ভাণ পত্রিকা
ছত্রিশতম সংখ্যা || সাতাশতম ই-সংস্করণ || এপ্রিল ২০২৩
সম্পাদক :
সম্পাদনা সহযোগী :
প্রচ্ছদ :
নক্সা পরিকল্পক :
অন্যান্য কাজে :
ভাণ-এর পক্ষে:
পার্থ হালদার
কর্তৃক
৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬
( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )
৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) bhaan.kolkata@gmail.com ( ই – মেল )
Reg. No : S/2L/28241
‘The Banshees of Inisherin’ সিনেমা নিয়ে আলোচনা করলেন – সম্রাট লস্কর
‘উড়ন্ত তারাদের ছায়া’ নাটকটির খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করলেন – দেবহূতি সরকার
‘Saas Bahu Achaar Pvt. Ltd.’ ওয়েব সিরিজ নিয়ে আলোচনায় মাতলেন – বৃতা মৈত্র
যাপিত নাট্যের দশম কিস্তি লিখলেন – কুন্তল মুখোপাধ্যায়
এশীয় থিয়েটারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে, তৃতীয় পর্ব লিখলেন – সায়ন ভট্টাচার্য
গিটারের অন্তরঙ্গে ঢুঁ মারলেন – অরিক্তম চ্যাটার্জি
বাংলা লিটিল ম্যাগাজিনের ধারক ও বাহক- সন্দীপ দত্ত’কে মনে করলেন – বিতান দে
সূচি
সম্পাদকের কথা
কবি বলেছিলেন – আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না। ফকির গেয়েছিলেন ” আমি কে তাই জানিলে সাধন সিদ্ধ হয়”! তাবৎ ভারতীয় দর্শনে বারংবার নিজেকে চেনার উপদেশ আছে। তবু নিজেকে অচেনা রেখেই মরছে বেশিরভাগ মানুষ। নিজেকে চেনার সামর্থ্য মানুষের অর্জন হয়নি এখনো। জীবনে থেকে জীবনকে না চেনার দুঃখ মানুষের নিয়তি। ইদানিং গোল বেঁধেছে আরও গভীরে। নিজেকে ভুল চেনায়। ভুল কে ঠিক ভাবায় এবং সে ভুল নিয়ে অহংকারী হওয়ায়। বালখিল্য-হাস্যকর-বিরক্তিকর আচরণের মানুষ এখন ক্রমবর্ধমান। না জেনে না বুঝে ‘ সব জেনে গেছি, বুঝে গেছি ‘ ভাব, আইডেন্টিটির কোন ক্রাইসিস থেকে আসে তা ভেবে দেখবেন নিরহঙ্কারী মনোবিদরা। আমরা বরং নিজেদের এক্তিয়ারের দু চার কথা ভাবি!
সেল্ফ অ্যাসেসমেন্ট বলে একটা দামি কথা আছে। কথাটিতে আধ্যাত্মিক বাড়াবাড়ি নেই। মোটের ওপরে কেজো নির্দেশ – নিজেকে জেনে বুঝে কাজে নামার সোজা ইঙ্গিত আছে এতে। এতে কাজের যেমন সুবিধা, কাজের মানুষেরও। আমার এক্তিয়ার ও সামর্থ্যের সঙ্গে আমার ক্রিয়াকর্মের ব্যবধান কমিয়ে আনার কথা মনে করিয়ে দেয় এই ইংরেজি শব্দটি। আত্মসচেতন হয়ে কাজ করা আর আত্ম প্রেমে নার্সিসিস্ট হয়ে অনভিপ্রেত ক্রিয়াকাণ্ড বাঁধানো যে এক কথা নয়, শব্দটিকে তলিয়ে দেখলে সে ভাষ্যও মেলে।তো কথা হচ্ছে এই আত্ম অনুধাবন কমে আসতে আসতে তলানি তে ঠেকেছে। অবশিষ্ট পতন ঠেকাতে না পারলে ঠেকনা দিয়েও ধরিত্রীর বোঝা বয়ে নিয়ে চলা মুশকিল। ওপর চালাকির দ্বারা মহৎ কিছু ঘটে না। ফাঁপা ঠুনকো কেরামতি গভীর ছুঁতে পারে না। অন্তরের সঙ্গে বাইরের যোগাযোগের নিরন্তন সাধনা ছাড়া একটি ভন্ড দুনিয়ারই দেখা মেলে।
টেকনো নির্ভরতায় আত্মপ্রকাশের ধরন পাল্টেছে, ওদিকে বিস্তার বেড়েছে বিস্তর! আপাত ভাবে সবকিছু সহজলভ্য মনে হচ্ছে। তাই এখন গায়ক নায়ক শিল্প শিল্পীর ছড়াছড়ি। আমি দু একটা গান মোটের ওপর ঠিকঠাক গাইতে পারি মানেই আমি যে গায়ক নই, গিটার আর মাওতোরগানে সুর তুলতে পারি মানেই আমি যে মিউজিক ডাইরেক্টর নই; ইতিহাসের তথ্য বিশ্লেষণ কিছু জানি বলেই যে আমি ঐতিহাসিক নই, চাঁদের পানা মুখ নিয়ে চারটে লোক কে ভেঙাতে পারি মানেই আমি যে অভিনেতা নই; এগ্রোনমি তে পাস দিয়েছি মানেই যে আমি কৃষিবিজ্ঞানী নই – এই বোধ টি বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। অর্জনের তুলনায় সম্পত্তিকে বেশি দেখানো, কঞ্চি হয়ে নিজেকে পুরুষ্টু বাঁশ ভাবা, শিশুবেলায় নিজেকে খোকার বাপ ভাবার মতোই বালখিল্য ও হাস্যকর।
কেবল হাস্যকর নয়। বিষয়টা দেশ জাতি সভ্যতা সংস্কৃতির পক্ষে বেশ বিপদজ্জনকও বটে। একজন মোটের ওপর ভালো অভিনেতা ভাবছেন তিনি উপন্যাস লিখবেন। এতদিন যে লেখেননি সে নির্ঘাত সময়াভাবে! প্রকাশক তার উপন্যাস না ছেপে যাবেন কোথায়। বৌ বাচ্চা পরিবার সহ আত্মজৈবনিক দাবি নিয়েই তো তিনি প্রকাশক। অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত ফ্যানরা গোটা উপন্যাস পড়বেন না একথা সত্য। কিন্তু কিনবেন না, এ তো আর সত্য নয়। আর কিনলেই প্রকাশকের লাভ। কিনে না পড়লে কার ক্ষতি প্রকাশকের সে ভাবনায় লাভ নেই!
তো এখন, অভিনেতা উপন্যাসকার হয়ে উঠে থামলেন না। গায়ক হতে চাইলেন। ওমা কী সুষ্ঠু ব্যবস্থা! মাস ছয়েকের মধ্যেই লিটারারি মিট এবং সরকারি অনুষ্ঠানে কৌশিকী চক্রবর্তীর সঙ্গে মঞ্চ শেয়ার করে তিনি হয়ত অতঃপর এম পি হওয়ার জন্য পার্টি জয়েন করলেন!! ঈশ্বর, কিছু হতে আর কিছু লাগে না। সব কিছু সস্তা, সহজলভ্য, চাইলেই হাতে ছোঁয়া যায়!!
মনসংযোগ, লাগাতার চর্চা, দেহে মনে পরিশ্রম, গভীরতর শিক্ষা, অধ্যাবসায়, ত্যাগ তিতিক্ষা কিছুই জরুরি নয় ! তুমি সৎ শিল্পী হয়ে দুশো লাইক। আমি জামা খোলার ভান করে রিল করলে লাখো লাইক!! সবার অভিযোগ, তার প্রতিভা দাম পেল না। তার কাজ কেউ বুঝল না। অতএব একটা জীবন মামা, যা ইচ্ছা তাই করে নাও। ফেসবুক ইন্সটা, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, রিল ভিডিও। হরেক মঞ্চ। বিচিত্র পারফরম্যান্সে ভরে দাও। গানের নামে একটা থ্যাবড়ানো চিৎকার ইউটিউবে আপলোড করে দাও, মানা করবার কেউ নেই।রান্না না জেনে রান্নার চ্যানেল খুলে দাও। এমন চ্যানেল ও দেখেছি, জব্বর ধনী বাপের একটি মেয়ে সারা সপ্তাহে কত বিচিত্র দামি দামি জিনিসপত্র কিনেছে তাই ঢোল পিটিয়ে দেখাতে বসে তার নিজস্ব চ্যানেলে। সেখানেও কমেন্ট বক্সে ‘দিদি লাভ’ ইউ” এর হাহাকার!! জয় গণতন্ত্র, জয় পুঁজি, জয় বাজার, জয় অনন্ত স্বাধীনতা!!
এতো স্বাধীনতা, যেখানে বিজ্ঞানেও তালি। কুসংস্কারেও তালি।বিকেলে দুষ্টু মিষ্টি রিলও ভালো। পাড়ার পাশের ঝিলও ভালো!
তবু রাত বাড়লে কারও কারও কেন যে মনে হয়, এ জন্মে কিচ্ছু করা হল না। এইটাই একমাত্র জ্বালা এবং আশা।
আমার এক ছাত্রী যে কোভিড কালে “দেখে লেখা পরীক্ষায়” ফার্স্টক্লাস পেয়েছে, যার তিন লাইনে কমপক্ষে নয়টি বানান ভুল থাকে; – জানালো, সে ডব্লিউ বি সি এস এর প্রিপারেশন নিচ্ছে। ভালো করে নে, বলতে গিয়ে গলা শুকিয়ে গেল আমার। আমার অন্য এক ছাত্রী সেদিন ফোন করে জানাল ওর ক্লাসে পৌঁছাতে দেরি হবে, তাই আমি যেন খানিক লেটে ক্লাসে যাই। গলায় কিছু একটা লটকে গেল বলে প্রত্যুত্তর দেবার ঝুঁকি থেকে বেঁচে গেলাম। পনি টেইল শোভিত সদ্য থিয়েটারে আসা একটি ছেলে আমায় জানালো, ও অপেক্ষায় আছে। আসল জহুরী ডিরেক্টর ওকে ঠিক ডেকে নেবেন নায়কের পার্টে। র- ফলা, য-ফলা উচ্চারণ করতে যে মানুষ ঝালাপালা বাঁধায়, রাগ অনুরাগ বিরাগ বিরহ প্রকাশে যে একচোখা, একমাত্রিক- সে ছোঁড়ার এ কনফিডেন্স কোন সূত্রে প্রাপ্ত হল এ এক ধাঁধা বটে। রসময় পাঠকের ঝুলিতে এমন অগনন উদাহরণ আছে জেনে ক্ষান্ত হয়ে পরের কথায় আসি!
ভেবে দেখলে বুঝবেন এর সমস্তটাই ধাঁধা নয়, হামবড়া ভাবের মানুষ চিরকাল ছিল। তারা নিজেরাই জানত কোন ফাঁপা স্তর থেকে তারা জীবনকে দেখে!! সত্যকারের প্রতিভাধর কাজের মানুষের কাছে তাদের মাথা থাকতো নত। আজ যে মাথা উঁচিয়ে,চোখ বাগিয়ে, বুক চিতিয়ে, মুখ ভেংচিয়ে নিজেকে যা, তার তুলনায় অনেক বড় করে দেখার প্রবৃত্তি বৃদ্ধি পেয়েছে, কোনো সাধনা ছাড়াই শ্রেষ্ঠ সাধক বনার যে হিড়িক পড়েছে, তার অনেক কারণের মধ্যে বর্তমানের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বড় ভূমিকা আছে। সমাজের মাথা বলছেন তার ৩০ টির এর মতো ভাষাতে পব্লেম নেই। এর ফলে নয়টি ভাষায় বুৎপত্তি অর্জন করা ভারতপথিক রামমোহন এর ২৫০ বছর উদযাপনে তেনার ছবি রামমোহনের তিনগুণ বড় দিতে বাধা থাকছে না! নয় তিনে সাতাশ – অঙ্ক পরিষ্কার। এক এইট ফেল মূলাধারীর পক্ষে স্রেফ গুন্ডাগিরি করে বিডিও এস ডি ও – এর টেবিলে পা তোলা যাচ্ছে। চেয়ার তুলে মারা যাচ্ছে। থুতু পর্যন্ত দেওয়া যাচ্ছে। মন্ত্রী হয়ে যাত্রা করা যাচ্ছে, অঢেল কবিতা লেখা যাচ্ছে, ছবিতে তুলিতে শিল্পের সমস্ত তালুকের তালুকদার বনা যাচ্ছে। ইচ্ছে হলেই দুবছরের দু একবার ইউনিভার্সিটি ছুঁয়ে পি এইচ ডি বাগিয়ে নেওয়া যাচ্ছে। এম পি হয়ে ভারতের পার্লামেন্ট থেকে ফিরে এসে শরীরী আকর্ষণের রিল বানাতেও বাধা থাকছে না! একটা সদর্থক বচন আছে বাংলায় – ” যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে ” । তার যে এমন কদর্য রূপ কুৎসিত স্বরূপে প্রকাশিত হবে এ ছিল অচিন্তনীয়।
নিজের সঙ্গে কথা বলার মহামূল্যবান ভারতীয় কালচার আজ পর্যুদস্ত। নিজেকে না চেনার থেকে নিজেকে ভুল চেনার ভ্রমে আমরা আজ বিভ্রান্ত। একটা কিছু গড়ে তুলতে গেলে যে মানসিক স্থিতি লাগে তার ‘মূল’ অস্থিরতায় দুলছে। এই তো চেয়েছিল ওরা। আমাদের প্রভুরা। আমরা ওদের হাড়িকাঠে মাথা গুঁজে ” উই আর ফ্রি। উই লাভ ফ্রিডম” বলে চ্যাচাচ্ছি। এই ফ্রি হল ফোকোট। এই স্বাধীনতা মানে সস্তা। নিজেকে সস্তা করা। দেশকে হীন করা। নিজেকে না চিনলে দেশও অচেনা থাকবে। সব অ্যাসেসমেন্ট গুলিয়ে যাবে…। আসুন আমরা “শ্রী শ্রী সৎ বিবেচক” ঈশ্বরের আরাধনায় মাতি!
‘The Banshees of Inisherin’ সিনেমা নিয়ে আলোচনা করলেন - সম্রাট লস্কর
সম্রাট লস্কর
বন্ধুত্বের ভাঙনকাল ও চলচ্চিত্রের অন্তর্নিহিত নাট্য-ব্যাকরণ: একটি
অর্বাচীন আলোচনা
ইনিশেরিনের প্রায়-অলস দিনযাপনের একটি প্রধান আকর্ষণের জায়গা অবশ্যই স্থানীয় পানশালা যেখানে বন্ধুরা, প্রতিবেশীরা মিলিত হয় প্রাত্যহিক আড্ডায়। প্রতি দুপুরে দ্বীপের সাদাসিধে যুবক পড্রিক (অভিনয়ে: কলিন ফ্যারেল) তাঁর অসমবয়সী প্রৌঢ় বন্ধু কলাম-এর (অভিনয়ে:
ব্রেন্ডন গ্লিসন) সাথে পানশালায় যায়। তাদের বন্ধুত্বের এ এক প্রাত্যহিক উদ্যাপন। সিনেমা শুরুর দুপুরটায় অবশ্য সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা ঘটে যায়। বন্ধুকে ডাকতে এসে পড্রিক দেখে কলাম চুপচাপ ঘরে বসে ধূমপান করে চলেছে; পড্রিকের ডাকে সে ফিরেও তাকায় না, কোনো
উত্তরও দেয় না। বিস্মিত পড্রিক ঘরে ফিরে আসে। তার অবিবাহিত বোন শোভান-কে (অভিনয়ে:কেরি কন্ডন) জানায় কলামের অদ্ভুত আচরণের কথা। “তোমায় বোধহয় ও আর পছন্দ করছে না তেমন”, শোভান ঠাট্টার সুরে বলে ওঠে। কথাটা সেও বিশ্বাস থেকে বলে নি, পড্রিকও বিশ্বাস করেনি। সরল, সাদাসিধে পড্রিক ভাবতেও পারে না যে তার প্রিয় বন্ধু তাকে আর পছন্দ করে না।অথচ, সেটাই সত্যি। এই গ্রাম্য, সাধারণ বুদ্ধির পড্রিকের সঙ্গে সময় কাটিয়ে কলাম আর সময় নষ্ট করতে চায় না। সে বরং তার জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো কাটিয়ে দিতে চায় সঙ্গীতের একনিষ্ঠ সাধনায়, নতুন সুরের সৃষ্টিতে। সেখানে পড্রিকের কোনো জায়গা নেই। কলাম তাই পড্রিকের সাথে শুরু করেছে প্রাক-অনলাইন যুগের ‘গোস্টিং’, এক নিষ্ঠুর অবজ্ঞা।পড্রিক অবশ্য এত কিছু বোঝে না। সে কলামের বন্ধুত্ব ফিরে পেতে চায়। বারংবার চেষ্টা করে
কলামের সাথে যোগাযোগ করতে। তিতিবিরক্ত হয়ে কলাম জানায় যে পড্রিক এ’রকম করতে থাকলে সে নিজের হাতের আঙুল একটা একটা করে কাটতে থাকবে। জেদী পড্রিক এই কথায় কোনো পাত্তাই দেয় না। নানা ভাবে সে কলামের কাছে ঘুরঘুর করতে থাকে, নেশার ঘোরে তাকে যা নয় তাই বলে, পরের সকালে ক্ষমা চাইতে গিয়েও গোলমাল করে ফেলে। কলাম তাদের বন্ধুত্বের স্পষ্ট সমাপ্তি ঘোষণা করে নিজের বাঁ হাতের একটা আঙুল কেটে সেই কাটা আঙুলটা পড্রিকদের বাড়ির দরজায় ছুঁড়ে দিয়ে। তাতেও কি পড্রিকের চেতনা হয়? না। সে এত সহজে হাল ছাড়তে রাজি নয়।পড্রিকের মরা বন্ধুত্ব বাঁচিয়ে তোলার এই নিষ্ফল চেষ্টায় একের পর এক বিপত্তি নেমে আসে ওই ছোট্ট দ্বীপে — কলামকে হারাতে হয় বাঁ হাতের অবশিষ্ট আঙুলগুলো; দুটো মৃত্যু আসে অকস্মাৎ, একটি মানুষের এবং আরেকটি বাড়ির অতি আদরের পালিত পশুর; একজন হুমকি দিয়ে আগুন লাগায় অন্যজনের বাড়িতে; এক অস্বস্তিকর অসমাপ্তির আবহে শেষ হয় সিনেমাটি। আইরিশ লোককথায় আছে যে কারো মৃত্যু আসন্ন হলে প্রেতিনী বন্শি-রা কেঁদেকেটে সেই মৃত্যুর কথা নাকি আগাম জানিয়ে দেয়। ইনিশেরিনের বন্শিদের কান্নাতে অবশ্য শারীরিক মৃত্যুর থেকেও গুরুত্ব পেয়েছে বন্ধুত্বের এই হনন। শেষ দৃশ্যে সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে দুই (প্রাক্তন) বন্ধু শুনতে থাকে আয়ারল্যান্ডের মূল ভূখণ্ড থেকে ভেসে আসা গৃহযুদ্ধের দামামা। ওই গৃহযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে একদিন, কিন্তু দুই বন্ধুর নিজস্ব যুদ্ধের কী হবে? এই ছোট্ট দ্বীপে ঘটতে থাকা এই ট্র্যাজেডি কি শুধুই ব্যক্তিগত? কে বেশি দায়ী এর জন্য? কলামের নিষ্ঠুর, স্বার্থপর সিদ্ধান্ত নাকি পড্রিকের বন্ধুত্ব বাঁচিয়ে রাখার অর্থহীন নাছোড়বান্দা চেষ্টা? মার্টিন ম্যাকডোনা সেই উত্তর ইচ্ছাকৃত ভাবেই দেন নি। উত্তর খোঁজার ভার তিনি বরং ছেড়ে দেন আমাদেরই ওপর।
আদতে নাট্যকার হিসেবে পরিচিত ও সমাদৃত হলেও চলচ্চিত্র জগতে ম্যাকডোনার অভিজ্ঞতাও কম নয়। তাঁর লেখা ও পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘সিক্স শুটার’ লাইভ অ্যাকশন শর্ট ফিল্ম বিভাগে জিতে নিয়েছিল ২০০৬-এর অ্যাকাডেমি পুরস্কার। পরের দেড় দশকে একে একে মুক্তি পায়
ম্যাকডোনার আরো চারটি সিনেমা, প্রতিটিই পূর্ণদৈর্ঘ্যের — ‘ইন ব্রুজ’ (২০০৮), ‘সেভেন সাইকোপ্যাথ্স’ (২০১২), ‘থ্রি বিলবোর্ডস আউটসাইড এবিং, মিসৌরি’ (২০১৭) এবং অবশ্যই আমাদের আলোচিত ‘দ্য বন্শিজ অব্ ইনিশেরিন’ (২০২২)। এই সব ক-টি সিনেমাতেই লেখক-পরিচালক তাঁর নাট্যজগতের অভিজ্ঞতাকে সচেতন ভাবে কাজে লাগিয়েছেন। বারে বারে নিয়ে এসেছেন নাটকে ব্যবহৃত তাঁর নিজস্ব আইরিশ ডার্ক হিউমার। তবে ম্যাকডোনার পাঁচটি সিনেমার মধ্যে ‘দ্য বন্শিজ অব্ ইনিশেরিন’-এই নাটকের প্রভাবটা সবচেয়ে বেশি। চলচ্চিত্র ও নাটক —
এই দুই মাধ্যমের মাঝের দেওয়ালটা এখানে একেবারে উধাও না হলেও জায়গায় জায়গায় সচেতন ভাবে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সেই সব ফাটল দিয়ে অনায়াসেই একদিক থেকে অন্যদিকে যাতায়াত করা যায়। চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাগৃহে বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ‘দ্য বন্শিজ অব্ ইনিশেরিন’ দেখতে দেখতে দর্শকের মনে হতেই পারে যে সে আদতে একটি নাটক-ই সে দেখছে ব্রডওয়ে বা রয়্যাল ন্যাশনাল থিয়েটারে বসে। আয়ারল্যান্ডের অ্যারান দ্বীপপুঞ্জের নাম এলেই যে নাট্যকারের নাম প্রথমেই ভেসে আসে তিনি হলেন জন মিলিংটন সিং। বন্ধু ইয়েট্সের পরামর্শে অ্যারান দ্বীপপুঞ্জে কিছুদিন কাটানোর পর বিংশ শতকের প্রথম দশকে সিং অ্যারান দ্বীপপুঞ্জের পটভূমিকায় লিখতে থাকেন ‘রাইডার্স টু দ্য
সি’-এর মতো একের পর এক অসাধারণ সব নাটক। সিং-এর প্রায় এক শতাব্দী পর ম্যাকডোনাও অ্যারান দ্বীপপুঞ্জের পটভূমিকায় লেখেন তিনটি নাটক যার মধ্যে প্রথম দু’টি — ‘দ্য ক্রিপ্ল অব্ ইনিশমান’ (১৯৯৮) আর ‘দ্য লেফটেনান্ট অব্ ইনিশমোর’ (২০০৬) অভিনীত হলেও তৃতীয়টি
মঞ্চ পর্যন্ত এখনও পৌঁছায় নি। ম্যাকডোনার ওই নাটকটিকে অভিনয়যোগ্য বলে একেবারেই মনে হয় নি। কী ছিল ওই তৃতীয়টি নাটকটির নাম? ‘দ্য বন্শিজ অব্ ইনিশীর’। সেই নাটকের-ই কি সিনেম্যাটিক ভার্সন ‘দ্য বন্শিজ অব্ ইনিশেরিন’? হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না। স্পষ্ট উত্তর
ম্যাকডোনা এখনও দেন নি। তবে অ্যারান দ্বীপপুঞ্জের কোনো দ্বীপের বন্শিদের নিয়ে ম্যাকডোনা যে কিছু ভেবেছিলেন অনেক আগেই সেটা আন্দাজ করাই যায়। সেই নাট্যভাবনা থেকেই হয়তো এই সিনেমাটার জন্ম। এমন এক সিনেমা যার নির্মাণে নাটকের অন্তর্নিহিত ব্যাকরণ,
আরোপিত রীতি-নীতি জড়িয়ে থাকবে পরতে পরতে।সেই ইয়েট্স বা সিং-এর আমল থেকেই আইরিশ নাটকে ধ্রুপদী নিয়ম মেনে চলার একটা সচেতন চেষ্টা দেখা যায়। সিং তাঁর ‘রাইডার্স টু দ্য সি’ নাটকে রেনেসাঁসের নব্য-অ্যারিস্টট্লীয়দের প্রিয় তিন ক্লাসিকাল ইউনিটিজ-এর সার্থক ব্যবহার করেছিলেন সুচারু দক্ষতায়। ম্যাকডোনাও তাঁর সিনেমায় সেটা করারই চেষ্টা করেছেন। নাটকের তিনটি ধ্রুপদী ঐক্য — unity of time, unity of place, unity of action, মেনে চলার চেষ্টা করা হয়েছে সিনেমাটিতে। অ্যারিস্টট্ল বলেছিলেন নাটকের ঘটনাক্রম সূর্যের একটি ঘূর্ণনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার কথা; ম্যাকডোনা তাঁর চিত্রনাট্যে একদিনের ঘটনা দেখান নি বটে, কিন্তু পুরো সিনেমা জুড়ে দেখানো হয়েছে কয়েকটি
মাত্র দিনের ঘটনা। সিনেমাটির সব অ্যাকশন ওই কাল্পনিক ইনিশেরিন দ্বীপেই ঘটে। মূল ভূখণ্ড থেকে কেউ কেউ আসে (যেমন কলামের নতুন বেহালাবাদক বন্ধু), আবার শোভানের মতো কেউ কেউদ্বীপের এই ছোট্ট পরিসরে হাঁপিয়ে উঠে চাকরি নিয়ে চলে যায় ইনিশেরিন ছেড়ে। সে সব সিনেমাতে উল্লেখ থাকে কিন্তু ক্যামেরায় দেখা যায় শুধু ইনিশেরিন-কেই। এ এমন এক দ্বীপ যা আধুনিক “সভ্যতা”র থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। যুদ্ধের খবর আর বন্দুকের আওয়াজ ভেসে আসে এখানে প্রায়ই; তেমন কোনো আলোড়ন অবশ্য পড়ে না। গল্পের একমুখিতাও এই সিনেমার এক পরম বিশেষত্ব। মানুষ ও পালিত পশুর আত্মীয়তা, বাবা-ছেলের সম্পর্কের ভয়াবহতা, একাকী নারীর নিজস্ব পরিচয় তৈরি করে আধুনিক হওয়ার চেষ্টা, এ র’কম অনেক বিষয় সিনেমাটি ছুঁয়ে গেলেও, মূল ফোকাস থাকে অবশ্যই দুই (প্রাক্তন) বন্ধুর সম্পর্কের দ্বন্দ্বে। Unity of action নিশ্চিত ভাবেই তাই প্রতিষ্ঠিত হয় এই সিনেমায়।‘দ্য বন্শিজ অব্ ইনিশেরিন’-এ নাটকের অন্যান্য বেশ কিছু প্রচলিত উপাদানও লেখক/পরিচালক
ব্যবহার করেছেন। আইরিশ নাটকে বোকাসোকা, হাঁদা টাইপের যে চরিত্রগুলো হামেশাই দেখা যেত, সেগুলো এখানেও এসেছে। পড্রিক নিজেই তো সে রকম এক চরিত্র, তবে আরেকটি চরিত্রও আছে ওই ধরনের — ডমিনিক (অভিনয়ে: ব্যারি কিয়োগান)। স্থানীয় বদমেজাজী পুলিশ অফিসারের ছেলে।বাবার কাছে হরদম মার খাওয়া, সুন্দরী শোভানের প্রতি দুর্বল ডমিনিক যেন পড্রিকের-ইআরেকটা সত্তা। ডমিনিকের করুণ পরিণতি সিনেমার গল্পে নিয়ে আসে এক অপ্রত্যাশিত ধাক্কা।পড্রিক হারায় তার আরেক বন্ধুকে। নাটকের গানের মতোই সঙ্গীত বারে বারে চলে আসে এই সিনেমায়। এই সঙ্গীত ঠিক লিরিকাল হয়ে ওঠে না। কলামের বেহালায় যে সুর বেজে ওঠে তাতে কদাচিৎ শোনা যায় জীবনের উল্লাস। বরং সেই সঙ্গীতে ধ্বনিত হয় বিচ্ছেদের সুর; মিশে যায় বন্শিদের অশুভ কান্না। অ্যারান দ্বীপপুঞ্জের নাটকে অলৌকিকতার উপস্থিত হয় স্বাভাবিক নিয়মেই। এই সিনেমাতে সেই অমোঘ অলৌকিকতার আবহ তো ‘বন্শিজ’ শব্দটির মধ্যেই স্পষ্ট নিহিত। মিসেস ম্যাক্কর্মিকের (অভিনয়ে: শীলা ফ্লিট্ন) চরিত্রটি হয়ে ওঠে ইনিশেরিনেররেসিডেন্ট বন্শি। সিং-এর নাটকের কোরিক চরিত্রগুলোর মতোই তিনি করেন অমোঘ সব ভবিষ্যদ্বাণী। সাবধান করে দেন আগামী মৃত্যুর সংবাদ দিয়ে। সিনেমার শেষ দৃশ্যে মিসেস ম্যাক্কর্মিক তাকিয়ে থাকেন সমুদ্রতীরে দাঁড়ানো দুই (প্রাক্তন) বন্ধুর দিকে। কেন? তিনি কী এমন কিছু জানেন যা অন্য কেউ জানে না? মৃত্যু কি আবার আসবে এই দ্বীপে কয়েক দিন বাদেই?
বন্ধুত্ব কি আবার জোড়া লাগবে নাকি তাদের সংঘাত চলতেই থাকবে এই ১৯২৩-এর আয়ারল্যান্ডের গৃহযুদ্ধের মতো? ‘দ্য বন্শিজ অব্ ইনিশেরিন’-কে কী নামে ডাকলে ঠিক হবে?এটি একটি চলচ্চিত্র না নাটকের চলচ্চিত্র রূপ? উত্তরগুলো খোঁজার কি আদৌ প্রয়োজন আছে?
সেটাও ভাবতে হবে যে।
গল্প, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: Martin McDonagh
অভিনয়ে: Colin Farrell, Brendan Gleeson, Kerry Condon, Barry Keoghan, Sheila
Flitton and others.
‘উড়ন্ত তারাদের ছায়া’ নাটকটির খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করলেন - দেবহূতি সরকার
দেবহূতি সরকার
“উড়ন্ত তারাদের ছায়া” ধরা পড়ে কি ঘাতকের চোখে?
‘Saas Bahu Achaar Pvt. Ltd.’ ওয়েব সিরিজ নিয়ে আলোচনায় মাতলেন - বৃতা মৈত্র
যাপিত নাট্যের নবম কিস্তি লিখলেন - কুন্তল মুখোপাধ্যায়
এশীয় থিয়েটারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে, তৃতীয় পর্ব লিখলেন - সায়ন ভট্টাচার্য
এশীয় থিয়েটার : পরিসর চিন্তা ও অন্বেষণ:সায়ন ভট্টাচার্য
গিটারের অন্তরঙ্গে ঢুঁ মারলেন - অরিক্তম চ্যাটার্জি
অরিক্তম চ্যাটার্জি
বাংলা লিটিল ম্যাগাজিনের ধারক ও বাহক- সন্দীপ দত্ত'কে মনে করলেন - বিতান দে
বিতান দে
আলাপ কবে হয়েছিল মনে নেই। হুজুগ থেকেই পত্রিকা করতে এসেছিলাম ২০১৭ সালে। লিটল্ ম্যাগাজিন কী, কেমন এইসব কিছুই জানতাম না অবশ্য এখন যে সব জেনে গেছি এমন দাবি করছি না। ইউজি ওয়ানে পড়াকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার ক্লাসে বলেছিলেন সন্দীপ দত্ত এবং তাঁর লিটল্ ম্যাগাজিন লাইব্রেরির কথা। এরমধ্যে অবশ্য তাঁর লেখা সাময়িকপত্র সংক্রান্ত বই পড়তে হয়েছে সিলেবাসের কারণেই। তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। পত্রিকার কাজও থমকে গিয়েছিল একরকম। বেতার নাটক সংখ্যা নিয়ে কাজ চলছে, তখনও সন্দীপ দত্তের সঙ্গে আলাপ হয়নি। প্রায় একইসঙ্গে কাজ চলছিল সমর সেন সংখ্যার। বছর দু-আড়াই আগের ঘটনা। একদিন টেমার লেনে গেলাম লিটল্ ম্যাগাজিন লাইব্রেরির সদস্য হব বলে। কত কথা বললেন, সেই প্রথম মুখোমুখি আলাপ। সমর সেনকে নিয়ে কাজ করছি শুনে খুশি হয়েছিলেন খুব। বলেছিলেন আমাদের বয়সী ছেলে-মেয়েরা এখনও সমর সেনকে নিয়ে ভাবে, এটাই ভালো লাগে। একইরকমভাবে যখন বেতার নাটক সংখ্যা প্রকাশ পাবে বলে জানিয়েছিলাম, কী যে আনন্দ পেয়েছিলেন বলার নয়! নিজে থেকে বেতারের কত সব নাম, স্মৃতি বলে যাচ্ছিলেন একের পর এক। বইমেলার মাঠে বসে আছি, দেখি স্যার আসছেন। বেতার নাটক সংখ্যা প্রকাশ পেয়েছে ততদিনে। হাতে নিয়ে দেখে গল্প শুরু করলেন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে, ২০২২ সাল। যত বলি ভিতরে এসে বসুন কিছুতেই আসবেন না। তারপর নিজে টাকা দিয়ে কিনলেন একটি সংখ্যা। সৌজন্য সংখ্যা হিসেবে এক কপি দিতে গেলেই বলতেন, লিটল্ ম্যাগাজিনের আবার সৌজন্য কী! কিনে পড়া উচিত সবসময়। প্যাভেলিয়নে নিজের মতো করে ঘুরতেন, মাথায় সেই টুপি এবং টি শার্ট। লিটল্ ম্যাগাজিনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে এই প্রত্যাশায় অসুস্থ শরীরের কথা ভাবতেন না বিশেষ। সমর সেন সংখ্যার কথা বলেছিলাম। তখন মাঝেমধ্যেই ঢুঁ মারি লাইব্রেরিতে। কোভিডে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর নতুন উদ্যমে গবেষকেরা লাইব্রেরিতে কাজ শুরু করেছেন। স্যার নিজে দায়িত্ব নিয়ে সমর সেনের উপর হওয়া কাজগুলো গুছিয়ে রাখতেন আমার জন্য। যেতে না পারলে নিজে ফোন করতেন, বকা দিতেন। তারপর যেমন প্রয়োজন তেমন ফটোকপিও করে দিতেন। নাও পত্রিকা দরকার। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে খুঁজতে বললেন। কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না, উনি কিন্তু নাছোড়; বললেন, খোঁজো ভালো করে, ওখানেই আছে। খুঁজতে গিয়ে পেলাম সুন্দরম পত্রিকা, সুভো ঠাকুরের সম্পাদনায় প্রকাশ পেত সেই পত্রিকা। বললেন, ভালো করে দেখে নাও, সেই সময়ে এমন কাজ করা কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না! তারপর ঠিক খুঁজে পেলাম নাও, কালো রেক্সিন দিয়ে বাঁধানো। স্যারের সঙ্গে কত গল্প হত, আমার পড়াশোনা নিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, জিজ্ঞেস করতেন পিএইচডি করব কিনা। মাঝেমধ্যে দুঃখ প্রকাশ করতেন যে তাঁর অবর্তমানে কীভাবে লাইব্রেরি চলবে! ততদিনে দেখেছি বহু গবেষককে সেখানে আসতে। বিদেশ থেকে কাজ করতে এসেছেন কতজন! বইমেলা, লিটল্ ম্যাগাজিন মেলা, স্যার কিন্তু লাইমলাইটে আসতেন না কখনো। পত্রিকা নিয়ে টেবিলে বসতেন, নিজের মতো ঘুরতেন, গল্প করতেন। অত বড়ো মাপের একজন মানুষ, অথচ এত প্রচারবিমুখ! অবাক হতাম কখনো কখনো, কী সাধারণভাবে দেখেছি তাঁকে। আমাদের কাজ চলছিল, স্যার লিস্ট করে দিচ্ছিলেন। তারপর একদিন তাঁর অসুস্থতার খবর পেলাম। জানতে পারলাম অনির্দিষ্টকালের জন্য লাইব্রেরি বন্ধ থাকবে। তারপর অপেক্ষা করতে করতে একসময় সময় ফুরালো। টেমার লেনের ওই বাড়িতে কী ধনসম্পদ রয়েছে আমরা জানি।
সন্দীপ দত্ত
অত পত্রিকা; উই, আরশোলায় তার কত নষ্ট করেছে সেই খবরও জানি। আর জানি স্যারের পরিশ্রম। কত যত্নে সব আগলিয়ে রেখেছিলেন আমাদের জন্য। আমার মতো অকিঞ্চিৎকরকেও ভালোবেসেছিলেন অনায়াসে। কাজকে ভালোবেসে নিজের কর্তব্য করে গেছেন এই মানুষটি। সন্দীপ দত্ত, আপনি কখনো আমার কাছে সন্দীপদা নন, আপনি স্যার, আমার একজন মাস্টারমশাই।