ভাণ পত্রিকা
২৬তম সংখ্যা || ১৯তম ই-সংস্করণ || জুন ২০২২
সম্পাদক :
সম্পাদনা সহযোগী :
প্রচ্ছদ :
নক্সা পরিকল্পক :
অন্যান্য কাজে :
ভাণ-এর পক্ষে:
পার্থ হালদার
কর্তৃক
৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬
( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )
৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) bhaan.kolkata@gmail.com ( ই – মেল )
Reg. No : S/2L/28241
সূচি
সম্পাদকের কথা
কথাটা হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে না। অনেকে অনেক কিছু করছে, কি করছে যদিও বা শেষতক মালুম হচ্ছে; কিন্তু কিভাবে করছে মোটেও দেখা যাচ্ছে না। না দেখা দিয়ে কিছু একটা ঘটিয়ে তোলা এই সময়ের সংস্কৃতি। ক্রমশ বুঝেছি ফলাফলই হচ্ছে অমোঘ। রাজা বনবার পথ অদেখা থাকুক। রাজা হলে মুকুট সহ ছবি দেখা দিক। এই হল দেখা-নাদেখার রাজনীতি। পথ নিয়ে একাল তেমন ভাবে না। সেই পথই সবচেয়ে দামি, যে পথে সফলতা আসে। নৈতিকতা ইত্যাদি দেখা যায় না। দেখা গেলে জ্ঞানতত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। ব্যাখ্যা দিলে নিজেকে জেতানো যাক বা না যাক, ঘেঁটে দেওয়া যায়। আর ঘেঁটে দিলে পথ ও যা, পুকুর ও তা। ধরুন মেডিকেল সাইন্সের একজন বিজ্ঞ মানুষ, পাকা চার দশক ধরে গবেষণা প্র্যাকটিশ,- দুই চালাচ্ছেন,- তাকে ও পাড়ার পটলা এসে ,”তুই কি জানিস রে শালা,তুই তো অমুকের দালাল!” লিখে পালিয়ে যেতে পারছে। যাকে গালি দিচ্ছে তার ছবি দেখা যাচ্ছ, যে গালি দিচ্ছে তার এক চিলতে ছবি অথবা বিমূর্ত কিছু দেখা যাচ্ছে কিন্তু তার বেশি কিছু না।অতঃপর গালিওয়ালা মাঝে মাঝে ফেসবুকে এসে গোপন বিহারে দেখে যাচ্ছে, রগড় কতটা জমেছে! কিন্তু নিজেকে দেখা দিচ্ছে না । দেখা না দিয়েই গাল দেওয়া যাচ্ছে। মিথ্যে বলা যাচ্ছে। বিপ্লবী বনা যাচ্ছে। নিজেকে উলঙ্গ করা যাচ্ছে। দেখা দেওয়ার বাধ্যতা নেই বরং লুকিয়ে থেকে অনেক অপকর্ম ঘটিয়ে দেওয়ার ইন্ধন দিচ্ছে বাজার। জনতারও যেন পোয়াবারো।”আছি অথচ নেই” -এর দোলায় সে দুলছে। দোলনের সে কী মজা রে ভাই!
দেখা যাচ্ছে না বলে আমার বাবা এটিএমের কার্ড করাতে চাইত না। বলতো যদি কিছু গোলমাল হয় আমি কি যন্ত্রের সঙ্গে কথা বলব?? মানুষ কই?? পরে সম্ভবত এটিএম এর গার্ড কাকুকে দেখে ভরসা সঞ্চয় করে কার্ড বানিয়ে ছিল। বাবার যুক্তি আমাকে বুঝিয়ে ছিলো সত্যিই তো, এই যে নোট বন্দির সিদ্ধান্ত নিল, তাকে তো চোখে দেখা গেল না! এইযে পেট্রোলের দাম বাড়লো,কে বাড়ালো তাকে দেখতে চাই, কিন্তু কোথায় সে?! সে কি একজন , অনেকজন, একটা প্রবণতা? একটা দুর্নীতি, একটা অনাদর্শ কেবল? মালুম হচ্ছে না। কেউ বলছে মোদি বাড়ালো, কেউ বলছেন মুখ্যমন্ত্রী কেন ট্যাক্স কমায় না? কেউ বলছে, বিশ্ববাজারে যুদ্ধ চলছে খেয়াল রাখো না! কেউ বলছে ভারতের অর্থনীতি এটা ছাড়া বাঁচবে না। কেউ বলছে ভারতের অর্থনীতি এই করেই ডুববে! সত্যি কেন তেলের দাম বাড়লো,কে বাড়ালো,মোট কথা তাদের দেখা যাচ্ছে না।এটা একালের সংস্কৃতি। আগের সব রাজার নামে হত। এখন রাজা-প্রজা গুলিয়েছে। এটা পার্টি করেছে, প্রশাসন করেনি। এটা ভিসি করছে রাজ্যপাল নিষ্পাপ। এটা লোভী লোকের কাজ, মুখ্যমন্ত্রী কী করবেন! এটা পার্টির সুপ্রমো চাইছেন কিন্তু প্রধানমন্ত্রী চাইছেন না। প্রধানমন্ত্রী চাইছেন শিল্পপতিরা চাইছেন না। কী গেরো। এক লোক, অজস্র উপাধি। এদিক দিয়ে উঁকি মারলে ওদিক দিয়ে পালায়। ধোঁয়া ধোঁয়া চারপাশ, চোখ জ্বলে; স্পষ্ট করে কিচ্ছুটি দেখবার যো নেই!!! কোভিড উত্তরকালে দেখতে পাই ফিজিশিয়ান ফিজিক ছাড়া চিকিৎসা করছেন!! কম্পিউটারের মাস্টার কম্পিউটার টু কম্পিউটারে ছাত্র কে দিগ্গজ করছেন। পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য আবিষ্কার করে প্র্যাকটিক্যালও অনলাইনে সারা গেল! আমার মেয়ের বিয়ের প্যান্ডেল কারা করল আমি সেই ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর মালিক কে দেখলাম না। এমনকি তাকে যে টাকা দিলাম গুনে গুনে, এ কথা বলা যাবে না। আমার টাকা আমি দেখলামই না কিন্তু দিলুম, সে নিল। দাতা- গ্রহীতা- টাকা কেউ কাউকে তেমন করে দেখা দিল না। পেটিএম টু জিপে টু ইউনো হয়ে সে উড়ে গেল। কিছুই দেখা গেল না। যদিওবা দেখা যায় তাহলে একটি অলৌকিক বিজ্ঞাপনের সঙ্গে এই দেওয়া-নেওয়ার নূন্যতম কোন পার্থক্য রইলো না। এই যে ভূতের মতন অনেক কিছু ঘটছে। তার ভয়ঙ্কর চাপও অনুভূত হচ্ছে, সেই অদেখা চাপের কারণে কষ্ট ত্রিগুণ হচ্ছে। অহৈতুকী ভক্তি এক কথা। অহৈতুকী অত্যাচার অসহনীয়। কি করে হচ্ছে, কেন হচ্ছে, কোথা থেকে হচ্ছে, কারা করাচ্ছে, বেশ পরিপাটি করে ঘেঁটে দেওয়া গেছে। কবির বানী চিরন্তন। তা-ই নতুন অর্থ পাচ্ছে। চোখ থাকতেও অন্ধ মোরা। বোধ থাকতেও বধির।
আমাদের শিশু কিশোর বেলায়,এমনকি যৌবনের প্রারম্ভে সবকিছু স্পষ্ট দেখা দিত। সেই নিয়ে আমাদের পরিতাপের অন্ত ছিল না। অংকে ফেল করলে চারপাড়া জেনেছে। স্কুল থেকে মার্কশিট নিয়ে ফেরার সময় কাকিমা জেঠিমা কাকা জ্যাঠা মাসি মেসো ছিনতাই করে সবটুকু দেখে নিতেন। কিছুই নাদেখা থাকত না। একমাত্র গোপন প্রেম কিছুদিন গোপনে রাখা যেত। আজকের মতো এসব কিছুতেই দেখাতে ইচ্ছে করত না।”Got engaged” এর চল ছিল না সেদিন। লজ্জা শরমে ডুবে ডুবে বেঁচেছি। তবু বড়দের থেকে কিছু আড়াল করতে পারিনি। আজ ক্ষমতাবান বাবা নিজের কন্যাকে দুনম্বরী করে চাকুরী দিয়ে, লজ্জাজনকভাবে বরখাস্ত হয়ে; এলাকায় ফিরে নিজেকে লুকিয়ে রাখেন না। প্রকাশ্যে দেখা দেন। গাঁদা ফুলের মালা ঝুলিয়ে বুক চিতিয়ে দুর্নীতি এগোয়!রাঙা ভোরের খোঁজে। কিন্তু একটা প্রয়োজনীয় জিনিস কিছুতেই দেখা যায় না তখন। খুব জরুরি একটা জিনিষ। তার নাম? – লজ্জা। এরপর আরো কিছু প্রকাশ্য ঘটনা ঘটে। সেই ক্ষমতাবানের, তার দলের পোষা বুদ্ধিজীবীর দল চুপ করে না থেকে, যুক্তি সাজায় এহেন ক্লেদাক্ত দুর্নীতির পক্ষে!! তখনো সব প্রকাশ্য হলেও একটা জিনিস কিছুতেই দেখা যায় না। তার নাম ও শরম। ওদের বিরুদ্ধে আমাদের ঘৃণাও কি খুব একটা দেখা যাচ্ছে?? যে ঘৃণার নাম – ছিঃ!!
যাপিত নাটোরের চতুর্থ কিস্তি লিখলেন - কুন্তল মুখোপাধ্যায়
কুন্তল মুখোপাধ্যায়
১৯৬২ সালে চীন-ভারতের যুদ্ধ হয়েছিল। ছোটো বেলায় শোনা ”হিন্দী –চিনি ভাই ভাই” এর ভাবনা অন্তহিত হয়েছিল রেডিও শুনে খুব মনখারাপ হ’ত। এই সময় রঙমহলে ‘সীমান্তের ডাক’ বলে একটা নাটক দেখেছিলাম, তাছাড়া সেই বছরেই বিশ্বরূপায় মন্মথ রায়ের কারাগার, আর রবীন্দ্রনাথের ক্ষুধিত পাষাণ দেখি। বাবার কাছে শুনেছিলাম সেই সময় মুক্তাঙ্গন রঙ্গালয়ে অনেক ভালো নাটক হত, কিন্তু দূরত্বের জন্য ওই বয়সে ওখানে আমার যাওয়া হয়নি। এই সময় বাবার বন্ধু বিশ্বনাথ সেনগুপ্ত, বিরাটি হাই স্কুলের ইংরেজির টিচার আমার বিশু জ্যেঠা আমায় সাহিত্য পড়ানোর ভার নেন। মফঃস্বল থেকে আসা শুধু ইংরেজি বর্ণমালা চেনা এক কিশোরকে ক্রমেই তিনি ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যের রসসাগরে অবগাহন করতে শেখালেন। বিশু জ্যেঠাই আমাকে চার্লস ল্যাম্বের টেইলস্ ফ্রম শেকসপীয়র, র্যাডিয়ান্ট রিডার পড়তে শেখালেন, বিভূতিভূষণের আম আটির ভেঁপু, রবীন্দ্রনাথের ছুটি, অতিথি, বলাই পড়ালেন, হাতে ধরালেন অবনী ঠাকুরের বুড়ো আংলা রাজকাহিনী। আমার কল্পনার জগৎ, ভাবনার দিশা আরও বিস্তৃত হলো। সেই সময়ই কোনো এক ছুটির দিনে বিশু জ্যেঠা আমাকে রয়াল শেক্সপীয়র গ্রুপের, মিড্ সামার নাইটস্ ড্রীম নাটকটি দেখান, কোন মঞ্জে সেটা এখন মনে নেই, শুধু মুগ্ধতার কথাই মনে আছে। কত রাত যে পাক্ আর বটম্ কে স্বপ্নে দেখেছি, তা গুনে শেষ করা যাবে না। অনেক পরে এই তো সেদিন নোটো ভাই তরুণ প্রধানের নির্দেশনায় রবীন্দ্রভারতী নাট্য বিভাগের রের্পাটারি প্রযোজনা ফাগুন রাত্রের গল্প দেখেও সেই মুগ্ধতা ফিরে পেয়েছিলাম। শিয়ালদহ ছেড়ে আমরা দমদমে সেন্টার সিঁথি হাউজিং এস্টেটে এসে উঠি ১৯৬৪ সালের কোন এপ্রিলের বিকেলে। সেই দিনই সকালে ওই কোর্য়াটার্সে এসে উঠেছিলেন গানের জগতের পণ্ডিত পবিত্র দাসগুপ্তের পরিবার। পবিত্রবাবুর ছেলে স্বপুদা আমার থেকে বছর পাঁচেকের বড় হলেও, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল, স্বপুদার বোন মুনমুন, পরে নামকরা রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী স্বাগতালক্ষ্মী দাসগুপ্ত, চিরদিনই আমার ছোট বোনের মত। ৬৪ সালের ওই গভঃ হাউজিং এস্টেটে, দমদম অঞ্চলে প্রথম গর্ভমেন্ট কোর্য়াটার্স এবং এখন অবিশ্বাস্য মনে হলেও সেই সময়ে প্রায় শতাধিক পরিবার ছিল যেন একটা এক্সেটেন্ডেড ফ্যামিলি। একসঙ্গে দুর্গাপুজো, সরস্বতী পুজো, রবীন্দ্রজয়ন্তী, বার্ষিক দু-টো নাটক অভিনয় বাঁধা ছিল। ছোটদের মধ্যে আমি, বাবলি, মানা (ডঃ প্রশান্ত), সঞ্জয়, সন্দীপ, নান্টু, পলু, কল্যাণ, সুনীল, স্বপুদার নির্দেশনায়, বিনিপয়সার ভোজ, চারমূর্তি, চাঁদা বিভ্রাট অভিনয় করি এবং পিঠ চাপড়ানি পাই । এই সময় ছ’মাস দমদমের কুমার আশুতোষ ইনস্টিটিউট স্কুলে পড়ার পর আমি শিয়ালদহ আর রাজাবাজারের মাঝামাঝি টাকী হাউস গভঃস্পনসর্ড মাল্টিপারপাস স্কুলে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হই। সেই বছরই স্কুল আর তার শিক্ষককুল দেবতোষবাবু, যতীনবাবু, জয়ন্তবাবু, অশোকবাবু ও হেড স্যার কানাইলাল মুখার্জী আমার সামনে পড়াশোনা আর সংস্কৃতি চর্চার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছিলেন।
বিদ্যার সাগরেরা: নাট্য দর্শকের পত্র - সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
বিদ্যার সাগরেরা দেখতে গিয়ে সবার আগে নাটকটির গড়নের দিকে আমাদের খেয়াল পড়ে। বলার কথাকে আমাদের কাছে পৌঁছতে এখানে এক উপ-ঘটনার সাহায্য নিয়েছেন নাটককার। এই উপ-ঘটনার নির্বাচন আমাদের কাছে অভিনব মনে হয়েছে। রাঢ় বাংলায় বিদ্যাসাগরকে ঘিরে এক অনুষ্ঠানে বাংলার শিক্ষা- সাংবাদিকতা ও বড়পর্দার কলকাতাবাসী চার নামীজনকে আমন্ত্রণ – আচমকতার মোড় ঘুরে যাওয়া – ঘটনাপ্রবাহে সিপিআই মাওবাদী প্রবেশ প্রসঙ্গ – তারপর আস্তে আস্তে ঘটনা আবর্তিত হওয়া।
পায়েল কাপাডিয়ার সিনেমার ন্যারেশান নিয়ে কথা বুনলেন - সুদীপ্ত নাগ
সুদীপ্ত নাগ
পায়েল কাপাডিয়ার ন্যারেশানে আমাদের মনে জমে থাকা কথাগুলি – ‘আ নাইট অব নোয়িং নাথিং’ আগের বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলেও আমাদের দেশে তাই নিয়ে কোন হইহই নেই । আর হবেই বা কেন? যেসব বিষয়কে কেন্দ্র করে এই সিনেমা বানানো হয়েছে তা আমাদের দেশের কিছু গেরুয়াধারীদের গায়ে লাগাটাই স্বাভাবিক । ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম মেকিংয়ে কিছু কাজ দেখলে আমরা আশা-ভরসা পাই । আর খুব কমই আমাদের দেশে এরকম কিছু কাজ হয় যা দেখে শ্রদ্ধা বা সম্ভ্রম জাগে । পায়েল কাপাডিয়ার ‘আ নাইট অব নোয়িং নাথিং’ সেরকমই মানের ছবি আমার মতে । আমাদের যৌবন আমাদের বাঁচতে চাওয়ার আকঙ্খাকে উজ্জীবিত করে তোলে । যৌবন এমন একটা সময় যখন প্র্যাকটিকাল জীবনের পাশাপাশি আবেগ এবং উন্মাদনা আমাদের বয়ে নিয়ে চলে এক অদ্ভুত জগতের মধ্যে । কলেজ বা ইউনিভার্সিটির জীবন এমনই যা স্টুডেন্টদেরকে মুক্তভাবে বাঁচতে শেখায় । জীবনের বাস্তব ডিসিশান গুলি নেবার আগে তারা আদর্শকে আর দর্শনকে সামনে রেখে নির্ভয়ে এগিয়ে যেতে চায় । পায়েল কাপাডিয়ার সিনেমা কোন কাল্পনিক বা তার থেকে দূরের কোন গল্প নয়। নিজের জীবনের একটি অংশ এবং পারিপার্শ্বিক দিক থেকেই উঠে এসেছে ।
এফ টি আই আই তে চেয়ারম্যান গজেন্দ্র চৌহানের পদত্যাগের দাবী থেকে , রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যা , জে এন ইউ এর আজাদির নাড়া , জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে পুলিশি হামলা, এই সব কিছু নিয়ে একটি এমন রাতের মধ্যে আটকা পড়ে গেছে আজকের যৌবন যা তাদের কণ্ঠরোধ করে রেখেছে । কিন্তু শুনতে যতটা হোপলেস লাগছে হয়ত আদতে ততটাও নয় । দুজন কাল্পনিক লাভারের চিঠির মাধ্যমে পায়েল তার সিনেমার বক্তব্যগুলিকে তুলে ধরেছেন । এদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমরা এই ঘোরতর অন্ধকার দেখতে পাচ্ছি । কিন্তু এরা সেই যৌবনে আছে , তাই হতাশার মধ্যেও এদের মনে বল আছে ।
এদের মনে এক অলীক আশা আছে পরের দিন সকালটাকে দেখার । সিনেমার শুরুতে আমরা এক দল যুবক-যুবতীদের নাচতে দেখি । কোন প্রথাগত নাচ নয় । নির্মল আনন্দে হাত-পা ছোঁড়ার যে বাঁধনহীন আনন্দ , তার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে এই নাচের মাধ্যমে । সিনেমার শেষে আবার একটি নাচের দৃশ্য আছে যেটা কিছুটা মেলাঙ্খলিক বলা যায় । কিন্তু এই ক্লান্তি আর বিভ্রান্তির মধ্যেও তারা ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশনটা ভোলেনি । পায়েল তার ছবিতে মোবাইল ক্যামেরার ফুটেজ থেকে , আরকাইভাল ১৬ এম এম ফুটেজ , সি সি টিভি ফুটেজ ব্যবহার করেছেন । এর মধ্যে ১৬ এম এম ফুটেজটি আসলে সেলুলয়েড নয় কিন্তু সেরকম একটি ফিল রাখার চেষ্টা করেছেন পরিচালক । পরিচালকের মতে এই সেলুলয়েড যে হারিয়ে গিয়ে সব কিছু ডিজিটালাইজেশন হয়ে যাচ্ছে এটিও এই মুহুর্তে সিনেমাপ্রেমীদের কাছে একটা অদ্ভুত কষ্টের ব্যাপার । হাতে ছুঁয়ে ফিল করে একটি ছবি নির্মান করার একটা আলাদা উৎকর্ষ আছে এবং যারা সেলুলয়েড নিয়ে কাজ করেছে বা এই মিডিয়ামটিকে ভালবেসেছে তাদের কাছেই এই কথাগুলো আমরা শুনি । যেমন কিছু বছর আগে লিওস কারাক্সও একটি ইন্টারভিউয়ে এইরকম কিছু কথা বলে ছিলেন । এই তথ্যচিত্রে সিনেমার প্রতি ভালবাসাটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । আজ প্রতিটি মানুষের কাছে তাদের ইস্যুগুলি গুরুত্বপূর্ণ । যেমন এফ টি আই আইয়ের অধঃপতনে সিনেমার ছাত্র-ছাত্রীরা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়েছেন , ঠিক একই ভাবে একটি দলিত ছেলের ইন্সটিটিউশনের শিকার হওয়ার প্রতিবাদে আত্মহত্যা অন্যান্য দলিতদের মনে আগুন জ্বালিয়েছে । কিন্তু এইটা আরও ভাল ভাবে একজন ফিল্ম স্টুডেন্ট অন্তর থেকে ফিল করতে পারছে যখন সে নিচু জাত বলে তার বয়ফ্রেণ্ডের ফ্যামিলি তাকে মেনে নিচ্ছেনা । এই ঘটনাটা না ঘটলে কিম্বা পলিটিক্যাল ভাবে গজেন্দ্র চৌহানকে চেয়ারম্যান না বানানো হলে হয়ত ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের শিল্প এবং শিল্প তৈরির এত ভাল জায়গাটা নিয়েই মশগুল থাকতো । যে সোভিয়েত এবং চেক সিনেমা ছবির পর্দায় মুগ্ধ করেছে , ল্যাটিন আমেরিকার পলিটিক্যাল সিনেমা , ফ্রেঞ্চ সিনেমার প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়ার প্রবণতা , জাপানিজ নিউ ওয়েভের হিস্ট্রি এবং কালচারাল ডিগ্রেডেশান নিয়ে ক্ষোভ এবং এক্সপিরিমেন্টেশন , সব কিছু যেন স্ক্রিন থেকে বেরিয়ে এসে পায়েলের ক্রাফটের মধ্যে ভর করেছে ।
পায়েলের সিনেমায় ন্যারেশান জিনিসটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ন রোল প্লে করেছে। এরকম চিঠির মাধ্যমে প্রেমিক-প্রেমিকার ন্যারেশান পার্সোনাল, পলিটিক্যাল সব এক করে দিয়েছে । এদের ভিন্ন ভাষার মাধ্যমে দেশের ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটিটাও চমৎকার ভাবে এসেছে । মেয়েটির গলার স্বরে ইম্প্যাথি এবং বেদনা যেন ঋত্বিক ঘটকের সিনেমার সহনভূতিশীল এবং উদার নারীদেরকে মনে করায় । এই ধরনের ন্যারেশান স্টাইল মিগুয়েল গোমেজ , ক্রিস মার্কার বা চান্তাল একেরম্যানদেরকে মনে পড়ায় । ভয়েস ওভারটি একদিকে যেমন সাবজেক্টিভ , অন্যদিকে তেমনি পোয়েটিক । পরিচালক জানেন যে আইজেন্সটাইনই হোক বা গ্রিফিথ , সব ছবিই কোন না কোন ভাবে পলিটিক্যাল । কিন্তু একজন নির্মাতা কতটা পলিটিক্যাল বা জাজমেন্টাল হবেন সেটা তার নিজস্ব চয়েজ । যেহেতু ছবিটি ইউথদের মনসতত্ত্ব নিয়ে, তাই এই ছবিটি অনেক পরিষ্কার ভাবে ভারতীয় জনতা পার্টি বা আর এস এসের নীতিগুলির সমাজের ওপর প্রভাব নিয়ে একটি ধারণা দিচ্ছে ।
কিন্তু একই সঙ্গে এই ছবি শেষের দিকে উত্তেজনা , হতাশা , ক্ষোভ এইসব থেকে কিছুটা সরে এসে ফিলজফিকাল কথা বলছে । রাস্তায় মিছিলে দাঁড়িয়ে ফিল্ম মেকার মেয়েটি পুলিশকে দেখে পাসোলিনির কথা ভাবছে । পুলিশ যদি প্রলেতরিয়েত হয় তবে তাদের মত শিক্ষিত এবং প্রতিবাদী লোকেরা আসলে এলিট । আর এই ডামাডোলে পুলিশ দুই পক্ষের মাঝখানে ফেঁসে গেছে । যে নির্মম ভাবে লাঠি চার্জ করছে তারও বাড়িতে হয়ত একটা ছোট বাচ্চা আছে , পরিবার আছে । সিনেমার শেষে একজন স্পিচ দিচ্ছেন তার বন্ধুদেরকে যে এই সময়টাই খারাপ। শুধু কয়েকটা মানুষ আর পার্টিকে দোষ দিয়ে খুব লাভ নেই । অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করতেই হবে কিন্তু ইতিহাস বলছে অন্যায় কোন না কোনভাবে চিরকালই ছিল । সেটার অবসান হবেনা হয়তো কিছুটা কমতে পারে । ইতিহাস সম্বন্ধে বলতে গিয়ে সুন্দর ভাবে একটা কথা উঠে এসেছে । আমরা ইতিহাস খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যাই । যারা এই সুযোগটা নিয়ে হাতে ছড়ি ঘোরাচ্ছে সেটাকেই ইতিহাস ধরে নেওয়া হচ্ছে । সেই কারণেই পায়েল কাপাডিয়া এই ফিল্মে হিস্ট্রিকে রিরাইট করেছেন । ফ্রেমে নিজের ইচ্ছে মত আঁচড় কেটেছেন , পেপার কাটিংস ব্যবহার করে অতীত থেকে বর্তমান অবধি ডিগ্রেডেশনের ধাপগুলি দেখিয়েছেন । ফুটেজকে ফাউন্ড ফুটেজ হিসাবে ব্যবহার করে তার ওপর ইচ্ছেমত কালারটোন , ন্যারেশান বসিয়ে নিজের আঙ্গিক থেকে একটি ইতিহাস রচনা করেছেন বর্তামান সময়ের; যা কোন ক্রনলজিক্যাল হিস্ট্রি নয়। বরং আমাদের মনের মধ্যে ছাপ ফেলা , আমাদের জীবনের টুকরো হিসাবে ছড়িয়ে থাকা এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ইতিহাস । ছবিতে নস্টালজিয়া বারবার উঠে এসেছে । ভালবাসার স্মৃতিগুলি এবং এফ টি আই আইতে স্বপ্নের দিন গুলি চিঠির দ্বারা রোমন্থনের মাধ্যমে । এই নস্টালজিয়াটা ঠিক পুরোন স্মৃতি গুলি ভাল ছিল বলে তা রোমন্থন নয় , যেন নস্টালজিয়া প্রসেসটির মধ্যেই এরকম একটা ভাল লাগার ব্যাপার আছে । শুধু পাস্ট নয় প্রেজেন্ট নিয়েই যেন একটি কাব্যিক নস্টালজিয়া গড়ে তুলেছেন পরিচালক । দিনের শেষে আমারা নিজেদের ভুল বোঝাতে চাই , অনেক কিছু মেনে নিতে বা বিশ্বাস করতে বড় কষ্ট হয় । L আর K ( পার্টনারদের নাম ফিল্মে )ভেতরে ভেতরে বিচ্ছেদকে মেনে নিয়েছে কিন্তু ফিল্ম স্ক্রিনিংয়ের অস্বচ্ছ আলোয় তারা যখন কিস করেছিল , সেই মুহুর্তের কথা ভাবলে L তার প্রেমিক সম্বন্ধে যে কথা গুলো ভুলতে চায় তা হয়ত সেই অনেক আগের থেকেই ভেতরে ভেতরে সত্য ছিল । ঠিক একই ভাবে গজেন্দ্র চৌহান আসার কিছুটা আগেই হয়ত এই বিখ্যাত ইন্সটিটিউটটির ভেতরে রাজনৈতিক মরচে ধরা শুরু হয়েছিল যার খুব পরিষ্কার ভাবে আঁচ পাওয়া যায়নি । মানুষের পতন , দেশের পতন , সিনেমার পতন, সব কিছু নিয়ে এই সিনেমার ব্যাপ্তি । কিন্তু বিভিন্ন সম্মানীয় আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেলেও এই অন্ধকারের ছত্রছায়ায় এই ছবির স্থান হয়না । তাই আমার লেখাটিও সিনেমার শেষ নাচটার মত । জানিনা লেখাটা কতজনের কাছে পৌঁছাবে বা কারা সিনেমাটা নিয়ে শুনে কী ভাববে । হতে পারে পরিচালকের ছবিটি পার্সোনাল এবং একটি মতাদর্শের মানুষকে হার্ট করতে পারে । কিন্তু যেগুলো পরিচালক বলতে চেয়েছেন তা কতটা সত্যি তা একবার ভেবে দেখতে অনুরোধ করলাম । কারণ ছবিটি পলিটিক্যাল হলেও ছবির বক্তব্যের পেছেনে রাগের চেয়ে বেশি সমবেদনা এবং উদাসীনতা ছড়িয়ে আছে ।
আদিবাসী মানভূমের জীয়ন্তদেবতাকে স্মরণ করলেন - সঞ্চিতা দত্ত
সঞ্চিতা দত্ত
‘যাতরা বুড়হি’ থান, আদিবাসী মানভূমের জীয়ন্তদেবতা – সঞ্চিতা দত্ত
আদিবাসী লোকদেবতায় অপদেবতার প্রভাব মারাত্মকভাবে চোখে পড়ে। ভূত-প্রেত, যোগিনী আদিবাসী জীবনযাত্রার অঙ্গ হয়ে উঠেছে। এখনও মানভূমে বড়পাহাড় পুজো, কুপ্রভাবের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় বার করে তারা। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে প্রকৃতিপুজো আদিবাসী লোকসংস্কৃতির প্রধান অঙ্গ। জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ সর্বত্রই তাদের অরণ্য-প্রকৃতি ও কৃষিকাজকে ঘিরে আবর্তিত। মজার ব্যাপার হল তাদের প্রতিটি জীবিকার সঙ্গে কোনও-না কোনও দেবতার নাম জড়িত। আর প্রতিটি উৎসবেই আছে নাচ-গান আমোদ-উল্লাস। মেয়েদের ব্রত পালন, উপবাস যেন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। প্রতি মাসেই কোনও-না কোনও পুজো হয় আদিবাসী সমাজে। তেমনই এক লোকদেবতা হল ‘যাতরা বুড়হি’।
পঞ্চায়েত -২ কে আত্মস্থ করে বর্ণন করলেন- সৈকত নন্দী
সৈকত নন্দী
সারল্যের হাত ধরেই সাফল্য , পঞ্চায়েত -২ এর মুগ্ধ বর্ণনায় সৈকত নন্দী
ধরুন আপনি আপনার ব্যস্ততম জীবনে কিছুটা ব্রেক নিয়ে বেরিয়ে পড়তে চান, হাওয়া বদলের উদ্দেশ্যে কিন্তু হাতে ছুটি নেই। দীঘা গিয়ে যে ঘুরে আসবেন সেইটুকু অবসরও পাচ্ছেন না। অগত্যা কি করা যায়? চিন্তা নেই চলুন “ফুলেরা ” ঘুরে আসি। উত্তরপ্রদেশের এক অখ্যাত, অনামী গ্রাম। সেখানে প্রধানজী আছেন, তার স্ত্রী রয়েছেন। রয়েছে রিঙ্কিয়া, সচিবজী অভিষেক, সহ-সচিব বিকাশ, উপ-প্রধান প্রহ্লাদ। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন আমি “পঞ্চায়েত ” ওয়েব সিরিজের ওই মানুষগুলোর কথাই বলছি। চা, বিস্কুট নিয়ে বসে পড়ুন, কারণ শুরু হচ্ছে, “পঞ্চায়েত -২” এর রিভিউ ।