magazines

৪৫তম ই-সংস্করণ ।। ৫৬তম সংখ্যা ।। ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

৪৫তম ই-সংস্করণ ।। ৫৬তম সংখ্যা ।। ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

ভাণ পত্রিকা


৪৫ তম ই-সংস্করণ ।। ৫৬ তম সংখ্যা ।।ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সম্পাদক :

সম্পাদনা সহযোগী :​

প্রচ্ছদ :

নক্সা পরিকল্পক :

অন্যান্য কাজে :

ভাণ-এর পক্ষে:

পার্থ হালদার

কর্তৃক

৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা: ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ: ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬

(হোয়াটসঅ্যাপ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ (কথা /হোয়াটসঅ্যাপ)

৮৭৭৭৪২৪৯২৮ (কথা) bhaan.kolkata@gmail.com (ই-মেল) ​

Reg. No: S/2L/28241
সম্পাদকের কথা

।। সম্পাদকের কথা।।

ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

দায় নেবার মানুষ কমছে। অভিযোগ করার মানুষ বাড়ছে। দায় চাপানোর মানুষ বাড়ছে। দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলার মানুষ ক্রমবর্ধমান। আমি কিছু জানি না, ও জানে। আমার কী করার আছে, ওরা বুঝুক। আমি নিজে বাঁচব নাকি তোমার দুঃখের কথা ভাবব? এসব আমাদের কাজ নাকি, তাহলে সরকার কী করবে?

আপে বাঁচলে বাপের নাম— এ প্রবাদ আজকের নয়। তবে নিজেকে টিকেয়ে রাখার জন্যেও অন্যের ঘাড়ে দায় চাপানোর প্রবণতা ক্রমবর্ধমান। রিক্সার চেন বার বার পড়ে যাচ্ছে সে দায় রিক্সাওয়ালার, আমার অফিসের খামকা দেরি করিয়ে দেয় কেন আহাম্মক! স্যার, রাস্তায় খুব জ্যাম, বৃষ্টি পড়ছে– তাতেও আমার অর্ডারি খাবার আসতে দেরি হবে কেন বলুন তো!? আমাকে তো ভাই টাকা কিছু কম খসাতে হয়নি! বাবার জন্য এই বিয়েতে রাজি হয়েছি, বিয়ের ঠ্যালায় নাচ ছাড়তে হল, অথবা ‘মা, তোমার বাড়ি গোছানোর ঠ্যালায় আমি আমার জিনিস খুঁজে পাই না’— পাঠক নির্ঘাত বুঝছেন দায় চাপানো আর স্বার্থপরতা এবং আত্মকেন্দ্রিকতা একই পিতার ঔরসজাত।

একজন শিক্ষক যিনি স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র পড়ান আজকের দিনে তার বিরক্তির শেষ নেই। ছেলেরা আসে না, ছেলেরা পড়ে না, ছেলেরা পড়তে পারে না, বলতে পারে না, উচ্চারণে জড়তা, লিখতে পারে না, ফোকাস নেই, কনসেন্ট্রেশন নেই, কথার দাম নেই, চিন্তার ধার নেই। কী পড়াব, কাকে পড়াব, কতগুলো মুর্খ, অপগণ্ড!— দেশটার হল কী! এবং তড়িৎ গতিতে মনে হবে— আমি কী করব? আমার ওপর কি বিশ্ব ভুবনের ভার! আমার ছেলে ব্যাঙ্গালোরে, আমার মেয়ে ম্যানেজমেন্টে, আমার নাতি বোস ইন্সটিটিউটে— এই যথেষ্ট! আমি তো‌ এসব অর্জন করেছি। সিপিএম তিনমুল বিজেপি যেই থাকুক না কেন, আমার নাতি বিদেশ যেতই। মোটকথা আমি সফল। আমার প্রতিভা আছে। আমার বাপের টাকা আছে। আমি কেন আহাম্মকদের দায় নেব?

আমি যদি ভাঙড়ের বস্তিতে জন্মাতাম। আমি যদি খাঁটি হিন্দু হয়ে মুসলমান মাত্রকেই ঘৃণা না করতাম। আমি যদি মুসলমান হয়ে দেশটাকে জান দিয়ে ভালোবাসতাম। আমার রিক্সা চালক বাবার যদি হঠাৎ করে ঠ্যাং ভেঙে যেত। আমার মায়ের যদি চালের চিন্তা করতে করতে ভয়ে ঘুম ভাঙত— তবে আমি ঠিক কী করতাম!? সেই মায়ের সন্তান হয়ে আমি কলেজে এসে ঠিক কতটা মন দিয়ে পলিটিক্যাল সায়েন্সে অনার্স পড়তাম। কনস্টিটিউশন-এর প্রিয়ামবেল মুখস্ত করতাম—

ভদ্রলোক হতে গেলে এসব কল্পনা শক্তিকে, এত অজস্র ‘যদি’-কে কবর দিয়ে দিতে হয়। মনকে বোঝাতে হয়, অতশত ভাবতে গেলে চলে না। সবাইকেই খুঁটে খেতে হয়, মিত্তাল, আদানি, আর ট্রেনের পা-দানিতে ঝোলা হকার– সবাইকে নাকি ‘খেটে’ খেতে হয়! যার যেমন সাধ্য, সে তেমন বাধ্য। কী আশ্চর্য! কী ভয়াবহ সাম্যবাদী চিন্তা!! কী শিল্পিত দায়সারা কথা!

অতএব সবাই মিলে তোলো ধ্বনি ‘ বল হরি, হরি বোল / যত দোষ নন্দ ঘোষ!

আমি কী করব !?একটি ছাত্র কেন কলেজে আসে? শুধু জ্ঞানার্জনের জন্য? আমরা যারা স্কুল কলেজের শিক্ষক আমাদের কি জ্ঞান অর্জনের পেছনে সে জ্ঞান কে জীবনে কাজে লাগিয়ে রুজিরুটির ভাবনা ছিল না? আজকের ছাত্রকে এই ‘অর্জন’ ঠিক কী দেবে? যদি সে ইতিহাস-সংস্কৃতি-সাহিত্য- বিজ্ঞান- অর্থনীতি-রাজনীতির পাঠ নেয় ? পাঠে পেট ভরবে? কাজ কোথায়? চাকরি কোথায়?  বছর তিনেক বাচ্চা ক্লাস ডিঙিয়ে রাতজেগে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে বিশ বছর নিজেকে ব্যতিব্যস্ত রেখে বুঝল, ধনী বাপের দুলালীর নখে রঙ করা শিখে নেল-আর্টের স্টুডিও খুললে পেট ভরত হয়ত? তবে কেন তাকে খামকা গান্ধীর চিন্তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার মিল অমিল পড়িয়ে হেনস্থা করা হল? ঠকানো হল? আমাদের  মেধাজীবী জ্ঞান তাপস শিক্ষক কূলের এত্ত জ্ঞান- এই সামান্য কথাটুকু বুঝে উঠতে পারেন না!সরকারের ভুল ধরলে , রাজনৈতিক ক্ষমতার সমালোচক হলে শান্তি বিঘ্নিত হবে। আমাদের জ্ঞান আর শানিত লজিক কেবল নিজেকে বাঁচাতে শিখিয়েছে। ছাত্রদের ঘাড়ে সব দোষ চাপালেই কেল্লাফতে। দায়িত্ব পালনের ঝ্যামেলা রইল না। বোকা- হাদাদের পড়িয়ে কী লাভ? গাধা পিটিয়ে ঘোড়া কি সম্ভব? তবে যে তপস্যায়  গড় মধ্যবিত্ত দায় না ঝেড়ে নিজের ঘাড়ে দায় নেবে, তেমন চেষ্টায়; কিজানি গাধার ঘোড়া হওয়াও অসম্ভব নয়!

আজ শিক্ষকদের টেনে আনলুম বলে ডাক্তার  মোক্তার বা অন্যদের আনন্দ পাবার খুব কিছু নেই। কথায় আছে, ঘুঁটে পোড়ে, গোবর হাসে!

কলকাতার গালগপ্পোর ত্রয়োদশ পর্ব লিখলেন - কিশলয় জানা

কলকাতার শীত,১৩ পর্ব
কিশলয় জানা

কলকাতার গরমে সাহেবসুবো থেকে দেশীয়দের নানা অসুবিধার কথা নিয়ে লেখা হয়েছে বিস্তর, কিন্তু সে-সব কথার ফাঁকফোকর গলে কলকাতার শীত যে কখন বেমালুম অদৃশ্যপ্রায় হয়ে থেকেছে কে জানে। সেই এক রাধাপ্রসাদ গুপ্তকে পেয়েছিলাম, যিনি বাঙালির শীতের হরেক মজার কথা শুনিয়েছিলেন, তবে সেখানে কলকাতার শীতের কথা আলাদাভাবে তেমন কিছু ছিল না। আজকের পর্বটি তাঁর অতুলনীয় লেখাটির দুর্বল লেজুড়।

 কলকাতায় এক সময় শীতকালে খুব ঠাণ্ডা পড়ত বলে যাঁরা বলে থাকেন, তাঁদের কথাকে শিরোধার্য করেই বলি, এ-ব্যাপারে ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলছে। সেই কবে, ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে অঘোরনাথ দত্ত মহাশয় কলকাতার জলবায়ু নিয়ে লিখতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, কলকাতার তিনটি ঋতুই কেবল দেখতে পাওয়া যায়। তার মধ্যে গ্রীষ্মকাল চৈত্র মাস থেকে আষাঢ় মাস (যতদিন না বর্ষা শুরু হয় ততদিন), বর্ষাকাল সচরাচর আষাঢ় মাসে বৃষ্টি আরম্ভ হওয়া থেকে ভাদ্রমাস, কখন কখন আরও বেশিদিন এবং শীতকাল অগ্রহায়ণ থেকে আরম্ভ করে মাঘ মাসের শেষ পর্যন্ত অনুভূত হয়। তাও তাঁর মতে, “বৎসরের মধ্যে অগ্রহায়ণ মাসের শেষ এবং মাঘ মাসের প্রথমাংশে সচরাচর শীতের প্রকোপ অধিক দৃষ্ট হয়।” অর্থাৎ এখন যেমন, বারো-তেরো দিন, বড়জোর মাসখানেক কলকাতায় শীত পড়ে, তখনও তার খুব ব্যতিক্রম ছিল এমন নয়। তবে তখন হয়ত ওই মাস দেড়-দুই যে শীতটা পড়ত তা যাকে বলে ‘জব্বর’ শীত, তেমন। এখনকার ফিনফিনে শীতের মতো নয়।

কলকাতায় শীতের কথা উঠলে আমরা নানা স্মৃতিকথা হাতড়াই, সাহেব-সুবোদের ভ্রমণ-বিবরণে চোখ রাখি, এই অধম লেখকও যে সেই সব কাজ করেন নি, এমন নয়, কিন্তু আমরা ভুলে যাই, কলকাতার শীত সম্পর্কে একজন একেবারে বাস্তব তথ্য লিখে গেছেন, যদিও গদ্যে নয়, পদ্যে, ফলে তাঁর কথা আমরা ভুলে বসে থাকি। হ্যাঁ, বুদ্ধিমান পাঠক ঠিক ধরেছেন, আমি ঈশ্বর গুপ্তের (১৮১২—১৮৫৯) কথা বলছি। কলকাতার শীতকাল নিয়ে অন্তত তিনটি কবিতা তিনি লিখে গিয়েছেন— ‘হিমঋতু-বর্ণন’, ‘শীত’ এবং ‘শীতের অত্যাচার’। অস্বীকার করার যো নেই যে, এই তিনটি কবিতার সাক্ষ্যে কলকাতার শীতকাল চমৎকারভাবে ধরা পড়ে। গুপ্তকবির চোখে শীতকাল মানেই কষ্টের সময়। যারা অর্থবান, তাঁরা তোরঙ্গ থেকে শাল বার করে গায়ে চড়ান, বনাৎ পরেন, শোওয়ার সময় গায়ে দেন লেপ-তোষক, কিন্তু যাঁরা দরিদ্র, তাঁদের সেই উপায় নেই, ওই কম্বল কিংবা ছেঁড়া কাঁথাই তাঁদের সম্বল। খুব সুন্দর বলেছেন তিনি—

 

‘যেই জন ভাগ্যধর,             গদী পাতা পাকা ঘর

সদা সঙ্গে সুরত-রঙ্গিণী।

আহার তাহার মত,            বিহার বিবিধ মত,

তাহারে জীবন্মুক্ত গণি।।

ধনীর শরীরে সাল,             গরীবের পক্ষে শাল

কম্বল সম্বল করি রয়।

বেণের পুঁটুলি হয়ে,             শুয়ে থাকে শীত সয়ে

উম বিনা ঘুম নাহি হয়।।

চিরজীবি ছেঁড়া কাঁথা            সর্ব্বক্ষণ বুকে গাঁথা

একক্ষণ তারে নাহি ছাড়ে।

শয়নের ঘর কাঁচা                ভার হয় প্রাণে বাঁচা

জড়ে তার বিন্ধে হাড়ে হাড়ে।।’

সেকালে খাস কলকাতায় অধিকাংশ বাড়ি ছিল মাটকোটা। অট্টালিকা, পাকা বাড়ি—এ-সবের সংখ্যা উনিশ শতকের মধ্যভাগেও যথেষ্ট কম ছিল। ঈশ্বর গুপ্তের এই কথাগুলি যে কত সত্য, তা বোঝা যায়, তাঁর মৃত্যুর দশ বছর পরে জন্ম নেওয়া বিবেকানন্দের মধ্যম ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ দত্তের মূল্যবান স্মৃতিকথা থেকে। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ফেলে আসা দিনের কলকাতার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে তিনি “শীতের কথা” নামের একটি ছোট্ট অনুচ্ছেদই দিয়েছেন। তিনি ছাড়া আর কেউই শীত নিয়ে এমন আলাদা অনুচ্ছেদের কথা ভাবেন নি। নবীন পাঠক, যিনি এখনও এই স্মৃতি ও তথ্যের আড়তে ভরা বইটি পড়েন নি, তাঁর জন্য পরিচ্ছেদ থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ তুলে দিচ্ছি, তাহলে অন্যান্য পাঠক বুঝতে পারবেন যে, কবিতায় ঈশ্বর গুপ্ত যা বলেছেন, তা নেহাত কথার কথা নয়, জলজ্যান্ত বাস্তব। মহেন্দ্রনাথ বলেছেন, “আমাদের ছেলেবেলায় দেখিয়াছি কলকাতায় দারুণ শীত পড়িত। রাত্রিতে শোবার সময় একটা মালসা করে উনান থেকে এক মালসা আগুন নিয়ে ঘরে রাখা হইত। সমস্ত ছোট ছেলেরা সেই আগুনে  (শরীর) সেঁকে তারপর লেপের ভিতর ঢুকিত। দরজা জানালার গনিক্লথ (Gunny Cloth) ডবল করে পর্দা দেওয়া হইত এবং ঘরে আগুন থাকা সত্ত্বেও লেপের ভিতর হি-হি করে কাঁপতুম। তখন কলকাতায় বাড়ি ঘর সামান্য ছিল, সর্বত্র পুকুর, কানাচ ও বাগান থাকায় হাওয়াটা জোরে আসিত এবং ঠাণ্ডাটা বড় বেশি হইত। গোলপাতা বা খোলার ঘর এইটা ছিল সাধারণ গৃহ। কোঠাবাড়ি তখন অল্প লোকের ছিল। এত লোকজন, কয়লার আগুন, গ্যাসের তাত না থাকায় শহর এত গরম হইত না, সেইজন্য শীত বেশি বলিয়া বোধ হইত।” এই সূত্রেই জনৈক এক বৃদ্ধের কথা জানিয়েছেন, যিনি বলেছিলেন, তাঁদের ছোটবেলায় হুগলীতে রাতে গুঁড়ি গুঁড়ি বরফ পড়ত। খড় বিছিয়ে তার ফাঁকে সরায় করে জল রাতের বেলায় বাইরে রাখলে জমে বরফ হয়ে যেত। এই কথাকে অতিশয়োক্তি বলে মনে করলে তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিই, রাজনারায়ণ বসুও বোড়ালে শীতকালে রাতের বেলা শিশির পড়ে ভোরে তা জমে বরফে পরিণত হওয়ার কথা বলেছেন। স্মরণে আসছে না কোথায় পড়েছিলাম, কোন স্মৃতিকথায় সম্ভবত, যেখানে হুগলীর কোন গ্রামে একবার বরফ পড়ার সংবাদ ছিল। শীতের সকালে উঠে সকলে দেখেছিল, চারপাশে মিহি তুষার জমে আছে। সম্ভবত অত্যাধিক ঠাণ্ডার জন্য শিশির ঘনীভূত হয়ে তুষারে পরিণত হয়ে থাকবে।

মহেন্দ্রনাথ থাকতেন উত্তর কলকাতার সিমলেতে। তাঁদের অবস্থাও তখন স্বচ্ছল ছিল। অতএব মালসার আগুন পুইয়ে, লেপের তলায় হি-হি করে কাঁপতে কাঁপতে শীতকে হয়ত উপভোগ করেছিলেন, কিন্তু অধিকাংশের সেই সৌভাগ্য হত না। তিনি যে ‘গানি ক্লথে’র কথা বলেছেন, তা মূলত চট বা তুষের কাপড়। শীত আটকানোর জন্য এই চটের পর্দা ডবল করে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। শীতকালে অভাবী লোকেরা এই গুণচট পেতে শুয়ে থাকতেন। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের পিসিমা নিস্তারিণী দেবী অভাবী ছিলেন, তাঁর স্মৃতিকথায় দেখি রাতের বেলা উনুনে ভাত রান্নার পর তার পাশেই গুণচট পেতে তাঁকে শুয়ে থাকতে।

অর্থবান মানুষদের কাছে শীত একরকম ছিল, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে শীত ছিল খুবই কষ্টকর একটা কাল। সন্ধ্যেবেলায় ভাতে ভাত খেয়ে সকলে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ত। মুড়ির চাক্তি এবং খাঁটি খেজুরের রস অবশ্য মিলত সহজেই। অতুল সুর তাঁর কলকাতা-বিষয়ক স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন, বিশ শতকের গোড়ার দিকে তাঁর ছেলেবেলায় শীতকালে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠলেই শোনা যেত, মুড়ির চাক্‌ ছোলার চাক্‌ চিঁড়ের চাক্‌-এর ফিরিওলার ডাক। সেইসঙ্গেই শীতকালে ভোরবেলা “চাই খেজুর রস” বলে হেঁকে হেঁকে খেজুর রস বিক্রি করতেন শিউলিরা। সে-সময় কলকাতার লোকেদের শীতকালে গায়ে খড়ি ওঠার সমস্যার জন্য বিষ্ণুতেল কিংবা ঘী মাখার রেওয়াজ ছিল। পায়ের ফাটা সারাতে আমের আঠা ব্যবহারের কথা গুপ্তকবি জানিয়েছেন। তবে শীতকালে আমের আঠা কীভাবে পাওয়া যেত তা জানি না। হতে পারে, এই আঠা বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে জমিয়ে রাখা হত। কারণ ঈশ্বর গুপ্ত শীতকালে এই আঠা ‘আক্রা’ হয়ে উঠত বলে জানিয়েছেন। হয়ত আরও নানা জিনিসের মত এই আঠাও মাথা-ঘষা প্রভৃতি ফিরিওলারা বিক্রি করতেন। পয়সাওলা এবং সম্ভ্রান্ত বাবুরা এই সময়ে পায়ে দিতেন ক্যাম্বিসের জুতো। গাঁজা, মদ, চরস ইত্যাদি সহযোগে শীত তাড়ানোর জন্য ইয়ার-দোস্ত নিয়ে মজলিসও বসাতেন তাঁরা। গঙ্গাসাগর যাত্রী সাধুসন্তদের ভীড়ে তখনও শহর গুলজার হত। খোলা আকাশের নীচে মাঠে বসে তাঁরা ভস্ম মাখতেন, গাঁজায় দম দিতেন আর মুখে বোম বোম শব্দ করতেন। জল প্রায় বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে যেত, মনে হত, “জলে উঠেছে দাঁত, কার সাধ্য দেয় হাত, আঁক ক’রে কেটে লয় বাপ্‌।”

কলকাতাবাসী সাহেবসুবোর কাছে কিন্তু নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ছিল আমদ-আহ্লাদের কাল। গরমে যেমন কাবু হয়ে তাঁরা কলকাতা ছেড়ে পালাতেন, শীতকালে তেমন হত না, বরং ফ্যানি পার্কসের মতো কেউ কেউ ইংল্যাণ্ডবাসী বন্ধুদের শীতকালেই কলকাতায় আসার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রায় সকলেই জানিয়েছেন, শীতকাল মানেই দেদার ফূর্তি, অনেকেই ছুটতেন কাছাকাছি ব্যারাকপুরে। গঙ্গার ধারে পাখি শিকার করা যেত, চাই কি কাছের জঙ্গলে খরগোশ। দিনটা হু-হু করে কেটে যেত। ব্যারাকপুরে তখন নেই-নেই করে প্রায় সকল সম্ভ্রান্ত ইংরেজরই একটা না একটা বাসাবাড়ির ব্যবস্থা ছিল। কলকাতার বুকে বসেও অবশ্য শীতের মজা নেওয়া যেত যত খুশি। সপ্তাহান্তের অপেক্ষায় না থেকে প্রায় রোজই এখানে-ওখানে বলডান্স, ডিনার  পার্টি, থিয়েটার দেখা, শিকারে যাওয়া, শীতের দুপুরে গঙ্গাবক্ষে ভ্রমণ কিংবা সার্কাস দেখতে যাওয়া। সাহেবঘেঁষা বাঙালি বাবুরা অনেকেই এই সময় বিশেষ পার্টি দিতেন। রাজা রামমোহনের বাড়ির পার্টির কথা অনেক সম্ভ্রান্ত সাহেবই উল্লেখ করেছেন। ফরাসি বটানিস্ট এবং পরিব্রাজক ভিক্তর জ্যাঁকমো তো এইরকম একটি পার্টিতে আহূত হয়ে রামমোহনের সঙ্গে আলাপ করে এত মুগ্ধ যে বলেই বসলেন, সারা ভারতবর্ষে এই একজন আলোকপ্রাপ্ত আধুনিক মানুষ তিনি দেখলেন, যিনি বাস্তবিকই এক রাজা। নিজের দিনলিপিতে তাঁর পরিমিত পানাহারের প্রশংসাও করেছেন তিনি। এই কথা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে রাজনারায়ণ বসু কে না উল্লেখ করেছেন পরবর্তীকালে। জোড়াসাঁকোর রূপলাল মল্লিকের বাড়িতে ঘটা করে বল নাচ, পার্টি ইত্যাদির আয়োজন হত এবং ছোট-বড় সাহেব-সুবোরা সেই পার্টিতে হামলে পড়তেন।

আভিজাত্য প্রদর্শনের জন্য বাঙালি বাবুদের শীতের অঙ্গ ছিল শাল। সেকালে শাল গায়ে দেওয়াও যেমন বনেদিয়ানা ছিল, তেমনই খুশি হয়ে ব্রাহ্মণসহ অন্যান্য পারিষদদের শাল দেওয়াটাও ছিল বনেদিয়ানার অঙ্গ। দ্বারকানাথ ঠাকুর প্যারিসে তাঁর তরফ থেকে দেওয়া এক পার্টিতে আগত সকল মহিলাদের শাল দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। নবকৃষন কবিয়াল থেকে গুণীদের সম্মান জানানোর জন্য শাল উপহার দেওয়ার রেওয়াজ চালু করেছিলেন। এই রীতি উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে আজ পর্যন্ত চলে আসছে। ‘নব-নাটক’ লিখে রামনারায়ণ তর্করত্ন সেই উনিশ শতকের মধ্যভাগে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির তরফ থেকে পুরস্কারের অর্থমূল্য ছাড়াও দু’খানি দামি শাল পারিতোষিক হিসেবে পেয়েছিলেন। সাহেবি পোশাকও কেউ কেউ গায়ে চাপাতেন। এমনকি হদ্দ গরমের দিনেও কেউ কেউ যে সাহেবিয়ানা দেখানোর জন্য শীতের পোশাক গায়ে চাপাতেন তা হুতোম চিরকালীন করে রেখে গিয়েছেন “রেলওয়ে” নামক লেখার ব্রাহ্ম বাবুর মধ্যে দিয়ে। বাবুটি দুর্গোৎসবের ছুটিতে বেড়াতে চলেছেন, তাঁর পরনে—”একটী কাল বনাতের পেনটুলেন, ও চাপকান পরা ছিল, তার ওপোর অ্যাক্‌টা নীল মেরিনোর চাইনা কোট, মাথায় অ্যাক্‌টা বিভর হেয়ারের চোঙ্গাকাটা ট্যাসল লাগানো ক্যাটিকৃষ্ণ ক্যাপ্‌ ও গলায় লাল ও হলদে রঙের জাল বোনা কম্‌ফরটার।” হতে পারে ক্যারিকেচার, কিন্তু সে-কালে এইরকম শীতের পোশাকে কলকাতার বাবুরা অভ্যস্ত ছিলেন। মহেন্দ্রনাথ দত্ত পূর্বোল্লিখিত গ্রন্থে জানিয়েছেন, সেকালে অবস্থাপন্ন লোকেরা নিমন্ত্রণ খেতে গেলে চীনের কোট গায়ে দিয়ে যেত। এর বুকটা লম্বা চেরা, তাতে হাড়ের বোতাম দেওয়া থাকত। এই হাড় কেটে বোতাম তৈরির কাজ হত যে-গলিতে, সেই গলিই হল আজকের হাড়কাটা গলি।

শীতকালে সার্কাস দেখতে সাহেব-মেম থেকে দেশীয়রা ভীড় জমাতেন। সার্কাস ছিল শীতকালের অঙ্গ। রাধাপ্রসাদ গুপ্ত ‘মহানগর’ পত্রিকার “সার্কাস ও সার্কাসে বাঙালি” নামক লেখায় স্মৃতি-রোমন্থন করেছেন যে, ১৯৩২-এর দশকেও কলকাতায় “বড়দিনে হগ সাহেবের বাজারের কেক, কমলা লেবু, শাঁকালু ইত্যাদির সঙ্গে বড়দের হাত ধরে সাহেবটোলার রোশনাই আর গড়ের মাঠে সার্কাস না দেখলে বড়দিন পুরো হত না।” তার পঞ্চাশ বছর আগের কলকাতাতেও বড়দিন থেকে শীতকালের অঙ্গই ছিল সার্কাস। কলকাতায় বিদেশী সার্কাস আসার আগেই বাঙালি ধরনে সার্কাসের প্রাক্‌-রূপ দেখা গিয়েছিল ১৮৬৮-তে সাতুবাবুর বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতে অনুষ্ঠিত হিন্দুমেলার দ্বিতীয় অধিবেশনে। এখানে আগের বছরের মতো কুস্তি, ইউরোপীয় কায়দায় ব্যায়াম, ঢেঁকি-ঘোরানো ইত্যাদির সঙ্গে একজন যুবক ঘোড়ায় চড়ে বেড়া টপকে সকলের প্রশংসা অর্জন করে। তবে কলকাতায় প্রথম সার্কাস আসে ১৮৭৩-৭৪ সাল নাগাদ। “উইলসনস্‌ গ্রেট ওয়ার্ল্ড সার্কাস” তথা উইলসনের সার্কাস দেখতে এসে কলকাতার শীতের সার্কাসকে অমর করে গিয়েছেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। এই সার্কাসে তৃতীয় শ্রেণির টিকিটের মূল্য ছিল আট আনা। সার্কাসে ঘোড়ার খেলে দেখে রামকৃষ্ণ মহেন্দ্রনাথ তথা কথামৃতকার শ্রীম-কে বলেছিলেন, ‘দেখলে বিবি কেমন ঘোড়ার ওপর বন্‌-বন্‌ করে দৌড়চ্ছে। কত কঠিন, অনেকদিন ধরে অভ্যেস করেছে, তবে তো হয়েছে। একটু অসাবধান হলেই হাত-পা ভেঙে যাবে, আবার মৃত্যুও হতে পারে। সংসার করা ঐরূপ কঠিন। অনেক সাধন-ভজন করলে পর, কেউ-কেউ ঈশ্বর কৃপায় পেরেছে। অধিকাংশ লোক পারে না।” উইলসনের সার্কাস বাদে আরও কয়েকটি পৃথিবীবিখ্যাত সার্কাস সেকালের কলকাতায় এসেছে। যেমন-ইতালীর চিয়ারিনীর সার্কাস, বিলেতের হারম্‌স্টোনস্‌ সার্কাস, রাশিয়ার ইসাকো সার্কাস। বাঙালিদের মধ্যে প্রথম ন্যাশনাল নবগোপাল মিত্র বিদেশী সার্কাসের প্রেরণায় ঠনঠনের মাঠে একখানি সার্কাস দল তৈরি করেন। তাঁর সার্কাসের দুরবস্থা বুঝতে গেলে অবনীন্দ্রনাথের ‘ঘরোয়া’ পড়তে অনুরোধ জানাই। তবে নবগোপাল মিত্র না পারলেও তাঁর জামাই রাজেন্দরলাল মিত্র ১৮৮৩ নাগাদ মির্জাপুরে ‘গ্রেট ইণ্ডিয়ান সার্কাস’ নাম দিয়ে একটি সার্কাস খোলেন। রামমোহনের নাতি হরিমোহন রায় ছিলেন অন্যতম পোষ্টা। এই সার্কাসই প্রথম দেশে-বিদেশে খেলা দেখাতে যায়। জনপ্রিয়ও হয়েছিল। তবে নানা কারণে ১৮৯৯ সালে সার্কাসটি বেচে দেওয়া হয় এবং কেনেন পরবর্তীকালের বাঙালি সার্কাসের বিস্ময় প্রোফেসর প্রিয়নাথ বোস। তিনি সার্কাসের নাম দেন ‘গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস’ যা প্রোফেসর বোসেস্‌ সার্কাস নামে দেশে-বিদেশে বিখ্যাত হিয়েছিল। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে বিদেশে শো করতে গিয়ে তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির সার্কাসও চিরতরে ইতিহাসের পাতায় চলে গেছে। চলে গেছে কলকাতার শীতের একটি জমজমাট আকর্ষণ।

 

উনিশ শতক ও সেকালের কথার প্রথম ভাগ - তন্ময় দেবনাথ



উনিশ শতক ও সেকালের কথা

পর্ব ১

সেকালের কলকাতায় জুয়াচুরি ও জালিয়াতি

তন্ময় দেবনাথ

১৯৭২-এর ৬ মার্চ নির্মলকুমার বসু আনন্দবাজার পত্রিকা-তে ‘কলিকাতার সামাজিক সমস্যা’ নামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন, সেখানে তিনি জানিয়েছেন উনিশ শতকের শুরুতে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে পূর্বের অভ্যস্ত সমাজজীবনকে শহুরে মোড়কে নতুন রূপ দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সেই প্রচেষ্টা পুরোপুরি সফল হয়নি। একদিকে নাগরিক চাহিদা, চাকরির আকাঙ্ক্ষা এবং তার সঙ্গে ব্রিটিশ অনুকরণ সব মিলিয়ে পল্লীপ্রকৃতির সঙ্গে শহুরে বাঙালির জীবনে বিচ্ছিন্নতার বোধ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তাছাড়া নতুন শহরের ব্যস্ত কর্মজীবন মধ্যবিত্ত বাঙালির মনে যে পারিবারিক উদাসীনতার জন্ম দিয়েছিল তার একটি উদাহরণ অবশ্যই শরৎচন্দ্রের ‘নিষ্কৃতি’ গল্পের গিরীশ। বলা বাহুল্য, এই শ্রেণির মানুষরাই সত্তর-আশির দশকে রামকৃষ্ণ-ভক্তির আশ্রয় নিয়েছিল। তবে লক্ষ্যণীয় এই যে, সেই শহুরে কর্মব্যস্ত জীবন ও নতুন উন্মুখ সমাজব্যস্থায় চুরি ও জালিয়াতির মতো একের পর এক অভিনব কাণ্ড ঘটেছে। এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়ে হুতোম প্যাঁচার নকশা-র (১৮৬১) সেইসব ছোটো ছোটো গল্প। তার মধ্যে ‘বুজ্‌রুকী’ অংশে হুতোম লিখেছেন, হরিভদ্দর খুড়ো তাঁকে জানিয়েছিল সিমলে পাড়ায় এক মহাপুরুষ সন্ন্যাসীর আগমন হয়েছে—তিনি সোনা তৈরি করতে পারতেন, লোকের মনের কথা গুণে বলতে পারতেন, পারা ভস্ম খাইয়ে পচা মড়াকেও জাগিয়ে তুলতে পারতেন। হুতোম সেই সন্ন্যাসীকে নির্দ্বিধায় বলেছিলেন ‘ভারি বুজরুক’। এই ‘বুজ্‌রুকী’ প্রসঙ্গেই হুতোমের মনে পড়ে গিয়েছিল ‘জোচ্চোরের জোচ্চূরি’ পাকড়াও করার পূর্ব মুহূর্তের কথা। কিন্তু এই সূত্রে হুতোম সময় ও সমাজের পরিবর্তন অর্থাৎ শিক্ষিত শহুরে বাঙালি জীবনের বিচ্ছিন্নতার যে প্রকরণটি ধরিয়ে দেন তা নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, ‘যখন হিন্দুধর্ম্ম প্রবল ছিল, লোকে দ্রব্যগুণ, কিমিয়া (অর্থাৎ ‘রসায়নবিদ্যা’—সূত্র: অরুণ নাগ), ভূতত্ব জানতো না, তখনই এই সকলের মান্য ছিল। আজ্‌ কাল ইংরাজি লেখা পড়ার কল্যাণে সে গুড়ে বালি পড়েচে,’। তাই হুতোমের সিদ্ধান্ত এই ধরনের বুজরুকি মানুষে সাধারণত পেটের দায়ে করে থাকে। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বীতংস’ গল্পটিকে যদি হুতোমের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে চাই খুব একটা বিরুদ্ধতা করা হবে না। কালাজ্বরের দৌরাত্ম্যে আসামের চা-বাগানে কুলি জোগান দেওয়ার মতো অসম্ভব ব্যাপারকে সম্ভব করে দেখিয়েছে গল্পের সুন্দরলাল। তার সন্ন্যাস গ্রহণ এবং নানাবিধ কৌশলের শিহরণ সাঁওতাল পরগনার মানুষদের মোহিত করে তুলেছিল। সুতরাং সুন্দরলালের প্রতি সাঁওতালরা প্রশ্নহীন আনুগত্যের বশেই এক সময় বাধ্য হয়ে চা-বাগানে কুলি হিসেবে যোগ দেয়, আর সুন্দরলাল সাহেবের থেকে বুঝে নেয় তার প্রাপ্য কমিশন। পূর্বে সুন্দরলাল পেশায় শ্রমিক ছিল, কিন্তু এইরকম কমিশন উপার্জনের পর তাকে আর ভাবতে হয় না পাথরের মতো নির্মম রাঙামাটিতে কঠিন পরিশ্রমে লাঙল ঠেলে গমের ফলন ভালো হল কি মন্দ হল।   

              হুতোমের কথা থেকে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না, সেকালে বুজরুকির প্রাবল্য কতখানি ছিল। মহেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯২৯-এ লিখেছিলেন কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা—সেখানে বলা আছে, মহেন্দ্রনাথের মা ভুবনেশ্বরী দেবীর ছোটো বয়সে এক চোর তাঁর পায়ের মল খুলে নিয়েছিল। তবে সেকালের শিক্ষিত বাঙালিরা যে এসব কিছুকে মদত দিতে কোনো রকমভাবে আগ্রহী ছিলেন না তা বলা বাহুল্য, তাই খুব স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে সেকালে এর জন্য কি কোনো সামাজিক সংগঠনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল? নিশ্চয়ই হয়েছিল। এমনকি এই সংক্রান্ত সামাজিক সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে একটি স্বতন্ত্র পত্রিকাও প্রকাশিত হত। আমরা জানি, উনিশ শতকে যেসব পত্রিকা ছাপা হয়েছিল তার মধ্যে সংবাদপত্রের সংখ্যা ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। স্বপন বসুর একটি লেখার সূত্র মতে বলতে পারি এই সংখ্যা ছিল তিনশোর বেশি। (প্রবন্ধ: ‘উনিশ শতকের বাংলা পত্রিকা—সামাজিক দায়বদ্ধতা’)। ১৮৮৬-তে কলকাতায় অনুসন্ধান সমিতি গঠিত হয়েছিল। এই সমিতির কার্যক্ষেত্র ছিল যথেষ্ট বিস্তৃত এবং দেশের লোকেদের সহানুভূতি আশানুরূপভাবে অর্জন করেছিল। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নানা বুজরুকির অনুসন্ধান করা এবং তা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা মারফত দেশবাসীকে জানিয়ে সচেতন করাই ছিল এই সমিতির লক্ষ্য। এক বছর অতিক্রম করার পর সমিতির সদস্যরা সম্পাদকদের নানান টালবাহানা খেয়াল করে নিজেদের কাগজ প্রকাশ করবার তাগিদে ১২৯৪ সালের ১৩ শ্রাবণ প্রথম প্রকাশ করেন অনুসন্ধান নামের একটি পত্রিকা। অনুসন্ধান সমিতির পাক্ষিক মুখপত্র। এই পত্রিকার লক্ষ্য ছিল মানুষ যেন কোনোভাবেই প্রতারকদের দ্বারা না ঠকেন—সে-বিষয়ে সচেতন করা। অর্থাৎ একটি ‘পাবলিক কালচার’ গড়ে তোলা। দীপেশ চক্রবর্তী তাঁর ইতিহাসের জনজীবন ও অন্যান্য প্রবন্ধ (২০১১) বইতে ‘পাবলিক কালচার’ বলতে বুঝিয়েছেন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির নিজেদের প্রয়োজনে একটি সমষ্টিগত জীবনের আয়োজন করা।

অনুসন্ধান পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রথম লেখা ছিল ‘কলিকাতার জুয়াচুরি’। প্রথমে আমরা বোঝার চেষ্টা করব অনুসন্ধান সমিতির সদস্যরা জুয়াচুরি ব্যাপারটিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাঁদের মতে জুয়াচুরির দুটি পর্যায়—প্রত্যক্ষ জুয়াচুরি এবং পরোক্ষ জুয়াচুরি। প্রত্যক্ষ জুয়াচুরি ব্যাপারটি কলকাতাকেন্দ্রিক, যেমন ব্যাবসার ক্ষেত্রে প্রতারণা অর্থাৎ লাভের প্রলভন দেখিয়ে কার্যসিদ্ধির চেষ্টা। অন্যদিকে মফস্‌সলে থেকে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের দ্বারা প্রতারণার শিকার হলে তাকে বলা হবে পরোক্ষ জুয়াচুরি। তাছাড়া পরোক্ষ জুয়াচুরি কলকাতারও অংশ। জনগণকে পরোক্ষ জুয়াচুরির প্রকার ভেদ সম্পর্কে সতর্ক করার জন্য কলকাতার পরোক্ষ জুয়াচুরিকে আটটি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়ে যাবে, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের দুটি গল্প ‘আধুনিক সন্ন্যাসী’ (মাঘ ১৩১১) ও ‘বিবাহের বিজ্ঞাপন’ (বৈশাখ ১৩১১)। প্রথম গল্পে পাই কলকাতার বেঙ্গল ব্যাঙ্কে জাল চেক ভাঙিয়ে বিশ হাজার টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যাওয়া ছদ্মবেশী সন্ন্যাসীকে ডিটেকটিভ পুলিশ গ্রেফতার করেছে। দ্বিতীয় গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র রাম অওতার নিজের গোপন অভিসন্ধি চরিতার্থ করার জন্য মিথ্যে পরিচয় দিয়ে কাশী যাত্রা করে, আর সেখানে দুই প্রতারকের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বশূন্য হয় এবং বাহ্যজ্ঞান হারায়। ‘কপট সন্ন্যাসী’ নামে একটি কাহিনি ছাপা হয়েছিল অনুসন্ধান-এর ১২৯৪-র ১৫ ভাদ্র সংখ্যাতে। মেদিনীপুর বড়বাজার থেকে জনৈক চন্দ্রনাথ মৈত্র সেই ঘটনার বিবরণ অনুসন্ধান সমিতিকে লিখে পাঠিয়েছিলেন। এক সন্ন্যাসী মেদিনীপুরের সম্ভ্রান্ত জন্মেজয় মল্লিকের কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্ত পুত্রের সুস্থতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যজ্ঞ করিয়ে নেন, এবং সেখান থেকে নিজস্ব কৌশলে দশ হাজার টাকার দশটা কড়কড়ে নোট নিয়ে সটান বেপাত্তা। তখন এই ঘটনা থানাপুলিশ পর্যন্ত গড়িয়ে ছিল, পুলিশ এই মর্মে একাধিক নিরপরাধী সন্ন্যাসী ও তাদের পারিষদবর্গকে গ্রেফতার করলেও আসল জোচ্চরকে ধরতে পারেননি। তাই মনে হয়, প্রভাতকুমার নিশ্চিতভাবেই এইরকম সংবাদের খোঁজ-খবর রাখতেন।    

প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘সংসার সীমান্তে’ গল্পে আমরা অঘোর দাসকে পেয়েছি। চুরি করার অপরাধে তাকে কারাগারে বন্দি করা হয়েছিল। গল্পটি বিশ শতকের ত্রিশের দশকে লেখা। আমরা দেখেছি, ১২৯৪-র আষাঢ় সংখ্যাতে নবজীবন পত্রিকাতে ‘বেদিয়াজাতি ও বেদিয়া চোর’ নামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। বেদিয়া জাতি যাযাবর, এই লেখায় এদেরকে ইউরোপ ও এদেশের প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ইংল্যান্ডে এই জাতিকে বলা হয় জিপ্‌সী এবং ইউরোপের কোনো কোনো জায়গায় বলা হয় জিঙ্গারী ও জিমবী। এদের নিজের ভাষা আছে, কিন্তু এরা যখন যে দেশে থাকে সেই দেশের ভাষা মোটামুটি আয়ত্ত করে নেয়। চৌর্যবৃত্তি এদের প্রধান কাজ হওয়ার জন্য ইংল্যান্ডের মতো বেশ কিছু দেশে এদের বিরুদ্ধে কঠিন আইন রুজু করা হয়েছিল। কেননা এরা সুযোগ পেলে স্থানীয় অধিবাসীদের শিশু সন্তান চুরি করে অন্যত্র বিক্রি করে দিত। ওয়াল্টার স্কটের Guy Mannering (১৮১৫) উপন্যাসে এই জিপ্‌সী জাতির বর্ণনা আছে। ভারতের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে এই জাতিকে বয়েদ বলে। নবজীবন পর্যবেক্ষণ করেছিল ভারতের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় বঙ্গদেশের বেদিয়ারা অনেক বেশি সভ্য হয়ে উঠেছিল। তারা ঘর-গৃহস্থলী বসিয়ে চাষাবাদ শুরু করেছিল। পূর্ববঙ্গের বেদিয়ারা জলের উপর নৌকার মধ্যে বাস করত। নৌকাতেই তাদের সাংসারিক দ্রব্য রাখা থাকত। এই বেদিয়ারা স্ত্রী-পুরুষে নৌকা বায়। তাই তাদেরকে বলা হত নৌ-বেদিয়া। জালিয়াদের মধ্যে যেমন জালো, মালো, কৈবর্ত প্রভৃতি অন্তর্জাতি আছে, যাদের কথা আমরা অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৫৬) উপন্যাসে পাই, তেমনই নৌ-বেদিয়াদের মধ্যে আছে বেদিয়া, বেবাদিয়া, সান্দার প্রভৃতি জাতি। কৃষ্ণনগর ও বারাসাত জেলাতে বেদিয়ারা পুরুষানুক্রমে বাস করে। এরা ধর্মে না হিন্দু, না মুসলমান। নবজীবন বলেছে, কলকাতায় যারা বাতের তেল বা গাছের শিকড় বিক্রি করে তারা আর কৃষ্ণনগরের বেদিয়ারা আলাদা। কিন্তু কৃষ্ণনগরের বেদিয়াদের প্রধান কাজ ছিল সিঁধ কাটা। তাই কৃষ্ণনগরের ম্যাজিস্ট্রেটদের হুকুম ছিল যখন কোনো বেদিয়া নিজের গ্রাম ছেড়ে স্থানান্তরে যাবে তখন স্থানীয় থানায় উপস্থিত হয়ে কোথায় এবং কী উদ্দেশ্যে তারা গমন করছে সবটা লিখে জানাবে। দ্বিতীয় নিয়ম ছিল বেদিয়ারা যখন স্থানান্তরে যাবে তখন তারা স্থানীয় থানায় সইসাবুদ করে থানাতেই রাত্রিযাপন করবে। এই রকমই এক বেদিয়ার থেকে তাদের চুরির কার্যপ্রণালী, অভিজ্ঞতা এবং শাস্তির ইতিবৃত্ত জেনে নবজীবন-এ ছাপা হয়েছিল। সেখান থেকে অনুসন্ধান বেদিয়াদের চৌর্যবৃত্তির অংশটুকু ১২৯৪-র ১৫ ভাদ্র সংখ্যাতে পুনর্মুদ্রিত করেছিল। এর কারণ নিশ্চিতভাবে বেদিয়াদের সম্পর্কে জনগণকে অধিক সচেতন করে তোলা। সেই কারণে এই সংক্রান্ত বিদেশী কাহিনিকেও অনুসন্ধান সমিতি বিশেষ আগ্রহ সহকারে ছাপিয়েছিল। কেননা, ১৫ অগ্রহায়ণ সংখ্যাতে রাশিয়ার একটি চুরির ঘটনা পেয়েছি। যদিও এই কাহিনি নবজীবন পত্রিকাতে পূর্বেই প্রকাশিত হয়েছিল।

ইংরেজ সাহেবদের জুয়াচুরির ঘটনাও অনুসন্ধান-এ নির্ভয়ে ছাপা হত, ১২৯৪-র ১৫ মাঘ সংখ্যাতে ছাপা হয়েছিল ‘সাহেবী জুয়াচুরি’। ময়দানের ঘড়দৌড়ে একজন ইংরেজ সাহেবের জাল টিকিট ও জাল শিলমোহর ডিটেকটিভ পুলিশ ধরেছিল। এছাড়া অনুসন্ধান পত্রিকাতে আমারা পেয়েছি ‘নবাবী জুয়াচুরী’, ‘জুয়াচোরের জমিদারী বন্ধক’ ইত্যাদি সত্য ঘটনার উল্লেখ। একই সঙ্গে পেয়েছি আরও বিচিত্র কিছু ঘটনার বর্ণনা, সেকালের বাংলাদেশের এই রকম কিছু চিত্র পাঠককে জানানোর অভিপ্রায় থেকে এখানে তেমনই কিছু কথা পেশ করা গেল—  

১.২ ছাপাখানার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞাপনসংস্কৃতিও জন্মের পরপরই বাহুল্য অর্জন করেছিল। এখনকার মতো সেকালেও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বা সরাসরি প্রকাশিতব্য বই বা পত্রিকার বিজ্ঞাপন দিয়ে অগ্রিম বুকিং করানো হত। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয় বিজ্ঞাপন ভুয়ো হত, নয়তো ভুয়ো বইয়ের বিজ্ঞাপন দেওয়া হত, আর নয়তো অগ্রিম বুকিংয়ের টাকা আত্মসাৎ করে কোনো কিছুই পাঠানো হত না, আবার কখনো কখনো বিজ্ঞাপিত বইয়ের বদলে অন্য কোনো সস্তা বই উপহার হিসেবে বাড়ির ঠিকানায় আসত। এই রকম একাধিক খবর অনুসন্ধান-এ ছাপা হয়েছিল। আমরা সেখান থেকে শুধুমাত্র এই ধরনের বই ও পত্রিকার নাম সংগ্রহ করে একত্রিত করলাম—‘গৃহ-চিকিৎসাসার’, ইংরাজির অর্থপুস্তক, ‘সৈনিক-সীমন্তিনী’, ‘লন্ডন রহস্য’, ‘লন্ডন-রাজ রহস্য’, ‘বস্তুবিদ্যা’, ‘পাগলিনী’, ‘সুরেন্দ্র-প্রতিভা’, ‘প্রভাবতী’, ‘গ্রন্থ-রত্নাবলী’, ‘নবযুগ’ (পত্রিকা), মহাভারতের অনুবাদ, ‘তন্ত্রকল্পলতিকা’-র অনুবাদ, ‘তন্ত্রকোষ’ ‘সুলভ পাকপ্রণালী’, ‘মূলানুবাদ কালীতন্ত্রের’, ‘ভেল্কী’, ‘গুপ্ত বিদ্যা’, ‘মূলানুবাদ পবনবিজয় স্বরোদয়’, ‘মূলানুবাদ আদি তন্ত্রকোষ’, ‘যোগিনীতন্ত্র’, ‘বিনা মূল্যে সমুদায় তন্ত্র’ (এই বইয়ের বিজ্ঞাপনে মহারাজা জ্যোতিরিন্দ্রমোহন ঠাকুরের নাম জড়িয়েছিল), ‘হরিতালভস্ম ও শক্তিসাধন’, ‘জ্ঞানরত্নাকর’, ‘পীঠমালা মহাতন্ত্র’, ‘ভাস্বতী বা ব্রহ্মাণ্ডের খবর’ (বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল এই বইয়ের লেখক রাজারাম বসু রাধাকান্ত দেবের বাড়ির লোক, কিন্তু রাধাকান্ত দেবের বাড়িতে এই নামের কেউ থাকতেন না), ‘পরিণাম’ মাসিক পত্রের বিজ্ঞাপন, ‘চেৎমতি’, ‘ললিতকামিনী’, ‘সরল চিকিৎসা’, ‘সিকিমূল্যে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ’, ‘পল্লী প্রকাশ’, ‘পাগলিনী’ (এই বইয়ের বদলে ‘নবনলিনী’ মাসিক পত্র পাঠানো হয়েছিল, এমনকি এই পত্রিকাও চলতে চলতে হঠাৎ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল), ‘কামধেনুতন্ত্র’ (এর বদলে ‘আকাহানভুয়া নাটক’ পাঠানো হয়েছিল), ‘ভারতললনা’ (এটি ছিল মাসিক পত্রের বিজ্ঞাপন, এর বদলে ‘চিরসঙ্গিনী’ নামের পুস্তক পাঠানো হয়েছিল), ‘সাহিত্য কুসুম’ (এই সাহিত্য পত্রিকার বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল সঞ্জীবনীবঙ্গবাসী পত্রিকাতে), ‘হিন্দু’ (মাসিক পত্রের বিজ্ঞাপন), ‘সুরাসারোদ্ধার’, ‘সুরেন্দ্র-প্রতিভা’ ‘ঐতিহাসিক ভিখারিনী’, ‘জ্ঞানভাণ্ডার’, ‘জগৎবাহী ও হিন্দুধর্ম্ম, ‘ন্যায়দর্শন’, ‘পূজায় বিরাট বিতরণ’, ‘রণরঙ্গিণী’, ‘সমর্থ-কোষ’, ‘মৎস পুরাণ’, ‘রসিক রাজ’, ‘অত্রি-সংহিতা’, ‘চাণক্য-শ্লোক’, ‘সচিত্র ভিষক-রাজ বিবরণ’, ‘সুনীতি ও সংবাদ’ (সাপ্তাহিক পত্র), ‘হিন্দু-শাস্ত্রপ্রকাশ’, ‘রাজচিকিৎসক’ (মাসিক পত্রিকা), ‘বিশ্বকোষ’, ‘সুলভ তন্ত্র-প্রকাশ’, ‘সস্তায় হীরকাঙ্গুরীয়’, ‘জগৎবাসী’ (পত্রিকা), ‘রত্নঝারি’ ইত্যাদি।      

              গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে ‘বইয়ের বিরুদ্ধে জিহাদ’ নামের একটি ছোটো লেখায় মণীন্দ্র গুপ্ত সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষিতে ‘ঠকানো’ ব্যাপারটি আলোচনা করেছেন। তাঁর বক্তব্য হল, ‘সারা পৃথিবী জুড়ে পুস্তকশিল্পের মালিকরা এক দল লোক পুষে রেখেছে, যাদের কাজ হচ্ছে বই তৈরি করা, আর তার বাজার বানিয়ে বিক্রি করা।’ মণীন্দ্র গুপ্তের মতে এরা আসলে সংগঠিতভাবে আমাদের ঠকাচ্ছে। 

১.৩ ইংরেজ আমলে প্রকাশ্যে লটারি ব্যবসা চলত না। তাই ধুরন্ধর ব্যক্তিরা সেকালে নানা উপায়ে এই ধরনের খেলা চালু করেছিল। যেমন—নম্বরানুযায়ী উপহার বিতরণ। বিজ্ঞাপনে বলা হত—দশ বিশ ত্রিশ হাজার টাকা পরপর সাজানো আছে, পরপর যিনি যেমন টাকা পাঠাবেন, তিনি তেমনই উপহার পাবেন। সে-সময় অনেকেই এই ফাঁদে পা দিত নির্দ্বিধায়। এই ধরনের বিজ্ঞাপন যারা দিয়েছিল এবং যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধান সমিতিতে জমা পড়েছিল তারা হলেন—যোগীন্দ্রনাথ দাস, প্রসাদকুমার মুখোপাধ্যায়, মাখনলাল দত্ত এবং বাগবাজারের আদরিণী অফিসের অধ্যক্ষগণ।

১.৪ চাকরির প্রলোভন দিয়ে জালিয়াতি সেকালের কলকাতাতেও পুরোদস্তুর ছিল। দক্ষিণেশ্বর নিবাসী কিশোরীমোহন চট্টোপাধ্যায় ১৮৮৬ সালে ১৫৩ নং লোয়ার চিৎপুর রোডে The Indian P. Co. নামে একটি কারখানা খুলেছিলেন এবং ১৮৮৬-র ২৮ আগস্ট স্টেটস্‌ম্যান পত্রিকায় এই কারখানায় একজন স্টক-কিপারের প্রয়োজনীয়তা জানিয়ে বিজ্ঞাপন দেন। সেখানে চাকরি প্রার্থীকে অগ্রিম টাকা জমা দেওয়ার কথা বলে হয়েছিল। ভবানীপুরের অভয়ানন্দ সেন এই চাকরির জন্য আবেদন করেছিলেন, এবং অগ্রিম ৩৫০ টাকা দিয়ে চাকরিতে জয়েনও করেছিলেন। ৩০ সেপ্টেম্বর তাকে নোটিস দিয়ে জানানো হয়েছিল ১৮৮৭-র ১ জানুয়ারি থেকে তার চাকরি থাকছে না অর্থাৎ কোম্পানির তাকে আর প্রয়োজন নেই। এই নোটিস দিয়েই নাকি কিশোরীমোহন চট্টোপাধ্যায় পালিয়েছিলেন, পরে তার কোনো অনুসন্ধানই পাওয়া যায়নি। এই রকম চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মানুষ ঠকানোর দায়ে সেকালে তারকনাথ দত্ত নামের এক জনৈক ব্যক্তির জেল হয়েছিল।

১.৫ সম্পত্তির লোভে জাল ছেলের আমদানি। কাঁথির এক ভদ্রলোক তার একমাত্র কন্যার বিয়ে দিয়েছিলেন নিকটস্থ রাজপরিবারে। সেই ভদ্রলোকের আর্থিক পরিস্থিতি ভালো ছিল না, তাই তার আশা ছিল মেয়ের বাড়িতেই প্রতিপত্তি জমাবেন। কিন্তু নিঃসন্তান অবস্থায় জামাতার আকস্মিক মৃত্যু হলে তিনি পড়লেন ফাঁপরে। জামাতার যেহেতু উত্তরাধিকার নেই তাই দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়রা সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল—এমন সময় ভদ্রলোক ঘোষণা করলেন তার কন্যা অন্তঃসত্বা। গর্ভের অবস্থা জানান দেওয়ার জন্য তিনি কন্যার পেটে প্রয়োজনমতো কাপড় জড়িয়ে রাখতেন, এবং সময় হলে একটি শিশু সন্তান এনে তার একমাত্র দৌহিত্র বলে ঘোষণা করেন তথা সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকার। ক্রমে দৌহিত্র রাজা হলে ভদ্রলোক স্টেটের ম্যানেজারি পেলেন। সবই ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু হঠাৎ যার থেকে ভদ্রলোক শিশু সন্তান নিয়ে এসেছিল তার সঙ্গে কোনো কারণে বচসা বাঁধলে সমস্তটা ফাঁস হয়ে যায়।

              সেকালের শান্তিপুরের কিশোরীলাল চক্রবর্তী পুত্র বঙ্কুবিহারীর দশ-এগারো বছর বয়সে বিবাগী হয়ে গৃহত্যাগী হওয়ার খবর অনুসন্ধান-এ ছাপা হয়েছিল। তিন চার বছর পর সেই গ্রামে এক সন্ন্যাসীর আবির্ভাব হয়েছিল, সন্ন্যাসী ছিলেন হুবহু বঙ্কুর মতোই। ফলে কিশোরীলাল অনেক ধরাধরি করে ছেলেকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যান, এবং পুনরায় বিবাগী হওয়ার ভয়ে তড়িঘড়ি করে ছেলের বিয়েও দেন। কিন্তু কিছু কাল পর হঠাৎ আসল বঙ্কু বাড়ি ফিরলে গ্রামসুদ্ধ লোকের অনুশোচনার আর শেষ থাকে না। এই ঘটনা প্রসঙ্গে আমাদের আচমকাই মনে পড়ে যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নীললোহিত সিরিজের একটি কাহিনি—নিয়তির মুচকি হাসি (১৯৯৫)। সেখানে অবশ্য হুবহু নীললোহিতের মতো দেখতে যে ছেলেটি গৃহত্যাগী হয়েছিল সেই একদিন সন্ন্যাসী রূপে গ্রামে ফিরে আসে।   

              সেকালের এইরকম একাধিক ঘটনার খোঁজ পাওয়া যাবে অনুসন্ধান পত্রিকাতে। যেমন—কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের জনৈক পাঁঠার মাংসবিক্রতা পাঁঠার মাংসের সঙ্গে কুকুরের মাংস মিশিয়ে বিক্রি করত। পিতা বিবাহ দিতে দেরি করছেন বলে ছেলে তার পিতার নামেই আদালতে মামলা করেছিল। অয্যোধ্যা অঞ্চলে জুনিয়ার কর্মচারীদের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র দিনে দুপুরে বাজারে বিক্রি হয়েছিল। বারাসতে চোর চোর খেলতে গিয়ে বালকদের মধ্যে যে চোর সেজেছিল বিচারে তার ফাঁসি ঘোষণা হয়, এবং একটি পেয়ারা গাছে চাদর বেঁধে তৈরি ফাঁস চোরবেশী বালকের গলায় পরানো মাত্র তার মৃত্যু হয়েছিল। ওষুধের বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণার খবরও কম কিছু ছিল না। এসব ছাড়াও এমনকি গরুর বাঁটের দুধ কুকুরে খেয়ে ফেলেছে এমন সংবাদও পাওয়া যাবে।

তবে কলকাতার জুয়াচুরি ও জালিয়াতি সম্পর্কে অনুসন্ধান সমিতির নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ছিল। এর কারণ অনুসন্ধান প্রসঙ্গে তারা প্রধানত সমকালের ইংরেজ শাসনকেই দায়ী করেছিলেন। আমরা খেয়াল করেছি, জুয়াচুরি দমন এবং জাতির সততা ও নৈতিকতার উন্নতিকল্পে অনুসন্ধান সমিতি ছিল যথেষ্ট তৎপর, কিন্তু তাদের সমস্ত কিছুর মূলে ছিল স্বদেশচিন্তা এবং জাতীয় বোধের নির্মাণ। উনিশ শতকের আশির দশকের পর থেকে অপেক্ষাকৃত একটি নতুন নির্মাণ প্রচেষ্টা হিসেবে যে সংঘবদ্ধ হিন্দু স্বদেশিকতার জন্ম হয়েছিল অনুসন্ধান পত্রিকার পরের দিককার লেখাপত্রে সেই সংক্রান্ত সক্রিয় চিহ্নগুলি স্পষ্টভাবেই ধরা আছে। এক হিসেবে বলতে পারি এই পত্রিকা ছিল অনেকক্ষেত্রেই নবজীবন পত্রিকার অনুসারী। এরা প্রায় প্রত্যেকেই ভারতবাসীকে ‘ধর্মপরায়ণ’ ভারতবাসী বলে চিনতে ও বুঝতে অভ্যস্ত ছিলেন। ২৯ অগ্রহায়ণ ১২৯৪-র অনুসন্ধান-এ যথেষ্ট উৎকণ্ঠার সঙ্গে ঘোষণা করা হয়েছিল ইংরেজরা এদেশে প্রবেশের পর থেকেই পরাধীনতা স্বীকার করে নেওয়ার পাশাপাশি ইংরেজি সভ্যতার আকর্ষণীয় আদব-কায়দা ও চালচলনকে সম্ভবের সীমা ছাড়িয়ে কৃত্রিম উপায়ে আত্মসাৎ করার প্রভূত চেষ্টা চলছিল। অর্থাৎ অর্থের নিত্য প্রয়োজনীয়তা ইংরেজি সভ্যতার অনুকরণ এবং চাটুবৃত্তির কারণেই তৈরি। তাই জাতির উন্নতি ছিল একমাত্র কাম্য। পূর্বে নব্যভারত লিখেছিল—জনসমাজের রক্ষা ও উন্নতির জন্য একদিকে যেমন ধর্মবলের প্রয়োজন, অন্যদিকে নৈতিক জ্ঞানের সমান আবশ্যকতা রয়েছে (আষাঢ় ১২৯০)। সুতরাং এই জনসমাজকে জুয়াচুরি ও জালিয়াতির মতো অনৈতিক কার্যকলাপ থেকে মুক্ত করা ছিল অনুসন্ধান সমিতির একটি পরিকল্পিত জাতীয় প্রচেষ্টা। তাই তাদের পক্ষে নির্দোষ মহারাজা নন্দকুমারকে স্মরণ করার মাধ্যমে এই জাতীয় ভাবাদর্শেরই অনুষঙ্গ প্রকাশ করা ছিল সামাজিক দায়িত্বতুল্য। ‘পাবলিক কালচার’ গড়ে তোলার জন্য এটি একটি বিশেষ ‘anecdote’-ও বটে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখতে চাই, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নন্দকুমারকে নতুনভাবে চেনা ও বোঝার দায় বাঙালিদের মধ্যে খুব গভীর একটা জায়গা তৈরি করেছিল। ১৩১৬ সালের বৈশাখ সংখ্যা সুপ্রভাত পত্রিকাতে যোগীন্দ্রনাথ সমাদ্দার এই বিষয়ে কিছু প্রশ্ন তুলেছিলেন, পরে ঐতিহাসিক চিত্র পত্রিকার ১৩১৬ জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় নিখিলনাথ রায় এর পাল্টা জবাব স্বরূপ আরও একটি লেখা লিখেছিলেন। যোগীন্দ্রনাথ নন্দকুমারকে স্বীকৃতি না দিতে চাইলেও নিখিলনাথ লিখেছিলেন, ‘নন্দকুমারের যে সমস্ত সৎকীর্ত্তি আজিও তাঁহার জন্মভূমিকে অলঙ্কৃত ও মুখর করিয়া রাখিয়াছে, যিনি মৃত্যুকালে বীরপুরুষের ন্যায় আপনার জীবন বিসর্জ্জন দিয়াছিলেন, কেবলমাত্র সেইরূপ তাঁহার জীবনের দুই একটি ঘটনায় তাঁহাকে জনসাধারণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলা যাইতে পারে। ওয়াট্‌সনের নাম জাল করিয়া যিনি উমিচাঁদের সর্ব্বনাশ সাধন করিয়াছিলেন, তিনি যদি Hero হন, এবং তাঁহার জন্য যদি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপনের চেষ্টা হয়, তাহা হইলে নন্দকুমারকে Hero বলিলে বোধ হয়, তত দোষের হইবে না।’ এছাড়া এই লেখা থেকে জানা গেছে, নন্দকুমারের ফাঁসি হলে কলকাতার সাধারণ লোক মর্মাহত হওয়ার পাশাপাশি প্রায়শ্চিত্তের উদ্দেশ্যে গঙ্গাজলে ঝাঁপ দিয়েছিল, অনেকে আবার কলকাতা ছেড়ে বালিতে গিয়ে বসবাস শুরু করেছিল। মহারাজা নন্দকুমার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান ছিলেন। ১৭৭৫ সালে নথি জালিয়াতির অভিযোগে তাঁর ফাঁসি হয়েছিল। এটি ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া প্রথম ফাঁসি। নন্দকুমারের পাগড়ি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে রাখা আছে।  

শেষ করার আগে আরও দুটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো। এক. সেকালে অনুসন্ধান সমিতির এইধরনের পদক্ষেপ গভর্নমেন্ট কী চোখে দেখত? দুই. এইধরনের উদ্যোগ তথাকথিত চোরেদের ওপর কেমন প্রভাব ফেলেছিল? প্রথম দিকে গভর্নমেন্টের কোনো সাহায্য অনুসন্ধান সমিতি পায়নি। এমনকি পুলিশকে কোনো জুয়াচোরের সন্ধান দিলে তারা কোনোরূপ উৎসাহ দেখাত না। কিন্তু পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশের পর পুলিশ ত্রস্ত হয়ে ওঠার পাশাপাশি সমিতির তরফে প্রাপ্ত খবরকে নিশ্চিত গুরুত্ব দিতে শুরু করেছিল। শুধু তাই নয়, সমিতির অফিসে গভর্নমেন্টের উচ্চ পদস্থ কর্মচারীর যাতায়াত পর্যন্ত শুরু হয়েছিল। এবং গভর্নমেন্ট সমিতির এই প্রচেষ্টাকে একটি আন্দোলন বলেই গণ্য করেছিলেন।

১৫ ফাল্গুন ১২৯৪-সংখ্যাতে ‘সহরের চোর ও পাড়াগেঁয়ে চোর’ শীর্ষক একটি কাল্পনিক কথোপকথন ছাপা হয়েছিল। কলকাতার লোকজন চুরির ব্যাপারে অতিশয় সতর্ক হয়ে ওঠার কারণে কলকাতার চোর চুরির জন্য পাড়াগাঁয়ে যায়, কেননা তার ধারণা পাড়াগাঁয়ের লোকেরা নিরীহ ভালো মানুষ। কিন্তু পাড়াগাঁয়ের চোর বলে তাদের লোকজন কপর্দকশূন্য, সেখানে চুরি করার মতো দ্রব্যসামগ্রী নেই। অর্থাৎ এরা দুজন ঘরবদল করতে উদ্যোগী। এই উদ্যোগ নিশ্চিতভাবেই পরিবর্তিত পরিস্থিতি সঞ্জাত। সুতরাং আজ ১২৫ বছর পর এই অনুসন্ধান সমিতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব হচ্ছে না কি?

                                                                                         ক্রমশ। .

'পাতাললোক'-এর খননে শিরদাঁড়া জুড়ে কাঁপুনি- অজন্তা সিন্হা

 

শিরদাঁড়ায় কাঁপন জাগায় ‘পাতাল লোক’

অজন্তা সিন্হা

 

হাতিরাম টাউন স্কোয়ারে পৌঁছনো মাত্র ড্যানিয়েলের আক্রমণের মুখোমুখি হয়। হোটেলের জানালা থেকে গুলি করে ড্যানিয়েল। মরতে মরতে বেঁচে যায় হাতিরাম আর এই লড়াইয়ের শেষ হয় ড্যানিয়েলের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। হোটেলের কিচেনে গিয়ে ড্যানিয়েলকে মারে হাতিরাম। পরদিন সকালে সে আঙ্কল কেনের সঙ্গে দেখা করে। তার অবর্তমানে যা যা ঘটে, কেন সব জানায় হাতিরামকে। নানা জটিল পরিস্থিতির মধ্যে সত্য সামনে আসে হাতিরামের। মোটামুটি এভাবেই এগিয়েছে ‘পাতাল লোক’ সিজন ২-এর শেষ পর্ব। বাকিটা তো আপনারা পর্দায় দেখবেন। গল্প বলে দিলে সব আকর্ষণ মাটি!!

হাতিরাম অর্থাৎ জয়দীপ আহলাওয়াত–তিনিই যে এই সিরিজের ইউএসপি, তাতে কারোওই তেমন সন্দেহ নেই। ‘পাতাল লোক’-এর অন্যতম সেরা আবিষ্কার এই অভিনেতা। এই মুহূর্তে তাঁর অভিনয় উল্লেখিত হচ্ছে ইরফান খান, কে কে মেনন, মনোজ বাজপেয়ী, পঙ্কজ ত্রিপাঠি প্রমুখ দেশের প্রথম সারির অভিনেতাদের সঙ্গে। জয়দীপ যে লম্বা রেসের ঘোড়া, সেটা এই সিরিজে প্রমাণিত। শুধু ওঁর অভিনয়ের রস গ্রহণ করার জন্যই ‘পাতাল লোক’ দেখতে পারেন আপনি। সিরিজের দুটি সিজনে অভিনয়ে এছাড়াও আছেন গুল পনাগ, নীরজ কবি, স্বস্তিকা মুখার্জি, ইশাক সিং, অভিষেক ব্যানার্জি, নীহারিকা দত্ত, রিচা চতুর্বেদী, জগজিৎ সন্ধু, আকাশ খুরানা, রাজেশ শর্মা, আসিফ খান, বিপিন শর্মা, মনীশ চৌধুরী, জন্হু বড়ুয়া, নাগেশ কুকুনূর, তিলোত্তমা সোম, প্রশান্ত তামাং, কেনি বসুমাতারি প্রমুখ।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে কিছু অশ্লীল ভাষার প্রয়োগ– ‘পাতাল লোক’ শুরু থেকেই বিতর্কের কেন্দ্রে। যত বিতর্ক তত গ্রহণযোগ্যতা। আদতে ভারতীয় বিনোদন মানচিত্রে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম যে নতুন ভাবনার জোয়ার নিয়ে আসে, সেখানে ‘পাতাল লোক’ নিঃসন্দেহে ঝড় তুলে দেওয়া একটি প্রযোজনা। তথাকথিত সভ্য সমাজ যে মিথ্যের মোড়কে নিজেদের মুড়ে রাখে, সেই মোড়ক ভেঙে চুরমার করে দেয় এই ওয়েব সিরিজ। ক্রাইম থ্রিলার বিষয়টা আসলে এমনই হওয়া উচিত– যেখানে প্রতি দৃশ্যে একই সঙ্গে শিরদাঁড়ায় হিমেল স্রোত বয়ে যাওয়া এবং মস্তিষ্কের তন্ত্রে তন্ত্রে বিদ্যুতের আঘাত হানার ব্যাপারটি ঘটে। এর ফলে যাবতীয় বিতর্ককে উড়িয়ে ক্রমশ জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠে ‘পাতাল লোক’।

শোনা যায়, সিরিজের কাহিনি শুনেই নাকি বলিউড তারকা অনুষ্কা শর্মা ‘পাতাল লোক’-এর প্রথম সিজনের প্রযোজনায় এগিয়ে আসেন। এর কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে পাবেন ‘পাতাল লোক‘-এর স্রষ্টা সুদীপ শর্মা। সিরিজের দ্বিতীয় সিজন প্রযোজনাও করেছেন তিনি (সঙ্গী ক্লিন স্লেট ফিল্মজ ও ইউনোইয়া ফিল্মস এলএলপি)। হার্দিক মেহতা, গুঞ্জিত চোপড়া, তমাল সেন, অভিষেক ব্যানার্জি, রাহুল কানোজিয়া, সাগর হাভেলির সঙ্গে একত্রে সিরিজের চিত্রনাট্য লিখেছেন সুদীপ। এই নামগুলি বিশেষভাবে উল্লেখের দাবিদার। কারণ, ‘পাতাল লোক’-এর লেখন এই সিরিজের প্রশংসায় সর্বত্র ও সর্বসম্মতিক্রমে উল্লেখিত। পরিচালনায় স্মার্ট অবিনাশ অরুণ ও প্রশিত রায় (প্রথম সিজন)। সিনেমাটোগ্রাফিতে ঝকঝকে অবিনাশ অরুণ ও সৌরভ গোস্বামী। নরেন চন্দ্রভারকর ও বেনেডিক্ট টেলর বানিয়েছেন ‘পাতাল লোক’-এর দুর্দান্ত ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর। ১১০টির বেশি রিয়েল লোকেশনে হয়েছে এই সিরিজের শুটিং–তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য চিত্রকূট, যেখানে প্রথম কোনও সিরিজের শুটিং হল।

বলিউডের অফবিট পরিচালক, যিনি নিজেও একজন অসাধারণ ক্রাইম থ্রিলার হিসেবে পরিচিত, সেই অনুরাগ কাশ্যপ তাঁর টুইটারে লিখেছেন, ‘পাতাল লোক’ হল দেশের সবচেয়ে সেরা ক্রাইম থ্রিলার। অভিনেতা মনোজ বাজপেয়ীও দারুণ প্রশংসা করেছেন এই সিরিজের। বিশেষভাবে অভিনয় প্রসঙ্গে উচ্ছ্বসিত হয়েছেন তিনি। সর্বভারতীয় প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকাগুলিও প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছে এর। অসংখ্য পুরস্কার ঝুলিতে পুরে নিয়েছে ‘পাতাল লোক’। ২০২০-র মে মাসে আমাজন প্রাইমে প্রথম সিজনের স্ট্রিমিং হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া ফেলে দিয়েছিল ‘পাতাল লোক’। সাফল্যের ধারাবাহিকতা মেনে দ্বিতীয় সিজন স্ট্রিমিং শুরু এবছর জানুয়ারিতে। এবারের গল্প পল্লবিত নাগাল্যান্ডের অস্থির রাজনৈতিক পটভূমিতে। শোনা যাচ্ছে, এবারও রুদ্ধশ্বাসে দেখার মতো এক অভিজ্ঞতা ওয়েব পর্দায় নিয়ে এসেছে টিম ‘পাতাল লোক’। দুটি সিজন মিলিয়ে ১৭টি পর্ব। এখনও দেখে না থাকলে আজই চোখ রাখুন আমাজন প্রাইমের পর্দায়।

শাসকের আসন কিভাবে টলমল?- সায়ন ভট্টাচার্য


শাসকের চুলের মুঠি ধরে নাড়িয়ে দিতে পারে যে লেখা!

সায়ন ভট্টাচার্য

উপন্যাস মানুষের ইতিহাস, আমার আপনার ইতিহাস। ঘড়ির কাঁটা খুঁচিয়ে লেখা ইতিহাস নয়, যেন অনেক দিনের জমানো স্মৃতির বারুদে এক পশলা আগুন। উপন্যাসের জটিল, গভীর অর্থ অনুসন্ধান করার পরে, নায়কের সংবেদনশীল অভিজ্ঞতা থেকে আনন্দ লাভ করে মানব সভ্যতা (তাদের কথোপকথন, জীবনের ছোট ছোট বিবরণে চরিত্রগুলিকে লেখক যেভাবে বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করেছেন) এবং নিজেদের সম্পূর্ণরূপে উপন্যাসের জগতে নিমগ্ন করে ফেলে। আমরা লেখকদের কথা ভুলে যেতে পারি। আমাদের মনের কোণের কোন এক অংশে আছে— যা মনকে নিষ্পাপ করে তোলে— এমনকি এটাও ভুলে যেতে পারি যে— উপন্যাসটি নিয়ে চিন্তা করছি তা একজন লেখকের কল্পনার দ্বারা রচনা করা হয়েছিল। উপন্যাসের একটি বৈশিষ্ট্য হল যে লেখক যে পাঠ্যাংশটিতে সবচেয়ে বেশি উপস্থিত থাকেন সেই মুহূর্তে আমরা তাকে সম্পূর্ণভাবে ভুলে যাই। এর কারণ হলো যে সময় আমরা লেখকের কথা ভুলে যাই সেই সময় আমরা কাল্পনিক জগতকে বাস্তব বিশ্ব বলে বিশ্বাস করি। আমরা লেখকের ‘আয়না’কে বিশ্বাস করি। উপন্যাসকে যেভাবে চিত্রিত করা হয় বা বাস্তবকে যেভাবে ‘প্রতিফলিত’ করা হয় তা একটি পুরাতন ধারার রূপক; নিঃসন্দেহে সত্যিই আর কোনো বস্তু নেই যা আয়নার মতো নিখুঁত। একমাত্র আয়নাই— আমাদের প্রত্যাশাকে পুরোপুরি পূরণ করে। প্রত্যেক পাঠক নারী, পুরুষ যেই হোক যখন একটি উপন্যাস পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়, সে তখন তার রুচি অনুযায়ী একটি আয়নাকে বেছে নেয়।

‘প্রজাপতি’ উপন্যাসের কথা মনে আছে? সমরেশ বসু (১১ই ডিসেম্বর ১৯২৪ – ১২ই মার্চ১৯৮৮)-র লেখা, বাংলা সাহিত্যের চে গেভারা, যিনি অনায়াসে কলমকে বন্দুকের মতো ব্যবহার করতে পারেন, স্থাণু সাহিত্যের মানচিত্রকে করে দিতে পারেন লন্ডভন্ড। সমরেশ-এর সাহিত্য ছুটে চলে মহাকালের রথের ঘোড়ায়, অনায়াসে লিখে দিতে পারেন শোষকের তৈরি করা নির্মম পরিস্থিতি। রাষ্ট্রীয় শোষণ মানে সবসময় সরাসরি মার নয়— অদৃশ্য চাবুক দিয়ে শপাং শপাং করে দাগ বসিয়ে যাওয়া, কিন্তু কোনও আওয়াজ হবে না, না হবে কোনও চিৎকার। কিন্তু, সচেতন শিল্পীদের কানে এসে পৌঁছায় সেই ভয়ানক চিৎকার। প্রকৃত কলম কখনও মিথ্যা কথা লিখতে পারে না। সমরেশ বসু নিরুপায় ছিলেন। ঠিক কোন ঐতিহাসিক সময়ে দাঁড়িয়ে লেখা হচ্ছে এই উপন্যাস, তার একটা চালচিত্র দেখে নেওয়া যাক। বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস বড়োই নির্মম। গোটা পৃথিবী জুড়ে ভাগ হয়ে গেছে শিবির। এক গোলার্ধ শাসন করছে অন্য গোলার্ধে। বলা ভালো শাসাচ্ছে। ভারতের ছয়ের দশকটা একটু দেখা যাক, ১৯৫৪ সালের পর থেকেই গণ অভ্যুত্থানের উত্তাল ঝড় উঠেছিল— ট্রাম, পোর্ট, সার্বিক কৃষক (তেভাগাসহ) আন্দোলন, হায়দরাবাদ ও কাশ্মীরে জনতার গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের দাবি, বিমানবাহিনীর ধর্মঘট, বিহারে পুলিশ বিদ্রোহ।
কলকাতায় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে জোর দেওয়া হয়েছিল আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিস্থিতির উপর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী নতুন পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদ ও জাপ সাম্রাজ্যবাদের পতন, সোভিয়েত দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতার বিকাশ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অভ্যুত্থান, ব্রিটেন-ফ্রান্স তথা ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আধিপত্য খর্ব হওয়া— সবটাই ইতিহাসের দর্পণে বারবার ফুটে উঠতে থাকে। চিনে নবধারার ‘জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব’ সমগ্র এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকায় প্রভাব বিস্তার করল। সর্বোপরি উপনিবেশ সমূহের শৃঙ্খল ছিন্ন করার সংগ্রাম অপ্রতিহত রইল। মানুষ পথ খুঁজতে খুঁজতে দিশেহারা। সুখেন (অভিনয়ে কাজল শম্ভু) কি এই নাটকে গুন্ডা? নাকি শুধু মাত্র একটা বোড়ে?

‘প্রজাপতি’ সময়ের দলিল, নৃশংস কংগ্রেসি জমানার বিপরীতে কমিউনিস্ট পার্টিও তো মেতে উঠলো লুম্পেন প্রলেতারিয়েত নিয়ে। ‘লুম্পেন’-দের নিয়ে বড্ড সমস্যা— এই জটিল সমাজ পরিস্থিতিতে, তারা তো শুধুমাত্র বোঝে স্বার্থসিদ্ধি! আর স্বার্থসিদ্ধিটুকু যে দল থেকেই হোক— সে কংগ্রেসই হোক কিংবা কমিউনিস্ট পার্টি। প্রশ্ন হল— ‘লুম্পেন’ কেন তৈরি হলো? আর ‘লুম্পেন’ কারা? এখান থেকেই একটা নাটকীয় দ্বন্দ্ব তৈরি হয়— যার উত্তরণের ফলস্বরূপ একটি থিয়েটার নির্মাণ করা যেতেই পারে। সৃজক নাট্যগোষ্ঠী ‘প্রজাপতি’কে মঞ্চে নিয়ে এলেন দেবাশিস বসু-র নির্দেশনায়।

১৯৬৭ সালে শারদীয় দেশ পত্রিকায় ‘প্রজাপতি’ উপন্যাস প্রকাশিত হয়। ১৯৬৮ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি, আইনজীবী অমল মিত্র, সমরেশ বসু এবং প্রকাশক শীতাংশু কুমার দাশগুপ্তের বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগে মামলা করেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার অবাক করে দিয়ে শ্রী মিত্রকে সমর্থন করে, এবং ‘প্রজাপতি’র বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখে। নিম্ন আদালত রায় দেয় যে উপন্যাসটি অশ্লীল এবং এর কোনও সাহিত্যিক মূল্য নেই । কলকাতা হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখে। সতেরো বছর পর, ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর ‘প্রজাপতি’র উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।রায় বাতিল হওয়ার পর ১৯৮৫ সালে এই ব‌ইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণে রেকর্ড বিক্রি হয়। (‘প্রজাপতি’র ১১তম সংস্করণে বলা হয়েছে যে প্রথম সংস্করণের ৮,৮০০ কপি মুদ্রিত হয়েছিল কিন্তু দ্বিতীয় থেকে দশম সংস্করণ (১৯৮৫ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত) ৪৮,০০০ কপি বিক্রি হয়)।

নাটকের আলোচনায় অনেকেই ভাবতে পারেন হঠাৎ ছাই চাপা ইতিহাসের কথাগুলো নিয়ে মেতে উঠেছি কেন? খারাপ লাগুক বা যাই মনে হোক— বাঙালি বড্ড ইতিহাস বিস্মৃত জাতি। আমরা ভুলে যেতে ভালোবাসি খুব। আর ভালোবাসি বলেই আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, উচ্চ শিক্ষা ও চিন্তা অনায়াসে ছিবড়ে করে ফেলে দিতে পারে, অস্বীকার করতে পারে অনায়াসে। কিন্তু ‘প্রজাপতি’-র মতো জীবন-নাট্য কখনও মুছে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়নি। শিরদাঁড়া বয়ে যে ঘাম একদম নিতম্বের কাছে পৌঁছে যেতে যেতে মনে করায় অনেক আতঙ্কের স্মৃতি, অনেক প্রেমের বুকে ফালাফালা করা ছুরির দাগ, সেই উলঙ্গ সমাজ-শরীর জুড়েই তো লেখা হয়েছে এই উপন্যাস। যে কোর্টরুম থেকে নাটকটি শুরু হয়, বুদ্ধদেব বসু (অভিনয়ে ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায়) কিংবা নরেশ গুহ (অভিনয়ে গৌতম পাল) যখন সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেন জনতার দরবারে, মহামান্য বিচারপতির সামনে, কোথাও তো জয় হয় সাহিত্যের‌ই! অন্ধকার প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র যন্ত্রের সঙ্গে সাহিত্যের দাবা খেলায় মাত হয়ে যায় রাষ্ট্র। এই নাটক কথা বলে, মুক্ত চিন্তার জন্ম হয় কলম থেকে, চরিত্ররা শুধু মাত্র সময়ের ফলাফল। নাটকের চরিত্রেরা আসতে থাকে এক এক করে কোর্টের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সমানুপাতিক হারে। সুখেন তো গুন্ডা হতে চায়নি, সুখেনের জন্য তো শিখা অপেক্ষা করেছিল সেই কলেজ জীবন থেকে। রাজনীতির ময়দান থেকে ঘরের অন্দরে পর্যন্ত শিখা-র আলো ছিল সুখেনের মনে। তবুও প্রজাপতিটাকে ধরতে গিয়ে মেরে ফেলে সুখেন। এই প্রজাপতির মৃত্যু যেন অনেকটা এস.টি.কোলরিজ-র ‘দ্য রাইম অফ দ্য এনশিয়েন্ট মেরিনার’-এর জীবনীকাব্যের সেই বৃদ্ধ মেরিনারের গলায় ঝুলতে থাকা অ্যলবাটরস পাখির দেহ। এই পাখি, এই প্রজাপতির মৃত্যু আসলে তো সুন্দরের অকাল প্রয়াণের সংকেত। নাটকে বেশ অনেকটা সময় জুড়ে সুখেনের প্রজাপতি ধরার দৃশ্যটা আমাদের ধৈর্য ও অশান্তি নিয়ে যেন লোফালুফি করে। উপন্যাসের আবহাওয়া আর পরিবেশ অনুসারে  সুদীপ সান্যাল-এর আলোর ন্যূনতম ব্যবহার সঠিক ভাবে দেখিয়ে দেয় আমরা কী ছিলাম, আর আমরা এখনও এক‌ই আছি।

জিনা (অভিনয়ে নিশা হালদার) আর শিখা (অভিনয়ে সুজাতা সরকার)— এই দুজনকে নিয়ে অধিকাংশ ভণ্ডে আচ্ছাদিত সমাজের বড্ড জ্বালা হয়, আর হয় যৌনপিপাসু সুখেনের বাবার (অভিনয়ে বিশ্বজিৎ সরকার) চরিত্রটি সামনে এসে গেলে। পণ্যের পৃথিবীতে চিন্তা ধুলিসাৎ হয়, নারী তো যৌন ইচ্ছা মেটানোর মাধ্যম হবেই। এই সাবধানতার কথাই তো বারবার বলতে হবে সাহিত্য ও থিয়েটারকে। আর ঠিক এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আজকের একবিংশ শতাব্দীতে নারী পুরুষের সম্পর্কের প্রতি দায়িত্ব এবং দায় বুঝে নেওয়ার সময় এসেছে। একটা থিয়েটার তো এই কথাগুলোই বলবে— বিনোদন নয়, বয়ান তৈরি করাই থিয়েটারের কাজ। কে কোন চরিত্রে কেমন অভিনয় করলো, এই নিয়ে সৃজক-এর ‘প্রজাপতি’ নাট্য চিন্তিত নয়। নাট্যদলের দায় যেমন একান্তই সমাজের উপর, সেখান থেকেই প্রশ্ন তোলা হয়— যে উলঙ্গ দেউলিয়া দেশের ছবি তৈরি করতে করতে ভবিষ্যতের ছবি; ষাটের দশকেই সমরেশ বসু তুলে ধরছেন, আজকের বাঙালি বা আজকের ভারতীয় সেই এক‌ই সংকটে দাঁড়িয়ে নয় কি? আর‌ও প্রকট ভাবে আমরা দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছি না তো?

শীতে এক মফস্সলের মেলার সরেজমিন- পার্থ হালদার

সাধারণতন্ত্র দিবস, মফস্‌সলের মেলা ও খেজুর রস

পার্থ হালদার 

অনেক ছোটবেলায় খাঁটি খেজুর রসের স্মৃতিকে যেমন এই তিরিশ পেরনো জিভ আর মনে রাখতে চায় না, তেমনই গ্রামের মেলা সম্বন্ধে মরচে পড়া স্মরণশক্তিতে শান দিয়েও ঝাপসা ছবি ছাড়া কিছুই মনপটে ভেসে ওঠে না। তাই ভাণের জন্য একখানি লেখা লিখতে, শ্বশুর বাড়ির আপ্যায়ণ নিতে, ভোরের আলোয় খেজুর রসের রসাস্বাদন এবং দীর্ঘদিন গ্রামের মেলা না দেখার লোভকে স্তিমিত করতে ছুটে গেলাম আহমেদপুর, বীরভূম সাধারণতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে।

১৯৬১ সালে তৎকালীন মেলা সম্পাদক বিশ্বনাথ মণ্ডলের হাত ধরে শুরু হয় আহমেদপুরের ‘নেতাজি মেলা’, যা আজও স্বমহিমায় ঐ অঞ্চলের মানুষের কাছে এক টুকরো বিনোদনের চাবিকাঠি। শহরের মেলার সঙ্গে, এই মেলার আপাতদৃষ্টিতে তেমন কোনো পার্থক্যই নেই। কারণ একটাই – নগরায়ণ। কিন্তু একটু মন দিয়ে দেখলে দেখা যাবে পার্থক্য আছে। আবেদনে, খুশিতে, যাপনে। আমাদের কাছে মেলা যে আঙ্গিকে, যে রূপে ধরা দেয় – একটু মফস্‌সলের মানুষের কাছে সেইভাবে ধরা দেয় না। আমাদের শহর ও শহরতলির মেলায় প্রধান বিষয় চাকচিক্যের সমাহার। কিন্তু এই মেলায় ছিল নির্মল আনন্দের বাহার। যেন প্রায় প্রত্যেকেই এই মেলার জন্য মুখিয়ে থাকে শীত পড়লে। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ছোট ছোট গ্রামের মানুষজনও এখানে এসে ভিড় জমায় এবং নিজেদের মতো অনাবিল আনন্দে মেতে ওঠে। টেলিভিশনের পরে, মোবাইল আজ যেভাবে আমাদের অপ্রয়োজনের আনন্দে থাবা বসিয়েছে – সেখানে মফস্‌সলের মানুষেরাও বঞ্চিত নন। তবুও, এই মেলায় সাধারণ মানুষ, মূলত খেটে খাওয়া, অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের কাছে এই মেলা যেন মুক্ত বাতাসের মত ধরা দেয় বছরের পর বছর। আমাদের নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইমে একটা ভালো সিনেমা-সিরিজ দেখলে যেমন ভালো লাগার হরমোন নিঃসৃত হয়, এখানকার কিছু মানুষদের কাছে এই মেলাও ঠিক তেমন। অনেকের কাছেই তা সারা বছরের খুশির রসদও বটে।

মেলায় ঢুকলে তেমন কিছু আলাদা চোখে পড়েনি। ছোট ছোট পসরা সাজিয়ে অনেকেই বসেছিলেন। খাওয়ার দোকানের পাশাপাশি, ‘হরেক মাল’-এর অনেক দোকান চোখে পড়েছিল, যা শহরের তুলনায় খানিক বেশি। দামের হেরফেরও আছে বটে। প্রাঙ্গণ সংলগ্ন জায়গায় বহু গরিব-গুর্বো মানুষও এসেছিলেন, নিজেদের পেট চালাতে। বোঝা যায়, মেলার ভিতরে প্রবেশপত্র অর্থ্যাৎ অর্থ-কড়ি দেওয়ার মত সম্বল নন তাঁরা। তাই ফুটপাথে বসেছিলেন। আবার কেউ কেউ বাইরে বসেছিলেন বিভিন্ন ফার্নিচার নিয়ে। ছোটবেলায় আমাদের এখানেও এমন দেখতে পেতাম, কিন্তু এখন পাই না। মেলার একদম শেষ প্রান্তে যেখান লোকজনের ভিড় পাতলা হয়ে যায়, সেখানে বহু পুরুষ মানুষ জমায়েত হয়েছিলেন একটা খেলা খেলতে। শ্বশুরমশাই বলেছিলেন, এখানে এটাকে ‘ফিরফিরি’ বলে। যাকে গোদা বাংলায় বলে জুয়া। খোলা আকাশের নিচে, রমরমিয়ে চলছিল ক্যাসিনোর গ্রাম্যরূপ ফিরফিরি। শহরে এইসবের খুব একটা বালাই নেই। থাকলেও আছে খুব মার্জিতভাবে।

কিন্তু রিল বানানো, নিজস্বি তোলা, সেগুলো এখন এখানেও বেশ চোখে পড়েছিল। আলাদা করে কৃষি প্রদর্শনী এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আমার নজর কেড়েছিল। কারণ, এখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্থানীয় মানুষেরাই এসে নৃত্য, গান পরিবেশনা করছিলেন। তাঁদের মধ্যেই কেউ কেউ বিচারকের আসনে আবার। পাশের কিছু গ্রামের আদিবাসীদের জন্য একটা দিন বরাদ্দ হয়েছিল, যেখানে আদিবাসী নাটক, গান প্রভৃতি অনুষ্ঠিত হবে। স্বনামধন্য কেউ আসেন কিনা জিজ্ঞাসা করা হয়নি, কিন্তু এই যে স্থানীয়দেরকে একজোট করে মেলার একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়, উৎসাহ প্রদান করা হয় – তা আমাদের এখানে খুবই কম। আমাদের এখানে ঝাঁকড়া চুল বা কোনো এক সিরিয়ালের শিল্পীকে না দেখলে মেলা জমে না, মানে লোক হয় না। স্থানীয় মানুষদের উৎসাহ দেওয়ার বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন রীতি আর কী। আসলে আমাদের মেলায় একাত্মতা, আন্তরিকতার অভাববোধ করি। এখানে সকলেই যেন ভিনদেশী গ্রহের মত। আসে আর যায়। সেই বন্ধনের বড্ড অভাবী মন নিয়ে আমরা থাকি। ছোটবেলার টুকরো স্মৃতি খুঁজে পেইয়েছিলাম এই মেলায়। যা কিছু শহরের ঝকঝকে আলোয় ঝলসে গিয়েছে, তা যেন এই মেলায় এসে অল্প হলেও ছুঁয়ে দেখলাম।

মেলার অভিজ্ঞতা রাত্রে শেষ হল। ভোর ভোর গেলাম খেঁজুর রস এবং গুড়ের সন্ধানে। আহমেদপুর ছাড়িয়ে যখন পাহাড়পুরের গ্রামের রাস্তায় স্কুটির চাকা গড়ালো, তখন হিমেল বাতাস আমার হৃদয় জুড়িয়ে দিচ্ছিল। রোদ ওঠার কিছু পরে খাঁটি খেঁজুর রসে চুমুক দিতেই যেন শৈশবের অমলিন স্মৃতি ফিরে এলো। বুঝলাম, আসলে মানুষ কিছু ভোলে না, ভুলে থাকে মাত্র। সঠিক উপাদানের সংযোজনে তার বহিঃপ্রকাশ হয়।

নলেন গুড় ও তার পাটালি তৈরি দেখলাম। দেখলাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা খোলা আকাশের নিচে খেজুর রস, কাঠের আগুনে জাল দিয়ে গুড় তৈরি করছে। একদিকে ঝোলা গুড় অন্যদিকে পাটালি। পাটালি তৈরি একটু কঠিন মনে হল। গুড় জালের পর, ঘষে ঘষে তৈরি করতে হল।

শুনলাম, কারিগরেরা সকলের নদিয়ার। পাহাড়পুর গ্রামে আসেন কেবল শীতে। লিজে ভাড়া নেন খেঁজুর গাছগুলো। কনকনে ঠান্ডাতে মাচা বেঁধে রাতের পর রাত এক জায়গায় কাটিয়ে দেয়। সত্যি, পেশারও কত বৈচিত্র। ঋতুভেদে তার স্থান বদলে যায়। শ্বশুরমশাইয়ের নিদান ছিল গুড় যেন খাঁটি থাকে। ওনারা বলেছিলেন এ-ক্লাস। কিন্তু পরমুহূর্তেই স্বীকার করে নিয়েছিলেন মুচি গুড়ে (পাটালির স্থানীয় নাম) একটু তো চিনি মারতে হবে, নইলে যে জমবে না। কিন্তু, নবাদ গুড়ে (নলেন গুড় বা ঝোলা খেঁজুর গুড়ের স্থানীয় নাম) একটা দানাও নেই চিনির। আমাকে একদম হাতে গরম পাটালি দিলেন তাঁরা। মুখে দিতেই গলে গেল। এও এক পাওনা বটে। বাইরে যার দাম কোথাও ৪০০ কোথায় ৬০০ টাকা কেজি, সেখানে বিনামূল্যে দু’খান পাটালি প্রাপ্তি হওয়াটা মন্দ নয়।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *