে ‘অপর’ ভেবে নিশ্চিহ্ন না করার দায়ে ওদের অপরিসীম জ্বলন হয়। সে জ্বালার থেকে রেহাই পান না বিদেশ সচিব এমনকি তার পরিবার। অথচ গণতান্ত্রিক দেশের একটি বয়স্ক ছাগলও বোঝে, সচিব আসলে মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত শোনান। ওদিকে পনেরো বছর জুড়ে দেশনায়করা তো ওদেরই মহাজন। মহাজনদের প্রতি তীব্র অভিমান বিকৃত কামনা হয়ে মানবতার দিকে ধেয়ে আসে। যুদ্ধ বিরতিতে আমরা স্বস্তি পাই। ওরা ছটফট করে চলে। নরকেও ফুল ফোটে, নরকবাসীর অভিশাপ সে কখনো ফুল দেখতে পায় না। পায় না ফুলের গন্ধ। বুদ্ধ, চৈতন্য, রবীন্দ্রনাথ, লালন, গান্ধী, নজরুল তোমরা তোমাদের করুণা সর্বব্যাপ্ত করো। ওদের জীবনের রূপ রস বর্ণ গন্ধ দিয়ে জীবনকে মধুময় করো। মধুর করো আকাঙ্ক্ষা। যুদ্ধে স্বামীহারা হিমাংসী, বলিষ্ঠ লড়াকু দেশপ্রেমি সোফিয়া কুরেশি, বিক্রম মিশ্রি-এর মধ্যে অন্তত দেশপ্রেম খুঁজে পান তারা। ততটুকু চোখ, সেইটুকু দৃষ্টি এই দুর্দিনে প্রার্থনা করি।
কলকাতার গালগপ্পোর পঞ্চদশ পর্ব লিখলেন - কিশলয় জানা
কলকাতার হাটে-বাজারে
কিশলয় জানা
ডিহি কলকাতা নামক গ্রাম ‘কলিকাতা নগরী’ হয়ে ওঠার আগে এখানকার মানুষেরা নিজেদের সাধ্যমতো ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রয়-বিক্রয় করতেন কোথায়? শেঠ-বসাকেরা মুর্শিদাবাদ থেকে, মতান্তরে হাওড়া থেকে তাঁদের ব্যবসা এখানে সরিয়ে নিয়ে আসার পরে, তাঁরাই বা কোথায় করতেন সওদা? কলকাতায় তখন বিপণনের কোন আলাদা স্থান ছিল কী? সাধারণ বিকিকিনিই বা হত কোথায়? আজকের নানা শপিং-মল্ কালচারের যুগে এই প্রশ্নগুলি সঙ্গত কারণেই জেগে ওঠে। রমেশচন্দ্র দত্ত প্রথমবার যখন বিলেতে যান, বিলেত দেখে তাঁর মনে হয়েছিল, লণ্ডন যেন বিজ্ঞাপনের শহর। তিনি যদি উনিশ শতকের কলকাতা সম্পর্কে কোন লেখা লিখতেন, তাহলে হয়তো বলতেন, সে-কালের কলকাতা ছিল বাজারের শহর। তবে একদিনেই তো আর তা হয় নি। তবে অষ্টাদশ শতক থেকেই কলকাতার গুরুত্ব যত বাড়ছিল, ততই এখানে একের পর এক বাজার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল।
পুরানো কলকাতায় অর্থাৎ ষোড়শ শতকের কলকাতা ও সংলগ্ন গ্রাম তিনটিতে কোন বাজারের কথা জানা না গেলেও, এখানে যেহেতু ছোট হলেও জনপদ ছিল, অতএব সঙ্গত কারণেই ধরে নেওয়া যায় যে, বড় বাজার না-থাকলেও ছোট ছোট হাটের অস্তিত্ব ছিল। কলকাতার কিছু কিছু স্থাননামের সঙ্গে হাট শব্দটি পরেও থেকে গিয়ে তারই সাক্ষ্য বহন করে। যেমন— কয়লাহাটা (বর্তমানের কালীকৃষ্ণ ঠাকুর স্ট্রীট), গরানহাটা, চিংড়িহাটা, দয়েহাটা (দুটি এলাকার নাম ছিল দয়েহাটা। একটি বর্তমানের দিগম্বর জৈন টেম্পল স্ট্রীট, অন্যটি বর্তমানের ছানাপট্টি। কোন দহের ধারে অবস্থিত হাট থেকে এই নাম এসে থাকবে), দরমাহাটা, নাপতেহাটা (বর্তমানের প্রসন্নকুমার ঠাকুর স্ট্রীট), নাপিতবাজার (বর্তমান লেনিন সরণি), রুইহাটা (আপজনের মানচিত্রে জায়গাটির উল্লেখ আছে, প্রাচীন একখানি হাট যে ছিল সন্দেহ নেই। দেবাশিস বসু মহাশয় অনুমান করেন, বর্তমানে এর নামই হয়েছে মল্লিক স্ট্রীট), হাটখোলা ইত্যাদি। এগুলির সবক’টিই যে আঠারো শতকের আগে ছিল, তা না-ও হতে পারে, তবে পরবর্তীকালে এলাকার চরিত্র পাল্টে গেলেও তার পুরানো নাম থেকে অনুমান করা যায় ছোট হোক বা বড়, এখানে একটা হাট বসত। তবে বৃহত্তর অর্থে যাকে বাজার বলে, তা আঠারো শতকের আগে তা ছিল না বলেই মনে হয়।
১৮২০-তে হ্যামিলটন জানিয়েছেন, বাজারের সঙ্গে সঙ্গে হাটও বহাল তবিয়তে ছিল তখনও। তফাৎ এই, বাজার ছিল স্থায়ী, হাট বসত নির্দিষ্ট দিনে। অর্থাৎ পুরানো গ্রাম্য জীবনে হাট বসার যা নিয়ন ছিল, সপ্তাহে একদিন কী দু’দিন বড়জোর, তেমনই বসত সাবেক কলকাতায়। কোণ একটি ফাঁকা মাঠে মাথার উপর অস্থায়ী চালা বেঁধে কী না-বেঁধে হাটগুলি বসত। কিছু সাধারণ ব্যাপারি এবং ব্যবসায়ীরা হাটে সওদা কেনা-বেচার উদ্দেশ্যে আসতেন। অন্যদিকে বাজারগুলি ছিল নির্দিষ্ট জায়গায় অবস্থিত নিত্যদিনের কেনাবেচার জায়গা। যদিও বাজারেও স্থায়ী দোকানের পাশে কিছু বিক্রতাকে অস্থায়ীভাবে দোকানঘর ছাড়াই বিক্রিবাটা করতে দেখা যেত। হ্যামিলটন বলেছেন, এই সব বাজারে কী-না পাওয়া যেত? গাঁজা থেকে বাঁদর, নিত্য প্রয়োজনীয় সস্তা হরেকরকম জিনিসপত্র থেকে শস্য, পোশাক, খাবারদাবার ইত্যাদি সবই মিলত বাজারগুলিতে। সেগুলির পরিসর এবং সওদা করার ক্ষমতা অনেক বেশি ছিল। নাগরিক জীবনের উপযোগী জিনিষগুলি বাজারেই বেশি মিলত বলে কালক্রমে হাটের গুরুত্ব কমে যায়, বাজারের গুরুত্ব বাড়তে থাকে, ফলে হাটগুলি নিজেদের নামখানি কেবল রেখে নিজেরা মুছে যায় চিরতরে।
সি.আর. উইলসনের স্বাদু ও তথ্যসমৃদ্ধ বই ‘দ্য আর্লি অ্যানালস্ অব দ্য ইংলিশ ইন বেঙ্গল’-এর মত (বছর সাতেক আগে এশিয়াটিক সোসাইটি দুই খণ্ডে বইটির পুনর্মুদ্রণ করেছিলেন। উৎসাহী পাঠক বাংলার অতীতকে জানতে এই বইটি দেখতে পারেন।) মানলে বলতে হয় যে, ষোড়শ শতকের দিকে সপ্তগ্রাম বন্দর নাব্যতা হারালে বাণিজ্যিক স্থান হিসাবে তার গুরুত্ব কমে যায়, তখন হাওড়ার বেতোড় হয়ে ওঠে অন্যতম বাণিজ্য-অঞ্চল। মনসামঙ্গল, মুকুন্দ চক্রবর্তীর কাব্যে এই বেতোড়ের কথা পাওয়া যায়। কথিত যে, এই বেতোড়েই শেঠ-বসাকেরা ব্যবসা সরিয়ে আনেন। পরে কোন কারণে বেতোড় ছেড়ে তাঁরা চলে আসেন ডিহি-কলকাতার আশেপাশে, সেখানেই সুতো কেনাবেচার একখানি হাটের পত্তন করেন সেখান থেকেই সূতানুটির হাটের জন্ম হয়। কিন্তু শেঠ-বসাকদের মতো ধুরন্ধর ব্যবসায়ীরা হঠাৎ কী কারণে ডিহি-কলকাতার মতো জঙ্গল ও স্বল্প-জনপদ অধ্যুষিত এলাকায় ব্যবসা সরিয়ে আনলেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে গোবিন্দরাম মিত্রের সময়কার কলকাতার যে-কয়েকটি ছবি এঁকেছিলেন বিদেশী শিল্পীরা তার কয়েকটিতে ছোট বাজারের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। কোম্পানির তরফে অন্যতম জমিদার হলওয়েল তাঁর ‘ইণ্ডিয়া ট্রাক্ট’-এ (১৭৭৪) যে-সব বাজারের কথা বলেছেন, তাঁর বেশিরভাগই পলাশির যুদ্ধের আগেই গড়ে উঠেছিল। এই সব বাজারের মধ্যে আছে— বড়বাজার, বাগবাজার, হাটখোলা বাজার, শোভাবাজার, ধোবাপাড়া বাজার, চার্লস বাজার, শ্যামবাজার, নতুন বাজার, বেগমবাজার, ঘাসতলা বাজার, জননগর হাট এবং গোবিন্দপুর গঞ্জ বা বাজার। এই বাজারগুলির অনেকগুলিই পরবর্তীকালেও তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল, কিছু কিছু অবশ্য হারিয়ে গিয়েছিল নতুন বাজারের চাপে, আবার গোবিন্দপুর গঞ্জের মত একটি বড় বাজারকে, যেটি নদীর উপকূলে হওয়ায় অনেক সমৃদ্ধ ছিল, ‘গঞ্জ’ কথাটি তারই ইঙ্গিতবাহী, সেটিকে গিলে খেয়েছিল ফোর্ট উইলিয়ম কেল্লা। ১৭৫৮-এর পর এই তাগিদেই গোটা গ্রামটিকে তুলে দেওয়া হয়। কীভাবে ঔপনিবেশিক প্রভুরা নিজেদের স্বার্থের জন্য একটি সমৃদ্ধ গঞ্জকে ‘নেই’ করে দিতে পারেন, এটি তার একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ।
বাজারগুলির মধ্যে কোনগুলি পুরানো বাজার, কোনগুলি তুলনায় নব্য তা আজ আর সঠিক বলার উপায় নেই। এ-ব্যাপারে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেছেন, চেতলা হাট সবচেয়ে পুরানো (এটা অবশ্য কোন মতে মেনে নেওয়া যায় না। হতে পারে, গঙ্গার আদি স্রোতের পাশে থাকা এই স্থানে গঞ্জ মতো গড়ে উঠেছিল, কিন্তু এই রকম গঞ্জ আদি গঙ্গার যাত্রাপথে আরও অনেক ছিল, আর তাছাড়া টালি সাহেবের খাল কাটার আগে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে এই সংযোগ গড়ে ওঠে নি, ফলে চেতলা হাটের আদিত্বের যুক্তি দুর্বল।), কেউ বলছেন—শ্যামবাজার, লালবাজার আর খাসবাজার (এই খাসবাজারই হচ্ছে পরবর্তীকালের বড়বাজার), কেউ বলছেন সন্তোষ বাজার, মন্দির বাজারের কথা। ১৭৩৮ থেকে ১৭৫২ সালের মধ্যে কলকাতায় ২১ থেকে ২২ টি বাজারের কথা কেউ কেউ বলেছেন, কিন্তু এগুলির অনেকগুলিই ব্যক্তিগত বাজার কিংবা কোম্পানির তরফে নতুন করে কাউকে ইজারা দেওয়া বাজার অথবা কোম্পানির নথিপত্রে অনুল্লিখিত সাময়িক বাজার। এইগুলির সঙ্গে কোম্পানির নথিপত্রে তালিকাভুক্ত বাজারের কোন মিল নেই। আমরা সে-সমস্ত বাজারের নাম আগেই উল্লেখ করেছি।
গোবিন্দপুর গ্রাম উচ্ছেদের পরে গ্রামবাসীদের অনেককে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছিল। স্বামী বিবেকানন্দ, নবগোপাল মিত্র প্রমুখের জন্য পরবর্তীকালে বিখ্যাত হয়ে ওঠা সিমলে চজিল একখানি ছোট গ্রাম। ইংরেজরা গোবিন্দপুর এবং খিদিরপুরের উচ্ছেদ হওয়া অধিবাসীদের কাউকে কাউকে পুনর্বাসন দেওয়ার জন্য গ্রামটি কিনে নেয় এবং এখানে একটি সমৃদ্ধ পল্লী গড়ে ওঠে। জনৈক জগন্নাথ রায় ১৭৮১ সালের দিকে এখানে একটি ছোট বাজার গড়ে তোলেন। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট না হওয়ায় বছর তিন-চারেকের মধ্যেই (নভেম্বর, ১৭৮৪) এখানকার অধিবাসীরা গভর্ণর জেনারেলের কাছে একটি বড় বাজারের জন্য আবেদন করেছিলেন বলে জানা যায়।
তবে সিমলের বাজার সম্পর্কে অন্য তথ্যও পাওয়া যায় মহেন্দ্রনাথ দত্তের কলকাতা-বিষয়ক বইটি থেকে। তিনি জানিয়েছেন, মহেন্দ্র গোস্বামীর গলির ধারে কোন একটি শিমূল গাছের নীচে বাজার বসত। তবে সেই গাছটি ১৭৬০-এর আগেই লুপ্ত হয়ে যায়।১৮৮২-র পূজার পর থেকে শীতকাল পর্যন্ত বর্তমানে বেথুন কলেজের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে ছাতুবাবুর (আশুতোষ দেব) একটি মাঠ ছিল, সেখানে জেলে এবং সব্জির ফড়েরা বাজার নিয়ে বসতে থাকে। এই নতুন বাজারের সঙ্গে পুরানো বাজারের প্রায়ই ঝামেলা হতে থাকে, সম্ভবত এই বাজারটি স্থায়ী করার জন্যই সিমলের অধিবাসীরা আবেদন করে থাকবেন। পরে বেথুন কলেজ তৈরির সময় এই বাজারটি ক্রয় করা হয়, ফলে পুরানো সিমলের বাজারটি উঠে যায়।
কলকাতায় তখন তিন প্রকারের বাজার ছিল— এক. কোম্পানির নিজস্ব মালিকানাধীন এগারোটি বাজার, যথা— বড়বাজার, জানবাজার, বহুবাজার, লালবাজার, বৈঠকখানা, কসাইটোলা, ধর্মতলা, কলিম্বা, আরকুলি, জননগর হাট এবং রাজনগর হাট। দুই. ব্যক্তিগত মালিকানাধীন নয়টি মতান্তরে এগারোটি বাজার, যথা— নবকৃষ্ণের ব্যক্তিগত মালিকানায় তিনটি বাজার— সূতানুটির হাট ও শোভাবাজার এবং আরও নয়টি বাজার— গোপী ঘোষের বাজার, কাশীবাজার, রামবাজার, টিরেটার বগডেন বাজার, শেরবোর্ণের চাঁদনীচক বাজার, পূর্বোক্ত সিমলা বাজার, রাজা রাজবল্লভের বাগবাজারের গোলা, তালতলার হাট এবং দর্পণারায়ণ ঠাকুরের ব্রহ্মোত্তর বাজার। এর বাইরেও বাজার ছিল, যেমন—মেছুয়াপট্টি, মল্লিকবাজার, চীনা বাজার, ফেনউইকের বাজার, চার্লস শটের শট্’স বাজার। কোম্পানির প্রাথমিক যুগের তালিকায় এগুলি আশ্চর্যজনকভাবে অনুপস্থিত দেখা যায়। আর একটি বাজারের উল্লেখ মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখায় পাওয়া যায়। সেটিও ব্যক্তিগত মালিকানাধীন বাজার। এটিও কোম্পানির তালিকায় অনুপস্থিত। সেটি হল জোড়াসাঁকো এলাকায় লালাবাবুদের বাজার। এই বাজারটি খুব জমজমাট ছিল বলে মহেন্দ্রনাথ জানিয়েছেন। ফলে অনেকেই সেদিন লালাবাবুদের বাজারে জিনিসপত্র কিনতে ছুটতেন। পরে এখানে আর একটি বাজার, সম্ভবত দর্পনারায়ণ ঠাকুরের বাজার তৈরি হলে লালাবাবুদের বাজারটি উঠে যায়। বাজার নিয়ে, নতুন বাজার বসানো নিয়ে প্রায়ই এদেশীয়দের সঙ্গে কোম্পানির বিরোধ বাঁধত। এ-ব্যাপারে প্রাথমিক দিকে শিথিলতা দেখালেও পরে কোম্পানির অবস্থান ছিল কড়া। পলাশির যুদ্ধে ক্লাইভের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ব্যাঙ্কার হুজুরিমলের বড়বাজার এলাকায় একটি জমি ছিল। সেই জমিতে তিনি একখানি বাজার চালু করেন কোম্পানির অনুমতি না নিয়েই। প্রভাবশালী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর বাজারটি কোম্পানি ভেঙে দেয়। একই ঘটনা ঘটে আর-এক প্রভাবশালী রাজা রামলোচনের বৈঠকখানা বাজারের কাছে আরকুলিতে হঠাৎ তৈরি করা বাজারকে কেন্দ্র করে। রামলোচন ছিলেন কমিটি অব রেভিনিউ-এর প্রেসিডেন্টের বেনিয়ান। ফলে তিনি ভেবেছিলেন, কোম্পানি তাঁকে ছাড় দেবে। কিন্তু কোম্পানি প্রথমে বাজারটি তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেয়, না দিলে ভেঙে দেয়, রামলোচন আবার বাজার বসালে কোম্পানি তাঁকে শায়েস্তা করার জন্য তাঁর গোমস্তাদের ফাটকে পোরে, ফলে রামলোচনকে প্রভাবশালী হওয়া সত্ত্বেও মাথা নত করতে হয়। আরপুলির বাজারটি উঠে যায়।
এই সব বাজারের স্বাস্থ্য একরকম ছিল না। সাহেবপাড়ার বাজারগুলির রক্ষণাবেক্ষণের দিকে নজর রাখা হলেও নেটিভ টাউনের বাজারগুলি অবহেলিত ছিল। দেশীয়দের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন অধিকাংশ বাজারের স্বাস্থ্য এই কারণে বিশেষ সুবিধার ছিল না। তবে তাতে কোম্পানির কিছু যায় আসত না। কারণ বাজারগুলি থেকে বাৎসরিক শুল্ক কম আদায় হত না। হ্যামিলটন জানিয়েছেন (১৮২০), এই জাতীয় বাজারের সংখ্যা ছিল মোট তেরোটি এবং তার থেকে বাৎসরিক ১০,০৫০ টাকা আদায় হত। এর মধ্যে টিরেটা বাজার, শেরবোর্ণ বাজার এবং শর্ট’স্ বাজার নিরানব্বই বছরের জন্য লিজে দেওয়া হয়। উপরন্তু কোম্পানি এঁদের বাৎসরিক কিছু টাকা অনুদান হিসেবে দিত। প্রথম দু’জন পেতেন বাৎসরিক ৫০০ টাকা এবং শেষের জন বাৎসরিক ৮৩২ টাকা। আগের পর্বেই বলা হয়েছিল, টিরেটা লটারি কমিটির পুরস্কার জিতে বাজারটি পান, শেরবোর্ণও একইভাবে চাঁদনীচকের মালিকানা লাভ করেন। দেশীয় ব্যক্তিদের মালিকানাধীন বাজারগুলি অবশ্য স্বাভাবিকভাবেই কোন অনুদান পেত না।
বড়বাজার ছিল এই সমস্ত বাজারগুলির মধ্যে সর্বোত্তম। ফ্যানি পার্কস্ তো বড়বাজারে শাল ও মুক্তোর কালেকশন দেখে (১৮২৮) যুগপৎ হতভম্ব এবং আনন্দিত। মিসেস ফেনটনের অবশ্য কলকাতার সবকিছুর মত বড়বাজারও ভালো লাগে নি। বড়বাজারের প্রায়ান্ধকার সরু এবং নোংরা লেন তথা গলি, কিম্ভূতকিমাকার বাড়িঘর (যেগুলিকে মেমসাহেব বাড়ি বলতেই নারাজ) সেইসঙ্গেই অর্দ্ধনগ্ন কালো মানুষের দল—তাঁর একেবারে ভিরমি খাবার জোগাড় হয়েছিল। যদিও তার মধ্যেই তিনি বিক্রি হতে দেখেছেন প্রবাল, নানা দেবদেবীর মূর্তি, পাখির পালক, ফুল, চিনা সিল্ক ইত্যাদি। ১৮৩৮-এ বড়বাজারে ঘুরতে গিয়ে লে-ও জানিয়েছেন, সরু রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধ দোকানগুলি বড়জোর চার ফিটের। সামনের দিকে খোলা, ভিতরে যাওয়ার কোন উপায় নেই, সামনে দাঁড়িয়েই দরদস্তুর করতে হয়। তবে দোকানগুলির জিনিসপত্রের কোয়ালিটির তুলনায় দাম অবিশ্বাস্যরকমের সস্তা। শাল, সিল্কের রুমাল থেকে নকশাদার কাপড়—সবই মেলে নামমাত্র মূল্যে। দামের একটা ধারণাও দিয়েছেন তিনি। সিল্কের রুমাল সাত টাকা, একসঙ্গে সাতটি নিলে চৌদ্দ টাকা ; ভালো নকশাদার কাশ্মীরি শাল পঞ্চাশ পাউণ্ড থেকে শুরু। এমিলি ইডেন অবশ্য প্রায় একইসময়ে বড়বাজার ঘুরতে গিয়ে হতাশ হয়েছিলেন। বড়বাজারের জুয়েলারির কালেকশন দেখে তাঁর মোটেও ভালো লাগেনি। তবে যাঁর যাঁর যেমন অভিরুচি, তেমনই প্রতিক্রিয়া হবে সন্দেহ নেই। তবে এই বড়বাজারেই কিন্তু সেকালের সম্ভ্রান্ত বাঙালি-অবাঙালি সব ব্যবসায়ী এবং বাবুদের গদি বা কারবার ছিল। বড়বাজার ছিল ব্রিটিশ রাজত্বের অর্থনৈতিক কর আদায়ের একটি প্রধান উৎস। সারাবছর এখানে যা বিক্রিবাটা হত, তা অকল্পনীয়। হুতোমের লেখা যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন যে, বড়বাজারের ব্যস্ততার কী নিখুঁত চিত্র তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। অতএব বড়বাজারকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করাই যায়, কিন্তু একেবারে অস্বীকার কী নাকচ করা যায় না।
আর একটি বিশেষ বাজার কিংবা হাটের কথা উল্লেখ করেই আজকে হাটে-বাজারে পথ হাঁটা শেষ করব। সেটি হল— বটতলা। এতা অবশ্য স্থায়ী কোন বাজার ছিল না। কোম্পানির নথিপত্রেও এর কোন উল্লেখ নেই। কিন্তু বাংলার সমাজ ও সাহিত্যে, স্মৃতিকথায় এর উজ্জ্বল উপস্থিতি। হরেকরকম বইয়ের বাজার বসত বটতলায়, পাওয়া যেত রঙিন লিথোগ্রাফ বা ছাপাই ছবি। সপ্তাহে শনি ও মঙ্গলবার এই দুই দিন বসত এই বাজার। কিন্তু এই বটতলার বাজার কোথায় বসত তা নিয়ে এখনও কেউ একমত হতে পারেন নি। কেউ বলেন বৈঠকখানায় চার্ণক যে বটগাছের তলায় বসে সওদা সারতেন (কিন্তু সে গাছ অনেক আগেই কাটা পড়েছিল), কেউ বলেন গরানহাটায়, কেউ বলেন টালিগঞ্জের দিকে, কেউ বলেন আজকের কলেজ স্ট্রীটের কাছেই কোথাও। ১৮৫৩ সালে একটি বিশেষ কারণে ‘হিন্দু কালেজে’র উপর ক্ষিপ্ত হয়ে তৎকালীন হিন্দু-সমাজের নেতৃবৃন্দ বড়বাজারের সিন্দুরিয়াপট্টিতে ‘হিন্দু মেট্রোপলিটন কলেজ’ স্থাপন করেন। গুরুচরণ দত্তের ডেভিড হেয়ার একাডেমি এবং মতিলাল শীলের শীল’স্ ফ্রি কলেজ দিয়েই এর সূচনা হয়। এই মর্মে ‘সংবাদ প্রভাকরে’ যে সংবাদ প্রকাশিত হয় ওই বছরের সেপ্টেম্বরের দিকে, সেখানে ডেভিড হেয়ার একাডেমির অবস্থান হিসাবে বলা হয় “বটতলার মধ্যে”। হতেই পারে, সে-সময় একাধিক বটতলা ছিল, তবে আমাদের অনুমান, এটিই সেই বটতলা, যাকে কোন কোন বইতে “বান্ধা বটতলা” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে যাঁরা বলছেন, “বাঁন্ধা” মানে বটতলার নীচটি বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছিল চুন-সুড়কি-ইঁট দিয়ে, তাঁরা “বান্ধা” শব্দটি যে স্থায়ী অর্থেও ব্যবহৃত হয়, সে-কথা ভুলে যান। আমাদের অনুমান, আগে বটতলা ছিল ভ্রাম্যমান, পরে বটতলা স্থায়ী ভাবে নির্দিষ্ট দিন সিন্দুরিয়াপট্টির কাছের এই বটতলায় বসতে থাকে। আধুনিক বাঙালি সংস্কৃতির এই সেই আঁতুড়ঘর, যেখানে উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে ‘কলির বউ ঘর ভাঙ্গানি’, ‘ঘর থাক্তে বাবুই ভেজে’, ‘মোহান্তের এই কী কাজ?’, ‘বেশ্যারহস্য’, ‘রতিবিলাস’, ‘আচাভুয়ার বোম্বাচাক্’ ইত্যাদি কত না ছোট-মাঝারি আজকের ভাষায় চটি বই মিলত, তার ইয়ত্তা নেই। এই বইগুলি যদি না বেরুত এবং তার কিছু কিছু যদি না বেঁচে যেত, তাহলে আমরা জানতেই পারতাম না কলকাতা নামক ঔপনিবেশিক প্রদীপের তলায় কত না অন্ধকার, কত না কলঙ্ক বাসা বেঁধে ছিল।
ছোটদের ছবির জীবন্ত দলিল - অরিত্র দে
ছোটদের ছবি? সত্যি?
অরিত্র দে
একটি কিশোর ছেলে। একটি সাইকেল। উঁহু। একপাল কিশোর। আর তাদের একপাল সাইকেল। কিন্তু দেওয়ালে সাইকেল রেখে কার অপেক্ষায়? এ তো টো টো করে পাড়া বেড়ানোর বয়স! কিন্তু না, চোখ-মুখ কাউকে পাগলের মতো খুঁজছে। এবার তো আসার সময় হল? এখনো আসছে না কেন?
আজ কি তবে… ওই তো! ওই তো! কিন্তু একি? পলক পড়ছে না তো কারোর! আর রেনাতো যেন নিজের মধ্যেই নেই! এ কি অপরূপ সুন্দরী! যেন স্বর্গলোকের অপ্সরা! রেনাতোর রোজ নতুন করে নেশা হয়ে যাচ্ছে। সেই ঘোরেই দিন রাত হচ্ছে দিনরাত। কিছুতেই ভুলতে পারছে না। হয়তো ভুলতে চাইছেও না। কেনই বা চাইবে? বয়সে বড় হলেই কি বাকিসব মিথ্যে? অন্যের বউ হলেই কি নিজের মন মিথ্যে? রেনাতো এসবের পরোয়া করে না। অন্তত নিজের জগতে। তাই প্রতিরাতে তার স্বপ্নসুন্দরী ‘মালেনা’ আসে তার কাছে। প্রতিরাতেই কিশোর রেনাতো প্রাপ্তবয়স্ক হয়। স্বশরীরে। স্বপ্নে। মনে মনে।
ছবির গল্প যত এগোয়, মালেনার মায়ায় জড়িয়ে যায় আট থেকে আশি। তার সাথে একটু মুহূর্তযাপন যেন সাত রাজার ধন এক মানিক। মালেনা আসলে এমন এক চরিত্র যার পুরুষ ছাড়া চলবে না। যে ভবের হাটে সাহস বেচে সাহচর্যের দরদাম করে। তবে এই লেনদেন ধোপে টেকে না। তার পুরুষ সহচরদের গৃহিণীরা এবার একজোট হয়। মালেনাকে শিক্ষা দিতে তারা তাকে দাগী আসামীর মতো মারে, চুল কেটে দেয়। আমরা যারা রেনাতোর চোখে মালেনাকে দেখতে দেখতে মালেনার সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিই, তারা হঠাৎ চটকা ভাঙার মতো চমকে যাই। সেই ছোটবেলার নিষেধ না মানার শাস্তি আবার তাড়া করে আসে। বুঝতে পারি, ও যে মানে না মানা।
‘মালেনা’ ছবির পোস্টার ‘ছোটদের ছবি’র পোস্টার নয়। বরং এক ঝলকেই বড় করে দেওয়ার পোস্টার। এও আমাদের ছোটোবেলারই অভ্যেস। যেটা নিষেধ সেটারই নেশা করি। লুকিয়ে চুরিয়ে। তারিয়ে তারিয়ে। হাবাগোবা নাবালকও হঠাৎ সাবাশ সাবালক! এ ছবির প্লট শিশুসাহিত্য নয়। রূপকথা নয়। রহস্য নয়। রোমাঞ্চ নয়। ভয় নয়। অথচ সবগুলোই এ ছবিতে ঠাসা। ছোট হলে উপরি পাওনা জ্ঞানবৃক্ষের ফরবিডেন ফলের রস। সেই যুক্তিতে এ ছবি অনেক বেশি ছোটদের ছবি। কিন্তু গুরুদায়িত্ব গুরুজনদের। তাঁরা কি এ ছবি তাঁদের সুবোধ বালক-বালিকাদের দেখতে দেবেন? তাঁরা নিজেরাও কি দেখতে চাইবেন? অন্তত বুড়ো বয়সে ছোট হওয়ার টানে? বলা শক্ত।
‘মালেনা’ রিলিজ হয় ২০০০ সালে। আর সঙ্গে সঙ্গেই অগ্ন্যুৎপাত। ইতালিয়ান পরিচালক গুইসেয়ে টর্নাটোরেকে তুলোধোনা করা হয় মালেনা আর রেনাতোর অসমবয়সী ফ্যান্টাসি দেখানোর জন্য। ঠোঁটকাটা রজার এবার্ট বলেই ফেললেন, ‘মালেনা’ আসলে শুধুই একটা মেয়ের গল্প। এ মেয়ের দুর্ভাগ্য তার রূপ-যৌবন আর সুডোল একটা নিতম্ব। তাই তার জীবন দুর্বিষহ। এ ছবি হাজার চেষ্টা করেও এই সত্যিটা লুকোতে পারেনি। দি গার্ডেন গার্জেনদের সুরেই বলল, ‘মালেনা’ আসলে কিছুটা সাইরেন, কিছুটা মিউজ, আর পুরোটা বিপদ। অর্থাৎ একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেও আমরা নাবালক। দুধের শিশু। জুজুকে রীতিমতো ডরাই। আর ‘ছোটদের ছবি’র জন্যে বায়না করি।
যতবার ‘ছোটদের ছবি’ শব্দটা লিখলাম, ততবার ছোট হয়ে উঠতে পারলাম কি? উঁহু, শিং ভেঙে বাছুরের দলে ঢোকার ব্যর্থ চেষ্টাটা দিব্যি চোখে পড়ছে। আসলে বড় হওয়াটা সহজ, ছোট হওয়াটা গরজ। ‘ছোটদের ছবি’ বানানোটাও কি তাই? তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে গরজ নয়, কাঁচামনের প্রাণখোলা গর্জন, কিন্তু সে ছবি তো ছোটরা বানায়নি। বড়রা বানিয়েছেন। এবং ছোট হয়ে বানিয়েছেন। কিন্তু কতটা হয়েছেন? বা হতে পেরেছেন? গোদা বাংলায়, বড়দের ছবি যদি শুধুই বড়রা দেখেন, তাহলে ‘ছোটদের ছবি’ও তো শুধুই ছোটদের দেখার কথা। বোঝার কথা। বড়দের ছবি যদি বড়রা বানান, ‘ছোটদের ছবি’ও তো শুধুই ছোটদের বানানোর কথা। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি।
তখন বোধহয় ক্লাস থ্রি বা ফোর। অভ্যাস বলতে ফাঁকিবাজি। নেশা বলতে ‘রাজকাহিনী’ আর ‘গোসাইবাগানের ভূত’। বিনোদন বলতে দূরদর্শন। সাদাকালো বোকাবাক্স। একবার একসপ্তাহ ধরে কয়েকটা চলচ্চিত্র দেখানো হচ্ছিল ডিডি বাংলা চ্যানেলে। মজার ছবি। খোঁজার ছবি। তখনও ছবিকে ‘বই’ বলতাম। কিন্তু মুস্কিল হয়েছিল, ছবিগুলো সবই রাতে দেখানো হচ্ছিল। শেষ হতে হতেই দেড়টা-দুটো। আর একটা দুধের শিশুর রোজ রোজ চোখ কচলাতে কচলাতে মজা খোঁজাটা নেহাতই বালখিল্যতা। সেই তখনই প্রথম ‘বাবলা’ (১৯৫১) দেখি। ‘হংসরাজ’ (১৯৭৬) দেখি। দুজনের সাথেই একাত্ম হই। হাজার হোক শিশুমন। কাঁচামন। মনে হয়েছিল, আমার সাথেই যেন অমনটা হয়েছে। সেকিহুহু করে উঠেছিল বুকটা! সেই আমার প্রথম ছোটদের ছবি দেখা।
যে ছবিগুলোর পোশাকি নাম ‘ছোটদের ছবি’, তাদের জন্মেরও একটা ইতিহাস আছে। সেটা সবসময় ছবিগুলোর মতো খুশির নয়। রঙিন নয়। বরং ছবি থেকে ছোটদের দূরত্ব বজায় রাখার সামাজিক প্রচেষ্টা। এই প্রচেষ্টার ভালো-মন্দ আছে। প্রচার-অপপ্রচার আছে। শাসন-ভাষন আছে। অথচ গল্প বলা নতুন কিছু নয়। এদেশে সেই বৈদিক যুগ থেকেই চলছে। গুরুগৃহে গুরুর মুখে। বাড়িতে ঠাম্মার মুখে। ইস্কুলে টিচারের মুখে। কিন্তু এতদিনে মননের চোখ ফুটল। সে সহজ পাঠের স্থিরচিত্র দেখল। সে মায়ের কোলে বসে কালীয়দমন পালা দেখল। সে ইস্কুলে লুকিয়ে নীলছবি দেখল। সে ধরা পড়ে বোকা সাজলো। অচলায়তন ভাঙল তবু মচকালো না।
সময়টা ১৯১০। তখন চলচ্চিত্র নেহাতই দুধের শিশু। অথচ এরইমধ্যে শিশুদের জন্যে জুজু হয়ে উঠেছে। পশ্চিম রীতিমতো ত্রস্ত। তর্ক, যুক্তি, চিন্তা, পাল্টা যুক্তি। তারপর বড়রা একজোট হল। ছবি সেন্সর করতে হবে। আর ছোটরাও সব ছবি দেখতে যাবে না। ব্যাস, চলচ্চিত্র জন্মেই দেখে ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি। এই তরজাটা চললো প্রায় ১৯২০ পর্যন্ত। ১৯৩০ থেকে প্রতিবিপ্লব। ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের সমাজবিজ্ঞানীরা ছোটদের ছবির পক্ষে কথা বললো। ছবিতে ছোটদের শিক্ষণীয় দিকটা নিয়ে আলোচনা হল। সেই প্রথম ছবির ভাগ বাঁটোয়ারা হল। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য আলাদা ছবি। ছোটদের জন্য আলাদা ছবি। আর দুটোর স্বাভাবিক মিশেল পারিবারিক ছবি। ফি শনিবার করে ছোটদের জন্য শনিবারের ম্যাটিনি শো-এর ব্যবস্থা হল। চললো ১৯৮০ পর্যন্ত।
এই সত্তরটা বছর ছোটদের ছবির সত্তরের দশক। মুক্তির দশক। নির্বাক থেকে নির্বাণ। আমরা পেলাম চ্যাপলিনকে, বাস্টার কীটনকে, হ্যারল্ড লয়েডকে। কথা নেই। কিন্তু ছোটদের কথা আছে। ছোট হওয়ার কথা আছে। সেইসব কথা লরেল-হার্ডি পেরিয়ে ‘দি উইজার্ড অফ ওজ’-এও পৌঁছে গেল। রুপোলি পর্দার ম্যাজিক এবার একটা সুষ্ঠ রূপ পেল। সেটা আরো পেলব হল সাহিত্যের দর্পনে, সাহিত্যের দর্শনে। চার্লস ডিকেন্সের ‘অলিভার টুইস্ট’ একটা জলজ্যান্ত চলচ্চিত্র হল ডেভিড লিনের ক্যামেরায়। তারপর ঋত্বিক ঘটক ঘটালেন অঘটন, ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’। কার্টুনও আর স্থির থাকতে পারল না। দূরদর্শনে সিরিজ হয়ে এল ‘দি পিঙ্ক প্যান্থার শো’। সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় তৈরি হল ‘গুপী গায়েন বাঘা বায়েন’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ‘হীরক রাজার দেশে’। ততদিনে ফেলুদাকে আমরা অক্ষরে অক্ষরে চিনে ফেলেছি। এদিকে ‘চারমূর্তি’ নিয়ে টেনিদাও হাজির। সব দাদাগিরিকে ছাপিয়ে গিয়ে স্টিভেন স্পিলবার্গ উপহার দিলেন ‘ই. টি.’। আমরা চলচ্চিত্রার্পিত।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। অমল দইওয়ালা হতে চেয়েছিল। তারপর একদিন তারা বড় হয়ে গেল। ভাগ্যিস কেউ কেউ তাদের কথা ভেবেছিল! ভাগ্যিস কেউ কেউ তাদের জন্য লিখেছিল, এঁকেছিল, গেয়েছিল, চলচ্চিত্র তৈরি করেছিল। তার সবকটা কালজয়ী নয়। কিন্তু বেশিরভাগই বাল্যকালজয়ী।
দ্বিশততম জন্মবার্ষিকীতে বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কার তাঁর শিক্ষাসংস্কার -কুন্তল মুখোপাধ্যায়
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বাংলা থিয়েটার
কুন্তল মুখোপাধ্যায়
“ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়- বিদ্যাসাগর” এর দ্বিশততম জন্মবার্ষিকীতে বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কার তাঁর শিক্ষাসংস্কার, নারী শিক্ষার বিস্তার, ধর্মীয় গোঁড়ামীমুক্ত জীবনচর্চা প্রভৃতি অনেক বিষয়েই আলোচনা হয়েছে, এবং আলোচনা চলছে, সুতরাং বাংলা থিয়েটার ও বিদ্যাসাগরের বিষয়ে কৌতূহল জন্মাবে তা খুবই স্বাভাবিক। এই কৌতূহলের মূল কারণ দুটি। প্রথমতঃ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের থেকে প্রায় পঁচিশ বছরের ছোটো গিরিশচন্দ্র তাঁর ‘সীতার বনবাস’ নাটকটি বিদ্যাসাগরকে উৎসর্গ করেছিলেন, এবং এটাও সত্য যে ‘বিধবা বিবাহ’ নাটকটি দেখে বিদ্যাসাগর অভিভূত হয়েছিলেন। দ্বিতীয়তঃ বাংলা থিয়েটারে মহিলা অভিনেত্রীদের অন্তর্ভুক্তি বিদ্যাসাগর সুনজরে দেখেননি। এই দুই আপাতবিরোধী সত্য দর্শনে বাংলা নাট্যচর্চা সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের দৃষ্টিভঙ্গি কি ছিলো কৌতূহল নাট্যচর্চাকারী দের মনে সেই বিষয়ে প্রশ্ন জাগে। এই নিবন্ধে উক্ত প্রশ্নের সবিস্তার ব্যাখ্যা পাওযা যাবে না। তবে সামান্য এই আলোচনা, যদি ভবিষ্যত গবেষকদের আগ্রহ জাগিয়ে তোলে, সেই নিমিত্তে এই উপস্থাপনা।
বিদ্যাসাগরের জীবনী থেকে জানা যায় বিশেষ কোনো শখ নেই ঈশ্বরের। “তবে কবিগানের খুব শখ আছে। কোথাও কবি গান হলে ঈশ্বর শুনতে যায়। বীরসিংহে গেলে সমবয়সী ভাই বন্ধুদের নিয়ে কবি গান করে।” (ইন্দ্র মিত্র- করুনাসাগর বিদ্যাসাগর)।
আমরা জানি এবং মানি বাংলায় থিয়েটারের আবির্ভাব ঘটার আগে কবিগান, তরজা, পালাগান, ওড়িয়া যাত্রার বহুচর্চিত অভ্যাস ছিল, এবং বাংলা থিয়েটারের সূচনালগ্নে এদের প্রভাবও ছিল। গিরিশচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথ দুজনেই এই বিষয়ে সহমত ছিলেন। অর্থাৎ শৈশব-কৈশোরে ঈশ্বরচন্দ্র, তার পরবর্তী সময়ের সকল বালকের মত সংলাপ নির্ভর, সুরাশ্রয়ী কাহিনী বর্ণনে উৎসাহী ছিলেন, এবং উক্ত কাহিনী বর্ণনের নাটকীয়তায়ও তাঁর আগ্রহ ছিল।
ভাষাগত শিক্ষায় ঈশ্বরচন্দ্রের বুৎপত্তি, সর্বজনবিদিত। মনে রাখা দরকার, সংস্কৃত কলেজের লেখাপড়া সাঙ্গ করে নয়, সংস্কৃত কলেজে পড়তে পড়তেই ঈশ্বরচন্দ্রের নামের শেষে উপাধি দেখা গেছে। তাঁর শিক্ষকদের অনুমতিক্রমেই তিনি ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি পেয়েছেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে (১৮৪১ সাল) বাংলাবিভাগে পন্ডিতের চাকুরী শুরু করেন, সেখানে মার্শাল সাহেবের পরামর্শে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষা শিক্ষা শুরু করেন। দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলমাধব মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ন গুপ্তের কাছে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার পাঠ নেন এবং সেকস্পীয়রের নাটাগ্রন্থ সমূহ পাঠ করেন। ঈশ্বরচন্দ্রের এইসব পাঠের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি। তাই বোধহয় আমরা পরবর্তী কালে তাঁর ভাবানুবাদে কালিদাস ও সেকস্পীয়রকে পাই, ‘শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রা’ ও ‘ভ্রান্তিবিলাস’ (কমেডি অফ এররস) রচনায়। ১৮৭২ সালে বাংলাদেশে সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ঠিক একবছর পরে, ১৮৭৩ সালে উত্তর কলকাতার ধনী ও সম্মানীয় ব্যক্তি আশুতোষ দেব (কাতু বাবু) মহাশয়ের দৌহিত্র শরৎচন্দ্র ঘোষ বেঙ্গল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন। ঈশ্বরচন্দ্র, মধুসূদন এই থিয়েটারের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এরও আগে চিৎপুরের সিঁদুরিয়াপট্টিতে রামগোপাল মল্লিকের প্রাসাদে মেট্রোপলিটন থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয়। ঈশ্বরচন্দ্র মেট্রোপলিটন থিয়েটারের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ১৮৫৯ সালের ২৩ এপ্রিল ও ৭ মে এখানে উমেশ চন্দ্র মিত্রের ‘বিধবা বিবাহ’ নাটকটি পরপর দুই বার অভিনীত হয়। এই দু’বারই ঈশ্বরচন্দ্র ‘বিধবা বিবাহ’ নাটকের অভিনয় দেখেন, এবং দুঃখে চোখের জল ফেলেন। অবশ্য অনেকের মতে এই চোখের জল যতটা না অভিনয় উৎকর্ষের জন্য তার চেয়ে অনেক বেশী ‘হিন্দুনারীর চিরবৈধব্য ভোগের কুফল’ মঞ্চে প্রতিফলিত হতে দেখেই তাঁর এই অশ্রুপাত। তবে উক্ত নাটকাভিনয় সমসাময়িক কালের সমাজে এক ব্যাপক সাড়া জাগিয়ে দিলো। প্রথমতঃ এই নাটকের বিষয়বস্তু ও রচনা সেকালের পক্ষে একান্তই নতুন ছিল। দ্বিতীয়তঃ খি. হলবাইনের আঁকা দৃশ্যগুলি আকর্ষণীয় ছিল। তৃতীয়তঃ অভিনয় হয়েছিল মোটামুটি উচ্চাঙ্গের। চতুর্থত, এই নাটকের গানগুলি সুগীত হয়েছিল এবং দর্শকদের মনোরঞ্জন করেছিল। ঈশ্বরচন্দ্র অবশ্যই বিষয়বস্তুতে বেশী আকর্ষিত হয়েছিলেন।
সমাজ সংস্কার ও নারীশিক্ষার প্রসারে ঈশ্বরচন্দ্রকে যারা সহায়তা করেছিলেন, তাদের মধ্যে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন অন্যতম। ঈশ্বরচন্দ্রের থেকে সাত বছরের বড় হয়েও তিনি ঈশ্বরচন্দ্রকে শ্রদ্ধা করতেন। ঈশ্বরচন্দ্রও তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন। এই পারস্পরিক শ্রদ্ধার মূল উৎস ছিল— (ক) হিন্দু সমাজের গোঁড়ামি, (খ) ইংরেজি শিক্ষার কুফল (গ) নব্য শিক্ষিত তরুণ সমাজের উৎশৃঙ্খলা। বিনয় ঘোষ বলেছেন, “বিদেশী মিশনারীদের প্রতি বিদ্যাসাগরের কোন শ্রদ্ধা ছিল না। দেশীয় খৃষ্টধর্ম গ্রহণকারীদেরও তিনি কঠোর সমালোচনা করেছেন। ব্যতিক্রম দু’জন কৃষ্ণমোহন ও মধুসূদন। ব্যিদাসাগর মহাশয় সংস্কারপন্থী কৃষ্ণমোহনকে শুধু ভালোবাসতেন না, শ্রদ্ধাও করতেন। বিশেষ নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের প্রকাশ্য সমর্থক ছিলেন খ্রিস্টান কৃষ্ণমোহন।” আমরা এখন প্রত্যেকেই জানি, আধুনিক বাঙালির প্রথম নাটক কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দ্যা পার্সিকিউটেড” (১৮৩১), ‘ডেডিকেশন টু হিন্দু ইউথস্’ – এই বাক্যবন্ধে ইংরেজি ভাষায় বাঙালির রচিত প্রথম ভারতীয় নাটক। রামনারায়ন তর্করত্নের ‘কুলীন কুলসর্বস্ব’ (১৮৫৪) বা তারাচরন শিকদারের ‘ভদ্রার্জুন’ (১৮৫২) এর আগে সংস্কারধর্মী এই নাটক দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর অগোচরে ছিল। এই নাটক যখন কৃষ্ণমোহন লিখেছেন তখন ঈশ্বরচন্দ্র এটির বিষয়ে কিছু জানতেন না। তবে পরবর্তী সময়ে কৃষ্ণমোহনের সংস্কারধর্মী কাজের সঙ্গে যখন তিনি পরিচিত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরী হয়েছে, তখন তিনি এই নাটকটির বিষয়ে কিছু জানতেন না, এমনটি ভাবতে দ্বিধা হয়। তবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকাররা বা স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
নাট্যমঞ্চের ও নাট্য অভিনয়ের সঙ্গে যে ঈশ্বরচন্দ্রের কোনো অসদ্ভাব ছিল না, তা জানা যায় মধুসূদন ও তরুণ গিরিশচন্দ্রের কথাবার্তায়। ১৮৬২ সালে মাইকেল তাঁর বীরাঙ্গনা কাব্য উৎসর্গ করেন ঈশ্বরচন্দ্রকে। ১৮৮০ সালে গিরিশচন্দ্র তাঁর তৃতীয় নাটক রচনা করেন, ‘সীতার বনবাস’। নাটকটি তিনি ঈশ্বরচন্দ্রকে উৎসর্গ করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বাংলা নাট্যমঞ্চের, নাট্য অভিনয়ের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বলেই গিরিশচন্দ্র তাঁকে নাটক উৎসর্গ করেছিলেন। নাটক উৎসর্গ তাঁকেই করা যায়, যিনি নাট্যকারের শ্রদ্ধার পাত্র ও উৎসাহদাতা। অনুৎসাহী, শ্রদ্ধা-বর্জিত কোনো ব্যক্তিকে নাট্যগ্রন্থ উৎসর্গ করা হয় না। কথিত আছে, কোনো এক রাতের অভিনয়ে গিরিশচন্দ্রের নারী উৎপীড়নের ভূমিকায় অভিনয় দেখে ঈশ্বরচন্দ্র তার উদ্দেশ্যে চপ্পল নিঃক্ষেপ করেন। গিরিশচন্দ্র অভিনয় থামিয়ে সেই চপ্পল মাথায় ঠেকিয়ে বলেন, এ পুরস্কার তার অভিনয় জীবনের সেরা পুরস্কার। অন্য এক কথনে উল্লিখিত হয় নীলদর্পণ নাটকে অর্দ্ধেন্দু শেখর মুস্তাফির রোগ সাহেবের অভিনয় দেখে ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর উদ্দেশে চপ্পল নিঃক্ষেপ করেন। যাই হোক না কেন, ঈশ্বরচন্দ্র যে নিয়মিত নাট্যদর্শক ছিলেন, এই ঘটনা তার প্রমাণ দেয়। বর্তমান নাট্য কর্মীরা এই ভেবে খুশী হবেন যে গিরিশ অর্দ্ধেন্দু স্তানিসলাভস্কি’র পদ্ধতি (যদিও তা সেইসময় তাঁদের কাছে অজানা ছিল) তেই অভিনয় করতেন, এবং ওই অভিনয় নভেম্বর-ডিসে ঈশ্বরচন্দ্রের মত বিদগ্ধ মানুষের প্রীতিরও কারণ হয়েছিল।
একটি বিতর্কিত বিষয় নিয়ে মতান্তরের সূত্রে ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে বাংলা নাট্যমঞ্চের বিচ্ছেদ ঘটে। আগেই উল্লিখিত হয়েছে, বেঙ্গল থিয়েটার প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই (১৮৭৩) ঈশ্বরচন্দ্র, মধুসূদন, দেবব্রত শ্রমী, উমেশচন্দ্র দত্ত সকলেই উক্ত থিয়েটারের পরামর্শ সভার সদস্য ছিলেন। মধুসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকের অভিনয়ের সময় মহিলা চরিত্রে মহিলা অভিনেত্রীদের অংশগ্রহণ করার বিষয়টি উত্থাপিত হয়। মাইকেল মধুসূদন এই বিষয়ক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। মধুসূদন এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে স্ত্রী চরিত্রে পুরুষদের দিয়ে অভিনয় করালে, কখনই তা স্বাভাবিক অভিনয় হতে পারে না। শরৎচন্দ্র ঘোষ (সাতুবাবু) এই অভিমত সানন্দে গ্রহণ করেন। শুরু হয় তর্ক-বিতর্ক। নানা সংবাদপত্র বিভিন্ন মত প্রকাশ করতে থাকে। স্থির হয় সুকুমারী (গোলাপ) শর্মিষ্ঠার চরিত্রে অভিনয় করবেন। ঈশ্বরচন্দ্র বারাঙ্গনাদের মঞ্চাভিনয়ের বিষয়টির বিরোধিতা করেন, এবং এ ব্যাপারে বিরুপ অভিমত প্রকাশ করেন। রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার সময় তাঁর যে সমর্থন ছিল, তা তিনি প্রত্যাহার করে নেন, এবং সেই সঙ্গে রংঙ্গালয়ের সংশ্রব পরিত্যাগ করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র স্ত্রী শিক্ষা প্রসারে এই বঙ্গে ভগীরথ। ‘বিধবা বিবাহ’ ও অন্যান্য সামাজিক সংস্কারে তিনি অগ্রগণ্য ভূমিকা নিয়েছেন। কিন্তু মহিলাদের অভিনয়ে অংশগ্রহণে তিনি বিরুপ। অনেকের মতেই, এ এক অদ্ভুত প্যারাডক্স। কিন্তু প্রত্যেক ঘটনাই কার্য-কারণ সম্পর্কে বিবেচিত হওয়া উচিত। ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন পরম যুক্তিবাদী, সংস্কারবাদী। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষিত নব্য তরুনদের অনেক কার্যকলাপকে তিনি নিছক নকলনবিশী বলে মনে করতেন ও অপছন্দ করতেন। নারী জাতির অবমাননা তাঁর কাছে দুঃসহ ছিল। তিনি মনে করেছিলেন, মহিলাদের নাট্যমঞ্চে নিয়ে এলে যে দেখুনেপনা ও বেলেল্লাপনা শুরু হবে, তাতে নারীজাতির অবমাননাই ঘটবে। নারীর স্বাধীনতার কোনো উন্মেষ ঘটবে না। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রসূত বাবুশ্রেণী, ধনী জমিদার তনয়ারা মহিলা অভিনেত্রীদের যতটা সম্মান দেবে, ততোধিক তাদের উপপত্নী হিসেবে বিবেচনা করবে। পতিতা আলয়ে গমন না করেও ধনী বাবু সম্প্রদায়েরা বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের সম্মানহানি করে, রঙ্গমঞ্চকেই হয়ত বা পতিতালয়ে পরিণত করবে। ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে শিক্ষার মাধ্যমে নারীজাতির উন্নয়ন সম্ভব, নাটকে অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে নয়। নাটক, তাঁর সময়ে শুধুমাত্র বিনোদনেরই বাহন। সেই যুগের সমস্ত অভিনেত্রীদের সুকুমারী, বিনোদিনী, কুসুমকুমারি, তিনকড়ি, তারাসুন্দরীদের জীবনযাপন, রঙ্গমঞ্চের বাবু ও মালিকদের নিবন্ধ তাদের সঙ্গে আচরণ ঈশ্বরচন্দ্রের অনুমানের উপযুক্ত সাক্ষ্য দেয়। ‘নাটকে লোকশিক্ষে হয়’ গিরিশচন্দ্রকে উল্লেখ করে রামকৃষ্ণের এই মহতী বানী উচ্চারণ এই ঘটনার অনেক পরের ঘটনা। পরবর্তী সময়ে বিনোদিনী, তিনকড়ি, তারাসুন্দরী, প্রমুখেরা নাট্য অভিনয়ের মাধ্যমেই তাঁদের ব্যক্তিত্ব উন্মোচনের সুযোগ ঘটেছে বলে মন্তব্য করেছেন। অবশ্য সেই সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের আত্মজৈবনিক কলহে জানা যায় রঙ্গমঞ্চে কিভাবে তাঁরা মানসিক ও শারিরীক অবমাননার শিকার হয়েছেন। সূচনালগ্নে অবজেক্টিভলি ঈশ্বরচন্দ্র যেরূপ আশংকা করেছেন, এমনটিই ঘটেছে। পরবর্তীতে সাবজেক্টভলি মহিলা অভিনেত্রীরা অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে নাটমঞ্চ ও নাটকে অভিনয়ে যে পরাধীনতা মুক্তির আনন্দ পেয়েছে, সূচনালগ্নে ঈশ্বরচন্দ্রের পক্ষে তা অনুধাবন করা সহজ ছিল না, এটা মানতেই হবে।
“পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়” এই আপ্তবাক্যের স্বীকৃতি দিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র প্রখ্যাত অভিনেতা উপেন্দ্রনাথ দাস ও তাঁর পিতা শ্রীনাথ দাসের পারিবারিক বিবাদের মধ্যস্থতা করেন। উপেন্দ্রনাথের থিয়েটার করা ও সুকুমারী গোলাপ সুন্দরীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কারণ ও উপেন্দ্রনাথের অন্যান্য আচরণের জন্য শ্রীনাথ দাস এবং তস্যবন্ধু স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর প্রতি বিরুপ ছিলেন। দারিদ্র ও ক্ষয় রোগের কারণে উপেন্দ্রনাথ তখন খুবই বিব্রত। শেষপর্যন্ত শিবনাথ শাস্ত্রীর চেষ্টায় ঈশ্বরচন্দ্র উপেন্দ্রনাথের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন। উপেন্দ্রনাথকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য ঈশ্বরচন্দ্র শ্রীনাথ দাসকে নানাভাবে বুঝিয়ে শেষপর্যন্ত পিতা-পুত্রের মিলন ঘটান। বাংলা রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠার (১৮৭২) প্রায় প্রাথমিক পর্বে ঈশ্বরচন্দ্রের নাটকের সংঙ্গে প্রীতির সম্পর্ক যে পরবর্তীকালে দূরত্বের ব্যবধানে পর্যবসিত হয়েছিল, তা বুঝতে গেলে সেই সময় ও সামাজিক ঘাত-প্রতিঘাতকে উপলব্ধি করতে হবে। বঙ্গের আদি অভিনয় চর্চা (পালাগান, তরজা, কবি গান) ঈশ্বরচন্দ্রের পছন্দের বিষয় ছিল, কিন্তু থিয়েটার যা রমেশচন্দ্র মজুমদারের ভাষায়, ‘সোশ্যাল রিলেশানস্ উইথ ইংলিশমেন’ সেই ব্যাপারটিকে এবং অভিনয়ের নামে নারীত্বের সামাজিক-দৈহিক অবমাননাকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। এই দ্বান্দ্বিক অবস্থানে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বাংলা থিয়েটারকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। আর এমন তো কথিতই আছে- ‘নো কনফ্লিক্ট, নো ড্রামা’।
‘ডানা’য় লেখো গান, সে গান বেঁচে যাবে - সায়ন ভট্টাচার্য
‘ডানা’য় লেখো গান, সে গান বেঁচে যাবে
সায়ন ভট্টাচার্য
‘‘দিন, এই ভাবেই যাবে। শুধু মুহূর্তের ভুলে ট্রেন
ফস্কাবে না প্রতিদিন, বাধ্যতামূলক অবসর
থাকবে না প্রতিদিন, পরের ট্রেনের অপেক্ষায়।’’
(‘চতুর্দশপদী’,/ অনির্বাণ ধরিত্রীপুত্র)
সাইকেলের চেন আর প্ল্যাটফর্ম ছিঁড়ে ট্রেন বার হয়ে যাওয়ার মধ্যে একটা ‘পড়ে যাওয়া’ থেকে যাও— সাইকেলের চেন ‘পড়ে যাওয়া’ কিংবা মনের মধ্যে ভয়— ওই সামান্য চাকরিটা হাত ছুট হয়ে যাবে না তো! গোপীনাথ ভাবে আবার আজ ছুটি হয়ে গেল, মানে বউয়ের মুখ ঝামটা, মেয়ের অনেক বড় চাহিদা, ছেলের চাকরির জন্য ঘুষ না হলে বাপের গায়ে হাত তোলা, খিস্তি— এই সব ভাবতে ভাবতে পর্দা খুলে যায় একাডেমিতে, মঞ্চে সংশপ্তক-এর প্রযোজনা ‘ডানা’, নাটক ও নির্দেশনা কৌশিক চট্টোপাধ্যায়।
শুধু কলম নয়, পর্দা খুললেও সব হিংসা চলে যায়। ‘ডানা’র ভরকেন্দ্র অপেক্ষা। একটা নিজের ভিতরে সৎ আমিকে খুঁজে পাওয়ার অপেক্ষা। ডানার কাজও তো বায়ুর উপর ভর করেই উঠে যাওয়া শুধু নয়, ভেসে যাওয়া— যাকে তুমি খুব নিচ থেকে দেখতে চাইছ মাধ্যাকর্ষণের আলিঙ্গনের মধ্যে, দেখতে চাইছ ক্ষমতার অমোঘ মাকড়সা-জালে, সেই মানুষটাই যখন সমস্ত ‘অপেক্ষা’গুলোকে জীবনের গোপন বাক্স থেকে লুকিয়ে বার করে ছুঁড়ে দেয়— তখন তাইই হয়ে যায় আকাশ, সেই আকাশ শুধুমাত্র তার। এখানেই তাঁর প্রতিবাদ, তাঁর প্রেম, এভাবেই তিনি বিদ্রোহী। এমনই এক বিদ্রোহের নাম গোপীনাথ।
“অতিকায় প্ল্যাটফর্ম পড়ে থাকবে— কাগজের রাশি— শুকনো খড়” বড্ড জিতে যেতে ইচ্ছে করে তাই না? জিতে যাওয়াটা যতটা মানুষের ‘আপন’, জয়ের সূচক ও সংজ্ঞা যে ততটাই নিজের নয়। জয়ের নির্দেশ তো দেবে সমাজ, তাদের চোখে মান্যতা পেতে হবে মানুষকে— কে জয়ী, আর কেইবা পরাজিত! আসলে মানুষ ক্লান্ত ফুসফুস নিয়ে বাঁচিয়ে রাখে হৃদয়ের এক গোপন লালসা- তার নাম ‘জয়’, আর সেই লালসার ঘূর্ণিঝড় ছিন্ন হলেই খুঁজে পাবে তার ডানা। নাটকের দ্বান্দ্বিক বিন্যাস যেন অমোঘ দীপন।
ওভারব্রিজের কিনারায় দাঁড়িয়ে নিচের দিকে নজর রাখা মানুষ, যার চিন্তাভার সেতুর সীমান্তে ঝুলিয়ে রেখে কৌশিক চট্টোপাধ্যায় তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন, আর নিজেই পরিবর্তন করছেন নিজেকে।
নাট্যকে করে দিয়েছেন জীবনমুখী গান। যাকে ভরা ট্রেনে, বা বাসে বা মেট্রোয় লড়াই করতে করতে কোনোমতে হিংস্র শ্বাপদের মতো কর্মক্ষেত্রকে টিকিয়ে রাখতে হয়, বাঁচাতে হয় সংসার নামক বিরাট অগ্নিকুন্ড; তাদের হৃদয়ের এক একটা অনন্দ নিয়ে পুঁতির মালা গেঁথে গেছেন নাট্যকার গোটা নাট্য জুড়ে। যারা হলের মধ্যে পৌঁছতে পারল না গোপীনাথ তাদের ক্ষয়, ব্যর্থ প্রেম, মধ্য রাতের চাপা কান্না, বাজারের হতাশা, বসের দিনের পর দিন থ্রেট, সংস্কৃতিক ক্ষেত্রে দাদা-দিদিদের তেল মারতে না পেরে ব্যর্থ হয়ে বিষ খাওয়া মানুষগুলোর এক একটা কোষ দিয়ে নিজের চরিত্রটা তৈরি করে নিলেন। এই গোপীনাথের চরিত্রে বুদ্ধদেব দাস যেন এক মায়াভরা আগুন লিপি। যার শরীরের মধ্যে বাসা বেঁধেছে জীবননগরে ভাষা।
কে লিখবে এই জীবন, তাই তো একজন নাট্যকার চাই— তিনি এলেন, তিনি সমস্ত ‘সিরাজদৌল্লা’, ‘রানা প্রতাপ’ সবাইকে বাদ দিয়ে সেই মানুষটাকে খুঁজে বার করলেন যিনি শান্তিপুর থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে শান্তিপুর ঘাড়ের উপর মাথাটা বয়ে নিয়ে বেড়ান। আমাদের অবিশ্বাস্য মনে হয়— গোপীনাথের মতোই আমাদের যদি কেউ বলত— “রোজ রোজ অফিস কিসের বলুন তো। এক একদিন অন্যরকম কিছু করতে পারেন না— একেবারে আলাদা— অন্য কিছু—”, কতটা ভয় লাগত শুনে তাই না? তবুও তো চাই বলুন, এই ‘হয়ে ওঠা’, এমন ঘুড়ি হয়ে আকাশ পার হয়ে যাওয়া, চাই আবার সেই পুরনো ডায়েরির কবিতার শরীরের ঘ্রাণ নিতে।
প্রতিটি মানুষের অন্তরে থাকা স্বাধীন যে মানুষ, তার চেয়ে বড়ো ক্ষমতাবান, বিরাট আকার নিশ্চয়ই শাহেনশা নন। তাকে ভেঙেচুরে, হামাগুড়ি দিয়ে, শরীর ছিন্নভিন্ন করে বার করতে চায় গোপীনাথ, যেভাবে মানুষ অবচেতনে মারে নিজেকে, গভীর রাতে চোখ ভরে ওঠে জলে— যেন নাট্যের চরম দ্বন্দ্বের আলো ছড়িয়ে যায় সমাজের কোনায় কোনায়।
কৌশিক চট্টোপাধ্যায়ের এমন কাব্যিক অথচ জীবন বিক্ষুব্ধ নাট্য নির্মাণ দেখতে দেখতে মনে পড়ে যায় মহাকবি ব্রেশট-এর অমোঘ বাণী— ব্যর্থ সেই দেশ, যাদের নায়কের প্রয়োজন হয়। তবুও আমরা নায়কের খোঁজ করি, আমাদের ভিতরের নায়কটাকে বার করে আনতে গেলে প্রয়োজন হয় কল্পিত এক নায়ক, যিনি হেরে যান না, হারতে হারতেও তাঁকে জিতে যেতেই হবে। এই মিথ্যা ‘কালঘুম’-এর মধ্যেই যে মানুষগুলোর অবদান চারপাশে এতটাই গভীর, তাদেরকে কোনও ভাবে ধর্তব্যের মধ্যেই রাখি না। আর রাখি না বলেই পৃথিবীজুড়ে ঘটে যায় বিশ্বযুদ্ধ, গাল্ফ যুদ্ধ, কারগিল, নোয়াখালির দাঙ্গা, ইরাক যুদ্ধ, আফ্রিকায় অ্যাপারথেইড, কাশ্মীর সন্ত্রাস, প্রতিদিন আরও আরও বেড়ে চলা ধর্ষণ। কিন্তু গোপীনাথ বলতে পারেন তাঁর মেয়েকে— “জোর করে ঘুমোলাম না। ডানা পাহারা দিতে হবে না! আচ্ছা তোরা আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চাস কেন রে?”
একটা ভালো থিয়েটারের দায় কী থাকে— তার একমাত্র দায় মানুষের কথা তৈরি করতে পারছেন কিনা, মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারছে কিনা— সংলাপহীন হয়ে যাচ্ছে বলেই তো সমাজটা বড্ড একে অপরের কাছে এখন বড় অচেনা। পড়শিকে হত্যা করার নেশায় মেতে উঠছি নিত্যনতুন অস্ত্র ভাণ্ডার ভরিয়ে। ওই একটাই কারণে আমরা সংসার থেকে সম্পর্ক; কোনোটাই বাঁচাতে পারছি না। গনগনে আগুনের আঁচে যদি একটু মনের বাস্তবতা থেকে সরে গিয়ে মানুষের হৃদয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াই, যদি একটু গুটিয়ে রাখা ডানাটা মেলে ধরি, তাহলেই দেখবো গোপীনাথের চাঁদু-র মতো কোমল প্রেমের আলিঙ্গন সুখ বাঁচিয়ে রাখবে পথ চলার জন্য, এই ডানা একান্ত নিজের, আমার আপনার। এই ডানার খোঁজ একজন প্রেমিকা দিতে পারে চাকরি না পাওয়া প্রেমিককে, দিতে পারে একজন বাবা তার মেয়েকে, একজন হেরে যাওয়া ছাত্র-ছাত্রীকে তার শিক্ষক দিতেই পারে।
‘ডানা’ তিনবার প্রযোজনা করা হয়, একদম ৯০ দশকের শেষের দিকে বোধহয় ৯৯, এরকম সালে ‘শান্তিপুর সাংস্কৃতিকে’। তখন পালান কুন্ডু করত গোপীনাথ। তারপর বছর পাঁচ কি সাত আগে প্রসেনজিৎ বর্ধন করতো ‘সংশপ্তক’র প্রযোজনায় ডানা। আর তারপরেই নতুন ডানা যেটা নামলো, এই ২৪শে মে বুদ্ধদেব দাস অভিনয় করল।
কৌশিক চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “চিরকালই থিয়েটারের রিয়ালিজম আমাকে খুব বেশি টানে না ন্যাচারালিজম খুব বেশি টানে না। আমি আমার যত নাটক করেছি তাতে খুউব ন্যাচারালিস্টিক খুউব রিয়ালিস্টিক নাটক প্রায় করিইনি মনে হয়, করলেও দু’চারটে কিন্তু তার ভেতরেও অনেক ভাঙচুর থাকে অনেক কিছু থাকে। আমাকে বরঞ্চ নন রিয়ালিজম অনেক বেশি টানে, আমাকে থিয়েট্রিক্যালিজম অনেক বেশি টানে।” একটা ঘর বাড়ির সেট, দেয়াল জানলা দরজা করতে ইচ্ছা করে না তৈরি করে তাঁর , কৌশিক মুক্ত করতে থাকেন মঞ্চ অনেক বেশি।
কৌশিক চট্টোপাধ্যায় ঠিক কোন মুহুর্তে এমন একটি নাটক তৈরি করলেন শোনা যাক— “আমাকে থিয়েট্রিক্যালিজম টানে বেশি, নন রিয়ালিজম টানে বেশি। ফলত যে সময়ে ডানা লেখা সেই সময় আমার মনে আছে আমি তখন খুব জার্মান এক্সপ্রেসনিজম নিয়ে পড়াশোনা করছিলাম, ভাবছিলাম এবং তখন বারবারই মানুষের ভেতরের মানুষ তাকে কানেক্ট করা, মানুষের ভেতরে যে মানুষটা থাকে যাকে দেখা যায় না বাইরে শোনা যায় না, দৈনন্দিনতায় যে আবদ্ধ তার বাইরেও একটা অন্য কেউ আছে, সেই মানুষটাকে খুঁজে বেড়ানোটার একটা নেশা জেগে বসেছিল, আজও সেই নেশাতেই খুঁজে বেড়াই। আমাকে সব সময় মানুষের অন্তরের লীলা অনেক বেশি টানে ভেতরের মানুষটা আমার কাছে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং তাকে প্রকাশ করা এবং এই সোসাইটি কে এই জগতকে আমি যেভাবে দেখি এটা খুব দৈনন্দিনতার সাপেক্ষ প্রোপাগান্ডার মত আজকের ইস্যু কালকের ইস্যু করে দিয়ে এরকম আমি করতে পারিনা। আমার একটা লিরিক দরকার হয়, আমার একটা কবিতা দরকার হয় একটা ভেতরের এক্সপ্রেশন দরকার হয় একটা ইনসাইট দরকার হয়। এই সবগুলো মিলেই ডানা গড়ে ওঠা, যে কারণে ডানাতে ওরা বড় থেকে ছোট হয়ে যায়, ছোট বয়সের ট্রমা ফিরে আসে ফেলে আসা দিন ফিরে আসে, ছোট বয়সের অত্যাচার ফিরে আসে, বুলিং ফিরে আসে এবং হেরে যাওয়া মানুষ আমাকে চিরকাল টানে, ভাঙাচোরা মানুষ আমাকে চিরকাল টানে আর ডেলি প্যাসেঞ্জার আমাকে ভীষণ টানে কারণ আমি সারা জীবন ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করেছি বিভিন্ন সময়ে। রাত্রি ৯:৫০ এর ট্রেন ভরে ফিরি রাস্তায় কুকুর আর ছায়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতে। আর আমি ছোটবেলা থেকে আমার মামাকে দেখেছি ডেলি প্যাসেঞ্জারি করতে। অনেক রাত্তিরে মাইমা দাঁড়িয়ে থাকতো। মাইমা জানলায় হ্যাঁ গো, ট্রেন এলো? তখন ট্রেন প্রায় লেট থাকতো, মানুষটা ফিরলো না এখনো। ফলত আমার বিভিন্ন নাটকে ডেলি প্যাসেঞ্জার ফিরে ফিরে আসে। এরা সকালে বেরোয় রাতে ফেরে, এরা কখন ছেলে বড় হয়ে যায় দেখতে পায় না। তা সেই সাধারণ মানুষ, সেই কিছু না হতে পাওয়া মানুষ, এই যে না হওয়া মানুষ ভাঙাচোরা মানুষ তাদের ভেতরের কোনো একটা জোরকে খুঁজে পেলে আমার আনন্দ হয়, তাদের কোথাও একটু উত্তরণের পথ দেখাতে পারলে বা তাদের পথ থেকে নিজেকে দেখতে পেলে একটু আনন্দ হয় এই সবগুলো মিলেই ডানা তৈরি করা। এইটুকুই আপাতত তোকে বলবার।”
নাট্যের মধ্যে একটা সাইকেল তাই বার বার ফিরে আসে, তার গতির কাছে জীবনের যে চ্যালেঞ্জ, সমাজ যাদের মাজা ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করে, আর দিনের শেষে যে গোপীনাথের মতো বাবারা ছেলের হাতে মার পর্যন্ত খায়— তারপরও বাবারা হেরে যায় না, অন্ধকার রাতে মেয়েকে বলে যায়,”… ডানা না মেললে কেমন করে বুঝবি— মেলে দে ডানা, মেলে দে”। এমনই এক গোপীনাথের জীবনকে রক্ত মাংসের করে তুলেছে বুদ্ধদেব দাস, ওর কথা একটু শোনা যাক – “এই নাটকটি করতে রাজি হলাম এই কারণে কারণ কোথাও গিয়ে এই নাটকটির টেক্সট আমাকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল। বলা যেতে পারে যে আমি এই ধরনের নাটক বা এই ধরনের চরিত্রকে মঞ্চায়ন করার জন্যই কোথাও গিয়ে থিয়েটার করার যে লোভ বা বাসনা সেটা এখনো ভেতরে একটা শিশুর মতন জেগে আছে। যখনই এ ধরনের টেক্সট পাই তখন মনে হয় যেন কিছুটা স্বস্তি কিছুটা জায়গা হল যেখানে থিয়েটার করার কারণটা কেন করছি বা কেন করার প্রয়োজন আছে তার কিছুটা উত্তর আমি খুঁজে পাই। তারপরে যখন এটাও আমার মাথাতে ছিল যে প্রসেনজিৎ দা (বর্ধন) কিন্তু এই কাজটি করেছে। কিন্তু আমার মনে হল যে এই কাজটা যদি আমি আবারও করি তা প্রসেনজিতদাকে, কি বলবো আমি মানে, প্রসেনজিৎ দা কে আর তো ছোঁয়া যাবে না কিন্তু তার করে যাওয়া কিছু ভালো কাজের মধ্যে ডানা একটি অন্যতম কাজ। যারা প্রসেনজিৎ দার কাজ দেখেছে তারা প্রসেনজিৎদার এই ‘ডানা’ নাটকটির অভিনয়কে একটা অন্যস্তরে অন্য জায়গায় সব সময় তুলে রেখেছে এবং রাখবে ও। আমার তখনই কোথাও মনে হলো যে প্রসেনজিৎদার এই কাজটি যদি আমি আবারও করি, যদি সৎ ভাবে করতে পারি, তাহলে কোথাও না কোথাও এই শিল্পচর্চার যাপনের মাধ্যমে, এই নাটকটি যাপনের মাধ্যমে প্রসেনজিৎদাকেও জড়িয়ে ধরা থাকবে মানে জড়িয়ে ধরা যাবে, জড়িয়ে থাকা যাবে। দলটাও জড়িয়ে থাকবে, কারণ যতবার এই নাটকটি মঞ্চায়ন হবে ততবার প্রসেনজিৎদার কথা আসবে। আর শিল্পী তো এভাবেই তার শিল্পচর্চার মাধ্যমে তার কাজের মাধ্যমে বেঁচে থাকেন। আমার মনে হয় প্রসেনজিৎ দা কে বারবার কোথাও গিয়ে এই দৈনন্দিন আমাদের এখনকার চারপাশের যে অবস্থা, যে, কি বলবো, যে মানে মনকে এক জায়গায় স্থির না করতে পারার যে দ্বন্দ্ব চলছে চারিদিকে ,যা অবস্থা চলছে, একটার পর একটা ঘটনা আমাদেরকে বিচলিত করছে বা আমরা একটা ঘটনার শোক ভিতরে উপশম করার আগেই আরেকটা এমন ঘটনা চলে আসছে যে বুঝতে পারছি না যে কি করব সেখানে দাঁড়িয়ে এই কাজটা যদি করা যায় অন্ততপক্ষে প্রত্যেকদিন দৈনন্দিন জীবনে প্রসেনজিৎদাকে হয়তো মনে করার বা মনে থাকার বা মনে রাখার হয়তো কখনো কখনো কারণ খুঁজে পাই না এই এই জঞ্জাল চারপাশে যা চলছে তার জন্য, তো এই কাজটা যখনই করতে যাই তখনই মাথায় আসে প্রসেনজিৎদা এই কাজটা করেছিল। প্রসেনজিৎদা এই কাজটা খুব ভালো করেছিল। এইভাবে ওকে মনে রাখা। আর কৌশিকদার সঙ্গে আমার কখনো অভিনেতা নির্দেশক হিসেবে কাজ করা হয়নি। এটা আমার একটা অন্যরকমের স্বপ্ন পূরণ ও বলা যেতে পারে। যে কৌশিকদার নির্দেশনায় আমি কাজ করার একটা সুযোগ পেলাম। আর এই চরিত্রটা করতে গিয়ে আমরা যারা করেছি তাদের মধ্যে অনেকেই আমরা আছি যারা প্রথমবার মঞ্চে উঠছে, অনেক নতুন ছেলে মেয়েরা রয়েছে। আমরা দলগতভাবে পরিশ্রম করেছি কাজটা নিয়ে। ভালো খারাপ নিয়ে আমরা একবারও ভাবি নি। আমরা প্রসেসটা খুব এনজয় করেছি এবং সৎভাবেই করেছি। পরিশ্রম হয়েছে সে পরিশ্রমটা হয়তো ভালো নাও হতে পারে কিন্তু পরিশ্রমটা আমরা সৎভাবে করেছি। এবং মঞ্চে যতবার আমরা এই নাটকটা নিয়ে ওঠার চেষ্টা করব আগামী দিন, এটুকুই থাকবে যে যতটুকু রিহার্সালে সৎভাবে করেছি ততটুকুই যেন মানুষের সামনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তুলে দিতে পারি। আর কেন নাটকটার চরিত্র বা নাটকটা কেন রেলেভেন্স সেটা তো দর্শক যখন দেখবেন বুঝতেই পারবেন যে নাটকটার সঙ্গে ২০২৫ সালে যে নাটকটার সঙ্গে যে কথাগুলো বলা হচ্ছে মানে এই চারপাশের অবস্থা মানুষের মন এবং মানুষের মগজকে কিভাবে পাগলের মতন তার শিরা উপশিরা ছিঁড়ে দিতে চাইছে, সেই সময় একটা মানুষ যদি গভীরভাবে ভাবতে শুরু করে যে যা যা ঘটছে তার আসল কারণ কী তাহলে একটা মানুষ সুস্থ থাকতে পারে না। পারবে না। মানুষ অনেকটা উপেক্ষা করেই হয়ত কিছুটা ভুলে গিয়েই, একটু কায়দা করে আমরা ভুলে গিয়েই আমরা আমাদের মতন করে একটু প্রাকটিক্যাল ভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি, নাহলে যদি এই গোপীনাথের মতন আমরা যদি ভাবতে শুরু করি, সত্যি পাগল কেন মানে বাঁচা যাবে না, মানে পাগল শুধু নয়, আমি বলব যে, মানুষের শেষ পরিণতি হচ্ছে মৃত্যু, মৃত্যু অবধারিত হবে। তো এই যে যন্ত্রনা যেটা আমি নিজের মধ্যে বা আমরা নিজের মধ্যে বুঝতে পারি, এবার আমার বলার জায়গা তো অন্য কোথাও নয় একজন থিয়েটার ছাত্র হিসেবে আমার তো কাজ হচ্ছে মঞ্চেই আমার রাগ দুঃখ কষ্ট আনন্দ সবটাকে, আমার ফ্রাস্ট্রেসনটাকে তুলে ধরা। তো ঐটুকু সময় গোপীনাথ কে নিয়ে যাপন করতে পারবো এবং যে কথাগুলো বলার চেষ্টা করা হয়েছে নাটকটার মধ্যে সেটা বলতে পারবো ওই টুকুর মধ্যেই আমার এই সমাজের সঙ্গে কোথাও গিয়ে একটু কোথাও গিয়ে সমাজের প্রতি বা আমার নিজের দায় দায়িত্বর প্রতি কোথাও গিয়ে মনে হয় যে একটু সামান্য হয়তো জাস্টিস করতে পারলাম। একটু বিবেক দংশনটা হয়তো ঘটলো। যন্ত্রণা যেটা আমাকে পেতে দিচ্ছে না পরপর ঘটনা এই দু ঘন্টা দশ মিনিটের নাটকে আমি হয়তো ওই যন্ত্রনাটাকে নিয়ে নিজেকে পাগলের মতন ছুঁড়ে দিতে মানে চিৎকার করে কাঁদতে পারবো, কাঁদাতে পারবো, পাগল হতে পারব যেটা আমি ব্যক্তিগত জীবনে বা আমি আমার সামাজিক জীবনে করতে পারি না। লোকে তাহলে বলবে যে মানে লোকে তাহলে মারবে আমাকে ধরে আর কি যেটা ওই নাটকের মঞ্চেতে পারি আমি। ওই সাহসটা এই চরিত্রটা আমাকে দিয়েছে করার। তার জন্যই করা।” আসলে একটা একতার মধ্যে দিয়ে সমাজ এগিয়ে চলে, সেই সমাজের প্রত্যেকের অবদান আছে। কয়েকজনকে দাগিয়ে দেওয়া শ্রেষ্ঠ আর নিকৃষ্ট রূপে, এটা অন্যায় হয়তো। ‘ডানা’ যতবার তার উড়াল নেবে, পর্দা সরবে ততবার সেই সমাজবদ্ধতার কথাও মনে আসবে যেখানে মানুষ শুধু মাত্র ভালোবাসা সংক্রমণ করতে পারে, হিংসা নয়।
দেবীর জীবনে ‘কালরাত্রি’র অন্ধকার কি ঘুচবে?- অজন্তা সিনহা
দেবীর জীবনে ‘কালরাত্রি’র অন্ধকার কি ঘুচবে?
অজন্তা সিনহা
ভবিষ্যৎবাণী জিনিসটা আমাদের মনের ওপর এমন এক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, যার প্রভাব জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে চরম প্রভাব ফেলে। বলা বাহুল্য, এটা ইতিবাচক ও নেতিবাচক দু-ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
হইচই-এর নতুন ওয়েব সিরিজ ‘কালরাত্রি’-তে উঠে এসেছে ভবিষ্যৎ বাণীর চরম নেতিবাচক অর্থাৎ ভয়ঙ্কর কালো দিক। বিয়ের পরই যদি কোনও মেয়ের ভাগ্যে ভবিষ্যৎ বাণী সংক্রান্ত চূড়ান্ত দুর্ভাগ্যজনক কিছু ঘটে, তাহলে কেমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, সহজেই বোধগম্য। আমাদের গল্পের মুখ্য চরিত্র দেবীর ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটে। তার চোখে ছিল নতুন সংসারের স্বপ্ন। কিন্তু বিয়ের পরদিনই সে স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হলো। একটি ভয়ংকর ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হলো–রহস্যজনকভাবে মারা গেল তার স্বামী। সবচেয়ে বড় কথা, এই ভবিষ্যৎ বাণী উঠে এলো তারই ঘনিষ্ঠ বন্ধু মায়ার মুখ দিয়ে।
শোকাহত দেবী যখন এই আকস্মিক বিপর্যয়ের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে, তখন ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারে তার নতুন পরিবার নিছক সাধারণ একটি পরিবার নয়। এদের সবটাই এক জটিল রহস্য ও গোপন অন্ধকারে মোড়া। তার শ্বশুরবাড়ির প্রতিটি মানুষই যেন কোনও না কোনও রহস্য বয়ে বেড়াচ্ছে। কারও চাহনিতে আছে গোপন শত্রুতা, কেউ যেন তাকে কিছুর জন্য দায়ী করতে চাইছে। আবার কেউ হয়তো সাহায্য করতে চাইলেও পরিস্থিতির কারণে অপরাগ হয়ে পড়ছে।
দেবী অনুভব করে, এই পরিবারের অতীতের গভীরে লুকিয়ে আছে এক ভয়ংকর সত্য, যা তার জীবনকে আরও বিপজ্জনক করে তুলতে পারে।
এতকিছুর মধ্যে সবচেয়ে অস্বাভাবিক ব্যাপারটি হল–সে নিজেও ধীরে ধীরে অনুভব করতে শুরু করে এক অদৃশ্য শক্তির অস্তিত্ব, যা তাকে অনুসরণ করছে। এটা কি নিছক কাকতালীয় ঘটনা, নাকি সত্যিই কোনও অতিপ্রাকৃত অভিশাপ তার জীবনকে গ্রাস করতে চাইছে? ‘কালরাত্রি’ এক শ্বাসরুদ্ধকর গল্প, যেখানে বাস্তব ও দুঃস্বপ্নের সীমারেখা ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে যায়। এটি এক অন্ধকার পরিবার, প্রতারণা, ভয়ের আবহ এবং অতিপ্রাকৃত ঘটনার এক অনন্য কাহিনি–যেখানে দেবী কেবল নিজের জন্যই নয়, একটি ভয়াবহ সত্য উদঘাটনের জন্যও লড়াই করে। এই রহস্যের সমাধান কি দেবী করতে পারবে? নাকি সে নিজেই ধীরে ধীরে ডুবে যাবে এক ভয়ংকর পরিণতির দিকে? সিরিজের পর্বে পর্বে রয়েছে এর উত্তর।
‘কালরাত্রি’-র হাত ধরেই ওয়েব দুনিয়ায় পা রাখলেন বাংলা ছোটপর্দার জনপ্রিয় তারকা সৌমিতৃষা কুন্ডু। এছাড়াও অভিনয়ে আছেন অনুজয় চট্টোপাধ্যায়, ইন্দ্রাশিস রায়, রাজদীপ গুপ্ত, সৈরীতি ব্যানার্জি, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, রূপাঞ্জনা মিত্র, কৌশানি মুখার্জি, সৌনক রায়, সম্পূর্ণা মন্ডল, দীপান্বিতা সরকার প্রমুখ। ছয় পর্বের এই সিরিজ পরিচালনা করেছেন অয়ন চক্রবর্তী। আপাতত প্রথম সিজনের স্ট্রিমিং চলছে। টিআরপি বলছে, রহস্য ও অতিপ্রাকৃত ‘কালরাত্রি’ বেশ পছন্দ করেছেন হইচই দর্শক!
সেকালের দুটি ব্রাহ্মবিবাহ-তন্ময় দেবনাথ
সেকালের দুটি ব্রাহ্মবিবাহ
তন্ময় দেবনাথ
ব্রাহ্মধর্ম ও সংস্কৃত প্রণালী অনুসারে বরিশালে দুটি বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল ১২৭৪ সালের ১৩ ও ১৪ শ্রাবণ। বরিশালের লাকুটিয়া গ্রামের জমিদার শ্রীযুক্ত বাবু রাখালচন্দ্র নাথ ও বিহারীলাল রায় ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, এবং ব্রাহ্মমত অনুযায়ী সংসারধর্ম নির্বাহ করতেন। পূর্ববঙ্গে ব্রাহ্ম-আন্দোলনের ইতিহাস আমাদের কম-বেশি জানা। বিশেষ করে বরিশালের ব্রাহ্মদের পরিচয়ও খুব অচেনা নয়। তবে বলতেই হবে, পূর্ববঙ্গে ব্রাহ্মনেতারা যেমন নতুন আলোড়ন তৈরি করতে পেরেছিলেন তেমনি তাঁদের নিপীড়িতও হতে হয়েছে খুব। ব্রাহ্মধর্মাবলম্বীরা গ্রামবাংলায় ‘খ্রিস্টান’ বলে কুখ্যাতি পেতেন। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহে শরৎচন্দ্র রায়ের ‘ব্রাহ্ম পল্লী’ প্রতিষ্ঠা করার মতো ছোটো ছোটো প্রচেষ্টাগুলি (দোকান, বাড়ি ইত্যাদি) মূলত পূর্ববঙ্গের ব্রাহ্মদের আত্মরক্ষার জন্যই ভাবা হত।
কালক্রমে তাই আবার ব্রাহ্ম-আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণের পর বরিশালের রাখালচন্দ্র নাথ ও বিহারীলাল রায়কে কেমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল সে-পরিচয় পাওয়া না গেলেও আমরা তা অনুমান করতে পারি। বরিশালের আর এক ব্রাহ্ম দুর্গামোহনের নামে লোকে ‘থুতু’ ফেলত। এমনকি চাটগাঁয়ের ব্রাহ্মমন্দিরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ইত্যাদি নানা ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু রাখালচন্দ্র নাথ ও বিহারীলাল রায়ের কথা আমরা প্রথম পাচ্ছি বামাবোধিনী পত্রিকা-তে।
বিহারীলালের সর্ব কনিষ্ঠা সহোদরা শ্রীমতী দিনতারিণীর (বয়স ছিল ১৫) সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল সিমলা নিবাসী ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ পাশ করা শ্রীযুক্ত বাবু নিবারণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের (বয়স ছিল ২৩)। পিতা শ্রীযুক্ত গিরীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। বিবাহকালে নিবারণবাবু মোজাফারপুর গভর্নমেন্ট স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদে নিযুক্ত ছিলেন। এই বিবাহানুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন কলকাতার কেশবচন্দ্র সেন ও সঙ্গে কিছু ব্রাহ্ম পরিবার। এটি প্রথম দিনের বিবাহ অর্থাৎ ১৩ শ্রাবণ। এই অনুষ্ঠানে প্রায় তিনশোর বেশি লোকের জমায়েত হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে ছিলেন ৫০জন ব্রাহ্ম ও ২৩জন ব্রাহ্মিকা।
উল্লেখ্য, তখনও ব্রাহ্মবিবাহ আইন পাশ হয়নি। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে সেই কাজটি করবেন কেশবচন্দ্র সেন। এই আইন অনুসারে বিবাহে ইচ্ছুক যারা তাদের ঘোষণা করতে হত যে, তারা হিন্দু নন। এবং হিন্দু আচার-আচরণের সঙ্গে কোনো রকম সংশ্রব নেই। বলাবাহুল্য কেশবচন্দ্রের এই উদ্যোগের ফলে তৎকালীন সনাতন-ধর্মাবলম্বীদের একটি বড়ো রকমের মতাদর্শগত সংঘর্ষের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। ১২৭৪ বঙ্গাব্দের বামাবোধিনী পত্রিকা-র শ্রাবণ সংখ্যায় (৪৮শ সংখ্যা, ৩য় ভাগ) প্রকাশিত ‘বরিশালের বিবাহ’ শীর্ষক সংক্ষিপ্ত লেখাটি পড়ে আমাদের এই ধারণা তৈরি হয় যে, ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মবিবাহ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে উক্ত ধর্মাবলম্বীদের একাংশ যেভাবে নিজেদের হিন্দুধর্মের আওতাভুক্ত করে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিলেন— সেখান থেকে কেশবচন্দ্র যেমনভাবে নিজেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন তেমনি তাঁর কাছে অন্যতম প্রেরণা হিসাবে ছিল বরিশালের এই বিবাহ-উদ্যোগ।
দিনতারিণীর পিতা রাজচন্দ্র রায় ছিলেন হিন্দুধর্মাবলম্বী। তিনি মৃত্যুর পূর্বে একটি উইলে লিখে যান “আমার উত্তরাধিকারীগণের মধ্যে যদি কেহ ধর্ম্মভ্রষ্ট হয়েন, তিনি আমার বিষয়ের অধিকারী হইবেন না।” (উৎস: বামাবোধিনী পত্রিকা, পূর্বোক্ত) কিন্তু মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রেরা ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন এবং উপবীত ত্যাগ করেন। মনে রাখতে হবে, কলকাতায় উপবীত ত্যাগ করতে অসম্মত ব্রাহ্ম পুরোহিতদের সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের আপোষ করা নিয়ে সমালোচনার ঝড় তৈরি হবে এই ঘটনার ঠিক পরপরই। যাই হোক, পুত্রদের ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণের কারণে রাজচন্দ্র রায়ের স্ত্রী পুত্র ও সংসার দুইই ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু দিনতারিণীর ব্রাহ্মধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল। তাই মাকে ছেড়ে তিনি ভাইদের সঙ্গে থেকে গেলেন, এবং ব্রাহ্মধর্মের শিক্ষা নেওয়ার সংকল্প করলেন। এছাড়া দিনতারিণীর তরফে তাঁর মাকে ছাড়বার আরও একটি কারণ ছিল— কেননা তাঁর মা হিন্দুধর্ম মতে কুলীন পাত্রের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দেওয়ার জন্য মনস্থির করেছিলেন। এই ঘটনার কিছু দিন পর কলকাতার ব্রাহ্মধর্ম প্রচারকদের দ্বারা বরিশালে একটি ব্রাহ্মিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এর ফলে দিনতারিণীর ধর্মশিক্ষা লাভের সুযোগ তৈরি হয়ে যায়। এই ঘটনার উল্লেখ কেশবচন্দ্র সেনের জীবনীতে পাই না, তা সত্ত্বেও বলতে হবে দিনতারিণীর এই ধরনের সংকল্প ও এই বিবাহানুষ্ঠান তাঁর পছন্দ হয়েছিল। তাঁর অংশগ্রহণ সেই প্রমাণ দেয়। তবে এই বিবাহ-সংবাদ জানানোর পাশাপাশি পত্রিকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘এই প্রকার উপযুক্ত বয়সে এবং পরস্পরের মনোনীত পাত্রে বিবাহ না হইলে বাল্য বিবাহের দারুণ দোষদূষিত বিবাহকে কখনই প্রকৃত অর্থে ব্রাহ্ম বিবাহ বলা যায় না। এইরূপ ব্রাহ্ম বিবাহ সকল দর্শন করিয়া অস্মদ্দেশীয় শিক্ষিত পুরুষদিগের আর প্রচলিত হিন্দুমতের জঘন্য প্রথানুসারে বিবাহ করিতে কখনই প্রবৃত্তি হয় না।’ (পৃ. ৫৫৯) এ যে বামাবোধিনী সভার বাণীস্বরূপ তা বলাবাহুল্য। তাছাড়া এই ধরনের বোঝাপড়ার সূত্রেই যে ধীরে ধীরে সহবাস সম্মতি আইন তৈরি হয়ে উঠবে তাও সহজে অনুমেয়।
১৪ শ্রাবণ একই বাড়িতে দ্বিতীয় বিবাহানুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানেও অংশ নিয়েছিলেন কলকাতা ও বরিশালের ব্রাহ্মরা। প্রথম বিবাহের তুলনায় দ্বিতীয় বিবাহ ছিল আরও বেশি ঐতিহাসিক। কেননা, এটি ছিল একটি বিধবা ও অসবর্ণ বিবাহ। কেশবচন্দ্র সেনের ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ (১৮৬৬) যেমনভাবে উপবীত ত্যাগ করতে চেয়েছিল তেমনি তাঁরা অসবর্ণ বিবাহের সমর্থকও ছিল। বরিশালের এই ব্রাহ্ম-পরিবার যে কেশবপন্থী ছিল তা নিঃসন্দেহে অনুমান করা যায়। তাছাড়া পূর্ববঙ্গে ব্রাহ্মনেতা হিসাবে কেশবচন্দ্রের বিশেষ খ্যাতি ছিল। ব্রাহ্মদের মধ্যে যে কয়েকটি মিশ্র বা সংকর বিবাহ হয়েছিল তার মধ্যে বরিশালের এই বিবাহ ছিল পঞ্চম। বামাবোধিনী পত্রিকা-ই আমাদের সেই তথ্য জানাচ্ছে। বিবাহের পাত্র ছিলেন বরিশালের গৈলা গ্রাম-নিবাসী দুর্গাদাস সেনের পুত্র শ্রীবৈকুণ্ঠ নাথ সেন। পাত্রী বাগআঁচড়া গ্রাম-নিবাসী তারাচাঁদ মল্লিকের কন্যা শ্রীমতী ভবানী সুন্দরী। নয় বছর বয়সে তিনি বিধবা হয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিবাহকালে তাঁর বয়স ছিল ২১। কিন্তু বৈকুণ্ঠবাবুর এটি ছিল প্রথম বিবাহ। তিনি ছিলেন জাতিতে বৈষ্ণব। পাত্রী পিরালী। বিবাহের পর বৈকুণ্ঠবাবু স্ত্রীকে লাকুটিয়া ভবনে রেখেছিলেন, এই ভেবে যে সেখানে থাকলে ভবানী সুন্দরী ব্রাহ্মিকা ভগ্নীগণের উপদেশ দ্বারা নিজের উন্নতিসাধন করতে পারবে।
অন্য সূত্র থেকে জানতে পারি, একই বছরেই বরিশালের দুর্গামোহন দাস ও তাঁর স্ত্রী দুটি বিধবা-বিবাহ দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন দুর্গামোহনের বিধবা বিমাতা। এর ফলস্বরূপ দুর্গামোহনকে গ্রামের জনসাধারণের থেকে যথেষ্ট নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছে। এছাড়া বরিশালের মোক্তার ঈশ্বরচন্দ্র সেন ১৮৬৭ সালেই একজন পতিতাকে বিয়ে করেছিলেন। ফলে ব্রাহ্মসমাজের নামে কুৎসা ছড়িয়ে পড়লে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী দৃঢ়চিত্তে সেই কুৎসার জবাব দিয়েছিলেন। সোমপ্রকাশ পত্রিকায় (১৮৬৭-র সেপ্টেম্বর) সেই প্রমাণ আছে। (সূত্র: মুনতাসীর মামুন, উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গের সমাজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৮৬)
এরপর তৎকালীন বাঙালি অভিভাবকদের কন্যার বিবাহ বিষয়ে সচেতন করার জন্য ১২৭৪ ভাদ্র সংখ্যায় ‘বিবাহ’ নামে একটি ছোটো কলাম ছাপা হয় বামাবোধিনী পত্রিকা-তেই। একটিমাত্র বাক্য পুরো লেখাটির মর্মার্থ বুঝিয়ে দেয়, ‘স্ত্রী এবং পুরুষের পরস্পরের বন্ধুতা মনোমিলন এবং প্রণয় যথার্থ বিবাহের লক্ষণ।’ (পৃ. ৫৮১)
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহের ব্রাহ্ম বৈকুণ্ঠনাথ ঘোষের বিধবা বোনের বিয়ে হয়েছিলেন। পাত্র শ্রীনাথ চন্দ। এটি ছিল ময়মনসিংহের প্রথম ব্রাহ্ম ও বিধবা বিবাহ। সেই বিবাহের বিবরণ পাওয়া যাবে বৈকুণ্ঠনাথ ঘোষের আমার জীবন কথা (১৩৩০) গ্রন্থে। জনকলাহলে বিয়ের মন্ত্র নাকি শোনা যায়নি! অর্থাৎ সব মিলিয়ে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় তৈরি হওয়া বিদ্যাসাগরী মতাদর্শের পরোক্ষ প্রভাব এক্ষেত্রে লক্ষ করা সম্ভব। তিনি চাইতেন বাংলায় সমাজ-সংস্কার শুরু হবে নারী মুক্তির মাধ্যমে। তাছাড়া উনিশ শতকে ‘আধুনিকতা’র রূপায়ণে যে-সকল ইংরেজদের এগিয়ে আসতে দেখেছি তাঁদের মধ্যে বেথুন ছিলেন স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ক উদ্যোক্তা।
পরে অবশ্য ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে কেশব-কন্যা সুনীতি দেবীর বিবাহানুষ্ঠান ঘিরে ব্রাহ্মনেতাদের মধ্যে যে মনান্তর ও মতান্তর তৈরি হয়েছিল সেই ইতিহাস আমাদের প্রায় জানা। শিবনাথ শাস্ত্রীর এই কি ব্রাহ্ম বিবাহ (১২৮৫) বইটি সেই ইতিহাসের ধারক। যাই হোক, বামাবোধিনী পত্রিকা-র এই সংবাদ উনিশ শতকে ব্রাহ্ম-আন্দোলনের অন্যতম তথ্য হিসাবে উঠে আসে।
বাংলা এখন কতটা রবীন্দ্র-সত্যজিৎ-নজরুলের- পার্থ হালদার
বাংলা এখন কতটা রবীন্দ্র-সত্যজিৎ-নজরুলের
পার্থ হালদার
মে মাস মানেই বাঙালির গদগদ ভাব। বাঙালিত্ব দেখানোর সহজ পথ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায় ও কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী যেন আমাদের বাংলার বিস্মৃত আবেগকে উসকে দিয়ে যায়। আমরা শাড়ি, পাঞ্জাবি পরে তাঁদের জন্মজয়ন্তী পালন করি। তাঁদের মূর্তি বা ছবির সামনে মাল্যদানে ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় দিয়ে লাইক তুলি। তাঁদের অতিপরিচিত গান, কবিতা বা সিনেমার অংশ নিয়ে চারটে বুলি কপচাই। বেশ আত্মতৃপ্তির চোয়া ঢেঁকুর তুলে, এক মেকি সম্ভ্রমের আত্মশ্লাঘা নিয়ে ঘুমোতে যেতে যেতে নিজেদের পিঠ চাপড়াই। কিন্তু এই সবকিছুই কি কেবলই লোক দেখানো? এর মধ্যে বিন্দুমাত্র সততা নেই? এটা কি একটি সামাজিক অভ্যাস নাকি ভিতর থেকে উঠে আসা সত্য অন্বেষণ?
আমাদের বর্তমান বাংলা তথা সমাজ নিয়ে এখন নানামুনির নানামত। কেউ বলছেন এটাই কালের নিয়ম, এরমই হওয়া উচিৎ। কিন্তু কী হওয়া উচিৎ? মানুষে-মানুষে বিভেদ হওয়া উচিৎ? নারী, দলিত বা পিছিয়ে পড়া শ্রেণিদের আরও নগন্য করে দেখা উচিৎ? ধর্মের নামে মানুষকে কেটে ফেলা উচিৎ? গরিব আরো গরিব হওয়া উচিৎ? এটাই কি নগরায়ন? এটাই কি সভ্যতা? এই সভ্যতার স্বপ্নই কি দেখেছিলেন আমাদের বাংলার শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ্রা? এই তিন ব্যক্তির কথায়, প্রকাশে কোনোদিন কোনো হিংসার বিচ্ছুরণ আমরা দেখিনি কিন্তু সাক্ষী থেকেছি প্রতিবাদের ভাষ্যে নিজ নিজ ভঙ্গিমায়। আজ বাংলায় তাঁদের নিয়ে যে উদ্যাপনে আমরা মেতে উঠি, তা কোথায় গিয়ে হৃদয়ের অন্তর থেকে আসে না। আসলে আজ বাংলার মানুষ যারা বীরদর্পে বলতেন, ‘ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধর/অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে’, তাঁরাই আজ ‘গোলি মারো শালো কো’-র স্লোগানে মুখরিত হত না। এই বাংলার মানুষ যাঁরা, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গেয়ে নিজেদের মেরুদণ্ডের পরিচয় দিত, আজ তাঁদের মধ্যেই ঢুকে, ‘আমাকে আমার মত থাকতে দাও।’ এই বাংলার মাটিতেই গর্জে উঠেছিল, ‘দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান’, কিন্তু আমাদের চরম দুর্ভাগ্য যে সেই বাংলার ধাত্রীভূমি এখন তোষামোদ ও দুর্নীতির আতুঁড়ঘরে পরিণত হয়েছে। আমাদের গর্বের কারণ আজ অস্তমিত। মানুষ অল্প সময়ে নিজের স্বার্থে বাঁচতে ভালোবাসে। এই কালের নিয়মকে অনুধাবন করতে পেরেই হয়তো কবিশ্রেষ্ঠ অমল, নিখিলেশ, কিশোর, রঞ্জনকে এনেছিলেন, কিন্তু সেই তাঁরাই আজকের দিনে হারিয়ে গেছে। শুধু আছে মঞ্চে বা বইয়ের পাতায়। কোনো একদল মানুষ সাম্প্রদায়িক হিংসার সমালোচনা করার সময় কবিগুরুর বা বিদ্রোহী কবির পংক্তি উদ্ধৃত করে, কিন্তু তলে তলে তারাই সেই উস্কানির মদদদাতা। কেউ ভোট প্রচারে এসে ভুল বাংলায় রবীন্দ্রনাথ বা সত্যজিৎ রায়কেই ঢাল করে ভোটের বৈতরণী পার হতে চায়। আবার কিছু এলিট প্রলেতারিয়েতপন্থী আছেন যারা বাড়ি থেকে অফিসে সর্বত্র রক্তকরবী থেকে সভ্যতার সংকট হয়ে হীরক রাজার দেশ বা আগুন্তক নিয়ে বাতেলা ঝাড়ে কিন্তু সময় পেলে নিম্নপদস্থ কর্মচারীকে ছোট বা ছাঁটাই কোনোটাই করতে ছাড়ে না। তাহলে এই শিক্ষা বা জন্মজয়ন্তী উদ্যাপন কি কোনো মূল্য থাকে যা ক্ষুদ্র স্বার্থে সমাজে বিষের সমান বিচরণ করে?
তাহলে আমরা কি কেবলই রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিৎ বা নজরুলকে সামনে রেখে নিজের ক্লেদাক্ত মনটাকে ঢাকার চেষ্টা করি? সবকিছুই কি শুধু বিশেষ দিনে নিজেদেরকে বিশেষ প্রমাণ করার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা? তার মানে কি এই সমাজ পুরোটাই ঘুণে ধরা? আমি তা বিশ্বাস করি না। কারণ এই লেখাটি যদি আপনি পড়ছেন তাহলে বুঝতে হবে, আপনিও কিয়দংশে আমার সঙ্গে সহমত এবং এই বেড়াজাল ভেঙে বেরিয়ে আসার চেষ্টা চালাচ্ছেন। কোনো অচলায়তন একদিনে ভাঙে না। আজ যে ধর্মান্ধতার, অসহিষ্ণুতার, স্বার্থান্বেষীর প্রাচীর গড়ে উঠেছে সমাজের চারিপাশে তা আমাদেরই ভাঙতে হবে। এক জীবনে এই মহান রূপ-শিল্পীদের পূর্ণ রূপে আত্মস্থ করা অসম্ভব যেমন, তেমনই শুধু উদ্যাপন নয়, আগামী প্রজন্মের কাছে এই ত্রয়ীর মহত্ত্বের কথা বারবার বলতে হবে। কারণ, বাঙালির যাপনে-মননে, স্বয়নে-স্বপনে সর্বদা বিজরিত এই তিন মহান ব্যক্তি। তাঁরা কেবল সাহিত্যিক বা শিল্পী হিসেবে আমাদের চিন্তা-চেতনার প্রান্তদেশে অধিষ্ঠিত নন, আমাদের আমোদে-বিবাদে, সংকটে-পরিত্রাণে, তাঁদের চরণে আমরা নব নব রূপে নিজেদের নিবেদন করি। তাঁরা শিখিয়েছেন কীভাবে প্রেমের পেলবতায় জীবন রোশনাই হয়। তাঁরা দেখিয়েছেন কীভাবে সংকীর্ণতার অচলায়তনকে ভেঙে মুক্ত চিন্তার শ্বাস নিতে হয়। তাঁরা বুঝিয়েছেন, বিভেদ নয়, সমস্ত মানবসভ্যতা একটি মন্ত্রে উজ্জীবিত হোক, তা হলো – একতা। আমি আশাবাদী, হাজার খারাপের মধ্যেও যে ভালোর অন্বেষণ আমরা চালিয়ে যাচ্ছি, তা একদিন সফল হবেই। সফল হবে এই তিনমূর্তির স্বপ্নের বাংলা।
রেডিও থেকে এফ.এম-সৌমেন বসু
রেডিও থেকে এফ.এম
সৌমেন বসু
আমাদের পাড়ার হারুবাবু একশ বছর পূর্ণ করতে চলেছেন আর কদিন পরেই। শতবর্ষের জন্মদিনকে জমিয়ে তুলতে নিজের ছেলে থেকে শুরু করে নাতির ছেলে পর্যন্ত সকলেই নানা পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত। একশ বছর বয়স হলেও হারুবাবুর ভরভরন্ত সংসারের সঙ্গে স্মৃতিটিও বেশ চনমনে। এখনও নিয়ম করে দুটি কাজ হারুবাবু করে থাকেন। প্রথমটি প্রতিদিন সকালে হাঁটা আর দ্বিতীয়টি নিয়ম করে রেডিও শোনা। তবে মুশকিল হল রেডিও সেটটা অনেক দিনের পুরোনো হওয়ায় ভালো শোনা যায় না। তাই হারুবাবুর নাতির ছেলে পিছু যখন এসে হারুবাবুকে জিগ্যেস করেছিল একশ বছরের জন্মদিনে বড়দাদাই কি নিতে চায় তখন হারুবাবু বলেছিলেন- “একটা নতুন রেডিও দিস্ দেখি।” হারুবাবুকে পিছু ‘বড়দাদাই’ বলে। হারুবাবুর আবদার শুনে পিন্ধু হেসে বলেছিল- “রেডিও শুনে কি করবে বড়দাদাই? তার থেকে FM শোনো।” এই বলে নিজের দু’কানে গোঁজা ইয়ার ফোন-এর একটা খুলে দাদুর কানে গুঁজে দিয়েছিল। একটুক্ষণ শোনার পর দাদু হেসে বলেছিল- “এ গানতো আমাদের রেডিওতেও হয়। তাহলে FM শুনতে বললি কেন?” পিছু একটু থমকে গিয়ে তারপর বলল- “বড়দাদাই, আজকাল সব্বাই FM শোনে। ঝক্কাস আওয়াজ, ঝিচ্যাক্ গান আর সব লাইভ, লাইভ…..।” পিন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে হারুবাবু বললেন- “শোনো দাদাই, রেডিও যে কি তা তোমরা বুঝবে না। জানো তো রেডিও প্রথম শুরু হবার পর সরকারী নির্দেশে বন্ধ হয়ে যাবার যোগাড় হয়েছিল। সে সময় কলকাতার এক রেডিওর দোকানের মালিক, তার নাম মণীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা বেতার কেন্দ্র কিনে নিয়ে নিজে চালাবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এমনকি দিল্লি পর্যন্ত দরবার করেছিলেন। তাঁর প্রস্তাব এবং হাজার হাজার মানুষের আবেদনে সরকার বেতার বন্ধ করতে পারেনি। আর তুমি FM-এর লাইভ অনুষ্ঠানের কথা বলছ? ১৯২৭সালে কলকাতা বেতারের শুরু থেকেই সব অনুষ্ঠান লাইভহত। ঘোষণা, গান-বাজনা, কথিকা এমনকি বড় বড় নাটক পর্যন্ত লাইভ হত।” পিন্ধু একটু নড়ে চড়ে বড়দাদাই-এর পাশে বসে রেডিওর গল্পে মজে গেল। পিছু তার মত গল্প শুনুক, এই অবসরে আমরা একটু ‘রেডিও থেকে FM’-এর চেহারাটা দেখে নিই।
আজকের আধুনিক রেডিওর যে চেহারা আমরা দেখি তার সলতে পাকানোর কাজ ভারতবর্ষে শুরু হয়েছিল এই কলকাতাতেই। ১৯১২ খ্রীস্টাব্দে মার্কনী কোম্পানী কলকাতার হেস্টিংস স্ট্রীটে তাদের একটি অফিস খুলেছিল ভারতের সমুদ্র উপকূলে ব্রিটিশ নেভিগেশন কোম্পানীর নৌবহরকে বেতার যন্ত্রে সাজিয়ে তোলার জন্য। পরে ১৯১৮ সালে ঐ অফিস স্থানান্তরিত হয় টেম্বল চেম্বার্স-এ। ১৯২৮ সালে অক্টোবর মাসের The Statesman পত্রিকা থেকে পাওয়া Eric Dunstan- এর একটি সাক্ষাৎকারে দেখা যায় ভারতবর্ষে পরীক্ষামূলক বেতার সম্প্রচারের জন্য কলকাতাকেই বেছে নেওয়া হয় প্রথম স্থান হিসেবে। Eric Dunstan ছিলেন Indian Broadcasting Company-র তদানীন্তন জেনারেল ম্যানেজার। তাঁর কথা থেকে আরও জানা যায় যে ১৯২২ সালের মে মাসে ভারত সরকারের কাছে আবেদন করা হয় পরের বছর অর্থাৎ ১৯২৩ সাল থেকে এই দেশে সম্প্রচার ব্যবস্থা শুরু করার অনুমতি প্রার্থনা করে এবং তা মঞ্জুরও হয়। পরবর্তীকালে The Statesman পত্রিকা লিখেছিল— “Calcutta was the first city in India to seize the opportunity and the Radio Club of Bengal was formed on the invitation of J. Briggs and J. R. Stepleton with a small transmitting station at Temple Chambers.” এই Radio Club of Bengal-এর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কলকাতা থেকে প্রথম বেতার সম্প্রচার হল ১৯২৩ সালের নভেম্বর মাসে। পরবর্তীতে একই রকমভাবে তৎকালীন বম্বেতে গড়ে ওঠে Radio Club। বেতার সম্প্রচারের ক্ষেত্রে এ সব প্রচেষ্টাই পরীক্ষামূলক ছিল।
ভারতবর্ষে বেতার সম্প্রচারের জন্মলগ্ন থেকেই একটা অদ্ভুত মিশ্র হস্তান্তরের ছবি পাওয়া যায়। কখনও বেসরকারী তো কখনও আবার সরকারী। বর্তমানে সরকারী এবং বেসরকারী দুধরনের আওতা ভুক্ত বেতার সম্প্রচারও নজরে পড়ার মতো। আসলে Public Service Broadcasting-এর মতো কল্যাণমূলক সম্প্রচারের পাশাপাশি পুরোপুরি ব্যবসাভিত্তিক সম্প্রচার ও বেতারের চেহারাটাকে আমূল বদলে দিয়েছে। বদলে গেছে পরিচালনগত পদ্ধতি, এসেছে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার আর নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বিনোদনমূলক চাহিদা। ‘রেডিও থেকে FM’ বোধহয় সেই পরিবর্তনেরই ছবি।
আবারও একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক। সালটা ১৯২৫। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের একটি ঘরে ছোট্ট একটি ট্রান্সমিটার বসিয়ে তাঁর এক সহকর্মীর সাহায্যে wireless-এ বিনোদনমূলক সম্প্রচার শুরু করেছিলেন ডঃ শিশির কুমার মিত্র। ব্যাপারটি নজরে আসে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন বা B. B. C.-এর। ১৯২৬ সালে সি. সি. ওয়ালিক্ ভারতবর্ষে আসেন বাণিজ্যিকভাবে বেতার সম্প্রচার কতখানি সম্ভব তা খতিয়ে দেখতে। টেম্পল চেম্বার্স-এর একদম ওপরের তলায় একটি স্টুডিও তৈরি করে শুরু করেন বেসরকারী উদ্যোগে বিনোদনমূলক বাণিজ্যিক বেতার সম্প্রচার। তখনও কিন্তু কলকাতা বা বম্বেতে আনুষ্ঠানিকভাবে বেতার সম্প্রচার শুরু হয়নি। কিন্তু তখন থেকেই বেতার সম্প্রচারের বাণিজ্যিক দিকটি কর্তাব্যক্তিদের মাথায় খুব পরিষ্কারভাবেই ছিল। বর্তমান প্রসারভারতী ভাবনা এবং বহু বেসরকারী FM রেডিওর সম্প্রচার সেই বহু বছর আগের বাণিজ্যিক ভাবনার সুদূরপ্রসারী ফল।
বেতার সম্প্রচারের পরীক্ষামূলক পর্ব শেষ করে অবশেষে এল ১৯২৭ সাল। ২৩শে জুলাই উদ্বোধন হল ভারতবর্ষের প্রথম বেতার কেন্দ্র বম্বে বেতার কেন্দ্র। এর মাত্র কিছুদিন পরে- ১৯২৭ এর ২৬শে আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হল কলকাতা বেতার কেন্দ্রের। ভারতবর্ষের দ্বিতীয় বেতার কেন্দ্র। Indian Broadcasting Company নামক বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে এবং পরিচালনায় শুরু হয়েছিল ভারতে বেতার সম্প্রচার। দুটি বেতার কেন্দ্রের পরিচালনার জন্য B.B.C থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল দক্ষ এবং অভিজ্ঞ কর্মীদের। বম্বের স্টেশন ডিরেক্টর ছিলেন এল. বি. পেজ এবং কলকাতা স্টেশনের ডিরেক্টর ছিলেন সি. সি. ওয়ালিক্। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সমস্যা দেখা দিল। B.B.C থেকে যে সমস্ত কলাকুশলীরা এসেছিলেন তাঁদের বেশ কিছু বাড়তি দাবী গ্রাহ্য না হওয়ায় তাঁরা স্বদেশে ফিরে যান। এঁদের মধ্যে ছিলেন কলকাতার স্টেশন ডিরেক্টর সি. সি. ওয়ালিক-ও। তাঁর জায়গায় পার্টটাইম স্টেশন ডিরেক্টর হিসেবে নিযুক্ত হলেন মার্কীন কম্পানীর জে. আর, স্টেপল্টন। অনুষ্ঠানসূচিতে এল নানান মৌলিকতা এবং বৈচিত্র্য।
১ নম্বর গাস্টিন প্লেসে অবস্থিত কলকাতা বেতার কেন্দ্রে সমবেত হলেন বাংলা এবং পাশ্চাত্য অনুষ্ঠানের বহু গুণী এবং নামী মানুষেরা। ১.৫ কিলোওয়াটের মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিটার থেকে সম্প্রচারিত হত অনুষ্ঠান। সব অনুষ্ঠান সরাসরি বা লাইভ সম্প্রচার হত। সে সময় রেডিও থাকত কেবলমাত্র লাইসেন্সধারীদের কাছেই। যতদূর জানা যায় ১৯২৭ সালেই লাইসেন্সধারী ছিলেন তিন হাজার পাঁচশোর কিছু বেশি। হারুবাবুর মুখে শুরুতেই শুনেছি ভারতীয় বেতার সম্প্রচার আরম্ভের পরেই বন্ধ হয়ে যাবার যোগাড় হয়েছিল। ১৯৩০ সালের মার্চ মাসে বেসরকারী প্রতিষ্ঠান Indian Broadcasting Company অর্থসঙ্কটে পড়ে বন্ধ হয়ে গেল। বেতারের নিয়ন্ত্রণ এল ভারত সরকারের হাতে। নতুন নাম হল Indian state Broadcasting Service। কিন্তু ব্যাপক লোকসানের জন্য ১৯৩১ সালের অক্টোবর মাসে বেতার কেন্দ্রগুলি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সাধারণ মানুষের প্রবল বিক্ষোভ এবং সরকারী সদিচ্ছার বেতার সম্প্রচার বন্ধ না হয়ে ১৯৩২ সালের মে মাসে পাকাপাকি ভাবে সরকারী পরিচালনাধীন হল। বেতারকে সাবলম্বী আর লাভজনক করে তোলার জন্য বেশ কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হল। বেতার সংগ্রাহক সরঞ্জামের ওপর কর বাড়ানো হল। জোর দেওয়া হল লাইসেন্স পদ্ধতির ওপর, বিনা লাইসেন্সে রেডিও সেট রাখা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা করা হল। ১৯৩৫ সালের আগস্ট মাসে ভারতীয় বেতারের প্রথম Controller of Broadcasting পদে যোগ দিলেন B. B. C থেকে আসা লায়োনেল ফিল্ডেন। যোগ দিয়েই নজর দিলেন সম্প্রচারে কারিগরী ব্যবস্থার দিকে। ১৯৩৬-এর ৮ই জুন Indian State Broadcasting Service-এর নাম পরিবর্তিত হয়ে হল All India Radio। শ্রম মন্ত্রালয় থেকে যোগাযোগ দপ্তর সেখান থেকে ১৯৪১ সালে তৈরি হওয়া তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক নামে একটি নতুন মন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণে এল All India Radio। ১৯৩৪ এবং ১৯৩৮ সালে দিল্লি এবং মাদ্রাজ বেতার কেন্দ্রের উদ্বোধন হল। ভারতীয় সম্প্রচার ব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়াল ক্রমশ। ১৯৫৭ সালে নাম হল আকাশবাণী। পাশাপাশি নানান পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন উন্নত করতে থাকল ভারতীয় বেতার সম্প্রচারকে। এল শর্টওয়েব ট্রান্সমিটার, এল Air Network। ক্রমশঃ পরিবর্তিত হতেহতে অ্যানালগ থেকে ডিজিটাল, AM থেকে FM, DTH থেকে Internet সম্প্রচার এবং Mobile Apps-এ বেতার সম্প্রচার। এখনও প্রতিদিনই বদলাচ্ছে সম্প্রচারের ছবিটা। ১৯৬৭-তে শুরু হওয়া বিবিধভারতী বিজ্ঞাপন কার্যক্রম উপার্জনের নতুন মাত্রা পেল ১৯৮০ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে FM সম্প্রচার শুরু হওয়ায়। ২০০১ সালে আকাশবাণীর FM-এর দ্বিতীয় চ্যানেল এল এবং ২০০৩ সাল থেকে সরকারী FM Rainbow এবং FM Gold এর পাশাপাশি আরও বহু বেসরকারী FM চ্যানেল ভারতবর্ষের ছোট বড় সব শহরে শুরু করল তাদের সম্প্রচার। নতুন করে রেডিও আবার ফিরে এল লোকের ঘরে, লোকের হাতে এবং কানে কানে।
হারুবাবু আর পিছু এতক্ষণ কি করছে তা দেখার জন্য উকি দিতেই শুনি হারুবাবু বলছেন- “তাহলে শুনলি তো, সেই কবে থেকে রেডিও আমাদের কতরকম ভাবে সাহায্য করছে, খবর দিচ্ছে, আনন্দ দিচ্ছে। রেডিওর ‘জয়হিন্দ’ শুনে তবে ঘুমতে যেতাম”। পিছু ওমনি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল-“সে তো আমাদের FMও দিচ্ছে। সারাদিন সারারাত যখন খুশি FM শুনতে পাবে। ঘুম না এলেও FM-এর গান শুনে রাত কেটে যাবে। আর কত কিছু জানতে পারি কোথায় ট্রাফিক জ্যাম, কখন বৃষ্টি নামবে, কোথায় কি পাওয়া যায়, কবে কার জন্মদিন সব সব FM বলে। পাশাপাশি ফোন করে, SMS করে আমরা কথাও বলতে সারি। বন্ধুদের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে পারি। দ্যাখোনা বড়দাদাই তোমার জন্মদিনেও FM কেমন শুভেচ্ছা জানাবে। আমি শুনিয়ে দেবো তোমাকে।” হারুবাবু একগাল হেসে বললেন- “তবে তো দাদাই FMও আমাকে শুনতে হবে এখন থেকে। তবে রেডিও সেটটা দিতে ভুলিসনে যেন।”