magazines

ছত্রিশতম সংখ্যা || সাতাশতম ই-সংস্করণ || এপ্রিল ২০২৩

ছত্রিশতম সংখ্যা ||  সাতাশতম  ই-সংস্করণ || এপ্রিল ২০২৩

ভাণ পত্রিকা

ছত্রিশতম সংখ্যা || সাতাশতম ই-সংস্করণ || এপ্রিল ২০২৩

সম্পাদক :

সম্পাদনা সহযোগী :​

প্রচ্ছদ :

নক্সা পরিকল্পক :

অন্যান্য কাজে :

ভাণ-এর পক্ষে:

পার্থ হালদার

কর্তৃক

৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬

( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )

৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) bhaan.kolkata@gmail.com ( ই – মেল ) ​

Reg. No : S/2L/28241

সম্পাদকের কথা

কবি বলেছিলেন – আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না। ফকির গেয়েছিলেন ” আমি কে তাই জানিলে সাধন সিদ্ধ হয়”! তাবৎ ভারতীয় দর্শনে বারংবার নিজেকে চেনার উপদেশ আছে। তবু নিজেকে অচেনা রেখেই মরছে বেশিরভাগ মানুষ। নিজেকে চেনার সামর্থ্য মানুষের অর্জন হয়নি এখনো। জীবনে থেকে জীবনকে না চেনার দুঃখ মানুষের নিয়তি। ইদানিং গোল বেঁধেছে আরও গভীরে। নিজেকে ভুল চেনায়। ভুল কে ঠিক ভাবায় এবং সে ভুল নিয়ে অহংকারী হওয়ায়। বালখিল্য-হাস্যকর-বিরক্তিকর আচরণের মানুষ এখন ক্রমবর্ধমান। না জেনে না বুঝে ‘ সব জেনে গেছি, বুঝে গেছি ‘ ভাব, আইডেন্টিটির কোন ক্রাইসিস থেকে আসে তা ভেবে দেখবেন নিরহঙ্কারী মনোবিদরা। আমরা বরং নিজেদের এক্তিয়ারের‌ দু চার কথা ভাবি!

সেল্ফ অ্যাসেসমেন্ট বলে একটা দামি কথা আছে। কথাটিতে আধ্যাত্মিক বাড়াবাড়ি নেই। মোটের ওপরে কেজো নির্দেশ – নিজেকে জেনে বুঝে কাজে নামার সোজা ইঙ্গিত আছে এতে। এতে কাজের যেমন সুবিধা, কাজের মানুষেরও। আমার এক্তিয়ার ও সামর্থ্যের সঙ্গে আমার ক্রিয়াকর্মের ব্যবধান কমিয়ে আনার কথা মনে করিয়ে দেয় এই ইংরেজি শব্দটি। আত্মসচেতন হয়ে কাজ করা আর আত্ম প্রেমে নার্সিসিস্ট হয়ে অনভিপ্রেত ক্রিয়াকাণ্ড বাঁধানো যে এক কথা নয়, শব্দটিকে তলিয়ে দেখলে সে ভাষ্যও মেলে।তো কথা হচ্ছে এই আত্ম অনুধাবন কমে আসতে আসতে তলানি তে ঠেকেছে। অবশিষ্ট পতন ঠেকাতে না পারলে ঠেকনা দিয়েও ধরিত্রীর বোঝা বয়ে নিয়ে চলা মুশকিল। ওপর চালাকির দ্বারা মহৎ কিছু ঘটে না। ফাঁপা ঠুনকো কেরামতি গভীর ছুঁতে পারে না। অন্তরের সঙ্গে বাইরের যোগাযোগের নিরন্তন সাধনা ছাড়া একটি ভন্ড দুনিয়ারই দেখা মেলে।

টেকনো নির্ভরতায় আত্মপ্রকাশের ধরন পাল্টেছে, ওদিকে বিস্তার বেড়েছে বিস্তর! আপাত ভাবে সবকিছু সহজলভ্য মনে হচ্ছে। তাই এখন গায়ক নায়ক শিল্প শিল্পীর ছড়াছড়ি। আমি দু একটা গান মোটের ওপর ঠিকঠাক গাইতে পারি মানেই আমি যে গায়ক নই, গিটার আর মাওতোরগানে সুর তুলতে পারি মানেই আমি যে মিউজিক ডাইরেক্টর নই; ইতিহাসের তথ্য বিশ্লেষণ কিছু জানি বলেই যে আমি ঐতিহাসিক নই, চাঁদের পানা মুখ নিয়ে চারটে লোক কে ভেঙাতে পারি মানেই আমি যে অভিনেতা নই; এগ্রোনমি তে পাস দিয়েছি মানেই যে আমি কৃষিবিজ্ঞানী নই – এই বোধ টি বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। অর্জনের তুলনায় সম্পত্তিকে বেশি দেখানো, কঞ্চি হয়ে নিজেকে পুরুষ্টু বাঁশ ভাবা, শিশুবেলায় নিজেকে খোকার বাপ ভাবার মতোই বালখিল্য ও হাস্যকর।

কেবল হাস্যকর নয়। বিষয়টা দেশ জাতি সভ্যতা সংস্কৃতির পক্ষে বেশ বিপদজ্জনকও বটে। একজন মোটের ওপর ভালো অভিনেতা ভাবছেন তিনি উপন্যাস লিখবেন। এতদিন যে লেখেননি সে নির্ঘাত সময়াভাবে! প্রকাশক তার উপন্যাস না ছেপে যাবেন কোথায়। বৌ বাচ্চা পরিবার সহ আত্মজৈবনিক দাবি নিয়েই তো তিনি প্রকাশক।‌ অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত ফ্যানরা গোটা উপন্যাস পড়বেন না একথা সত্য। কিন্তু কিনবেন না, এ তো আর সত্য নয়। আর কিনলেই প্রকাশকের লাভ। কিনে না পড়লে কার ক্ষতি প্রকাশকের সে ভাবনায় লাভ নেই!

তো এখন, অভিনেতা উপন্যাসকার হয়ে উঠে থামলেন না। গায়ক হতে চাইলেন। ওমা কী সুষ্ঠু ব্যবস্থা! মাস ছয়েকের মধ্যেই লিটারারি মিট এবং সরকারি অনুষ্ঠানে কৌশিকী চক্রবর্তীর সঙ্গে মঞ্চ শেয়ার করে তিনি হয়ত অতঃপর এম পি হওয়ার জন্য পার্টি জয়েন করলেন!! ঈশ্বর, কিছু হতে আর কিছু লাগে না। সব কিছু সস্তা, সহজলভ্য, চাইলেই হাতে ছোঁয়া যায়!!
মনসংযোগ, লাগাতার চর্চা, দেহে মনে পরিশ্রম, গভীরতর শিক্ষা, অধ্যাবসায়, ত্যাগ তিতিক্ষা কিছুই জরুরি নয় ! তুমি সৎ শিল্পী হয়ে দুশো লাইক। আমি জামা খোলার ভান করে রিল করলে লাখো লাইক!! সবার অভিযোগ, তার প্রতিভা দাম পেল না। তার কাজ কেউ বুঝল না। অতএব একটা জীবন মামা, যা ইচ্ছা তাই করে নাও। ফেসবুক ইন্সটা, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, রিল ভিডিও। হরেক মঞ্চ। বিচিত্র পারফরম্যান্সে ভরে দাও। গানের নামে একটা থ্যাবড়ানো চিৎকার ইউটিউবে আপলোড করে দাও, মানা করবার কেউ নেই।রান্না না জেনে রান্নার চ্যানেল খুলে দাও। এমন চ্যানেল ও দেখেছি, জব্বর ধনী বাপের একটি মেয়ে সারা সপ্তাহে কত বিচিত্র দামি দামি জিনিসপত্র কিনেছে তাই ঢোল পিটিয়ে দেখাতে বসে তার নিজস্ব চ্যানেলে। সেখানেও কমেন্ট বক্সে ‘দিদি লাভ’ ইউ” এর হাহাকার!! জয় গণতন্ত্র, জয় পুঁজি, জয় বাজার, জয় অনন্ত স্বাধীনতা!!
এতো স্বাধীনতা, যেখানে বিজ্ঞানেও তালি। কুসংস্কারেও তালি।বিকেলে দুষ্টু মিষ্টি রিলও ভালো। পাড়ার পাশের ঝিলও ভালো!
তবু রাত বাড়লে কারও কারও কেন যে মনে হয়, এ জন্মে কিচ্ছু করা হল না। এইটাই একমাত্র জ্বালা এবং আশা।

আমার এক ছাত্রী যে কোভিড কালে “দেখে লেখা পরীক্ষায়” ফার্স্টক্লাস পেয়েছে, যার তিন লাইনে কমপক্ষে নয়টি বানান ভুল থাকে; – জানালো, সে ডব্লিউ বি সি এস এর প্রিপারেশন নিচ্ছে। ভালো করে নে, বলতে গিয়ে গলা শুকিয়ে গেল আমার। আমার অন্য এক ছাত্রী সেদিন ফোন করে জানাল ওর ক্লাসে পৌঁছাতে দেরি হবে, তাই আমি যেন খানিক লেটে ক্লাসে যাই। গলায় কিছু একটা লটকে গেল বলে প্রত্যুত্তর দেবার ঝুঁকি থেকে বেঁচে গেলাম। পনি টেইল শোভিত সদ্য থিয়েটারে আসা একটি ছেলে আমায় জানালো, ও অপেক্ষায় আছে। আসল জহুরী ডিরেক্টর ওকে ঠিক ডেকে নেবেন নায়কের পার্টে। র- ফলা, য-ফলা উচ্চারণ করতে যে মানুষ ঝালাপালা বাঁধায়, রাগ অনুরাগ বিরাগ বিরহ প্রকাশে যে একচোখা, একমাত্রিক- সে ছোঁড়ার এ কনফিডেন্স কোন সূত্রে প্রাপ্ত হল এ এক ধাঁধা বটে। রসময় পাঠকের ঝুলিতে এমন অগনন উদাহরণ আছে জেনে ক্ষান্ত হয়ে পরের কথায় আসি!

ভেবে দেখলে বুঝবেন এর সমস্তটাই ধাঁধা নয়, হামবড়া ভাবের মানুষ চিরকাল ছিল। তারা নিজেরাই জানত কোন ফাঁপা স্তর থেকে তারা জীবনকে দেখে!! সত্যকারের প্রতিভাধর কাজের মানুষের কাছে তাদের মাথা থাকতো নত। আজ যে মাথা উঁচিয়ে,চোখ বাগিয়ে, বুক চিতিয়ে, মুখ ভেংচিয়ে নিজেকে যা, তার তুলনায় অনেক বড় করে দেখার প্রবৃত্তি বৃদ্ধি পেয়েছে, কোনো সাধনা ছাড়াই শ্রেষ্ঠ সাধক বনার যে হিড়িক পড়েছে, তার অনেক কারণের মধ্যে বর্তমানের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বড় ভূমিকা আছে। সমাজের মাথা বলছেন তার ৩০ টির এর মতো ভাষাতে পব্লেম নেই। এর ফলে নয়টি ভাষায় বুৎপত্তি অর্জন করা ভারতপথিক রামমোহন এর ২৫০ বছর উদযাপনে তেনার ছবি রামমোহনের তিনগুণ বড় দিতে বাধা থাকছে না! নয় তিনে সাতাশ – অঙ্ক পরিষ্কার। এক এইট ফেল মূলাধারীর পক্ষে স্রেফ গুন্ডাগিরি করে বিডিও এস ডি ও – এর টেবিলে পা তোলা যাচ্ছে। চেয়ার তুলে মারা যাচ্ছে। থুতু পর্যন্ত দেওয়া যাচ্ছে। মন্ত্রী হয়ে যাত্রা করা যাচ্ছে, অঢেল কবিতা লেখা যাচ্ছে, ছবিতে তুলিতে শিল্পের সমস্ত তালুকের তালুকদার বনা যাচ্ছে। ইচ্ছে হলেই দুবছরের দু একবার ইউনিভার্সিটি ছুঁয়ে পি এইচ ডি বাগিয়ে নেওয়া যাচ্ছে। এম পি হয়ে ভারতের পার্লামেন্ট থেকে ফিরে এসে শরীরী আকর্ষণের রিল বানাতেও বাধা থাকছে না! একটা সদর্থক বচন আছে বাংলায় – ” যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে ” । তার যে এমন কদর্য রূপ কুৎসিত স্বরূপে প্রকাশিত হবে এ ছিল অচিন্তনীয়।

নিজের সঙ্গে কথা বলার মহামূল্যবান ভারতীয় কালচার আজ পর্যুদস্ত। নিজেকে না চেনার থেকে নিজেকে ভুল চেনার ভ্রমে আমরা আজ বিভ্রান্ত। একটা কিছু গড়ে তুলতে গেলে যে মানসিক স্থিতি লাগে তার ‘মূল’ অস্থিরতায় দুলছে। এই তো চেয়েছিল ওরা। আমাদের প্রভুরা। আমরা ওদের হাড়িকাঠে মাথা গুঁজে ” উই আর ফ্রি। উই লাভ ফ্রিডম” বলে চ্যাচাচ্ছি। এই ফ্রি হল ফোকোট। এই স্বাধীনতা মানে সস্তা। নিজেকে সস্তা করা। দেশকে হীন করা। নিজেকে না চিনলে দেশও অচেনা থাকবে। সব অ্যাসেসমেন্ট গুলিয়ে যাবে…। আসুন আমরা “শ্রী শ্রী সৎ বিবেচক” ঈশ্বরের আরাধনায় মাতি!

‘The Banshees of Inisherin’ সিনেমা নিয়ে আলোচনা করলেন - সম্রাট লস্কর

সম্রাট লস্কর
বন্ধুত্বের ভাঙনকাল ও চলচ্চিত্রের অন্তর্নিহিত নাট্য-ব্যাকরণ: একটি

অর্বাচীন আলোচনা

অনলাইন ডেটিংয়ের রমরমার এই যুগে একটি ইংরেজি শব্দ সাম্প্রতিক সময়ে বেশ পরিচিতি পেয়েছে— ‘গোস্টিং’। ‘পরিচিতি’ কথাটি সচেতন ভাবেই ব্যবহার করলাম এখানে ‘জনপ্রিয়তা’-র বদলে কারণ ‘গোস্টিং’ বিষয়টি প্রিয় হওয়া বেশ মুশকিল, বিশেষত তাদের পক্ষে যাদের জীবনে ‘গোস্টিং’এসেছে ভাববাচ্যে। কাকে বলে গোস্টিং? কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্কে, বিশেষত রোম্যান্টিক সম্পর্কে, কোনো একজন যখন আচমকাই কোনোরকম কারণ না দেখিয়েই অপরজনের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় সেটাই হল গোস্টিং। বিড়ম্বিত, বিভ্রান্ত সেই অপরজন যখন প্রথম জনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তখন কোনো রকম উত্তর পায় না। প্রেতের মতোই তারা যেন মিশে গেছে অপরিচিতির বাতাসে। যোগাযোগের সব মাধ্যম থেকে তারা হারিয়ে যায়, ফোন বা টেক্স্‌ট মেসেজের জবাব আসে না, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাাকাউন্ট ডি-অ্যাাক্টিভেট করে বা অপর ব্যক্তিকে চিরকালের মতন ব্লক করে তারা একেবারে হারিয়ে যায় জীবন থেকে। সম্পর্ক ভেঙে যায় বাঞ্ছিত ‘ক্লোজার’ ছাড়াই; এক তীব্র অতৃপ্তিবোধ মাঝে মাঝেই তীক্ষ্ণ ভাবে খোঁচা দেয় হৃদয়ে।আধুনিক সম্পর্কে ‘গোস্টিং’ বেশ পরিচিত একটি ট্রেন্ড। এই অনলাইন সম্পর্কের যুগে সম্পর্ক ভেঙে হারিয়ে যাওয়া বেশ সহজও বটে। সম্পর্ক অনলাইন না হলে আরোপিত স্থানিক বা ভৌগোলিক দূরত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে। কিন্তু কেমন হয় যখন কেউ আচমকাই সম্পর্ক ভেঙে দিয়েও প্রতিবেশী থেকে যায়? রোজ দেখা হলেও সে এড়িয়ে যায় এককালের প্রিয় বন্ধুকে? পুরোনো বন্ধুর চোখের সামনেই গড়তে থাকে নতুন বন্ধুত্ব, নতুন সম্পর্ক? কেমন হবে সেই ভাঙনকালের দুঃসহ যাপন? কোন নিশ্চিত ট্র্যাজিক পরিণতির দিকে এগিয়ে যাবে সেই তীব্র আবেগের ভাঙা সম্পর্ক? এই উত্তরই খুঁজতে চেয়েছেন মার্টিন ম্যাকডোনা তাঁর সাম্প্রতিকতম চলচ্চিত্র ‘দ্য বন্‌শিজ অব্‌ ইনিশেরিন’-এ। বিংশ শতকের তৃতীয় দশকে আয়ারল্যান্ডের অ্যারান দ্বীপপুঞ্জের একটি কাল্পনিক দ্বীপ ইনিশেরিনের বুকে গড়ে উঠেছে ভাঙা বন্ধুত্বের এই নির্মোহ ট্র্যাজিক গাথা।
 

ইনিশেরিনের প্রায়-অলস দিনযাপনের একটি প্রধান আকর্ষণের জায়গা অবশ্যই স্থানীয় পানশালা যেখানে বন্ধুরা, প্রতিবেশীরা মিলিত হয় প্রাত্যহিক আড্ডায়। প্রতি দুপুরে দ্বীপের সাদাসিধে যুবক পড্‌রিক (অভিনয়ে: কলিন ফ্যারেল) তাঁর অসমবয়সী প্রৌঢ় বন্ধু কলাম-এর (অভিনয়ে:
ব্রেন্ডন গ্লিসন) সাথে পানশালায় যায়। তাদের বন্ধুত্বের এ এক প্রাত্যহিক উদ্‌যাপন। সিনেমা শুরুর দুপুরটায় অবশ্য সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা ঘটে যায়। বন্ধুকে ডাকতে এসে পড্‌রিক দেখে কলাম চুপচাপ ঘরে বসে ধূমপান করে চলেছে; পড্‌রিকের ডাকে সে ফিরেও তাকায় না, কোনো
উত্তরও দেয় না। বিস্মিত পড্‌রিক ঘরে ফিরে আসে। তার অবিবাহিত বোন শোভান-কে (অভিনয়ে:কেরি কন্ডন) জানায় কলামের অদ্ভুত আচরণের কথা। “তোমায় বোধহয় ও আর পছন্দ করছে না তেমন”, শোভান ঠাট্টার সুরে বলে ওঠে। কথাটা সেও বিশ্বাস থেকে বলে নি, পড্‌রিকও বিশ্বাস করেনি। সরল, সাদাসিধে পড্‌রিক ভাবতেও পারে না যে তার প্রিয় বন্ধু তাকে আর পছন্দ করে না।অথচ, সেটাই সত্যি। এই গ্রাম্য, সাধারণ বুদ্ধির পড্‌রিকের সঙ্গে সময় কাটিয়ে কলাম আর সময় নষ্ট করতে চায় না। সে বরং তার জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো কাটিয়ে দিতে চায় সঙ্গীতের একনিষ্ঠ সাধনায়, নতুন সুরের সৃষ্টিতে। সেখানে পড্‌রিকের কোনো জায়গা নেই। কলাম তাই পড্‌রিকের সাথে শুরু করেছে প্রাক-অনলাইন যুগের ‘গোস্টিং’, এক নিষ্ঠুর অবজ্ঞা।পড্‌রিক অবশ্য এত কিছু বোঝে না। সে কলামের বন্ধুত্ব ফিরে পেতে চায়। বারংবার চেষ্টা করে
কলামের সাথে যোগাযোগ করতে। তিতিবিরক্ত হয়ে কলাম জানায় যে পড্‌রিক এ’রকম করতে থাকলে সে নিজের হাতের আঙুল একটা একটা করে কাটতে থাকবে। জেদী পড্‌রিক এই কথায় কোনো পাত্তাই দেয় না। নানা ভাবে সে কলামের কাছে ঘুরঘুর করতে থাকে, নেশার ঘোরে তাকে যা নয় তাই বলে, পরের সকালে ক্ষমা চাইতে গিয়েও গোলমাল করে ফেলে। কলাম তাদের বন্ধুত্বের স্পষ্ট সমাপ্তি ঘোষণা করে নিজের বাঁ হাতের একটা আঙুল কেটে সেই কাটা আঙুলটা পড্‌রিকদের বাড়ির দরজায় ছুঁড়ে দিয়ে। তাতেও কি পড্‌রিকের চেতনা হয়? না। সে এত সহজে হাল ছাড়তে রাজি নয়।পড্‌রিকের মরা বন্ধুত্ব বাঁচিয়ে তোলার এই নিষ্ফল চেষ্টায় একের পর এক বিপত্তি নেমে আসে ওই ছোট্ট দ্বীপে — কলামকে হারাতে হয় বাঁ হাতের অবশিষ্ট আঙুলগুলো; দুটো মৃত্যু আসে অকস্মাৎ, একটি মানুষের এবং আরেকটি বাড়ির অতি আদরের পালিত পশুর; একজন হুমকি দিয়ে আগুন লাগায় অন্যজনের বাড়িতে; এক অস্বস্তিকর অসমাপ্তির আবহে শেষ হয় সিনেমাটি। আইরিশ লোককথায় আছে যে কারো মৃত্যু আসন্ন হলে প্রেতিনী বন্‌শি-রা কেঁদেকেটে সেই মৃত্যুর কথা নাকি আগাম জানিয়ে দেয়। ইনিশেরিনের বন্‌শিদের কান্নাতে অবশ্য শারীরিক মৃত্যুর থেকেও গুরুত্ব পেয়েছে বন্ধুত্বের এই হনন। শেষ দৃশ্যে সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে দুই (প্রাক্তন) বন্ধু শুনতে থাকে আয়ারল্যান্ডের মূল ভূখণ্ড থেকে ভেসে আসা গৃহযুদ্ধের দামামা। ওই গৃহযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে একদিন, কিন্তু দুই বন্ধুর নিজস্ব যুদ্ধের কী হবে? এই ছোট্ট দ্বীপে ঘটতে থাকা এই ট্র্যাজেডি কি শুধুই ব্যক্তিগত? কে বেশি দায়ী এর জন্য? কলামের নিষ্ঠুর, স্বার্থপর সিদ্ধান্ত নাকি পড্‌রিকের বন্ধুত্ব বাঁচিয়ে রাখার অর্থহীন নাছোড়বান্দা চেষ্টা? মার্টিন ম্যাকডোনা সেই উত্তর ইচ্ছাকৃত ভাবেই দেন নি। উত্তর খোঁজার ভার তিনি বরং ছেড়ে দেন আমাদেরই ওপর।
আদতে নাট্যকার হিসেবে পরিচিত ও সমাদৃত হলেও চলচ্চিত্র জগতে ম্যাকডোনার অভিজ্ঞতাও কম নয়। তাঁর লেখা ও পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘সিক্স শুটার’ লাইভ অ্যাকশন শর্ট ফিল্ম বিভাগে জিতে নিয়েছিল ২০০৬-এর অ্যাকাডেমি পুরস্কার। পরের দেড় দশকে একে একে মুক্তি পায়
ম্যাকডোনার আরো চারটি সিনেমা, প্রতিটিই পূর্ণদৈর্ঘ্যের — ‘ইন ব্রুজ’ (২০০৮), ‘সেভেন সাইকোপ্যাথ্‌স’ (২০১২), ‘থ্রি বিলবোর্ডস আউটসাইড এবিং, মিসৌরি’ (২০১৭) এবং অবশ্যই আমাদের আলোচিত ‘দ্য বন্‌শিজ অব্‌ ইনিশেরিন’ (২০২২)। এই সব ক-টি সিনেমাতেই লেখক-পরিচালক তাঁর নাট্যজগতের অভিজ্ঞতাকে সচেতন ভাবে কাজে লাগিয়েছেন। বারে বারে নিয়ে এসেছেন নাটকে ব্যবহৃত তাঁর নিজস্ব আইরিশ ডার্ক হিউমার। তবে ম্যাকডোনার পাঁচটি সিনেমার মধ্যে ‘দ্য বন্‌শিজ অব্‌ ইনিশেরিন’-এই নাটকের প্রভাবটা সবচেয়ে বেশি। চলচ্চিত্র ও নাটক —
এই দুই মাধ্যমের মাঝের দেওয়ালটা এখানে একেবারে উধাও না হলেও জায়গায় জায়গায় সচেতন ভাবে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সেই সব ফাটল দিয়ে অনায়াসেই একদিক থেকে অন্যদিকে যাতায়াত করা যায়। চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাগৃহে বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ‘দ্য বন্‌শিজ অব্‌ ইনিশেরিন’ দেখতে দেখতে দর্শকের মনে হতেই পারে যে সে আদতে একটি নাটক-ই সে দেখছে ব্রডওয়ে বা রয়্যাল ন্যাশনাল থিয়েটারে বসে। আয়ারল্যান্ডের অ্যারান দ্বীপপুঞ্জের নাম এলেই যে নাট্যকারের নাম প্রথমেই ভেসে আসে তিনি হলেন জন মিলিংটন সিং। বন্ধু ইয়েট্‌সের পরামর্শে অ্যারান দ্বীপপুঞ্জে কিছুদিন কাটানোর পর বিংশ শতকের প্রথম দশকে সিং অ্যারান দ্বীপপুঞ্জের পটভূমিকায় লিখতে থাকেন ‘রাইডার্স টু দ্য
সি’-এর মতো একের পর এক অসাধারণ সব নাটক। সিং-এর প্রায় এক শতাব্দী পর ম্যাকডোনাও অ্যারান দ্বীপপুঞ্জের পটভূমিকায় লেখেন তিনটি নাটক যার মধ্যে প্রথম দু’টি — ‘দ্য ক্রিপ্‌ল অব্‌ ইনিশমান’ (১৯৯৮) আর ‘দ্য লেফটেনান্ট অব্‌ ইনিশমোর’ (২০০৬) অভিনীত হলেও তৃতীয়টি
মঞ্চ পর্যন্ত এখনও পৌঁছায় নি। ম্যাকডোনার ওই নাটকটিকে অভিনয়যোগ্য বলে একেবারেই মনে হয় নি। কী ছিল ওই তৃতীয়টি নাটকটির নাম? ‘দ্য বন্‌শিজ অব্‌ ইনিশীর’। সেই নাটকের-ই কি সিনেম্যাটিক ভার্সন ‘দ্য বন্‌শিজ অব‌্ ইনিশেরিন’? হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না। স্পষ্ট উত্তর
ম্যাকডোনা এখনও দেন নি। তবে অ্যারান দ্বীপপুঞ্জের কোনো দ্বীপের বন্‌শিদের নিয়ে ম্যাকডোনা যে কিছু ভেবেছিলেন অনেক আগেই সেটা আন্দাজ করাই যায়। সেই নাট্যভাবনা থেকেই হয়তো এই সিনেমাটার জন্ম। এমন এক সিনেমা যার নির্মাণে নাটকের অন্তর্নিহিত ব্যাকরণ,
আরোপিত রীতি-নীতি জড়িয়ে থাকবে পরতে পরতে।সেই ইয়েট্‌স বা সিং-এর আমল থেকেই আইরিশ নাটকে ধ্রুপদী নিয়ম মেনে চলার একটা সচেতন চেষ্টা দেখা যায়। সিং তাঁর ‘রাইডার্স টু দ্য সি’ নাটকে রেনেসাঁসের নব্য-অ্যারিস্টট্‌লীয়দের প্রিয় তিন ক্লাসিকাল ইউনিটিজ-এর সার্থক ব্যবহার করেছিলেন সুচারু দক্ষতায়। ম্যাকডোনাও তাঁর সিনেমায় সেটা করারই চেষ্টা করেছেন। নাটকের তিনটি ধ্রুপদী ঐক্য — unity of time, unity of place, unity of action, মেনে চলার চেষ্টা করা হয়েছে সিনেমাটিতে। অ্যারিস্টট্‌ল বলেছিলেন নাটকের ঘটনাক্রম সূর্যের একটি ঘূর্ণনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার কথা; ম্যাকডোনা তাঁর চিত্রনাট্যে একদিনের ঘটনা দেখান নি বটে, কিন্তু পুরো সিনেমা জুড়ে দেখানো হয়েছে কয়েকটি
মাত্র দিনের ঘটনা। সিনেমাটির সব অ্যাকশন ওই কাল্পনিক ইনিশেরিন দ্বীপেই ঘটে। মূল ভূখণ্ড থেকে কেউ কেউ আসে (যেমন কলামের নতুন বেহালাবাদক বন্ধু), আবার শোভানের মতো কেউ কেউদ্বীপের এই ছোট্ট পরিসরে হাঁপিয়ে উঠে চাকরি নিয়ে চলে যায় ইনিশেরিন ছেড়ে। সে সব সিনেমাতে উল্লেখ থাকে কিন্তু ক্যামেরায় দেখা যায় শুধু ইনিশেরিন-কেই। এ এমন এক দ্বীপ যা আধুনিক “সভ্যতা”র থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। যুদ্ধের খবর আর বন্দুকের আওয়াজ ভেসে আসে এখানে প্রায়ই; তেমন কোনো আলোড়ন অবশ্য পড়ে না। গল্পের একমুখিতাও এই সিনেমার এক পরম বিশেষত্ব। মানুষ ও পালিত পশুর আত্মীয়তা, বাবা-ছেলের সম্পর্কের ভয়াবহতা, একাকী নারীর নিজস্ব পরিচয় তৈরি করে আধুনিক হওয়ার চেষ্টা, এ র’কম অনেক বিষয় সিনেমাটি ছুঁয়ে গেলেও, মূল ফোকাস থাকে অবশ্যই দুই (প্রাক্তন) বন্ধুর সম্পর্কের দ্বন্দ্বে। Unity of action নিশ্চিত ভাবেই তাই প্রতিষ্ঠিত হয় এই সিনেমায়।‘দ্য বন্‌শিজ অব্‌ ইনিশেরিন’-এ নাটকের অন্যান্য বেশ কিছু প্রচলিত উপাদানও লেখক/পরিচালক
ব্যবহার করেছেন। আইরিশ নাটকে বোকাসোকা, হাঁদা টাইপের যে চরিত্রগুলো হামেশাই দেখা যেত, সেগুলো এখানেও এসেছে। পড্‌রিক নিজেই তো সে রকম এক চরিত্র, তবে আরেকটি চরিত্রও আছে ওই ধরনের — ডমিনিক (অভিনয়ে: ব্যারি কিয়োগান)। স্থানীয় বদমেজাজী পুলিশ অফিসারের ছেলে।বাবার কাছে হরদম মার খাওয়া, সুন্দরী শোভানের প্রতি দুর্বল ডমিনিক যেন পড্‌রিকের-ইআরেকটা সত্তা। ডমিনিকের করুণ পরিণতি সিনেমার গল্পে নিয়ে আসে এক অপ্রত্যাশিত ধাক্কা।পড‌্‌রিক হারায় তার আরেক বন্ধুকে। নাটকের গানের মতোই সঙ্গীত বারে বারে চলে আসে এই সিনেমায়। এই সঙ্গীত ঠিক লিরিকাল হয়ে ওঠে না। কলামের বেহালায় যে সুর বেজে ওঠে তাতে কদাচিৎ শোনা যায় জীবনের উল্লাস। বরং সেই সঙ্গীতে ধ্বনিত হয় বিচ্ছেদের সুর; মিশে যায় বন্‌শিদের অশুভ কান্না। অ্যারান দ্বীপপুঞ্জের নাটকে অলৌকিকতার উপস্থিত হয় স্বাভাবিক নিয়মেই। এই সিনেমাতে সেই অমোঘ অলৌকিকতার আবহ তো ‘বন্‌শিজ’ শব্দটির মধ্যেই স্পষ্ট নিহিত। মিসেস ম্যাক্‌কর্মিকের (অভিনয়ে: শীলা ফ্লিট্‌ন) চরিত্রটি হয়ে ওঠে ইনিশেরিনেররেসিডেন্ট বন্‌শি। সিং-এর নাটকের কোরিক চরিত্রগুলোর মতোই তিনি করেন অমোঘ সব ভবিষ্যদ্‌বাণী। সাবধান করে দেন আগামী মৃত্যুর সংবাদ দিয়ে। সিনেমার শেষ দৃশ্যে মিসেস ম্যাক্‌কর্মিক তাকিয়ে থাকেন সমুদ্রতীরে দাঁড়ানো দুই (প্রাক্তন) বন্ধুর দিকে। কেন? তিনি কী এমন কিছু জানেন যা অন্য কেউ জানে না? মৃত্যু কি আবার আসবে এই দ্বীপে কয়েক দিন বাদেই?
বন্ধুত্ব কি আবার জোড়া লাগবে নাকি তাদের সংঘাত চলতেই থাকবে এই ১৯২৩-এর আয়ারল্যান্ডের গৃহযুদ্ধের মতো? ‘দ্য বন্‌শিজ অব্‌ ইনিশেরিন’-কে কী নামে ডাকলে ঠিক হবে?এটি একটি চলচ্চিত্র না নাটকের চলচ্চিত্র রূপ? উত্তরগুলো খোঁজার কি আদৌ প্রয়োজন আছে?
সেটাও ভাবতে হবে যে।

আলোচিত সিনেমা: The Banshees of Inisherin
গল্প, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: Martin McDonagh
অভিনয়ে: Colin Farrell, Brendan Gleeson, Kerry Condon, Barry Keoghan, Sheila
Flitton and others.
 
 

‘উড়ন্ত তারাদের ছায়া’ নাটকটির খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করলেন - দেবহূতি সরকার

 

দেবহূতি সরকার
“উড়ন্ত তারাদের ছায়া” ধরা পড়ে কি ঘাতকের চোখে?

 

“উড়ন্ত তারাদের ছায়া”। নামটির মধ্যের যে মায়া সে মায়া নাটকে ছড়িয়ে পড়ে ইতিহাসের এক নিষ্ঠুর অধ্যায় ঘিরে। পারস্য সম্রাট নাদির শাহর ভারত আক্রমণ এবং সেই সূত্রে ততৎকালীন মোঘল সম্রাট মোহম্মদের সঙ্গে তাঁর সংঘাতের রক্তাক্ত বাস্তব আর তাকে ছাপিয়ে মোহম্মদ ও নাদির শাহর পারস্পরিক সংলাপের ঘোরলাগা স্বপ্ন এই নাটকের কেন্দ্রবিন্দু।
ইতিহাস বলে নাদির শাহ একদিকে দক্ষ সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাজ সম্রাট, নির্মম নিষ্ঠুর।
সামান্য দরিদ্র পশুপালকের সন্তান, নেই কোনো পারিবারিক রাজরক্তের ঐতিহ্য। নিজের চেষ্টায় দুর্দিমনীয় এই মানুষ হয়ে ওঠে প্রায় সমগ্র এশিয়ার সম্রাট। আলেকজান্ডারের সঙ্গে তুলনা করা হয় তাঁর, নেপোলিয়ান তাঁকে আদর্শ মনে করতেন। সারাজীবন জুড়ে যুদ্ধই ছিলো তাঁর ধর্ম।অন্যদিকে মহম্মদ শাহ ভারত ইতিহাসের এক ব্যর্থ মোঘল সম্রাট। সাম্র‍্যাজ্য রক্ষায় ব্যর্থ, যুদ্ধে ব্যর্থ খালি তাঁর অন্তর্গত রক্তে খেলা করে শিল্প সাহিত্য সঙ্গীত চারুকলা। মহম্মদ শাহের রঙিন জীবনের জন্য তার নাম মহম্মদ শাহ রঙিলা।
এই দুই বিপরীত চারিত্রধর্মের ব্যক্তিত্ত্বের সংঘাত অথবা মিলনে কী ঘটতে পারে তাই এই নাটকে কল্পনার চোখে দেখাতে চেয়েছেন নাট্যশিল্পী দেবাশিস।মহম্মদ রাতের আঁধারে সুরাপান করে তারাদের ছায়ায় খুঁজে চলেন অতীত। যুদ্ধ রক্ত তাঁকে ক্লান্ত করে। নামিয়ে রাখতে চান সম্রাটের হীরক খচিত পোষাকের ভার। সঙ্গী তাঁর ওবায়েদ্দুল্লা, সে সম্রাটের একলা রাতের বন্ধু, একএক্টি। এই চরিত্র ঐতিহাসিক ট্র‍্যাজেডির পরম্পরায় মনে পড়ায় দিলদারকে।
সে রাজাকে সতর্ক করে নাদির শাহের আগ্রাসনের ব্যাপারে। মহম্মদের নাদিরের আগামনকে আক্রমণ বলে মানতে চান না, মনে করেন পালিয়ে এসে ভারতে লুকিয়ে থাকা শত্রুদের নিকেশ করতেই তিনি এসেছেন। এই বিশ্বাস। মানুষের প্রতি শিল্পের প্রতি কোমল হৃদয়ানুভূতির প্রতি একান্ত বিশ্বাস মোহম্মদের চরিত্রের মেরুদন্ড হিসেবে দেখাতে চাওয়া হয়েছে। মনে পড়ে যায় শচীন্দ্রনাথের সিরাজদৌল্লাকে।
অসামান্য স্থিরতায় এই চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন তথাগত। গান ও অভিনয়ের মেলবন্ধনে অবিশ্বাস্য স্বপ্নসম্ভব এই চরিত্রকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন।
নাদির শাহ অন্যমেরুতে দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত রক্তের মানুষ। তলোয়ারে রক্ত শুকোয় না। কিন্তু কোঁচরে জমিয়ে রাখেন মটর দানা। তাঁর দারিদ্র্য ক্লিষ্ট অতীতকে তিনি ভোলেন না। ভারতকে তিনি শাসন করতে নয় লুঠ করতে চান, মানুষের লাশের ওপর দিয়ে এগিয়ে চলেন মসনদের দিকে।
মুখোমুখি হন মহম্মদের। শিল্পী সত্ত্বা আর ঘাতক সত্ত্বার দ্বন্দের এক অসামান্য দৃশ্য সেটি। মহম্মদকে হিংসার কথা বলে চলেন নাদির, আর মহম্মদ বলেন বিশ্বাসের কথা। কিকি নিয়ে যেতে চান নাদিরের পেশ করা সেই তালিকায় থাকে কোহিনূর ময়ূর সিংহাসন। এমনকি মহহমদ কন্যাকেও পুত্রের বেগম হিসেবে নিয়ে যেতে চান শুনে মহম্মদ বলেন হিন্দুস্থান থেকে এই সকল সম্পদ নিয়ে গেলেও হিন্দুস্তানকে রিক্ত করা যাবে না, সে আবার নিজেকে ভরিয়ে তুলবে। এই মুহূর্তের সংলাপে হাততালির বন্যা বয়ে যায় বেশ কয়েক দফায়। এই দৃশ্যে মহম্মদ তার চিন্তার তরঙ্গ চারিয়ে দিতে থাকেন নাদিরের হৃদয়ে। নাদির দোস্ত বলে জড়িয়ে ধরেন মহম্মদকে।
মানবিক দুর্বলতা, বিশ্বাসের উদ্ভাস যদি ঘাতকের মস্তিষ্কে প্রবেশ করে তাহলে যা হতে পারে তাই ঘটতে থাকে দ্বিতীয় অর্ধ জুড়ে। রক্তলোভী যুদ্ধবাজ নাদির এখন অসুস্থ। মাঝরাতে দেখেন মহম্মদের ভুত শুনতে পান তাঁর ক্ষমাশীলতার শব্দাবলী। বাস্তবে তাঁর মৃত্যুর রটনায় পুত্র রেজা ক্ষমতার নেশায় মেতে উঠেছে।হত্যা করেছে সিংহাসনের দাবীদার হতে পারা শিশুদের নারীদের। নাদির বিরক্ত ক্লান্ত। তাঁর মানসিক সংঘাত, বিদ্ধস্ত শরীর, দুর্বল হতে থাকা চেতনা এখানে নিজস্ব দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন সঞ্জীব। অসুস্থ শরীরে বিভ্রান্ত মস্তিস্কে বসে থাকা নাদিরের মনলোকে বারে বারে আসেন মহম্মদ।কখনো দেখান তারাদের ছায়া আবার কখনো তাতিয়ে তোলেন নাদিরের পৌরুষ। আবার যুদ্ধ। গুপ্ত ঘাতকের হাতে আহত নাদির সন্দেহবাতিকগ্রস্ত। পুত্র রেজাকে শুধু সন্দেহের বশেই দেন ভয়ানক শাস্তি।
নিজের দুই উপড়ানো চোখ থালায় করে নিয়ে আসে। তার কাতর স্বর প্রতিধ্বনিত হয় আব্বা আমি তোমায় ভীষণ ভালো বাসি৷ নিজের বিচারে নিজেই দগ্ধ হন নাদির। এসময় মহম্মদ আসেন তার মৃত্যুর ভবিষ্যৎবাণী করতে। অবিশ্বাস্য লাগে তাঁর। তিনি মরতে চান না, তাঁর অসুখ সেরে গেছে। তাহলে? যে কোনো স্বৈরাচারী শাসকের মত এতদিনের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার লড়াই-এ বানিয়ে তোলা শত্রুদের হাতে ঘুমের মধ্যে আক্রান্ত হন পারস্যের তখতের অধিপতি। মরতে মরতেও দুজনকে মেরে যান এরপর পড়ে থাকে জীবন মৃত্যুর পরপারের জগৎ যেখানে মহম্মদ বলেন জীবন ভালোবাসার মতো করুণ আর নাদির বলেন মৃত্যু ঘেন্নার মত উজ্জ্বল।সংলাপ এই নাটকের ভরকেন্দ্র। ঐতিহাসিক ট্র‍্যাজেডির দীর্ঘ আবেগময় কাব্যগন্ধী সংলাপের প্রতি সুবিচার করতে পেরেছেন অভিনেতারা এটিও বড়ো পাওনা। পোষাক, আলো, মঞ্চ ব্যয়বহুল। নাটকের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ ও যথাযথ। ভাবনার ছাপ স্পষ্ট। মঞ্চে দুটি স্তম্ভ যেন দুই ব্যক্তিত্ত্বের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সেখানেই বেঁধে রাখা হয় বন্দীদের। অনেকগুলি দড়ি এদিকে ওদিকে টান করে বাঁধা। আর ওপরের দিকে বিন্দু বিন্দু ছোট ছোট তারা। দুবার অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে পড়ে তারাদের ছায়া। লেজারের ব্যবহার সুন্দর। মঞ্চে দুতিনটি কাঠের ব্লক, দুতিনটি লোহার ফ্রেম আর ফ্রেমে ঝোলানো স্বচ্ছ পর্দা। বারবার পর্দা টানার দৃশ্য এক ঘেয়ে লাগে বড়ো। 
মঞ্চের দুপাশে বসে গায়ক ও বাদ্যকরের দল। গান এ নাটকটি সুরে বেঁধে দেয়। গজলের বিষাদ আর কাওয়ালির বিশালতা। প্রসঙ্গত মহম্মদ ভারতে কাওয়ালির প্রচলন করেছিলেন। তাই গানের প্রয়োগে বোধ ও মেধা আশা জাগায়। অতিরিক্ত শারীরিক কসরতের অনুপস্থিতি মনকে বড়ো আরাম দেয়। সুফী ঘরানার নাচ ওয়েল রিহার্সড এবং নাট্যমুহূর্ত নির্মাণে সক্ষম।
 ইতিহাস এ নাটকের কাঠামো মাত্র কিন্তু মৃত মানুষের ছায়া, উড়ন্ত তারাদের ছায়া এই নাটককে রক্তমাংসময় করে তোলে। ইতিহাস তবু নাটক নয়, নাটক শুধুই ইতিহাস নয় এই সত্য নাট্যকার সফল ভাবে বুনে দিতে পেরেছেন। ইতিহাসবর্ণিত নিষ্ঠুর সম্রাটের মানুষ হৃদয়ের দোলাচল, জটিল মনস্তত্ত্বকে দেবাশিস উদঘাটন করতে চেয়েছেন। নাদির শাহ তাঁর রাজত্বের ইতিহাস লিখিয়ে রাখতে চাননি।ইতিহাস যেখানে নীরব সেখানেই নাটককারের কলম কথা বলে। যুদ্ধের সংখ্যা, মৃতের সংখ্যা, লুন্ঠিত সম্পদের খতিয়ান, কুটিল রাজনৈতিক কার্যকলাপের তথ্যে ভিত্তি করে দ্বন্দজটিল নাদির শাহকে গড়ে তুলতে চেয়েছেন দেবাশিস। মনস্তত্ত্ব উদঘাটনে তাঁর হাতিয়ার মহম্মদ, ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া মহম্মদের শিল্পীসত্ত্বা। হিন্দুস্থানের আবেগকেও স্থানে স্থানে সন্তর্পণে প্রবেশ করিয়ে দিতেও তিনি সক্ষম হয়েছেন।
নাটককারই যেখানে নাট্যকার সেখানে লেখকের অভিপ্রায় দর্শকের কাছে পৌঁছে দেবার যে সুযোগ থাকে তা দেবাশিস দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছেন। সেইসঙ্গে তিনি পালন করেছেন মঞ্চপরিকল্পনা, আলোক পরিকল্পনা, আবহ পরকল্পনার গুরুদায়িত্বগুলিও। সংস্তব নাট্যদলের এই নাটকটি তাই সর্বাথে দেবাশিসের নির্মাণ বলা যেতে পারে। ইতোমধ্যেই নাটকটি দর্শকমন্ডলীর সমাদর লাভ করেছে। নাট্যসমালোচক ও লোকমুখের প্রশংসাবাক্য শুনেই তাই “উড়ন্ত তারাদের ছায়া” দেখতে গেছিলাম আকাডেমিতে। পরের মুখের ঝাল খেয়ে ঠকেছি অনেক। তাই অবিশ্বাসীর মন নিয়েই হলে ঢুকেছিলাম।পরিপূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে পিঠটান করে বসে রুদ্ধশ্বাস এক নাট্যের সাক্ষী হলাম। শিল্পের প্রতি কোমল হৃদয় বৃত্তির প্রতি আস্থা যাদের তারা কি সত্যিই দেখাতে পারে নৃশংসকে উড়ন্ত তারাদের ছায়া? জানা নেই? তবে আমরা যারা শিল্পকে ভালোবেসে বেঁচে থাকতে চাই, আসলে তো শিল্পের মধ্য দিয়ে হন্তারকের মনোলোকে তারার ছায়া ফেলার স্বপ্ন নিয়েই বেঁচে থাকি! মাথার ভেতর অনেকদিন থাকবে উড়ন্ত তারাদের মায়া।
 
 

‘Saas Bahu Achaar Pvt. Ltd.’ ওয়েব সিরিজ নিয়ে আলোচনায় মাতলেন - বৃতা মৈত্র

 
স্বাদে অনবদ্য সাস-বহুর আচার:বৃতা মৈত্র
 
 
ওয়েবসিরিজে ক্রাইম আর সেক্স দেখে যাঁরা ক্লান্ত, একেবারে তাঁদের জন্যই যেন তৈরি সাস-বহুর একত্র লড়াইয়ের এই দুরন্ত কাহিনি। জি ফাইভে স্ট্রিমিং হচ্ছে ‘সাস বহু আচার প্রাইভেট লিমিটেড’ শিরোনামের একেবারে ভিন্নস্বাদের এক সিরিজ। যেটা সবচেয়ে বেশি ভাবার বিষয়, সেটা হলো, সাস বনাম বহু নয়, সাস-বহুর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই এখানে। মধ্যবিত্ত পরিবারের বধূ সুমনকে সমর্থন জানাতে গিয়ে নিজের ছেলের বিরদ্ধে যেতে পিছপা হন না তার সাসুমা। দুই নারীর সমাজ-সংসারের এই লড়াইয়ের উল্টোদিকে একজনের ছেলে, আর একজনের প্রাক্তন স্বামী। 
দিলীপ শ্রীবাস্তব নামের এই মানুষটি তার প্রাক্তন স্ত্রী সুমনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে ছেলেমেয়েকে (জুহি ও রিশু) নিজের কাছে রেখেছে। মনে মনে সম্পূর্ণ পুরুষতান্ত্রিক দিলীপ ডিভোর্সের পর দ্বিতীয় বিয়ে করেছে মনীষাকে। তাদের একটি ছেলেও হয়েছে বিয়ের পর, নাম ভিভান। জুহি ও রিশু কেমন থাকতে পারে তাদের সৎমায়ের কাছে, এটা ভেবে স্বভাবতই অহরহ অস্থির হয় সুমন ! তার পক্ষে ছেলেমেয়েকে ছেড়ে থাকা প্রচন্ড যন্ত্রনাময়। কিন্তু দিলীপ আইনের বেড়াজালে আটকে রেখেছে বিষয়টাকে। আইনি যুক্তি, ছেলেমেয়ে মানুষ করার মতো টাকা নেই সুমনের কাছে। গল্পের মূল কেন্দ্রে রয়েছে দিলীপ (অনুপ সোনি), দিলীপের প্রথম স্ত্রী সুমন শ্রীবাস্তব (অম্রুতা সুভাষ) ও সুমনের সাসুমা (যামিনী দাস), মনীষা (অঞ্জনা সুখানি)। অভিনয়ে এছাড়াও আছেন আনন্দেশ্বর দ্বিবেদী (সুমনের ব্যবসার পার্টনার শুক্লাজি), মনু বিস্ত (জুহি), নিখিল চাওলা (রিশু), স্রেয়াংশ কৌরব (ভিভান), নিশা জিন্দাল, প্রিয়া গুপ্তা।
সচরাচর একজন ভালো মানুষ হিসেবেই আমরা পর্দায় দেখি এনএসডি-র প্রাক্তনী অনুপ সোনিকে। ছোটপর্দায় দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে সোনি টিভির অত্যন্ত জনপ্রিয় শো ‘ক্রাইম পেট্রোল’ হোস্ট করেছেন তিনি। পাঠক স্মরণ করুন ছোটপর্দার জনপ্রিয়তম ধারাবাহিক ‘বালিকা বধূ’-র ভৈরোঁর কথা। মেগার সবচেয়ে স্তিতধী ও বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ। অনুপ সোনি, ভারতীয় টেলিভিশনের খুব চেনা এক মুখ। সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন তিনি। তবে, টিভিতেই অনুপের সেরা অভিনয় দেখেছে দর্শক। এহেন অনুপ ওটিটি প্ল্যাটফর্মে, এমন বিপরীত এক অবতারে !
ফিরে আসি গল্পে। কেন সিরিজের নাম ‘সাস বহু আচার প্রাইভেট লিমিটেড’ ? গল্পেই তার ইঙ্গিত মেলে। সুমন আর তার শাশুড়ি যে আচারের ব্যবসা করছে, তা সহজেই উপলব্ধ। কিন্তু আজকের ব্র্যান্ড জমানায় কে নেবে সুমনের ঘরে তৈরি আচার ? অতএব অসম যুদ্ধ ! তার মধ্যে দিবারাত্রি দিলীপের তাড়না। দিল্লীর চাঁদনী চক এলাকাকে ঘিরে পল্লবিত এই সিরিজের গল্প। আপাতত ব্যবসা দাঁড় করিয়ে পর্যাপ্ত টাকা রোজগার করতে চায় সুমন। উদ্দেশ্য ছেলেমেয়েকে কাছে রাখা। কেন দিলীপ সুমনের সঙ্গে সংসার করতে পারলো না, সেটার উত্তর আপনারা জানতে পারবেন সিরিজটি দেখলে। মনীষাও দুই সন্তানের জনক এক পুরুষকে বিয়ে করে কতটা সুখী ? জুহি, রিশু বা ভিভানের মধ্যেই বা কোন রসায়ন চলছে ? এসব নানা টক-ঝাল-মিষ্টি ঘটনা প্রবাহে সুস্বাদু হয়ে উঠেছে সাস-বহুর আচার। 
রিয়েল লাইফ লোকেশনে এর রিয়েল লাইফ স্টোরি লিখেছেন অভিষেক শ্রীবাস্তব ও স্বর্ণদীপ বিশ্বাস। পরিচালনা অপূর্ব সিং কারকি। পাঠক এমনটা ভাববেন না, এক নারীর জীবন-সংগ্রাম মানেই এক কাঠখোট্টা বিষয়। এ সিরিজ কিন্তু মোটেই তেমন নয়। মাঝে মাঝে কমেডির ছোঁয়াও পাবেন। আর এভাবেই প্রতিটি পর্বকে উপভোগ্য করে তুলেছেন পরিচালক।
নীলোৎপল বোরার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক রসগ্রাহী। অর্জুন কুক্রেতির সিনেমাটোগ্রাফি কাহিনির সঙ্গে মানানসই। আপাতত ৬ পর্বের প্রথম সিজন দেখানো হয়েছে। পর্বগুলোর সময়সীমা ২০-৪৫ মিনিট। 

যাপিত নাট্যের নবম কিস্তি লিখলেন - কুন্তল মুখোপাধ্যায়

 যাপিত নাট্যের দশম  কিস্তি:কুন্তল মুখোপাধ্যায়
 
১৯৭৩’র ১৬ই জানুয়ারী কলামন্দির বেসমেন্টে একটি দেড় ঘন্টার নাটক করেছিল চেতনা, নতুন দলের নতুন নাটক। আমি তখন প্রায় দিনই লোয়ার সার্কুলার রোডের ওপর আমাদের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের হস্টেলে (হিন্দু হস্টেল) আড্ডা মারতাম। আমার ক্লাসমেট সুমন (বর্তমানের নামকরা সাংবাদিক), লেখক সুমন গুপ্ত, গৌতম, নীলয়, যারা আবার কলেজে আমার নাট্যসাথী ছিল, তাদের সঙ্গে জমজমাটি আড্ডা। তো নীলয় আমাকে খবর দিলো ওই দিনের নাট্যসস্থার কথা। চলে গেলাম পাঁচ টাকার টিকিট কেটে। অডিটোরিয়ামে দর্শক সংখ্যা বেশ কম। জানলাম নাটকের নাম মারীচ সংবাদ, সত্যিকথা বলতে কী, বিরাট কিছু আশা নিয়ে যাইনি, কিন্তু নাট্যদর্শনে মগ্ন হয়ে পড়লাম, নাটক দেখে হল থেকে বেরিয়ে সেই মগ্নতাই মুগ্ধতায় পরিণত হল। তখন অতটা না বুঝলেও দীর্ঘকাল নাট্যচর্চার সাথে যুক্ত থাকতে থাকতে বুঝেছি নাটকের লিখিত বা মুদ্রিত রূপের নির্ভরতার থেকেও মঞ্চে উপস্থাপিত নাট্যভাবের সাবলীলতার উপরই সেই নাটকের সার্থকতা বেশী নির্ভর করে। ফলে প্রথাগত নাটক দেখার অভ্যস্ত চোখে মারীচ সংবাদ এর প্রথম অভিনয় দেখা এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। দর্শক হিসাবে এই অভিজ্ঞতা একই সঙ্গে উপভোগ ও উপলব্ধির। আগেই একবার বলেছি নাটক শেখার, ভালোবাসার অন্যতম উপায় হল নাটক দেখা। দেখতে দেখতেই গ্রহণ বর্জনের প্রক্রিয়াটি কার্যকরী হয়ে ওঠে। ৭০’এর দশকের প্রথম অর্দ্ধের অনেকটা সময় আমি নাটক দেখে দেখেই নাটক শিখেছি। নাটকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়েছি।বহুরূপী, পি.এল.টি, নান্দীকারের সব নতুন নাটক তো দেখতামই তার সঙ্গে যুক্ত হল থিয়েটার ওয়ার্কসপ, চেতনা, রূপান্তরী, থিয়েটার কমিউন। থিয়েটারের গিল্ড, সি.পি.এ.টি, নক্ষত্র এইসব দলের নাটক দেখা। নিজের পড়াশোনা, খেলাধূলার বাইরে এই নাট্য দর্শনও হলো আমার নাট্যযাপন। বিভাসদা, অশোকদা, নীলকণ্ঠদা, অসিত দা, আর শ্যামল দার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয়ও আমার নাটক শিক্ষায় বড় ভূমিকা নিয়েছে। অশোকদার মারফৎ পাঠ করেছি এরিফ বেন্টলীর, ‘হোয়াট ইজ থিয়েটার’ নালকন্ঠদা পড়িয়েছেন আঁতোয়ার, ‘থিয়েটার এন্ড ডাবল’, মেথুয়েন থেকে প্রকাশিত, ‘ব্রেশট্ রচনাবলী’ হাতে এসেছে, পড়ছি রিচার্ড শেখনারের, ‘পারফর্মেটিভ সারকারসামটেন্সেস ফ্রম দি আভাগাঁদ টু রামলীলা’। বাংলায় পড়ছি পবিত্র সরকার, দর্শন চৌধুরী, অজিত ঘোষ, বিষ্ণু বসু, সাধন ভট্টাচার্যের লেখা গ্রন্থ। আর আলোচনা করছি মূলত অশোকদা, বিভাসদা, নীলকন্ঠদা আর জ্যোতিদার সঙ্গে। এই সময়ই মফঃস্বল শহর সেই সুদূর বালুরঘাট থেকে আসা হরিমাধব মুখোপাধ্যায়ের নাটক দেখেও উত্তেজিত হয়েছি, ভালো লেগেছে বহরমপুরের অঞ্জন বিশ্বাসের কাজ। একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতার মঞ্চে অমল রায়, গৌতম মুখোপাধ্যায়, শ্যামল তনু দাশগুপ্ত, নবেন্দু সেন, রাধারমন ঘোষ, রবীন্দ্র ভট্টাচার্যদের নাটকের অভিনয় দেখেও শিখেছি অনেক। ৭০ এর দশকের মাঝামাঝি একাদেমী মঞ্চে, চাক ভাঙা মধু (থিয়েটার ওয়ার্কশপ), দানসাগর (থিয়েটার কমিউন), ভালো মানুষের পালা (চেতনা), কলকাতার হ্যামলেট (সি.পি.এ.টি), গদ্য-পদ্য-প্রবন্ধঘ (রূপান্তরী), পাঁচ দিনের এক নাট্যোৎসব হয়। পাঁচ দিনই আমি স্বতাগিদেই ওখানে রিসেপশেন কাজ করেছি। নাটক দেখা তো বটেই তার সঙ্গে সঙ্গে নাট্যবিষয়ক আলোচনা নাট্য ব্যক্তিত্বদের ব্যক্তিগত আড্ডা, নাট্য ভাবনার সঙ্গে পরিচিত হবার এই সুযোগের আমি সদ্বব্যহার করেছি। মনে পড়ে কি অবলীলায় বিভাসদাকে প্রশ্ন করেছি, চাক ভাঙা মধু নিবিষ্ট হয়ে দেখি, কিন্তু রাজরক্ত দেখতে দেখতে হাই ওঠে কেন, নীলকন্ঠদার কাজ ‘জীবিকা’ ও ‘প্রস্তুতি’র নাট্যগঠন নিয়ে জেনেছি। অসিতদা রাজনৈতিক নাটকের রোমান্টিকতা বাদ দিয়ে তার দ্বান্দ্বিক দিকটির দিকে নজর ঘুরিয়েছেন। এই উৎসবেই মোহিত চট্টোপাধ্যায়, বিদ্যুৎ নাগ, অজিত সান্যাল প্রমুখের সঙ্গে হৃদ্যতা হয়েছিল। জরুরী অবস্থা, পাড়ায় পাড়ায় সন্ত্রাসের মধ্যেও ভয় না পেয়ে নাট্যদর্শন সূত্রে নাট্যযাপন আমার মনোবলে চিড় ধরতে দেয়নি। আজ পরিণত বয়সে এসে বুঝি নাট্যদর্শন সূত্রে গ্রহণ-বর্জন এবং প্রশ্ন করার তাগিদ থেকে নাট্যজ্ঞান আরোহন করার এই প্রক্রিয়ার কোনো অন্ত নেই।

এশীয় থিয়েটারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে, তৃতীয় পর্ব লিখলেন - সায়ন ভট্টাচার্য

এশীয় থিয়েটার : পরিসর চিন্তা ও অন্বেষণ:সায়ন ভট্টাচার্য

পর্ব : ৩
 
জাপানের থিয়েটার সংস্কৃতির দিকে নজর দেওয়া যাক। 
 
জমকালো মুখোশ, অভিনয়ে আকস্মিক আবেগ, কৌতুক ও হাস্যরসের তীব্র উপস্থিতি এবং আকর্ষণীয় নাচ ও কস্টিউম- এর সবক’টি জিনিসই উপস্থিত দর্শক ও শ্রোতাদের মুগ্ধ করে দিতে পারে। মঞ্চের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অবিশ্বাস্য নাটকীয়তা আর রঙিন পোশাকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অসামান্য উপস্থিতি অনেক কিছু মনে করিয়ে দিতে পারে। অতীতের রাজা ও রাজবংশের গল্প, গ্রামের লোককথা, পারিবারিক কাহিনী, ভূত-প্রেতের উপদ্রব এমনকি নিছক হাস্যরস; সবই উপস্থাপনার গুণে অভাবনীয় ও সুন্দর হয়ে উঠবে। হ্যাঁ, এটা আর কিছু নয়, জাপানের ঐতিহ্যবাহী কাবুকি থিয়েটার।
 
জাপানি ক্লাসিকাল থিয়েটারের তিনটি প্রধান traditionsতিহ্য রয়েছে: Kabuki, Noh, এবং বুনারকু। এই প্রতিটি পারফরম্যান্সকে ইউনেস্কোর দ্বারা অদম্য সাংস্কৃতিক মূল্য বলে মনে করা হয়েছে, ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য তাদের সংরক্ষণে সহায়তা করে (“কাবুকি ঘটনা ও বিশদ” ২০১৪;)। Kabuki এডো পিরিয়ডে এর শিকড়গুলি সনাক্ত করে এবং গানের উপস্থাপন করতে তিনটি অক্ষর ব্যবহার করে (ka), নাচ (bu), এবং দক্ষতা (ki)। টিপিক্যাল kabuki শোগুলি তাদের বিস্তৃত পোশাক, অতিরঞ্জিত উইগ, শিহরণযুক্ত মেকআপ, ওভার-দ্য টপ ক্রিয়া এবং কেবল পুরুষ অভিনয়কারীর উপস্থিতি দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। যেহেতু কথোপকথনে ঐতিহ্যবাহী জাপানি শব্দ রয়েছে যা দেশীয় ভাষাভাষীরা এমনকি অনুসরণ করতে অসুবিধা পেতে পারে (“কাবুকি, নোহ, এবং বুনরাকু” ২০২০), তাই শ্রোতাদের অর্থ বোঝাতে আন্দোলনের উপর ইচ্ছাকৃত মনোযোগ রয়েছে।
 
Kabuki জাপানের থিয়েটারের তিনটি প্রধান ফর্মগুলির মধ্যে একটি (অন্য দুটি সত্তা Noh এবং বুনারকু)। দুর্দান্ত পোশাক, স্ল্যাপস্টিক অ্যাকশন এবং অতিরঞ্জিত আন্দোলন, গতিশীল সেট এবং সৃজনশীল প্রপ ব্যবহারটি সনাক্তযোগ্য পারফরম্যান্সের জন্য তৈরি করে। প্রাচীন গ্রিস এবং রোমে মঞ্চের ঐতিহ্য বা এলিজাবেথান ইংল্যান্ড মতো kabuki পুরুষদের দ্বারা মূলত প্রাধান্য পেয়েছে, বলা যাবে না। হাস্যকরভাবে, এই শিল্পরূপটি কিয়োটোতে একটি মহিলা মাজারের পরিচারক ইজুমো ন ওকুনি (সিএ। 1578-1613) দ্বারা আবিষ্কার করা হয়েছিল এবং 17 তম শতাব্দীতে তাঁর মহিলা নৃত্যশিল্পীদের দ্বারা জনপ্রিয় হয়েছিল।
 
ওকুনির নৃত্যশিল্পীরা তাদের বহিরাগত পোশাকগুলি নিয়ে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল, যার মধ্যে কয়েকটি ছিল পর্তুগিজ মিশনারীদের রূপকর্ম এবং তাদের ক্রস ড্রেসিং দৃশ্যের কারণে প্রতিদিনের জীবনকে বিমোহিত করে। পরে অবশ্য সম্পূর্ণ অভিনবত্ব ছিল না; অনেক বেশি বয়স্ক মহিলাদের মুখোশধারী পুরুষরা অভিনয় করেছিলেন নো থিয়েটার, উদাহরণস্বরূপ। এডো পিরিয়ড চলাকালীন, টোকুগা শোগুনেট মহিলাদের অভিনয় করতে নিষেধ
করেছিলেন kabuki পতিতাবৃত্তির সাথে সম্পর্কিত হওয়ার কারণে ট্রপস (একটি অযৌক্তিক ধারণাও এর সাথে যুক্ত) জাপানীবাইজি), তাই আজ অবধি, kabuki এখনও পুরুষদের দ্বারা সঞ্চালিত হয়; বেশ কয়েকজন পুরুষ kabuki অভিনেতারা মহিলা চরিত্রে অভিনয় করতে বিশেষত (অননাগটা)।
 
এশীয় নারীদের সাংস্কৃতিক দক্ষতার ইতিহাস এতটাই বলিষ্ঠ ছিল যা সংস্কৃতির প্রতিটা অংশকেই প্রভাবিত করে।
 
১৬২৯ সালের দিকে কাবুকি জাপানি শোগুনদের রোষানলে পড়ে। ফলে নারীদের অভিনয় ও গানের কাবুকি নিষিদ্ধ হয়ে গেলো। সরকারের মনে হয়েছিলো, এ ধরনের বিনোদনের ফলে সমাজের উঁচু মহলে বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখা দেবে। ফলে নারীদের অংশগ্রহণের বদলে ছেলেদের দ্বারা নতুনভাবে চালু করার চেষ্টা হয়েছিলো। একই কারণে এটিও নিষিদ্ধ হলো। ১৬৫০ সালের দিকে কাবুকিতে বয়স্ক পুরুষদের অভিনয় করার প্রচলন হয়েছিলো। এই পর্যায়ে পুরুষ অভিনেতারাই চরিত্রের প্রয়োজনে মেকআপ নিয়ে নারীর ভূমিকায় অভিনয় করতেন। এই পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয় ছিলো। শহরাঞ্চলে কাবুকি থিয়েটারের জনপ্রিয়তা ক্রমে বাড়তেই থাকে। ‘নাকামুরা-জা’, ‘ইচিমুরা জা’ ও ‘কাওয়ারাজাকি জা’ এই থিয়েটারগুলো সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। কিছু অভিনেতার এমন বহুমুখিতা রয়েছে যে তারা বিভিন্ন চরিত্রের চিত্রিত করতে পারে; সাকাতা তোজুরো চতুর্থ এবং নাকামুরা শিচিনোসেকে দ্বিতীয় উভয়ই পুরুষ ও মহিলা চরিত্রে অভিনয় করতে পারে। বাস্তবে, তবে, বেশিরভাগ কবুকি অভিনেতারা একটি বিভাগে বিশেষজ্ঞ, যেমন অভিনয় কৌশল, ভয়েস ব্যবহার ইত্যাদি প্রায় আজীবন প্রশিক্ষণ এবং বিশেষত্ব প্রয়োজন কাবুকির মূল চরিত্রের মধ্যে রয়েছে: অক্লান্ত (বাস্তববাদী বক্তৃতা এবং আরও মার্জিত পদ্ধতি / অঙ্গভঙ্গিতে জোর দেয়), আরগোটো (চটকদার, গতিশীল গতিবিধি এবং আক্রমণাত্মক, “জীবনের চেয়ে বৃহত্তর” স্পিচ ধরণগুলি ব্যবহার করে) এবং ওনাগনাটা (মহিলা চরিত্রে অভিনেতা)।
 
ইজুমো ন ওকুনি ছাড়াও আধুনিক জাপানি কাবুকির ভিত্তি অনেকগুলি মূল খেলোয়াড় স্থাপন করেছিলেন। জাপানি নাট্যকার / পুতুল চিকামাতসু মনজায়মন (১1653৫৩-১ Willi২৫) উইলিয়াম শেকসপিয়রের সাথে (১৫1725-1564-১1616১ to) তুলনা করা হয়েছে তাঁর প্রসারিত ফলাফলের জন্য; জাহান্নামের কুরিয়ার (1711) এবং আমিজিমায় প্রেমের আত্মহত্যা তিনি লিখেছিলেন এমন অসংখ্য স্ক্রিপ্টগুলির মধ্যে অনেকগুলি করুণ আত্মহত্যা নিয়ে আলোচনা করে। রিচার্ড বার্বেজ (সি। 1567 – 1613) এর সাথে শেক্সপিয়ারের ঘন ঘন সহযোগিতার অনুরূপ, চিকামাতসু প্রায়শই সাকাতা তোজুরো প্রথম (১-1647-১ romantic০৯) রোম্যান্টিক শোতে তার শীর্ষস্থানীয় মানুষ হিসাবে অভিনয় করেছিলেন, তাঁর বাস্তব অভিনয় এবং মৃদু আচরণের জন্য সমসাময়িকরা প্রশংসিত হয়েছিল। একই সময়ে, ইচিকাওয়া ডানজুরো প্রথম (1709-1660) তার বোমাবাজি উত্সাহের জন্য তরঙ্গ তৈরি করছিল, তাকে যুদ্ধ এবং সংঘাতের সাথে জড়িত গল্পগুলির জন্য পুরোপুরি উপযোগী করে তুলেছিল।
 
কাবুকি পারফরম্যান্স থেকে ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, এবং কাবুকি থিয়েটার, টোকিওর অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ থিয়েটারগুলি, 1991 সাল থেকে তাদের সারা বছরই দেখাতে শুরু করেছে 2005 XNUMX বিপণনেরও এক বছর ছিল Kabuki সিনেমা ফিল্ম। আজ, বেশ কয়েকটি কাবুকি ইউরোপ, এশিয়া এবং উত্তর আমেরিকা ভ্রমণ করে।
 
কাবুকির প্রভাব থিউরিং (2018) নোট হিসাবে আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত। এই সাংস্কৃতিক অনুশীলনের বিবিধ পারফরম্যান্স শৈলী এবং অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলি ইউনেস্কোর অদম্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তালিকায় এর অন্তর্ভুক্তির দিকে পরিচালিত করেছে। 
আরও গভীর ভাবে এই থিয়েটারকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। চিন ও জাপানের থিয়েটারের অন্তর্গত মিল ও অমিলের ভাবনাগুলো তখনই ফুটে উঠবে।

গিটারের অন্তরঙ্গে ঢুঁ মারলেন - অরিক্তম চ্যাটার্জি

অরিক্তম চ্যাটার্জি 

লোকাল গীটারের মোকাম ১  
গিভসন, গডসন, গ্রাসন, ট্রোনাড স্ট্রেঞ্জার,– এরা কেউ স্ট্রেঞ্জার ছিলো না আমাদের কাছে।আমরা মানে হা-ক্লান্ত সত্তরের বিগতবসন্তবেলার ললিত ক্রোড়ে লালিত মুকুলেরা, যারা নব্বইয়ের বিশ্বায়িত চড়া রোদে পেকে বিলকুল আঁটি হয়েছিলাম। আগের সাঙ্গীতিক জেনারেশনের যে ন্যারেশনের কেন্দ্রে বীনা বা কাঞ্জিলাল, পাকড়াশি, হীরেন বা হেমেন সদলবলে জাঁকিয়ে বসেছিলেন, সেখানেই এই সব নতুন দোআঁসলা নামের বেপরোয়া ফিচেলরা কি এক আনকোরা আস্কারায় মজে আমাদের লব্জ কবজা করে বসলো মিলেনিয়েম কায়েম হতেই। অবশ্য অধিকারের অধিকার তাদের ছিলো, কারণ তাদের’ই কান টেনে, গলা ভেঙ্গে, কেঠো শিরদাঁড়ায় অকাট্য আঙ্গুলের নিরুপম শাসনে আমরা গান বাজনার এ বি সি ডি শিখেছিলাম। হ্যাঁ, এবিসিডি ই, কারণ এই বর্ণমালিকার করে সপেছিলেম সখি হৃদমহলার বর্ণিল মালিকানা। সাবেক সারাগামা কে সাময়িক অবসরে পাঠিয়েছিলাম আমরা সবাই এবিসিডি শিখছিলাম। ফিল্টারহীন ধোঁয়ার বৃত্তে আমরা সবাই গীটার শিখছিলাম।         
তবে এই শেখার ধরতাই ছিলো অনোখা। এখন যেমন আগ্রহী বাবা মায়ের দল অনাগ্রহী ছেলেমেয়েদের হাত ধরে নিয়ে গিয়ে দামী দোকানের গ্রহীতা হয়ে গীটার কিনে দেয়, তখন তেমনটি ছিলো না মোটেও। নব্বইয়ের শেষ অব্দিও গীটার প্রকৃত’ই অ্যান্টি-ইন্সটিটিউশনাল ছিলো। এর ইন্সটিটিউশান বা টিউশান কোনোটাই তেমন ছিলো না। তাই গীটার কিনতে হোতো লুকিয়ে, শিখতে হোতো বন্ধুর কাছে। উপরোক্ত বাবা মায়েদের অনেকে্ই ঊঠতি বয়সে লুকোনো জমানো টাকায় গীটার কিনেছিলো, আর বাবার ঠ্যাঙ্গানির ভয় (সেটা ছিলো ঠাঙ্গানিসাম্প্রদায়িক পিতৃত্বসম্প্রদায়ের অন্তিম প্রজন্ম) হোস্টেলে রেখে আসতে হোতো। বাড়িতে গীটার নিয়ে আসলে শুনতে হোতো, ‘বাড়িটাকে হোস্টেল বানিয়ে তুলছিস’। গীটার ছিলো এক গ্রন্থিহীন বোহেমিয় সচেতন স্বেচ্ছাচারের প্রতীক। তার তন্ত্রে ছিলো স্বপ্নতন্ত্র, যৌথখামারের হাতছানি(অ্যানাক্রনিস্টিক লজিকে বড়রা অনেকেই যে যৌথটা যৌনতার ছুতমার্গ থেকে অভিন্ন মনে করতেন হয়তো)! কারণ এর অনুষঙ্গে ভালোবাসাও ছিলো পুরোদস্তুর।          
একটি অবজেক্টকে নিয়ে এই যে রোম্যান্টিকতা, যা প্রায় একটি ফেটিশিজমের পর্যায় পৌঁছোয়, এখন বুঝতে পারি সেটি খুব সযত্নে নির্মিত হয়েছিলো। শিলাজিত লিখেছিলেন, ‘এই গীটারটা বন্দুক হয়ে যেতে পারে যদি ভয় দেখাও’ (বন্দুক ফ্রয়েডিয় ধাচায় খোলতাই হতো কিন্তুক), অথবা সুমন লিখেছিলান, ‘জানি না গীটার কেন আমার প্রেমের রাজধানী’, অঞ্জনের একটা গোটা অ্যালবামের নাম ছিলো ‘পুরোনো গীটার’। অ্যালবাম মানে ক্যাসেট, যার কভার আর্টেও তারা উপস্থিত হতেন গীটার হাতে। সুমন তার প্রথম অ্যালবামেই লিখেছিলেন, ‘সিন্থেসাইজারের টাপুর টাপুর/ সুমন চাটুয্যের একঘেয়ে সুর’, কিন্তু প্রথম কয়েকটি ক্যাসেটের কভার আর্টে তিনি সবসময়’ই গীটার হাতে কিলার। বিগত দিনের শিল্পীদের হারমোনিয়ম স্যোয়্যাগ আমরা দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম। কিন্তু সেটি যন্ত্রানুসঙ্গ‘ই ছিলো। হারমোনিয়মের নিজের নির্মিত আইডেন্টিটি ছিলো না, বাজার সেভাবে সেই উপস্থিত’ও করেনি। তাই দুটি বিপরীতমুখী ঘটনা হোলো তারুন্যের প্রতীক হিসেবে গীটার উত্থান, কিন্তু তরুণদের হাতে উদবৃত্ত ক্যাপিটলের অভাব। অতএব, সেই বাজারি ফয়সালার পরাকাষ্ঠাটি রচিত হোলো যেটা নিয়ে দু’কথা বলতেই এই ভণিতা। অর্থাৎ বাংলার যন্ত্র উৎপাদনের কাঠামোয় নব্বইয়ের মাঝামাঝি থেকে যে একটা প্যারাডাইম শিফট এলো। লোকাল ব্র্যান্ড গীটারের উত্থান। এই ইতিহাসটা না ঘাঁটলে নতুন বাংলা গানের জগতে গীটারের ধুমকেতু টাইপ উত্থান ও আকস্মিক পতন কোনোটি বোঝা যাবে না। প্রতিটি কৃষ্টিবলয়ের একটা বস্তুগত, মেটিরিয়াল দিক থাকে, যেটা উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে, ও সেই প্রক্রিয়ার অর্থনীতির সাথে জুড়ে থাকে। তেমনি বাংলা নতুন ধারার গানের সাথে ছিলো অঙ্গাঙ্গী ভাবে ছিলো ক্যাসেট বিপণন ও অল্প খরচে গীটার পণ্যটির আত্মপ্রকাশের অধ্যায়টি।                     
বনহুগলী উত্তর কলকাতার বাজনার ঠেক। দেশে ও বিদেশে বেজে ওঠা বহু যন্ত্রের কুলুজি ধরে ব্যাক ক্যাল্কুলেশন করলে তার মুন্ডুটি গোঁত্তা খাবে বরানগরের বেহালাপাড়ার টিমটিমে আলোজ্বলা তেলকালিধুলোমাখা এই অঞ্চলের ছোট ছোট ওয়ার্কশপগুলোয়। ঢুকতেই চোখে পড়বে কাঠের সেতার কাটিং হয়ে সাইকেলে চেপে পালিশ হতে ছুটেছে, বা রোদ্দুরে শুকোচ্ছে সাধের তানপুরাটার লাউ। তরল গালার গন্ধ মিশেছে পোড়া পেট্রলের ঝাঁঝে, আবার কোথাও বসে বেহালার ছড়ে গোছ পড়াচ্ছেন এক বৃদ্ধ কারিগর যার দৃষ্টি মিলিয়ে গেছে কুঠিঘাটের গঙ্গার পারে নিভে আসা প্রাগৈতিহাসিক এক গোধুলির আলোয়। টিমটিমে বাল্ব যার প্রতিবিম্বের নাগালটুকু পায় না। তো এখানেই ‘আলো মিউজিক’ এর মালিক দিলীপদা গীটারে তার পড়াতে পড়াতে বলছিলেন, ‘আমি সাত বছর বয়স থেকে মিউজিকের ‘লাইনে’ বুঝলেন। পয়তাল্লিশ বছর হয়ে গ্যালো এ লাইনে। প্রথম প্রথম বেশি বিক্রী ছিলো হারমোনিয়ম আর তবলার। হারমোনিয়ম মানে বক্স আর বাংলা। বাংলাই চলতো বেশী। বীনার রীড চাইতো সবাই, পাকড়াশি ছিলো বেস্ট, তবে দামী ছিলো। আর তানপুরো বিক্রি হতো মেল, লেডিজ রবীন্দ্র ভারতী কাছে থাকায় তানপুরার সাথে এস্রাজ, সারেঙ্গী, দিলরুবা ও বিক্রি হতো কিছু কিছু। আর কিছু বেচতাম হাওয়াইন গীটার! হেবি সেল! নব্বইয়ের পর থেকে তার বিক্রী কমতে থাকে। এখন প্রায় বন্ধ’। এটা জরুরি কথা। আটের দশকের শেষ অব্দিও বাঙ্গালী গীটার বলতে হাওয়াইয়ান গীটার’ই বুঝতো। অপূর্ব মরমী এই যন্ত্রটির ওপর দখল হারিয়ে আমার ধারনা বাঙ্গালীর ক্ষতি’ই হয়েছে। এর সলাজ, নিভৃত, অনুচ্চকিত ও কিঞ্চিৎ অনুনাসিক কন্ঠে ধাতব পাতের মেদুর প্রয়োগে সবাক হয়ে উঠতো বাঙ্গালীর প্রিয় গানের সুরগুলি। হয়তো সেই সময় বাঙ্গালীর চারিত্রিক আদর্শের সঙ্গে এ মিলেও যেতো কোথাও। মূলতঃ বিদেশী (এবং অনেকাংশে ইলেক্ট্রিক হলেও) যন্ত্রটি তুলসিতলার পিদিম-পিলসুজের মতো একনিষ্ঠ বাঙ্গালী হয়ে উঠতে পেরেছিলো। এই যন্ত্রটি বানাতো মূলতঃ দুটি কোম্পানি, গিভসন ও হবনার। আমাদের ছোটবেলায় আমরা সবাইকে এই দুটির কোনো একটিই বাজাতে দেখতাম।        
যখন নব্বই এর গোড়ায় হঠাত করে স্প্যানিশ গীটারের চাহিদা বাড়ে, তখন এই দুই কোম্পানিই প্রথম তাদের উৎপাদন বাড়ালো, যদিও এই হঠাৎ ক্রমবর্ধমান চাহিদার সাথে তাল রাখা সহজ ছিলো না। কারিগরেরাও, যারা হাওয়াইয়ান গীটারে হাত পাকিয়েছিলেন, তারাও তৈরী ছিলেন না এই চাহিদের জোগান দিতে। তাই প্রথম দিকে, মানে বিরানব্বই (যে বছর ‘তোমাকে চাই’ মুক্তি পায়) থেকে পচানব্বই পর্যন্ত গীটারের মান আশাব্যাঞ্জক ছিলো না। চিন্তন মিউজিক অ্যাকাডেমির গীটারের শিক্ষক সারনাথ বলছিলেন, ‘প্রথমে একটা নায়লন স্ট্রিং এনেহছিলাম বাজাবো বলে। সুমনের একটা প্রভাব ছিলো। সে দেখি বাজেই না। শেষে ব্রিগাঞ্জা থেকে বিদেশি তার এনে লাগাতে খানিক আওয়াজ বেরোলো। কিন্তু বছর সাতেক পর আবার একটা দেশি যন্ত্র কিনেছিলাম। নায়লন স্ট্রিং’ই, এক ছাত্রের জন্য। দেখলাম বেশ ভালোই বাজছে। পাঁচ সাত বছরে কিছু খুব ডেডিকেটেড লুথিয়ের (যারা যন্ত্র বানান) এর নেতৃত্বে বাঙ্গালী কারিগররা কাজটা শিখে নিয়েছিলো’। কিভাবে এত অল্প সময়ে এই কাজটা আয়ত্ত হল, তার সালতামামী ক্রমশ প্রকাশ্য। অলমিতি।   
 

বাংলা লিটিল ম্যাগাজিনের ধারক ও বাহক- সন্দীপ দত্ত'কে মনে করলেন - বিতান দে

 

বিতান দে

আলাপ কবে হয়েছিল মনে নেই। হুজুগ থেকেই পত্রিকা করতে এসেছিলাম ২০১৭ সালে। লিটল্ ম্যাগাজিন কী, কেমন এইসব কিছুই জানতাম না অবশ্য এখন যে সব জেনে গেছি এমন দাবি করছি না। ইউজি ওয়ানে পড়াকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার ক্লাসে বলেছিলেন সন্দীপ দত্ত এবং তাঁর লিটল্ ম্যাগাজিন লাইব্রেরির কথা। এরমধ্যে অবশ্য তাঁর লেখা সাময়িকপত্র সংক্রান্ত বই পড়তে হয়েছে সিলেবাসের কারণেই। তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। পত্রিকার কাজও থমকে গিয়েছিল একরকম। বেতার নাটক সংখ্যা নিয়ে কাজ চলছে, তখনও সন্দীপ দত্তের সঙ্গে আলাপ হয়নি। প্রায় একইসঙ্গে কাজ চলছিল সমর সেন সংখ্যার। বছর দু-আড়াই আগের ঘটনা। একদিন টেমার লেনে গেলাম লিটল্ ম্যাগাজিন লাইব্রেরির সদস্য হব বলে। কত কথা বললেন, সেই প্রথম মুখোমুখি আলাপ। সমর সেনকে নিয়ে কাজ করছি শুনে খুশি হয়েছিলেন খুব। বলেছিলেন আমাদের বয়সী ছেলে-মেয়েরা এখনও সমর সেনকে নিয়ে ভাবে, এটাই ভালো লাগে। একইরকমভাবে যখন বেতার নাটক সংখ্যা প্রকাশ পাবে বলে জানিয়েছিলাম, কী যে আনন্দ পেয়েছিলেন বলার নয়! নিজে থেকে বেতারের কত সব নাম, স্মৃতি বলে যাচ্ছিলেন একের পর এক। বইমেলার মাঠে বসে আছি, দেখি স্যার আসছেন। বেতার নাটক সংখ্যা প্রকাশ পেয়েছে ততদিনে। হাতে নিয়ে দেখে গল্প শুরু করলেন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে, ২০২২ সাল। যত বলি ভিতরে এসে বসুন কিছুতেই আসবেন না। তারপর নিজে টাকা দিয়ে কিনলেন একটি সংখ্যা। সৌজন্য সংখ্যা হিসেবে এক কপি দিতে গেলেই বলতেন, লিটল্ ম্যাগাজিনের আবার সৌজন্য কী! কিনে পড়া উচিত সবসময়। প্যাভেলিয়নে নিজের মতো করে ঘুরতেন, মাথায় সেই টুপি এবং টি শার্ট। লিটল্ ম্যাগাজিনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে এই প্রত্যাশায় অসুস্থ শরীরের কথা ভাবতেন না বিশেষ। সমর সেন সংখ্যার কথা বলেছিলাম। তখন মাঝেমধ্যেই ঢুঁ মারি লাইব্রেরিতে। কোভিডে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর নতুন উদ্যমে গবেষকেরা লাইব্রেরিতে কাজ শুরু করেছেন। স্যার নিজে দায়িত্ব নিয়ে সমর সেনের উপর হওয়া কাজগুলো গুছিয়ে রাখতেন আমার জন্য। যেতে না পারলে নিজে ফোন করতেন, বকা দিতেন। তারপর যেমন প্রয়োজন তেমন ফটোকপিও করে দিতেন। নাও পত্রিকা দরকার। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে খুঁজতে বললেন। কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না, উনি কিন্তু নাছোড়; বললেন, খোঁজো ভালো করে, ওখানেই আছে। খুঁজতে গিয়ে পেলাম সুন্দরম পত্রিকা,‌ সুভো ঠাকুরের সম্পাদনায় প্রকাশ পেত সেই পত্রিকা। বললেন, ভালো করে দেখে নাও, সেই সময়ে এমন কাজ করা কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না! তারপর ঠিক খুঁজে পেলাম নাও, কালো রেক্সিন দিয়ে বাঁধানো। স্যারের সঙ্গে কত গল্প হত, আমার পড়াশোনা নিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, জিজ্ঞেস করতেন পিএইচডি করব কিনা। মাঝেমধ্যে দুঃখ প্রকাশ করতেন যে তাঁর অবর্তমানে কীভাবে লাইব্রেরি চলবে! ততদিনে দেখেছি বহু গবেষককে সেখানে আসতে। বিদেশ থেকে কাজ করতে এসেছেন কতজন! বইমেলা, লিটল্ ম্যাগাজিন মেলা, স্যার কিন্তু লাইমলাইটে আসতেন না কখনো। পত্রিকা নিয়ে টেবিলে বসতেন, নিজের মতো ঘুরতেন, গল্প করতেন। অত বড়ো মাপের একজন মানুষ, অথচ এত প্রচারবিমুখ! অবাক হতাম কখনো কখনো, কী সাধারণভাবে দেখেছি তাঁকে। আমাদের কাজ চলছিল, স্যার লিস্ট করে দিচ্ছিলেন। তারপর একদিন তাঁর অসুস্থতার খবর পেলাম। জানতে পারলাম অনির্দিষ্টকালের জন্য লাইব্রেরি বন্ধ থাকবে‌। তারপর অপেক্ষা করতে করতে একসময় সময় ফুরালো। টেমার লেনের ওই বাড়িতে কী ধনসম্পদ রয়েছে আমরা জানি।

 

সন্দীপ দত্ত

 

অত পত্রিকা; উই, আরশোলায় তার কত নষ্ট করেছে সেই খবরও জানি। আর জানি স্যারের পরিশ্রম। কত যত্নে সব আগলিয়ে রেখেছিলেন আমাদের জন্য। আমার মতো অকিঞ্চিৎকরকেও ভালোবেসেছিলেন অনায়াসে। কাজকে ভালোবেসে নিজের কর্তব্য করে গেছেন এই মানুষটি। সন্দীপ দত্ত, আপনি কখনো আমার কাছে সন্দীপদা নন, আপনি স্যার, আমার একজন মাস্টারমশাই। 

 
 

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published.