magazines

৪৪ তম ই-সংস্করণ ।। ৫৫ তম সংখ্যা ।।জানুয়ারী ২০২৫

৪৪  তম ই-সংস্করণ ।। ৫৫   তম সংখ্যা ।।জানুয়ারী   ২০২৫

ভাণ পত্রিকা


৪৪ তম ই-সংস্করণ ।। ৫৫ তম সংখ্যা ।।জানুয়ারি ২০২৫

সম্পাদক :

সম্পাদনা সহযোগী :​

প্রচ্ছদ :

নক্সা পরিকল্পক :

অন্যান্য কাজে :

ভাণ-এর পক্ষে:

পার্থ হালদার

কর্তৃক

৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬

( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )

৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) bhaan.kolkata@gmail.com ( ই – মেল ) ​

Reg. No : S/2L/28241

সম্পাদকের কথা

।। সম্পাদকের কথা।। 
জানুয়ারী,২০২৫ 

 

শুধু ইনফোসিসের সুপ্রিমো নন, তিনি যে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন, তিনি যে বাড়াবাড়ি করে ফেলেন সে খোঁজ অনেকেই রাখেন। হপ্তায় নব্বই ঘন্টা কাজ করার ভয়ংকর এবং অশ্লীল প্রস্তাব তিনি হাস্যমুখে পরিবেশন করে নিজেকে উঁচু দলের দার্শনিক ঠাউরেছেন বলে মনে হল। কর্মযোগকে মাত্রাতিরিক্ত এবং অমানুষিক করে তোলার ইচ্ছে তার কোন্ মন দিয়েছে, সেটি ঠিক কোন ঢঙের বিকারগ্রস্ততা, তার নামকরণ মনস্তত্ত্ববিদরা করবেন। আমরা কেবল এই বিকারের জনগ্রাহ্যতা নিয়ে অল্প ক’লাইন ভাবতে চাই।

 

সমাজের গণ্যমান্য সিরিয়াস মানুষজন মোটের ওপর গতিময় শৃঙ্খলাবদ্ধ বেশি-বেশি কাজের প্রশংসায় হামেশাই বিশ্বাসগ্রাহ্য বক্তৃতা দেন। বিশ্বের সবাই কেন কাজের মর্ম বোঝে না, কেন নিজের সমাজের, দেশহিতের কাজে নিজেকে না জড়িয়ে পরম অলসতায় জীবনকে অর্থহীন করে তোলে— তা নিয়ে তাদের হাহুতাশের শেষ নেই। এ ব্যাপারে স্কুলের হেডমাস্টার, কলেজের প্রিন্সিপাল হাসপাতালের সুপার, কয়লাখাদানের মালিকের সঙ্গে ইনফোসিসের কর্তার প্রভেদ নেই। তারা জানেন এজেন্সি কোম্পানির সামগ্রিক উন্নতির সঙ্গে তাঁর নিজের নামখানিও স্বার্থময় জড়িয়ে আছে। সে এজেন্সির নানা থাকের কর্মচারীরা কিন্তু কর্মসংস্কৃতির একই সুরে আবৃত নন। কাজ এবং প্রাপ্যকে তারা মার্কসীয় পন্থায় বুঝে নিতে জানেন। অবকাশের অধিকার সম্পর্কেও তাদের অনেকেরই স্বচ্ছ ধারণা। তবে অবকাশ বেশি হলে চলে না, শুনেছি অস্বস্তি হয়। অশান্ত মন ছুটির আকাঙ্ক্ষা আর কাজের বদ্ধতার মাঝ বরাবর দুলতে থাকে। এটাই একালের চাকুরিজীবীর নিয়তি।

 

তবে চাকুরিজীবীর মাসকাবারি কাঁচা টাকার নিশ্চয়তা, তার নিজের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাকে কাটছাঁট করে। সে বোঝে, চাষীর মাঠে যাবার সিদ্ধান্ত এবং চাষের প্রতি কমিটমেন্ট চাষীর যতটা নিজের, বৌ কে নিয়ে পুরী বেড়ানোর মনোবাঞ্ছা কে সাকার করতে সে অফিসার হয়েও পরনির্ভর। বাসনা বক্ষে দুরু দুরু টেনশনে লাল হয়ে ছুটির দরখাস্ত হাতে বহু কর্মচারীদের বড় বাবুর দোরগোড়ায় অপেক্ষা করতে আমি দেখেছি।

 

যাদের দৈনিক আট-দশ ঘন্টা বাঁধা ডিউটি, তাদের তুলনায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে কর্মরত বহু মানুষকে আমি দৈনিক আরো বেশি সময় পরিশ্রম করতে দেখেছি। ব্যক্তির উন্নতির কারণ সেখানে ব্যক্তি। উন্নতি অবনতিও মোটের ওপর ব্যক্তিগত। সে ব্যক্তি যখন ব্যক্তিগত স্তরের উদ্দীপনা নিয়ে সংস্থার কাজে ঝাঁপায়, সংস্থার উন্নতিতে ব্যক্তির ভূমিকা গৌন থেকে যায়। তার স্বীকৃতি কতটা হবে তা নির্ভর করে সংস্থার চেয়ারম্যানের উদারতার ওপর। আবার অর্থনৈতিক চাহিদা ছাড়াই কেবল আনন্দ পেতে অক্লান্ত পরিশ্রম করার বাঙালি আমরা কম দেখিনি। একজন ছবি আঁকিয়েকে দৈনিক পনেরো ঘন্টা কাজ করতে আমি দেখেছি। একজন থিয়েটার ডিরেক্টরকে টানা ১২ ঘন্টার রিহার্সালে বসতে দেখিনি তেমন করে।

 

তার মানে কাজের সঙ্গে আনন্দ জুড়ে গেলে কাজের সময় বাড়ে। কাজে ডুবে থাকতে ইচ্ছে করে। আর যে কাজের সঙ্গে যুক্ত মানুষটির কাজের পক্ষে একটা আদর্শগত ভিত্তি আছে, সে সেই কাজে অনেক সময় ব্যয় করেও ভাবে আরো কেন করছি না! বিদ্যাসাগর নিশ্চয়ই বুক কিপারের কাজে টানা ১৫ ঘন্টা টানতে পারতেন না। অথচ বুক কিপারের কাজের চেয়ে কোটিগুণ চ্যালেঞ্জিং কষ্টসাধ্য যন্ত্রণাদায়ক কাজে এতো সময় ব্যয় করলেন। আজকের কর্মের সঙ্গে কর্তার মানস প্রবৃত্তির যে যোজন দূরত্ব,-একথা তো সেই কবে মার্কস সাহেব সরল করে বুঝিয়ে দিয়েছেন।

 

ফলে কী কারণে ৯০ ঘণ্টা খেটে মরব আমি? আমি কি কেবল খাটতেই জন্মেছি? সন্তানের মুখ ধরে চুমু খাওয়ার বাসনা ছেড়ে, নদীর পাড়ে শীতের রোদ পোহানোর ডাক ছেড়ে, আমি কি কেবল কাজের ছুতোয় বাজারের স্বার্থের কার্যকরী যন্ত্র হয়ে যাব? অঞ্জন চৌধুরীর সন্ধ্যা রায়ের মতো মুখ গুঁজে উদয়াস্ত পরিশ্রমে আদতে কার কার পেট মোটা হয়? কার পক্ষে কার বিপক্ষে নিরন্তর খেটে চলি আমরা? তলিয়ে দেখলে বুঝব, আমি গাছ কাটার পক্ষে, নদী বোজানোর পক্ষে, জীবনদায়ী ঔষধের দাম বাড়ানোর পক্ষে, গরিব কে চিরকাল গরিব রাখার পক্ষে, ধনীকে চিরকাল উঁচুতে রাখার পক্ষে, নিজের স্ট্যাটাস সিম্বলের পক্ষে এবং নিজের অন্তরের প্রকারান্তরে জীবনের বিপক্ষে খেটে চলেছি। শৃঙ্খলাবদ্ধ গতিশীল মগজহীন হৃদয়হীন আত্মহত্যার পক্ষে কেবলই খেটে চলেছি, মাথা কুটে চলেছি, আত্মার অসহ্য যন্ত্রণাকে হজম করতে করতে কত যে “ভালো আছি”— সে সব সাজানো ছবির বিজ্ঞাপনে ভরে দিচ্ছি চারপাশ! ইনফোসিস এর কর্তার মাথায় যে অন্তহীন অনন্ত রাক্ষুসে খিদে তার মকরের দাঁতের আক্রোশে দীর্ন বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে আমাদের শৈশব কৈশোর যৌবন প্রৌঢ়ত্ব। রাক্ষস শুধু কোয়ান্টিটি বোঝে, কোয়ালিটি বোঝে না। রাক্ষস শুধু জীবন বোঝে, মৃত্যু বোঝে না। রাক্ষস শুধু পেটুক হয়, রসিক হতে পারে না। হে জীবন, হে জীবন রসিক তুমিই বোঝো প্রবৃত্তির নিবৃত্তির লীলা, তুমি বোঝো কতটা নুন প্রকৃতপক্ষে তরকারির উপযুক্ত। তুমি জানো, কম নয়, বেশি তো নয়ই, জীবনের রান্নাঘরে চাই রান্নার ব্যালান্স। আমরা নুন-পোড়া অন্ধ রাক্ষসের অর্থহীন কাজের ঘোরে চরকি কাটতে চাই না।

 

কলকাতার গালগপ্পোর দ্বাদশ পর্ব লিখলেন - কিশলয় জানা

ঘাটের কথা,১২   পর্ব 
কিশলয় জানা 

সেকেলে কলকাতার পূজাপার্বণ

আগের পর্বে বলব-না বলব-না করে দুগ্‌গা পুজো নিয়ে অনেক কথা বলে ফেলায় যাঁরা রাগ করেছেন, তাঁদের মাথায় শান্তিজল ছিটিয়ে এই পর্বে অন্যান্য উৎসবের কথা বলি। সেকালে কলকাতায় দুগ্‌গা পুজো ছাড়াও অন্যান্য উৎসব নেহাত কম হত না। প্রাণকৃষ্ণ দত্ত সেগুলির একটি দীর্ঘ তালিকা দিয়েছেন। সে তালিকার প্রসঙ্গে কিছু বলার আগে দত্ত মশায়ের বই থেকে একখানি ছড়া উদ্ধার করি। কথায় কথায় আমরা বারো মাসে তেরো পার্বণের কথা বলি। কিন্তু সেকালে সেই তেরো পার্বণ বলতে কোন্‌ গুলিকে বোঝানো হত, তা সেকালে প্রচলিত এই ছড়া থেকে জানা যাবে—

চৈত্রমাসে চড়ক পূজা গাজনে বাঁধা ভারা।

বৈশাখ মাসে দেয় সকল তুলসীগাছে ঝারা।।

জ্যৈষ্ঠমাসে ষষ্ঠীবাঁটা জামাই আনা আনি।

আষাঢ় মাসে রথযাত্রা দড়া টানাটানি।।

শ্রাবণ মাসে ঢেলাফেলা হয় চড়চড়ী।

ভাদ্র মাসে টকপান্তা খান মনসা বুড়ী।।

আশ্বিনে অম্বিকা পূজা কাটে মোষ পাঁটা।

কার্ত্তিকে কালিকা পূজা, ভাইদ্বিতীয়ার ফোঁটা।।

অঘ্রাণে নবান্ন নূতন ধান কেটে।

পৌষ মাসে বাউনী বাঁধা ঘরে ঘরে পিটে।।

মাঘ মাসে শ্রীপঞ্চমী ছেলের হাতে খড়ি।

ফাল্গুন মাসে দোলযাত্রা ফাগ ছড়াছড়ি।।

 

এই ছড়া থেকে বোঝা যাচ্ছে, সে-সময় বাঙালি হিন্দুর অবশ্যপালনীয় তেরোটি পার্বণের মধ্যে যা একালেও কম-বেশি প্রচলিত, সেগুলি হল— চড়ক, জামাইষষ্ঠী, রথযাত্রা, মনসা পূজা (রান্না পূজা), দুর্গাপূজা, কালী পূজা, ভাইফোঁটা, নবান্ন উৎসব, পৌষ-পার্বণ, সরস্বতী পূজা এবং দোল-উৎসব। চড়ক অবশ্য কলকাতায় আর হয় না, তবে হুতোমের নক্‌শার শুরুতেই চড়কের যে বিস্তৃত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তাতে বোঝা যায়, এককালে খাস কলকাতার অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব ছিল চড়কপূজা। মনসাপূজাও মফস্‌সলে যেমন হয়, কলকাতার বিমিশ্র মেট্রোপলটন কালচারে তেমন হয় না। আর একটা সত্য কথা হল, খাস কলকাতা থেকে সাপ প্রায় বিলুপ্ত হয়েছে বলে, এখানে সর্পদংশনে মৃত্যুর ভয় কম, ফলে মনসাভক্তিও কম। এই তালিকায় দু’টি পার্বণ বর্তমানে প্রচলিত নেই, তার একটি বৈশাখ মাসে তুলসী পূজা। হিন্দু বিশ্বাস মতে, বৈশাখ মাস হল মাধব মাস। এই মাসে তুলসী গাছে রবিবার ও একাদশী ছাড়া জলদান করলে মৃত্যুর পর বৈকুন্ঠলোকে প্রবেশ করা যায়। এই রীতিটি সেই সময় হিন্দুদের অন্যতম প্রধান পার্বণ ছিল। বিবেকানন্দের মেজভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত জানিয়েছেন, “তখনকার দিনে লোকের তুলসী গাছের উপর বড় ভক্তি ছিল।” সে-সময় একটি কথা প্রচলিত ছিল যে, শালগ্রাম, তুলসী গাছ এবং গরু না থাকলে, তাকে হিন্দুর বাড়ি বলেই মনে করা হত না। গ্রীষ্মকালে তুলসীগাছে ঝারা দেওয়া হত। এই ঝারার সাহায্যে জল দেওয়ার ব্যাপারটি আজও কেউ কেউ করে থাকেন। সন্ধ্যাবেলায় তুলসীর মূলে প্রদীপ জ্বালানো ছিল অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। শ্রাবণ মাসের ঢেলাফেলা উৎসব হুতোমও উল্লেখ করেছেন। এটি আসলে নাগপঞ্চমীর দিন অনুষ্ঠিত মনসা পূজা। ঢেলা শব্দটি ডালার অপভ্রংশ। পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া প্রভৃতি জেলার কোন কোন অঞ্চলে এখনও ঢেলা ফেলা নামেই পূজাটি প্রচলিত। এই পূজায় সাত রকমের শাক খেতে হয়। ডালায় খই ইত্যাদি সাজিয়ে মনসার কাছে উৎসর্গ করা হত বলে এই রকম নাম হয়ে থাকবে। আবার শ্রাবণ মাসে ইলিশ মাছ বাজারে আসার আগে এক রকমের পুজো হত, সেটিকেও ঢ্যালা ফেলা বলেছেন কেউ কেউ। হুতোমের গুরুদাস গুঁইয়ের এই ঢ্যালা ফ্যালার জন্য মাস-মাইনেটাই পুরো খরচ হয়ে যেত। আরও নানা পার্বণের মতো এই পার্বণটিও বর্তমানে কলকাতাবাসীরা আর পালন করেন না।

 

কিন্তু সেকালের কলকাতায় কেবল এই তেরোটি পার্বণই পালন করা হত, এমন ভাবলে খুব ভুল হবে। আগেই বলেছি, প্রাণকৃষ্ণ দত্ত কলকাতা-বিষয়ক তাঁর মূল্যবান ইতিহাসে নেই নেই করে প্রায় চৌষট্টিটি এইরকম উৎসব পার্বণের কথা বলে “সমস্ত প্রকাশ করা অসম্ভব” বলে ক্ষান্ত হয়েছেন। সে-তালিকাটি থেকে দেখা যায়, অধিকাংশ পার্বণই বর্তমানে আর আমরা পালন করি না। যেমন— সীতা নবমী, নৃসিংহ চতুর্দ্দশী, চন্দন যাত্রা বা ফুলদোল, যম পূজা, রম্ভা তৃতীয়া ব্রত, অঘোর চতুর্দ্দশী, আলোক অনাবস্যা বা গো-সহস্রী, সীতাষ্টমী বা জীমূতবাহন পূজা, বরদা চতুর্থী, মদন ত্রয়োদশী বা কন্দর্প পূজা, গুহ ষষ্ঠী, ললিতা সপ্তমী বা কুক্কুটী ব্রত, ঘেঁটু পূজা, ভীম একাদশী, বিবস্বৎ সপ্তমী ইত্যাদি। আবার কিছু কিছু পূজা কম-বেশি একালেও চালু আছে, যেমন— বাসন্তী বা অন্নপূর্ণা পূজা, কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা এবং দীপাবলির দিন অনুষ্ঠিত লক্ষ্মী পূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা, কার্তিক পূজা, অক্ষয় তৃতীয়া, দশহরা, অম্বুবাচী, গণেশ পূজা, শীতলাষ্টমী, শিবরাত্রি, রটন্তী কালী পূজা, রাসযাত্রা, ঝুলনযাত্রা ইত্যাদি। শেষের দিকের পার্বণগুলি অবশ্য যৎসামান্যই একালে পালিত হয়। তবে এই তালিকাটি দেখলে সেকালে বাঙালির বারোমাসে যে কমপক্ষে চৌষট্টি পার্বণ ছিল, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তবে এর সবগুলিই সকলে পালন করতেন না। তালিকায় বৈষ্ণব ও শাক্ত ভেদে উভয় মতাবলম্বী মানুষেরা যে-যাঁর পার্বণ পালন করতেন। সাধারণ ভাবে, অবস্থাপন্ন বিষয়ী লোকেরা বারো মাসে সে তেরো পার্বণের কথা আগে বলা হয়েছে, তা তো পালন করতেনই, উপরন্তু জগদ্ধাত্রী, কার্তিক পূজাও করতেন। যাঁর ঘরে বছরে অন্তত দু’টি-তিনটি উৎসব না পালিত হত, তাঁকে কেউ কেউকেটা ভাবতেন না। সমাজে তাঁর আদর-প্রতিপত্তি কম হত। ফলে সম্পন্ন মানুষেরা বছরে কয়েকটি উৎসব অন্তত পালন করার চেষ্টা করতেন। হুতোমও জানিয়েছেন যে, নতুন বাবুরাও “নিত্য নৈমিত্তিক দোল দুর্গোৎসব প্রভৃতি বারো মাসে তেরো পার্ব্বন ফাঁক দিতেন না; ঘেঁটু পূজোতেও চিনির নৈবিদ্দি ও শকের যাত্রা বরাদ্দো ছিল ও আপনার বাড়িতে যে রকম ধুম করে পূজো আচ্ছা কত্তেন; রক্ষিত মেয়ে মানুষ ও অনুগত দশ বারো জন বিশিষ্ট ব্রাহ্মণদেরো তেমনই ধুমে পূজো করাতেন।”

 

ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে, হুতোম যে সময়ে এই বাবুদের ছবি আঁকছেন, তখন এই বাবুরা সব দূর অতীতের মানুষ। ইতিহাসের সামগ্রী। পলাশীর যুদ্ধের বছর তিন চার পর থেকে উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝি পৌঁছেই বাবুয়ানির প্রদীপ নিভু নিভু হয়ে আসে। আর উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তো সেই বাবুয়ানি ধুঁকছে। বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া আগের সেই বোলবোলাও আর নেই বাবুদের, ফলে তাঁরা যে ঘটা করে বারো মাসে তেরো পার্বণ পালন করবেন, তার আর যো ছিল না। তবে প্রাণকৃষ্ণ দত্ত একটি অভিনব সংবাদ দিয়েছেন যে, অনেক ভদ্রলোক মহরম পালন করতেন। রাস্তায় তাজিয়া বের করে হাসান-হোসেনের নাম করে বুক চাপড়াতেন এবং লাঠি খেলতেন। এই ঘটনা সত্যি হলে বলতে হয়, এটি ছিল উনিশ শতকের শিক্ষিত ভদ্রলোকদের এক নতুন হুজুগ। তবে আপাতভাবে কলকাতাবাসী হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ আপোষরফার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক বাতাবরণ গড়ে তুলেছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। তারপর তাতে ভেদবুদ্ধির রাজনীতি ঢুকে পড়ল এবং বিষবৃক্ষের ফল ফলতে দেরি হল না।

 

বিভিন্ন পূজা উপলক্ষ্যে শোভাযাত্রা বের করার একটা রেওয়াজ ছিল। সে নবমী পূজার বলিদানের পর মোষ বা ছাগের কাটা মুণ্ডু নিয়েই হোক, কিংবা আখ, কুমড়ো, লেবু কিংবা নারকেল হোক, তা নিয়ে মিছিল করে নগর পরিক্রমা করা হত। কেউ একজন উবু হয়ে বসে নিজের পেট ও উরুর মাঝে একটি নারকেল রেখে তা চেপে বসে থাকত, আর আট-দশ জন সেই নারকেল কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করত। প্রায়ই এই নিয়ে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে যেত। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই প্রথা বন্ধ হয় নি। জন্মাষ্টমীতে কাদা আর দই মেখে শোভাযাত্রা সহকারে গঙ্গাস্নান করতে যেত অনেকেই। দোলের ঘটা ছিল দেখবার মতো। সেদিন সারা শহর রঙিন হয়ে উঠত আবীর আর পিচকিরির রঙে। সেইসঙ্গেই চলত অশ্রাব্য গালিগালাজ। তাতে অবশ্য কেউ রাগ করত না, কেননা সেটাই ছিল প্রথা। ইংরাজরা যখন আসেনি, তখন থেকেই না-কি দোলের ঘটা ছিল। যদিও যে কলকাতায় তখন জনবসতিই ছিল হাতে গোনা, আর জনসংখ্যাও ছিল সীমিত, সেখানে দোলের ঘনঘটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য গল্প বলে মনে হয় না।

 

গোবিন্দপুরের মুকুন্দরাম শেঠ এবং তাঁর ছেলে একখানা পুকুর খনন করেছিলেন, তখন গঙ্গা আরও কাছাকাছি ছিল লালদীঘির। এই দিঘির পশ্চিম পাড়ে শেঠের প্রাসাদোপম অট্টালিকা, উত্তর পাড়ে রাধার দোলমঞ্চ এবং দক্ষিণ পাড়ে গোবিন্দের দোলমঞ্চ ছিল। রাধার দল এবং গোবিন্দের দল-এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে সকলে একে অপরের দিকে রং-আবীর ইত্যাদি ছুঁড়তেন। সেদিন দিঘির জলে আবীর গুলে সেই জল পিচকারিতে ভরে ব্যবহার করা হত। সেই থেকে না-কি দিঘির নাম লালদীঘি হয়েছে। যদিও শিবনাথ শাস্ত্রী বলেছেন, ইংরেজরা কলকাতায় বসতি স্থাপনের পর পানীয় জলের সুবিধার জন্য নানা জায়গায় কয়েকটি বড় পুকুর খনন করেছিলেন, যেগুলিতে কাউকে স্নান করতে দেওয়া হত না। এই পুকুরগুলির জল পান করার জন্য ব্যবহৃত হত। এগুলির মধ্যে লালদিঘি ছিল সর্বপ্রধান। তিনি জানিয়েছেন, উড়িয়া ভারীদের অনেকেই ওই জল বড় বড় ভিস্তিতে ভরে বাড়িতে বাড়িতে সরবরাহ করত। যাই হোক, কথিত যে, যেখানে আবীর স্তুপ করে রাখা হত, সেই স্থানে গড়ে ওঠা বাজারকে লালবাজার এবং রাধার মঞ্চের উত্তরদিকে যে বাজার ছিল, তাকে রাধাবাজার বলা হত। আজও এই নাম দু’টি বজায় আছে।

 

খাস কলকাতায় দোলযাত্রার পাশাপাশি রাসযাত্রাও বেশ ধূমধাম করে হত। এই ব্যাপারে শিয়ালদহের কাছে অবস্থিত শুঁড়ো ( বর্তমানে ৩৩ নং ওয়ার্ড ) ছিল রাসের জন্য বিখ্যাত। এখানে ছিল কৃতবিদ্য মনীষী রাজেন্দ্রলাল মিত্রের প্রপিতামহ রাজা পীতাম্বর মিত্রের বাগান এবং সুরম্য অট্টালিকা। পীতাম্বর মিত্র দিল্লী দরবারে নবাবের অধীনে কর্মচারী ছিলেন এবং পরে নবাব কর্তৃক রাজা বাহাদুর খেতাব এবং দশ হাজার অশ্বারোহীর মুনসেবদার হয়েছিলেন। তাঁর আদিবাড়ি ছিল মেছুয়াবাজারে। পরে তিনি বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেন এবং শুঁড়োয় উঠে আসেন। তাঁর বাড়ির রাস দেখার জন্য লোকে একেবারে ভেঙে পড়ত।

 

রথের উৎসবের ঘনঘটা ছিল দেখবার মতো। তবে কলকাতার রথের চেয়ে শ্রীরামপুরের মাহেশের রথের বেশি খ্যাতি ছিল। না থাকলে কি আর বঙ্কিমচন্দ্র ‘রাধারানী’র গল্প শোনাতে পারতেন? মাহেশের রথ নিয়ে নানা কিংবদন্তী প্রচলিত থাকলেও, এই রথ অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকবে। শ্যামবাজারের দেওয়ান কৃষ্ণরাম বসু মাহেশের রথ নির্মাণ করেন বলে জানা যায়। পরবর্তীকালে হুগলীর কালেক্টরের দেওয়ান থাকার সময় তিনি মাহেশের জগন্নাথদেবের নামে নিজের অনেক সম্পত্তি দেবত্র করে যান। কৃষ্ণরামের দানধ্যানের খ্যাতি ছিল। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় তিনি এক লক্ষ টাকার চাল বিতরণ করেছিলেন বলে জানা যায়। পরবর্তীকালে মাহেশের নামে উৎসর্গীকৃত সম্পত্তির আয় থেকেই মাহেশের রথ-উৎসব অনুষ্ঠিত হত। রথযাত্রার সময় যে-রথ টানা হত, বাকি সময় তা কোন না কোন জায়গায় রাখা থাকত। বৈঠকখানায় একটি বহুকালের বটগাছের নীচে শোভারাম বসাকের এমনি একটি রথ রাখা থাকত, যা না-কি ছিল সত্তর ফুট উঁচু। পোস্তায় নবাব লেন ও মহর্ষি দেবেন্দ্র রোডের সংযোগস্থলে যে জগন্নাথ মন্দিরটি রয়েছে, সেটিও অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে শোভারাম বসাকের তৈরি করা। সেই সাবেক মন্দির অবশ্য আর নেই। পরে পাথরের তৈরি আজকের মন্দিরটি তৈরি করা হয়। সেই মন্দিরের জগন্নাথদেবের তিনটি সুদৃশ্য রথ খুব বিখ্যাত ছিল। সারাবছর রথ তিনটি গরাণহাটার লালাবাবুদের বাড়ির উঠোনে থাকত। এই লাহাবাবু সম্ভবত গরাণহাটার বিখ্যাত ধনী শিবচন্দ্র সরকার হতে পারেন কিংবা জোড়াসাঁকোর লালাবাবু হতে পারেন, যাঁর একটি বাজারেরকথা মহেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন। রথযাত্রা উপলক্ষ্যে রানি রাসমণির একখানা রূপোর তৈরি রথ বের হত, এটিও সেকালে বিশেষ আলোড়ন ফেলেছিল। রথযাত্রার আগে গোলপাতার সুদৃশ্য ছাতা (তখন কাপড়ের ছাতা সবে এসেছে, বড়লোকেরা তাও দু’-একটি রাখতেন), বড় বড় হাতপাখা, রঙমশাল, নারিকেলের শাঁসের মশাল ইত্যাদি নিয়ে শোভাযাত্রা যেত। মেলা বসত কোথাও কোথাও পথের দুধারে।

 

চড়ক পূজার বিশদ বর্ণনা হুতোমের নকশায় দেওয়া রয়েছে। সারা শহর কীভাবে উন্মত্ত হয়ে উঠত সে-সময় তার এমন জীবন্ত রসালো বর্ণনা উৎসাহী পাঠককে পড়ে নিতে অনুরোধ জানাই। সে-সময় আর একটি পুজো বাড়ি বাড়ি হত, সেটি ফাল্গুন মাসের সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত ঘেঁটুপূজা। মূলত মেয়েলি পূজা হলেও, এই পূজা উপলক্ষ্যে বাবুরা পথে পথে শোভাযাত্রা বার করতেন, বড় বড় জালা, গামছা ইত্যাদি দিয়ে ঘটা করে পূজার ব্যবস্থা করা হত। এই পূজার প্রণাম হল উলটানো জালায় লাঠির বাড়ি মেরে ভাঙা, কে সেই কাজ আগে করবে, তার জন্য কোথাও কোথাও মল্লযুদ্ধ হত। বিজয়ী মল্লবীর জালায় প্রথম লাঠির ঘা-টি দেওয়ার সুযোগ পেতেন।

 

এবার পূজার একখানা গালগপ্পো দিয়ে এবারের কিস্‌সা খতম করি। সে-সময় সব পূজাতেই মদ্যপানের ব্যাপকতা ছিল। কালীপূজার রাতে তা মাত্রা ছাড়িয়ে যেত। এ-ব্যাপারে প্রসিদ্ধ ছিলেন শোভাবাজারের কালীশংকর ঘোষ। ইনি এবং এঁর ভাই দুর্গাপ্রসাদ কোন এক আমেরিকান ক্যাপ্টেনের অধীনে জাহাজ কোম্পানিতে কাজ করতেন। এঁরা ছিলেন ঘোর তান্ত্রিক। এঁদের কালীপূজায় বাড়ির মেয়েরা-ছেলেরা সকলেই মদ্যপান করে টুপভুজঙ্গ হয়ে থাকতেন। এঁর গৃহিণী একবার দুপুরবেলায় মদ খেয়ে পড়ে ছিলেন, বেয়ারারা গিয়ে তেল-জল বকশিশ চাইলে ইনি রেগে বলে উঠেছিলেন, ‘কী? এ-বাড়িতে এসে তোরা তেল-জল চাইচিস? যা, মিঠাই খা আর মোমবাতি মাখ!’ এই বাড়ির পূজা নিয়ে অনেক রসালো কাহিনি সেকালে ঘুরে বেড়াত। সবই প্রায় মোদো-মাতালের কিস্‌সা। পূজায় অসংখ্য ছাগ, মোষ ইত্যাদি বলি হত। একবার কালীশংকর ভাবলেন, প্রতিবার ছাগ-মোষকে বলি দিয়ে আমি পুণ্য অর্জন করি, এইবার যদি গুরুদেবকে বলি দিই, তাহলে স্বর্গগমনের ক্ষেত্রে আর কোন বাধা থাকবে না। গুরুদেবও পাঁড় মাতাল হয়ে রয়েছেন, শুনে তিনিও আহ্লাদে হাত তুলে রাজি রাজি বলে নাচতে লাগলেন। কিন্তু যাঁরা বলি দিতেন, তাঁরা বেশি মদ্যপান করতেন না, করলে বলি দিতে অসুবিধা হতে পারে। তবে কালীশংকর শুনলে রাগ করতে পারেন এই কারণে বাইরে দেখাতেন যেন তাঁরাও পাঁড় মাতাল হয়ে গেছেন। তাদের সর্দার বুদ্ধি করে বলল, ‘বাবু, এই খাঁড়ায় ছাগ-মোষ বলি দেওয়া হয়, এই খাঁড়ায় কি আর গুরুদেবকে বলি দিতে আছে। আমার বাটিতে একখানা নতুন খাঁড়া আছে, সেখানা নিয়ে এসে আমি বলি দিচ্ছি।’ কথাটা কর্তা ও তাঁর গুরুদেব দুজনেরই মনে ধরল। সর্দার এই সুযোগে বাইরে বেরিয়ে পুলিশ ডেকে গুরুদেব ও বাবু দুজনের প্রাণ ও জেলযাত্রা আটকালেন।

যাত্রাভিনয়ের উপভোক্তাদের গল্প শোনালেন- তরুণকুমার দে

যাত্রাভিনয়ের উপভোক্তা তথা শ্রোতা বা দর্শক,৩য়  পর্ব 
তরুণকুমার দে

১৯৬৩-তে ‘রক্তের নেশা’ পালায় যুদ্ধ সম্পর্কে তিনি নূতন বক্তব্য পেশ করেছিলেন। যাত্রাদলের পছন্দ হয়নি। তিনি জানিয়েছিলেন: “প্রকাশ আর্য অপেরার একজন ‘নটবীর’ নিজের ভূমিকা মনঃপূত না হওয়ায়।…” পালাটি ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরের মরশুমে শান্তিগোপাল তরুণ অপেরা লীজ নিয়েছিলেন। তিনি পালাটি আগ্রহের সাথে অভিনয় করেছিলেন। পালাটির সুখ্যাতি হয়েছিল প্রধান চরিত্র প্রথা বিরুদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও।
পালাটির কেন্দ্রীয় বা প্রধান চরিত্রে ছিলেন তিলকরুদ্র অলকাপুরী রাষ্ট্রের প্রধান। তিলকরুদ্র সাগ্রহে প্রতিবেশী রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করেছিলেন। কিন্তু একসময়ে চুক্তিভঙ্গ করে অলকাপুরীর ওপর পাশের রাষ্ট্র পলাশপুরের সৈন্যবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। অপ্রস্তুত হলেও তিলকরুদ্র প্রতিরোধ করেছিলেন। দ্রুত আক্রমণকারী সৈন্যদল প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পিছিয়ে গিয়েছিল। তিলক রুদ্র যাত্রার ট্রাডিশন ভেঙ্গে বিজয়ের মুখে যুদ্ধ বন্ধ করতে চাইছিলেন। কারণ : “তিলক।। …… তারা অপরাধী সত্য, কিন্তু তার প্রায়শ্চিত্তও তারা করেছে বারো হাজার সৈন্যের প্রাণবলি দিয়ে। এরা এই পৃথিবীরই মানুষ। এদের জন্য আমার বুক ফেটে যাচ্ছে।

অর্থাৎ ব্রজেন্দ্রকুমার বীরত্বকে হত্যার বদলে আলিঙ্গনেই চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন। শান্তিগোপাল সবসময়েই নূতনত্ব খুঁজতেন। ইতিবাচক পরিবর্তনের পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। “তিলকরুদ্র” চরিত্রটিতে তিনি নিজেই অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
শান্তিগোপালও নিজেকে সাধারণ মানুষের শরিক ভাবতেন। ফলে ওই নবচিন্তার অংশীদার হতে তিনি দ্বিধাবোধ করেননি। পরবর্তীকালে তিনি বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা অবহেলিত মানুষেরই প্রতিনিধিত্ব করেন। কিন্তু ব্রজেন্দ্রকুমার কীভাবে বীররসের ওই ব্যাখ্যা উপস্থাপনা করেছিলেন? কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, যাত্রার শ্রোতা/দর্শক প্রতিশোধের রক্ত দেখতে চায় না।

এ প্রসঙ্গে প্রায়ই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যাংশ আবৃত্তি করতেন:
“যার যাহা আছে তার থাক তাই,
কারো অধিকারে যেতে নাহি চাই
শান্তিতে যদি থাকিবার পাই
একটি নিভৃত কোণে।”

তিনি ‘মানিকপালা’ পালা রচনা করেছিলেন ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে। কিন্তু পালার দুটি প্রধান ভূমিকায় দুজন সক্রিয় রাজনীতিবিদের চরিত্র এবং সমকালীন রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব প্রতিফলিত হয়েছিল। পালাতে ওই দুটি চরিত্রে যথাক্রমে স্পষ্টই চেনা যেত আবুল কাশেম ফজলুল হক এবং মহম্মদ আলী জিন্নাহ-কে। বাংলা তথা সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তখন পাকিস্তানের দাবি উপস্থিত হয়েছিল এবং একদা ‘হিন্দু-মুসলমান মৈত্রীর দূত’ রূপে কথিত জিন্নাহ্ ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়েছিলেন।
পালাটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। কিন্তু ময়মনসিংহ জেলার বহু দর্শক পালাটিকে ‘চাষার ছেলে’ বলে প্রচার করেছিলেন। তাদের বক্তব্য ছিল পালাটির নাম ‘মানিকমালা’র পরিবর্তে ‘চাষার ছেলে’ হওয়াই সঙ্গত। কারণ কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘দেবরায়’কে অভিজাতরা সকলেই ‘চাষার ছেলে’ বলে ব্যঙ্গ করতো। দেবরায় ছিলো চাষি পরিবার থেকে দত্তক নেওয়া [রাজার] পালিত ছেলে। ব্যঙ্গ এবং ধিক্কারোক্তি শুনে দেবরায় রাজ্য অধিকার করেছিল, কেবলমাত্র অভিজাতদের ওপর শোধ তুলবার জন্য।

পালাটি যখন প্রকাশিত হয়েছিল, তখন ব্রজেন্দ্রকুমার ‘মানিকমালা’র সঙ্গে ‘চাষার ছেলে’ নামটিও যোগ করেছিলেন। অতঃপর ‘চাষার ছেলে’ নামেই পালাটি বেশি পরিচিতি লাভ করেছিল। পালার ভূমিকায় ব্রজেন্দ্রকুমার ময়মনসিংহ জেলার সমস্ত শ্রোতা/দর্শকের কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছিলেন।
“তাঁহাদের দেওয়া নাটকের এই সুসঙ্গত উপাধি আমি সাদরে ‘মানিকমালা ‘ নামের সঙ্গে যুক্ত করিলাম।” এখানেও লক্ষ্যণীয় ‘সুসঙ্গত’ শব্দটি ব্রজেন্দ্রকুমার নিজের নির্বাচিত নামের পাশে ওই নামটি সুপ্রযুক্ত ছিল, সেই স্বীকৃতি রেখেছিলেন ।

কিন্তু জীবন-সায়াহ্নে ১৯৭২-৭৩ মরশুমে পালার নাম পরিবর্তনের অনুরোধ [কর্তৃপক্ষের] তিনি অগ্রাহ্য করেছিলেন। বারবারই কয়েকটি অভিনয়ের ফলশ্রুতি লক্ষ্য করতে বলেছিলেন। চার/পাঁচটি অভিনয়ের পরে কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছিলেন যে, নামটি যথাযথই হয়েছে;যাত্রার দর্শকেরা ওই ‘আঁধারের মুসাফির’ নামটিকেই উপযুক্ত মনে করছেন। পালা নাটকের নামকরণের সময়, বেশ বোঝা যায়, তিনি দর্শকদের গ্রহণক্ষমতা এবং দ্রুত অগ্রসর মানসিকতার প্রতি গভীর আস্থা রেখেছিলেন।

মন ভালো করা ‘ইয়ে মেরি ফ্যামিলি’-অজন্তা সিনহা




ওয়েব দুনিয়ায় সেক্স-ক্রাইম-হরর স্টোরির রমরমার মাঝে বেশ খানিকটা রিলিফ ওয়েব সিরিজ ‘ইয়ে মেরি ফ্যামিলি’! ভারতীয় মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির পটভূমিতে আমরা যে গল্প পল্লবিত হতে দেখি, তাতে রাজ্য বা সম্প্রদায় নিরিখে খুব বেশি পার্থক্য থাকে না। পরিবারের সদস্যদের মধ্যেকার রসায়ন থেকে পাড়া-প্রতিবেশী, স্কুল-কলেজ, অফিস-কাছারি সর্বত্র সম্পর্কের এক চেনা ছবি আমরা দেখতে পাই। এই সিরিজেও তারই প্রতিফলন, যা দর্শককে সহজেই আকৃষ্ট করে। পুরো সিরিজটি মোট ৪টি সিজন এবং ২২টি এপিসোডে বিন্যস্ত। সৌরভ খান্না যেমন যত্নে লিখেছেন এই সিরিজের গল্প, তেমনই নিখুঁত ব্যাঞ্জনায় পর্দায় তাকে হাজির করেছেন পরিচালক সমীর সাক্সেন।

প্রথম সিজনের গল্প গড়ে ওঠে ১৯৯৮ সালের প্রেক্ষিতে, রাজস্থানের জয়পুরের এক পরিবারকে কেন্দ্র করে। এখানে মূলত ১২ বছর বয়সী হর্ষল গুপ্ত থুড়ি হর্ষুর (বিশেষ বানসাল) কান্ডকারখানা ঘিরেই লেখা হয়েছে গল্প। গুপ্ত পরিবার এবং তাদের দিন-রাত্রির বিভিন্ন সমস্যা ও আনন্দ-বেদনার অভিজ্ঞতা, হর্ষুর স্কুল ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মিলে দুষ্টুমি–ইত্যাদি একেবারে রিয়ালিস্টিক মেজাজে আঁকা হয়েছে এই সিজনে। অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে আছে হর্ষুর বাবা দেবেন্দ্র গুপ্ত (আকাশ খুরানা), মা পূর্বা গুপ্তা (মোনা সিং), হর্ষুর দাদা ডাব্বু বা দেবাংশ (অহন নির্বাণ), হর্ষুর ছোট বোন ধ্বনি ওরফে চিট্টি গুপ্তা (রুহি খান), হর্ষুর বেস্ট ফ্রেন্ড শঙ্কি (প্রসাদ রেড্ডি), বিদ্যা অর্থাৎ হর্ষু যার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে (রেবতী পিল্লাই) প্রমুখ। বলা বাহুল্য চমৎকার গল্প বিন্যাস ও নিপুণ অভিনয়ে এই টিম প্রাণবন্ত করে তোলে ‘ইয়ে মেরি ফ্যামিলি’র এই সিজন। এর প্রথম সম্প্রচার হয়েছিল ১২ জুলাই, ২০১৮।

দ্বিতীয় সিজন থেকে গল্পে এলো পরিবর্তন। পটভূমি একই, কিন্তু, পাত্রপাত্রী গেল বদলে। গল্প বিন্যস্ত নতুন এক পরিবারকে ঘিরে। অবস্থী পরিবারের ১৫ বছর বয়সী মেয়ে ঋতিকার গল্প বলা হয়েছে এখানে। এই পর্বে উঠে এসেছে এক কিশোরী মেয়ের জীবনের নানা চ্যালেঞ্জ এবং জীবন সংগ্রামের কথা। চতুর্থ সিজন শুরু হয় ২০২৪ সালের ১৬ই আগস্ট। এই প্রসঙ্গে অবস্থী পরিবারের বাকি সদস্যদের কথা বলি। ঋতিকার ভূমিকায় ছোট পর্দার চেনা মুখ হেতাল গাড়া। অন্যান্যদের মধ্যে আছে ঋতিকার বাবা সঞ্জয় অবস্থী (রাজেশ কুমার), ঋতিকার মা নীরজা অবস্থী (জুহি পারমার), ঋতিকার ভাই ঋষি অবস্থী (অঙ্গদ রাজ), ঋতিকা-ঋষির ঠাকুমা (বীণা মেহতা)। অভিনয়ে আরও আছেন সরওয়াম কুলকার্নি, অবতার বৈষ্ণনী, সুপবিত্র বাবুল প্রমুখ।

বলা বাহুল্য, দ্বিতীয়-তৃতীয়-চতুর্থ সিজনেও দুর্দান্ত এক অভিনেতা টিম পর্দায় জীবন্ত করে তুলেছেন চরিত্রগুলোকে। প্রথম সিজনের মোনা সিং বা পরের সিজনগুলির জুহি পারমার হিন্দি বিনোদনের ক্ষেত্রে অতি চেনা মুখ। দুজনেই যথেষ্ট জনপ্রিয়। তবে, আগের গুপ্তা পরিবার বা পরের অবস্থীদের গৃহিণীর ভূমিকায় তাঁদের নির্বাচন নিছক জনপ্রিয়তার নিরিখে নয়। সিরিজে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন ওঁরা। উল্টোদিকে আকাশ খুরানা বা রাজেশ কুমারও কম যান না। সবচেয়ে উল্লেখ্য এই সিরিজের কিশোর অভিনেতা টিম। বিশেষ, হেতাল, অঙ্গদ–প্রত্যেকে এক সে বড়কর এক !! নিটোল গল্পের নিবিড় আন্তরিকতায় ভরপুর ‘ইয়ে মেরি ফ্যামিলি’ দেখতে পাবেন নেটফ্লিক্স ও আমাজন মিনি টিভিতে।

 

বীজাঙ্কুর -অয়ন্তিকা নাথ

ক অথবা এক্স; এখানে বসে কেনও?
খ অথবা ওয়াই; ভাবছি রাদার চেষ্টা করছি শুনতে
ক অথবা এক্স; কী?
খ অথবা ওয়াই; শব্দ। এখানে কোনও শব্দ নেই। খেয়াল করনি?
ক অথবা এক্স; হুস! তাই আবার হয় নাকি? বিশ্বের কোনও জায়গা শব্দশূন্য থাকতে পারে নাকি?
খ অথবা ওয়াই; কী জানি? এই, মেলায় যাবে? বন্দুক দিয়ে বেলুন ফাটাব…

ঠোঁট উল্টে, মণিবন্ধে সেঁটে থাকা চকচকে ঘণ্টার,সেকেন্ডের কাঁটা, বালি চিকচিক সময় তাক করে, খলখল শব্দ উৎপাদনের আশায় প্রিয় পুরুষের পানে মধুর কটাক্ষ ছুঁড়ে দিয়ে লাল, নীল, হলদে বেলুনের দিকে অস্ত্র তুলে ধরে রমণী আর ঠিক সেই মুহূর্তে পুরুষের মনে হয় অন্য সমস্ত শব্দ ফেলে দিয়ে, ব্রাত্য করে দিয়েও মানুষের কপট ইচ্ছাশক্তির শব্দ নমনীয় মুখমণ্ডলে সকালের না হওয়া ঘুমের মতো লেগে থাকে, তাকে ফেলা যায় না সহজে। ডান চোখ টিপে ধরে রেখে, রেটিনার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ঘোড়া টিপে দিল রমণী। এক, দুই, তিন শূন্য… অতি মানবীয় হ্যালোজেনিক আলোয় প্রেম দানা বাঁধে না সহজে।
ঘোর চৈতে কোকিলগুলো কি সব মরেছে নাকি? পুরুষ জোনাকি খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে।

ওপরের সংলাপ এবং ঘটনা দুই-ই কাল্পনিক এবং ব্যক্তিবিশেষে অপ্রয়োজনীয়ও হতে পারে। চলচ্চিত্র নির্মাতা দেবরাজ নাইয়া একটা ছোট ছবি বানিয়েছেন, নাম ‘বীজাঙ্কুর’। বিষয় যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে শিশুদের দুরাবস্থা। খুবই সহজ বিষয়। সহজ নয়? কেনো সহজ নয়? এরকম তো হরবখত হয়েই…” অ বাংলাদেশ বড্ড বাড়াবাড়ি করছে, এবার সিরিয়া শালা একবার পড়ুক, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কে আটকায় দেখব”-অ্যাঁ কী বলচেন? আবার বাজে কথা বলছি, টপিকের বাইরে কথা? আরে মশাই ওই যে বলছিলুম না শব্দ? হ্যাঁ কদিন যাবত এই একই শব্দ বাড়িতে, ঘরে, বাথরুমে, বৌ-কে কাতুকুতু দিতে দিতে এতবার শুনেছি যে যুদ্ধ শুনলেই আপনা থেকে কেমন একটা বাংলাদেশ বাংলাদেশ আর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা ভেবে রক্ত চলকে উঠছে। ইদানিং আর তাই ওল্ড মঙ্ক খাচ্ছি না বুজলেন। ইশে, ওই সারে যাঁহা সে আচ্ছা,বন্দে মাতরম, ইনকিলাব জিন্দাবাদ… সরি সরি শেষেরটা তো এখানে বসবে না তাই না? হ্যাঁ তো ওই শেষেরটা বাদে বাকিগুলো শুনচি।মাইরি বলচি দাদা টাকা,লিভার দুটোই বেঁচে যাচ্ছে। যাই হোক দেবরাজ নাইয়ার ওই ছবিটা নিয়ে বলছিলাম না? এই আমিই বলছিলাম? শিওর আপনি? না কেমন মনে হল না আমি না অন্য একটা মেয়ে বলতে শুরু করেছিল। যাক গে যাক, তো গেছিলাম ছবিটা দেখতে।

কী দেখলেন
সেইটাই তো বলচি কাকা। দেখলাম না কিছুই, থুরি দেখলাম কিন্তু শব্দ।
শব্দ দেখলেন? মানে চোখের সামনে জ্যান্ত শব্দ ঘুরে-ফিরে বেড়াতে দেখলেন?
আরিব্বাস। হেব্বি বলেচেন তো। তাই তো দেখলুম। কতগুলও বেশ ডাগর-ডোগর শব্দ চলে-ফিরে নেচেকুঁদে বেড়াচ্ছে চোখের সামনে। বোমা, দুড়দাড় দুড়দাড়, সাঁই সাঁই এরোপেলেন, হে হে ওই পধানমন্ত্রী যেমন পেলেনে যান তেমন পেলেন, তারপর মাছি, গাছ, পাতা সব কত কত শব্দ আর শব্দ…
আহ্! এমন করে নয়, প্রথম থেকে গুছিয়ে বলুন। একদম প্রথম থেকে কী কী শব্দ দেখতে পেলেন?
অই তো, কতগুলো লোকের ক্যাঁচাল করার শব্দ, অনেকটা রথতলার মোড়ের সাট্টার ঠেকে ক্যাঁচাল পেকে দাঙ্গা বাধালে যেমন শব্দ হয়, তেমন একটা শব্দ কালো পর্দার ওপর দিয়ে… এই তুমি কে অ্যাঁ? ও মাইরি তুমিই তো প্রথম ওই ফিলম নিয়ে কথা বলতে শুরু করলে। এই তো এই মেয়েটাই। তারপর আমার ঘাড়ে চাপিয়ে, মহা সেয়ানা তো। আমি থোড়াই দেখেছি ওসব ফিলম।
আপনিই তো দেখেছেন, আলবাত দেখেছেন, আপনিই তো বললেন ওই শব্দ দেখেছেন, দাঙ্গা লাগার আগের মতো শব্দ, আর সেটা দেখেই তো আপনার আজকাল মনে হয় ওল্ড মঙ্কের বদলে সারে যাঁহা সে আচ্ছা শুনলে রক্ত চলকে ওঠে।
অ্যাই মেয়ে, এসব কখন বললাম? একদম উধোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাবে না।

আহা! আপনি বলেননি, আমি বললাম। এটাকে বলে পোলিটিক্যাল অ্যানালিসিস।
ওসব আমি বুজি না, কিন্তু সিনেমাটা আসলে কে দেখেছিল? তুমি না আমি?
হি হি হি, ভাবুন কে দেখেছিল?
আমি? কিন্তু ওইসব সিনেমার বাচ্চারা কে কার কে হয়? কোন দেশে যুদ্ধ হল, কেই বা মরল? আর শেষে ওই যে সাদা কাপড়ে জড়ানো দেহগুলো, ওরা এপারের না ওপারের? কিছুই তো বুজলুম না। তবে দেখলুম কেন?
কে বলল আপনি বোঝেননি? আলবাত বুঝেছেন। পুব দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে বুকে হাত দিয়ে বলুন তো আপনি ওই সাদা কাপড়ে মোড়া দেহগুলোর পায়ের কাছে যখন বোমারু বিমান নেমে আসার আগের মুহূর্তে কাপড়ের টুকরোগুলো বাতাসে পতপত করে নড়ছিল তখন সেই শব্দ, সাদা, ফ্যাকাশে, রক্তশুন্য শব্দ দেখে আপনার নিজের ঘরের দেওয়ালে টাঙানো একরত্তি ঘষা কাচের চৌকো আয়নাটার কথা ভেবে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে ওঠেনি? বাড়ির নড়বড়ে সিমেন্ট চটা ছাদের কথা ভেবে গা গুলিয়ে ওঠেনি যখন হাঁপর ধ্বনীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বোমারু বিমানের শব্দ গিলে ফেলার চেষ্টা করছিল রুগ্ন বালকের শ্বাস টানার শব্দ আর কর্পোরেশনের মান্যতা ব্যতীত, বেনামী জমির পোড়ো আকাশখোলা ঘরের মধ্যে আরেকটি রুগ্ন বালিকা বুকে চেপে ধরে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করছিল বালকের নিঃশ্বাসের শব্দটুকু? আপনি প্রথমে ওদের মধ্যে ভাই-বোন বা রক্তের কোনও সম্পর্কের সমীকরণ তৈরি করার চেষ্টা করলেও, আপনি নিশ্চিত জানতেন যে কেবল দুজন মানুষ হওয়া ব্যতীত ওদের মধ্যে অন্য কোন সম্বন্ধ নেই, যা আছে তা কেবল মানুষ হওয়ার জন্য মানুষের সঙ্গে মানুষের যে সংযোগ, সেই সংযোগটুকুই, আর কিছু না, কেবল ওই সংযোগটুকুই যথেষ্ট একে অপরকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করার জন্য। আপনি তো এও জানেন যে দেশের নাম নেই, যাদের বুড়ো আঙুলের ছাপ কেউ মৃত্যুর পরে কেউ কখনও সনাক্ত করতে পারবে না, তাদের মাথার ওপরে যেসব যুদ্ধ ঘটে, সেসব যুদ্ধের নাম, সন, তারিখ সেই দেশের বাসিন্দারা মনে রাখে না, সম্ভবত জানেও না। যে শিশু যুদ্ধের ছবি খোদাই করার শব্দের মধ্যে অবিরত খেলা খেলা ছবি খুঁজতে চেষ্টা করে (আপনারাও খুঁজতে প্রবৃত্ত করেন তাদের) তারা চোখে দূরবীক্ষণ লাগালে খেলার ছলেই দেখতে পায় সাধের সবুজ ছিঁড়ে-কুটে জলের বুকে ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসছে যুদ্ধবিমান আর সেই বিমানের শব্দই তাকে যুদ্ধাক্রান্ত মৃত্যুমুখী মানুষে পরিণত করে। এরপর আর ওদের কোনও কোটার দরকার হবে না, কেওআইসির আপডেট,র‍্যাশনের চাল, সবার জন্য শিক্ষা সর্বশিক্ষা ফুঃ ছোঃ, গিলি গিলি ছু…

অ্যাই অ্যাই বেরোও তো, তফাৎ যাও, দূর হটো,সন্ত্রাসবাদী, পুলিশ পুলিশ, আমার নাম বিপিন পাল, ওয়াইজেড এলাকার মুদি দোকানের সেকেন্ড কর্মচারী,থানা এ,পোস্টঅফিস বি, দেশের নাম ভারত, আর রাষ্ট্রভাষা হিন্দি। উফফ ফের শব্দ, এবার সত্যি সত্যি বমি হয়ে যাবে মাইরি।

খ্যাঁক, খ্যাঁক, খ্যাঁক! পাশের দোকানে রেডিওতে ‘মন কি বাত’ আরম্ভ হল বিপিনবাবু। এ শব্দ জাতীয় শব্দ, ওই জাতীয় ফুল, জাতীয় খাবার, জাতীয় ভাষার মতো। আজ আসি তবে? ও হ্যাঁ, অনেক বছর আগে এই দেশে রবীন্দ্রনাথ বলে একজন জন্মেছিলেন। তো লোকটা একটা ভারি মজার কথা বলেছিল কিনা বুঝলেন, বলেছিল যে, আত্মীয়তার সম্বন্ধ এবংসামাজিকতার সম্বন্ধের বাইরেও মানুষের মানুষের সঙ্গে মানুষের একরকম সম্বন্ধ থাকে, যে সম্বন্ধকে অ্যাকনলেজ করার জন্য পূর্বভারতের মুসলমানরা আদাবের প্রচলন করেছেন। এ মানবিক সম্বন্ধ, মানুষ হওয়ার দৌলতেই এই সম্বন্ধ মানুষের সঙ্গে মানুষের গড়ে ওঠে স্বাভাবিক প্রবৃত্তির মতোই, সহজ স্বভাবধর্মের দাবি মেনে। এবার আরেকবার ‘বীজাঙ্কুর’ এর ওইসমস্ত যুদ্ধপীড়িত বাচ্চাদের একে অপরের পাশে রেখে দেখতে চেষ্টা করুন। চেষ্টা করতে করতে এক সময় বুঝে যাবেন যে কোনও ‘জাতীয়’ নেশার থেকেই ওল্ড মঙ্কের নেশা আসলে অনেক বেশি সাশ্রয়কর, স্বাদেও মধুর। একদম ওই যাকে বলে রঙে খাসা, স্বাদে তাজা, বাংলাদেশের নেশার রাজা। হ্যাঁ! এটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না? আসি।
এই মেয়ে আজ তারিখ কত? নাম বলে যাও, কে তুমি নাম কী, পদবী, ঠিকানা…
#জেড, এক্স ওয়াই জেড, সেই জেড। আজ ৮ই অগাস্ট, ২৫-৪৫ মানে আপনার দোকানের চৌকাঠের ওপারে ২০২৫ আর এপারে মানে রাজপথে ১৯৪৫।
‘শত্রুপক্ষ যদি আচমকা ছোঁড়ে কামান-
বলব, বৎস সভ্যতা যেন থাকে বজায়।

চোখ বুঁজে কোনো কোকিলের দিকে ফেরাব কান’

চোখ বুঁজে কোনো কোকিলের দিকে ফেরাব কান
চোখ বুঁজে কোনো কোকিলের দিকে ফেরাব কান।

বিঃদ্রঃ সমালোচনা লেখার যোগ্যতা আমার নেই। সিনেমা দেখে আমাদের মত নিছক দেখনে-শুননেওয়ালা মানুষরা কেবল দেখে যা উপলব্ধি করে সেটুকুই লিখতে পারে।‘বীজাঙ্কুর’ দেখে এই হালফিলে চলতে থাকা একটা অদ্ভুত নেশার গন্ধে নাক ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। সেই নেশার গল্পই যা দেখছি, যেমন যেমন দেখছি তা বলার চেষ্টা করলাম। পরিচালক দেবরাজ নাইয়া এই ছবিকে আদতে শব্দের প্রতিলিপি হিসাবে দর্শকের সামনে হাজির করেছেন, যে প্রতিলিপি সম্ভবত বিপিনবাবুদের কারণসেবনের তাকদকে প্রশ্ন করতে শেখায়, আর জেড নিতান্তই বখে যাওয়া মাথামোটা পাবলিক। ওর জীবনে কিস্যু হবে না। এবার এই কারণের স্বরূপ আসলে তরলপানা হলদেটে নাকি অন্য কিছু সেটা, দর্শক ঈশ্বরের দান; তাই আপনারাই বিবেচনা করুন এবং তার সঙ্গে ইচ্ছে হলে ‘বীজাঙ্কুর’একবার দেখতেও পারেন যদি হৃদয় এবং হৃৎপিণ্ড বাড়াবাড়িরকমের দুর্বল না হয়ে থাকে। এই পালায় এ পর্যন্তই। ও হ্যাঁ, শব্দের পাশাপাশি ‘বীজঙ্কুর’ নিজের মত করে কিছু গন্ধের চাষও করেছে, শব্দসংখ্যাজনিত সীমাবদ্ধতার কারণে সে নিয়ে এই লেখায় বলা সম্ভব হল না। যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধটা শেষ পর্যন্ত না বাঁধে তখন না হয় সে নিয়ে কিছু কথা বলা যাবে। আপাতত বিদায়, জয় হিন্দ, যুদ্ধ ইয়ে বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *