ভাণ পত্রিকা
২৯তম সংখ্যা || ২১ তম ই-সংস্করণ || আগস্ট ২০২২
সম্পাদক :
সম্পাদনা সহযোগী :
প্রচ্ছদ :
নক্সা পরিকল্পক :
অন্যান্য কাজে :
ভাণ-এর পক্ষে:
পার্থ হালদার
কর্তৃক
৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬
( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )
৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) bhaan.kolkata@gmail.com ( ই – মেল )
Reg. No : S/2L/28241
সূচি
‘পিটার ব্রুক’এর অলিগলি সন্ধানে-সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
‘বন্ধুত্ব’ নিয়ে দু-চার কথা বললেন-আবীর কর
নৃত্যনাট্য ‘আজকের একলব্য’এর স্বাদ ভাগ করে নিলেন-সুমেধা চট্টোপাধ্যায়
নাটক ‘গর্তকন্যা’ কেমন লাগলো, জানালেন-সায়ন ভট্টাচার্য
‘অনন্ত’ সিনেমাকে ঘিরে কিছু মন্তব্য করলেন-সুদীপ্ত নাগ
‘মহাভারত মাডার্স’ ওয়েব সিরিজের খুঁটিনাটি তুলে ধরলেন -বৃতা মৈত্র
সম্পাদকের কথা
দেখা এর উপরিতল আর ভিতরিতল নিয়ে আমাদের দর্শনে যে কথা আছে তার ইয়ত্তা নেই। বহিঃদৃষ্টি আর অন্তঃদৃষ্টি নিয়ে কতসব অন্তর্ভেদী দেখা। কেউ দেখছে তবু দেখছে না। কেউ সবটা দেখতে পারছে না।কেউ দেখার আগেই মুদছে আঁখি আড়াল এসে আঁধার করছে দেখা। কেউ দেখেও না দেখার ভান করছে। কেউ না দেখে দেখাচ্ছে দ্বিগুণ দেখা। অতিরিক্ত দেখার ব্যারাম আছে অনেকের। কেউ দেখেই খালাস। কেউ কী দেখলাম – ভাবতে থাকে অনেক কাল। মাঝে কত দেখার জিনিস আসে, তা টের পায় না। কেউ কল্পনা ছাড়া দেখতে পারে না। কারো বা যেটুকু কল্পনা না থাকলে দেখা অসম্ভব, তাই জোগাড় হয় না। কেউবা ভাবতে ভাবতে দেখে, আর দেখতে দেখতে ভাবে। এই করতে করতে এক দেখা বহু হয়ে যায়। এমনিতেই সময়ান্তরে দেখা বদলায়। ক্লাস-কাস্ট, গ্রাম-শহর, কৃষ্টি-কালচার ইত্যাদিতে এক কে অনেকান্তিক লাগে। এক এক রকমের, এক এক ধরনের, বিচিত্র রঙ-বর্ণের, বিবিধ তাৎপর্যপূর্ণ দেখা। অন্যদিকে চাহিদা মতো দেখা, সুবিধে মতো দেখা এ জিনিস দ্রুত বাড়ছে পৃথিবীতে। এইটা আমি
দেখছি বেশ । ভাবটা এমন, এতো দেখা আমার কোন কাজে লাগবে? আমার সুখের জন্য, আমার সাকসেসের জন্য যেটুকু লাগে সেটুকু দেখতে চাইছি আমি। আরব দেশ বন্যায় ভাসে কেন? শীতের দেশ কানাডায় তাপপ্রবাহ হয় কেন … এসব দেখলেই ভাবনা আসে। তারচেয়ে মদন মার্কা ভিডিও দেখলে ফূর্তি বেশি। এই যে কোটি কোটি টাকার চাক্ষুষ দুর্নীতি কত লোক স্রেফ মজা করে দেখছি। দল বাঁচাতে অসহায় দলদাসরা দেখেও দেখছেন না। নিমক চাটা বিদগ্ধ মহল চোখের অসুখের ভান করছেন। বিরোধী গোষ্ঠী এসবে দুঃখ জ্বালা অপমানকে মিনিমাম করে কেবল নিজেদের ক্ষমতা অর্জনের রাস্তা হিসেবে দেখছে একে। মোদ্দা কথা,উপরিতলের সুবিধা মতো, স্বার্থ বিজড়িত দেখার মধ্যেই আজকের যাবতীয় দেখা-দেখি! ওদেশের অয়দিপাউস সত্য অনুসন্ধান থামাতে চাননি। ফল হয়েছিল ভয়াবহ। সত্যের ভয়াল চেহারা সহ্য করতে না পেরে নিজেই নষ্ট করেছিলেন আঁখি। এদেশের বিল্বমঙ্গল বাইরের মোহে কিছুতেই যখন অন্তরকে দেখতে পাচ্ছিলেন না, তখন নিজের দৃষ্টি নিজেই নষ্ট করে তাকে অন্তঃদৃষ্টির পথে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। পথ পরিক্রময় ক্লান্ত হয়ে বিজন ভট্টাচার্য লিখেছিলেন রাজনীতিকরা জগতকে এক চোখে দেখে। তার প্রস্তাব ছিল শিল্পীরা যাতে দুচোখ দিয়ে দেখার সাহস অর্জন করতে পারে সে আর কতটুকু সম্ভব হলো? তবে চ্যাং মুড়ি কানীর এক চোখ দিয়ে যে শিবের সাধনা অসম্ভব, এ কথাটা যত দিন যাচ্ছে তত মালুম হচ্ছে।
‘পিটার ব্রুক’এর অলিগলি সন্ধানে- সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
এমটি স্পেস! পিটার ব্রুক আর নেই
পিটার ব্রুক আর নেই। সত্যিই একটা শূন্যতা গ্রাস করছে যদিও দীর্ঘায়ু তিনি। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল সাতানব্বই। তবু কেমন যেন লাগে। কেমন যেন লাগছে কিছু কি হারিয়ে ফেললাম? কিছু কি তলিয়ে গেল,- বুঝতে পারছিনা! আমরা ওঁর কাজ দেখিনি, থিয়েটার দেখিনি, ছায়াছবি দেখিনি, ছেঁড়া-ছেঁড়া কিছু কথা জেনেছি মাত্র। তার ভিতর দিয়ে একটি ছবি এঁকেছি – সেই ছবিটা ভেঙে গেল। আচমকা তিনি আমাদের কাছে এসেছিলেন মহাভারতের অনুষঙ্গে। মহাভারতের নয় ঘণ্টার নাট্যরূপে। যেখানে আবার দ্রৌপদী এবং একলব্যের ভূমিকায় দুই ভারতীয়। মল্লিকা সারাভাই এবং আকরাম শেখ। দেশ আবার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মাননা দিয়েছে। এ হেন ঘটনার পর আমরা খুঁজতে শুরু করি। খুঁজতে গিয়ে তল পাইনা। কমবেশি প্রায় আশি বছরের থিয়েটার জীবন। দেখি, বিশ শতকের আধুনিকতায় কীভাবে তিনি নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছেন, একে একে মঞ্চে আনছেন ককতো থেকে সার্তে আরশেক্সপিয়র তো আছেনই। তাঁর সঙ্গে কাজ করছেন সালভাদর দালি। পোষাক ও মঞ্চদৃশ্যের পরিকল্পনা করছেন। আঁভা গার্দ থিয়েটারকে আত্মস্থ করছেন। প্রাণিত হচ্ছেন আর্তোর নির্মমতার নাট্যে। মঞ্চে আনছেন জঁ জিনকে। বিষয়ে বিষয়ে বদলে যাচ্ছে আঙ্গিক। বিষয়কে অন্য মাত্রায় আনছেন নাট্যভাষা বদলে যাচ্ছে বারংবার। আবার গ্রোটস্কির কাছে যাচ্ছেন নতুন ভাষার সন্ধানে। পিটার ওয়াইস-এর মারা সাদ এর প্রযোজনা করছেন। চলে আসছেন প্রাচ্যে – ত্রয়োদশ শতকের এক পারসিক কবিতা থেকে মঞ্চস্থ করছেন ‘দ্য কনফারেন্স অব দ্য বার্ডস’ – ১৯৮০-তে। হাত তুলে নিচ্ছেন মহাভারতের মঞ্চায়ন। এই মহাকাব্যকে সেলুলয়েডেও ধরছেন, বানাচ্ছেন তার ছোটপর্দার ছোটরূপ। অন্যদিকে রয়্যাল শেক্সপিয়র কোম্পানিতে টানা শেক্সপিয়র করছেন। মঞ্চে আসছে অপেরা। কাজ করছেন একাধিক ইউরোপীয় ভাষায়। পারিতে স্থাপনা করছেন বিপুলকায় থিয়েটার গবেষণালয়। নিরীক্ষায় মাতছেন পরিসর তথা শূন্য পরিসর বা এমটি স্পেস নিয়ে।
ছবি সৌজন্য: গুগল
এইখানে এসে আমাদের থমকে দাঁড়াতে হয়। জানতে ইচ্ছে করে এতকিছু তিনি করলেন কেন? খালি নানা নাটক করে যাবেন, নানা প্রযোজনা করে যাবেন- এমনি কি কারণ? এমন করে ভাবা মনে হয় ঠিক হবে না কখনই। নাকি নিয়ত নব নাট্য নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে যাওয়াই ছিল তাঁর অভিলাষ! আগে বলা ঘটনার থেকে হয়তো তাঁর সমর্থন আমরা পেয়ে যাব। যেমন আমরা দেখি এশিয়া-ইউরোপ, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এই চার মহাদেশের সমসাময়িক আধুনিকতম প্রকরণ, চিন্তন তথা জীবনদর্শনকে কীভাবে তিনি আত্মস্থ করেছেন, তার প্রয়োগ করেছেন, যে প্রয়োগের কারণে এসেছে বিরুদ্ধ সমালোচনাও। যেমন ঘটেছিল মহাভারতের বিষয়গত বিন্যাস ঘিরেও, যা দেখে রুস্তম বারুজা বা পাজ (PAJ) (অর্থাৎ পারফর্মিং আর্টস জার্নাল) নাট্য পত্রিকার সম্পাদক, গৌতম দাশগুপ্ত বিরুদ্ধমত পোষণ করেছিলেন। এখানে বলি, তিনি যে তাঁর সময়ের সেরা নাট্য-নিরীক্ষক, উদ্ভাবক একথারও সমর্থন আছে চারপাশে। কিন্তু কেবলই কি নাট্য-নিরীক্ষার জন্য এত আয়োজন! নাকি নতুন থেকে নতুনতর নাট্যভাষার, তথা নাট্যভাষার আন্তর্জাতিকতার তালাশ – না হলে দেশ থেকে দেশান্তরে, ভাষা থেকে ভাষায়, মহাদেশ থেকে মহাদেশে – কেন তাঁর মনের যাওয়া-আসা – এইসব নানা আংশিক অসমাপ্ত সন্ধানের পাশে আরেকটি জিজ্ঞাসা এসে দাঁড়ায় – কেমন তাঁর জীবনদর্শন? কী তাঁর রাজনৈতিক প্রত্যয়? এছাড়া তো কেউ হবেন না কোনোদিন। আর এই দর্শন ও প্রত্যয়ের ছায়া কি পড়েনি তাঁর নির্মাণমালায়? তাঁকে নিয়ে এমনসব তোলপাড়ের ভিতর খেয়াল পড়ে তাঁর চিন্তায় চার মহাদেশের নাট্য থাকলেও বাদ থাকে আফ্রিকা। আর তার চিন্তায় ছায়া ফেলে না কোথাও। লোকনাট্যে কিংবা প্রাচ্যে তাঁর আগ্রহ কাব্যে, তাঁর আগ্রহ শিকড়ে। এই সমস্ত দেখাকে, এই ইতস্তত প্রশ্নের পাশে সাজিয়ে রাখি আমরা। সম্পূর্ণ-অসম্পূর্ণের মাঝখানে তাঁকে ঘিরে জেগে থাকে অনন্ত জিজ্ঞাসা। এমন তো হবেই। কারণ তিনি তো পিটার ব্রুক। আর এভাবেই আমাদের অনন্ত জিজ্ঞাসার মাঝখানে ফেলে রাখে রেখে তিনি চলে যান অনন্তের দিকে।
‘বন্ধুত্ব’ নিয়ে দু-চার কথা বললেন- আবীর কর
বন্ধু, কী খবর বল?
‘হঠাৎ রাস্তায় আপিস অঞ্চলে
হারিয়ে যাওয়া মুখ, চমকে দিয়ে বলে-
বন্ধু, কী খবর বল?
কতদিন দেখা হয়নি… ‘
— কবীর সুমন
বন্ধু ও বন্ধুত্ব মানুষের মনের কোন গহনে যে অমলিন স্মৃতি হয়ে থাকে, সে সম্পর্কে সদ্য একটি ঘটনা প্রত্যক্ষ করলাম। আমার এক নবতিপর দাদামশাইয়ের মুমূর্ষু অবস্থা জেনে দেখতে গিয়েছি। তিনি তখনও স্পষ্ট কথা বললেও, কাউকেই চিনতে পারছেন না। নিজের ছেলেমেয়েদেরকেও না, স্মৃতি কাজ করছে না। সবাই চেষ্টা করছে, যে যার মুখ সামনে রেখে, নাম বলে বা টুকরো টুকরো ঘটনার উল্লেখ করে স্মৃতিকে জোড়া লাগাতে, কিন্তু তিনি দু’একটা কথা বললেও, কারও নাম মনে করতে বা মুখ চিনতে পারছেন না। চেনা-অচেনার পর্বে তিনি যথারীতি আমাকেও চিনতে পারলেন না। কিন্তু পরক্ষণেই কোন এক আত্মীয়া, আমি কোত্থেকে আসছি অর্থাৎ আমার গ্ৰামের নাম উল্লেখ করলেন। গ্ৰামের নাম শুনেই, মুমূর্ষু বৃদ্ধ, সম্পর্কে আমার দাদামশাই আমাকে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,”সুন্দরপুরের মোহিনী কি বেঁচে আছে?” মোহিনী গাঙ্গুলী, আমার বন্ধু। আমরা একসঙ্গে… চিকিৎসাবিজ্ঞানের নিরিখে হয়তো এই স্মৃতি, স্মৃতিভ্রংশের নানান যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা মিলবে, কিন্তু ঐ মুহূর্তে ব্যক্তিগত স্তরে আমি উপলব্ধি করলাম এক মুমূর্ষু ব্যক্তির কাছে ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনিদের সর্বক্ষণ আসা যাওয়া, আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা যখন প্রায় বিস্মৃতির অতলে, তখন জীবনের শেষশয্যায়, কোনও সুদূর কৈশোরের স্কুলবেলার বন্ধুকে অমলিন স্মৃতিতে ধরে রাখাও এক অনুপম দৃষ্টান্ত। সত্যিই তো, আমাদের জীবনের পথ চলায়, জীবন-পথের বাঁকে বাঁকে, আর জীবনের ওঠা-পড়ায় বন্ধুর ভূমিকা অপরিসীম। ভালো বন্ধু, মন্দ বন্ধু উভয়কে নিয়েই আমাদের সম্পূর্ণ জীবন। ভালো বন্ধু অবশ্যই ভালো, বরাবর সে বাড়িয়ে থাকে সাহায্যের হাত, বিপদে-আপদে পাশে থাকে, প্রয়োজনীয় আস্থা ও সান্ত্বনা, অসময়ে আর্থিক আত্মিক সাহায্য, সুসময়ে আনন্দকে দ্বিগুণ করায় তার জুড়ি মেলা ভার। আর মন্দ বন্ধু বরাবর আমাদের অভিজ্ঞ করে তোলে, বাস্তবের কালো-কঠিন মাটিতে আছড়ে ফেলে আমাদের শক্ত করে, স্বাবলম্বী করে, একা পথ চলতে শেখায়। বন্ধু সাধারণত রক্তের সম্পর্কের কেউ নয়, সে অর্থে আত্মীয়ও নয়। আবার পারস্পরিক সহযোগিতায়, অন্তরঙ্গতায় একদিন উভয় উভয়ের কাছেই হয়ে উঠে আত্মার আত্মীয়, পরমাত্মীয়। আর অন্যদের চোখে ;হরিহর আত্মা। বন্ধু সম্পর্কে রবীন্দ্র উবাচ আমরা বন্ধুর কাছে মমতা চাই, সমবেদনা চাই, সাহায্য চাই ও সেই জন্যই বন্ধুকে চাই। আর বন্ধুত্ব নিয়ে কবির অভিমত বন্ধুত্ব আটপৌরে, ভালোবাসা পোশাকী, বন্ধুত্বের আটপৌরে কাপড়ের দুই এক জায়গায় ছেঁড়া থাকিলেও চলে, ঈষৎ ময়লা হইলেও হানি নাই, হাঁটুর নীচে না পৌঁছিলেও পরিতে বারন নাই। গায়ে দিয়া আরাম পাইলেই হল। বাস্তবিক, নির্মল বন্ধুত্বে পোশাকী বা পেশা কী? সেটা কোনো ধর্তব্যের বিষয় নয়। বন্ধু মানেই মন ও মননে আশ্চর্য মিল আবার হতে পারে কথায় কথায় তর্ক কিন্তু সব তর্কবিতর্কের পর আবার একসঙ্গে। বিদগ্ধজনেদের কেউ বলেছেন;একজন বিশ্বস্ত বন্ধু দশ হাজার আত্মীয়ের সমান।আবার কেউ বলছেন,সর্বোৎকৃষ্ট আয়না, একজন পুরানো বন্ধু। মহামান্য রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালামের বক্তব্য একটা ভালো বই একশো জন বন্ধুর সমান,আর একজন ভালো বন্ধু একটা লাইব্রেরির সমান।তবে, এ প্রসঙ্গে ভাববার মতো মন্তব্য করে গেছেন শিব্রাম চক্রবর্তী বন্ধু পাওয়া যায় সেই ছেলেবেলায় স্কুল কলেজেই, প্রাণের বন্ধু তারপর আর হয় না। এরপর জীবন জুড়ে যারা থাকে, তারা কেউ বন্ধু নয়। তারা দুরকমের, এনিমি, নন-এনিমি। নন-এনিমিদের বন্ধু বলে ধরতে হয়। কথাটা একদম হক কথা। স্কুল-বেলায় বা কলেজ-ক্যাম্পাসে গড়ে ওঠা নির্মল বন্ধুত্ব আর আমৃত্যুকালে হয়ে উঠে না। ঐ যে বেঞ্চে জায়গা রাখা, টিফিন শেয়ার, স্কুলের গেটে হাত গলিয়ে একসঙ্গে আলুকাবলি, বরফগোলা খাওয়ার বিস্তর মজা। ভরা বর্ষায় জলকাদার মাঠে স্কুল-ইউনিফর্মের শুভ্রতাকে সিকেয় তোলে, ফুটবলের নামে কাদা মাখামাখির এক মাঠ মজা- স্কুলবেলার বন্ধু ছাড়া আর কে দেবে? কলেজ ক্যাম্পাসে বন্ধুত্ব আরও দৃঢ়, প্রথমত নবযৌবনের স্পর্ধা, তারপর চা-সিগারেট-ক্যান্টিন-আড্ডা-ইউনিয়ন-বন্ধুনী-গান-পান মিলে উদ্দামতায় বাঁধা প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা সেই বন্ধুত্ব, বিনা স্বার্থের, বিনা শর্তের। তাই পরবর্তীতে তার জুড়ি মেলা ভার।
ছবি সৌজন্য: গুগল
স্কুল কলেজের বাইরেও বন্ধু থাকে ছড়িয়ে, পাড়ায়-ক্লাবে-ঠেকে। এছাড়াও খেলার মাঠে, রাজনীতির ময়দানে, সাহিত্য বাসরে, আর আছে এক দশকের বেশি কাল ধরে সোশ্যাল সাইটে হরকিসিমের বন্ধু-বান্ধবের ছড়াছড়ি (ছ্যাঁড়াছেঁড়িও বলা যায়)। বন্ধুকে শুধুমাত্র বন্ধু ডেকে মন ভরেনা। বান্ধব, সুহৃদ, সুজন, হিতৈষী, সখা, মিত্র, মিতা, দোস্ত, ইয়ার, কমরেড অজস্র নামে ডেকেও শেষ হয় না। এক সময় রাঢ়বঙ্গের অনেক জায়গায়
ফুল বা মকর পাতানোর চল ছিল। দীর্ঘ যাতায়াত বা এটা-সেটা দেওয়া নেওয়ায় মনের মিল হলে, যেকোনো একটি শুভদিনে পরস্পরের হাতে ফুল দিয়ে বন্ধুত্বের স্বতন্ত্র অনুষ্ঠান হতো। আর মকর হল জলের সই বা স্যাঙাৎ। পৌষ সংক্রান্তি তথা মকর সংক্রান্তির বিহানবেলায় নদী বা পুকুরের স্নানজলে পরস্পরের হাত ধরে তিন ডুব দিয়ে, সেই মকর বন্ধুত্বের শুভ সূচনা। সেকালে গঙ্গাস্নানে বা সাগরস্নানে গেলে মূলতঃ মেয়েদের মধ্যে সই পাতানোর চল ছিল। ফিরে এসে পরস্পরকে ডাক পাড়তো গঙ্গাজল সাগরসই বা মকর সম্বোধনে। ঘটা করা সেই নয়নমণি বন্ধু অনেক সময় হয়ে দাঁড়াতো চোখের বালি। গত শতকের সত্তর আশির দশকে সহ মতাবলম্বী ছেলে-বন্ধুরা পরস্পরকে ইয়ার, দোস্ত, কমরেড নামে ডেকেছে। এবং প্রায় ঐ সময়কাল থেকে বঙ্গসমাজেরও মান্যতা প্রসারিত হয়েছে যে, ছেলেতে ও মেয়েতেও অবাধ বন্ধুত্ব হয়। আর সেই বন্ধুত্ব পরে পরে প্রমাণ করেছে অবাধ বন্ধুত্ব সময় সুযোগে কমবেশি অবাধ্য হয়। আর পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে স্কুল কলেজে ইয়ারমেট, রুমমেট, ক্লাসমেট তো ছিলই। ইদানীং যদিও ক্লাসমেটের থেকে গ্লাসমেটের গুরুত্ব বাঙালির জীবনে কয়েকগুণ বেড়েছে। আর নব্বইয়ের দশকে সম্ভবত প্রথম পারস্পরিক চেনাজানা ও মুখোমুখি বন্ধুত্বের বাইরে আজকের যে ভার্চুয়াল-বন্ধুত্ব, তার শুরুয়াৎ বলা যেতে পারে। তার নাম ছিল পত্রমিতালি। চিঠিপত্রে সে এক মিষ্টিমধুর মিত্রতা। মুখোমুখি দেখা নয়, পিঠোপিঠি বসা নয়, শুধু চিঠোচিঠি সুখালাপ। এরপর এল নতুন শতক, হাতে হাতে বিকশিত হলো মুঠোফোন, যার দৌলতে মিতভাষী তথা স্বল্পভাষীরাও কথার তোড়ে বানভাসি। পাড়ার প্রায় মূক মেয়েটিও মোবাইলে হলো মুখর। মাঝবয়সী গৃহবধূর মোবাইলে টিং শব্দে ঢুকে পড়লো বেয়াড়া এসএমএস। সাদা-কালো নোকিয়া, তাতেই ধীর লয়ে পরকীয়া। এর মাঝে দৈনিকে বন্ধুত্বের বিজ্ঞাপন। বড়ই রহস্যঘেরা সেই মিত্রভাষ। হররোজ মজাদার বিজ্ঞাপনে সে এক আনন্দ-হাট। বোল্ড রিলেশন , ক্লোজ রিলেশন,গড়ার প্রতিশ্রুতিতে ভরা বন্ধুত্বের এক এক প্রতিষ্ঠান,অন্তরঙ্গ,লাভ পয়েন্ট,প্রেম বন্ধন,মনের মানুষ,Moon Light,Love Sixteen, Heart 2 Heart এইসব
ফ্রেন্ডস ক্লাব থেকে বন্ধুত্বের ডাক পাঠাচ্ছে পায়েল, মধুমিতা, অন্বেষা, পারমিতা, তুলিকারা — নামে বেনামে। রঙে-রসে ভরা সেই সম্ভাব্য বন্ধুত্বের বিজ্ঞাপনী লেখনী আজ প্রিয়া, কাল মিস্টু, পরশু দিয়া,নতুন কেউ মানেই নতুন ভালো লাগা। এইসব আয়ব্যয়ের বন্ধুত্বের গেরোও মারাত্মক, সেই সব কাহিনিও পর্দা ফাঁস হয়ে মাঝেমাঝে উঠে আসে দৈনিকে।আজ থাক, ঐ সব ছকের বন্ধুত্বের প্রসঙ্গ, নিছক বন্ধুত্বের প্রসঙ্গেই ফিরি।ফ্রেন্ডশিপ ডে পালন,মূলত পাশ্চাত্য সংস্কৃতি। আর পাশ্চাত্যের পশ্চাতে পশ্চাতে ফেরা আমাদের বঙ্গ-সংস্কৃতি। তাই অগস্টের ফার্স্ট সানডে নিয়ে ইদানীং মাতামাতি চলে। আমাদের ফুল মকর সই পাতানোর বঙ্গ-সংস্কৃতি সেখানে ম্লান। অথচ কী গভীর আন্তরিকতার ঋদ্ধ ছিল সেই সব সখ্য। নিখাদ বন্ধুত্বের প্রসঙ্গে, কলেজ লাইফের স্মৃতিতে ও শ্রুতিতে শুকতারা হয়ে আছে, বারবার শোনা অঞ্জন দত্তের শ্রুতি নাটক প্রিয়বন্ধু । ঐ যে আসমা চৌধুরী জয়িতা আর অর্ণব চট্টোপাধ্যায় ওরফে ন্যাবা। দুই দেশ, দুই ধর্ম — অথচ কি অভিন্ন বন্ধুত্ব। ভালোলাগে মেঘলা দিনে নিষ্পলকে রামধনু খুঁজতে… বন্ধু… বন্ধু… । যতবার শুনি, ততবারই ঘোর লাগে, চোখের পাতায় লেগে যায় ঐ বন্ধুত্বের মায়াঞ্জন। নিখাদ বন্ধুত্ব বারবার হতে চেয়েছে বাঁধনহারা। অকৃত্রিম বন্ধু সু-মনে শুধু ডাক দিয়ে যায় তোমায় আমি গড়তে চাইনা, পড়তে চাইনা/কাড়তে চাইনা, নাড়তে চাইনা/ফুলের মত পাড়তে চাইনা/চাইছি তোমার বন্ধুতা। আমাদের বহতা জীবনের অনেকটা অংশ জুড়েই থাকে বন্ধু। হয়তো সাময়িক বিচ্ছেদ হয়। তারপরও সময় চলে যায়, জীবনও থেমে থাকে না।তারপর আবার হঠাৎ মাঝপথে হাঁটতে হাঁটতে বন্ধু কী খবর বল? কতদিন দেখা হয়নি
এক লহমায় উঠে আসে পুরানো দিন, পুরানো আড্ডা। ফেলে আসা পুরানো বসন্তের রঙ মেখে হো হো হাসিতেআরও নতুন হয়ে উঠে সে বন্ধুত্ব।
নৃত্যনাট্য ‘আজকের একলব্য’এর স্বাদ ভাগ করে নিলেন- সুমেধা চট্টোপাধ্যায়
দৃষ্টিনন্দন ভঙ্গিমায় অপরূপ শ্রদ্ধার্ঘ্য
শ্রী উদয়শঙ্কর এবং শ্রীমতি অমলাশঙ্কর নিজস্ব ঘরানায় নৃত্যশিল্পী-মহলে এক অতি পরিচিত যুগলের নাম। দেশে বিদেশে সর্বত্র ‘শঙ্কর’ পরম্পরার নৃত্যবিভঙ্গকে তারা ছড়িয়ে দিয়েছেন- একথা সর্বজনবিদিত। এই পরম্পরার যোগ্য ধারক এবং বাহক উদয়শংকর এবং অমলা শংকরের কন্যা শ্রীমতি মমতা শঙ্কর এবং তাঁর স্বামী চন্দ্রোদয় ঘোষ। সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত দেন মমতা শঙ্করের কন্যাসমা দুই পুত্রবধূ সুদেষ্ণা শঙ্কর ঘোষ এবং সৌরিতা শঙ্কর ঘোষ। এদের নিয়ে বহু স্মরণীয় উপস্থাপনা মমতা শঙ্কর আমাদের উপহার দিয়েছেন। যার মধ্যে ‘অমৃতস্য পুত্র’, ‘হোরিখেলা’,’প্রকৃতি’, ‘কালমৃগয়া’ এবং ‘আজকের একলব্য’ খুব গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীমতি অমলা শঙ্করের ১০২ তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে গত ২৬শে জুন সল্টলেকের EZCC-তে উদয়ন কলাকেন্দ্র দ্বারা পরিচালিত এক অত্যন্ত মনোগ্রাহী অনুষ্ঠানের সাক্ষী ছিলাম। প্রবেশদ্বারের সামনেই ছিল অমলা শঙ্করের একটি খুব সুন্দর করে সাজানো প্রাণবন্ত ছবি। প্রথমে শ্রী চন্দ্রোদয় ঘোষ উদয়নের সম্পর্কে এবং তাঁদের পরম্পরা সম্পর্কে জানালেন। তারপর অমলাশঙ্কর এবং উদয়শঙ্করের অনন্য সৃষ্টি ‘কল্পনা’র একটি সাদা-কালো ছবি দেখানো হল। নতুন প্রজন্মের মানুষের কাছে ‘কল্পনা’র কিয়দংশও চাক্ষুষ করা এক অভিজ্ঞতা। এরপর সৌরিতা শঙ্কর ঘোষের পরিচালনায় শ্রীরামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেকের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক অপরূপ নৃত্যনাট্য পরিবেশন করা হয়। নাম ‘Coronation of Rama’। এটি খুব অল্প সময়ের হলেও এতে মমতা শঙ্কর নিজে অংশগ্রহণ করেন।
ছবি: Coronation of Rama
সব শেষে পরিবেশিত হয় মমতাশংকর ডান্স কোম্পানী বা উদয়ন কলাকেন্দ্র পরিচালিত একটি নৃত্যনাট্য ‘আজকের একলব্য’। একলব্যের গুরুদক্ষিণার পরম্পরা আজও জারি। গুরুর কঠোরতম ব্যবহারের পরে আজকের একলব্যরাও কখনও ন্যায্য গুরুদক্ষিণা দিতে ভোলে না। এই নৃত্যনাট্যটি রচনা করেছেন মমতা শঙ্কর নিজেই। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল সমগ্র রচনাটিতে কোনও কথোপকথন বা ডায়লগ নেই। পুরো গল্পটি শুধুমাত্র শরীরী সঞ্চালনা এবং ভঙ্গিমার মাধ্যমে পরিবেশিত হল। একলব্যের ভূমিকায় রুদ্রপ্রসাদ রায় সকলের মন কেড়ে নেন। নাচের সঙ্গে তাঁর অভিনয়ও ছিল নজরে পড়ার মতো। গুরুর অভিনয় করেন বিধান রায়চৌধুরী। তাঁর অবশ্য নাচের কোনও সুযোগ ছিল না। তাও তাঁর ঋজু ভঙ্গিমা এবং ব্যক্তিত্ব তাঁর ভূমিকার জন্য যথোপযোগী ছিল। সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন রবীন দাস। আগেও তাঁর কাজ আমরা হোরিখেলায় দেখেছি। ধবনি ক্ষেপণে ছিলেন কৃষ্ণজিৎ মুন্সি এবং বাবু দাস। পরম্পরা বজায় রেখে আলোক-সম্পাত করেন শ্রী রাতুল শঙ্কর ঘোষ। মমতা শংকরের জ্যেষ্ঠ পুত্র। আলোর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল যে অনেক ক্ষেত্রেই মূল চরিত্র অর্থাৎ যিনি স্টেজের মাঝখানে আছেন তাঁকে পিছন থেকে আলোকিত করে মুখ অন্ধকারে রেখে অবয়ব এবং তাঁর অঙ্গসঞ্চালনা দর্শকের সামনে আনা হয়েছিল। এটি খুব কম মঞ্চ উপস্থাপনায় দেখা যায়। প্রকৃত অর্থেই এটি “ a treat to eyes’। নাচের জন্য একলব্য বাড়ি, গ্রাম সব কিছু ত্যাগ করে একটি নাচের দলে নাম লেখায়। তারপর সে ঐ দলেরসাথে বেরিয়ে পড়ে বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করতে। ধীরে ধীরে নৃত্য-পরিচালক গুরুর থেকে ছাত্র এবং শিক্ষানবীশ একলব্যর গুরুত্ব বাড়তে থাকে দর্শক মহলে। এই ঘটনা সহ্য না হওয়ায় তিনি একলব্যকে তাড়িয়ে দেন। একলব্য এর পর ধীরে ধীরে নিজের দল করে এবং অনেক পরিচিত বন্ধুরা এসে যোগ দেয়। কিন্তু সে সর্বদা গুরুকে মনে রেখে চলে এবং তাঁর নিজের সাফল্যের জন্য গুরুরই নাম করে। বেশ কিছু বছর পর তাঁরই একটি অনুষ্ঠানে গুরু আসেন এবং লুকিয়ে দেখেন সকলের সামনেই কি পরিমাণ গুরুভক্তি ও শ্রদ্ধা সহ একলব্য নৃত্য-পরিবেশন করল। নিজের ভুলে মরমে মরে যান তিনি। উপলব্ধি করেন আজও বেঁচে আছে একলব্যরা। সৌরিতা শঙ্কর ঘোষ ছিলেন একটি বিশেষ চরিত্রে। গ্রামবাসীদের মধ্যে। মমতা শঙ্করও মঞ্চ আলোকিত করে শেষে আসেন।
ছবি: আজকের একলব্য
উদয়শঙ্কর ধারার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, কোনও বিশেষ ক্লাসিকাল আঙ্গিকে না নেচে নিজের ভিতর থেকে যে আনন্দ বা ভাব আসছে তাই অঙ্গ-সঞ্চালনার মাধ্যমে তুলে ধরা। আর এক্ষেত্রে যখন দলগতভাবে এঁরা নৃত্য-পরিবেশন করে তখন প্রত্যেকের হাত, পা এবং সমগ্র শরীর একইভাবে এবং একইসঙ্গে আন্দোলিত হয়, যা অত্যন্ত নয়নাভিরাম। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় well-synchronized। ছেলে-মেয়েরা যখন একসঙ্গে নাচ করেন সেক্ষেত্রেও অসম্ভব পরিশীলিত হয় দৃশ্যটি, একটি তালি দেওয়া বা মাথা নাড়ানোর দৃশ্যও একসাথে সম্পন্ন হয়। এর জন্য উদয়নের নৃত্যশিল্পীরা অক্লান্ত অনুশীলন করেন, যার খন্ডচিত্র উদয়নের পক্ষ থেকে তাদের ফেসবুক পেজে প্রচারসূত্রে দেওয়া হয়ে থাকে। আমি নিজে আগে উদয়ন কলাকেন্দ্র পরিচালিত একাধিক উপস্থাপনা দেখেছি। কিন্তু ‘আজকের একলব্য’ সবার থেকে আলাদা। একটি অত্যন্ত আটপৌরে বিষয়কে এক দলগত উপস্থাপনার রূপদান করা নিঃসন্দেহে প্রসংশার দাবী রাখে। সব মিলিয়ে এক অবিস্মরণীয় সন্ধ্যা, নাচ যারা পছন্দ করেন তাদের মনে চিরজাগরুক হয়ে রইল।
নাটক ‘গর্তকন্যা’ কেমন লাগলো, জানালেন- সায়ন ভট্টাচার্য
মানবের গর্তযাপন রহস্য
বিশ্বায়ন কী? বিশ্বের আয়ন? মানে বিশ্বের চলন? নামে তো বুঝলাম ‘চলন’ আছে – কিন্তু সেই চলন কোথায় গিয়ে পৌঁছে দেবে মানব সভ্যতাকে, মানবের কী হবে গতি! বিশ্ব যদি প্রবেশ করে আমার মধ্যে – তাহলে মানসিক শূন্যতা, চিন্তার, শূন্যতা, ভাবনার শূন্যতা এসব তো থাকার কথাই নয়। কিন্তু ব্যাপারটা তো এমন হচ্ছেই না – বরং আরও বেশি করে মানুষ শূন্য পথের যাত্রী হয়ে উঠছে। অথচ যার হওয়ার কথা ছিল আলোর পথযাত্রী। রাত্রির বিষাক্ত বুকের উপর তার উন্মত্ত চুম্বনের নেশা কেন তাকে বিভিন্ন ধরনের ‘গর্ত’এর নির্মাতা করে তুলছে। খুঁজে দেখবো উত্তর । নিশ্চয়ই এমন অনেক মুহূর্ত চলতে থাকে এখনকার জীবনে যখন আপনি আর আপনার প্রিয় মানুষটি পাশাপাশি শুয়ে রিল্যক্স করছেন অথচ ল্যপটপ কিংবা মুঠোফোন আপনাদের হাতে সঙ্গ দিচ্ছ। প্রযুক্তিই কি গ্রাস করেছে সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্যের সমাজ জীবনকে? পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনকে আঘাত করছে না? অনেকগুলো মানুষকে একটা অন্ধকারে ঘরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে ‘থিয়েটার প্ল্যাটফর্ম’ নাট্যদলের লোকজন। মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কোনও মানুষ কে দেখাবে বলে – যেমন সেই ঘরের মধ্যে লুকিয়ে ছিল আরও একটা ঘর!
ছবি: নাটকের কিছু দৃশ্য
কে যেন একটা বসে আছে! অপেক্ষা করছে জালের ঘরে, একটা চৌকির উপর বসে অপেক্ষা করছে। সামনে তার চেয়ার পিছনে কালো দেওয়াল, ঘরের মধ্যে অনেকগুলো ঘর, সময়, পরিস্থিতি লুকিয়ে আছে। হঠাৎ কে একটা পাশে বসলো, এই কে …কে তুমি …. আর ওই যে নারী বলতে শুরু করলো “গর্তকন্যার গল্প। নির্দিষ্ট করে বললে গর্তকন্যার প্রেমের গল্প।” একটা গর্তের ভিতর শুরু হচ্ছে নাট্য, যেখানে মনটাই আমাদের নাট্যমঞ্চ। গল্পের ঢেউ উঠবে, আমাদের নিয়ে ভেসে যাবে। ফেনার মতো আছড়ে পড়বে সীমান্তরেখায় থাকা বাঁশরির মন। কোন সীমান্তে সে আছে? শ্রেণিচেতনায় আবদ্ধ থেকে ভাবলে হবে না, মনের সীমান্তে থাকা মানবের শ্রেণি কী ও কেমন – তার ধারনা তো একেবারেই অজানা। ভাবি কতটুকু? কে তৈরি করলো বাঁশরির মন? আস্তে আস্তে বাঁশরি ঘিরে ফেলছে সমাজের অধিকাংশ আত্মার উপস্থিতি। পৃথিবীতে এমন মেয়ে কি দেখা যায় না –
যে মিশতে চায় না, গল্প করতে চায় না, প্রেম করতে চায় না – শুধু চায় এক অপার একাকীত্বের মরুদ্যান যাপন। পুতুল খেলার চেয়ে ছোটবেলা থেকে গর্তের প্রতি টান তাকে করে তুলেছে পৃথিবীর কাছে অস্বাভাবিক।
ছবি: নাটকের কিছু দৃশ্য
এখান থেকেই দেবাশিস গল্পের চুলের মুঠি ধরে নাটকীয় মোড়টা তৈরি করবে – কে অস্বাভাবিক?-
বাঁশরি নাকি বাঁশরির সমাজ ?
বাঁশরি সুন্দরী কিন্তু পুরুষ ঘেন্না করে। বাঁশরি বই নিয়ে থাকে কিন্তু পড়াশুনায় ভালো না। কারা যেন গোটা
ঘরে ফিস্ ফিস্ ফিস্ করছে ….. আর বড় বড় বীভৎস মুখোশমানব এসে খবর দিয়ে যাচ্ছে কে অস্বাভাবিক। ঘটতে থাকে নানা নাটকীয়তা। আধুনিক সমাজ মানুষকে অনেকগুলো চোখ, অনেকগুলো কান খুলে দিয়েছে। খুলুন একটু সেগুলো বাঁশরির মা বলে,
– “দেখ, আমার বাঁ দিকের বুকের এখানটা কেমন লাল হয়েছে। মনে হয়, পোকা-টোকা কিছু কামড়েছে। এই দেখ ।”
– “আমি দেখে কি করবো? বাবাকে বলো।”
– সে কি বাবাকে কী বলবো! যেখানে সেখানে তো আর পোকা কামডায়নি, বুকে কামডে়ছে। মেয়েকে ছাড়া কাকে
দেখাবো?”
এই মা’ই তো বাঁশরি আর বাঁশরির বাবার অজান্তে রঙ্গনের সঙ্গে গভীর শরীরী সম্পর্ক তৈরি করেছিল। অন্যদিকে তার বাবা বাঁশরির গানের দিদিমণির গর্ভে সন্তান উৎপাদন করে বেশ সুন্দর সংসার পেতেছিল অন্য জায়গায়। এর জন্য তো মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হওয়ার কথা নিঃসঙ্গতা, কিন্তু গর্তকন্যার যে গোটা ঘরই হয়ে উঠলো একটা গর্ত। তাই তার আনন্দ। পরিবারের পারস্পরিক সম্পর্কগুলো ক্রমশই নড়বড়ে হয়ে যেতে শুরু করলেও বেশ দৃপ্ততার সঙ্গে কয়েক মুহূর্তের জন্য রঙ্গনকে কামের ফাঁদে ফেলে লোহার শাবল দিয়ে বিকলাঙ্গ করে দেয় সে। জেল হয়। আবার নতুন গর্ত। ধাবমান আধুনিকতার পেছনে ছুটতে গিয়ে মানুষ হয়ে পড়ে আত্মকেন্দ্রিক। মানুষের একা হয়ে পড়ার এই প্রবণতা তাকে অস্বাভাবিক নয়, জীবনের প্রতি লোভ সমাজকে অনেক বেশি অস্বাভাবিক করে দিয়েছে।
ছবি: নাটকের কিছু দৃশ্য
গর্তকন্যার চরিত্রে অর্পিতা ঘোষ এই নাট্যের মূল অলংকার ও বিস্ময়। চরিত্রের গোটা শরীরের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক সীমাহীন অসহায়তা, নির্জনতা – তার মনের মধ্যে যেন আরও তৈরি করেছে কৃষ্ণকায় মেঘ। উন্মাদ মনের হঠাৎ উচ্ছলতা, চলনের পারম্পর্যহীন গতি মস্তিষ্কের অসারতার তীব্র ছবি তৈরি হয় তার মধ্যে। একাধারে তার মগজে লুকিয়ে থাকা জীবনের ইতিহাস, তার রক্তে বয়ে চলা মা’কে খুনের অনুতাপ সতত
তার কুঁকডে় থাকা দেহ, চোখে মুখে ভয়ের অভিব্যক্তি যেকোনো মানুষকে স্তব্ধ করে দিয়ে সক্ষম। অর্পিতা ঘোষের অভিনয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তার সাবলীল মঞ্চের চলন, গোটা মঞ্চটা তার শরীরে মনে মিলেমিশে এক স্পন্দন হয়ে ওঠে। দেবাশিস যে ঘরের কাঠামোটি তৈরি করেছে, সেখানে অগুন্তি প্রপসের সঙ্গে ওই ছোট জায়গায় তার অভিনয়ের কাব্যময় কৌশল যেন আরও বিস্তৃত করে তুলছে নাট্য পরিসরটি। বাঁশরির মধ্যে যে একটি বিষাক্ত মন ঢুকে গেছে তার প্রকাশ পায় অর্পিতার কন্ঠস্বরের মোলাযে়ন উচ্চারণ তার সঙ্গে সাপের মতো তীক্ষ্ণ চোখের ব্যবহার। গা হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায় সেই তীব্রতার কাছে। দেবাশিসের মঞ্চ নির্মাণ ও সেই সঙ্গে কোরাস টিমের বিরাট ও বিকৃত মুখোশের ব্যবহার আমাদের বুঝিয়ে দেয় কোন অসহায় পরিস্থিতিতে অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম করছে এক একজন মানুষ। আধুনিক বাংলা অন্তরঙ্গ নাট্যের এক নতুন পথরেখা তৈরি করলো থিয়েটার প্ল্যাটফর্ম তাদের ‘গর্তকন্যা’ প্রযোজনাটির মধ্যে দিয়ে।
‘অনন্ত’ সিনেমাকে ঘিরে কিছু মন্তব্য করলেন- সুদীপ্ত নাগ
অনন্ত (২০২২)
পরিচালক – অভিনন্দন দত্ত
অভিনয়ে – ঋত্বিক চক্রবর্তী, সোহিনী সরকার
অনন্ত এই জীবন। অনন্ত ভালবাসা। সময়ের অপেক্ষায় কাটিয়ে দেওয়া যায় জীবনের দামি মুহূর্তগুলিকে ঝরা পাতাকে সঙ্গী করে।অনন্ত একটা ডেবিউ ফিচার ফিল্ম হিসাবে খুব একটা অসংলগ্ন কাজ নয়। ছবিটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত নিজস্ব ছন্দে দর্শককে টেনে রাখতে সক্ষম। দৈনন্দিন ঘ্যানঘ্যানে জীবনে কাব্যের ছোঁয়া হিসাবে সিনেম্যাটিগ্রাফি, আলোর ব্যবহার এবং মিউজিকের ব্যবহারে কাব্যিক ছোঁয়া তৈরি করেছেন পরিচালক।ঋত্বিক চক্রবর্তী এবং সোহিনী সরকারের ডায়লগ কম। তার জায়গায় নীরবতা এবং তাদের শারীরিক অঙ্গভঙ্গি, ফেসিয়াল এক্সপ্রেশান গোটা সিনেমায় কথা বলার চেষ্টা করেছে। নিঃসন্দেহে এটি যে ভীষণ চ্যালেঞ্জিং একটি দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই।
ছবি সৌজন্য: গুগল
বেশ, সিনেমাটির যে দিক গুলি ভাল লেগেছে আলোচনা করে নিলাম। এবার যেগুলি ভাল লাগেনি সেগুলি নিয়ে একটু বিশ্লেষণে যাওয়া যাক। সিনেমায় ইন দ্য মুড ফর লাভের লুজ ইন্সপিরেশান বা আসা যাওয়ার মাঝের মত শব্দ এবং কাব্যিক মুহূর্ত তৈরি করার প্রভাব আছে। অন্য ছবির প্রভাব থাকা খুবিই স্বাভাবিক ব্যাপার যতক্ষণ না সেটা একটু বেশি লক্ষণীয়। এই দিকটি যদি বাদও দিই তাহলেও ছবিতে এডিটিং-এর স্টাইলটি একটু সমস্যাজনক লেগেছে। যে জিনিসগুলি ইতিমধ্যেই দর্শক বুঝতে পারছে সেগুলিকে বিভিন্ন রকম প্রতীকি ব্যবহার করে বারবার বোঝানোটা কি দর্শককেই বোকা ভাবা নয়? অনবরত পুরনো ঘড়ির টিকটিক (নতুন কিছু নয় সময়ের রূপক হিসাবে), বারবার নদীতে পা ডোবানো এবং বালতিতে পা ডোবানো ক্রস কাটিংয়ের মাধ্যমে দেখানো, রোদ যে একটি বিশেষ ইঙ্গিত বহন করছে তা একটু বেশি বার অনেকরকম শট ইউজ করার মাধ্যমে বোঝানো, এগুলি সত্যি বলতে মোটেই খুব একটা সূক্ষ্ম রুচির মনে হয়নি। যখন একটি দৃশ্যের রূপক হিসাবে কিছু ব্যবহার হয় তখন বিস্তার তৈরি করার সুযোগ হারিয়ে যাওয়ার চান্স থাকে। মেয়েটি জলে পা ডোবাচ্ছে, শান্তি পাচ্ছে এর পাঁচ ছয় রকম আলাদা আলাদা ইন্টারপ্রিটেশান দর্শকের কাছে হতে পারে। কিন্তু শুধুমাত্র নদী দেখালে সেটা আর হয়না। সিনেমার সম্পাদনা নিয়ে অল্প আলোচনা হল। এছাড়া সম্পাদনা নিয়ে খুব একটা কিছু বলার নেই। যদি মোটের উপর ছবিটির ছন্দের কথা ধরি তাহলে কিছু স্লো-মোশানের দৃশ্য ছাড়া বেশ সুন্দর ভাবে দৃশ্য, শব্দ এবং সময়ের মেলবন্ধন ঘটেছে সাদামাটা দিনগুলির বিভিন্ন দিক তুলে ধরতে বা স্মৃতির কোনায় হাতড়ানো কিছু মুহূর্ত তুলে ধরতে।
ছবি সৌজন্য: গুগল
সিনেমার গল্পটি নিয়ে এবার একটু আলোচনা হোক। একজন বেকার ছেলে, মায়ের মৃত্যুর পর ভাড়াটে রেখে
চালায়। পরিবার না থাকায় জীবন থেকে অনেকটাই সরে এসে এক অলীক অবলম্বনের স্বপ্নে মশগুল। এই অবধি সত্যি বলতে বেশ ইন্টারেস্টিং।আর যে বন্ধুটি দিনরাত জ্ঞান মারে সেই চরিত্রটিও কন্ট্রাস্ট হিসাবে ভাল ম্যাচ। সমস্যাটা হল মেয়েটিকে নিয়ে। অ্যাবিউসিব অ্যালকোহলিক ফাদার নিয়ে যার জীবন দুর্বিসহ। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাবার পছন্দ করা মাতাল স্বামীকেই তাকে গ্রহণ করতে হবে। অথচ মেয়েটি স্কুল টিচার। আমাদের নায়কের ওই চার দেয়ালের চেয়ে মেয়েটির গণ্ডি একটু বেশি। সে জীবন সংগ্রাম করছে। নদীর স্বপ্ন দেখছে। এত সহজে সে হার মেনে নেবে প্রথমেই এটা সত্যি বলতে একটু অস্বাভাবিক লেগেছে। দ্বিতীয়ত বিয়ের রাতে দেহের বিসর্জন এবং তারপর দেহত্যাগ একটু যেন বেশি প্রভাব ফেলার একটা সুপরিকল্পিত চেষ্টা। তবে ডিরেক্টার বলতেই পারেন যে কল্পনা মেশানো গল্পে বাস্তবতার চেয়ে নিরাকার গভীরতা বেশি। অর্থাৎ , কোনও এক সময়ে অন্তরের মিলনের মত বিষয়ই এই সিনেমার মূল ভাবধারা।
ছবি সৌজন্য: গুগল
অনন্ত ছবিটির বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য দিক থাকলেও এটিকে কিছুটা ইন্টেল্যাকচুয়াল মাস্টারেবেশন মনে হয়েছে আমার। আমার পার্সোনালি মনে হয়েছে ছবিটির পেসের সঙ্গে লং, এক্সট্রিম লং শটস, মিনিমালিস্টিক ক্যামেরা ওয়ার্কের থেকে বেশি কার্যকর হতে পারত হয়ত। কিন্তু এই ছবির চ্যালেঞ্জিং দিক এই বিভিন্ন এক্সপ্রেশান বা ক্যারেক্টারদের কাছ থেকে তুলে ধরার মধ্যেই ছিল। সেদিক থেকে চেষ্টাটা ভাল এটুকুই বলব। অন্যদিকে চরিত্রগুলি বড্ড লিনিয়ার হয়ে গিয়েছে। আরেকটু বিভিন্ন শেডস রাখলে হয়ত আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্য হতে পারত। বিশেষত কোন চরিত্রেরই একটি বা দুটি দিক থাকেনা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্যদিক গুলি প্রকাশিত হয়। অনন্ত আমার দারুণ কিছু লাগেনি। তবে এরম মুড পিস অনেকের ভাল লাগতে পারে। এই ধরনের বিভিন্ন কাজ থেকেই ট্রু জেম পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে উঠে আসতে পারে। তাই পরিচালক এবং অভিনেতাদের শুভেচ্ছা একটি অফবিট ছবি করার সাহস দেখানোর জন্য ।
‘মহাভারত মাডার্স’ ওয়েব সিরিজের খুঁটিনাটি তুলে ধরলেন - বৃতা মৈত্র
রহস্য জটিল মহাভারত মার্ডারস-এ অর্ণব রায় একজন আমেরিকা প্রবাসী ভারতীয় লেখক, ব্লগার, পডকাস্টার। তাঁরই লেখা বেস্ট সেলার উপন্যাস ‘মহাভারত মার্ডারস’ অবলম্বনে একই নামে ওয়েব সিরিজ প্রযোজনা করেছে এসভিএফ এন্টারটেনমেন্ট। পরিচালনা সৌমিক হালদার। বাংলা সিনেমা জগতের অত্যন্ত প্রতিভাবান এই তরুণ–একাধারে সিনেমাটোগ্রাফার, প্রোডাকশন ডিজাইনার এবং কোরিওগ্রাফার। ওয়েব সিরিজের ক্ষেত্রে থ্রিলার বা ক্রাইম এক বহু চর্চিত বিষয় আজ। তবে, ‘মহাভারত মার্ডারস’-কে সেই প্রেক্ষিতেও খুব চেনা কিন্তু মনে হয় না। বরং বেশ জটিল এক বিষয় রূপে উপলব্ধ হয়। আর এমন এক বিষয়কে পর্দায় সঠিক
ছবি সৌজন্য: গুগল
অর্ণবের কাহিনির মুখ্য চরিত্রটি এক ইতিহাস থুড়ি পুরান প্রসিদ্ধ খলনায়কের ছায়া অবলম্বনে সৃষ্ট।মহাভারতের ধারা মেনেই নিজেকে দুর্যোধন মনে করে সে। তার টার্গেট এমন কয়েকজন, যারা তার দৃষ্টিভঙ্গিতে পাণ্ডব। শুধু পাণ্ডব নয়, দ্রৌপদীর সঙ্গেও হিসেব মেলাবে সে। দুর্যোধনের সঙ্গে তো পাণ্ডবদের শত্রুতা সেই মহাকাব্যের কাল থেকে। আর দ্রৌপদী, সেই স্বয়ম্বর সভার অপমান? সেও তো দুর্যোধন ভোলেনি আজও।পাঠক বুঝতেই পারছেন,এই সবই ঘটনার ভিতরের ঘটনা। সেটা বুঝতে অনেকটা সময় লেগে যায় তদন্তকারী টিমের। একের পর এক খুন হয়।অর্থাৎ কেসটা সিরিয়াল কিলিংয়ের। আর প্রতিটি খুনের প্লটে রয়েছে মহাভারতের কোনও না কোনও অনুষঙ্গ।
ছবি সৌজন্য: গুগল
ইনভেস্টিগেটিং অফিসার রুকসানা এবং সিদ্ধার্থ এই খুনগুলির তদন্তে নেমেছে। তারা রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করতেই একের পর এক টুইস্ট। আধুনিক সময়ের কুরুক্ষেত্র যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে দর্শকের সামনে।প্রতীকী অর্থে অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত মেজাজে নতুন কালের মহাভারত বর্ণিত হয় ওয়েব পর্দায়।অর্ণবের লেখার পরতে পরতে যে সাদা-কালো-ধূসরতা আছে, তাকে নিপুণ ছন্দে নিয়ে আসেন সৌমিক। জটিল এক অপরাধী মন। তাকে খুঁজে বের করা সহজ নয়। রুকসানা-সিদ্ধার্থ কী করবে? তারাও কীমনস্তাত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখবে? তদন্তে কী কী উঠে আসে আর কে এই প্রতিশোধ নাটকের পিছনে দুর্যোধনের ভূমিকায়, সেটা জানতে অবশ্যই আপনাকে দেখতে হবে এই সিরিজ।
ছবি সৌজন্য: গুগল
‘মহাভারত মার্ডারস’ এর অভিনেতা টিমের কথা পৃথকভাবে বলতে হয়। রুকসানার চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রিয়াঙ্কা সরকার। তিনি আজ আপন ক্ষমতাবলেই নানা ধরনের চরিত্রে নিজের দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন।বড় পর্দা থেকে ওয়েব সিরিজ–প্রিয়াঙ্কা লা জবাব। পাশাপাশি অর্জুন চক্রবর্তী।সিদ্ধার্থর ভূমিকায় তাঁর স্মার্ট উপস্থিতি ভালো লাগে। বেশ ভিন্ন স্বাদের এক চরিত্রে আছেন বাংলা বিনোদন জগতের অপরিহার্যনাম শ্বাশ্বত চ্যাটার্জি। রাজনৈতিক নেতা পবিত্র চ্যাটার্জির ভূমিকায় দুর্দান্ত তিনি। অন্যান্যদের মধ্যে অভিনয় করেছেন ঋষভ বসু, রাজদীপ গুপ্ত, সুদীপ মুখোপাধ্যায়, দেবাশিস মণ্ডল প্রমুখ ও একটি ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে কৌশিক সেন। বলা বাহুল্য, অভিনয়ে এঁরাও কেউ কম যান না। ১২ পর্বের এই সিরিজ
দেখানো শুরু হয়েছে গত মে মাসে। প্রতি পর্বের সময়সীমা ২৫ মিনিট।
ছবি সৌজন্য: গুগল
আগেই বলেছি অভিনব ভাবনা। প্রতি পর্ব এগিয়েছে টানটান রহস্যে। ফলে তীব্রতর হয়েছে দর্শক আকর্ষণ। আদতে সৌমিক কাজটাই করেছেন এক শক্তপোক্ত কাঠামোয়। কৃতিত্বের ভাগীদার হবেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য এবং সৌগত রায়ও–ওঁরা দুজনে মিলেই লিখেছেন চিত্রনাট্য ও সংলাপ। কস্টিউম, মেকআপ, সেট ডিজাইনিং, মিউজিক থেকে শুরুর মন্তাজ–সবটাই খুব স্মার্ট। একেবারে মেদহীন এর চিত্রনাট্য। প্রথম পর্বগুলিতে মনে হবে, লোকটি এমন পর্যায়ে নিষ্ঠুরতা কেন করছে? এই হত্যার পিছনে কী তার উদ্দেশ্য! তারপর উঠে আসবে মহাভারত অনুষঙ্গ। পর্বের সময়সীমা কম থাকাটা প্লাস পয়েন্ট হয়েছে সিরিজের ক্ষেত্রে। লোকজন দেখার পরও ভাবছেন, কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে! খুন ছাড়াও ‘মহাভারত মার্ডারস’-এ আছে ড্রাগচক্র, নীল ছবির ব্যবসা ও অন্যান্য অপরাধ।
ছবি সৌজন্য: গুগল
থ্রিলারের যাবতীয় অনুষঙ্গ বজায় রাখার পাশাপাশি চরিত্রগুলি বিন্যস্ত করার ক্ষেত্রে বাড়তি ভাবনা যুক্ত করা হয়েছে। যার ফলে, দর্শকরাও তাঁদের ভাবনার খোরাক পেয়ে চলেছেন অবিরত। মনস্তত্ত্বের একাধিক স্তরে এই অপরাধীর বিচরণ। তাকে খুঁজে বের করা অসম্ভব মনে হতেই পারে। কিন্তু বসে নেই সিদ্ধার্থ-রুকসানাও। তারাও প্রতি পদক্ষেপে নতুন নতুন সূত্র খুঁজে বের করছে। সব মিলিয়ে জমে উঠেছে ‘মহাভারত মার্ডারস’! হইচই দর্শক আপাতত বুঁদ একালের এই মহাকাব্যিক থ্রিলারে করেন তিনি।