magazines

৪৬ তম ই-সংস্করণ ।। ৫৭ তম সংখ্যা ।। মার্চ, ২০২৫

৪৬ তম ই-সংস্করণ ।। ৫৭ তম সংখ্যা ।। মার্চ, ২০২৫

ভাণ পত্রিকা


৪৬ তম ই-সংস্করণ ।। ৫৭ তম সংখ্যা ।। মার্চ ২০২৫

সম্পাদক :

সম্পাদনা সহযোগী :​

প্রচ্ছদ :

নক্সা পরিকল্পক :

অন্যান্য কাজে :

ভাণ-এর পক্ষে:

পার্থ হালদার

কর্তৃক

৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা: ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ: ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬

(হোয়াটসঅ্যাপ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ (কথা /হোয়াটসঅ্যাপ)

৮৭৭৭৪২৪৯২৮ (কথা) bhaan.kolkata@gmail.com (ই-মেল) ​

Reg. No: S/2L/28241

সূচিপত্র

সম্পাদকের কথা

।।সম্পাদকের কথা।।

মার্চ, ২০২৫

ধ্বস্ত নুব্জ দুবলা গণতন্ত্রের পানে আর তাকানো যায় না। এ পোড়া দেশের তথাকথিত গণতন্ত্রের প্রতি ভদ্রজনোচিত প্রত্যাশাও ক্রমহ্রাসমান। সঙ্কট যখন গভীরতর তখন টিকে থাকাকেই রাজকীয় মনে হয়। চারদিক ক্রমশ ঝাপসা হতে থাকে।‌মনে হয় গণতন্ত্রের  ইন্তেকাল ঘটে গেছে। তবু গণতন্ত্রের নামে, গণতন্ত্রের আড়ালে, গণতন্ত্রের মুখোশ পরেই শাসন যন্ত্র চলছে, ‘জোর যার মুল্লুক তার’ চলছে, ‘বেশ করেছি’ চলছে, ‘যা পারিস করে নে, আমার কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবি না’— ইত্যাদি হাজারো প্রকাশ্য দাম্ভিক হুঙ্কার চলছে। সব চলছে গণতান্ত্রিক রাজ্যে এবং বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে। সরকারি দল বিরোধী দল হুঙ্কারের প্রতিযোগিতায় জনগণকে বোঝাচ্ছে এটাই স্বাভাবিক। এখন সর্বোচ্চ ক্ষমতা ফলাও করেও এসব করতে হচ্ছে ‘গণতন্ত্র’এর নামে। গণতন্ত্রের এমন মহাত্ম! যুগে যুগে এক একটা লব্জ এমন ক্ষমতাবান হয়, তাকে ছেড়ে রাষ্ট্রযন্ত্র চলতে পারে না। খুন রাহাজানি রকমারি দুর্নীতি অন্য কন্ঠস্বরকে জব্দ করার নির্লজ্জ মিথ্যাচার সবই তাই এখন গণতন্ত্রের নামেই দিব্য চালিয়ে নেওয়া যাচ্ছে। যেমন সমাজবাদ, সোসিয়ালিজম এমন একটা প্রতিষ্ঠিত লব্জ ছিল একদা হিটলারও তার পার্টির নামকরণ থেকে সে শব্দদ্বয় থেকে মুক্ত হবার সাহস দেখাননি। নাজি– নামে Nationalist Socialist German workers Party’ এর ঘোর ফ্যাসিবাদ, উগ্রতম হিংস্র নিষ্ঠুর অত্যাচার সমাজবাদীদের ওপরে চালিয়েছিল।

 

আমাদের বঙ্গদেশে গরু, বালি, কয়লা, রেশন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ,চাকরিকে আমরা দুর্নীতির এক একটি স্কুল হিসেবে চিনি। এই দুর্নীতিকে যদি অক্সিজেন জোগাতে হয়, অক্সিজেন আনতে হয় গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো পুড়িয়ে। আর সরকারি উদ্যোগের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিকে দীর্ঘায়ু দিতে গেলে কাজে অদক্ষ, অপগণ্ড, অপদার্থ অথচ অর্থ  যশ লোভী অমেরুদণ্ডী মধ্যবিত্তের সাহায্য নিতে হয় সরকারকে। দু পাঁচজন এমন জ্ঞানী গুণী কেও পাওয়া অসম্ভব নয়, নানা সাইকোলজিক্যাল কারণে যিনি অখাদ্যদের হয়ে অযুক্তি কুযুক্তি কুকর্ম এবং সর্বাধিক মূর্খ এবং উচ্চতর শয়তানদের পক্ষে নিত্য সওয়াল করবেন। ফলে রকমারি চোরে ডাকাতের পিসতুতো মাসতুতো হতে অধিক সময় লাগে না । অনৈতিকতার এক শক্তপোক্ত দেওয়াল তৈরি হয়। সে দেওয়াল ভেঙে ফেলা অসম্ভব না হলেও সহজ হয় না মোটেও।

 

গণতন্ত্রের সন্ধানে শান্তি ভঙ্গকারী যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীরা এখন খবরের শিরোনামে। মন্ত্রীর গাড়ির চাকা থামছে না দেখেও কিছু অকুতোভয় একুশ-বাইশ দমে যায়নি। গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক দেশের জনগণের মন্ত্রীর কাছে তাঁরা জানতে চেয়েছিল গণতন্ত্রের এই হাল কেন? মুমুর্ষু গণতন্ত্রকে মাড়িয়ে আপনি পালিয়ে যাচ্ছেন কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ে ভোট হয় না কেন? স্থায়ী ভিসি ইসি নেই কেন? কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভোট নাই অথচ শাসক পন্থী ছাত্রদলের সিন্ডিকেট চলে কেন? ওরা এসবের আড়ালে ওরা হয়তো বলতে চেয়েছিল দুর্নীতিকে দীর্ঘায়ু করতে আপনারা ইচ্ছে করেই হাসপাতালে, শিক্ষাঙ্গনে, সমবায়ে, বোর্ডে, কাউন্সিলে ছড়ানো ছিটানো গণতান্ত্রিক প্রতিবেশকে জেনে বুঝে খুন করছেন। তাই এমন ধুন্ধুমার। রক্তপাত। চোখের দগদগে ঘা এবং যন্ত্রণা ও পাল্টা যন্ত্রণার নাটকে যাদবপুর জমজমাট।

 

চোখ থাকতেও অন্ধ মোরা, মুখ থাকতেও মূক– এসব কবির বাণী। কবি হয়ত ছন্দমিলের খাতিরে তাদের কথা লিখে যেতে পারেননি, যারা বিশেষ বিশেষ জিনিস দেখতে পান অথচ বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সেই একই চক্ষুদ্বয় বিশেষ একটা কাজ করে না। অনেক স্বঘোষিত নিরপেক্ষর দল বলতে লাগলেন ছাত্ররা অতীব দুষ্টু প্রকৃতির। ডিসিপ্লিনের প্রাথমিক পাঠ হয় নি। গোঁয়ার এবং উদ্ধত। সান্ত্রী নিজেই চোরেদের মদদদাতা কিংবা রক্ষাকর্তা কিনা সেসব আলোচনার চাইতে বড়ো হল তিনি গুরুজন! বড়ো আশ্চর্যের কথা এই হিসেবে ক্ষুদিরাম,প্রফুল্ল চাকী,মাষ্টার দা, যতীন দাস সকলে গুরুজনদের খুন করতে উদ্যত হয়েছিলেন! তবে খামকা তাঁদের জন্মদিনে, দেশের জন্মদিনে, দেশাত্মবোধক সঙ্গীত কেন? তাহলে তো সন্ত্রাস-বিরোধী স্লোগানই জুতসই হত। মনে রাখার কথা যে স্বঘোষিত নিরপেক্ষ ভদ্রমহোদয়েরা যে আগ্রহে ছাত্রদলের একাংশের বিশৃঙ্খলা দেখে প্রমাদ গোনেন, তারাই ছাত্রদলের বাবা কাকা জ্যাঠা দাদামশায়দের গড়া মন্ত্রী সভা থেকে পর্ষদ, কাউন্সিলের অজস্র এবং ভয়াবহ অনৈতিকতা এমনকি প্রমাণ্য দুর্নীতির বেলায় চোখ কান মুখ বন্ধ (বন্ধক!) রাখেন। এইসব মা-বাপদের কাছে  চাকরি বিক্রি করাটা বিশৃঙ্খলা নয়। তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করাটা বিশৃঙ্খলা। বাপের মদ খেয়ে বাওয়াল দেওয়াটা অপরাধ নয়, ছেলের প্রতিবাদটা কেবল ‘উদ্ধত’! কোম্পানির আমল থাকলে এরা ক্লাইভ পন্থী হতেন সন্দেহ নেই। শক্তি মানের পক্ষে গদগদ আনুগত্য আর দুর্বলদের গণতন্ত্রের পাঠ পড়ানোর চেষ্টা ওদের শুকিয়ে আমশি গোছের দুর্বল কালো হৃদয় টিকেই প্রকাশ করে। এখনও কি দেশে সিরাজ বিরোধী, ক্লাইভ পন্থী লোকের সংখ্যা কম? বাস্তিল দুর্গের ভেঙে ফেলাটা এইসব মাপা ভদ্রতার অহংকৃত মা-বাপের কাছে ঠিক কী ধরণের বিশৃঙ্খলা জানতে ইচ্ছে করে। এই অপগণ্ড কূলের অশ্লীল অসভ্য সুবিধাবাদের আড়ালে দাঁড়িয়েই গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত মন্ত্রী, এম এল এ, এম্পিরা প্রকাশ্য রাস্তায় বুক চিতিয়ে একথা  বলেন‌না যে আগামীতে ভোট হবে, যাদবপুরের বিশৃঙ্খলাকারীদের আমরা পরাজিত করব গণতান্ত্রিক পথে। ওরা বলেন ৩০ সেকেন্ড থেকে মেরেকেটে ২/৪ মিঃএ যাদবপুর ‘দখল’ করবেন!! ‘দখল’-শব্দটি আলেকজান্ডার, সমুদ্র গুপ্ত, শশাঙ্ক, আলাউদ্দিন, মাহমুদ বা শিবাজীদের সময়ের ভাষা। রাজতন্ত্রের, সামন্ততন্ত্রের বাস্তবতা। আমরা সংবিধানের নামে শপথ করে ‘গণতন্ত্র’ ‘গণতন্ত্র’ ধেই ধেই নেত্য করতে করতে গলার শিরা ফুলিয়ে সেই একই কাজ করব? যারা গণতন্ত্রের নামে দখলের রাজনীতি করবেন, বুথ দখল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় দখল, – তাদেরকে ঘৃণা করা, এইসব  অসুস্থ উচ্চারণের প্রতি প্রতিবাদ তো দূরের কথা, বিরক্তও হব না? ওই সরকারের ক্ষমতার বলে বলীয়ান নেতামন্ত্রীসান্ত্রীসামন্তদের গা ঘেঁষে ছবি তুলব? আড়চোখে দেখে নেব চরাচর থুতু তে ভেসে যাচ্ছে, তবু আমরা চতুর শেয়ানা আর অমেরুদণ্ডী গণ্ডারী চামড়ার জোরে মুখে ঢলঢল হাসি আনতে ভুলব না!? মেকআপ করব? মেনে নেব? দেশটা উচ্ছন্নে গেছে সেটি কেবল বিড়বিড় করে কমফোর্ট জোনে উড়িয়ে দিয়ে পাপস্খলন করব? আমাদের ন্যুব্জ দুবলা ধস্ত বিকৃত গণতন্ত্রের জন্য আমরা প্রত্যেকে দায়ী, আমিও দায়ী– একথা ভাবার সাহসটুকু অত্যন্ত দ্রুত জোগাড় হোক।

কলকাতার গালগপ্পোর চতুর্দশ পর্ব লিখলেন - কিশলয় জানা

কলকাতার গালগপ্পো ১৪
লটারি কমিটির কেরদানি
কিশলয় জানা

কলকাতার ইতিহাস নিয়ে যাঁরাই কিছু বলতে বসেছেন কিংবা আমার মতো গালগপ্পের আসর বসিয়েছেন, তাঁদের কারুরই লটারি কমিটির কথা না বলে উপায় নেই। সেই যে অরণ্য-ডোবা-মাটির বাড়ি আর অস্বাস্থ্যকর জলবায়ু শোভিত ডিহি কলকাতা, ডিহি সূতালুটি এবং ডিহি গোবিন্দপুর, তার আজকের ঝাঁ-চকচকে মেট্রোপলিটন হয়ে ওঠার গোড়ার যুগে এই লটারি কমিটির অবদান অবিস্মরণীয়। আর এই লটারি কমিটির হাত ধরে কেবল কলকাতা ধীরে ধীরে তার নাগরিক মুখে নিয়ে উঠে এল না, কত রাজা-গজার সূর্য অস্ত গেল, আবার কত সামান্য ফকিরের যে কপাল ফিরে গেল, তার ঠিক নেই। সাধে কী আর লটারি কমিটি তার প্রায় চল্লিশ বছরের ইতিহাস নিয়েই কলকাতার ইতিহাসে পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছে?

পলাশির যুদ্ধের বছর দশেক পর থেকেই কলকাতার গ্রামীণ চরিত্র আস্তে আস্তে বদলাতে শুরু করেছিল, অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে যা অপরিকল্পিতভাবে কিন্তু তুলনায় দ্রুত বিকশিত হয়, তবে ১৮৩০-এর আগে তা মূলত সীমাবদ্ধ ছিল সাহেব-টাউনের মধ্যেই। বাইরের তথ্যপ্রমাণ থেকে আপাতভাবে মনে করা যেতে পারে যে, কলকাতায় সুরম্য অট্টালিকা, প্রাসাদ, পাকা বাড়ি ইত্যাদির সংখ্যা যেহেতু বাড়ছিল, পাশাপাশি কুঁড়ে ঘরের সংখ্যা কমছিল, অতএব কলকাতার নগরায়ণ দ্রুত তার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছিল। অষ্টাদশ-উনিশ শতকের নথিপত্রের হিসেব দেখলে জানা যায়, কীভাবে কাঁচা বাড়ির সংখ্যা ক্রমশ কমছিল— ১৭৯৩ খিষ্টাব্দে যেখানে কাঁচা বাড়ির সংখ্যা ছিল ৭৪৭৬০, সেখানে প্রায় তিরিশ বছর পরে ১৮২২-এ পৌঁছে তার সংখ্যা কমে হল ৬৭৫১১, আর তার দশ বছরের মাথায় সংখ্যাটি গিয়ে দাঁড়াল ৬৫৪৬০-এ। অর্থাৎ প্রথম ঊনত্রিশ বছরে যেখানে বছর প্রতি কাঁচা বাড়ির সংখ্যা হ্রাসের পরিমাণ প্রায় ২৫০, সেখানে উনিশ শতকের তিনের দশকে পৌঁছে বছর প্রতি প্রায় দুশো পাঁচ-ছয়টি বাড়ি কমছিল। পরের দিকে অনেক দ্রুত কাঁচা বাড়ির সংখ্যা কমছিল দেখে কেউ মনে না করেন যে, কলকাতা ধীরে ধীরে নগর হয়ে উঠছিল বলেই এই সংখ্যা হ্রাস। আসলে ব্যবসাবাণিজ্যের হাত ধরে যতই কলকাতায় কিছু ভুঁইফোড় অর্থবান শ্রেণির সৃষ্টি হচ্ছিল, দেখা দিয়েছিল নতুন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি, ততই দরিদ্র মানুষের জমি-বাড়ি কিনে নিয়ে সেখানে তাঁদের বড় পাকা বাড়ি তৈরি হচ্ছিল। অর্থহীন কিংবা স্বল্প পুঁজির দরিদ্ররা যে খাস-কলকাতায় ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছিলেন, তা আজকের গপ্পো নয়, কলকাতা বিকাশের সেই প্রথম থেকেই শুরু হয়েছিল। তার পরেও খাস কলকাতায় এত কুঁড়েঘর ছিল যে, ১৮৩৭-এ প্রশাসনিক নির্দেশ জারি করা হল যে, নতুন কোন কুঁড়েঘর আর খাস-কলকাতার বুকে তৈরি করা যাবে না। জঙ্গল, অস্বাস্থ্যকর জলা, লবণহ্রদের দুর্গন্ধময় হাওয়া ইত্যাদি পরিবেষ্টিত কলকাতায় সাহেবসুবদের এবং এদেশীয় কিছু কপালে পুরুষদের নাগরিক সুযোগসুবিধা দিতে ওয়েলেসলি ১৮০৩ সালে একটি উন্নয়ন কমিটি তৈরি করেন, এই কমিটিকেই লটারি কমিটির অঙ্কুর ধরা যেতে পারে।
ওয়েলেসলি যে আট বছর গভর্ণর হিসেবে ছিলেন, সেই সময়ে খাস কলকাতার সাহেবটোলার নানা সুবিধা-অসুবিধার দিকে তিনি নজর দিয়েছিলেন এবং যতদূর সম্ভব চেষ্টা করেছিলেন যে, সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অসুবিধাগুলি দূর করে কলকাতাকে সাহেবদের বসবাসের উপযোগী করে তোলা। তাঁর ধারণা ছিল, এর ফলে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও অপ্রত্যক্ষভাবে কিছু সুফল দেশীয় মানুষেরাও পাবে। কিন্তু পরিকল্পনা করলেই তো আর হল না, তার জন্য চাই সুপ্রচুর অর্থ। এই অর্থ আসবে কোথা থেকে ? কোম্পানিকে চাইলেই তো আর অর্থ মিলবে না। অতএব লটারি করে অর্থের যোগান সুনিশ্চিত করার ভাবনাচিন্তা। কিন্তু এই লটারির কথা মাথায় এল কী করে ?
কলকাতায় লটারি ব্যাপারটি কিন্তু বেশ পুরানো। ওয়েলেসলির কার্যকালের আগেই ১৭৮৪ সালের বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায়, কলকাতায় তখন থেকেই লটারি ব্যাপারটি শুরু হয়েছে এবং টিকিটের চাহিদা ছিল প্রচুর। বলা বাহুল্য সাহেবরাই তখনও এই লটারিতে অংশ নিতে পারতেন, দেশীয় সাধারণের সাধ থাকলেও সাধ্য ছিল না, তার নিয়মও ছিল না। লটারিওয়ালারা প্রথম দিকে ভাবতেই পারেননি যে গুটিকয় দেশীয় রাজাগজা ছাড়া বাকিরা লটারির টিকিটের ব্যাপারে উৎসাহিত হবে। কিন্তু এটা ছিল ব্যক্তিগত লটারি খেলা। এর সঙ্গে সরকারের কোন যোগ ছিল না। ১৭৮৯-এর দিকে একটি বিশেষ ভাবনা নিয়ে লটারির কথাটা মাথায় এল কারুর কারুর। আসলে সাহেবরা এদেশে এসেছেন অনেক দিন হল, কিন্তু সামাজিক মেলামেশা, বলডান্স কিংবা কোন সভাসমিতির জন্য এমন কোন হল নেই, যেখানে ইউরোপীয় মানুষেরা একত্রে সমবেত হতে পারেন। এই ভাবনা থেকেই ১৭৯২-এর ৩১ মে লা গ্যালিস ট্যাভার্ণে সম্মিলিত একদল সাহেব ঠিক করলেন যে, এই সমস্যার সমাধানের জন্য তৈরি হবে একটি “public building for the general accommodation of the settlement”. এই ভাবনা থেকেই কিন্তু পরবর্তীকালের টাউন হলের জন্ম। এই উদ্দেশ্যে তাঁরা লটারি বিক্রি করে সেই টাকা থেকে পাব্লিক বিল্ডিং গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। ৬০ সিক্কা টাকার ৫০০০ টিকিট ছাপা হয়, যার মধ্যে ১৩৩১ টা টিকিটে তিন লক্ষ টাকার প্রাইজ থাকবে, বাকি ৩৬৬৯ টি টিকিট হবে সাধারণ টিকিট, যাতে পুরস্কার পাওয়া যাবে না। প্রায় একই সময়ে একটি প্রাইভেট লটারি কোম্পানি ম্যাসোনিক লটারি কলকাতার বুকে একই উদ্দেশ্যে স্থাপিত হবে একটি হল, তা-ও লটারি বিক্রির টাকা দিয়ে এই মর্মে বিজ্ঞাপন দেয় এবং এই মর্মে ১০০ টাকা করে ৮০০০ টিকিট বিক্রি করা হয়। উভয় খেলাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এবং ওয়েলেসলি ১৭৯৮-এর মে মাস থেকে ১৮০৫ পর্যন্ত এদেশে গভর্ণর জেনারেল থাকার সময়ে একাধিকবার টাউন হলের ফাণ্ড তৈরির উদ্দেশ্যে লটারির ব্যবস্থা হয়েছে এবং ১৮০৫ সালের এই মর্মে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে দেখা যায় যে, তিনি এবং গর্ভণর কাউন্সিলের সদস্যদের অনেকেই এইভাবে টাকা জোগাড় করার ব্যাপারে অন্যতম পৃষ্ঠপোষক।
এই সমস্ত দেখেই সম্ভবত ১৮০৩ সালে ওয়েলেসলি কলকাতার নাগরিক উন্নয়নের কাজের জন্য লটারির পক্ষপাতি ছিলেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে লটারির সাহায্য নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ১৮০৮ সালের এপ্রিল মাসে, লর্ড মিন্টোর সময়ে। সরকারের অনুমোদনে প্রথম লটারি অনুষ্ঠিত হয় ১৮০৯ সালে। এই মর্মে ওই বছর ২রা ফেব্রুয়ারি ‘ক্যালকাটা গেজেটে’ যে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, সেখান থেকে জানা যায়, এই খেলায় প্রথম পুরস্কার ছিল এক লক্ষ টাকা। মোট পুরস্কারের অর্থমূল্য ছিল তিন লক্ষ টাকা। এইসময়েই আজকের যে টেরিটি বাজার, যার মূল্য সেকালে ছিল দুই লক্ষ সিক্কা টাকা, তাও ওই লটারি কমিটিতে পুরস্কার পেয়েই তৎকালীন কলকাতার সার্ভেয়ার এডওয়ার্ড টিরেটা বাজার বসান, সেই থেকেই টিরেটা বাজার অপিচ টেরিটি বাজার নাম হয়েছে। মিন্টোর পরবর্তী গভর্ণর জেনারেল মার্কুইস অব হেস্টিংসের আমলে ১৮১৭ থেকে পাকাপাকিভাবে লটারি কমিটি তৈরি হয়ে যায়। তখন থেকে কমিটি শহরের উন্নয়ন-বিষয়ক নানা প্রকল্পের কাজ দেখতে শুরু করে। লটারি বিক্রির টাকায় পানীয় জলের সঙ্কট মেটানোর জন্য বেশ কিছু পুকুর তৈরি হয়। অনেকগুলি নতুন রাস্তাঘাটও নির্মিত হয়, যেমন— ইলিয়ট রোড, ওয়েলিংটন রোড, স্ট্র্যাণ্ড রোড, কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলেজ স্ট্রীট, আর্মহার্ষ্ট স্ট্রীট, রডন স্ট্রীট এবং হাঙ্গার ফোর্ড স্ট্রীট। তৈরি হয়েছিল এক্সচেঞ্জ-হাউস, তাউনহল, ফ্রি ম্যাসনের বাড়ি, বেশ কিছু উদ্যান এবং সৌধ। এছাড়াও পুরানো রাস্তাঘাট সংস্কার করা, রাস্তা এবং গলিগুলির নামকরণ করা, সাধারণের ব্যবহারের জন্য শৌচালয় এবং গোরস্থানের ব্যবস্থা করার কাজও এই লটারি কমিটির টাকাতেই হয়। ওয়েলিংটন স্কোয়ারের ট্যাঙ্কও এই লটারি কমিটির টাকায় গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালের ক্যালকাটা ইমপ্রুবমেন্ট ট্রাস্টের সূত্রপাত এই লটারি কমিটির হাত ধরেই।
যদিও প্রথম থেকেই লটারি কমিটি ছিল বিতর্কিত একটি কমিটি। উন্নয়নের নামে জনসাধারণের কাছ থেকে টাকা হাতানোর একটা কৌশল হিসেবে অনেকেই একে দেখতেন এবং এর বিরুদ্ধে খড়গহস্ত ছিলেন। কথাটা যে পুরোপুরি মিথ্যে তাও নয়। যবে থেকে দেশীয় সাধারণের জন্য লটারি-ব্যবস্থা উন্মুক্ত করে দেওয়া হল, কত ধনী যে লাভের আশায় সর্বস্ব বেচে একাধিক টিকিট কিনে একটা পয়সাও পায় নি ফলে পথের ভিখিরি হয়ে গিয়েছে, আবার কেউ কপালের গুণে সামান্য একটি-দুটি টিকিট কিনেই আস্ত একখানা বাজার ইত্যাদির স্বত্ত্ব লাভ করেছে। ধনীদের নাহয় ওড়ানোর মতো সঙ্গতি ছিল, কিন্তু কত সাধারণ মানুষ যে লটারি-লাভের অলীক স্বপ্নের পিছনে ঘটিবাটি পর্যন্ত বেচে ফৌত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এমনকি গির্জার পাদরিরাও লটারির টিকিট কেটে ভাগ্য ফেরানোর খেলায় মেতে উঠেছিলেন। আবার অনেকে পুরস্কার পেতেন। ১৮২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চুঁচুড়ার জনৈক প্রাণকৃষ্ণ লাহা এবং লালমোহন পাল এক লক্ষ টাকা পান, এ-টিকিট তাঁরা যৌথভাবে কিনেছিলেন, অতএব টাকাও সমান ভাগে ভাগ হয়েছিল।
এই সুযোগে নতুন খেলাও চালু হয়ে গিয়েছিল। টিকিটের দাম তো নেহাত কম ছিল না, ফলে রাজাগজা ছাড়া সহজে হাত বাড়ানোর উপায় ছিল না ; তার উপর টিকিট প্রায়শই নিলামে উঠত এবং যিনি নির্দিষ্ট ন্যূনতম মূল্যের চেয়ে বেশি দর হাঁকতেন, তিনিই সমস্ত টিকিটের অধিকারী হতেন। বাকিদের হাপিত্যেশ করা ছাড়া উপায় ছিল না। অথচ টিকিট কেনার লোভ ষোল আনা। মানুষের এই স্বাভাবিক দুর্বলতার পথ ধরেই বড়বাজারের কিছু ব্যবসায়ী একজোট হয়ে একখানা সঞ্চয় ভাণ্ডার খুললেন। এই সঞ্চয় ভাণ্ডারের জমা টাকা চৌষট্টি ভাগে ভাগ হবে বলে জানালেন তাঁরা। অংশীদারী হতে হলে প্রথমে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে অংশীদার হতে হবে, তারপর প্রতি মাসে দশ টাকা করে চার বছর পর্যন্ত দিতে হবে, তারপর সেই জমা টাকার সুদ থেকে লটারি কোম্পানির লটারি কেনা হবে। যে টাকা লটারি থেকে লাভ হবে, সেই টাকা সমান চৌষট্টি ভাগে ভাগ করে দেওয়া হবে অংশীদারদের। যদি কেউ মাঝপথে আসল টাকা ফেরৎ চান তিনি ফেরৎ পাবেন। যে-সময় সাধারণ মানুষের মাসিক আয় তিন-চার টাকার বেশি ছিল না, সে-সময় মাসিক দশ টাকার সংস্থান করতে তাঁকে যে গিন্নির গয়না থেকে শুরু করে ঘটিবাটি বিক্রি করতে হবে, তাতে কোন সন্দেহ ছিল না। আজকের চিট ফাণ্ডের এঁরা যেন আদি পুরুষ। ‘সমাচার দর্পণ’ অবশ্য ১৮২৪-এর কাগজে এই নিয়মের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। করবেন বা-না কেন ? বড়বাজারের চার ব্যবসায়ীদের মধ্যে ছিলেন —গদাধর শেঠ, রূপনারায়ণ বসাক, বিজয়কৃষ্ণ শেঠ এবং ভুবনমোহন বসাক। এঁদের কোন পরিচয় আজ পাওয়া মুশকিল। কলকাতার আদিযুগের শেঠ-বসাকদের কোন আত্মীয়-স্বজন হতে পারেন, ভিন্ন মানুষও হতে পারেন। লোকনাথ ঘোষের প্রদত্ত বংশতালিকা থেকে এই নামের কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। নগেন্দ্রনাথ শেঠের শেঠ-বসাকদের ইতিহাস থেকেও না। ‘সমাচার দর্পণ’ প্রশংসা করেছে দু’কলম লিখেছেন বটে, কিন্তু প্রতারিতদের চোখের জলের কোন সংবাদ তাঁরা রাখেন নি।
কিন্তু চিরকাল সমান যায় না। ক্ষোভ বাড়ছিল। কারণটা সহজেই অনুমেয়। যদিও লটারি কমিটি শেষ পর্যন্ত মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে গেছেন, যাতে করে এটা বন্ধ না হয়। বোঝাই যায়, লাভ কম হচ্ছিল না। শেষের দিকে নিজেদের স্বচ্ছ প্রমাণ করার জন্য দেশীয় উচ্চপদস্থদের নিয়ে নানা কমিটি তৈরি করা হত। এইরকম কমিটির সদস্য হিসাবে নাম পাওয়া যায় রসময় দত্ত, দ্বারকানাথ ঠাকুর, হরিমোহন ঠাকুর, রামগোপাল মল্লিক প্রমুখেরা। যদিও ১৮৩০-এর শেষ নাগাদ লটারি কমিটির কাজকর্ম বন্ধ করার হুকুম বিলেতের বোর্ড অব ডিরেক্টরস্‌-এর কাছ থেকে এসে পৌঁছেছিল, তা জানা যায় ‘হরকরা’ কাগজ থেকে। এই তথ্য কতদূর সত্য তা নিরূপণ করার উপায় নেই। তবে নেই-নেই করে ১৮৩৬ পর্যন্ত কমিটি নানাভাবে তার অস্বিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল। শেষে নানা অভিযোগের ভিত্তিতে ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে কোম্পানির ওপরওয়ালারা লটারি কমিটির কাজকর্ম বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

প্রান্তিক মানুষজনের জীবনস্পন্দনকে উপলব্ধি করতে চাওয়ার উপাখ্যান- কৌশিক পাল



দিশারী
কৌশিক পাল
‘বাপের কথা ছাড়ান দ‍্যান বাবু। বাপের যুগ গপ্প কথা হয়া গেইচে আইজ্। সেই হিসাবে আইজ আর প‍্যাট ভরে না। আইজ্ প‍্যাট ভরাতে হলে নতুন হিসাবটা চালু করা দরকার।’
গ্রাম বাংলার আর্থ-সামাজিক ঘূর্ণাবর্তে জটিল রাজনীতির যোগে সৃষ্ট শোষণসর্বস্ব ঝোড়োহাওয়াকে প্রতিরোধ করে বাঁচার-পথ-খুঁজতে-চাওয়া নিস্প্রভ জনজীবনের সংলাপকে বিশ্বাসযোগ‍্য করে তার ওই আঞ্চলিক উপভাষা, প্রমিত বাংলা নয়। আর এখানেই হরিমাধব মুখোপাধ‍্যায়ের (০৩/০৪/১৯৪১ – ১৭/০৩/২০২৫) স্বাতন্ত্র‍্য। জন্মস্থান ও বেড়ে ওঠার বালুরঘাট তথা উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক উপভাষাই যাঁর শ্রেষ্ঠ নাটকগুলির প্রাণ।
১৯৭৮ এর ৪ মার্চ লেখা শুরু করে ৫ মার্চ শেষ করেন জনপ্রিয় একাঙ্ক বেতার নাটক ‘পঁচিশ পঁচাত্তর’। ১০ এপ্রিল তাঁরই নির্দেশনায় আকাশবাণীতে সেটির প্রচার হয়। নাটকটি উৎসর্গ করেন তেভাগার কৃষকদের উদ্দেশে। ১৯৭৮-এ লালরঙের দিনে দাঁড়িয়ে তৎকালীন কৃষকদের ভূমিকেন্দ্রীক দাবীতে যেন শামিল করলেন নিজেকে, সেই তেভাগাকে মনে রেখেই। কিন্তু আর তিন ভাগের এক ভাগ নয়, মালিক পঁচিশ কৃষক পঁচাত্তর, তাই তো ‘পঁচিশ পঁচাত্তর’। শুরুর সংলাপটি সেই নাটকেরই কেন্দ্রীয় চরিত্র বুধা-র।
কলকাতায় কলেজে পড়া এবং চাকরি করার সাথে সাথে দেখা থিয়েটারগুলো ছিল নাটকের-মাটি-বালুরঘাটে ছোটবেলায় দেখা নাটকগুলোর থেকে ভিন্ন স্বাদের। নিজস্ব নাট‍্যচর্চা এবং একই সাথে শম্ভু মিত্র, অজিতেশ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়, কুমার রায়ের মতো মানুষজনেদের সাথে ঘনিষ্ঠ মেলামেশার সুযোগে এবং মনোজ মিত্র, বিভাস চক্রবর্তী, অরুণ মুখোপাধ‍্যায়ের মতো বন্ধুদের সান্নিধ্যে সেই সময়টা ছিল আক্ষরিক অর্থেই এক-সোনার সময়। কিন্তু হরিমাধব মুখোপাধ‍্যায়কে আবার বালুরঘাটে ফিরে যেতে হয় তাঁর অধ্যাপনার চাকরির সুবাদে। হাওড়ার নটনাট‍্যমে যেই প্রতিভার বিকাশের শুরু তার আলো বাংলার প্রান্ত প্রান্তকে ছুঁলো স্বভূমিতে ফিরে আসবার পরেই। পথে ঘাটে আড্ডায় বাজারে সমাজের সব শ্রেণির মানুষজনের সাথে কখনও যশোহরের কখনও পুরুলিয়ার ভাষায় অনায়াসে-কথা-বলা হরিমাধব মুখোপাধ‍্যায় নিজের অঞ্চলের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ব‍্যাপকভাবে প্রয়োগ করলেন নাট‍্য সৃজনে। ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং পুরাকীর্তিসমৃদ্ধ দক্ষিণ দিনাজপুরের আঞ্চলিক উপভাষা, লোকজ সংস্কৃতি, লোকজীবন, আচার-বিশ্বাস, প্রাকৃতিক প্রতিকূলতাসহ মানুষজনের মধ‍্যে তেভাগা, নকশাল এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রভাবে জেগে থাকা সচেতন প্রশ্ন হরিমাধব মুখোপাধ্যায়ের সৃজনে বারবার ফিরে এসেছে। তাই কলকাতা থেকে বহুদূরের এক প্রান্তীয় জেলায় নিজের মাটিকে বুক বুক করে ছুঁয়ে এই ব‍্যতিক্রমীর রচনা-নির্দেশনা শুধু আপন স্বাতন্ত্র‍্যেই উজ্জ্বল নয় জন্মভিটের অহংকারেও।
স্কুলজীবনে তেরো বছর বয়সে ‘তরুণতীর্থ’ নামে একটি দল বেঁধে ফেলা থেকে শুরু করে কলকাতা পর্ব সেরে ১৯৬৯-এ বালুরঘাটে তিনটি নাট‍্যদলের সম্মিলিত চেষ্টায় নাট‍্যদল ‘ত্রিতীর্থ’র ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মাঝের পথটুকু সহজ ছিল না। প্রথম প্রথম একটা বাঁশ কেনার পয়সা ছিল না দলের, ছুটে বেড়িয়েছেন পাতিরাম থেকে হিলি। মা-বোনেদের কাপড়, ঘরের আসবাবপত্রকে সম্বল করে মঞ্চ-সেট বানিয়ে নাটক করেছেন করে মাঠে। নিলামে ওঠা চালকলের মালিককে অনেক অনুরোধ করে যন্ত্রপাতিগুলো নিয়ে, সেই লোহা-কাঠ দিয়ে বানিয়েছেন মঞ্চ। পেয়েছেন অসংখ‍্য মানুষের শর্তহীন সাহায্য। গুড় বিক্রেতা, রিক্সাওয়ালা, পিওন, জমিদারগিন্নি, আইনজীবী, সাধারণ গৃহবধু, সকলের অভিনয়ে এবং আনুষঙ্গিক কাজে সকলের অংশগ্রহণে ত্রিতীর্থ আক্ষরিক অর্থেই ছিল গণতান্ত্রিক। সেই সাথে চলেছে নতুন নাটকের খোঁজ, গানে সুর দেওয়া, মৌলিক নাটক লেখা এবং আগাথা ক্রিস্টি-চেকভ থেকে শুরু করে মহাশ্বেতা দেবী, আশাপূর্ণা থেকে ব্রেশট-এর নাটক আর গল্পাবলম্বনে নাটক লেখা। আক্ষরিক অর্থেই একজন ডেডিকেটেড নাট‍্যকর্মীর মতো প্রযোজনাকেন্দ্রীক সব ক্ষেত্রেই নিজেকে নিয়ে গেছিলেন উল্লেখযোগ‍্য দক্ষতার জায়গায়। দশ পুতুল, বহ্বারম্ভ, শিশুপাল, অনিকেত, বিছন, বীজমন্ত্র, খারিজ, মাতৃতান্ত্রিক, নিকটগঙ্গা, দেবাংশী, লালশালু, বন্দুক তাঁর মৌলিক এবং বিদেশি লেখকদের নাটক ও গল্পাবলম্বনে লেখা নাটকগুলির মধ‍্যে উল্লেখযোগ‍্য। বিভিন্ন নাট‍্যদলে তাঁর নির্দেশিত এবং অভিনীত প্রযোজনাগুলির মধ‍্যে গ‍্যালিলিও, তিন বিজ্ঞানী, জল, পীরনামা, পাপ ও পাপী, দেবীগর্জন, ছেঁড়া কাগজের ঝুড়ি, আক্কেল সেলামী, বন্দিবীর, পাখির বাসা, ছুটির খেলা, বিশে জুন, চার প্রহর, বিছন (হিন্দী), বৃষ্টি বৃষ্টি, উল্লেখযোগ‍্য। বিজন ভট্টাচার্যের দেবীগর্জন তাঁকে অভিনয় এবং নির্দেশনায় যথেষ্ট খ‍্যাতির আসনে বসায়। স্কুলের শতবার্ষিকী, এলাকায় গুটিবসন্তের প্রাদুর্ভাব এ-হেন বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বেশ চটজলদি নাটক লিখে দিতে পারতেন। প্রাণশক্তিতে ভরপুর তাঁর লেখা নাটকগুলো থেকে দর্শক খুব সহজেই ভাললাগা এবং ভালবাসার উপকরণ পেতেন।
একটি বিষয় উল্লেখ করতেই হয় তা হ’ল ২০১৪-১৫ তে রক্তকরবীর রাজবংশী ভাষায় স্ক্রিপ্ট লেখার কথা। উত্তরবঙ্গের চা বাগানে শ্রমিকদের বঞ্চনা, বনাঞ্চলের অস্তিত্ব মুছে সাধারণের অধিকার কাড়া সমূহ প্রাসঙ্গিক ইস‍্যুগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হিসাবে এ এক-ব‍্যতিক্রমী পদক্ষেপ ছিল হরিমাধব মুখোপাধ‍্যায়ের। স্ক্রিপ্ট সম্পূর্ণ করে প্রেসিডেন্সির একটি সেমিনারে তা পড়ে শোনান পবিত্র সরকার, শমীক বন্দ‍্যোপাধ‍্যয়, মলয় রক্ষিত প্রমুখের উপস্থিতিতে। কাজটি খুবই প্রশংসিত হয় এবং রবীন্দ্রসদনে মঞ্চস্থ হয় রাজবংশী ভাষায় রক্তকরবী, অতঃপর তা বালুরঘাট সহ উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু জায়গায় রাজবংশী ভাষাভাষী দর্শকের সামনে অভিনীত হয়। সেই প্রযোজনার মঞ্চসজ্জাতেও ছিল অভিনবত্বের ছাপ।
প্রকৃত অর্থেই সংবেদনশীল মনের নাটককার, নাট‍্যকার, অভিনেতা এবং নাট‍্যসমালোচক হরিমাধব মুখোপাধ‍্যায়ের স্পষ্টবাদীতাও ছিল উল্লেখনীয়। ‘জল’ গল্পটির নাট‍্যরূপের অনুরোধ নিয়ে গেলে মহাশ্বেতা দেবী রাজী হন এবং কয়েকদিনের মধ‍্যেই নাট‍্যরূপ করে তা পাঠিয়ে দেন হরিমাধব বাবুকে। এক ঘন্টা পনেরো মিনিটের সেই স্ক্রিপ্ট পড়ে তাতে অসঙ্গতির জায়গাগুলো দ্বিধাহীন স্পষ্টতায় চিঠি লিখে মহাশ্বেতা দেবীকে জানান তিনি। ’প্রত‍্যুত্তরে মহাশ্বেতা দেবী পোস্টকার্ডে লিখেছিলেন : ‘আমি বুঝতে পেরেছি তুমি আমার গল্প বোঝ। তাই দ্বিধা না রেখে Throw away my script into the dustbin, write your own script yourself as it understood and do it. I give you full liberty’। পঞ্চান্নজন শিল্পী সমন্বয়ে ‘জল’ একটি সফল প্রযোজনা।
দীর্ঘ দিনের নিরলস পরিশ্রম এবং অধ‍্যবসায়, জীবনের প্রতি সর্বোপরি মানুষের প্রতি এক-অনিঃশেষ ভালবাসা, বালুরঘাট তথা সমগ্র উত্তরবঙ্গের প্রান্তিক মানুষজনের জীবনস্পন্দনকে উপলব্ধি করতে চাওয়া একটি ব‍্যাকুল হৃদয়ই প্রয়াত হরিমাধব মুখোপাধ‍্যয়কে নিজের মতো করে নাটকের ভাষায় মানুষের কাছে পৌঁছনোর মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এই প্রয়াণ এক-অপূরণীয় শূন‍্যস্থান। সঙ্গীত নাটক একাডেমি, দিশারী পুরস্কার, বঙ্গভূষণ, রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়‍্যালয়ের ডি লিট সহ আরও অনেক সম্মানে ভূষিত, নাট‍্য আন্দোলনের দিশারী হরিমাধব মুখোপাধ‍্যায়ের প্রতি রইল প্রাচ‍্যের শ্রদ্ধার্ঘ‍্য।

প্রেম ভালোবাসার নৌকার সওদাগর: কুন্তল মুখোপাধ্যায়

প্রেম ভালোবাসার নৌকার সওদাগর: প্রতুল মুখোপাধ্যায়
কুন্তল মুখোপাধ্যায়

দূরে গেলেই কি
চলে যাওয়া যায়
সদ্য ফোটা শিউলির বাস
অবোধ পাখির ডানা ঝাপটানো
ভালোবাসার আশা নাই
জোছনায় উড়ে যাওয়া
মৃদু আর মৃদু ভাসে
ভগ্ন যাদের আলোয়
ডিঙা ভাসাও – ভাসাও…?
কে যেন দিয়েছিল ডাক
সে ডাক অন্তরের
যাক থেমে যাক

আমরা যারা বিগত শতাব্দীর সত্তর দশকে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি তাদের একটা স্বপ্নের কলেজস্ট্রিট ছিল , ফুটপাতের ঝোলানো র‍্যাকে বই দেখা-কেনা ছিল, কফি হাউস, গোলদিঘী , প্রেসিডেন্সির সিঁড়ি, ট্রামের ডিংডিং ,পাতিরাম ,দিলখুশ, রাস্তার মিছিল আর গৌতমদা প্রতুলদা, ছিল। সেক্তদা কমরেড, “মুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি”র মতো বিপ্লবী গানের সাথে “আলু বেচো ছোলা বেচো” আর “আমি বাংলায় গান গাই”-এর প্রতুল মুখোপাধ্যায় বেশি বেশি করে ছিল । ১৯৭৭ সালে আমি সবেমাত্র অধ্যাপনা শুরু করেছি আমার এক বন্ধু ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ডালহৌসি শাখায় সবে চাকরি পেয়েছিল ।

তিনদিনের মাথায় আমাকে ডাক দিল “আমার অফিসে আয় তোর প্রিয় একজনের সঙ্গে আলাপ করাবো”। বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে গিয়ে দেখি আনমনে টেবিল চেয়ারে বসে কলেজস্ট্রিটের রাস্তায় দেখা সেই নিরলঙ্কার, সরল ভঙ্গী নিয়ে বসে আছেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়। আমি গিয়ে টেবিলের সামনে দাঁড়ালাম, ভাবলাম কলেজস্ট্রিটের রাস্তায় আলাপী ছাত্রকে কি আর উনি মনে রাখবেন? আমার ভাবনা বদলে দিয়ে তিনি বলে উঠলেন “এই তুমি সেই নাটক করতে গিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে হেনস্থা হওয়া কুন্তল না? তা কি করেছো নাটক করছো তো? “আমার অধ্যাপনা ও নাটক করার কথা শুনে বললেন— চলো রাস্তায় যায়। তারপর রাস্তায় নেমে চা খেতে খেতে শুরু হলো আড্ডা।
আমি নিকোলাই অস্ট্রভস্কি উপন্যাস অবলম্বনে ইস্পাত লিখছি শুনে প্রতুলদা বলে উঠলেন, পাভেলের মুখে “মুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি” গানটি দেবে নাকি”? আমি তো ট্রামলাইনে হোঁচট খেতে খেতে সামলে নিয়ে বললাম, আপনি অনুমতি দেবেন? প্রায় জড়িয়ে ধরে প্রতুলদা বললেন “কেন নয়” ? তারপর শুধু ইস্পাত নাটকে নয়, আমার নাটকের দলের সংলাপ কোলকাতার সিগনেচার মিউজিক হয়ে গেল ” মুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি”। সেই ১৯৮০ সালের ১লা মে থেকে শুরু করে আজ অবধি আমাদের দলের সদস্যরা অভিনয়ের আগে প্রত্যেকদিন গভীর মনোনিবেশ স্থাপনের জন্য ওই গানটাই গেয়ে উঠি। এইভাবে শুরু হলো প্রতুলদার সাথে পথ চলা। তারপর বিভিন্ন সময়ে, নানাভাবে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সহপাঠী হয়েছি , তা সে কনোরিয়া জুট মিল আন্দোলন, বা বইপাড়ার অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান হোক বা ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানই হোক না কেন।

আসলে প্রতুলদার মধ্যে অন্যজনের সঙ্গে আত্মীয়তা নির্মানে কোনো দ্বিধা ছিল না।
আকাদেমি মঞ্চে আমাদের শূদ্রায়ন নাটক দেখে লাফিয়ে মঞ্চে উঠে পড়া, হায় রাম — চলেছে যুদ্ধে দেখে উত্তেজিত হওয়া স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে কালচক্র নাটকের জন্য চর্যাপদ ভিত্তিক সংগীত নির্মাণের জন্য দীনেন্দ্র চৌধুরীর সহায়তা নিতে বলা আরো কতো কী। বন্ধু সুশীল সাহার অনুরোধে চাঁদপাড়ায় একটা থিয়েটার ওয়ার্কশপের কাজ করতে গিয়ে প্রতুল দা, সুশীল দা আর আমি মিলে ‘ডিঙা ভাসাও সাগরে’ গানটি দিয়ে একটি নাট্য কোলাজ তৈরি করেছিলাম। আর একবার হৃদয়পুরে একটি আলোচনা সভায় প্রতুল দা আর আমি আলোচনা করার পর আয়োজক সংস্থার কর্তা ব্যক্তিদের ও প্রতুলদার অনুমতি নিয়ে আমি যখন চলে আসছি, তখন গান গাইতে উঠে প্রতুল দা প্রথমেই গাইতে শুরু করলেন— ‘ কুন্তল চলে গেলে গাইব না’, কী বিড়ম্বনা। প্রতুলদার বেলেঘাটার বাড়িতে গিয়ে দেখেছি আড়ম্বরহীন, ছিমছাম, সহজ সরল সংসার। ‘আলু বেচো, ছোলা বেচো বেচো বাখরখানি, বেচো না বেচো না বন্ধু তোমার চোখের মনি’ স্রষ্টা প্রতুল মুখোপাধ্যায় ছিলেন আপন সম্মান সৃজনে সচেতন এক ব্যক্তিত্ব। গলার সুরের সাথে সাথে হাততালি দিতে দিতে তাঁর গোটা শরীর চোখেমুখে যে সুরঝর্ণার আলোকধারা প্রবাহিত হত তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। ইউরোপের রাস্তায়, প্যারিসে, প্রাগে, ভিয়েনায় এমন গায়ক/ গায়িকার গায়কী শোনার অভিজ্ঞতা আছে তবে এই বাংলায় আমাদের বড় হয়ে ওঠার সময়ে দেখা ধুতি-পাঞ্জাবী হারমোনিয়াম-তবলা সহযোহে যে মধ্যবিত্ত গায়কীয়ানা গড়ে উঠেছিল, প্রতুল দা তার ব্যতিক্রম। গানের সঙ্গে হাত তালি দিতে দিতে গায়নভঙ্গীতে প্রতুল দা অনেকটাই খঞ্জনী হাতে বহরমপুরে দেখা বীনাদিদু বা শোনপ্রয়াগে মাঝরাতে নদীর পাড়ে বসে রবি চাটুজ্জ্যের খোলাগলায়— ‘ আজি যত তারা তব আকাশে’র সঙ্গে কেমন যেন মিলেমিশে যায়। ২০১০এর পর তার সঙ্গে যোগাযোগটা একটু ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল— এই পর্বেই তিনি বঙ্গবিভূষণ, সংগীত মহাসম্মান, নজরুল স্মৃতি সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। গতবছর আমাদের এলাকায় একটি ছোট সংগীতচক্রে আলোচক-গায়ক হিসাবে তিনি এসেছিলেন, আমিও ছিলাম। আমাকে দেখে শিশুর মতো হেসে, হাততালি দিয়ে গেয়ে উঠলেন আমার প্রিয় গান— ‘ ছোকরা চাঁদ, জোয়ান চাঁদ’ প্রিয় কবি শঙ্খ ঘোষের বাবরের প্রার্থনা বা অরুণ মিত্রের কবিতা সুর সংযোজন করে তিনি যখন গাইতেন তখন মনে হত কোন এক উদাসী বৈরাগী কণ্ঠে গান গেয়ে বিশ্ব ভ্রমণে বেড়িয়েছেন। ‘যেতে হবে বহুদূরে’ বলে হয়ত প্রতুল মুখোপাধ্যায় পার্থিব শরীর ত্যাগ করেছেন তবে যতদিন বাংলা ভাষার চলন থাকবে, মনে হয় ততদিন ‘আমি বাংলায় গান গাই’-এর স্রষ্টা আমাকে ভালোবাসার সিংহাসনে অমর হয়ে থাকবে।

জাতি হিংসার পৃথিবীতে জোটবদ্ধ লড়াইয়ের প্রভাব - সায়ন ভট্টাচার্য


জাতি হিংসার পৃথিবীতে জোটবদ্ধ লড়াইয়ের সাইরেন ‘সন্দীপনী’
– সায়ন ভট্টাচার্য

থিয়েটারের দায় এখন কী! অবশ্য শুধু থিয়েটারই বা কেন! সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা কী কোনোভাবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কোনো দায় নিচ্ছি? এর সঠিক উত্তর হয়তো আমাদের সাম্প্রতিক সময় আমাদের সামনে তুলে ধরছে না, তবে, সচেতনভাবে আমরা ক্ষয়িষ্ণু দেশ কাল পৃথিবীর মানবিক অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হতে চেষ্টা করাটাও অত্যন্ত জরুরি। সময়টাকে স্যামুয়েল বেকেট-এর ‘এন্ডগেম’ নাট্যে বেদনাহত ক্লোভ-এর সংলাপ ধার করে বলতে ইচ্ছে করছে “No one that ever lived ever thought so crooked as we.”

‘সন্দীপনী’ নিছক একটি নাট্য নির্মাণ নয়, বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, একেই কি বলে সভ্যতা?, কারাগার, নবান্ন, কল্লোল, চাঁদ বণিকের পালা, মেফিস্টো, শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে যেভাবে দিক পরিবর্তনের মশাল নিয়ে সংকটময় পৃথিবীর হয়ে প্রশ্ন করেছে, এক‌ই ভাবে হন্তারক সময় কত নৃশংস ভাবে একটা প্রজন্মকে (বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের) শেষ করার খেলায় মেতে উঠেছে সেই সমস্ত বঞ্চিতের হয়ে আবার নতুনভাবে প্রশ্ন করছে ‘সন্দীপনী’।

সময় বদলায়, এবং সেই বদলের ক্রান্তিকাল আসে। বড় ভয় হয় এই সময়গুলোতে। ভয়ের একটাই কারণ – নেতৃত্বহীনতা। মার্কসের ভাষায় পরিবর্তনই শাশ্বত। আবার মার্কসের সাবধানবাণী এও বলে কীভাবে সমকালীন সমাজের গর্ভেই নিহিত থাকে ধ্বংসের অন্ধকার ভ্রূণ। পৃথিবী আবার হয়তো শান্ত হবে, একদিন শাসন ও শোষণের ঝড় থেমে যাবে, প্রত্যেক তরুণ প্রজন্মের চোখে থাকবে স্বপ্ন, মানুষের পাত ভরে উঠবে ফুরফুরে সাদা ভাতে, কিন্তু সত্যিই কি বিনা স্বপ্নে, বিনা রক্তপাতে একটা অন্ধকার সময়কে পরিবর্তন করতে পারবে একটা প্রজন্ম?! আবহমান কাল ধরে মানব সভ্যতার পরিবর্তনকামী এমনই এক স্বপ্নের নাম আর্নেস্তো রাফায়েল গেভারা ডে লা পারনা।
পৃথিবীর সমস্ত খেটে খাওয়া, নিজের হক বুঝে নেওয়া মানুষের অন্যতম হ্যান্ডসাম নায়ক ‘চে’। ‘হ্যান্ডসাম’ শব্দটার একটা পুঁজিবাদী অর্থের প্রতিবাদেই শব্দটা ব্যবহার করলাম, কারণ এর মূল অর্থ তো যিনি নিরলসভাবে সামাজিক কর্মের কর্মের সঙ্গে যুক্ত। স্টাইল আইকন নয়, চে আসলে পৃথিবীর যেখানেই যে মানুষ রাষ্ট্রের সঙ্গে দুর্দমনীয় ভাবে লড়ছেন নিজেদের ক্ষুদ্র কিংবা বৃহৎ পরিসরে তিনি তাদের সহযোদ্ধা, কমরেড। ‘সন্দীপনী’ নাট্যে একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছাত্র ছাত্রীদের সামনে চে-এর ইতিহাস কোন‌ও সিলেবাসের শাসন মেনে নিয়ে আসছেন তা নয়, বরং মানুষ চে গেভারা-কে নিয়ে আনলেন ছাত্রদের সামনে। বিপ্লবী দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ মানুষটার ভিতরেও যে একজন প্রেমিক কবি স্বামী কিংবা পিতার স্পন্দন সদাবহমান বারংবার সেই কথাগুলোই যেন দৃশ্যায়িত হতে দেখছিলাম।
এমন‌ই ক্লাসরুম তো চায় আজকের প্রজন্ম, কটা ক্লাস ঘরে আজ চে গেভারা নিয়ে কথা বলা হয়? জানানো হয় না বলেই থিয়েটারের মঞ্চের উপর এমন এক একটি ইতিহাসকে তুলে ধরতে হয়।

চে আমাদের হৃদয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারেন হিংস্র সাম্রাজ্যবাদের রক্ত-কাদা-মাটির উপর বিদ্রোহের নন্দনকানন। এইজন্যই তিনি বলতে পারেন— “কিন্তু যখনই ভাবি, কেবল আমার সন্তানেরা দুধেভাতে থাকবে? আশেপাশের কত বাচ্চা… তাদের জীবন, তাদের ভবিষ্যত কি বিপন্ন… আমার ভালোবাসার স্বপ্নটা ভেঙ্গে যায় এ্যালাইডা, আমি পারি না। একা সুখী হওয়া যায় না কমরেড!”

এই কথা শুধুমাত্র একজন বিপ্লবী তাঁর বীরাঙ্গনা স্ত্রীকেই বলছেন না, এই উচ্চারণ আসলে কালের কণ্ঠস্বর। সময় যখন অন্ধকার হয়ে থাকে গণমঞ্চে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলোই হয়তো উচ্চারণ করেন কোনো অভিনেতা, শিক্ষক, কবি কিংবা দেশনায়ক। প্রতিবেশীর জন্য ভাবনাই এক নবজাগরণের রাজপথে এসে দাঁড়ানো প্রাথমিক ইস্তাহার। এই রাজপথেই কোনো বঞ্চিতের হাত ধরে কোনো সচ্ছল, কোনো শিক্ষক হাত ধরেন ছাত্র কিংবা ছাত্রীর, কোনো বন্ধু হাত ধরে তার বন্ধুর, কোনো প্রেমিক হাত ধরে তার প্রেমিকার। চে-ফিদেলের যুগলবন্দি আসলে প্রতিবাদের এক সিম্ফনি, যার সুরে কেঁপে ওঠে ক্ষমতাশালী সরকারের চাপিয়ে দেওয়া রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো। সচেতন মানুষের কানে ফিসফিস করে ইতিহাস বারবার বলে যায় ক্লান্ত হয়ে থেমে যাওয়া নয়, কোনো কিউবার মন্ত্রিত্ব নয়, বঞ্চিত বলিভিয়ার পাশে দাঁড়ানোই আমাদের প্রথম এবং প্রধান দায়। বিপ্লব মানে দৃপ্ত মেরুদণ্ডে চোখে চোখ রেখে কথা বলার ফাইনাল রিহার্সাল। সেখানে মতান্তর থাকে, চোখের জল থাকে কিন্তু স্বাধীনতার জন্য মুষ্টিবদ্ধ হাত এক বিন্দুও শিথিল হয়ে যায় না। তাই চে গেভারা হয়ে ওঠেন একটি দর্শন।
প্রত্যেক মানুষের হৃদয়েই এই সুপুরুষ, জেদি গেরিলার বুটের ছাপ এবং বারুদ গন্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে, শুধু তার জন্য প্রয়োজন হয় দীপক বোসের মতন একজন অধ্যাপকের। ঠিক যেমন প্যারিসের ছাত্র আন্দোলনে হিংস্র ফরাসি সরকারের ছাত্রদের উপর নামিয়ে আনা নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের হয়ে কণ্ঠ উত্তাল করেন শেষ শতাব্দীর বিদ্রোহী বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষক জা পল সার্ত্র। সাম্প্রতিক সময়ের ভারতীয় নোংরা রাজনীতির বিষবাষ্প এবং ঘৃণার লেলিহান উদগীরনে ছারখার হতে থাকে তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যত, তখন রনি, অহনা, বিনতা, শঙ্কুর সামনে একজন জ্যান্ত শিক্ষকরূপে দীপক বোস চিনিয়ে দিতে পারেন নির্মম সময়ের জঙ্গল থেকে কীভাবে পাচো, টুমা, পম্বো তাদের কমান্ডারের নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা, কিউবা, কঙ্গো, বলিভিয়া ছারখার করে দাবানল ছড়িয়ে দিয়েছিল হিংস্র শাসন ব্যবস্থা। রাষ্ট্র সবসময়‌ই একটা কাঠামো তৈরির চেষ্টা করে চলেছে। তাকে বজায় রাখাটাও রাষ্ট্রের কাজ। যে কথাগুলো বারবার প্রচার করা হচ্ছে তা হলো – ‘ইতিহাসের শেষ’, ‘আইডিওলজির শেষ’ – তার মধ্যে দিয়ে একটা তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করে এক শ্রেণীর সমাজতত্ত্ববিদ ইতিহাসের নতুন চিহ্ন তৈরি করছেন। ইতিহাসের এই চরিত্র আমাদের বলে – ইতিহাস শেষ মানে হচ্ছে তোমাদের সবরকম প্রতিবাদ প্রতিরোধের শেষ। ইতিহাস শেষের মধ্যে দিয়ে জাহির করার চেষ্টা করা হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম হেজিমনিস্টিক ট্রেন্ড বা ক্ষমতার নাগপাশ। এই কারণেই দীপক বোস-এর মতো শিক্ষকরা রাধেশ্যাম টোডির মতো অভিভাবকদের দ্বারা আজকের পৃথিবীতে সবসময় অপমানিত হচ্ছেন।

নাটককার অনির্বাণ সেন-এমন একটি নাটকের জন্য কলম তুলে নিলেন কেন, তাঁর মুখেই শোনা যাক-“চে গেভারাকে নিয়ে পড়াশোনা করতে চেয়েছিলাম। সাহায্য করলেন প্রফেসর কৌশিক চট্টোপাধ্যায়। নিজের সংগ্রহ থেকে দশটি বই দিলেন। চেকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে দেখা বইগুলি গোগ্রাসে গিলতে সময় লাগলো প্রায় ছয়মাস। তার মধ্য চের সহধর্মিণী এ্যালাইডা মার্চের লেখা My life with Che ভিষন আচ্ছন্ন করে রাখলো বেশ কয়েকদিন। এই বইতে চে যেমন বিপ্লবী তেমনি এক দুর্ধর্ষ প্রেমিক।
বামফ্রন্ট আমলে যেমন প্রায় সবাই সিপিএম ছিলেন নতুন সরকার আসার পর সেই সবাই আবার হঠাৎ করে তৃণমূল হয়ে গেলেন। বাড়ীতে বসে ভাবতাম এভাবে গণমতাদর্শের পরিবর্তন কিভাবে সম্ভব হয়। এছাড়া চে যদি কম্যুনিস্ট হন তবে আশেপাশে যারা বামনেতা হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেন তারা কতটা কম্যুনিষ্ট! মূলত এই চিন্তার জারিত ফসল
‘সন্দীপনী’। এই নাটক যে ধরনের সরাসরি এবং সমকালীন রাজনীতির কথা বলে তাতে এই নাটকটি পড়ে মঞ্চায়নে পিছিয়ে গেলেন বহু দল (যা অবশ্য আমার অনেক নাটকের ক্ষেত্রেই নিয়মিত ঘটনা)। শেষপর্যন্ত লিলুয়া প্রগতির আবীর ঘোষ স্পর্ধা দেখালেন, আমার লেখাটি মঞ্চের আলো দেখল।”

নির্দেশক আবীর ঘোষ বলছেন,”বেশ কিছুদিন ধরেই এমন এক রাজনৈতিক নাটকের সন্ধানে ছিলাম যা সমসাময়িক রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার বিরুদ্ধে মতাদর্শগত রাজনীতির কথা বলতে পারে। দলগত রাজনীতির উর্ধে গিয়ে এমন কিছু কথা বলতে চাইছিলাম যা আমরা অনেকেই বিশ্বাস করি কিন্তু বলতে পারি না অথচ এই সময়ে তা খুবই জরুরী। সন্দীপনী প্রথমবার পড়ার পর এই চাহিদার অনেকটাই যেন মিলে গেলো বলে মনে হলো। একদিকে রাজ্যের রাজনীতি, ছাত্রদের রাজনৈতিক বিমুখতা অন্যদিকে চে গেভারার মত তীব্র রাজনৈতিক মতাদর্শ বিশ্বাসী একজনের উপস্থাপনা৷ এই দুয়ের বিপরীত মেলবন্ধন বা সমাপতন এই নাটকের চালিকা শক্তি। আবার থিয়েট্রিক্যাল চলন বলতে যেটুকু বুঝি তার সব উপাদান এই নাটকের পরতে পরতে। ফলত নির্দেশক হিসেবে এই লোভ সংবরণ করা কঠিন।”

ভালো থিয়েটারের জন্য যেমন একটা ভালো নাটকের প্রয়োজন, তেমন ভাবেই দরকার মননশীল অভিনেতা। এই নাট্য নির্মাণের সম্পদ প্রতিটি অভিনেতা অভিনেত্রী। অবশ্যই তাদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চে গেভারা-র চরিত্রে সুমিত কুমার রায়। যে কোনো ঐতিহাসিক চরিত্রে অভিনয় করা শিল্পীর কাছে একটি চ্যালেঞ্জ। চরিত্র কখন‌ও হয়ে ওঠা যায় না, চরিত্রকে আঁকা যায় বাইরে থেকে মঞ্চে উপর। সুমিত খুব সুন্দর করে বললেন তাঁর চরিত্র নির্মাণের প্রক্রিয়ার কথা, “চে-এর চরিত্রে অভিনয় করার সময় আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। একজন অ্যাক্টর হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে আমি নির্দেশকের থেকে যথেষ্ট স্বাধীনতা পেয়েছি । চে-র চরিত্রের বিভিন্ন দিকগুলি , যেমন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রবিশেষে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে , যুদ্ধক্ষেত্রে , পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে চে গেভারা কেমন এবং তার চরিত্রের নায়কোচিত flamboyancy তাঁর জনপ্রিয়তা আমাদের দেখা।
কিন্তু চার দেয়ালের মধ্যে স্ত্রীর সঙ্গে সংসারী চে আমাদের অচেনা। তখন তার সত্তা নিরাবরণ।
বাইরের সাজানো গোছানো পৃথিবী থেকে আলাদা। চে – র সম্পর্কে যেটুকু তথ্য পাওয়া যায় সেটিও এই দিকটি জানার জন্য যথেষ্ট নয়।
এবং সন্দীপনী তে আমরা চে-র চরিত্রের সেই দিকটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি । একজন মানুষ যখন দিনের পর দিন তার স্ত্রী সন্তান থেকে দূরে যুদ্ধক্ষেত্রে। সেই সময়ে যখন তিনি তাঁর স্ত্রী-কে তাঁর সামনে দেখছেন তখন তাঁকেই আঁকড়ে ধরতে চাইছেন পরম বন্ধুর মত, অবচেতন মনে ঘরে ফেরার তাগিদে তাঁর কাছেই চাইছেন মানসিক আশ্রয়। সন্দীপনী কমিউনিস্ট বিপ্লবী চে-র সাথে সাথে এর আটপৌরে চে-র সাথেই আমাদের সাক্ষাতের মুহূর্ত।” দীপক বোস-এর মতো একজন আদর্শ শিক্ষকের যে মেধা এবং সংযম থাকা প্রয়োজন তার নিখুঁত প্রকাশ ভঙ্গি তৈরি করেন ব্রতীন গঙ্গোপাধ্যায়। অ্যলাইদা চরিত্রের দৃপ্ততা ও এক‌ই সঙ্গে একজন বিপ্লবীর সহধর্মিনী রূপে পাশে থাকার পরেও তিনি যে একজন মা একজন নারী, দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরের মুহূর্তে নিজের প্রতিটা আত্মপ্রকাশকে জ্যান্ত করে তুলেছেন গর্বিতা ঘোষ। এই নাটকের সম্পদ দলগত অভিনয়। থিয়েটার ডিজাইন, বিশেষ করে মিনিমালিস্টিক সেটের জ্যামিতিক বিন্যাস তৈরি করে অনায়াসে বলিভিয়ার জঙ্গলে দর্শককে নিয়ে গেছেন নির্দেশক আবীর ঘোষ। বাংলার মানুষের জন্য এমন থিয়েটার আর‌ও বেশি করে হোক।

 

জমজমাট স্পাই ও অ্যাকশন থ্রিলার ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’-বৃতা মৈত্র

জমজমাট স্পাই অ্যাকশন থ্রিলারদ্য ফ্যামিলি ম্যান

বৃতা মৈত্র

শ্রীকান্ত তিওয়ারি ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (NIA)-র অন্তর্গত থ্রেট অ্যানালিসিস অ্যান্ড সার্ভেল্যান্স সেল (TASC)-এর একজন সিনিয়র অফিসার।


তার কাজের সঙ্গী, বন্ধু ও সহকর্মী জে কে তলপাড়ে। শ্রীকান্তের জীবন দুটি ভাগে বিভক্ত। এক তার পারিবারিক জীবন, যেখানে তিনি একজন দায়িত্ববান স্বামী ও বাবা। আরেকটি হলো শ্রীকান্তের পেশাদারী জীবন, যা চূড়ান্ত পর্যায়ে গোপনীয়।

দেশকে সন্ত্রাসবাদীদের হাত থেকে রক্ষা করায় ব্রতী শ্রীকান্ত। ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’-এর প্রথম সিজনে আমরা দেখি শ্রীকান্ত ও তার টিম চেষ্টা করছে ‘মিশন জুলফিকার’ নামে একটি সন্ত্রাসী পরিকল্পনা ব্যর্থ করার। স্পাই ও অ্যাকশন থ্রিলার ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’ এখনও যাঁরা দেখেননি তাঁদের জানাই, ভারতীয় প্রযোজনায় এই মাত্রার শিরদাঁড়া সোজা করে দেখার মতো অভিজ্ঞতা কমই হয় আমাদের।

নির্মাতা বিখ্যাত রাজ & ডি কে। স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম আমাজন প্রাইম ভিডিও। সিরিজটির প্রথম ও দ্বিতীয় সিজনের চিত্রনাট্য লিখেছেন সুমন কুমার, সংলাপ লেখক সুমিত অরোরা ও সুমন কুমার। তৃতীয় সিজনের কাজ শুরু হয়েছে।
একদিকে পরিবার, অন্যদিকে সিক্রেট মিশনের টানাপোড়েনে পর্যুদস্ত অথচ প্রতিজ্ঞায় অটল একজন আদ্যন্ত মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ শ্রীকান্ত তিওয়ারির চরিত্রে মনোজ বাজপেয়ীর অভিনয় ইতিমধ্যেই দারুণভাবে প্রশংসিত। বলিউডের প্রথমসারির এই অভিনেতার ওয়েব সিরিজে অভিনয়ের খবরে প্রত্যাশায় উন্মুখ ওয়েব দর্শককে বিমুখ করেননি মনোজ। অভিনয়ে এ ছাড়াও আছেন প্রিয়ামণি (শ্রীকান্তের স্ত্রী), শরিব হাশমি (শ্রীকান্তের বন্ধু ও সহকর্মী জে কে তলপাড়ে), শরদ কেলকার, নীরজ মাধব, দলীপ তাহিল, সানি হিন্দুজা, শ্রেয়া ধন্বনথারি প্রমুখ। আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আছেন জি এম ওয়ানি (পাক প্রধানমন্ত্রী কাজি), যতীন্দ্র বহুগুণা, মাইম গোপী, আজহাগাম পেরুমল, আনন্দসামি, বিপিন শর্মা, তারিক আহমেদ খান, শারিক খান, কৌস্তভ কুমার, অসিফ বসরা, শ্রীকান্ত দয়াল ও অন্যান্যরা।
দ্বিতীয় সিজনের গল্প মূলত শ্রীলঙ্কার একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর (তামিল টাইগার্সের অনুপ্রেরণায়) স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিকল্পনা ঘিরে আবর্তিত। এই সিজনের মুখ্য আকর্ষণ দক্ষিণের জনপ্রিয় তারকা সামান্থা রুথ প্রভু, যিনি প্রধান ভিলেনের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। এই সিরিজের হাত ধরেই তাঁর ওয়েব ডেবিউ হলো। শোনা যাচ্ছে, সিজন ৩-এর ট্রেলারে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, কোভিড নাইনটিন অতিমারীর আড়ালে চীন ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে আক্রমণের পরিকল্পনা করছে, এই বিষয়টি। প্রথম সিজন ২০১৯ সালে প্রাইম ভিডিও-তে মুক্তি পায় এবং দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। জনপ্রিয়তার ধারা অব্যাহত রেখে দ্বিতীয় সিজন ২০২১-এ মুক্তি পায়। ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’ ঝুলিতে পুরে নিয়েছে ১১টি ফিল্মফেয়ার ওটিটি পুরস্কার, ৫টি এশিয়ান একাডেমি ক্রিয়েটিভ অ্যাওয়ার্ড এবং আরও অনেক স্বীকৃতি। তৃতীয় সিজনের শুটিং শুরু হয়েছে গত বছর, যার জন্য টানটান অপেক্ষায় ওয়েব সিরিজ দর্শক।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *