magazines

পঁয়ত্রিশতম সংখ্যা || ছাব্বিশতম ই-সংস্করণ || মার্চ ২০২৩

পঁয়ত্রিশতম সংখ্যা ||  ছাব্বিশতম  ই-সংস্করণ || মার্চ ২০২৩

ভাণ পত্রিকা

পঁয়ত্রিশতম সংখ্যা || ছাব্বিশতম ই-সংস্করণ || মার্চ ২০২৩

সম্পাদক :

সম্পাদনা সহযোগী :​

প্রচ্ছদ :

নক্সা পরিকল্পক :

অন্যান্য কাজে :

ভাণ-এর পক্ষে:

পার্থ হালদার

কর্তৃক

৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬

( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )

৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) bhaan.kolkata@gmail.com ( ই – মেল ) ​

Reg. No : S/2L/28241

সূচি

সম্পাদকের কথা

মনে হবে বুঝে গেছি, না বোঝার আছেটাই বা কী ! অথচ তাঁর এমনই লীলা মোটে কিছু বুঝিনি। বুঝিনি যে, সেটা না বোঝার জন্য,- পরিস্থিতি ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। বুঝেও না বোঝা, বোঝার বোঝা, বেশি বোঝা, ছেঁড়া ছেঁড়া বোঝা, বুঝে বুঝদারের মতো সে বোঝা রেখে পালিয়ে যাওয়া ইত্যাদি কম বোঝাপড়ার মধ্যে প্রতিদিন আমাদের কাটে না! বোঝার ভারে ন্যুব্জ মানুষ গান ধরে ” এখন সন্ধ্যা বেলা কোলের ছেলে কোলে তুলে নে মা”
কিন্তু তাতে মায়ের বোঝা কতটা বাড়ে, সে কথা মালুম করে কজন? কোটি কোটি আদদামড়া ছেলে যদি কোল চায়!!

ভারতবর্ষের গরিব গুর্বো অন্ত্যজ জন জাতির মুখের পানে চেয়ে বুঝেছি, একটি কথাই তারা বোঝাতে চায় যে, দেখো বাপু আমি কিছু বুঝিনি , না বোঝাটাই আমাদের পরম্পরা। সেখান থেকেই লাভের গুড় মন্থন করে মোড়ল মাতব্বর ফোড়ে দালালদের জন্ম । জন্ম সমকালীন পলিটিক্সের। জন্ম বহু কবিতারও । কবিগুরু লিখলেন ” সেই সব মূঢ় ম্লান মুখে দিতে হবে আশা/ ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা” সেকথা ছেঁড়া ছেঁড়া বুঝে আমাদের সরকার বাহাদুর জুতো ছাতা সাইকেল ইত্যাদি দিচ্ছেন। তাও আবার মুফতে নয়, ভেট হিসেবে ভোট দিচ্ছে বেঁধে। নাদিলে রামের নামে যতই আপত্তি থাক না কেন,রাম ক্যালানি মাস্ট। এটা যে খুব একটা জুতসই আশার কথা নয় তাই বা বুঝছে কয়জন?

যাগ্গে যারা বোঝেন না, একথা নির্দ্বিধায় বোঝেন,- সেই অসীম সৎ মানুষের কথা আমরা আপাতত তুলছি না। কান্ট হবস লক ঘেঁটে বুঝতেও চাইছি না মানুষ আদতে কী চায়, কীভাবে চায় অথবা কোন পানে চাওয়াকে সবচেয়ে গুরুতর ভাবে! বরং বুঝতে চাইছি আমরা যারা “বুঝে গেছি” মুখ চোখ নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছি তাদের নিয়ে।
মাস্টারি করতে গিয়ে বুঝেছি একটা বড় অংশের মাষ্টারদের বোঝাবুঝি একতরফা। ছাত্র পড়ে না, ছাত্র আসে না, ছাত্র বোকা, ছাত্র বোঝে না! ভাবটি যেন -হা ঈশ্বর, দিতে চাই নিতে কেহ নাই! আচ্ছা ছাত্র কেন আসে না, কেন বোঝে না, কেন মন দেয় না!- এই ‘কেন’একটা উঁচু দরের রাজনীতি। কিন্তু আমি তো শিক্ষক। রাজনীতি করি না। আমি তো ব্লক সভাপতি নই। আমার খাটের নিচে টাকা নেই। আমি কেন ভাববো, আমি তো দেশ চালাই না। আমি বুঝলে কার তাতে কী! এ তো ফলাফল হীন চরৈবেতি! আমি আমার চালাকি তলিয়ে বুঝেছি, এতো ভাবলে সত্যি টা বুঝে যাব। সে বোঝা জ্বালাবে। আমি একজন গণ্যমান্য, আমি কেন জ্বলবো?! আলোকায়নের প্যাচালো যুক্তির যে মুক্তি নেই, একথাটিও বোঝে কয়জনা??!

আমরা যারা বুঝতে পারি, সেই পারার মধ্যে একটা স্বার্থের পোকা সুযোগ সন্ধানীর মতো পাক দিতে থাকে। কতটুকু কীভাবে বুঝলে সে স্বার্থ ( মূলত শ্রেনি স্বার্থ ) অক্ষত থাকে। শৃঙ্খলিত থাকে প্রতিদিনের সুখ এবং ভবিষ্যতের সমৃদ্ধি, সে গণ্ডি আমরা সচরাচর ছাড়াই না। যেমন এক শিক্ষক বুঝলেন গেরুয়া পার্টি মোটের ওপর প্রতিক্রিয়াশীল, বিভেদকামী, ধর্মের নিষ্ঠুর ব্যবসাদার। তারপরও তিনি গেরুয়াতেই ভোট দিতে চান। ডিএ এর জন্য। তার স্থির বিশ্বাস এই টুকু ইয়ে, ডিএ এর জন্য করা চলে। একে কীভাবে যে বুঝবো, বুঝতে বুঝতে কত যে নামব,-সে কথা বোঝে কয়জনা!? হয়ত এ কারণেই ম্লান মুখে আশা দেওয়া আর হল না। আমার স্থির বিশ্বাস উক্ত শিক্ষক রবীন্দ্রনাথের কবিতা খানা আবৃত্তি করতে গেলে বুঝদার আবেগে কেঁপে কেঁপে ওঠাতে কোনো ফাঁকি রাখবেন না!

কোন আশাতে আজকের ডিগ্রি কলেজের এক সাধারণ ছেলে সিলেবাসে মন লাগাবে যখন পরীক্ষার ও.এম. আর শিটের ৯৮ শতাংশ জ্বাল বেরোয়। যোগ্য প্রার্থীরা অনশনে কেঁদে কঁকিয়ে রাস্তা দাপিয়ে পুলিশের মাসিক ক্যালানি খায়! যে সরকার এই অপকর্ম করবে, যখন সে ছাত্র দেখবে, সেই সরকারের পা চেটে চলেছেন শিক্ষক ডাক্তার উকিল মোক্তার কবিয়াল ছবিয়াল – পিলারস অব দ্যা সোসাইটির একটা বড় অংশ। এই প্রজন্ম কেন চঞ্চল হবে, কথা রাখবে না, সত্তরের গদগদ প্রেমের প্রতি ছুঁড়ে দেবে না তাচ্ছিল্য?- কেননা তার ইউনিভার্সিটির ভিসি ঘুষখোর, শিক্ষা মন্ত্রী চুরির দায়ে গাম্ভীর্যতার সঙ্গে জেল বন্দী। সে ছাত্র পরীক্ষা কবে হবে জানতে পারে মোটে হপ্তা খানেক আগে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথারা ইডি সেবি ভয়ের মাঝেও ভয়াল লোল জ্বিহা নিয়ে ব্যস্ত যে! মাঝ রাতে রেজাল্ট বেরোয়, ভোর বেলা সে রেজাল্ট তুলে নেওয়া হয়। এই পরীক্ষা, এই নেই। এই বিশ্ববিদ্যালয় আইনী ওই বেআইনি। এই বিএড সৎ, ওই বিএড জ্বালি। ইন্টারভিউ দিলে ফেল, না দিয়ে চাকরি। এই রেজাল্ট, এই হাওয়া। এই নেতা এই ছাতা। এই ঘাস ওই পদ্ম!!
বাবার তিরিশ হাজার রোজকারে কোনোমতে টেনেটুনে চলত সংসার, তেলের দাম, গ্যাসের দাম দ্বিগুণ হল।ওদিকে বাপের রোজকার কমে হল আধা। বুড়ো বাপের খাটনি বাড়ল! তবু আমার ছাত্র উদ্দেশ্য হীন, উচ্চশিক্ষিত বেকার বনতে, কেন মন প্রাণ দিয়ে স্থির হচ্ছে না লেখাপড়ায়, তাই নিয়ে আমাদের কী বিপুল ভুল বোঝা!! দেশের বাবাদের অস্থিরতার অবাধ্য জিন নিয়ে ঘুরছে ওরা। এই প্রজন্ম ঘেন্না জমাচ্ছে প্রতিদিন।যেদিন সুনামির মতো আছড়ে পড়বে সে ঘৃণার পাহাড় আমাদের রোমান্টিক সাজানো বাগানে, নাছোড়বান্দা বোঝাপড়া হবে সেদিন, সন্দেহ নেই। ব্যক্তিগত ভালো বাঁচা বড় অর্থে ভালো সময়ের কাছে ঋণী, রাজনীতির মহা আখ্যান ব্যক্তিজীবনে কী অসহ্য অসহায়তা আনতে পারে,- একথাটিই বা ঢোকে কজনের ঘটে!?

গরিবের পার্টির প্রগলভ বাচাল ছেলেটি মনে করে গরিব-টরিব বুঝে গেছে। গরিব তাকে না বুঝলে সে গরিবের অদৃষ্ট । ঘরের বর ভাবছে শাড়ি গয়না যথেচ্ছ দেওয়ার পর মনমরা বৌ, বৌ এর কপাল। বাবা ভাবছেন ঘুষের টাকা জোগাড় করে যে ছেলের হাতে তুলে দেওয়া গেল না এ তার কপাল।
ঠাম্মা ভাবছে চাকরি পেয়েও যে চলে গেল এ নির্ঘাত কর্মফল।একেবারে সহজিয়া মনের সহজাত অনুভব !! ঔপন্যাসিক চাদ্দিন বীরভূমের হোটেলের এসি রুমে থেকে সাঁওতাল মন বুঝে ফেলেছেন ।কিন্তু এতই কি সোজা হে বাপু । তোমার আমার এই যে বোঝা ,নিতান্ত নয় সোজাসরল,বোঝার গভীরে হাজারো অঙ্ক । সে অঙ্ক বোঝার সাধ্য কজনের ??

‘জাহানাবাদ’ সিরিজের আনাচে-কানাচে ঢুঁ মারলেন - বৃতা মৈত্র

সন্ত্রাসের বাতাবরণে প্রস্ফুটিত প্রেম:বৃতা মৈত্র

সাল ২০০৫। পটভূমি বিহারের ছোট এক শহর জাহানাবাদ। প্রেক্ষিত নকশাল আন্দোলন, যাকে প্রশাসন ঘোরতরভাবে সন্ত্রাসবাদ আখ্যা দিয়েছে। শ্রমজীবি মানুষের অধিকারের লড়াই কবে, কীভাবে সন্ত্রাসবাদের চেহারা নেয় বা কোথায় কে, কীভাবে বিষয়টিকে চিহ্নিত করে সন্ত্রাসবাদ রূপে–সেসব গভীর তর্কের বিষয় ! এখানে তার অবকাশ নেই। আর ওয়েব সিরিজ সম্পর্কে পড়তে গিয়ে পাঠকই বা কেন সেসব তাত্বিক আলোচনায় আগ্রহী হবেন ! তবে, একটা কথা উল্লেখ প্রয়োজন, ফিকশন হলেও ঐতিহাসিক (এবং রাজনৈতিক) প্রেক্ষিতগুলি যথাসম্ভব সততার সঙ্গে প্রকাশ করা নির্মাতাদের নৈতিক দায়িত্ব। একথা বলা যায়, ফিকশনের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে আর যাই হোক, ‘জাহানাবাদ-অফ লাভ এন্ড ওয়ার’-এর নির্মাতারা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে সস্তা নাটকে পরিণত করেননি। 
সৌজন্যে  : সোনি liv 
ঘটনাপ্রবাহ এইরকম–জাহানাবাদের শান্ত, নিরুদ্বেগ পরিবেশে এই মুহূর্তে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা। কারণ, কুখ্যাত নকশাল নেতা দীপক কুমারকে তার দলকর্মীদের একটি বড় অংশ পরিকল্পনা করছে জেল ভেঙে বাইরে আনার। জাহানাবাদের এই জেলখানা তখন দেশের মধ্যে বৃহত্তম। অর্থাৎ, দীপক কুমারকে বের করে আনার অপারেশনটি ছিল বেশ বড়সড় এক পদক্ষেপ ! এমন এক পরিপ্রেক্ষিতে অশান্তির ঝড় তো উঠবেই ! এরই পাশাপাশি আমরা দেখতে পাই দুটি মানুষের মধ্যে ভালোবাসার ফুল ফোটার বৃত্তান্ত। এলাকার কলেজের অধ্যাপক অভিমন্যু সিং এবং ছাত্রী কস্তুরী মিশ্রর মধ্যে সম্পর্ক এগিয়ে চলে প্রেমের পথে। চিরন্তন জাতপাতের রাজনীতি নিয়ে উস্কানিমূলক ঘটনা ঘটায় ছাত্রনেতা সূরজ সিং। এই সূত্রেই সে এবং প্রফেসর অভিমন্যু একে অপরের মুখোমুখি। কস্তুরীর সঙ্গে অভিমন্যুর আলাপও এই প্রেক্ষিতেই। 
সৌজন্যে  : সোনি liv 
এইসব যখন চলছে, তখনই নিহত হয় প্রদীপ কুমার নামের এক ব্যক্তি। এই মৃত্যুকে ঘিরে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায় গোটা শহর। একদল মনে করে, এটি অতি তুচ্ছ ব্যাপার। সন্ত্রাসের প্রেক্ষিতে এমন তো ঘটবেই ! অপরপক্ষের মতে, এটি অত্যন্ত নিষ্ঠুর এক খুনের ঘটনা। তারা বিচার চায়। চায় প্রতিকার। এলাকায় সন্ত্রাস তীব্র আকার ধারণ করে। যার প্রভাব প্রবলভাবে পড়ে সাধারণ মানুষের জীবনে। প্রেম, ধ্বংস, পরাজয়–ঘৃণা, ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা–কাহিনি আবর্তিত এই সবকিছু নিয়েই। যে প্রশ্নটি বারবার উঠে আসে–প্রেম, মানুষের স্বাভাবিক ধৈর্য্য, সহনশীলতা, স্থিতি–এই বিষয়গুলিরই জয় হবে নাকি খুনখারাপি আর সন্ত্রাসের মাঝখানে জেরবার হবে তাদের জীবন ? 
 
কী আছে জাহানাবাদের মানুষের ভাগ্যে–দেখুন ‘জাহানাবাদ-অফ লাভ এন্ড ওয়ার’, সোনি লিভ-এর পর্দায়। আদ্যন্ত অপরাধ-নির্ভর এই থ্রিলারের কাহিনি, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন রাজীব বার্নওয়াল। পরিচালনা রাজীব বার্নওয়াল ও সত্যাংশু সিং। ‘জাহানাবাদ-অফ লাভ এন্ড ওয়ার’ নির্মাণের মুখ্য ও নেপথ্য কারিগর (শো রানার), তিনবার জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী ‘হাজারো খোয়াইশে এইসি’ খ্যাত পরিচালক সুধীর মিশ্র। প্রসঙ্গত, নকশাল আন্দোলনের বিষয়টি এর আগে সুধীরের সিনেমাতেও পেয়েছি আমরা।
সৌজন্যে  : সোনি liv
প্রযোজনা স্টুডিও নেক্সট। ১০ পর্বের প্রথম সিজন স্ট্রিমিং শুরু হয়েছে গত ৩ ফেব্রুয়ারি। এক একটি পর্ব ৩৫-৪০ মিনিট সময়সীমায় বিন্যস্ত। অভিনয়ে আছেন ঋত্বিক ভৌমিক (অভিমন্যু সিং), পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় (দীপক কুমার), হরষিতা গৌর (কস্তুরী মিশ্র)। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আছেন রজত কাপুর, সত্যদীপ মিশ্র, সুনীল সিং, সোনাল ঝা, রাজেশ জৈশ ও শিখা চৌহান প্রমুখ। পরমব্রত সম্ভবত এমন কঠোর, কঠিন নেগেটিভ রোলে এর আগে অভিনয় করেননি। আমি অন্তত তাঁকে এমন ভূমিকায় দেখেছি বলে মনে পড়ে না। কেরিয়ারের এমন প্রান্তে এসে নিজেকে নিয়ে ভাঙ্গাগড়ার কথা ভাবতেই পারেন তিনি। বাকি বিচার দর্শকের হাতে।
 
 

নারীবাদের উল্টো পিঠের সঙ্গে পরিচয় করালেন - শৈলী চক্রবর্তী

 
শৈলী চক্রবর্তী 

 

*Feminism to Fame-In-Ism*
 
“সময়ের ঘষা লেগে শিলালিপি যায় ক্ষয়ে ক্ষয়ে” —
 
শিলালিপির কথা জানিনা, তবে নীতি, মূল্যবোধ সময়ের কালচক্রে ক্ষয়েই যাচ্ছে। কেবল পড়ে আছে কিছু চিরন্তন সত্য যা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই।খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের পর আসে ক্ষমতা ও খ্যাতির লড়াই। ক্ষমতা যদিও মুষ্টিমেয় কিছু জায়গায় সীমাবদ্ধ, কিন্তু খ্যাতির ব্যাপ্তি অনেক বেশি। আর এই খ্যাতির মোহ এমনই এক জিনিস, যা পাওয়ার আশায় মানুষ জীবনের আসল অর্থ ভুলে যায়। আমরা যারা উদার অর্থনীতির by-product, জেনে এলাম জোর যার মুল্লুক তার। আদতেই পয়সাকে তার মূল্য হারিয়ে, কড়কড়ে নোট টু ক্রিপ্টো কারেন্সির যাত্রা সম্পন্ন করতে দেখলাম। 
আর শিখলাম, মূহুর্তকে উপভোগ করতে হবে না, সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইক, শেয়ার যত বেশি, তোমার জীবনযাত্রার মান তত উন্নত। আর এ’ভাবেই হারিয়ে গেল একটা গোটা দশকের কিছু বেশি সময়। তৈরি হলো এমন এক সভ্যতার, যেখানে আমরা জানলাম অন্যকে সাহায্য করতে হবে, সোশ্যাল মিডিয়ায় জানানোর জন্য। খ্যাতির নেশা সর্বনাশা। আর এই সর্বনাশের নেশায় মাতোয়ারা আমরা কমবেশি সকলেই। 
 
সমানাধিকার ও নারীবাদের নীতি নিয়ে যে যুদ্ধ চলছে তা পরিণত হয়েছে কূটনৈতিক ছায়া যুদ্ধে। অর্থাৎ তুমি যদি মেধা, বুদ্ধি বা অন্যান্য আঙ্গিকে দক্ষ হও তবেই তুমি সামনের সারিতে বসার সুযোগ পাবে। আর পান থেকে চুন খসলেই হবে খিল্লির পাত্র। চলতি ভাষায় ‘ট্রোল’। যে মেয়েটি অফিস, সংসার সামলে বছরে একবার হলেও ট্রেক করেন, আর যে মহিলা সেলাই করে সংসার চালান, তাঁদের দক্ষতার তুল্যমূল্য বিচার করার মধ্যে যে কোনো বাহাদুরি নেই, তা ভুলতে বসেছি আমরা। আর এই সমাজব্যবস্থা তৈরি হয়েছে এক বিশেষবর্গের বুদ্ধিজীবী শ্রেণির জন্য। এই প্রজাতি, মাছের ঝোল থেকে রক এন্ড রোল সব বিষয়ে পারদর্শী। সুন্দরবনের বন্যা থেকে সাগরপারের যুদ্ধ সব বিষয়ে তাঁদের প্রগাঢ় জ্ঞান। নিজেদের প্রগতিশীল বলে দাবি করা এই জাতির মতামত যদি একটুও খুঁটিয়ে দেখা যায়, দেখতে পাবেন মধ্যযুগীয় বর্বরতা সমানভাবে বিরাজমান। এক পা এগিয়ে, দুই পা পিছনে যাওয়া এই সমাজব্যবস্থা যে কীভাবে নিজেদের সভ্য সমাজ বলে দাবি করে, সেই বিষয়ে এক বিরাট প্রশ্নচিহ্ন থেকে যায়। 
মারণাস্ত্র এখন শুধুমাত্র পারমাণবিক বোমা নয়, আসলে শব্দ এখন আসল অস্ত্র। এর প্রয়োগ সঠিকভাবে না করলে সমাজ ধ্বংস হবে অচিরেই। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমরা কোন সমাজের অঙ্গীকার করছি তা ভেবে দেখার সময় এসে গেছে।

সদ্য প্রয়াত, ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়কে নিজের কৈশোরের স্মৃতি দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করলেন - বিতান দে

ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় ও এক টুকরো কৈশোর :বিতান দে
 
বয়স তখন ছিল পনেরো, তাই স্বপ্ন দেখার ব্যারামে ভুগতাম কমবেশি। অবশ্য ১৫ বললে ভুল হবে, তার খানিক আগে থেকেই সেই স্বপ্ন দেখার শুরু। কী সেই স্বপ্ন? বাড়ির বুক সেল্ফে সাজানো থাকবে পাণ্ডব গোয়েন্দার পুরো সেট। নিছক খামখেয়ালে নয়, এক অদম্য ভালোলাগা ছিল ওই পাঁচ প্লাস এক চরিত্রের উপর। বাবলু, বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্চু এবং পঞ্চু, ওরফে কানা পঞ্চু। পাঁচজন মানুষ এবং একজন মনুষ্যতর জীব। কী যে ভালো লাগতো এদের অ্যাডভেঞ্চার! পাণ্ডব গোয়েন্দা আমি প্রথম দেখি আমার এক দাদার বাড়িতে, একটু উল্টেপাল্টেই বাড়িতে এসে বাবার কাছে বায়না, কিনে দিতে হবে। প্রথম ছ’টা খণ্ড যতদূর মনে পড়ছে নিউ বেঙ্গল প্রেস থেকে প্রকাশ পেত। সাত থেকে শেষ খণ্ড পর্যন্ত প্রকাশ করতো আনন্দ পাবলিশার্স। স্বপ্নপূরণ হয়নি, বিক্ষিপ্তভাবে এক-একটা খণ্ড কিনে পড়েছি। ২১ নম্বর খণ্ডের খল চরিত্রের কথা এখনও বেশ মনে আছে। লোকটার নাম ছিল প্রিন্স, গল্পটা সম্ভবত চন্দনকাঠ চুরি বা পাচার নিয়ে এবং যতটা মনে পড়ছে, অদ্ভুতভাবে প্রিন্স শেষপর্যন্ত নিজে একা হয়ে যায়, একেবারে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন। যে বয়সে পাণ্ডব গোয়েন্দা পড়ছি, সেই বয়সকে বয়ঃসন্ধির সময় বলা চলে। নিজে বারো ক্লাস পর্যন্ত বয়েজ স্কুলে পড়েছি, তাই বান্ধবীদের সান্নিধ্য একেবারেই ছিল না। টিউশনে যেটুকু ছিল তা তথৈবচঃ।
পান্ডব গোয়েন্দা শ্রষ্ঠা: ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় 
টিম পাণ্ডব গোয়েন্দা, পাঁচজন কিশোর-কিশোরী, স্রেফ বন্ধু। তাদের মধ্যে কোথাও নিজেদের ভিতর সামান্য ভালোলাগা বা পছন্দ হওয়ার আঁচটুকুও পাওয়া যায় না। এইটে কি খুব স্বাভাবিক? অবশ্য পাণ্ডব গোয়েন্দার সব কাহিনি আমি পড়িনি, তাই আমার পড়া কাহিনিগুলোর মধ্যে থেকেই এই প্রশ্নটা উঠে এসেছিল। তারপর নিজেরই মনে হয়েছে, হয়তো সচেতনভাবেই একটা বয়সের কথা মাথায় রেখেই এই বিষয়ে কোনো দৃষ্টিভঙ্গির আলোকপাত ঘটাননি লেখক। বয়সের কথা বললাম কারণ ওই বয়সটাই যে ‘উচ্ছন্নে যাওয়ার বয়স’ এমনটা ততদিনে জেনে গিয়েছিলাম পারিপার্শ্বের প্রভাবে। 
 
পাণ্ডব গোয়েন্দা আমার কিশোর বয়েসের বেড়ে ওঠার সঙ্গী। একে আদৌ কতটা গোয়েন্দা কাহিনি বলা চলে, এর মধ্যে থেকে কোনো ‘সো কলড প্রেম’ উঠে আসে কি না—এই নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে, হবে। কিন্তু সবকিছুর পরেও আমি ভুলতে পারব না, পঞ্চু কেবল কানা, এইটে কী ভীষণ মনখারাপ তৈরি করত আমার মনে। কোনো অভিযানে পঞ্চুকে ফিল্ডে কখন পাব, এই নিয়ে মনের ভিতর একটা উত্তেজনা কাজ করত গল্পগুলো পড়তে পড়তে। এরসঙ্গে থাকত বইগুলোর অপূর্ব সব প্রচ্ছদ। অবশ্য নিউ বেঙ্গল থেকে প্রকাশিত বইগুলোর প্রচ্ছদ ভালো লাগতো না। পাঁচজনের ছবি, পাশে একটা কুকুর এবং প্রতিটা খণ্ড আলাদা আলাদা রঙের।
আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত খণ্ডগুলো অনেকসময় কেবল প্রচ্ছদের কারণেই কিনে এনেছি, এমনও হয়েছে। অল্পকিছু কথা বলা গেল এই সীমিত পরিসরে, উপলক্ষ্য একটা রয়েছে তো বটেই! আমাদের কিশোরবেলার একজন রূপকার, ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় চলে গেলেন। এই পাণ্ডব গোয়েন্দার সু-বাদে নিজেই কখন পঞ্চ-পাণ্ডবের এক হয়ে উঠতাম, বুঝতে পারতাম না। অনেক স্মৃতি, তার সামান্য কিছু টুকরো মনে পড়ে খুব। ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর পাণ্ডব গোয়েন্দাকে ভুলি কী করে!
 

যাপিত নাট্যের নবম কিস্তি লিখলেন - কুন্তল মুখোপাধ্যায়

 যাপিত নাট্যের নবম কিস্তি:কুন্তল মুখোপাধ্যায়
 
আমার ছাত্র জীবন, বিশেষ করে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট – পোষ্ট গ্র্যাজুয়েট পড়ার সময় কলেজ স্ট্রীটের সঙ্গে শুরু হ’ল প্রেমপর্ব। যদিও আমি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়তাম তবুও প্রেসিডেন্সীর রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি বিভাগের নিজস্ব পাঠাগারের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক ধ্রুব পাল ও স্যার অমল মুখোপাধ্যায় এর সৌজন্যে আমি প্রেসিডেন্সীর লাইব্রেরীও ব্যবহার করতে পারতাম, এমন কি দু-চারটে ক্লাসও করেছি। ওই সময়ই প্রথম দেখি মহীনের ঘোড়াগুলির স্রষ্টা গৌতম চট্টোপাধ্যায়কে, যদিও তখন তিনি কলেজ ছেড়ে দিয়েছেন তা সত্ত্বেও মাঝেমাঝে কলেজস্ট্রীট চত্বরে দেখা মিলতো এই সময়ই ১৯৭৪ সালে কাউন্সিল ফর পোলিটিক্যাল স্টাডিজের ছাত্র ইউনিট একটা ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট ফোরাম গঠন করে, যার মূল হোতা ছিলেন সেই সময়ের প্রখ্যাত গণসংগঠনের নেতা মন কুমার সেনের ছেলে ভাস্কর দা। অন্য সদস্যরা প্রায় সবাই পোস্ট গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট, আমি পোস্ট গ্র্যাজুয়েটে ঢোকার অপেক্ষায়। আমাকে মৃণাল সেন  ও উৎপল দত্ত’র সাক্ষাৎকার গ্রহণের দায়িত্ব দেওয়া হল। আমি অশোক মুখোপাধ্যায়ের সহায়তায় একটা প্রশ্নমালা তৈরি করে, দুজনের সঙ্গেই আগে থেকে সময় স্থির করে দুই ভিন্ন ভিন্ন দিনে সাক্ষাৎ করা ধার্য করলাম। মৃণাল সেন তাঁর ছবি করার নানা স্ট্যাগল, ছবির এ্যাসথেটিকস্ ও নিওরিয়ালিজম্ নিয়ে কথা বলার পর বললেন, অনেক ভারী ভারী কথা বললাম বটে, আসলে আমি কিছুই জানি না। আমাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে হেসে বললেন, শোনো মৃগয়ার শুটিং হচ্ছে আদিবাসী গ্রামে, গৌরাঙ্গ (মিঠুন) তীর ছোঁড়ার পর আমার দিকে তাকাতে আমি প্রশংসা সূচক ঘাড় নাড়লাম। আদিবাসী যে মানুষেরা শ্যুটিং দেখছিল তাদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলাম কেমন দিলাম। কিন্তু ওদের যখন জিজ্ঞাসা করলাম, কি ঠিক হয়েছে তো? ওরা মাথা নেড়ে বললেন কিছুই হয়নি। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ওরা জানাল তীর ছোঁড়ার সময় বুড়ো আঙ্গুলের কোনও ব্যবহার লাগে না। ইনডেক্স ফিঙ্গার আর মিডল ফিঙ্গার মুঠো করে তীর ছুঁড়তে হয়।
আমার অহঙ্কারের বেলুন ফেটে ঘেঁটে গেল। বুঝলাম কিছুই শিখিনি। আমার বোবা মুখের দিকে তাকিয়ে মৃণাল সেন বললেন, কখনও ভাববে না তুমি সব জানো, জানার ভাঁড়ার শূন্য মনে করে কাজ করবে, দেখবে অনেক নতুন সত্য আবিষ্কৃত হবে।
উৎপল দত্তের বাড়ী যাওয়ার সময় আমার ডিপার্টমেন্টের এক সিনিয়র দাদা জহর দা আমার সাথী হলেন, ‘’কল্লোল’’ (উৎপল দত্তের বাড়ীর নাম) ঢুকে বাইরের ঘরে বসেছি, মিনিট পাঁচেক পরে উপরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন উৎপল দত্ত। আমার সেই সিনিয়র দাদা চোখের সামনে উৎপলবাবুকে দেখে একেবারে মূক ও স্থির। উনি বসতে বললেন ‘’স্ট্যান্ড স্টিল’’। আমি শেষে হাত ধরে বসালাম। আগে থেকে এ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া ছিল, আর উনি আমাকে শেখর গাঙ্গুলীর ভাগ্নে বলে চিনতেন। আমার পড়াশোনার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। নতুন কী বই পড়েছি সেই খবর নিলেন, রিয়াজেনডের ভাষ্যে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো পড়ার উপদেশ দিলেন। এরপর খুব সাবলীল ভাবে প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকলেন। অশোকদা একটা প্রশ্ন দিয়ে বলেছিলেন যদি সাহসে কুলোয়, তাহলে প্রশ্নটা করো। আমি সেই প্রশ্নটা করার আগে বলে নিলাম, আমি তো কিছুই জানি না, তাই ভুল হলে বকবেন, এরপর প্রশ্নটা করলাম, ‘’আপনার মত একজন নাট্য কর্মীর কাছে কোনটা বেশি গুরুত্ব পাবে, অর্থ, যশ না রাজনৈতিক সচেতনতা?’’ উনি দু-মিনিট আমার মুখের দিকে বড়বড় চোখে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর উচ্চকন্ঠে হেসে বললেন, রাজনৈতিক সচেতনতা আর নাটক করতে গিয়ে যশ এলে তাকে তো ফেরাতে পারি না। তারপর একটু থেমে গলাটা খাদে নামিয়ে টিপিকাল উৎপলীয় সুরে বললেন, আর অর্থ না হলে খাবো কি? তারপরই খুব সিরিয়াসলী বললেন, ‘’The work of theatre is ideological, whether it consciously exposes the cause of a class or not, it must willy-hilly, Participate the class struggle of ideas.’’ চা-জলখাবার খেয়ে ওঁনাকে প্রণাম করে উঠে পড়ি।
মৃণাল সেনও উৎপল দত্তের ইন্টারভিউ দুটো তখনকার ‘’ইউথ টাইমস্’’ পত্রিকায় (অধুনালুপ্ত) ছেপে বেরিয়েছিল। আমি দুটো লেখার জন্য পাঁচশো টাকা পেয়েছিলাম। সেটাই আমার প্রথম উপার্জন। দুজন প্রণম্য শিল্প-সংস্কৃতির মানুষের আশীর্বাদই ছিল আমার পাথেয়।
এই সময়েই বাণিক রায় সম্পাদিত ‘’লাপয়েজি’’ পত্রিকার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। ‘’লাপয়েজি’’ আয়োজিত কবিতা পাঠের আসার স্বরচিত কিছু ছড়া পাঠ করার পর, সেই সভার সভাপতি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমাকে প্রশ্ন করেন, ‘’তুই নাটক করিস?’’ আমি বলি কেন পড়াটা নাটকীয় হয়ে গেল? উনি বললেন, না ঠিক ভাবেই পড়া হয়েছে।‘’ এই সভাতেই আমার সঙ্গে প্রখ্যাত ছড়াকার সৃজন সেনের আলাপ হয়, যা পরবর্তীতে গভীর সখ্যে পরিণত হয়। এই সময়ই সূর্য সেন স্ট্রীটে একটা পুরোনো মেস বাড়ির এক তলায় আমার স্কুলের বন্ধু প্রবীরের উৎসাহে আমি, পাড়ার বন্ধু গৌতম, হবু ডাক্তার বিবেকব্রত দাস, এবং ওই মেসের বাসিন্দা অসিত কয়েকদিন নাটকের মহড়া দিই। প্রথমে রবীন্দ্রনাথের ‘’বিনি পয়সার ভোজ’’ ও পরে ব্রেখটের ‘’সম্রাট ও ভিখিরি’’ নাটক দুটি নারকেলডাঙ্গা, বেলেঘাটা ও দমদম কালীচরণ শেঠ লেনে অভিনয় করি। মহড়ার আগে বা পরে ফেভারিট কেবিনের ভিমের চপের স্বাদ মুখে এখনও লেগে আছে।
 
 

এশীয় থিয়েটারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে, দ্বিতীয় পর্ব লিখলেন - সায়ন ভট্টাচার্য

এশীয় থিয়েটার : পরিসর চিন্তা ও অন্বেষণ:সায়ন ভট্টাচার্য

পর্ব : ২
 
এশিয়ার নাট্য ও নাটকের সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিন্যাসের ধারণা আমরা দেখতে শুরু করবো। পরিসরকে চিনতে গেলে সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যগুলি জানা দরকার। চীন দিয়ে শুরু করা যাক। 
 
• চীনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ‘কুনকু’ থিয়েটার
 
শুধু এশিয়াতে নয়, গোটা বিশ্বে চীনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিস্ময়কর ধারাপথ আছে। চীনের নাম উঠলেই মনে হতে থাকে দেশটির একাধিক বিষয় যা মানুষের মনকে আচ্ছন্ন করতে পারে – চীনের মহাপ্রাচীর, খাবার, চিত্রকলা, মার্শাল আর্ট, সাম্প্রতিক অর্থনীতির তুলনাহীন সমৃদ্ধি প্রভৃতি। 
চীনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য শুধু যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের চিন্তার রসদ দিয়েছে তা-ই নয়, দিয়েছে বিভিন্ন দিকে বিভিন্ন সময় অন্যান্য সংস্কৃতির মহানুভবতা মেনে নিয়ে একাত্ম হতে চেয়েছে। সঙ্গীত, চিত্রকলা ও মার্শাল আর্টের মতো চীনের চীনের থিয়েটার একাধারে লৌকিক ও গণতান্ত্রিক। চীনের এমনই এক মঞ্চশিল্প হচ্ছে ‘কুনকু’ থিয়েটার।
 
‘কুনকু’ চীনের প্রাচীন থিয়েটার স্টাইলের মধ্যে অন্যতম। তবে নামের উচ্চারণ ভিন্ন হয়ে থাকে বিভিন্ন অঞ্চলে। অনেক জায়গায় এটি ‘কুইনচু’ নামেও উচ্চারিত হয়। এই নাট্যধারা বেশ প্রাচীন হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে। 
 
কুনকু’র ইতিহাস বেশ প্রাচীন। চীনের ইতিহাসের লিখিত বর্ণনা অনুযায়ী, ১৫৩০ সালে ওয়েই লিয়ানফু নামক জনৈক বিদ্যান প্রশাসকের হাত ধরে এর যাত্রা শুরু হয়। তবে ১৫৬০ সালের আগে এটি থিয়েটার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেনি। সে বছর বিখ্যাত চীনা নাট্যকার লিয়ান চেনয়ু তার একটি নাটকের জন্য থিয়েটার হিসেবে এর প্রথম ব্যবহার করেন। তারপর থেকে ‘কুনকু’ ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে থাকে। একসময় এটি অফিসিয়াল মেলোডি বা ‘কাওয়ান চিয়াং’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এইসময় থেকে এ থিয়েটারে নাটক নির্মাণের জন্য কবি, সুরকার, চিত্রকর ও নির্দেশকের যৌথ ভূমিকার সাহায্য নেওয়া হতো। এরপর প্রায় ২০০ বছর ‘কুনকু’ থিয়েটার তার সমৃদ্ধি দেখেছে।
 
ব্যতিক্রমী ও বর্ণীল কস্টিউম, মঞ্চনাটক, দলীয় সঙ্গীত, নাচ, জমকালো বাদ্য, কবিতার মাধ্যমে গল্প উপস্থাপন, সংঘাতের দৃশ্যে মার্শাল আর্টের তীব্র উপস্থিতি- সব মিলিয়ে এই থিয়েটার যেকোনো সংস্কৃতিপ্রেমীর মন জয় করার জন্য যথেষ্টের চেয়েও বেশি।
আঠারো শতকের মধ্যভাগ থেকে ‘কুনকু’ থিয়েটার সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে আত্মপ্রকাশ করে। এই সময় থেকেই তাই নতুন ভাবে ‘বেইজিং অপেরা’ হিসেবে পরিচিত হতে থাকে।
 
সময় পাল্টায়, থিয়েটার পাল্টে যায়। কারণ শাসন ও সাংস্কৃতিক সমীকরণ বিষয়টা সর্বদাই ক্ষমতার চাবুকের তলায় থাকে।
 
 চীনের সম্রাট চিয়ানলুং এর পৃষ্ঠপোষোকতায় ‘বেইজিং অপেরা’ ধীরে ধীরে প্রসারিত হতে থাকে। ফলে ট্র্যাডিশনাল ‘কুনকু’ থিয়েটারের সীমা সংকুচিত হয়ে যায়। সাধারণ জনগণের ধারণা হচ্ছিল ১৯০০ সাল নাগাদ এই ঐতিহ্য হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সময়ের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য ট্রেডিশনাল ‘কুনকু’ থিয়েটারের বিশালতা কিছুটা সংক্ষিপ্ত করা হয়। একটি ছোট নাটক, সীমিত পরিসরের গানের দল ও বাদ্যের আয়োজনে তৈরি হওয়া নতুন ‘কুনকু’ ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। উনিশ শতকের কিছু উৎসাহী থিয়েটার প্রেমীর কারণে এ থিয়েটার বিলুপ্ত হওয়া থেকে বেঁচে যায়।
 
বিশ শতকের ষাটের দশকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় এই থিয়েটার বেশ বড় হুমকির মুখে পড়ে। চীনের ক্ষমতাসীন কম্যুনিস্ট সরকার একে সমাজতন্ত্রের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে এই বর্ণীল ঐতিহ্য শাসকদের রোষানলে পড়ে। পার্টি ক্যাডারদের হাতে কলাকুশলীদের অনেকে নিহত হন। অনেকে প্রাণ বাঁচাতে হংকং ও তাইওয়ানে পালিয়ে যান। সত্তরের দশকের শেষের দিকে চীন সরকার কিছুটা উদার হলে ‘কুনকু’ থিয়েটার আবার প্রাণ ফিরে পায়।
 
কমিউনিস্ট পার্টি ও নাট্য সংস্কৃতির একটা গভীর সম্পর্কের ইতিহাস আছে। কিন্তু তার উল্টো দিকটাও আছে কিন্তু! এক তরফা বিষয়টি দেখলে হবে না। 
 
বর্তমানে চীনে ৬টি বড় ‘কুনকু’ থিয়েটার গ্রুপ আছে। এসব গ্রুপে সব মিলিয়ে প্রায় ৬০০-৭০০ অভিনেতা, গায়ক, বাদক ও অন্যান্য কলাকুশলী আছে। এদের প্রত্যেকের নিজ নিজ পারফর্মারদের প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য কার্যক্রমের জন্য আলাদা আলাদা কেন্দ্র রয়েছে। এসব থিয়েটার গ্রুপের চারটি আছে জিয়াংশু ও ঝেজিয়ান প্রদেশে। অন্য দুটি গ্রুপের কার্যালয় হুনান ও বেইজিং অঞ্চলে আছে। দেশের বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় এ থিয়েটারের কার্যালয় আছে। তার মধ্যে নিউ ইয়র্কের ‘কুনকু’ থিয়েটার বেশ প্রসিদ্ধ। এটি সাংহাই অঞ্চল থেকে আগত থিয়েটার গ্রুপের কলাকুশলীরা উত্তর আমেরিকায় প্রথম শুরু করেছিলেন।
 
‘কুনকু’ থিয়েটারের প্রাণ বা অন্তর্বস্তু তিনটি। এগুলো হচ্ছে বক্তব্য, সঙ্গীত ও নাচ। এ থিয়েটারের বিশেষ ধাঁচের শৈল্পিক উপস্থাপনের জন্য প্রতি অভিনেতা-অভিনেত্রীকে নাচ ও গানে বেশ ভালো দক্ষতা আয়ত্ত করতে হয়। সঙ্গীত ও বক্তব্য মোট দু’ভাগে বিভক্ত। উচ্চ সাহিত্যিক গুণসম্পন্ন যেসব কবিতা অর্কেস্ট্রার সঙ্গে সুর দিয়ে গাওয়া হয়, তাকে ‘আরিয়াস’ বলা হয়। অন্য ভাগে সুর দেওয়া গান ও বক্তব্য বাদে কিছু কথা আবৃত্তি করার মতো সমবেতভাবে বলা হয়। অনেক সময় মঞ্চে একজন অভিনেতা গান করেন এবং আরেকজন অভিনেতা জপ করার মতো কথা বলতে থাকেন। দুইয়ে মিলে এক অসাধারণ শিল্পের সুললিত ব্যঞ্জনা মঞ্চে ফুটে ওঠে।
এই থিয়েটার মঞ্চে পরিবেশিত করার নিয়মকে ‘চু পাই’ বা ‘কু পাই’ বলা হয়। কবিতার লাইনগুলো মঞ্চের সঙ্গীতের সঙ্গে সুন্দরভাবে মেলানোর জন্য যথাযথ নিয়ম তৈরি করা হয়। কবিতার প্রতিটি লাইনের একেকটি শব্দ উচ্চারণের প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গানে সুর দেওয়া হয়। এখানে কিছু মজার বিষয় আছে। চীনা ভাষার উচ্চারণ প্রক্রিয়া অন্যান্য ভাষার মতো নয়। সুরের ওঠানামার সঙ্গে এই ভাষার শব্দের উচ্চারণে পরিবর্তন আসে। নিয়ম অনুসারে গানের প্রতিটি শব্দই এক একটি ‘মেলোডি’। গান পরিবেশনের সময় প্রত্যেকটি ‘মেলোডি’ নিজের গুণে ফুটে ওঠে।
 
‘কুনকু’ থিয়েটারে আধুনিক ‘মান্দারিন’, চীনা ভাষা ব্যবহার করা হয় না। এমনকি আঞ্চলিক কুনশাং বা সুঝৌ ভাষাও ব্যবহৃত হয় না। এ থিয়েটারের ভাষা মঞ্চের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা কৃত্রিম ভাষা (মধ্যযুগের বাঙলা ব্রজবুলি কবিতার মতো)। এই থিয়েটারের স্ক্রিপ্ট সাধারণত কবিরা লিখতেন, – লেখার সময় লাইন, শব্দ ও অন্ত্যমিল মিলিয়ে বেশ জটিল শৃঙ্খলা মেনে চলা হয়। এই শৃঙ্খলা ইংরেজি বা বাংলা সনেট লেখার চেয়েও বেশ কঠিন। গান ও কবিতার উপস্থাপন ছাড়াও নাচ এই থিয়েটারের এক অপরিহার্য অঙ্গ। নাচের বিশেষ ধরনের কস্টিউম বেশ উজ্জ্বল ও রঙিন হয়ে থাকে। চরিত্র উপস্থাপনের সময় গান ও সুরের সাথে মিল রেখে নাচে বিশেষ ধরনের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহৃত হয়। অভিনেতা বা অভিনেত্রী এসব আলাদা আলাদা বডি ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে সুখ, দুঃখ, রাগ, প্রেম ও বিনয়ের বিভিন্ন মনোভাব দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলতে পারেন।
‘কুনকু’ থিয়েটারের মঞ্চে বিশেষ জাঁকজমক থাকে না। নাচের মুদ্রায় সাবলীল দৃশ্য ফুটিয়ে তোলার জন্য মঞ্চে বাড়তি দৃশ্যের অবতারণা কিছু কম পরিমাণে করা হয়। মঞ্চে আলাদা কোনো পর্দার ব্যবস্থা থাকে না। অভিনেতা বা অভিনেত্রীর পাশে দৃশ্যে সামান্য চেয়ার বা টেবিলের ব্যবস্থা থাকতে পারে। নায়ক-নায়িকার পোশাক হিসেবে ব্যবহৃত কস্টিউম সাধারণত চীনের ‘মিং’ রাজবংশের সময়কালীন প্রচলিত পোশাকের অনুকরণে তৈরি করা হয়।
 
এই থিয়েটারের চরিত্রগুলো বেশ সুনির্দিষ্ট। প্রধান চরিত্র সাধারণত তিনটি- ‘দাং’ বা ‘যুবতী’, ‘শেং’ বা ‘যুবক’, ও ‘কুয়াও’ বা ভাঁড়। এছাড়া আরো কিছু পার্শ্ব চরিত্র থাকে। এগুলোর মধ্যে ‘লং শেং’ বা ‘বৃদ্ধ’, ‘লাও দাং’ বা ‘বৃদ্ধা’ ও ‘ঝৌ দাং’ বা ‘তরুণ-তরুণী’ উল্লেখযোগ্য। ‘কুনকু’ থিয়েটারে বাদ্য বাজানোর জন্য অর্কেস্ট্রা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত ৬-১০ জন নিয়ে এই অর্কেস্ট্রা তৈরি হয়। বাদ্যের ধরন অনুযায়ী অর্কেস্ট্রা দু’ভাগে বিভক্ত থাকে। তার ও বাতাস চালিত বাদ্যযন্ত্র বাজানো দল ‘ওয়েন চ্যাং’ নামে পরিচিত। হাতের আঙুল বা ছোট কাঠি দিয়ে বাজানো বাদ্য পরিচালনার দল ‘য়ু চ্যাং’ নামে খ্যাত। ‘ওয়েন চ্যাং’ প্রাথমিকভাবে মঞ্চের গানের সাথে বাঁশির সুর দিয়ে থাকে। গানের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে কখনও কখনও ‘জিথার’ (দেখতে অনেকটা গিটারের মতো) বাজানো হয়ে থাকে।
২০০১ সালে ইউনেস্কো চীনের এই অনবদ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ‘মাস্টারপিস অব দ্য ওর্য়াল্ড অ্যান্ড ইন্ট্যানজিবল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ খেতাবে ভূষিত করে। ‘কুনকু’ থিয়েটার চীনের ইতিহাস ও সংস্কৃতির মতো এর মানবিক সমৃদ্ধির এক অনন্য উদাহরণ।
 
কাব্য সাহিত্য ভাষা সংস্কৃতি ইতিহাস ক্ষমতার – সবটা মিলিয়ে যেন একটা মানবিক বর্ণালী তৈরি করতে পারে এশীয় নাট্য। তাত্ত্বিক জায়গা আসবো – তবে তার আগে এই বিরাট মহাদেশটার মধ্যে থেকে খুঁজে আনবো থিয়েটার সংস্কৃতির একটি বেনিয়সহকলা-র সৌন্দর্য।

১৯৮৪ সালের সিনেমা, ‘জাগ উঠা ইনসান’-কে বর্তমান সময়ের প্রাসঙ্গিকতায় পড়লেন - সুকন্যা ঘোষ

সুকন্যা ঘোষ 

“জাগ উঠা ইনসান”

 
 
 
“জাগো” এই শব্দটির মানে শুধুমাত্র ঘুম থেকে জেগে ওঠাই নয়, এই “জাগো” শব্দের আর এক প্রতিশব্দ হল “জাগরণ” যার মানে মনের বিকাশ, মনুষ্যত্ব বোধের বিকাশ। যেখানে চিরাচরিত নিয়ম, শৃঙ্খলা, ধর্ম, কুসংস্কারে আবদ্ধ অন্ধকারে ঘুমিয়ে থাকা মানুষের চিত্ত জাগরণের কথা বলা হয়েছে। এমনই জেগে ওঠার গল্প আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালক কে. বিশ্বনাথ ১৯৮৪ সালে তার পরিচালিত হিন্দি চলচ্চিত্র “জাগ উঠা ইনসান”-এর মধ্যে দিয়ে। যেখানে তথাকথিত হিন্দু সমাজের হরিজন অর্থাৎ দলিত সম্প্রদায় এবং ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের নগ্ন সত্যতাকে দর্শকের সামনে তুলে ধরেছেন। শুধুমাত্র এটাই নয় সঙ্গে দেখা যায় নারী পরাধীনতা, কঠোর ধর্মবাদ, প্রেম, যুক্তিবাদী ধার্মিকতা, দাঙ্গা ইত্যাদি। 
ভারতীয় হিন্দু ধর্মের অস্পৃশ্যতা, জাতিভেদ প্রথা, কুসংস্কার সবটা মিলিয়ে সমাজ এক শ্রেণিকে ( ব্রাহ্মণ ) সবচেয়ে উঁচুস্থানে ও আর এক শ্রেণিকে ( দলিত ) সবচেয়ে নিচুস্থানে জায়গা দিয়েছে, যারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বঞ্চিত। তাই ১৯৩৩ সালে মহাত্মা গান্ধী এই দলিত গোষ্ঠীর মানুষদের হরিজন নামকরণ করে ছিলেন। “হরিজন” শব্দের অর্থ “ভগবানের মানুষ” কিন্তু এই মানুষদের ভগবানের মন্দিরে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। চলচ্চিত্রে দেখা যাচ্ছে কিশোর হরি যখন ছদ্মবেশে পাঠশালাতে গিয়ে বেদপাঠ শিখতে গিয়েছিল তখন তাকে হরিজন সম্প্রদায়ে চিনতে পেরে সেখান থেকে মারধর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। শুধু শিক্ষা ক্ষেত্রেই নয়, কোনো ব্রাহ্মণ বা উঁচু জাতির বাড়ি থেকে জল খাওয়াতেও দলিতদের নিষেধাজ্ঞা ছিল।   
 
“জাগ উঠা ইনসান” চলচ্চিত্রের মধ্যে তিনটি চরিত্র প্রধান ভূমিকা পালন করে- হরি ( হরিজন বংশভূত ), সন্ধ্যা ( ব্রাহ্মণ নর্তকী ), নন্দু ( ব্রাহ্মণ অনাথ ), তাছাড়াও পাশ্ববর্তী চরিত্র প্রত্যেকেই নিজ নিজ শিল্পী গুণের পরিচয় দিয়েছেন। সঙ্গে এখানে সঙ্গীতের ব্যবহার অতি নিপুণ আর বাঁশির ব্যবহার বিশেষ ভাবে দেখানো হয়েছে। বোঝানোই হচ্ছে যে, রাধা যেমন কৃষ্ণের বাঁশির সুরে প্রেমে উন্মত্ত, সে যেমন সংসারের কোনো বাঁধার তোয়াক্কা না করে ভালোবাসায় মাতোয়ারা হয়ে কৃষ্ণের কাছে ছুটে চলে যায় ঠিক তেমনভাবেই সন্ধ্যা হরির বাঁশির সুরের প্রেমে বশ হয়ে হরির কাছে বারেবারে ফিরে আসে, তার কাছে উঁচুজাতি, নিচুজাতি কোনো কিছুই যায় আসে না।
হরি আর সন্ধ্যা দুজনেই ধর্ম, সমাজের সমস্ত বাঁধন, নিয়মের বেড়াজাল অতিক্রম করে একে অপরকে ভালোবাসে কিন্তু সেটা বেশি দিনের জন্যে নয়। কারণ সামাজিক, সাম্প্রদায়িক প্রথার জাঁতাকলের মাঝে পড়ে গিয়ে নিজেদের স্বপ্ন, ভালোবাসা দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে দেয় আর সন্ধ্যা তার দাদুর পছন্দের পাত্র নন্দুর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে যেতে বাধ্য হয়ে। দেখা যাচ্ছে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় উঁচু দরের হলেও নারী জাতি কোনোকালেই স্বাধীন ছিল না। আসলে সমাজের সকলেই কেমন কাঠের পুতুলের মতোন ধর্মের নাচনে নেচে যাচ্ছে। 
 
পরিশেষে দেখা যাচ্ছে যে নন্দু, হরির আর সন্ধ্যার ভালোবাসা বুঝতে পারে, কারণ নন্দু কখনই সন্ধ্যার মধ্যে স্ত্রীর স্বরূপ খুঁজে পাইনি, সর্বদাই দেবীরূপে প্রত্যক্ষ করেছে। সঙ্গে আরও সে বুঝতে পেরেছে যে নন্দু আর সন্ধ্যার বিয়ের ৭ পাক ঘুরলেও, ৮ পাক ঘোরা হয়নি। আর এই ৮ পাক অর্থাৎ ৮ বচনই হল মূল বচন যেখানে মনের মিলন যা হরি আর সন্ধ্যার মধ্যেই ছিল। নন্দু তার সমস্ত যুক্তি, বুদ্ধি দিয়ে পরিবারকে আসল বেদের অর্থ বোঝায়। জন্মেই মানুষ ব্রাহ্মণ বা হরিজন হয় না, হয় তাঁদের কর্মের নিরিখে। তাই তাদের প্রেমের মিলনের জন্যে রাজি করায়, পরে তার পরিবার সকলে রাজি হলেও কিন্তু সমাজ সেটাতে প্রস্তুত ছিল না। ধর্ম, সম্প্রদায় ও সংস্কারের অন্ধকার থেকে তারা তখনও জেগে উঠতে পারেনি, তাই নন্দুর কথাকে তারা মান্যতা দিতে পারলো না আর লাঠি সরকি নিয়ে বাঁধা দিতে চলে আসলো। আসলে মানুষই হলো মানুষকে ধ্বংস করার প্রথম অস্ত্র, যা আজও অবিরত চলে আসছে, তাই কবি জীবনানন্দ বলেছেন –
 
 “কুইসলিং বানালো কি নিজনাম – হিটলার সাত কানাকড়ি
         দিয়ে তাহা কিনে নিয়ে হয়ে গেল লাল
    মানুষেরই হাতে তবু মানুষ হতেছে নাজেহাল।”
                 ~’সৃষ্টির তীরে’ (১৯৫৪)
দুই সম্প্রদায়ের দাঙ্গা হাঙ্গামার কবলে পরে নন্দু আর সন্ধ্যার পরিবারকে হরি বাঁচাতে আসে কিন্তু বিধির নিয়ম খণ্ডায় কে। মিলন তো হওয়ারই ছিল আর তাই হল, সেটা সামাজিকভাবে না হলেও প্রাকৃতিকভাবে হয়ে গেলো কারণ সিনেমার শেষে প্রচণ্ড লাঠির আঘাতে হরি মারা যায় আর অসুস্থ সন্ধ্যা তাই শুনে হৃদরোগে মারা যায়। আর এইভাবেই সম্পন্ন হয় প্রেম যুগলের অলৌকিক মিলন। আর সেই মিলন দৃশ্যে সামিল দুই উগ্র সম্প্রদায় আর প্রকৃতি। ধর্মের নামে কুসংস্কারকে ভেদ করে দুই নর ও নারী ভালবাসার শিলমোহর গেঁথে দিলো, যেখানে নিয়মের কোনো কিছুই বাঁধ মানে না। 
 
সমস্তটা মিশিয়ে সামাজিক আর ধার্মিক রূঢ়তা, প্রেমের স্বাধীনতা সঙ্গে বাস্তব জীবনের চরম সত্যতা প্রকাশ পেয়েছে যা ছবির শেষ পর্যায় শৈল্পিক কুশলতার মাধ্যমে দর্শকের সামনে তুলে ধরেছেন। ” জাগ উঠা ইনসান”-এ মনুষ্যত্ব জাগরণ ও প্রতিফলন উভয়ই ঘটেছে।
 

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published.