magazines

২৬তম সংখ্যা || ১৯তম ই-সংস্করণ || জুন ২০২২

ভাণ পত্রিকা

২৬তম সংখ্যা || ১৯তম ই-সংস্করণ || জুন ২০২২

সম্পাদক :

সম্পাদনা সহযোগী :

প্রচ্ছদ :

নক্সা পরিকল্পক :

অন্যান্য কাজে :

ভাণ-এর পক্ষে:

পার্থ হালদার

কর্তৃক

৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬

( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )

৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) bhaan.kolkata@gmail.com ( ই – মেল ) ​

Reg. No : S/2L/28241

সূচি

সম্পাদকের কথা

কথাটা হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে না। অনেকে অনেক কিছু করছে, কি করছে যদিও বা শেষতক মালুম হচ্ছে; কিন্তু কিভাবে করছে মোটেও দেখা যাচ্ছে না। না দেখা দিয়ে কিছু একটা ঘটিয়ে তোলা এই সময়ের সংস্কৃতি। ক্রমশ বুঝেছি ফলাফলই হচ্ছে অমোঘ। রাজা বনবার পথ অদেখা থাকুক। রাজা হলে মুকুট সহ ছবি দেখা দিক। এই হল দেখা-নাদেখার রাজনীতি। পথ নিয়ে একাল তেমন ভাবে না। সেই পথই সবচেয়ে দামি, যে পথে সফলতা আসে। নৈতিকতা ইত্যাদি দেখা যায় না। দেখা গেলে জ্ঞানতত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। ব্যাখ্যা দিলে নিজেকে জেতানো যাক বা না যাক, ঘেঁটে দেওয়া যায়। আর ঘেঁটে দিলে পথ ও যা, পুকুর ও তা। ধরুন মেডিকেল সাইন্সের একজন বিজ্ঞ মানুষ, পাকা চার দশক ধরে গবেষণা প্র্যাকটিশ‌,- দুই চালাচ্ছেন,- তাকে ও পাড়ার পটলা এসে ,”তুই কি জানিস রে শালা,তুই তো অমুকের দালাল!” লিখে পালিয়ে যেতে পারছে। যাকে গালি দিচ্ছে তার ছবি দেখা যাচ্ছ, যে গালি দিচ্ছে তার এক চিলতে ছবি অথবা বিমূর্ত কিছু দেখা যাচ্ছে কিন্তু তার বেশি কিছু না।অতঃপর গালিওয়ালা মাঝে মাঝে ফেসবুকে এসে গোপন বিহারে দেখে যাচ্ছে, রগড় কতটা জমেছে! কিন্তু নিজেকে দেখা দিচ্ছে না । দেখা না দিয়েই গাল দেওয়া যাচ্ছে। মিথ্যে বলা যাচ্ছে। বিপ্লবী বনা যাচ্ছে। নিজেকে উলঙ্গ করা যাচ্ছে। দেখা দেওয়ার বাধ্যতা নেই বরং লুকিয়ে থেকে অনেক অপকর্ম ঘটিয়ে দেওয়ার ইন্ধন দিচ্ছে বাজার। জনতারও যেন পোয়াবারো।”আছি অথচ নেই” -এর দোলায় সে দুলছে। দোলনের সে কী মজা রে ভাই!

দেখা যাচ্ছে না বলে আমার বাবা এটিএমের কার্ড করাতে চাইত না। বলতো যদি কিছু গোলমাল হয় আমি কি যন্ত্রের সঙ্গে কথা বলব?? মানুষ কই?? পরে সম্ভবত এটিএম এর গার্ড কাকুকে দেখে ভরসা সঞ্চয় করে কার্ড বানিয়ে ছিল। বাবার যুক্তি আমাকে বুঝিয়ে ছিলো সত্যিই তো, এই যে নোট বন্দির সিদ্ধান্ত নিল, তাকে তো চোখে দেখা গেল না! এইযে পেট্রোলের দাম বাড়লো,কে বাড়ালো তাকে দেখতে চাই, কিন্তু কোথায় সে?! সে কি একজন , অনেকজন, একটা প্রবণতা? একটা দুর্নীতি, একটা অনাদর্শ কেবল? মালুম হচ্ছে না। কেউ বলছে মোদি বাড়ালো, কেউ বলছেন মুখ্যমন্ত্রী কেন ট্যাক্স কমায় না? কেউ বলছে, বিশ্ববাজারে যুদ্ধ চলছে খেয়াল রাখো না! কেউ বলছে ভারতের অর্থনীতি এটা ছাড়া বাঁচবে না। কেউ বলছে ভারতের অর্থনীতি এই করেই ডুববে! সত্যি কেন তেলের দাম বাড়লো,কে বাড়ালো,মোট কথা তাদের দেখা যাচ্ছে না।এটা একালের সংস্কৃতি। আগের সব রাজার নামে হত। এখন রাজা-প্রজা গুলিয়েছে। এটা পার্টি করেছে, প্রশাসন করেনি। এটা ভিসি করছে রাজ্যপাল নিষ্পাপ। এটা লোভী লোকের কাজ, মুখ্যমন্ত্রী কী করবেন! এটা পার্টির সুপ্রমো চাইছেন কিন্তু প্রধানমন্ত্রী চাইছেন না। প্রধানমন্ত্রী চাইছেন শিল্পপতিরা চাইছেন না। কী গেরো। এক লোক, অজস্র উপাধি। এদিক দিয়ে উঁকি মারলে ওদিক দিয়ে পালায়। ধোঁয়া ধোঁয়া চারপাশ, চোখ জ্বলে; স্পষ্ট করে কিচ্ছুটি দেখবার যো নেই!!! কোভিড উত্তরকালে দেখতে পাই ফিজিশিয়ান ফিজিক ছাড়া চিকিৎসা করছেন!! কম্পিউটারের মাস্টার কম্পিউটার টু কম্পিউটারে ছাত্র কে দিগ্গজ করছেন। পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য আবিষ্কার করে প্র্যাকটিক্যালও অনলাইনে সারা গেল! আমার মেয়ের বিয়ের প্যান্ডেল কারা করল আমি সেই ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর মালিক কে দেখলাম না। এমনকি তাকে যে টাকা দিলাম গুনে গুনে, এ কথা বলা যাবে না। আমার টাকা আমি দেখলামই না কিন্তু দিলুম, সে নিল। দাতা- গ্রহীতা- টাকা কেউ কাউকে তেমন করে দেখা দিল না। পেটিএম টু জিপে টু ইউনো হয়ে সে উড়ে গেল। কিছুই দেখা গেল না। যদিওবা দেখা যায় তাহলে একটি অলৌকিক বিজ্ঞাপনের সঙ্গে এই দেওয়া-নেওয়ার নূন্যতম কোন পার্থক্য রইলো না। এই যে ভূতের মতন অনেক কিছু ঘটছে। তার ভয়ঙ্কর চাপও অনুভূত হচ্ছে, সেই অদেখা চাপের কারণে কষ্ট ত্রিগুণ হচ্ছে। অহৈতুকী ভক্তি এক কথা। অহৈতুকী অত্যাচার অসহনীয়। কি করে হচ্ছে, কেন হচ্ছে, কোথা থেকে হচ্ছে, কারা করাচ্ছে, বেশ পরিপাটি করে ঘেঁটে দেওয়া গেছে। কবির বানী চিরন্তন। তা-ই নতুন অর্থ পাচ্ছে। চোখ থাকতেও অন্ধ মোরা। বোধ থাকতেও বধির।

আমাদের শিশু কিশোর বেলায়,এমনকি যৌবনের প্রারম্ভে সবকিছু স্পষ্ট দেখা দিত। সেই নিয়ে আমাদের পরিতাপের অন্ত ছিল না। অংকে ফেল করলে চারপাড়া জেনেছে। স্কুল থেকে মার্কশিট নিয়ে ফেরার সময় কাকিমা জেঠিমা কাকা জ্যাঠা মাসি মেসো ছিনতাই করে সবটুকু দেখে নিতেন। কিছুই নাদেখা থাকত না। একমাত্র গোপন প্রেম কিছুদিন গোপনে রাখা যেত। আজকের মতো এসব কিছুতেই দেখাতে ইচ্ছে করত না।”Got engaged” এর চল ছিল না সেদিন। লজ্জা শরমে ডুবে ডুবে বেঁচেছি। তবু বড়দের থেকে কিছু আড়াল করতে পারিনি। আজ ক্ষমতাবান বাবা নিজের কন্যাকে দুনম্বরী করে চাকুরী দিয়ে, লজ্জাজনকভাবে বরখাস্ত হয়ে; এলাকায় ফিরে নিজেকে লুকিয়ে রাখেন না। প্রকাশ্যে দেখা দেন। গাঁদা ফুলের মালা ঝুলিয়ে বুক চিতিয়ে দুর্নীতি এগোয়!রাঙা ভোরের খোঁজে। কিন্তু একটা প্রয়োজনীয় জিনিস কিছুতেই দেখা যায় না তখন। খুব জরুরি একটা জিনিষ। তার নাম? – লজ্জা। এরপর আরো কিছু প্রকাশ্য ঘটনা ঘটে। সেই ক্ষমতাবানের, তার দলের পোষা বুদ্ধিজীবীর দল চুপ করে না থেকে, যুক্তি সাজায় এহেন ক্লেদাক্ত দুর্নীতির পক্ষে!! তখনো সব প্রকাশ্য হলেও একটা জিনিস কিছুতেই দেখা যায় না। তার নাম ও শরম। ওদের বিরুদ্ধে আমাদের ঘৃণাও কি খুব একটা দেখা যাচ্ছে?? যে ঘৃণার নাম – ছিঃ!!

যাপিত নাটোরের চতুর্থ কিস্তি লিখলেন - কুন্তল মুখোপাধ্যায়

কুন্তল মুখোপাধ্যায়

১৯৬২ সালে চীন-ভারতের যুদ্ধ হয়েছিল। ছোটো বেলায় শোনা ”হিন্দী –চিনি ভাই ভাই” এর ভাবনা অন্তহিত হয়েছিল রেডিও শুনে খুব মনখারাপ হ’ত। এই সময় রঙমহলে ‘সীমান্তের ডাক’ বলে একটা নাটক দেখেছিলাম, তাছাড়া সেই বছরেই বিশ্বরূপায় মন্মথ রায়ের কারাগার, আর রবীন্দ্রনাথের ক্ষুধিত পাষাণ দেখি। বাবার কাছে শুনেছিলাম সেই সময় মুক্তাঙ্গন রঙ্গালয়ে অনেক ভালো নাটক হত, কিন্তু দূরত্বের জন্য ওই বয়সে ওখানে আমার যাওয়া হয়নি। এই সময় বাবার বন্ধু বিশ্বনাথ সেনগুপ্ত, বিরাটি হাই স্কুলের ইংরেজির টিচার আমার বিশু জ্যেঠা আমায় সাহিত্য পড়ানোর ভার নেন। মফঃস্বল থেকে আসা শুধু ইংরেজি বর্ণমালা চেনা এক কিশোরকে ক্রমেই তিনি ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যের রসসাগরে অবগাহন করতে শেখালেন। বিশু জ্যেঠাই আমাকে চার্লস ল্যাম্বের টেইলস্ ফ্রম শেকসপীয়র, র্যাডিয়ান্ট রিডার পড়তে শেখালেন, বিভূতিভূষণের আম আটির ভেঁপু, রবীন্দ্রনাথের ছুটি, অতিথি, বলাই পড়ালেন, হাতে ধরালেন অবনী ঠাকুরের বুড়ো আংলা  রাজকাহিনী। আমার কল্পনার জগৎ, ভাবনার দিশা আরও বিস্তৃত হলো। সেই সময়ই কোনো এক ছুটির দিনে বিশু জ্যেঠা আমাকে রয়াল শেক্সপীয়র গ্রুপের, মিড্ সামার নাইটস্ ড্রীম নাটকটি দেখান, কোন মঞ্জে সেটা এখন মনে নেই, শুধু মুগ্ধতার কথাই মনে আছে। কত রাত যে পাক্ আর বটম্ কে স্বপ্নে দেখেছি, তা গুনে শেষ করা যাবে না। অনেক পরে এই তো সেদিন নোটো ভাই তরুণ প্রধানের নির্দেশনায় রবীন্দ্রভারতী নাট্য বিভাগের রের্পাটারি প্রযোজনা ফাগুন রাত্রের গল্প দেখেও সেই মুগ্ধতা ফিরে পেয়েছিলাম। শিয়ালদহ ছেড়ে আমরা দমদমে সেন্টার সিঁথি হাউজিং এস্টেটে এসে উঠি ১৯৬৪ সালের কোন এপ্রিলের বিকেলে। সেই দিনই সকালে ওই কোর্য়াটার্সে এসে উঠেছিলেন গানের জগতের পণ্ডিত পবিত্র দাসগুপ্তের পরিবার। পবিত্রবাবুর ছেলে স্বপুদা আমার থেকে বছর পাঁচেকের বড় হলেও, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল, স্বপুদার বোন মুনমুন, পরে নামকরা রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী স্বাগতালক্ষ্মী দাসগুপ্ত, চিরদিনই আমার ছোট বোনের মত। ৬৪ সালের ওই গভঃ হাউজিং এস্টেটে, দমদম অঞ্চলে প্রথম গর্ভমেন্ট কোর্য়াটার্স এবং এখন অবিশ্বাস্য মনে হলেও সেই সময়ে প্রায় শতাধিক পরিবার ছিল যেন একটা এক্সেটেন্ডেড ফ্যামিলি। একসঙ্গে দুর্গাপুজো, সরস্বতী পুজো, রবীন্দ্রজয়ন্তী, বার্ষিক দু-টো নাটক অভিনয় বাঁধা ছিল। ছোটদের মধ্যে আমি, বাবলি, মানা (ডঃ প্রশান্ত), সঞ্জয়, সন্দীপ, নান্টু, পলু, কল্যাণ, সুনীল, স্বপুদার নির্দেশনায়, বিনিপয়সার ভোজ, চারমূর্তি, চাঁদা বিভ্রাট অভিনয় করি এবং পিঠ চাপড়ানি পাই । এই সময় ছ’মাস দমদমের কুমার আশুতোষ ইনস্টিটিউট স্কুলে পড়ার পর আমি শিয়ালদহ আর রাজাবাজারের মাঝামাঝি টাকী হাউস গভঃস্পনসর্ড মাল্টিপারপাস স্কুলে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হই। সেই বছরই স্কুল আর তার শিক্ষককুল দেবতোষবাবু, যতীনবাবু, জয়ন্তবাবু, অশোকবাবু ও হেড স্যার কানাইলাল মুখার্জী আমার সামনে পড়াশোনা আর সংস্কৃতি চর্চার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছিলেন।

বিদ্যার সাগরেরা: নাট্য দর্শকের পত্র - সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

বিদ্যার সাগরেরা দেখতে গিয়ে সবার আগে নাটকটির গড়নের দিকে আমাদের খেয়াল পড়ে। বলার কথাকে আমাদের কাছে পৌঁছতে এখানে এক উপ-ঘটনার সাহায্য নিয়েছেন নাটককার। এই উপ-ঘটনার নির্বাচন আমাদের কাছে অভিনব মনে হয়েছে। রাঢ় বাংলায় বিদ্যাসাগরকে ঘিরে এক অনুষ্ঠানে বাংলার শিক্ষা- সাংবাদিকতা ও বড়পর্দার কলকাতাবাসী চার নামীজনকে আমন্ত্রণ – আচমকতার মোড়‌ ঘুরে যাওয়া – ঘটনাপ্রবাহে সিপিআই মাওবাদী প্রবেশ প্রসঙ্গ – তারপর আস্তে আস্তে ঘটনা আবর্তিত হওয়া।

 
প্রায় শুরুতেই গভীর নাটকীয়তা জড়িয়ে দেন নাটককার, যা আমাদের মনকে টানে। আবার মিশিয়ে দেন রূদ্ধশ্বাস গতি। মেশান উৎকণ্ঠা ও রহস্য! ভেতরে ভেতরে রহস্যের উপকরণ ছড়িয়ে রাখেন শেষ অব্দি। সংলাপে, সংলাপের আদলে শব্দ বা রসিকতার আবেদনে থাকে নতুনের আভাস। সব মিলে নাটকের অবয়বে বেশ যত্ন আমরা লক্ষ করি। তবে নাটকটি হয়তো আলাদা করে পড়ার সুযোগ হলে আরো একটু বিশদে বলা যেত। বিশদে বললে ভালো লাগতো।
 
আবার নাটকের বলার কথা আমাদের কাছে একেবারে অনিবার্য মনে হয়েছে। মনে হয়েছে এমন কথাই এখন ফিরে ফিরে আসুক। মনে হয়েছে সময়-সমাজ-রাজনীতি-ব্যক্তি আমাদের কথার কেন্দ্রে আসুক। মুক্তিপথ নিয়ে না হয় পক্ষ-বিপক্ষ টানলাম আমরা, না হয় নিলাম বাতিলের সিদ্ধান্ত। কিন্তু জিজ্ঞাসা জারি রাখা, তর্ক চালিয়ে যাওয়া জরুরী। নাটককার তা ধরেছেন এগিয়ে দিয়েছেন কিছুদূর। তিনি যে খুব থৈ পাচ্ছেন এমন মনে হয় নয়। তাঁর থৈ পাওয়ার কথাও নয়। তিনি খুঁজছেন, তোলপাড় করে খুঁজছেন। যদিও এই তর্ক জারি রাখার কথা নতুন নয়।
 
নাটককারের এই টানাপোড়েনের বড় প্রমাণ পরমেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিঠিটি। চিঠিটির ব্যবহারের প্রয়োগ বেশ অন্যরকম। সঙ্গে বলি, এই চিঠির বয়ানের শেষ লাইন – “এই ঘন্টা তিরিশের ভয়ঙ্কর মশকরা থেকে যদি কোনো ফুলকি বেরিয়ে থাকে, সেটি মশালের দিকে ছুঁড়ে দেবেন।” আবেদন এবং কাব্যময়তা আমাদের বার বার পড়িয়ে নেয়। লক্ষ করার মতো, এই জিজ্ঞাসা দীর্ণ রাজনৈতিক কর্মী, যে আত্মহননের পথ বেছে নেয়, তাঁর নাম রাখা হয় পরমেশ্বর।
 
আবার এও লক্ষ করার, চিঠি শেষ হচ্ছে বিপ্লবের দীর্ঘায়ু কামনায়। লক্ষ করি, তার নাটকের ভিতর আলতো করে ছুঁয়ে যাওয়া বাংলার চলতি রাজনীতি ঘিরে শ্লেষও।
 
দলগত অভিনয়-সংহতি আমাদের টেনেছে। টাইমিং, ছন্দ, লয় এইসব যেন ঠিকঠাক এলো। সকলেই বিষয়ের গভীরে চলে গিয়েছেন ভেতর থেকে যেন খুঁড়ে আনছেন অভিব্যক্তির নানা মণিমুক্তো। এনেছেনও তাই। হয়তো একটু বেশি এনেছেন সাগর ও সত্য এবং বিপ্লবী মহিলা কর্মী চরিত্র। আর তাই মহিলা কর্মী ওইরকম প্যাসিভ-অ্যাক্টিভ এক্সপ্রেশন আমরা ভালো করে নজর করেছিলাম। অভিনয়ের এমন ধাঁচে যদি যত্ন যোগ হয় তবে কোথায় না যেতে পারে।
 
মঞ্চে কয়েকটা ব্লকিং ছবির মত মনে থাকল। দৃশ্যের কয়েকটি চেয়ার রয়েছে তাতে আধুনিক আসবাবের ছোঁয়া নিশ্চয়ই নির্দিষ্ট ভাবনা থেকেই। বাঁদিকে বেশ উঁচুতে একটা জানালার মত… স্কাইলাইট ভাবতে পারি। এটা ঘর বোঝাতে যেমন, তেমনই মুক্তচিন্তা অবাধ আসা-যাওয়া বলেও মনে হয় ভাবতে পারি। যা এক অন্য ব্যঞ্জনা তৈরি করে। আলো, আলো-আঁধারি ও আবহ ভয় সংস্কার উদ্বিগ্নতা আত্ম সমীকরণ মুহূর্তেও ভালো সায় দিয়েছে। আলোতে কি দু-একটা রং মিশিছে? খেয়াল করিনি। আর আবহর কম্পোজিশন সংখ্যাটি একটু কমবে?
 
আর নাটকের সংলাপ কি আর সামান্য সংহত হতে হবে? জানিনা নাটককারই বলতে পারবেন। পরিচয় লিপিতে ‘তাহলে এসবের মানে কী’ বা ‘ঘন্টা’, ‘অনির্বাণ’ এই কয়েকটা বানান যদি দেখে নেওয়া যায়, যোগ করা যায় চরিত্র নাম। পরিচয় লিপিতে চিঠির হরফ নির্বাচন বেশ, তবে নাটকের নামের ওই বাঁকের হরফ কেন রাখা হয়েছে তা মনে হয় যাঁরা বানিয়েছেন তাঁরাই বলতে পারবেন। টিকিট রঙে-আকারে-বিন্যাসে একেবারে চোখে আরাম। যে কথা বলতেই হয়, সময়ের গভীর থেকে বিদ্যার সাগরেরা তুলে আনে, তোলপাড় জিজ্ঞাসা আর সেখানেই ভাণ তথা ভাণের বন্ধুদের এক অনন্য কৃতিত্ব

পায়েল কাপাডিয়ার সিনেমার ন্যারেশান নিয়ে কথা বুনলেন - সুদীপ্ত নাগ

সুদীপ্ত নাগ

পায়েল কাপাডিয়ার ন্যারেশানে আমাদের মনে জমে থাকা কথাগুলি – ‘আ নাইট অব নোয়িং নাথিং’ আগের বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলেও আমাদের দেশে তাই নিয়ে কোন হইহই নেই । আর হবেই বা কেন? যেসব বিষয়কে কেন্দ্র করে এই সিনেমা বানানো হয়েছে তা আমাদের দেশের কিছু গেরুয়াধারীদের গায়ে লাগাটাই স্বাভাবিক । ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম মেকিংয়ে কিছু কাজ দেখলে আমরা আশা-ভরসা পাই । আর খুব কমই আমাদের দেশে এরকম কিছু কাজ হয় যা দেখে শ্রদ্ধা বা সম্ভ্রম জাগে । পায়েল কাপাডিয়ার ‘আ নাইট অব নোয়িং নাথিং’ সেরকমই মানের ছবি আমার মতে । আমাদের যৌবন আমাদের বাঁচতে চাওয়ার আকঙ্খাকে উজ্জীবিত করে তোলে । যৌবন এমন একটা সময় যখন প্র্যাকটিকাল জীবনের পাশাপাশি আবেগ এবং উন্মাদনা আমাদের বয়ে নিয়ে চলে এক অদ্ভুত জগতের মধ্যে । কলেজ বা ইউনিভার্সিটির জীবন এমনই যা স্টুডেন্টদেরকে মুক্তভাবে বাঁচতে শেখায় । জীবনের বাস্তব ডিসিশান গুলি নেবার আগে তারা আদর্শকে আর দর্শনকে সামনে রেখে নির্ভয়ে এগিয়ে যেতে চায় । পায়েল কাপাডিয়ার সিনেমা কোন কাল্পনিক বা তার থেকে দূরের কোন গল্প নয়। নিজের জীবনের একটি অংশ এবং পারিপার্শ্বিক দিক থেকেই উঠে এসেছে ।

এফ টি আই আই তে চেয়ারম্যান গজেন্দ্র চৌহানের পদত্যাগের দাবী থেকে , রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যা , জে এন ইউ এর আজাদির নাড়া , জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে পুলিশি হামলা, এই সব কিছু নিয়ে একটি এমন রাতের মধ্যে আটকা পড়ে গেছে আজকের যৌবন যা তাদের কণ্ঠরোধ করে রেখেছে । কিন্তু শুনতে যতটা হোপলেস লাগছে হয়ত আদতে ততটাও নয় । দুজন কাল্পনিক লাভারের চিঠির মাধ্যমে পায়েল তার সিনেমার বক্তব্যগুলিকে তুলে ধরেছেন । এদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমরা এই ঘোরতর অন্ধকার দেখতে পাচ্ছি । কিন্তু এরা সেই যৌবনে আছে , তাই হতাশার মধ্যেও এদের মনে বল আছে ।

এদের মনে এক অলীক আশা আছে পরের দিন সকালটাকে দেখার । সিনেমার শুরুতে আমরা এক দল যুবক-যুবতীদের নাচতে দেখি । কোন প্রথাগত নাচ নয় । নির্মল আনন্দে হাত-পা ছোঁড়ার যে বাঁধনহীন আনন্দ , তার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে এই নাচের মাধ্যমে । সিনেমার শেষে আবার একটি নাচের দৃশ্য আছে যেটা কিছুটা মেলাঙ্খলিক বলা যায় । কিন্তু এই ক্লান্তি আর বিভ্রান্তির মধ্যেও তারা ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশনটা ভোলেনি । পায়েল তার ছবিতে মোবাইল ক্যামেরার ফুটেজ থেকে , আরকাইভাল ১৬ এম এম ফুটেজ , সি সি টিভি ফুটেজ ব্যবহার করেছেন । এর মধ্যে ১৬ এম এম ফুটেজটি আসলে সেলুলয়েড নয় কিন্তু সেরকম একটি ফিল রাখার চেষ্টা করেছেন পরিচালক । পরিচালকের মতে এই সেলুলয়েড যে হারিয়ে গিয়ে সব কিছু ডিজিটালাইজেশন হয়ে যাচ্ছে এটিও এই মুহুর্তে সিনেমাপ্রেমীদের কাছে একটা অদ্ভুত কষ্টের ব্যাপার । হাতে ছুঁয়ে ফিল করে একটি ছবি নির্মান করার একটা আলাদা উৎকর্ষ আছে এবং যারা সেলুলয়েড নিয়ে কাজ করেছে বা এই মিডিয়ামটিকে ভালবেসেছে তাদের কাছেই এই কথাগুলো আমরা শুনি । যেমন কিছু বছর আগে লিওস কারাক্সও একটি ইন্টারভিউয়ে এইরকম কিছু কথা বলে ছিলেন । এই তথ্যচিত্রে সিনেমার প্রতি ভালবাসাটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । আজ প্রতিটি মানুষের কাছে তাদের ইস্যুগুলি গুরুত্বপূর্ণ । যেমন এফ টি আই আইয়ের অধঃপতনে সিনেমার ছাত্র-ছাত্রীরা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়েছেন , ঠিক একই ভাবে একটি দলিত ছেলের ইন্সটিটিউশনের শিকার হওয়ার প্রতিবাদে আত্মহত্যা অন্যান্য দলিতদের মনে আগুন জ্বালিয়েছে । কিন্তু এইটা আরও ভাল ভাবে একজন ফিল্ম স্টুডেন্ট অন্তর থেকে ফিল করতে পারছে যখন সে নিচু জাত বলে তার বয়ফ্রেণ্ডের ফ্যামিলি তাকে মেনে নিচ্ছেনা । এই ঘটনাটা না ঘটলে কিম্বা পলিটিক্যাল ভাবে গজেন্দ্র চৌহানকে চেয়ারম্যান না বানানো হলে হয়ত ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের শিল্প এবং শিল্প তৈরির এত ভাল জায়গাটা নিয়েই মশগুল থাকতো । যে সোভিয়েত এবং চেক সিনেমা ছবির পর্দায় মুগ্ধ করেছে , ল্যাটিন আমেরিকার পলিটিক্যাল সিনেমা , ফ্রেঞ্চ সিনেমার প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়ার প্রবণতা , জাপানিজ নিউ ওয়েভের হিস্ট্রি এবং কালচারাল ডিগ্রেডেশান নিয়ে ক্ষোভ এবং এক্সপিরিমেন্টেশন , সব কিছু যেন স্ক্রিন থেকে বেরিয়ে এসে পায়েলের ক্রাফটের মধ্যে ভর করেছে ।

পায়েলের সিনেমায় ন্যারেশান জিনিসটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ন রোল প্লে করেছে। এরকম চিঠির মাধ্যমে প্রেমিক-প্রেমিকার ন্যারেশান পার্সোনাল, পলিটিক্যাল সব এক করে দিয়েছে । এদের ভিন্ন ভাষার মাধ্যমে দেশের ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটিটাও চমৎকার ভাবে এসেছে । মেয়েটির গলার স্বরে ইম্প্যাথি এবং বেদনা যেন ঋত্বিক ঘটকের সিনেমার সহনভূতিশীল এবং উদার নারীদেরকে মনে করায় । এই ধরনের ন্যারেশান স্টাইল মিগুয়েল গোমেজ , ক্রিস মার্কার বা চান্তাল একেরম্যানদেরকে মনে পড়ায় । ভয়েস ওভারটি একদিকে যেমন সাবজেক্টিভ , অন্যদিকে তেমনি পোয়েটিক । পরিচালক জানেন যে আইজেন্সটাইনই হোক বা গ্রিফিথ , সব ছবিই কোন না কোন ভাবে পলিটিক্যাল । কিন্তু একজন নির্মাতা কতটা পলিটিক্যাল বা জাজমেন্টাল হবেন সেটা তার নিজস্ব চয়েজ । যেহেতু ছবিটি ইউথদের মনসতত্ত্ব নিয়ে, তাই এই ছবিটি অনেক পরিষ্কার ভাবে ভারতীয় জনতা পার্টি বা আর এস এসের নীতিগুলির সমাজের ওপর প্রভাব নিয়ে একটি ধারণা দিচ্ছে ।

কিন্তু একই সঙ্গে এই ছবি শেষের দিকে উত্তেজনা , হতাশা , ক্ষোভ এইসব থেকে কিছুটা সরে এসে ফিলজফিকাল কথা বলছে । রাস্তায় মিছিলে দাঁড়িয়ে ফিল্ম মেকার মেয়েটি পুলিশকে দেখে পাসোলিনির কথা ভাবছে । পুলিশ যদি প্রলেতরিয়েত হয় তবে তাদের মত শিক্ষিত এবং প্রতিবাদী লোকেরা আসলে এলিট । আর এই ডামাডোলে পুলিশ দুই পক্ষের মাঝখানে ফেঁসে গেছে । যে নির্মম ভাবে লাঠি চার্জ করছে তারও বাড়িতে হয়ত একটা ছোট বাচ্চা আছে , পরিবার আছে । সিনেমার শেষে একজন স্পিচ দিচ্ছেন তার বন্ধুদেরকে যে এই সময়টাই খারাপ। শুধু কয়েকটা মানুষ আর পার্টিকে দোষ দিয়ে খুব লাভ নেই । অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করতেই হবে কিন্তু ইতিহাস বলছে অন্যায় কোন না কোনভাবে চিরকালই ছিল । সেটার অবসান হবেনা হয়তো কিছুটা কমতে পারে । ইতিহাস সম্বন্ধে বলতে গিয়ে সুন্দর ভাবে একটা কথা উঠে এসেছে । আমরা ইতিহাস খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যাই । যারা এই সুযোগটা নিয়ে হাতে ছড়ি ঘোরাচ্ছে সেটাকেই ইতিহাস ধরে নেওয়া হচ্ছে । সেই কারণেই পায়েল কাপাডিয়া এই ফিল্মে হিস্ট্রিকে রিরাইট করেছেন । ফ্রেমে নিজের ইচ্ছে মত আঁচড় কেটেছেন , পেপার কাটিংস ব্যবহার করে অতীত থেকে বর্তমান অবধি ডিগ্রেডেশনের ধাপগুলি দেখিয়েছেন । ফুটেজকে ফাউন্ড ফুটেজ হিসাবে ব্যবহার করে তার ওপর ইচ্ছেমত কালারটোন , ন্যারেশান বসিয়ে নিজের আঙ্গিক থেকে একটি ইতিহাস রচনা করেছেন বর্তামান সময়ের; যা কোন ক্রনলজিক্যাল হিস্ট্রি নয়। বরং আমাদের মনের মধ্যে ছাপ ফেলা , আমাদের জীবনের টুকরো হিসাবে ছড়িয়ে থাকা এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ইতিহাস । ছবিতে নস্টালজিয়া বারবার উঠে এসেছে । ভালবাসার স্মৃতিগুলি এবং এফ টি আই আইতে স্বপ্নের দিন গুলি চিঠির দ্বারা রোমন্থনের মাধ্যমে । এই নস্টালজিয়াটা ঠিক পুরোন স্মৃতি গুলি ভাল ছিল বলে তা রোমন্থন নয় , যেন নস্টালজিয়া প্রসেসটির মধ্যেই এরকম একটা ভাল লাগার ব্যাপার আছে । শুধু পাস্ট নয় প্রেজেন্ট নিয়েই যেন একটি কাব্যিক নস্টালজিয়া গড়ে তুলেছেন পরিচালক । দিনের শেষে আমারা নিজেদের ভুল বোঝাতে চাই , অনেক কিছু মেনে নিতে বা বিশ্বাস করতে বড় কষ্ট হয় । L আর K ( পার্টনারদের নাম ফিল্মে )ভেতরে ভেতরে বিচ্ছেদকে মেনে নিয়েছে কিন্তু ফিল্ম স্ক্রিনিংয়ের অস্বচ্ছ আলোয় তারা যখন কিস করেছিল , সেই মুহুর্তের কথা ভাবলে L তার প্রেমিক সম্বন্ধে যে কথা গুলো ভুলতে চায় তা হয়ত সেই অনেক আগের থেকেই ভেতরে ভেতরে সত্য ছিল । ঠিক একই ভাবে গজেন্দ্র চৌহান আসার কিছুটা আগেই হয়ত এই বিখ্যাত ইন্সটিটিউটটির ভেতরে রাজনৈতিক মরচে ধরা শুরু হয়েছিল যার খুব পরিষ্কার ভাবে আঁচ পাওয়া যায়নি । মানুষের পতন , দেশের পতন , সিনেমার পতন, সব কিছু নিয়ে এই সিনেমার ব্যাপ্তি । কিন্তু বিভিন্ন সম্মানীয় আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেলেও এই অন্ধকারের ছত্রছায়ায় এই ছবির স্থান হয়না । তাই আমার লেখাটিও সিনেমার শেষ নাচটার মত । জানিনা লেখাটা কতজনের কাছে পৌঁছাবে বা কারা সিনেমাটা নিয়ে শুনে কী ভাববে । হতে পারে পরিচালকের ছবিটি পার্সোনাল এবং একটি মতাদর্শের মানুষকে হার্ট করতে পারে । কিন্তু যেগুলো পরিচালক বলতে চেয়েছেন তা কতটা সত্যি তা একবার ভেবে দেখতে অনুরোধ করলাম । কারণ ছবিটি পলিটিক্যাল হলেও ছবির বক্তব্যের পেছেনে রাগের চেয়ে বেশি সমবেদনা এবং উদাসীনতা ছড়িয়ে আছে ।

আদিবাসী মানভূমের জীয়ন্তদেবতাকে স্মরণ করলেন - সঞ্চিতা দত্ত

সঞ্চিতা দত্ত

‘যাতরা বুড়হি’ থান, আদিবাসী মানভূমের জীয়ন্তদেবতা – সঞ্চিতা দত্ত

আদিবাসী লোকদেবতায় অপদেবতার প্রভাব মারাত্মকভাবে চোখে পড়ে। ভূত-প্রেত, যোগিনী আদিবাসী জীবনযাত্রার অঙ্গ হয়ে উঠেছে। এখনও মানভূমে বড়পাহাড় পুজো, কুপ্রভাবের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় বার করে তারা। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে প্রকৃতিপুজো আদিবাসী লোকসংস্কৃতির প্রধান অঙ্গ। জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ সর্বত্রই তাদের অরণ্য-প্রকৃতি ও কৃষিকাজকে ঘিরে আবর্তিত। মজার ব্যাপার হল তাদের প্রতিটি জীবিকার সঙ্গে কোনও-না কোনও দেবতার নাম জড়িত। আর প্রতিটি উৎসবেই আছে নাচ-গান আমোদ-উল্লাস। মেয়েদের ব্রত পালন, উপবাস যেন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। প্রতি মাসেই কোনও-না কোনও পুজো হয় আদিবাসী সমাজে। তেমনই এক লোকদেবতা হল ‘যাতরা বুড়হি’।

‘যাতরা বুড়হি’ নিছকই এক লৌকিক দেবতা। অদ্ভুত নিয়ম ও আচার-অনুষ্ঠানের আঙ্গিকে গড়া এই উৎসবের রীতিনীতি। পয়লা মাঘ প্রতিবছর এই পুজোর দিন নির্ধারন করে গ্রামবাসী। ওই দিনটিতেই শুরু হয় তাদের নতুন কৃষিবর্ষ। ‘গলাগোঁসাই’ নির্বাচনের পাশাপাশি তারা নিজেদের মনিব অর্থাৎ ‘গলা’ নির্বাচন করে। লোকমুখে শোনা তথ্যে, দুটো বা তিনটে খাঁজকাটা একটা সরু কাঠের খুঁটিই হল ‘যাতরা বুড়হি’ মূর্তি। একে আবার বলে ‘যাতরা খুঁটি’। যে পুজো করে তাকে ‘লায়া’ বলে; কিন্তু সে কোনও পুরোহিত বা ব্রাহ্মণ নয়। ও সব ব্রাহ্মণের বালাই এই সমাজে নেই। সমাজের নিম্নশ্রেণির পিছিয়ে পড়া মানুষেই হল এই পূজার মূল উদ্যোক্তা। সকালে সমস্ত কিছু গুছিয়ে মূর্তি স্থাপন করার পর বিকেলে তাদের কাজ ঢাকের শোভাযাত্রা নিয়ে বের হওয়া। সঙ্গে থাকে কিছু সামান্যই উপকরণ—ফুলের মালা, ঘি, গুড়, আতপচাল, সিঁদুর, বেলপাতা—তবে প্রধান উপকরণ হিসেবে অবশ্যই থাকবে মুরগির ছোট বাচ্চা। অদ্ভুত কৌশলে এই বাচ্চাটাকে তারা সংগ্রহ করে। শোভাযাত্রায় বেরিয়ে পথে যে মুরগির বাচ্চা পাবে সেটিকেই কুড়িয়ে নেবে ‘লায়া’। সবচেয়ে মজার বিষয় এই পুজোয় না আছে মন্ত্র-তন্ত্র, না কোনও উপবাস। কেবল ভক্তি আর বিশ্বাসই প্রধান উপকরণ। সাঁওতাল বা শবরদের পুজো বলি-প্রধান হলেও এতে কোনও বলির নিয়ম নেই। খুঁটি পোতা নিয়ম কানুনের পর বেশ মজার ছলে ঘি, গুড়, আতপচাল মেশানো প্রসাদ রীতিমতো জোর করেই মুরগির বাচ্চাকে খাওয়ানো হয়। তাদের বিশ্বাস এর ফলেই শুধু সেই গ্রামে নয় আশেপাশের গ্রামগুলোরও মঙ্গল হবে। বাচ্চাটিকে সিঁদুর মাখিয়ে আকাশের দিকে উড়িয়ে দেওয়া হয়। এই অনুষ্ঠানটিকে বলে ‘যাতরা উড়া’। ‘যাতরা টাইড়ে’ প্রচুর লোক দেখতে আসে। উড়ন্ত মুরগিটি যে ধরতে পারবে সেই মুহূর্ত থেকে তার হয়ে যাবে। ‘লায়া’ দর্শকদের বোকা বানানোর জন্য মুরগির বাচ্চাটি লুকিয়ে রেখে অন্য কিছু আকাশে ছুড়ে দেয়, মানুষ বিভ্রান্ত হলে হঠাৎ করে প্রসাদ খাওয়ানো মুরগির বাচ্চাটি বের করে ও উড়িয়ে দেয় আকাশে। গ্রামবাসীরা লুফে নেয়। আশীর্বাদী এই মুরগিটিকে তারা অনেক যত্ন করে। মেয়ে মুরগি হলে দেখা যায় তার বাচ্চাগুলি হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে। এরা সহজে মারা যায় না এটাই গ্রামবাসীর বিশ্বাস। আর ছেলে মোরগ হলে লড়াইতে তাকে হারানোর ক্ষমতা আর কোনও মুরগির হয় না। বাঙালি সরস্বতী পুজোর মতো তাদের এই উৎসবটি ছোট ছেলেমেয়েরা তাদের শিল্পচর্চা বা লেখাপড়ার সূচনা দিন হিসেবে বেছে নেয়। তাদের বিশ্বাস ওইদিন সূচনা করলে ‘যাতরা বুড়হি’ পথ সুন্দর করে দেবে। এই উৎসবে আবার মুরগি ছাড়াও কেউ কেউ পাঁঠা বা ছাগল উৎসর্গ করে; পরে গ্রাম ভেদে যারা এটিকে পায় তারা প্রসাদ হিসেবে রান্না মাংস গ্রহণ করে। প্রতিবছর বহু কষ্টের মধ্যেও জীয়ন্ত দেবতারূপে এই ‘যাতরা বুড়হি’ পুজো করা হয়। শবর, সাঁওতাল সমাজেই মূলত এই পুজো প্রচলিত।
আদিবাসীদের বিভিন্ন ‘টোটেম’ বা ‘কুলপ্রতীক’-এ যে গাছ, পশুপ্রাণী আছে সেই গাছকে কাটা বা পশুপ্রাণীকে হত্যা করা তাদের সমাজে নিষিদ্ধ। এই ‘নিষেধ’ বা ‘ট্যাবো মধ্যে কোথাও একটা পরিবেশের ভারসাম্যের ইঙ্গিত লুকিয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে লৌকিক দেবদেবীর ‘থান’ যেন এক প্রকার মিলন স্থল।

পঞ্চায়েত -২ কে আত্মস্থ করে বর্ণন করলেন- সৈকত নন্দী

সৈকত নন্দী

সারল্যের হাত ধরেই সাফল্য , পঞ্চায়েত -২ এর মুগ্ধ বর্ণনায় সৈকত নন্দী

ধরুন আপনি আপনার ব্যস্ততম জীবনে কিছুটা ব্রেক নিয়ে বেরিয়ে পড়তে চান, হাওয়া বদলের উদ্দেশ্যে কিন্তু হাতে ছুটি নেই। দীঘা গিয়ে যে ঘুরে আসবেন সেইটুকু অবসরও পাচ্ছেন না। অগত্যা কি করা যায়? চিন্তা নেই চলুন “ফুলেরা ” ঘুরে আসি। উত্তরপ্রদেশের এক অখ্যাত, অনামী গ্রাম। সেখানে প্রধানজী আছেন, তার স্ত্রী রয়েছেন। রয়েছে রিঙ্কিয়া, সচিবজী অভিষেক, সহ-সচিব বিকাশ, উপ-প্রধান প্রহ্লাদ। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন আমি “পঞ্চায়েত ” ওয়েব সিরিজের ওই মানুষগুলোর কথাই বলছি। চা, বিস্কুট নিয়ে বসে পড়ুন, কারণ শুরু হচ্ছে, “পঞ্চায়েত -২” এর রিভিউ ।

আজ থেকে দুই বছর আগে যখন সারা পৃথিবী করোনা মহামারীর করাল গ্রাসে সন্ত্রস্ত, মানুষকে ক্ষণিক স্বস্তি দিয়েছিলো TVF এর “পঞ্চায়েত “। গল্প বলার সরলতা, নিখুঁত অভিনয়, সর্বপরি লক-ডাউনে ঘরে বসে অতিষ্ঠ হওয়া মানুষ গোগ্রাসে গিলেছিলো এই সিরিজের প্রথম ভাগ, ঘরে বসেই সারা ভারতবর্ষ “ফুলেরা ” গ্রামে পৌঁছে গেছিলো ফ্রেশ অক্সিজেন নিতে। বাইরে বেরোলে মাস্ক পরিহিত মানুষ দেখতে দেখতে সবার মতন আমিও ভাবতাম, আর কি মাস্ক ছাড়া জীবন কাটবেনা? তখন আশীর্বাদ স্বরূপ “পঞ্চায়েত” সিরিজের ওই সরল গ্রাম্য মুখ গুলো সত্যিই আরেকবার ভালো করে হাসতে-হাসতে বাঁচতে শিখিয়েছিলো। আশার পারদ অনেকটাই চড়েছিল, কারণ প্রথম ভাগ শেষ হয় প্রধানের মেয়ে রিঙ্কিয়ার সাথে সচিব অভিষেকের হঠাৎ সাক্ষাতে।
 
আমরা মনে-মনে আশার সুতো বুনেছিলাম, “ও হমমম! এই ব্যাপার” এই ভেবে। ওদের মধ্যে প্রেমটা নিশ্চিত ধরেই বুক ভরে অক্সিজেন নিয়ে “ফুলেরা” ছেড়েছিলাম । দ্বিতীয় ভাগ যেন ঠিক ঐখান থেকেই শুরু। সারা সিরিজ জুড়ে হালকা চোখের চাহনির আদান-প্রদান, স্মিত হাসি, ফোন নম্বর নিয়ে আলাদা করে কাউকে না জানিয়ে ফোন করা, “সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে” টেক্সট ম্যাসেজ করা। এই টুকটাক ঘটনা সবাইকেই তার প্রথম প্রেমের কথা মনে করিয়ে দেবেই। এই ভাগে নতুন সংযোজন “বাকরাকাস” যা “বক রাক্ষস” এর অপভ্ৰংশ, বিনোদ, ক্রান্তি দেবী, সিদ্ধার্থ, MLA চন্দ্র কিশোর সিং আর এই মুহূর্তে বহুল আলোচিত রিঙ্কিয়া ।
প্রশ্ন জাগতেই পারে, কেন এই সিরিজ এত জনপ্রিয়? যেখানে নামিদামি মুখ বলতে রঘুবীর যাদব, নীনা গুপ্তা, জিতেন্দ্র কুমার। বাকিরা নামে অনামী কিন্তু অভিনয়ের ক্ষেত্রে এক চুল জায়গা কাউকে ছেড়ে দেননি। সে বিনোদ হোক, কি MLA চন্দ্র কিশোর সিং।
 
দীর্ঘকায়, ফর্সা, বড়লোকের ছেলে মেয়ের পাবে গিয়ে নাচ, প্রেম কাহিনী, অহেতুক যৌন সুড়সুড়ি মার্কা দৃশ্য এইসবের আড়ালে স্টারকিডদের রোজগার করিয়ে দেওয়ার বস্তাপচা কনসেপ্ট থেকে দর্শক বহুত আগেই মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। জনতা, জনার্দন এখন অনেক সাবলীল ও সাবালক।
 
তারা নিজেদের জীবনের গল্প দেখতে চায়, নিত্য-নৈমিত্তিক ছোট-খাটো অসুবিধা গুলিকে সবার সাথে ভাগ করে নিতে চায়। তাই ছাদে লাউ হলে কূটনৈতিক ভাবে কাজ সারার কাজে হোক কি, ঘরে-ঘরে শৌচালয় নির্মাণের উপযোগিতা, একজন সরকারী সচিবের ২০ হাজার টাকার চাকরি করে MBA-এর প্রিপারেশন হোক, কি ক্রমেই প্রিয় হয়ে ওঠা মানুষটির জন্মদিনে কেক নিয়ে এসে উদযাপন, কিংবা ১.৫ কোটি টাকার চাকুরের গ্রামের নানান খুটিঁনাটিতে জীবনের আস্বাদ নেওয়া। পঞ্চায়েত-২ সারা ভারতের গড়পড়তা সব জীবনকাহিনীর জীবন্ত দর্পন হয়ে উঠেছে।
 
এইখানেই এই সিরিজের সাফল্য। সাধারণ মানুষের সার্বিক তৃপ্তিতে পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের সবকটির সমান ভাবে সহযোগিতা থাকতেই হয়।
 
ভালো স্বাদের গল্প, দৃষ্টি-নন্দন ক্যামেরার কাজ, ভার্চুয়ালি প্রাণ ভরে অক্সিজেন নেওয়া, সাথে-সাথে শ্রুতিমধুর আবহ ও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আপনাকে মাতিয়ে রাখবেই।
রিঙ্কিয়া আর অভিষেকের সমীকরণটা জমতে-জমতে জমেনি । তবে দুইজনের মনেই অনুরাগের ছোঁয়া লেগেছে এই পর্বে। পরের পর্বে “মধুপেন সমাপয়েৎ” নিশ্চয়ই দেখতে পাবো, এই আশা আলবাত করা যায়।
 
অভিনয় নিয়ে কি বা বলার আছে। এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায় দেখ। ডায়ালগ ডেলিভারি থেকে, ছোট-ছোট পাঞ্চগুলো রসিকতার আতরে চোবানো, যা প্রতি মুহূর্তকেই করেছে সুবাসিত। মুখ্য চরিত্রে থাকা জিতেন্দ্র কুমার দিনে-দিনে ভারতীয় সিনেমার সম্পদ হয়ে উঠছেন। নীনা গুপ্তা ও রঘুবীর যাদবকে নিয়ে তো আলাদা করে কিছুই বলার নেই। এনাদের দেখে মনেই হয়নি এনারা অভিনয় করছেন। চন্দন রায় হোক কি ফাইজাল মালিক, গ্রাম্য সরলতার ভাঁজে এমন দুঁদে অভিনয় করেছেন যা গল্পের টানটান চিত্রনাট্যকে পড়তে দেয়নি কখনোই। অল্প কিছুক্ষণের জন্য আসা বিনোদ (অশোক পাঠক) হোক কি, MLA চন্দ্র কিশোর সিং (পঙ্কজ ঝা)নিজের পাওয়া সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন। আরেক জনের নাম না বললেই নয়, সে এই গল্পের খলনায়ক।
 
“বক রাক্ষস” বা “বাকরাকাস” ভূষণ (দুর্গেশ কুমার)। যার সাবলীল অভিনয় আপনার জীবনেরও খলনায়কের মুখটিকে কিন্তু অবলীলায় মনে করিয়ে দেবেই।
১৮ মে আমাজন প্রাইমে মুক্তি পেয়ে গিয়েছে এই সিরিজের দ্বিতীয় ভাগ। আপনার চা শেষ হয়ে গিয়েছে মনে হয় ইতিমধ্যে। তাই সময় নষ্ট না করে মুড়ি, চিপস বা পপকর্ন নিয়ে বসে চটপট দেখে ফেলুন আপনার প্রিয়জনের সাথে। একটি শেষ সতর্কীকরণ, এই সিরিজের দ্বিতীয় ভাগ একটু বেশি পরিণত, তাই হাসির সাথে সাথে শেষে কিছু দুঃখের দৃশ্য মনকে সিক্ত করবেই। “ফুলেরা ” হাসাতে জানে, নতুন ভাবে বাঁচতে শেখায় ,সেই “ফুলেরা”ই আপনাকে কাঁদাবেও। আর স্পয়েলার্স দিচ্ছিনা। যান, যান তো দেখে ফেলুন চটপট ।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published.