ভাণ পত্রিকা
তেতাল্লিশতম সংখ্যা || তেত্রিশতম ই-সংস্করণ || ডিসেম্বর ২০২৩
সম্পাদক :
সম্পাদনা সহযোগী :
প্রচ্ছদ :
নক্সা পরিকল্পক :
অন্যান্য কাজে :
ভাণ-এর পক্ষে:
পার্থ হালদার
কর্তৃক
৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬
( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )
৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) bhaan.kolkata@gmail.com ( ই – মেল )
Reg. No : S/2L/28241
সম্পাদকের কথা
।। সম্পাদকের কথা।।
।।ডিসেম্বর ২০২৩।।
সস্তা এবং (অ)স্বস্তি
বস্তা বস্তা সস্তা ব্যাপার-স্যাপার এখন বঙ্গ-সংস্কৃতির অঙ্গ। সস্তার আসুরিক উদযাপন থেকে স্বস্তি পাবার কোনো আশু সম্ভাবনাও নেই। ভেবে দেখলে জিনিস-পত্র কেনাকাটার সময় ‘সস্তা’ শব্দটিকে কাছের মনে হয় বটে, তবু সস্তা জিনিসের টেকসই নিয়ে আমাদের মনের আশঙ্কা চিরকালের। নানা স্টাইল দিয়েও সস্তার মালের ধরা পড়বার সম্ভাবনা চোদ্দ আনা। মানুষ যাতে সস্তা না হয়ে ওঠে, তার সমাজনীতি রাজনীতি ধর্মনীতি বিজ্ঞান থেকে বিনোদন – কিছুই যাতে কিছুতেই স্থূল এবং চটুল না হয়ে ওঠে, তাই নিয়ে আমাদের একটা ভাবনা স্কুলবেলা থেকে গড়ে উঠেছিল। যা সস্তায় মেলে , সে লাভের সুখ ছেড়ে, নিজের মূল্য না কমিয়ে, মান-সম্মান জমিয়ে, স্বস্তি খুঁজেছি এতকাল । যারা নিজেদের সস্তা করেছেন, তাদের দিকে করুনা ছুঁড়েছি। দুঃস্বপ্নে ভাবিনি, সস্তা কেন নই, তাই নিয়ে বন্ধু স্বজন শুভানুধ্যায়ীদের কটূক্তি শুনতে হবে কখনো। সস্তা না হওয়া যে যুগোপযোগী হবে না, উল্টে মর্যাদাবান মানুষ কে অহংকারী বলে দাগানো হবে- এমন দামি চিন্তাটাকে এতদিন সস্তা করে ভেবেছি হয়ত!!
সত্য উচ্চারণের ভয় আমাদের চিরন্তন।কানা ঘুষো যদিও তাকে প্রকাশ করি, তবু সত্যর অনুপ্রকাশ্যে আনতে পারি না। ক্ষমতার কাছে আমাদের ব্যক্তিগত সত্য ম্রিয়মান ও নিষ্প্রভ।সত্য যে সাধনার ফল, যোগ্যতায় অর্জিত – একথা জেনে , নিজের কাছে হেরে, পরাজয়ের গ্লানি মেখে অনেক সময় কাটিয়েছি আমরা। কিন্তু কখনও সত্য কে সস্তা করে , সস্তাকেই সত্য ভেবে আরাম খুঁজতে বসিনি। উদোর পিন্ডি ভুদোর ঘাড়ে চাপাইনি। ইদানিং এসবের বহুল প্রয়োগ দেখে কথাগুলো উঠে আসতে চাইছে।
সত্যের সঙ্গে সম্পূর্ণতার যোগ স্পষ্ট। খণ্ড সত্যে তাঁকে ( অর্থাৎ সত্য) যে মেলে না উপনিষদ থেকে রবীন্দ্রনাথ তার সাক্ষী হবেন। আমাদের খণ্ড সত্যের আবছা দৃষ্টির বিরামহীন নাচানাচি থেকেই সম্ভবত এই জোড়াতাপ্পি মারা সস্তার জন্ম ।
সস্তার কথাটি মোটেও সস্তা কারণে তৈরি হচ্ছে না। চারপাশের সস্তা জিনিসের অত্যুসাহে সস্তাতর হতে দেখে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সস্তার দূষণ সর্বগ্রাসী। একবার নিজেকে ভুলিয়ে সস্তা পাড়ায় নিয়ে যেতে পারলেই কেল্লাফতে। ইদানিং তো সস্তা পাড়াটাই ভদ্র পাড়াগুলো কে দখল করে নিচ্ছে। যুদ্ধ জয়ের জয়জয়াকারে সস্তা রঙ, সস্তা মদ, স্থূল মস্তির হুল্লোড় চলছে। ভদ্রতাকে সে পরাস্ত করছে না শুধু , উপহাস করছে। ধ্যান ও একাগ্রতা কে সে ঠাট্টা করছে। একটু বড় করে দেশ কাল কে দেখতে চাইলে সে বলছে সময় নেই। মদ মাংস বিরিয়ানি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে যে! বাইক চালিয়ে সুখ তুলতে যাওয়ার সময় বয়ে যাচ্ছে। কথা যদি উপরিস্তর ভেদ করে ক্রমশ ভেতরে ঢোকে, সস্তার দল উসখুস ক’রে ঠিক একটা গোল বাধায়। ঠিক যখন একটা সুর বেজে ওঠে সস্তার দল ডিকচাক ডিকচাক চালিয়ে দেয়। যদি কেউ যত্ন নিয়ে অনেক শ্রমে মেধায় একটা ছবি বানায় সস্তার দল সে ছবিকে দেখাতে দেয় না। সস্তারা সস্তাপ্রশাসন এবং সস্তাদরের নেতাদের দিয়ে সে ভেতর-ছোয়া ছবিকে প্রেক্ষাগৃহের ধার ঘেঁষতে দেয় না। সস্তা নামের কিম্ভূত পরিচালক যে সস্তা জিভে কর্তৃপক্ষের সস্তা পা চাটে, তাকেই সস্তা মন্ত্রী আজকের সত্যজিত বানিয়ে দেন। যারা সস্তা নন, সেই সংখ্যালঘুর দল নিশ্চিত চেনন, উনি সত্যজিত নন, সস্তাজিৎ।
আমরা সস্তা নিয়ে তেমন বিচলিত নই। এ তো আজকের কথা নয়, সবকালের। সমস্যা হলো সস্তাবাদের বিস্তার, সস্তামির অহংকার আর সস্তা
সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির জন্য। দশের মাথা মঞ্চ দাপিয়ে সস্তামোর আঁচে ঘি ঢেলে চলেছেন- আমি সব জানি, আটগন্ডা ভাষা জানি, গান জানি,নেত্ত জানি, ছবি সহ সবই জানি। ভুল কে ঠিক দেখাতে জানি। ঠিক কে চেপে দিতে জানি। চুরির দায়ে জেল যাওয়া মন্ত্রীর হাত নাড়া দেখলে ভাববেন ছুটি কাটাতে সুইজারল্যান্ড যাচ্ছেন। বাচ্চাদের দুপুরের খাবার চোরের হাবভাব এতটাই বিপ্লবী সুলভ দেখলে তাজ্জব বনে যেতে হয়। তাবৎ সরকারি দুর্নীতির নেতা অমাত্য মোসাহেবদের জেলগমনের হাবভাব প্রফুল্ল চাকী অথবা কানাইলাল দত্তের মতো!!— এই যে একটা চৌর্য ক্রিয়া থেকে অপমান শ্লাঘা অথবা লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার রস বেরতো এতকাল —- এখন বদলে হুঙ্কার বেরুচ্ছে, বেরুচ্ছে বিপ্লবীয়ানা, হিরোইজম। এ তো আর ব্যক্তি দুর্নীতিবাজ নেতার মধ্যে থাকছে না শুধু , তাকে যারা স্বার্থের জন্য,দলের জন্য, টালিগঞ্জে ছবি বানানোর জন্য, ওমুক ঢপের কমিটির প্রধান হয়ে থাকার জন্য, নোলার জন্য, পিতৃদত্ত জিহ্বার খোরাকের জন্য – সমর্থন করছেন,- তারাও অবিলম্বে সস্তা বনে যাচ্ছেন। ফলে সস্তার এক সাম্রাজ্য গড়ে উঠছে।
মানীর মান নাই। জ্ঞানীর মান নাই। সতের জয়গান নেই। দরদীর মূল্য নেই। উদারের সম্মান নেই। আছে ভোট জোট ঘোঁট তাবেদার উমেদার প্রবঞ্চক, ক্ষমতার নোংরা ব্যবহার, মুখে প্রেম হৃদয়ে ছুরিকা।
উপর থেকে সস্তা নামছে বলে জলের এতো তোড়। ক্ষমতা চাইছে বিদ্যালয় নয়, বিদ্যালয়ের মতো। কলেজ নয়, কলেজের মতো।হাসপাতাল নয় হাসপাতালের মতো। ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল নয় ওসবের মতো একটা কিছুএকটা চলুক। রাজনীতি নয়, রাজনীতির মতো এমন একটা কিছু চলুক যাতে ভদ্রলোকের অস্বস্তি হবে। নোংরা ভাষা নোংরা ব্যবহার কে এমন করে প্রতিষ্ঠা করো যাতে মন্দ জনের চিরস্থায়ী হয় রাষ্ট্র পরিচালনায়। জনগণের সম্মতি নিয়ে জনগণের ভালো নয় ভালোর মতো দেখতে খারাপ একটা তন্ত্র চলুক। সবকিছু কে সস্তা করে দাও । সবাই পাশ, সবাই কবি, সবাই রত্ন, সবাই ফেমাস !! কোনও প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে সস্তা অযোগ্য লোকটি খোঁজো , তার লেজ টা কে লুকিয়ে মাথা বানাও। এই হচ্ছে সস্তা নীতির মস্ত কথা।
ক্ষমতা, প্রযুক্তি, রাষ্ট্র নীতি ও নির্দেশ সহযোগে জীবন- অভ্যাসের গভীরে জনতা কে সস্তা করে তুলতে পারলে, দু একটা দাভালকার দের গুলি করে পুঁতে দেওয়া কোনো গভীর কথা নয়। সভ্যতার এই সস্তা উল্লাস ক্রমশ বাড়বে বলেই মনখারাপ। পোড়া দেশের এই দুঃসময়ের সস্তার অস্বস্তি এড়িয়ে কীভাবে ভালোর জন্য একটা গভীর এবং সত্য আকাঙ্ক্ষা কে লালন করা যায় , কত মানুষের মধ্যে তাকে বিস্তার দেওয়া যায়- এটাই সময়ের দায়! সময় মানে এই সময়ে বেঁচে থাকা আমাদের।
যাপিত নাট্য ' এর ষষ্টদশ কিস্তি লিখলেন - কুন্তল মুখোপাধ্যায়
কুন্তল মুখোপাধ্যায়
‘আশ্রম’ ওয়েব সিরিজের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করলেন - বৃতা মৈত্র
বদনামী আশ্রমে আরও উগ্র নিরালা বাবা
নয়া সিজনেও পর্দা কাঁপাবেন ববি দেওল
বাবা অন্তর্যামী হ্যায়, ও আপকে মন কী বাতে জানতে হ্যায়–এই হলো ‘এক বদনাম আশ্রম‘-এর নতুন ট্যাগলাইন। সিজনে ৪-এর নয়া চমক ! পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানাই সিজন ৩ থেকেই নিরালা বাবার ‘আশ্রম’-এর নতুন নামকরণ ‘এক বদনাম আশ্রম‘। তথ্যসূত্র বলছে, স্বঘোষিত ধর্মগুরু নিরালা বাবার আশ্রমের কুকর্মকাণ্ডের সিজন ৪ আমরা দেখতে পাবো আগামী ২৯শে ডিসেম্বর থেকে। বলিউডের অফবিট পরিচালক প্রকাশ ঝা পরিচালিত প্রথম ওয়েব সিরিজ ‘আশ্রম’ শুরু হয় ২০২০-র আগস্টে এম এক্স প্লেয়ারে। নির্মাতা হিসেবে প্রকাশ যথেষ্ট সমাজমনস্ক আর অনেকটাই প্রতিষ্ঠান বিরোধী। আর কে না জানে, ইদানীং এ দেশে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ফলে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক কর্তা ব্যক্তিরাই যে চটেন, তা নয়, তাদের পিছনে দাঁড়ানো অবোধ জনতার একাংশও বেজায় নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করে।
২০২০-তেই স্ট্রিমিং শুরু হয় ‘আশ্রম চ্যাপ্টার টু : দ্য ডার্ক সাইড’ অর্থাৎ সিরিজের দ্বিতীয় সিজন। শুরুর আগে প্রকাশিত হয় ট্রেলার, সেখানে বাবা নিরালার কান্ডকারখানা আর একটু প্রকটিত হওয়ার ইঙ্গিত ছিল। আর সেটা দেখেই ক্ষেপে ওঠে বজরং দল। হিন্দুত্ববাদকে অপমান করছে এই সিরিজ, সেই অভিযোগে প্রকাশকে নানাভাবে আক্রমণ করে হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী দলটি। তাতে অবশ্য দমেননি প্রকাশ। তার প্রমাণ, গত বছরই এসে গিয়েছে ‘আশ্রম’ চ্যাপ্টার ৩। আগামী ডিসেম্বরে আসছে সিজন ৪, সে খবর তো শুরুতেই বলেছি।
ধর্মের নামে এক ভয়ঙ্কর অপরাধচক্র এ দেশে বরাবরই রমরম করে চলে। ‘আশ্রম’ তাই নিছক এক পলিটিকাল ক্রাইম থ্রিলার সিরিজ নয়। একে নির্দ্বিধায় সমাজের জ্বলন্ত চিত্র বলা যায়। ভন্ড বাবাদের মানুষ ঠকানোর কাহিনি বহুবার সংবাদ মাধ্যমে উঠে এসেছে। মানুষকে কিছু পাইয়ে দেওয়ার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি জনিত আর্থিক কেলেঙ্কারি থেকে খুন, নারীঘটিত নোংরামি–কিছুই বাকি রাখে না এরা। ‘আশ্রম’ সিরিজের বাবা নিরালাও (ওরফে মন্টি সিং) এমনই এক ব্যাক্তি। সব দিক থেকে পিছিয়ে থাকা মানুষের অন্ধ বিশ্বাসকে হাতিয়ার করেই যাবতীয় অনাচার চালিয়ে যাচ্ছে সে।
আদতে এই ‘বাবা’ সেজে বসা গুরুদের আমরা সকলেই চিনি। এ এক দুরন্ত ব্যবসা। এই ব্যবসায় কোনও লগ্নি নেই, ক্ষতিরও সম্ভাবনা নেই। আছে শুধু লাভ। টার্গেট শুধুই সেইসব অসহায় সাধারণ মানুষ নয়, যারা সমাজের যাবতীয় প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। আমরা দেখি, তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত, শিক্ষিত মানুষজনও বাবাদের খপ্পরে পড়ে। বাস্তবে যেমন হয়, এখানেও বাবা নিরালা়র পাশে রয়েছে অসাধু রাজনৈতিক নেতা হুকুম সিং এবং সুন্দরলাল। ভোটব্যাঙ্কের জন্য এরা বাবার ছত্রছায়ায় থাকার চেষ্টা করে। ‘আশ্রম’-কে ঘিরে কিছু সৎ মানুষের দেখাও পাবেন দর্শক, যারা এই কুচক্র ভেঙে দিতে বধ্যপরিকর।
বাবা নিরালার ভূমিকায় বিরাট চমক দিয়েছিলেন প্রকাশ, অভিনেতা ববি দেওলকে নির্বাচিত করে। বলিউডের একদা এই স্টার একসময় প্রচুর মশালা ছবিতে কাজ করে যে স্টারডম অর্জন করেন, সেই আবরণ হেলায় খুলে ফেলে আজ তিনি এক শক্তিশালী অভিনেতার তকমায়। নিঃসন্দেহে নিজের এক অনন্য উত্তরণ ঘটিয়েছেন ববি। বাবা নিরালার চরিত্রে তাঁর রিয়ালিস্টিক ও দাপুটে অভিনয় এই সিরিজের অন্যতম সেরা আকর্ষণ। বিভিন্ন সিজনের অভিনয়ে এ ছাড়াও আছেন চন্দন রায় সান্যাল, অদিতি পোহানকর, তুষার পান্ডে, দর্শন কুমার, অনুপ্রিয়া গোয়েঙ্কা, ত্রিধা চৌধুরী, অনুরিতা ঝা, পরিণীতা শেঠ, বিক্রম কোচার, অনিল রাস্তোগি, সচিন শ্রফ, রাজীব সিদ্ধার্থ, জাহাঙ্গীর খান, অধ্যয়ন সুমন, কেশব পণ্ডিত, মালা সিনহা, নবদীপ তোমর, প্রীতি সিং, অয়ন আদিত্য, এষা গুপ্তা ও হেমন্ত চৌধুরী প্রমুখ। প্রত্যেকেই স্ববৈশিষ্টে উজ্জ্বল।
‘এক বদনাম আশ্রম ৪‘-এ আরও উগ্র আর ক্ষমতার দম্ভে বলীয়ান নিরালা বাবা ! তার উদ্ধত ঘোষণা, ভগবানকে কে জেলবন্দি করবে ? বাবার সরাসরি হুঙ্কার, আইন তাকে ছুঁতেই পারবে না। প্রকাশ ঝা প্রোডাকসন্স-এর ব্যানারে প্রকাশ নিজেই প্রযোজনা করেছেন এই সিরিজ। কিছু কিছু মিডিয়ায় প্রকাশিত, কুখ্যাত গুরমিত রাম রহিম সিংয়ের আদলেই তৈরি হয়েছে নিরালা বাবার চরিত্রটি। যদিও এই বিষয়ে নির্মাতাদের পক্ষে কিছু বলা হয়নি। সিরিজের গল্প লিখেছেন হাবিব ফয়সল। চিত্রনাট্য মাধবী ভাট, অবিনাশ কুমার, সঞ্জয় মাসুম, তেজপাল সিং রাওয়াত ও কুলদীপ রুহিল। তিনটি সিজন মিলিয়ে মোট ২৮টি পর্বে ‘আশ্রম’ দেখছেন দর্শক। সিজন ৪ কত পর্বে, তা এখনও জানা যায়নি।
ধর্ম নিয়ে ব্যবসা ও অসাধুতা সামগ্রিকভাবে সমাজের পক্ষে কতটা ক্ষতিকারক আর এই ক্ষতি কতদূর সুদূরপ্রসারী, সেকথা সকলেই জানে। তা সত্ত্বেও প্রশাসনের নাকের ডগাতেই চলে এই চক্র। বিষয়টির গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা বিচারে ‘আশ্রম’ একদিকে যেমন সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। তেমনই কোথাও কোথাও যৌনদৃশ্য প্রদর্শনের বাড়াবাড়ি নিয়েও সমালোচনার ঢেউ উঠেছে। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম মানেই কোথাও একটা এই বাড়াবাড়ির অভিযোগ নতুন নয়। এখানেও বিষয়ের পথ ধরেই হয়তো দৃশ্য রচনা। তবে, এই সব মত-বিরোধ ইত্যাদির পরেও এই সিরিজের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে তর্কের অবকাশ নেই।
উপন্যাসের নাম'সংঘাত' কেননা বিষয় 'নাটক' - খুঁজে পেলেন মৌলিকা সাজোয়াল
মৌলিকা সাজোয়াল
শিল্প-শ্রমিকের ‘সংঘাত’
An artist never works under ideal conditions. If they existed, his work wouldn’t exist, for the artist doesn’t live in a vacuum. Some sort of pressure must exist: the artist exists because the world is not perfect. Art would be useless if the world were perfect, as man wouldn’t look for harmony but would simply live in it. Art is born out of an ill-designed world
আন্দ্রে তারকভস্কির এই বিশ্বাসকে অস্বীকার করবার চেষ্টা করেছি বহুবার। আনন্দস্রোতে গা ভাসালে, তৃপ্তির আমেজে মজে থাকলে কেন কেউ শিল্প নির্মাণ করতে পারবে না? —এই প্রশ্ন ঘুরে-ফিরে মাথায় এসেছে। কিন্তু শিল্পীর সাধের শিল্পকে খানিক দূরে সরিয়ে যদি শিল্পীর দিকে মনোনিবেশ করা যায়, তখন সততই চোখে পড়ে একজন শিল্পীও আর পাঁচটা মানুষের মতো সুখে শিহরিত হয়, দুঃখে দগ্ধ হয় কিন্তু মর্মস্থলের গভীরে লুকোনো রাশি রাশি বিষণ্ণতাকে কখনোই নিজের সত্তা থেকে পৃথক করতে পারে না। আমাদের অন্তর্নিহিত একাকিত্বের বোধ, গভীর বিষণ্ণতার চিরস্থায়িত্ব বাহ্যিক সুখের জোয়ারে কিংবা দুঃখের আকস্মিকতায় হারিয়ে যেতে পারে, কিন্তু শিল্পীর ক্ষেত্রে তা হয় না। অন্তরের নিগূঢ়তম প্রদেশের বেদনার চোরাস্রোতটুকু যিনি বহু যত্নে আত্মস্থ করতে পারেন, তিনিই হয়ে ওঠেন খাঁটি শিল্পী। সেরকমই এক শিল্পীর জীবনের গল্প দিব্যেন্দু পালিতসংঘাত(১৯৯২) উপন্যাসে তুলে ধরেছেন।
শিল্পে সংঘাতময়তা নতুন কথা নয়। এক্ষেত্রে লেখক বেছে নিয়েছেন একজন নাট্যশিল্পীর নাটকীয় জীবন কাহিনিকে।সংঘাত উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র ঋতুপর্ণা চৌধুরী নব্বইয়ের দশকের মেয়ে কিন্তু আজকালকার নাট্যকর্মীরা তার গল্পকে ‘ওসব আগেকার দিনে হত’ বলে উড়িয়ে দিতে পারবেন না। মাঝে তিন দশক কেটে গেছে কিন্তু বেশি কিছু বদল ঘটেনি। সিনেমার গ্ল্যামার গায়ে মাখার আগে হালকা মেক আপের টাচ বোলানোর মতো নাটকে দুদিন তালিম নিতে আসা অভিনেতাদের কথা অবশ্য এখানে হচ্ছে না, বা চলতি রাজনীতির রঙে সময়-সুযোগ মতো নিজেকে যারা সাজিয়ে নিতে পারেন, সেইসব নাট্যকর্মীরাও ঋতুপর্ণা চৌধুরীর সঙ্গে একাত্মবোধ করবেন না। তবে সাধারণ সংগ্রামী নাট্যকর্মীরা হয়তো ঋতুপর্ণাতে ডুব দিলে এগিয়ে চলার ভরসা পেতে পারেন। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির সুশ্রী, সুঠাম, শালীন এই মেয়েটি একটি স্কুলের পার্টটাইম শিক্ষিকা এবং নাট্যাভিনেত্রী। শিক্ষিকার জীবন তাকে বাধ্যত বহন করতে হয় কারণ, আমরা সবাই জানি কেবলমাত্র নাটক করে জীবন নির্বাহ করা মুশকিল। একুশ বছর বয়সে অকাল বৈধব্য তাকে যতটা কঠিন করে তোলে, তার চেয়ে আরও অনেক বেশি কাঠিন্য প্রদান করে তার পরবর্তী সংঘাতপ্রবণ জীবন। ত্রিশ বছর বয়সে প্রিয়তম মানুষ বাবা বাসুদেব চৌধুরীকে হারিয়ে সহায়সম্বলহীন মা ভারতী এবং সদ্য যৌবনে পা রাখা বোন সুপর্ণার ভার কাঁধে নিয়ে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের এই মেয়েটি হয়ে ওঠে আরও বেশি স্থির, গভীর, চিন্তা-চেতনায় সমৃদ্ধ, উদ্দেশ্যে অটল। তার স্থির স্বপ্ন সে নাটকের অভিনেত্রী হবে। বেঁচে থেকে লড়াই করবে, অভিনয়ের মুন্সীয়ানা দিয়ে নিজে তৃপ্ত হবে এবং দর্শকদের তৃপ্ত করবে। জীবনের প্রবলতম আঘাত, মা-বোনের অসহযোগিতা, অপমান, বীরকেষ্ট দাঁর মতো কিছু শিল্প ব্যবসায়ীর অযৌক্তিক দাবিদাওয়া তাকে বারবার ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে, কিন্তু ঋতুপর্ণা সেই টুকরোগুলোকে জড়ো করে আবার নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে তার স্থির স্বপ্নের দিকে চেয়ে। শান্ত চোখে একজন যথার্থ শিল্পীর মতো লক্ষ করেছে জীবনের প্রতিটি রূপের বদল, পাওয়া এবং হারানোর মধ্যেকার শূন্যতার স্পন্দন। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে আত্মস্থ করে ঢেলে দিয়েছে তার শিল্পসত্তার মধ্যে। জীবন-মৃত্যুর সুনিপুণ শিল্প তার চেতনায় বিকীর্ণ হয়েছে।
ঋতুপর্ণার মা ভারতী পুরোনো দিনের মানুষ। তিনি বিশ্বাস করেন, পুরুষবিহীন সংসার মানে অভিভাবকহীন সংসার। পুরোনো কিছু বিকৃত ধ্যান-ধারণার যাঁতাকলে পড়ে তিনি নিজে ভালো থাকেননি, ঋতুপর্ণাকেও থাকতে দেননি। মা হিসেবে তার পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে যখন-তখন তার ওপর অহেতুক আঘাত হেনেছেন। তাঁর মানসিক সংকীর্ণতা প্রসূত ধারণা ঋতুপর্ণা বাহিসেবী জীবন যাপন করে কারণ, সে বিধবা হয়ে রাত করে বাড়ি ফেরে, মুখে রঙ মেখে ছেলেদের সঙ্গে অভিনয় করে, প্রকাশ্যে ছেলেদের সঙ্গে বাক্যালাপও করে। এতদসত্ত্বেও ঋতুপর্ণাকে সরাসরি আক্রমণ করার সাহস ভারতীর নেই কারণ, পেট প্রতিপালনের জন্য ঋতুপর্ণার অর্জিত অর্থটুকু তার প্রয়োজন। তাই তিনি চান, লোকজনকে ধরে কয়ে হলেও ঋতুপর্ণা যেন তার পার্টটাইম স্কুলের চাকরিটা ফুলটাইম করে নেওয়ার ব্যবস্থা করে। তাতে নাটক-অভিনয় ইত্যাদির ভূতও মেয়ের ঘাড় থেকে নামে, তাছাড়া রাত করে বাড়ি ফেরা, পরপুরুষের সঙ্গে মেলামেশা, সর্বোপরি লোকনিন্দার ফাঁড়াটুকু কেটে যায়। আশচর্যের বিষয়, ঋতুপর্ণার লড়াই, তার স্বপ্ন, অল্প বয়সে বৈধব্য লাভের তীব্র যন্ত্রণাটা তার চোখে পড়ল না, নিজে বৈধব্য লাভের পরেও নয়। বরঞ্চ তারপরে স্বার্থপরতা আরো ঘনীভূত হয়ে বড়ো করে তুলল লোকনিন্দা আর সমাজ সংস্কারকে। বাসুদেব মারা যাওয়ার সময় বিষাদমগ্ন ঋতুপর্ণা যখন জ্যেষ্ঠ কন্যা হিসেবে বাবার মুখাগ্নি করার দায় গ্রহণ করতে গিয়েছিল, ভারতী তখনও ঋতুপর্ণার অবস্থান, তার বৈধব্যকে স্মরণ করাতে ভোলেননি,
তখন, অতো শোকের মধ্যেও আশেপাশের সকলকে স্তম্ভিত করে বলে উঠল ভারতী, ‘না, না। ও নয়, ওর গোত্র আলাদা—। যা করার সুপুই করবে।’
মাতৃত্বের তথাকথিত কোমল ছবিকে লেখক বারবার ব্যঙ্গ করেছেন এই উপন্যাসে। ভারতীর ছোট সন্তান সুপর্ণার প্রতি অদ্ভুত একচোখামি, ঋতুপর্ণার প্রতি অনর্থক নিষ্ঠুরতা স্তব্ধ করে দেয় পাঠককে। দিদি হিসেবে সুপর্ণার লাগামছাড়া হাবভাব, প্রসাধনের উগ্রতা নিয়ে বকাঝকা করতে গিয়ে সুপর্ণার থেকেও কম ঘা খায়নি ঋতুপর্ণা। এ বিষয়ে সুপর্ণার সটান জবাব ছিল,
‘বিধবা হয়েও তুমি সাজতে পারো, আমি পারি না কেন!’
ভারতী উপরে উপরে সুপর্ণাকে শাসন করলেও ঋতুপর্ণাকে জনান্তিকে জানিয়ে রাখেন, দোষ তার ছোট মেয়ের নয়, সে যা দেখছে, তা-ই শিখছে। আজন্মলালিত সংস্কারের বশে ঋতুপর্ণার শিল্পীসত্তার থেকে ভারতী কাছে বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছে তার অকপট স্বাবলম্বী জীবনযাত্রা। ঋতুপর্ণার যে অভিনয় সকলকে বিমুগ্ধ করে, তাবড় তাবড় গুণীজনেদের সম্মোহিত করে, সেই অভিনয় দেখে ভারতীর অভিব্যক্তি এবং মন্তব্য বিস্ময়কর,
বলতে পারল না নাটক ভালো লেগেছে না মন্দ। কী যেন ভাবছে। শুধু বলল, ‘অতো লোকের সামনে একটা পরপুরুষের বুকে ওইভাবে মাথা মুখ ঠেকালি। হ্যাঁ রে, একটুও লজ্জা করল না তোর!’
ভারতীর কথা শুনেথালায় হাত থেমে গেল ঋতুর।
হাসিতে কুটিকুটি হয়ে সুপর্ণা বলল, ‘ওটা তো নাটক, মা! সত্যি-সত্যিই কিছু ঘটছে নাকি!’
‘আমি কি ভুল দেখলাম তবে!’
ভারতী তিরস্কার করল না। শুধু বলল, ‘রোজ যদি একই নাটক হয়, রোজই তো তাহলে শাঁখা ভাঙতে হয়, লোহা খুলতে হয় তোকে! খারাপ লাগে না!’
অপরিসীম ব্যথা সঞ্চয় করেও ঋতুপর্ণা সমস্ত সংঘাতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, স্বপ্ন দেখা থামায়নি। তার গ্লানিময় জীবনটুকু নাটকের রিহার্সাল রুমেই সপ্রতিভ মুক্তি লাভ করেছে।
ঋতুপর্ণার বাবা বাসুদেব অপরাধীর গ্লানি নিয়ে মারা যাওয়ার আগে তাকে বলেছিল,
‘তুই শুধু আমার দুর্ভাগ্যটাই পেয়েছিস মা। আর কিছু পাসনি।’
সেই দুর্ভাগ্যের দান মাথায় করেই সে রোজগার করেছে রক্ত জল করা শ্রম দিয়ে। সুশ্রী চেহারার চটক দেখিয়ে সহজ উপার্জনের সুযোগ পেয়েছে কিন্তু লড়াইয়ের পথটাই সে বেছে নিয়েছে। বাবার মৃত্যুর পর সে তার অল্প-বিস্তর রোজগার দিয়ে স্বার্থপরের মতো কলকাতায় থাকার ব্যবস্থা করে নিতে পারত। তাতে অন্তত মধ্যমগ্রাম থেকে লোকাল ট্রেনে ঝুলে রোজ রোজ যাতায়াত করার ঝক্কি থাকত না। সেক্ষেত্রে অভিনেত্রীসুলভ স্বাচ্ছন্দ্য, আয়াশটুকুও সে পেত, স্কুলের চাকরির বাড়তি শ্রমটা এড়িয়ে নিজের স্বপ্ন এবং প্যাশন নিয়ে আরো দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে পারত কিন্তু দায়িত্ববোধ থেকে সে একচুলও নড়েনি। শিল্পীরা অনেক সময়ই শিল্পের দোহাই দিয়ে পারিবারিক দায়দায়িত্ব সম্বন্ধে ঔদাসীন্য দেখান কিন্তু ঋতুপর্ণা এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ভারতী ঋতুপর্ণার অভিনেত্রী জীবনকে খাটো চোখে দেখলেও অভিনয় করা উপার্জনের খবর নিতে ভোলেননি। ভারতীর নির্লজ্জ বস্তুবাদী আচরণ দেখে সে নিজেকে আরও সঙ্কুচিত, আরও গভীর করে তুলেছে, জীবনের প্রতি তার অমোঘ প্রশ্ন উঠে এসেছে,
সংস্কার যাকে দূরে সরিয়ে দেয়, দায়িত্ব নেবার জন্যে তাকে কাছে টানা হয় কেন!
সংসার জীবন নয়, সন্তান-সন্ততি নয়, শুধু নিজের শিল্পসত্তাকে প্যাশন মেনে নব্বইয়ের দশকের একটি একাকী মেয়ে হাজারটা বাধা-বিপত্তি এড়িয়ে নিজের মেরুদণ্ড দৃঢ় রেখে নিজের তথাকথিত অর্থহীন জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তুলেছে, এখানেই ঋতুপর্ণার অনন্যতা। সে শখের অভিনেত্রী নয়, অভিনয় তার মর্মস্থল থেকে ঘনীভূত হয়। অফিস, ক্লাব, থিয়েটারে বছরে এক-দুবার অভিনয় করে যে সস্তার হাততালি কুড়োনো যায়, শুধু সেটুকুই তার শিল্পসত্তাকে পুষ্ট করে না। সে চায় গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয় করতে, একজন খাঁটি অভিনেত্রীর জীবন, পুরোদস্তুর শিল্পীর জীবন। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেই তো সবসময় উপায় থাকে না। গ্রুপ থিয়েটারে টাকার বিষয়টি যে অনিশ্চিত। অফিস-ক্লাবের বাৎসরিক অনুষ্ঠানের জন্য দৈনন্দিন রিহার্সালের চল্লিশ টাকা, যাতায়াতের দশটাকাটা হেলায় হারিয়ে গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয় করার স্বপ্ন পূরণটুকু হয়তো হবে কিন্তু ঋতুপর্ণার রোজগারের মুখাপেক্ষী পরিবারটি যে নস্যাৎ হয়ে যাবে। গ্রুপ থিয়েটারের সমষ্টিগত প্রয়াসের প্রতি যার এতো ভালোবাসা সেই ঋতুপর্ণার পক্ষে কেবল নিজের স্বার্থের কথা ভেবে পরিবারকে ঝেড়ে ফেলা সম্ভব ছিল না। তাই চাইলেই সে লোকাল ট্রেনের প্যাচপ্যাচে গুমোট আবহাওয়াকে অস্বীকার করে গঙ্গার ঘাটে বা ময়দানের উদাত্ততায় নিজের প্রাণকে মেলে ধরতে পারত না। কিন্তু জীবন যাকে স্বপ্ন দেখায়, সে স্বপ্ন পূরণের আকস্মিক সুযোগ পেলে জীবনের সেই দানকে অস্বীকার করতে পারে না। ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হলে ঋতুপর্ণার নূরজাহান চরিত্রে অভিনয় দেখে মুগ্ধ হন ‘রঙ্গনামা’ গ্রুপের পরিচালক অরিজিৎ মিত্র, ঋতুপর্ণার ছ-বছরের সাধনার পালে বাতাস লাগে। অফিস, ক্লাবের বৈচিত্র্যহীন ক্লান্তিকর অভিনয়ের একঘেয়েমি থেকে বেরিয়ে ‘রঙ্গনামা’য়সংঘাত নাটকের মুখ্য চরিত্র সীতার ভূমিকায় অভিনয় করে সে রাতারাতি নাম করে ফেলে। তিন স্তরে তিন অঙ্কে বিন্যস্তসংঘাত নাটক ১৯৪৭ সালের প্রেক্ষাপটে নিম্ন-মধ্যবিত্ত যুবতী সীতার পঞ্চাশ বছরের যে সংগ্রামকে তুলে ধরে, তাতে অভিনয় করতে করতে সীতার জীবনের প্রতিটি পট পরিবর্তনের সঙ্গে ঋতুপর্ণা মিশিয়ে দেয় তার নিজের জীবনের রঙ, রস, খুলে দেয় অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার। অভিনয় তার ধ্যান-জ্ঞান। শোক এবং শূন্যতার গভীরে বিরাজ করেও বাসুদেবের মৃত্যুর পর তার মনে প্রশ্ন জাগে,
…জীবনের এই দৃশ্যে নাটক এলে কীভাবে অভিনয় করত সে? প্রতিক্রিয়ার তিনটি আলাদা ধরনের মধ্যে কোনটিকে বেছে নিত? কিংবা, কীভাবে ফোটাতো সেই অভিজ্ঞতাকে—
ঋতুপর্ণার নাটকীয় জীবন সংগ্রাম এবং নাটকের সীতার সংগ্রামের মেলবন্ধন করে লেখক উপন্যাসের নামকরণ করেছেন ঋতুপর্ণা অভিনীত নাটকের নামে— সংঘাত। এই সংঘাতময়তা যত সহজে নাটককারের কল্পনায় নিজের প্রেক্ষিত খুঁজে পায়, সম্মোহিত দর্শকের সপ্রশংস দৃষ্টি লাভ করে, তত সহজে জীবনের প্রেক্ষিত খুঁজে পায় না। মেক আপ, সংলাপ, আচরণ, চরিত্রের উত্থান-পতন মঞ্চেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। অভিনেতার জীবনের বিচিত্র রসে টইটম্বুর হয়ে সমবেত হাততালি চেনে কিন্তু অভিনেতার কঙ্কালটুকু ভরাট করে না। তার উত্থান-পতন আমৃত্যু লেগেই থাকে, ঘটনাচক্রে ভরাট হলেও জীবন ফের থাবা বসায়, খুবলে নেয় রূপ-রস। ঋতুপর্ণা বিধবা হয়ে, প্রিয়তম মানুষ নিজের বাবাকে হারিয়ে সংসারের জোয়াল টেনে কোনোরকমে সাফল্যের মুখ দেখতে না দেখতেই তার জীবনে ঘটে যায় আরেক বিপর্যয়। ডিসেম্বরের এক রাতে অভিনয় সেরে বাড়ি ফেরার পথে ভয়ঙ্কর পথ দুর্ঘটনায় তার বাঁ পা অচল হয়ে যায়। মাত্র একুশ বছর বয়সে বৈধব্য লাভের পর ঋতুপর্ণার মানসিক প্রতিবন্ধকতাকে সামাল দিয়েছিল নাটকের প্রতি তার নিঃশর্ত ভালোবাসা। শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ঋতুপর্ণার লড়াইয়ের বিস্তার উপন্যাসে পাওয়া যায় না। শুধু এইটুকু জানা যায়, সীতার ভূমিকায় ঋতুপর্ণাকে বাদ দেওয়ার জন্য অরিজিৎ মিত্রের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা করে ‘রঙ্গনামা’ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে সংঘাত নাটকের রচয়িতা মৃণাল, ঋতুপর্ণার সুহৃদ শান্তনুসহ, দেবযানী, রফিকুল, বাপ্পাদিত্যের মতো আরো অনেকে। তারা প্রসেনিয়াম ছেড়ে স্ট্রিট থিয়েটার করবে, তারা ঋতুপর্ণার সুস্থতার জন্য অপেক্ষারত। অভিনেত্রী ঋতুপর্ণাকে একান্তই যদি ফিরে না পাওয়া যায়, তবে তারা নাট্য-পরিচালক হিসেবে ঋতুপর্ণাকে চায়। ঋতুপর্ণা আবার বেঁচে থাকার রসদ পেয়ে যায়। নাট্যপ্রেমের ঘোরে পুনরুজ্জীবিত হওয়ার আনন্দে ডুবে যায়,
শিরায় শিরায় ছটফট করছে তার উঠে দাঁড়ানোর পুরনো সঙ্কল্প। সংলাপে স্ফুরিত হতে চাইছে ঠোঁটদুটো। ‘সংঘাত’ –এর শেষ দৃশ্য। আলো এসে পড়েছে মুখে। সীতা নয়, সে—সূর্যের বাদামি আলোয় পালটে যাচ্ছে তার মুখের মানচিত্র। মঞ্চ থেকে রাস্তায় নেমে এসেছে সে। তাকে ঘিরে চেনে অচেনা অসংখ্য মানুষ। আরো অনেক মানুষ জড়ো হচ্ছে তাদের পিছনে। ভাগ্যের শাসন ভেঙে যে একবার বেরিয়ে আসতে শিখেছে, সে আবার পারবে না কেন!
গ্রুপ থিয়েটার ভেঙে যাওয়ার ইতিহাসের মাঝে বিলুপ্ত হয়ে যায় এমন অনেক ঋতুপর্ণার কথা, যাদের জীবনের একমাত্র নিয়ন্ত্রণী শক্তি নাটকের প্রতি ভালোবাসা। ভাগ্যের অসহযোগিতাকে একহাতে নিয়ে তারা বারবার হেসে-খেলে বাজি মাত করে। ভাগ্য এইসব শিল্পীদের যত দুর্বিপাকে ফেলে, এরা যেন ততই ভাগ্যের চাকায় পিষ্ট হয়ে নিজের ভেতর থেকে বের করে আনে আশ্চর্য প্রতিভাধর রসের ভাণ্ডার।
ঋতুপর্ণার বাবা-মা এবং তাদের দুই বোনের পারিবারিক চতুষ্কোণ ভেঙে যায় তার বাবা বাসুদেব মারা যাওয়ার পরই। তিন নারীর ত্রিভুজটা কোনোদিনই জুতসোইভাবে গড়ে ওঠেনি। মা-বোনের সমান্তরালে থেকেই লড়াই চালিয়ে যায় ঋতুপর্ণা। রক্তের সম্পর্ক সবসময় নির্ভরতা দেয় না। অনেক সময় কেবল কাছাকাছি বেঁধে রাখে। অদৃশ্য সেই বাঁধুনির গতানুগতিকতায় বয়ে চলে রক্তের ধারাবাহিকতা। সেই ধারাবাহিকতা সস্নেহে কাছে টেনে নেয় না, অথচ চাপিয়ে দেয় দায়দায়িত্বের দুর্বিষহ ভার। ঋতুপর্ণার ক্ষেত্রে তাই হয়েছে, তবে শুভাকাঙ্ক্ষীর অভাব তার কখনই ঘটেনি। নাট্যজগৎ তাকে স্বপ্ন পূরণ করবার সুযোগ যেমন দিয়েছে, পাশাপাশি দিয়েছে বঙ্গবাসী কলেজের বাংলার অধ্যাপকপ্রবীর ঘোষ, তরুণ অভিনেতা শান্তনু, সংঘাত নাটকের লেখক মৃণালের মতো সুহৃদদের।
শান্তনুর ঋতুপর্ণার প্রতি প্রেম নাকি আনুগত্য রয়েছে, তা নিশ্চিত করে বোঝা যায় না। তবে ঋতুপর্ণার শিল্পসত্তার প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা এবং আস্থার কারণে সে সময়ে-অসময়ে তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ‘রঙ্গনামা’য় নতুন অভিনেত্রীর খোঁজ চলছে— সে খবরও প্রথম সে-ই দেয়।
প্রবীর ঘোষ ঋতুপর্ণার প্রতিবেশী। তার বিয়ে হওয়ার কয়েক মাস পরেই প্রবীরের বিয়ে হয়। নাটক পাগল এই লোকটি ঋতুপর্ণাকে সবিশেষ স্নেহ করে, তার সমস্ত খবরাখবর রাখে, আপদে-বিপদে পাশে দাঁড়ায়, ঋতুপর্ণা না ডাকলেও চুপিসারে সস্ত্রীক তার নাটক দেখে আসে। শিল্পী ঋতুপর্ণার উৎকর্ষতায় আপ্লুত এই মানুষটির প্রতি ঋতুপর্ণারও বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। দীর্ঘ বৈধব্য যাপনের পর কখনও অসতর্ক মুহূর্তে মনে মনে সে প্রবীরকে শারীরিকভাবে কামনা করে বসেছে কিন্তু বিনম্র শ্রদ্ধাবোধ থেকে সস্নেহ দূরত্ব বজায় রেখেছে। তার মতো বিধবা যুবতীর প্রবীর ঘোষের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকার, আলাপচারিতা নিয়ে পাড়াপড়শি, ঋতুপর্ণার মা অসন্তোষ দেখিয়েছে কিন্তু সেসব কুৎসিত আঘাত, লোকনিন্দার ভয়ে প্রবীরের সঙ্গে আত্মীয়তায় ছেদ টানেনি সে।
নাটকে অভিনয় করতে গিয়ে ঋতুপর্ণা সন্তোষ তরফদারের মতো অপটু নির্দেশক এবং অরিজিৎ মিত্রের মতো তুখোড় পরিচালকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। সন্তোষ তরফদার অপটু হলেও সুযোগ পেলেই তাকে নানাভাবে সাহায্য করেছে, কাজের বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। অরিজিৎ মিত্র ঋতুপর্ণার প্রতিভার স্ফুরণে সহায়তা করেছে কিন্তু তাকে শারীরিকভাবে ব্যবহার করতে কসুর করেনি। দীর্ঘকালীন অবসাদের অবসর যাপনের পর অথবা কৃতজ্ঞতাবশত ঋতুপর্ণাও তাকে বাধা দেয়নি। তবে তার পায়ের অ্যাকসিডেন্টের পর তাকে প্রাথমিকভাবে আশ্বাস দিলেও অরিজিৎ মিত্র শেষবধি তার পাশে থাকেনি। নতুন অভিনেত্রী নিয়ে নতুন করে নাটক সাজানোর পরিকল্পনা করেছে। আসলে অরিজিৎ মিত্র সীতারূপী ঋতুপর্ণায় মুগ্ধ হয়েছিল, নিম্ন-মধ্যবিত্ত বিধবা ঋতুপর্ণায় নয়। সে ঋতুপর্ণায় প্রতিভা চিনেছে এবং তাকে কাজে লাগিয়েছে। তাছাড়া ঠুনকো লাস্যময়তার প্রতি আগ্রহ কাটিয়ে পেশাদারিত্বে ফিরে আসতে অরিজিৎ মিত্রের সময় লাগেনি। তাই সে তার ধর্মমতে শিল্পীকে ফেলে শিল্প নিয়ে এগিয়ে যেতে চেয়েছে। কিন্তুসংঘাত নাটকের রচয়িতা মৃণাল অরিজিতের মতো বস্তুবাদী হয়ে উঠতে পারেনি। সে বিশ্বাস করেসংঘাত যেমন তার নাটক, তেমনি সীতা ঋতুপর্ণার চরিত্র। রক্তের দাবিতে নিঃসম্পর্কিত এই মানুষগুলোর ভালোবাসা, সাহচর্য, আত্মীয়তা ছাড়া ঋতুপর্ণার একার লড়াই ধোপে টিকত না।
২০২৩ সালে দাঁড়িয়ে আমরা অহরহ শুনি, গ্রুপ থিয়েটারের বিলুপ্তি আসন্ন। কোনোক্রমে ভাড়া করা সৈন্য জোগাড় করে দলগুলি টিকিয়ে রাখা হচ্ছে। তার মাঝে ঋতুপর্ণার মতো একটি মেয়ের গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয় করার জন্য এই অনমনীয় লড়াইয়ের গল্প বিস্মিত করে। চারপাশে বৃত্তায়িত জলরেখার ভেতর অসহায় পিঁপড়ের মতো এইটুকু জীবনে, যে জীবন অপমানে, অসহায়তায়, নিঃসঙ্গতায় নিরন্তর ক্ষয়ে যাচ্ছে, তাতে অভিনয়ের সার্থকতা কতোটুকু? তাও আবার প্রায় বিনা পয়সায় শিল্প-সাধনায়? সে প্রশ্নের জবাব হয়তো পাওয়া যেতে পারেসংঘাতউপন্যাসে।
কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর গল্পকথা -- কলমে নীলাঞ্জনা ব্যানার্জ্জী
নীলাঞ্জনা ব্যানার্জ্জী
কলকাতার দুর্গাপুজো কালিপুজোর ধুম কাটলে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে কৃষ্ণনগর । জগদ্ধাত্রী পুজো এই শহরের শ্রেষ্ঠ উৎসব । এখানকার প্রতিটি বাসিন্দা অপেক্ষায় থাকে এই উৎসবের । সব থেকে ভালো জামাটা জমানো থাকে জগদ্ধাত্রী পুজোর জন্য। এই কটাদিন শুধু উড়ে বেড়ানো। কাজ,পড়াশোনার জন্য বাইরে থাকা ছেলে মেয়েরা দুর্গা পুজোয় আসতে না পারলেও এই পুজো কোন ভাবেই মিস করে না। তথ্য প্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত এমন অনেক মানুষকে ব্যাক্তিগতভাবে চিনি যারা দুর্গা পুজোতে কাজ করেন শুধুমাত্র নিজের শহরের শ্রেষ্ঠ উৎসবে মাতবেন বলে। কিন্তু জগদ্ধাত্রী পুজো মানেই সবাই ভেবে নেন চন্দননগর। আসলে এই পুজো যে কৃষ্ণনগরের প্রানের পুজো সে খবর আর কজন রাখেন। আজ আমি আপনাদের আমার ‘সব পেয়েছির দেশ’র জগদ্ধাত্রী পুজোর গল্প বলব।
যিনি জগতের জননী তিনিই জগদ্ধাত্রী । চণ্ডী তে তাঁর স্তবগাঁথা অনুসারে “ বিশ্বেশ্বরী ং জগদ্ধাত্রী ং স্থিতি সংহার কারিনীম “ । পুরানের কাহিনি অনুসারে বলা যায় , রামচন্দ্রের ক্রেতা যুগে এই পুজোর সুচনা । কালীর মতই দেবী জগদ্ধত্রী ত্রান্ত্রিক মতে পূজিতা । স্বামী জগদীশ্বরানন্দের মতে, প্রায় প্রত্যেক হিন্দু ত্রন্ত্রে এমনকি অসংখ্য বৌদ্ধ তন্ত্রেও জগদ্ধাত্রীর উলেখ আছে ।
কৃষ্ণনগরের এই পুজোর প্রচলন কিভাবে হল সেই নিয়ে আবহমানকাল ধরে যে কিংবদন্তীচলে আসছে তাকে কলমে ফুটিয়ে রুপদান করেছেন শ্রী সুধীর চক্রবর্তী । তিনি লিখেছেন ; “ একবার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তার ছেলে শিব চন্দ্র সহ মুর্শিদাবাদের নবাবের আদেশে বন্দী হন । সময়মত খাজনা না দিতে পারাই ছিল তাঁর অপরাধ । কোন নবাব ? অনেকের মতে নবাব মীরকাশিম । একটা মতে তিনি বন্দী ছিলেন মুর্শিদাবাদে । আরেক মতে মুঙ্গের দুর্গ । সময় ১৭৬৩ সাল । যখন কারাগার থেকে মুক্ত হলেন রাজা তখন আশ্বিন মাস । এখানে দুর্গাপূজা । দ্রুতগামী ছিপ নৌকায় চেপেও মহাপূজার মধ্যে পৌছাতে পারলেন না । বিজয়াদশমীর বিকালে পৌঁছালেন নদিয়ার রুকুনপুরের ঘাটে । শ্রান্ত আশাহত রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ঢলে পড়লেন ঘুমে । তারপরই সেই স্বপ্ন ।
তবে স্বপ্নের সেই দেবীমূর্তি দুর্গা নন । অথচ ত্রিনয়নী,চারহাত,রক্তাম্বর ধারিনী । শাদা নর সিংহে যোদ্ধৃ মত বসে আছেন । দুই হাতে শঙ্খ চক্র, আর দুই হাতে ধনুর্বান। স্বপ্নে দেবীর প্রত্যাদেশ হল ; সামনের শুক্লা নবমীতে একইদিনে সপ্তমী – অষ্ঠমী – নবমীপুজা করলেই দুর্গাপূজার অনুকল্প হবে। রাজা তাই করলেন। সেই থেকে কৃষ্ণনগরে চালু হল জগদ্ধত্রীর পুজা।“স্বপ্নে দেখা মায়ের রুপদান করেছিলেন শিল্পী , মা এখানে যেন অশ্বরূঢ়া যুদ্ধ রত সৈনিকের । দেবীর বাহন কেশরযুক্ত আফ্রিকার সিংহ নয়, এই সিংহ এর রুপ অনেকটা শাদা ঘোড়ার মত যা আসলে ‘নরসিংহ ‘। হিরণ্যকশিপুকে শ্রীকৃষ্ণ বধ করেছিলেন এই নর সিংহরুপে। এই শাদাঘোড়া প্রসঙ্গে পাঁচকড়ি বন্ধ্যোপাধ্যায় তার একটি লেখায় উল্লেখ করেছেন ; “ সে সিংহবাহিনীর সিংহ আর একরকমের ছিল, এখনকার African Lion – এর নকল ছিল না। সে অলৌকিক সিংহ , ঘাড় খুব লম্বা, মুখখানা কতকটা ঘোড়ার মতন, কতকটা মকরের মতন, শাদা, রোগা, টানা ও লম্বা,এক অপূর্ব জানোয়ার। “তবে এর মাধ্যমে তিনি সমাজ সংস্কারের বীজ প্রোথিত করলেন। তিনি যখন রাজবাড়িতে জগদ্ধাত্রীর পুজো করছেন,তার কিছু সময় পর মালো পাড়ার মালো সম্প্রদায়ের মানুষেরা রাজার কাছে পুজোর অনুমতি চাইছেন,তখন সেই অনুমতি রাজামশায় নিম্ন বর্গের মানুষদের দান করছেন। পুজো প্রচলনের এই মত ছাড়াও আর একটি ভিন্ন মত প্রচলিত আছে। নরেশ চন্দ্র চাকী তাঁর ‘ নদীয়া পরিচিতি ‘ গ্রন্থে লিখছেন, জগদ্ধাত্রীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন একজন পন্ডিত তান্ত্রিক।কৃষ্ণচন্দ্রের বহু আগে বাংলার অনেক মন্দিরে জগদ্ধাত্রী মূর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। যেমন, বীরভুমের হেতম পুরের শিবমন্দির, চন্ডীদাস – নানুরের শিবমন্দির, ইলামবাজারের দেউল্ মন্দিরে টেরাকোটা জগদ্ধাত্রীর মূর্তি আছে। তবে রাজার হাত ধরেইমন্দিরে বিরাজমান দেবী সাদরে অভ্যর্থিত হলেন গৃহস্থের ঘরে ঘরে, যা আজ কৃষ্ণনগর বাসীদের প্রানের শ্রেষ্ঠ পুজো।রাজবাড়ির প্রতিমাকে ভোগে মাছ দেওয়া হয়। গবেষক সুধীর চক্রবরতীর মত ছিল, মালোপাড়া , দাসপাড়া , বাগদী পাড়া, ও কাপড়ের পট্টী পুজো ছিল পুরনো । শোনা যায়, কাপড়ের পট্টীর পুজোতে নিমতলাতে থাকা বারবনিতাদের বিশেষ ভুমিকা থাকত । তারা প্রতি বছর মাকে সোনার কিছু দান করত।২০০০ সালের পর থেকে বারোয়ারির পুজোর নাম দেয়া শুরু হয় । যেমন, কাঁঠাল পোতা বারোয়ারির মা ‘ ছোট মা’ , চকের পাড়া ‘আদিমা’ , তাঁতি পাড়া ‘ বড়মা’ , চুনারি পাড়ার মা ‘ চারদিনী মা ‘ কারন একমাত্র এই পাড়াতে পুজো চারদিন ধরে হয়।
এই পুজো উদযাপন হয় একদিন। কিন্তু মানুষের ঘোরা শুরু হয়ে যায় তার দুদিন আগে থেকেই। পুজো কমিটি গুলি কদিন আগে থাকতেই সাজানোর কাজ সম্পূর্ণ করে ফেলে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুজোর উদ্বোধন হয়। জনসমাগম সামলাতে পুলিশ প্রশাসন পুজো উদ্যোক্তারা একপ্রকার
হিমশিম খেয়ে যান।
রাজবাড়িতবে এই সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছেন আমাদের চাষা পাড়া বারোয়ারির ‘ বুড়িমা ‘।এই পুজো উৎপত্তি নিয়ে সাংবাদিক গৌতম ধনী লিখেছেন; “ কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির এক বিশ্বস্ত কর্মচারী গোবিন্দ ঘোষ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলেই চাষাপাড়ার গাছের তলায় ঘট পুজো করে জগদ্ধাত্রী আরাধনা শুরু করেন। তবে কারো কারো মতে এই পুজো শুরু হয় গিরিশচন্দ্রের [ ১৮০১-১৮৪০ ] বা তার পরে কোন রাজার আমলে।“ প্রবীণদের থেকে জানা যায়, কানাই পাল এই প্রতিমা গড়তেন । প্রতিমাকে হালকা ও বড় আকৃতিতে গড়ার জন্য মোটা করে বিচুলি বাঁধতেন । প্রথমদিকে নিজের হাতে মায়ের মুখের আদল তৈরি করলেও পরের দিকে বানিয়ে নিয়েছিলেন একটি স্থায়ী ছাঁচ । এত বড় আকারের প্রতিমার আরাধনাসম্ভবত চাষা পাড়া বারোয়ারি থেকেই প্রথম শুরু হয় । তারপর থেকেই এমন ধাঁচের প্রতিমার প্রচলন শুরু হয় । কিন্তু বুড়িমাকে সম্মান জানিয়ে এখনও অন্যান্য বারোয়ারির প্রতিমার উচ্চতা সামান্য ছোট রাখা হয় । বুড়িমাকে দেখতে দূর দুরান্ত থেকে লোক আসেন। সবার বিশ্বাস বুড়িমা জাগ্রত।ভক্তরা খড়ে নদীতে স্নান করে দণ্ডী কাটতে কাটতেএসে পুজো দেন। এছাড়াও পুজোর পাচঁদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান। মা সেজে ওঠেন ডাকের সাজে । পুজোর আগের দিন বুড়িমাকে গহনা পড়ান হয়।সমস্ত গয়না ব্যাঙ্কের লকার থেকে পুলিশি পাহারায় নিয়ে আসা হয় পুজো প্রাঙ্গনে। সে এক দেখার মত অনুষ্ঠান। কর্মকর্তা যারা গয়না পড়ান তারা শুদ্ধ হয়ে শুভ্র বস্ত্রে মাকে সাজিয়ে তোলেন। বুড়িমার কপাল ভর্তি থাকে সোনার টিপে, সমস্ত গয়না যদিও মাকে পরানো হয়না। মাকে ভক্তরা যে শাড়ী দেন অধিকাংশই বেনারসীতা সিংহ এর লেজে জড়িয়ে দেয়া হয় ,শাড়ীর সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না , অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি। পুজোর দিন সানাই বাজে যেটা রেকর্ডে বাজান হয়না, চাষা পাড়ার একদম শুরুতে যে প্যান্ডেল করা হয় সেই প্যান্ডেলের ওপর একটা খোপ থাকে, যেখানে শিল্পীরা সানাই বাজান, নহবত বসে। বুড়িমার বাহন সিংহ তারও নিজস্ব গয়না আছে। বিভিন্ন পাড়ার মধ্যে পুরস্কার পাওয়ার যে প্রতিযোগিতা চলে সে সবের থেকে বুড়িমা উর্দ্ধে। বুড়িমার ভোগ রান্না দেখবার মতন। প্রচুর উনুন করা হয়, আর লাখ লাখ মাটির সরা আসে ভোগ বিতরণের জন্য। ভোগ হিসেবে দেয়া হয় পোলাও । কুপন কেটে সেই ভোগ সংগ্রহ করা হয়। সন্ধে ৬ টার পর কুপন ছাড়াই ভোগ প্রসাদ বিতরণ করা হয়। বুড়িমার কাছে অঞ্জলি দেবার জন্য তিল ধারণের জায়গা থাকে না।পুজোর দুদিন আগে থেকে বিভিন্ন মানসিক দ্রব্যাদি গ্রহন করা হয়। গতবছর এই পুজোর ২৫০ বছর পূর্তি হয়েছে। পুজোর পরের দিন বিকেলে বুড়িমার প্রধান পুরোহিত চোখের জলে ভেসে মাকে বরণ করে বিদায় জানান,এ যেন তার নিজের মেয়ের শ্বশুর বাড়ি যাত্রা । এরপর সাধারন মানুষ লাইন দিয়ে মূল নাট মন্দিরে উঠে মাকে বরণ করেন। মেয়ে, বৌ সকলে মায়ের পায়ে সিঁদুর দিয়ে মঙ্গল কামনা করেন । বুড়িমাকে নিয়ে অনেক মিথ মানুষের মুখে মুখে ফেরে। যারা মাকে কাঁধে নিয়ে বিসর্জনে যান তারা বলেন মা নাকি হঠাত ভারী হয়ে যান। আবার সাঙের বাঁশ ভেঙে গেলে নাগরিকরা মনে করেন মায়ের পুজোয় নিশ্চয়ই কোন খুঁত হয়েছে। বুড়িমাকে নিয়ে আমার নিজের জীবনেও একটা ঘটনা আছে। তখন আমি খুব ছোট, বুড়িমার পুজো আমার বাড়ির ঠিক সামনেই হওয়ার সুবাদে সবসময়ই যেতাম। সেদিন ছিল পুজোর পরের দিন ছিল, আমি আমার এক বউদির সাথে যেতে যেতে বলেছিলাম, ‘বুড়িমা তো বুড়ি নয়।‘ তখন হঠাতই আমার পাশে থেকে একজন বলে উঠেছিল ‘ আমি তো বুড়ি হয়ে গেছি। আমি তাহলে তো বুড়িমা।‘ ভীষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেছিলাম ওই বক্তা একজ্ন বৃদ্ধা , অসম্ভব রকমের সুন্দর, আর মুখ জুড়ে হাল্কা হাসি। আমি যদিও আর কোন কথা বলার সুযোগ পাইনি আর উনিও ভিড়ে এমন ভাবে মিশে গিয়েছিলেন আমি আর খুঁজেও পাইনি। আমি জানি না উনি কে ছিলেন! এত বছর পরও ওই বৃদ্ধার মুখ আমি ভুলিনি। কিন্তু আমি আজও বিশ্বাস করি উনি আমার কাছে বুড়িমা। এই শহরের প্রতিটা মানুষ বিশ্বাস করেন বুড়িমা আছেন ।
গোবিন্দ সড়ক বারোয়ারির পুজো বহুদিনের। এখানে প্রাতিমা ‘ আলোকেশ্বরী মা’ নামে পরিচিত। সাহিত্যিক নারায়ণ সান্য্যাল এই পুজোর সাথে যুক্ত ছিলেন। আর একটি ক্লাব যার কথা না বললেই নয়, সেটি হল পাত্রবাজার বারোয়ারির ক্লাব স্বীকৃতি । প্যান্ডেল সজ্জার জন্য প্রতিবার এই পুজো কমিটি পুরস্কৃত হয়। কৃষ্ণনগর মাটির পুতুলের জন্য বিখ্যাত। আর তার প্রাণকেন্দ্র ঘূর্ণি। তাই এখানে মূলত থিমের পুজোর রমরমা চোখে পড়বার মত। যেমন, এবছরের কিছু থিম—
বউবাজার – রাজমহল, কলেজ স্ট্রিট – উৎসবে আলো, রায় পাড়া মালি পাড়া – দুবাইয়ের মীরাকেল হাউস, গড়াই পাড়া – তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা, ঘূর্ণি নবারুণ সংঘ – স্মরণে সত্যজিৎ , জল্কল বারোয়ারি – শ্রী গুরুধাম ভক্তি মন্দির, দর্জি পাড়া – স্বপ্নের দেশে মা , রাধানগর – ৬০ ফুট উঁচু শিবলিঙ্গের অভিষেক, আমিনবাজার- রাজস্থানের উমেদ ভবন প্যালেস, চৌধুরী পাড়া – প্যারিসের ডিসনিল্যান্ড, ঘূর্ণি বকুলতলা- সহজপাঠ, ঘূর্ণি ভাই ভাই- মহিষাদল রাজবাড়ি, পল্লীশ্রী—দেশভাগের যন্ত্রণা , নগেন্দ্রনগর- মেঘমল্লার, ঘূর্ণি তুফান সঙ্ঘ- কুম্ভকর্ণের কাল ঘুম, ঘূর্ণি হালদারপাড়া- ভাবনায় নয় বাস্তবে নারী, শক্তিনগর এম এন বি – চীনের বৌদ্ধ মন্দির, ঘূর্ণি গোয়ালা পাড়া – তারানাথ তান্ত্রিক, এম জি রোড- কেদারনাথ মন্দির, ক্লাব ছন্নছাড়া- ব্যোমকেশ ও দুর্গ রহস্য, ইত্যাদি।
মালোপাড়ার ‘জলেশ্বারী মা’এর পুজো পদ্ধতিতে নানা বৈচিত্র্য দেখা যায়। যেমন, জল ভরা প্রথা। ১৫ জনের বেশি ছেলেরা মেয়ে সেজে জল ভরে। জলঙ্গীর জল অষ্ঠমী তিথিতে এনে রাখা হয় হয় নাট মন্দিরে। রাতের বেলায় ছেলেরা মেয়ে সেজে জল ভরবে কলসে। নবমী তিথি উপস্থিত হলে ছয় জনের বেশি ছেলেরা মায়ের উপোষ করে থাকে। জলঙ্গির জলে স্নান করে দণ্ডী কাটতে কাটতে তারা মায়ের নাট মন্দিরে আসে। নবমীর দিন এখানে আঁখ, কুমড়ো, কলা বলি হয়। এরপর যারা উপস থাকেন, তারাফুলের মালা,চিনি সন্দেশ, ফল, মিষ্টি , ইত্যাদি নিয়ে সাজানো ‘নবমীর থালা’মাথায় নিয়ে সিদ্ধেশ্বারী কালীবাড়িতে পুজো দিতে আসেন। এরপর শুরু হয় ধুনো পোড়ান অনুষ্ঠান , উপসীরা নাট মন্দিরের ওপর বাবু হয়ে বসেন, তাদের শরীরে জড়িয়ে দেয়া হয় ভেজা সাদা কাপড় । মাথার ওপর রাখা হয় একটা কাপড়ের বিড়ে আর তার ওপর আগুনের সরা। তার ভিতর পোড়ান হয় ধূপ । কয়েক কুইন্ট্যাল ধূপ পোড়ান হয় খুব অল্প সময়ের মধ্যে । এখানে মাকে তিন রকম মাছ ইলিশ,কাতলা,রুই ভোগ হিসেবে দেয়া হয়। এছাড়াও পুজোর দিন সারারাত ধরে পায়েস দেয়া হয় সমস্ত দর্শনার্থীদের । বিসর্জনের সময় এখনও ‘ তিন থাকের ফুল ‘ এর গ্যাসের আলো জ্বালানো হয়। কাঠামোতে কোন পেরেক থাকে না।পাটের সরু দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকে কাঠামোর সংযোগ। পুজোর বিসর্জনের পর কাঠামো আলাদা করতে শুধু একটা ব্লেড লাগে। আনুমানিক এই কাঠামোর বয়স ২৫০ বছর।
এবার আসি বিসর্জনের কথায়। প্রবীণ মানুষদের মুখ থেকে আমরা জানতে পারি এই বিসর্জনেও রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। শহরের সমস্ত প্রতিমা মিছিল করে বিসর্জনের সময় রাজবাড়ি ঘুরে তারপর জলঙ্গীর দিকে যাত্রা করত। এর পিছনে কারন হিসেবে বলা যায় রানীমা ঠাকুর দেখতে পছন্দ করতেন, তাই রানীমাকে দেখাবার জন্য প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হত। যেসব প্রতিমা তার ভাল লাগতো তাদের উপহার দিতেন অর্থ আর প্রতিমা শিল্পীকে দিতেন একটি কাঁসার ঘরা । যেসব শিল্পীরা কাঁসার ঘরা পেতেন তাঁরা পরের বছর সেই ঘরা মাথায় নিয়ে পুজোর বিসর্জনে প্রদর্শন করতেন। পুজোর পরের দুদিন ঠাকুর বিসর্জন হয়। এখানে বিশেষ আকর্ষণ হল প্রথমদিনের সকালে ঘট বিসর্জন , বেলা ১১ টা থেকে শুরু হয় যা দেখবার জন্য কাতারে কাতারে মানুষ রাস্তার দুই ধারে বিকেল পর্যন্ত অসীম ধৈর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। আর এই শোভাযাত্রার সময় ঘট ছাড়াও সেখানে বিভিন্ন ট্যাব্লো থাকে যা মানুষরা সাজে। এই ঘট বিসর্জনে অন্যতম আকর্ষণ থাকে হাতারপাড়া বারোয়ারির ট্যাব্ল। এই ঘট বিসর্জনের পর কিছু ঘণ্টার ব্যাবধানে শুরু হয় সাঙে করে প্রথমদিনের প্রতিমা নিরঞ্জন। জগদ্ধাত্রীর মূর্তি সাঙে বসানোর আগে তেল, সিঁদুর দিয়ে ধূপ প্রদীপ দেখানো হয়। এই সাং এতটাই কৃষ্ণ নাগরিকদের আবেগের যে ২০২০ সালে করোনার জন্য প্রসাশন থেকে সাং হবে না বলায় শহরের প্রতিটি মানুষ শহরের প্রাণকেন্দ্র পোস্ট অফিস মোড়ে জড়ো হয়ে অবরোধ করেছিল। এই দিন ঐতিহ্য মণ্ডিত বনেদি বারোয়ারির প্রতিমা বিসর্জন হয়। প্রতিটি বারোয়ারি তাদের প্রতিমাকে বাঁশের সাং করে বেয়ারাদের কাঁধে চাপিয়ে আগে রাজবাড়ি প্রদক্ষিন করিয়ে ঘাটের উদ্দেশে রওনা হয়। এর সাথে থাকে শয়ে শয়ে ঢাকের বাদ্দি। মানুষের প্রান প্রাচুর্যকে কুনিশ করতে হয়। এই বিসজন শেষ হতে হতে পরের দিন সকাল হয়ে যায়। আর সবার শেষে যায় কৃষ্ণনগরের রাজরানী , কৃষ্ণনগর বাসিদের আবেগ ‘ বুড়িমা’। সাধারন মানুষ এই বিসর্জন না দেখে বাড়িমুখো হন না। ‘বুড়িমা’ই একমাত্র যার সামনে থাকে পুলিশের গারি। পুলিশি প্রহরায় মা যান । ১০০ এর বেশি ঢাক বাজে, বহু মানুষ আগে আগে দৌড়ান আর তারপর কাঁধে চেপে এগিয়ে আসেন রাজরানী । রাজবাড়ি প্রদক্ষিন করে এসে মাকে চাষা পাড়ার মুখে এনে নাচানো হয়। গোটা শহর বুড়িমার জয়ধ্বনি দেয়, সে এক অন্য অনুভুতি। তারপর মাকে কিছুক্ষনের জন্য তার বাড়ির সামনে নামিয়ে রাখা হয়। তারপর আবার কাঁধে চেপে ঘাটের দিকে যাত্রা। গতবছর, বুড়িমার নিরঞ্জন হতে দুপুর হয়ে গেছিল। তার অন্যতম কারন মাকে ঘাটে নিয়ে গিয়ে তারপর গয়না খোলা হয়। ভরি ভরি গয়না খুলতে প্রায় ঘণ্টা তিনেকের বেশি সময় লাগে।বিসর্জনের সময় রাজবাড়ি প্রদক্ষিনের রীতি মানে না একমাত্র নেদের পাড়া বারোয়ারি । ইতিহাস বলে রাজার আমলে এই পাড়ার ব্রাম্মনরা কর দিতেন না, ‘কর না দিবার পাড়া’ এই নামে পরিচিত হতে হতে লোকমুখে নাম হয় নেদের পাড়া ।রাজাকে কর দিত না বলেই এই পাড়ার ঠাকুর রাজবাড়ি যেত না, যা আজও মেনে চলা হয়। দ্বিতীয় দিন, বাকি ক্লাব তাদের প্রতিমা নিরঞ্জন করে। দ্বিতীয় দিন সাঙের বদলে গাড়িতে করে ঠাকুর নিয়ে যাওয়া হয়, সাথে থাকে ঢাক, বাজনা, আর মানুষের উল্লাস।
তথ্যসূত্রঃ
১। সুপ্রতিম কর্মকার; জগদ্ধাত্রীর উৎস সন্ধানে,মুদ্রা প্রকাশনা
২। শেখর শীল; কৃষ্ণচন্দ্রের কৃষ্ণনগর ও কৃষ্ণনাগরিকের উৎসব যাপন, প্যাপিরাস
৩। সুজন সারথি কর; অষ্ঠাদশ শতক ঃ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় এবং দুর্গাপূজা, শৈবাল সরকার সম্পাদিত মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও সমকাল, মুদ্রা প্রকাশন।
৪। সুধীর চক্রবর্তী ; উৎসবে, মেলায়, ইতিহাসে, পুস্তক বিপণী,
৫। আন্তরজালিক মাধ্যম
৬। প্রবীণ নাগরিকদের সঙ্গে কথোপকথন
নীলাঞ্জনা ব্যানার্জ্জী