ভাণ পত্রিকা
তেত্রিশতম সংখ্যা || চব্বিশতম ই-সংস্করণ || জানুয়ারী ২০২৩
সম্পাদক :
সম্পাদনা সহযোগী :
প্রচ্ছদ :
নক্সা পরিকল্পক :
অন্যান্য কাজে :
ভাণ-এর পক্ষে:
পার্থ হালদার
কর্তৃক
৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬
( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )
৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) bhaan.kolkata@gmail.com ( ই – মেল )
Reg. No : S/2L/28241
সূচি
দিল্লী ক্রাইম সিজন-২ এবং শেফালি সাহের কৃতবিদ্য অভিনয়ের কথা শোনালেন – বৃতা মৈত্র
সাধারণ দর্শকের চোখে নাট্য অভিনয়ের বিভিন্ন স্তর তুলে ধরলেন – বৈশাখী পাঠক
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে পাথেয় করে বাউলের তত্ত্বকথা লিখলেন – সঞ্চিতা দত্ত
ওয়ানস আপন আ টাইম ইন ক্যালকাটা সিনেমার গভীরে ডুব দিলেন – সুমন সাধু
নৃত্যে মুদ্রা কতটা অপরিহার্য, তা বোঝালেন – শ্রীপর্ণা ভট্টাচার্য
সম্পাদকের কথা
দিল্লী ক্রাইম সিজন-২ এবং শেফালি সাহের কৃতবিদ্য অভিনয়ের কথা শোনালেন - বৃতা মৈত্র
শেফালির আলোকবর্তিকা আরও একবার
চলতি বাসে গণধর্ষণের শিকার নির্ভয়ার ঘটনায় একদা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল দিল্লি শহর তথা সারা দেশ। সাল ২০১২ কলঙ্কিত হয়ে রয়েছে এই ঘটনায়। কলঙ্কিত সমাজ। কলঙ্কিত দেশের আইন ব্যবস্থা। ডাক্তারদের বহু চেষ্টার পরও নির্ভয়াকে বাঁচানো যায়নি। যদিও, তার আগেই ধরা পড়ে ঘটনায় অভিযুক্ত ছয় অপরাধী। তাদের একজনের আত্মহত্যা, একজন বয়সে কিশোর তাই শাস্তি কম, বাকি চারজনের ফাঁসি–সমস্তটাই এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় চলে, যা সকলেরই জানা। তবে, দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারণ এক্ষেত্রে প্রশাসনিক গাফিলতি নয়, আইনের কূটকচালি! বরং প্রশাসন এখানে দৃষ্টান্তমূলক কাজ করে আর এই সূত্রেই উঠে আসে ডিসিপি সাউথ বর্তিকা চতুর্বেদীর নাম। একটি সুদক্ষ ও নিবেদিত প্রাণ পুলিশ টিম নিয়ে অসাধ্য সাধন করেন তাঁরা।
সাধারণ দর্শকের চোখে নাট্য অভিনয়ের বিভিন্ন স্তর তুলে ধরলেন - বৈশাখী পাঠক
নাট্যকর্মীদের অভিনয় বিভিন্ন মাধ্যমে:
এক সাধারণ দর্শকের দৃষ্টিতে
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে পাথেয় করে বাউলের তত্ত্বকথা লিখলেন - সঞ্চিতা দত্ত
কেমনে চিনিব তোমারে
ওয়ানস আপন আ টাইম ইন ক্যালকাটা সিনেমার গভীরে ডুব দিলেন - সুমন সাধু
একটি শহর যেন বিষম পাথর হয়ে আছে
১
“কলকাতা আমার বুকে বিষম পাথর হয়ে আছে কলকাতা আমার বুকে বিষম পাথর হয়ে আছে
আমি এর সর্বনাশ করে যাবো—”
‘স্মৃতির শহর’-এ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একসময় লিখেছিলেন এ কবিতা। আসলে স্মৃতি সততই উস্কানিমূলক। বলে পিছন ফিরে তাকাও। তাকালে যদি ভালো কিছু মনে না পড়ে? যদি খারাপটাই বারবার স্মৃতিদগ্ধ করে। তাই স্মৃতিদের বিস্মৃতি হতে বেশি সময় লাগে না। কিন্তু তবুও কেউ কেউ থেকে যান মাঝসমুদ্রের নাবিকের মতো। যিনি সমস্তটা দ্যাখেন। তারপর একসময় তাঁর স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসে এ জীবদ্দশার পাল্টে যাওয়া। দেখা যায় দুর্নীতি, বিকৃতি, দূষণ আর পচনশীল পাহাড়ের সারি সারি দৃশ্য।
মাঝ সমুদ্রের সেই নাবিকের নাম আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত। সমসাময়িক বাংলা চলচ্চিত্রে যিনি ফাগুন এনেছেন। তাঁর সাম্প্রতিক সংযোজন ‘ওয়ানস আপন আ টাইম ইন ক্যালকাটা’। তিলোত্তমার ক্রমশ বদলে যাওয়ার গা শিরশিরানি তাঁর ছবির বিষয়বস্তু। দেখা যাচ্ছে, এ শহরের প্রায় প্রত্যেকেই এই পচনশীল সমাজব্যবস্থার অংশ। ব্যতিক্রমী শুধু এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ, শিশির। তার সম্বল বলতে একটি অবলা প্রাণী। কেন যে তার বাচ্চা হচ্ছে না, এই দুশ্চিন্তায় তিনি জর্জরিত। তিনিই একমাত্র শান্তির ঘুম ঘুমান।
এ শহরের ল্যান্ডমার্ক বলতে যা কিছু বোঝানো হয়, সবই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে পোস্তা ব্রিজ, ভেঙে যাচ্ছে সায়েন্স সিটির সামনে বসানো ডাইনোসর, উবে যাচ্ছে সার্কারিনা থিয়েটার, নতুন শহর হচ্ছে নিউটাউন। শহরে ব্যস্ততা বাড়ছে। আর ক্রমশ মানুষ একা হতে হতে আরও গভীর একা হয়ে পড়ছে। দুর্নীতির জাঁতাকলে কেমন যেন সকলেই আটকে৷ কেউ কাউকে দু-ইঞ্চি ছেড়ে কথা বলবে না।
‘ওয়ানস আপন আ টাইম ইন ক্যালকাটা’ ছবিতে প্রধান চরিত্র এলা। মধ্যবিত্ত পরিবারে বাস। স্বপ্ন দ্যাখে গগনচুম্বী অট্টালিকার। মেয়ে মারা যাবার পর ঠিক করে স্বামী শিশিরের সঙ্গে আর থাকবে না। না, ওসব রোজকার অশান্তি টশান্তি নেই। মনের মিল না থাকলে এক ছাদের তলায় থাকাটা বড্ড মুশকিল হয়ে পড়ে। কিন্তু এলা ফ্ল্যাট কেনার জন্য লোন নিতে পারে না৷ শরিকি দাদাকে বলে নিজের অধিকার ছিনিয়ে নিতে পারে না৷ আগে টুকটাক অভিনয় করত, এখন টিভিতে সঞ্চালনা করে। ভাগ্য ফেরানোর অনুষ্ঠান। ওই টিভি স্টুডিওতেও আবার দুর্নীতি। মশার কামড়ের দুর্নীতি। বসের সঙ্গে এলার একটা ভাব-ভালোবাসা হয়। মনের নয়, শরীরের। আশার নয়, আকাঙ্খার। স্বপ্নের নয়, লোভের। অট্টালিকা পাবার লোভ। পায়ও। তবে শহরের বাইরে। ঠিকানা কলকাতা। কিন্তু সে জোর করে টানাহেঁচড়ার কলকাতা। এমন কলকাতা যে একটা ওলাও বাড়ির দুয়ার অবধি পৌঁছায় না।
আদিত্য বিক্রম অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে প্রধান চরিত্র এলাকে দেখান পাড়ার এক কোণে পড়ে থাকা ‘Use Me’-র মতো। অথচ সে আগলে রেখেছে হাজার যন্ত্রণা। মাকে ছোটোবেলায় না পাওয়ার যন্ত্রণা। এমনকি নিজের মেয়ে হারানোর যন্ত্রণা।
২
“আর তাছাড়া ভাই আমরা সবাই জেনেছিলাম হবে
নতুন সমাজ, চোখের সামনে বিপ্লবে বিপ্লবে—”
সাউন্ড ডিজাইন এবং অ্যাস্থেটিক সেন্সের বাইরেও এই ছবি সরাসরি এবং সংলাপ প্রধান। যা আদিত্যর আগের দুটি কাজের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ছবিতে ব্যবহৃত ডাইনোসরটি আসলে সভ্য সমাজকে দিকনির্দেশ করে। এই ‘সভ্য সমাজ’ যেন ডাইনোসর যুগের মতো আজ অতীত হয়ে গেছে৷ ছবিতে অসাধারণ একটি চরিত্র আছে, বুবুদা। যিনি বন্ধ হয়ে যাওয়া থিয়েটারকে আগলে রাখেন আজও। প্রধান চরিত্র এলার দাদা। তবে নিজের নয়। ইলার বাবার আরেক সম্পর্কের ছেলে। বুবুদা বন্ধ হয়ে যাওয়া সমাজব্যবস্থার ভূত। মৃতপ্রায় এই মানুষটি বাড়ি আগলে বসে থাকে একা। একটা সময় আসে, যখন সে আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। বাড়ির সবচেয়ে পুরোনো কাজের লোকটিকে বিষাক্ত মনে হয়।
ছবিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে রবীন্দ্রনাথের গান৷ সে গান যেন পরিবর্তনের চিহ্ন স্বরূপ৷ একটি ছোট্ট দৃশ্যে দেখানো হয় এক বাচ্চা মেয়ে রবীন্দ্রনাথের রিমিক্স গানে নাচছে। আসলে তার পরিবার বা সমাজ তাকে শেখাতে পারেনি যে, কোনটা আসল আর কোনটা নকল। হিন্দি-ভোজপুরিঘেঁষা উত্তেজনামূলক হাই রিদমের রবীন্দ্রসংগীতে বাচ্চাটির মন গেছে। পুরো ছবিতেই স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ আছেন। যেভাবে থাকেন বাঙালির মননে৷ শহরের মেজাজ পাল্টায়, কিন্তু বাঙালির রক্ষাকবচ হয়ে, নিদেনপক্ষে দেওয়ালে টাঙানো ফুলের মালা সজ্জিত ‘ঠাকুর’ হয়েও। তাই ইলার অফিসে পার্টির দিন ‘আলোকেরই ঝরনা ধারায় ধুইয়ে দাও’ বাজে, রিমিক্সে। পাশের পাড়ার গলি থেকেও শোনা যায়, রিমিক্স। বাচ্চা মেয়েটি নাচে, রিমিক্স গানে৷ কিন্তু সমাজব্যবস্থা (পড়ুন ফ্লাইওভার) যখন ভেঙে পড়ে, বাঙালির উপর যখন বলপূর্বক রবীন্দ্রচেতনা বৃদ্ধি করতে চায় রাষ্ট্র, তখন রবীন্দ্রনাথ ঝাঁপিয়ে পড়েন এই সভ্যতার কাঠামোর উপর। শয়ে শয়ে মানুষ মারা যায়। এলার বস দুর্ঘটনায় মারা যায়৷ এলার শয্যাসঙ্গী একজন ব্যর্থ ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার অপরাধে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। এলা সব টিভিতে দ্যাখে। এলা হাসে। এলা প্রবল হাসে। সে আরও আরও একা হয়ে যায়।
তাকে আবার ফিরে আসতে হয় ফেলে আসা স্বামীর কাছে। ইলার পা টলমল। নকলের স্বপ্ন দেখা ইলা আসলে ফিরে আসে আসলের কাছে। এ-ও এক রূপক। যেমন রূপক, এলা অট্টালিকা পাবার লোভে বসের সঙ্গে যৌনতায় লিপ্ত হয়; অন্যদিকে দেখা যায় দুই কুকুরের মিলন। মানুষ বনাম পশুর যৌনতা। কিংবা যৌন আবেদনের লড়াই।
নৃত্যে মুদ্রা কতটা অপরিহার্য, তা বোঝালেন - শ্রীপর্ণা ভট্টাচার্য
শ্রীপর্ণা ভট্টাচার্য
নৃত্য জগতে মুদ্রার পরিচিতি
প্রথম অংশ
নৃত্য, এই কথাটার মধ্যেই এক প্রাঞ্ছলতা লুকিয়ে আছে। তবে নৃত্যের রহস্য ভেদ করতে গেলে, নৃত্যের উৎপত্তি ঠিক কবে হয়েছিল তা সন-তারিখ দিয়ে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। তবুও নৃত্যের উৎপত্তি বলা যায় আদিম মানুষের বুদ্ধি বিকাশের জন্মলগ্নে, তার চেতনার উন্মেষের প্রথম ধাপে। এই প্রকৃতির বিচিত্র লীলা যখন তার হৃদয়ে ঢেউ জাগাল, ভাষাহীন মানুষ তার আবেগের জোয়ারের মুক্তি ঘটালো দেহের ভাষায়, মানে দেহের নানান অঙ্গ ভঙ্গিমার মাধ্যমে তখন থেকেই সৃষ্টি হল নৃত্যের।
মুখের দ্বারা গান, হাতের মুদ্রা দ্বারা সেই গানের অর্থ প্রকাশ, নেত্রদ্বয় দ্বারা ভাব প্রদর্শন এবং পায়ের দ্বারা তাল ও লয় রক্ষা করাই নৃত্য।
আর নৃত্যে হাতের আঙ্গুলের বিশেষ বিশেষ ভঙ্গির দ্বারা যখন কোন অর্থ প্রকাশ করা হয়, তখনই তাকে মুদ্রা বলা হয়। এই মুদ্রার নানারকম অর্থ করা হয়। সংগীতদর্পণে বলা হয় – “ সম্প্রদায়ানুসরণং মুদ্রা হৃদয়রঞ্জনী।“ মুদ্রা শব্দের অর্থ – “মুদ্রম্ আনন্দং রাতি দদাতি” অর্থাৎ যা আনন্দ দান করে। সুতরাং বলা যায় মুদ্রা হচ্ছে নৃত্যেরই এক ভাষা।এর সাহায্যেই নৃত্যের বক্তব্য প্রকাশ করা হয়। অনেক সময় একটি মুদ্রার বিভিন্ন রকম প্রয়োগের দ্বারা নানারকম অর্থও ব্যক্ত করা হয়। অর্থাৎ এই অঙ্গুলি চালনা বিশেষ বিশেষ রস ও গভীর অর্থের দ্যোতক।
ভরতনাট্যম, কথাকলি , কথক ও মণিপুরী এই চারটি শাস্ত্রীয় নৃত্যের মধ্যে ভরতনাট্যম ও কথাকলিতেই মুদ্রার ব্যবহার বেশী হয়, কথক ও মণিপুরী নৃত্যে মুদ্রার ব্যবহার কম। আর এই নৃত্যবিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করতে হলে মুদ্রা আয়ত্ত করা একান্ত প্রয়োজন।
অভিনয় দর্পণ অনুযায়ী দুই প্রকার প্রধান হস্তমুদ্রা অথবা ভঙ্গিমা বা প্রতীক দেখা যায় , যেমন- অসংযুক্ত (একক) এবং সংযুক্ত (উভয় হস্ত)।
অসংযুক্ত মুদ্রাঃ-
এক হাতের দ্বারা যে মুদ্রা দেখান হয় অর্থাৎ একটি হাতের দ্বারা যখন অর্থ প্রকাশ করা হয় তখন তাকে অসংযুক্ত মুদ্রা বলে। নাট্যশাস্ত্র মতে ২৮ প্রকার অসংযুক্ত মুদ্রার উল্লেখ আছে। যথা- ১) পতাকা,২) ত্রিপতাকা,৩) অর্ধপতাকা,৪) কর্তরী মুখ, ৫) ময়ূর,৬) শুকতুন্ড,৭) অর্ধচন্দ্র ,৮) অরাল, ৯) মুষ্ঠি, ১০) শিখর, ১১) কপিত্থ, ১২) কটাকামুখ, ১৩) সূচী , ১৪) চন্দ্রকলা, ১৫) পদ্মকোশ, ১৬) সর্পশীর্ষ, ১৭) মৃগশীর্ষ, ১৮) সিংহমুখ, ১৯) কাঙ্গুল, ২০) অলপদ্ম, ২১) চতুর, ২২) ভ্রমর, ২৩) হংসাস্য,২৪) হংসপক্ষ, ২৫) সন্দংশ, ২৬) মুকুল, ২৭) তাম্রচূড়,২৮) ত্রিশূল।
এছাড়াও নাট্যশাস্ত্র মতে আরও অন্য ৪ টি অসংযুক্ত মুদ্রা হল –
১) ব্যাঘ্র, ২) অর্ধসূচী,৩) কটক, ৪) পল্লী।
১) পতাকাঃ- আঙ্গুলগুলি সমানভাবে ছড়িয়ে পরস্পর গায়ে লাগা অবস্থায় থাকলে এবং কেবলমাত্র অঙ্গুষ্ঠটি ভাঁজ করা থাকলে পতাকা মুদ্রা হয়।
পতাকা
ব্রহ্মা জয়ের বার্তা -পরব্রহ্মাকে জানাবার জন্য এই হস্ত ধ্বজার মতো ব্যবহৃত করেছিলেন। তারপর থেকেই এই মুদ্রা পতাকা নামে পরিচিতি লাভ করে। পতাকা হস্ত ব্রহ্মা থেকে উৎসারিত হয়েছে। এর রং হচ্ছে শ্বেত।
নাট্যশাস্ত্র অনুসারে-
ব্যবহার- প্রতাপে, প্রেরনে, হর্ষে, গর্বে, আমি, আমার প্রভৃতি গর্ব প্রকাশে হাত দুটি ললাট অভিমুখে ঊর্ধে তুলতে হয়। হাত দুটি ঊর্ধে উথিত করে অগ্নিধারা পুষ্পবৃষ্টি নিরূপণ করতে আঙ্গুল গুলি ঊর্ধমুখি করে মাথার ওপর রেখে পুনরায় অধোমুখী পুস্পবৃষ্টি বোঝানো হয়। পতাকা হাত দুটিকে যুক্ত করে স্বস্তিক এবং স্বস্তিককে বিচ্যুত করে পতাকা হাত দুটিকে মণিবন্ধের সঙ্গে যুক্ত করে বাহুর পরিভ্রমণের দ্বারা পল্বল (ক্ষুদ্র জলাশয়) , পুষ্পপহার, শষ্প (নবতৃণ) প্রভৃতি পৃথিবীতে অবস্থিত বস্তুকে নির্দেশ করা হয়। স্বস্তিককে বিচ্যুত করে আবার বিচ্যুত হাত দুটিকে স্বস্তিক করে, এই ক্রমে সংবৃত, বিবৃত অর্ধসংবৃত ও অর্ধবিবৃত ইত্যাদি নানাভাবে হাত দুটিকে রেখে পতনোন্মুখকে রক্ষা করা, অপরের দৃষ্টি থেকে গোপন করা প্রভৃতি ব্যক্ত করা হয় এবং হাত দুটিকে অধোমুখে ও ঊর্ধাভিমুখে চালনা করে বায়ুচালিত ঊর্মির দ্বারা বেলাভূমির বিক্ষোভ ও বেগ দেখানো হয়। রেচকের সাহায্যে হাত দুটির চালনার দ্বারা পাখিদের পাখা উৎক্ষেপণের অভিনয় করতেও এই মুদ্রা প্রযোজ্য হয়। পতাকা হাত দুটির তলদেশ ঘর্ষণের দ্বারা কোন দ্রব্য ধোয়া, মাজা ও পেষণ করা প্রভৃতি বোঝায়। এছাড়া শৈলধারণ ও উদ্ঘাটনে ব্যবহৃত হয়। দশক, শতক, সহস্র সংখ্যা বোঝাতেও ‘পতাকা’ ব্যবহার করা হয়।
অভিনয়দর্পণ অনুসারে-
প্রয়োগ-
“নাট্যারম্ভে বারিবহে বনে বস্তুনিষেধনে ।
কুচস্থলে নিসায়াং চ নদ্যামমরমণ্ডলে।।
তুরঙ্গে খণ্ডনে বায়ৌ শয়নে গমনোদ্দ্যমে ।
প্রতাপে চ প্রসাদে চ চন্দ্রিকায়াং ঘনাতাপে।।
কবাটপাটনে সপ্তবিভক্ত্যার্থে তরঙ্গকে।
বীথী প্রবেশ ভাবেহপি সমত্বে চাঙ্গরাগকে।।
আত্মার্থে শপথে চাপি তুষ্ণীম্ভাবনিদর্শনে ।
তাল পত্রে চ খেটে চ দ্রব্যাদিস্পর্শনে তথা।।
আশীর্ব্বাদক্রিয়ায়ং চ নৃপশ্রেষ্ঠস্য ভাবনে।
তত্র তত্রেতি বচনে সিন্ধৌতু সূকৃতিক্রমে।।
সম্ভোধনে পুরোগেহপি খড়্গরূপস্যে ধারণে।
মাসে সংবৎসরে বর্ষাদিনে সম্মার্জ্জনে তথা।।
এবমর্থেষু যুজ্যন্তে পতাকহস্তভাবননা।”
অর্থ:-
নাট্যারম্ভেঃ- নৃত্যের আরম্ভন্।
বারিবহেঃ- জলসন্তরণ।
বচনঃ- বন।
বস্তুনিষেধনেঃ- কোনো বিষয়ের নিষেধ করণ।
কুচস্থলেঃ- বক্ষ স্পর্শ
নিশায়াঞ্চঃ- রাত্রিকাল।
নদ্যামঃ- নদী।
অমরমণ্ডলেঃ- স্বর্গলোকে।
তুরঙ্গেঃ- অশ্ব বা অশ্বারোহণ।
খণ্ডনেঃ- ছেদন।
বায়ৌঃ- বায়ু।
শয়নেঃ- শয়ন।
গমনোদ্যমেঃ- গমনের উদ্যম।
প্রতাপেঃ- প্রতাপ প্রকাশ।
প্রসাদেঃ- প্রসন্নতা প্রকাশ।
চন্দ্রিকায়াংঃ- চাঁদের কিরণ।
ঘনাতাপেঃ- প্রখর সূর্য্যের দীপ্তি।
কবাট পাটনেঃ- দ্বার খোলা হচ্ছে এমন।
সপ্তবিভক্ত্যার্থেঃ- সপ্তবিভক্তি বোধন।
তরঙ্গেঃ- উর্ম্মি।
বীথি প্রবেশ ভাবেঃ- পথ প্রবেশ।
সমত্বঃ- তুল্যতা জ্ঞাপন।
অঙ্গরাগকেঃ- কুঙ্কুম-চন্দনাদি দ্বারা গাত্র বিলেপন।
আত্মার্থেঃ- নিজ অর্থবোধক।
শপথেঃ- প্রতিজ্ঞা।
তুষ্ণীম্ভাবনিদর্শনেঃ- নীরবতা জ্ঞাপন।
তালপত্রেঃ- তাল পাতা।
খেটেঃ- যষ্ঠি ধারণ।
দ্রব্যাদি স্পর্শনেঃ- দ্রব্য প্রভৃতি স্পর্শন।
আশীর্ব্বাদক্রিয়াংঃ- আশীর্বাদ কার্য্যে।
নৃপশ্রেষ্ঠস্যভাবনেঃ- শ্রেষ্ঠরাজার অনুধ্যান।
তত্র তত্রেতি বচনেঃ- ইহা, উহা প্রভৃতি।
সিন্ধৌঃ- সমুদ্র।
সুকৃতিক্রমেঃ- সৎকর্মের নির্দ্দেশ।
সম্বোধনেঃ- সম্বোধন।
পুরোগঃ- অগ্রগমন বা পুরোগামী।
খড়্গরূপস্য ধারণেঃ- খাড়্গিক।
মাসেসংবৎসরেঃ- মাস এবং বৎসর।
বর্ষাদিনেঃ- বৃষ্টির দিন।
সমার্জ্জনেঃ- পরিষ্করণ বা সম্মার্জ্জনী।
উক্ত সমস্ত বিষয় বোঝাতে পতাকা হস্ত ব্যবহার করা হয়।
২)ত্রিপতাকাঃ– পতাকা হতে অনামিকা ভাঁজ করা থাকলে ত্রিপতাকা হয়। শত্রু যখন তাঁর বজ্র অস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন তখন এই হস্তের ব্যবহার দেখা যায়। ইন্দ্র থেকে এই হস্তের উৎপত্তি।
ত্রিপতাকা
ব্যবহারঃ- আবাহন, অবতরণ, বিসর্জন, বারণ, প্রবেশ, চিবুকাদি স্পর্শ, প্রণাম, বিবিধ বচন,মস্তক স্পর্শ, মুকুট ধারণ, মুখ,কান আচ্ছাদন, প্রভৃতি।
প্রয়োগঃ-
“মুকুটে বৃক্ষভাবেষু বজ্রে তদ্ধরবাসরে ।
কেতকিকুসুমে দ্বীপে বহ্নিজ্বালা বিজৃম্ভনে।।
কপোত পত্রলেখায়াং বাণার্থে পরিবর্ত্তনে।
যুজ্যতে ত্রিপতাকোহয়ং কথিতো ভরতোত্তমৈঃ”।।
অর্থঃ-
মুকুটেঃ- শিরোভূষণ বা মুকুট।
বৃক্ষভাবেষুঃ- বৃক্ষভাবে।
বজ্রেঃ- বজ্র।
তদ্ধরবাসরেঃ- বজ্রধারী বাসর।
কেতকী কুসুমেঃ- কেতকী পুস্প।
দ্বীপেঃ- প্রদীপ।
বহ্নিজ্বালা বিজৃম্ভনেঃ- অগ্নিশিখা বর্দ্ধন।
কপোতেঃ- কপোত পক্ষীর আকৃতি প্রদর্শন।
পত্রলেখায়াংঃ- পত্রলিখন অথবা অলকা তিলকা [ অঙ্গলিপ্ত কুঙ্কুম, চন্দনাদিকৃত মুখচিত্রন অথবা কুচ চিত্রন ]।
বাণার্থেঃ- বাণের আকার প্রদর্শন।
পরিবর্ত্তনেঃ- পরিবর্ত্তন বা ঘূর্ণন।
এই সকল বিষয়ে ‘ত্রিপতাকা’ নামক হস্ত ব্যবহার করা হয়।
৩)অর্ধপতাকাঃ- ত্রিপতাকা হতে কনিষ্ঠা ভাঁজ থাকলে অর্দ্ধপতাকা হয়। ত্রিপতাকা থেকেই অর্ধপতাকার উৎপত্তি হয়েছে।
ব্যবহারঃ- পত্র, ফলক,তীর,ধব্বজ, শৃঙ্গ প্রভৃতি।
অর্ধপতাকা
প্রয়োগঃ-
“পল্লবে ফলকে তীরে উভয়োরিতি বাচকে।
ক্রকচে ছুরিকায়াঞ্চ ধব্বজে গোপুর শৃঙ্গয়োঃ।
যুজ্যতেহর্দ্ধ পতাকোহয়ং তত্তৎকর্ম্ম প্রয়োগকে।।”
অর্থঃ-
পল্লবেঃ- তরুলতার পল্লব [ নূতন পাতা ]।
ফলকেঃ- ফলক।
তীরেঃ- নদীকূল অথবা তট।
উভয়োরিতিবাচকেঃ- উভয় বা দুই বাক্যের বধ।
ক্রকচেঃ- করাত।
ছুরিকায়াংঃ- ছুরি।
ধ্বজেঃ- ধ্বজ বা পতাকায়।
গোপুরঃ- পুরদ্বার বা নগর দ্বার।
শৃঙ্গয়োঃ- শিঙ্।
এই সকল বিষয়ে যে হস্ত ব্যবহার করা হয় তাকে অর্ধপতাকা বলে।
৪)কর্তরীমুখঃ- ত্রিপতাকাহস্তে মধ্যমা থেকে তর্জনীবিশিষ্ট অবস্থায় যদি থাকে এবং হাতের পেছনদিক দৃষ্ট হয়, তবে কর্তরীমুখ হয়। যখন শশাঙ্ক শেখর রাক্ষস জলন্ধরকে ধ্বংস করতে গিয়েছিলেন তখন তিনি তর্জনীর সাহায্যে পৃথিবীর মধ্যস্থলে একটি বৃত্ত রচনা করেন। এই হস্ত শঙ্কর (শিব) থেকে উৎসারিত হয়েছে। এর রং তাম্র বর্ণ।
নাট্যশাস্ত্র অনুসারে-
ব্যবহারঃ- পতনে, দংশনে, শৃঙ্গে, মরণে, অপরাধে প্রভৃতি।
কর্তরীমুখ
অভিনয়দর্পণ অনুসারে-
প্রয়োগঃ-
“স্ত্রীপুংসয়োস্তু বিশ্লেষে বিপর্য্যাসপদেহপি বা।
লুণ্ঠনে নয়নান্তে চ মরণে ভেদভাবনে।
বিদ্যুদর্থেহপ্যেক শয্যাবিরহে পতনে তথা।
লতায়াং যুজ্যতে যস্তু স করঃ কর্ত্তরী মুখ ।।”
অর্থঃ-
স্ত্রীপুংসয়োস্তু বিশ্লেষেঃ- স্ত্রী পুরুষের বিচ্ছেদ।
বিপর্য্যাস পদেহপি বাঃ- বিপর্য্যস্ত অবস্থা।
লুণ্ঠনেঃ- লুণ্ঠন।
নয়নান্তেঃ- চক্ষুর প্রান্ত।
মরণেঃ- মরণ।
ভেদভাবনেঃ- পার্থক্য জ্ঞাপন।
বিদ্যুদর্থেঃ- বিদ্যুৎ অর্থে।
একশয্যাবিরহেঃ- বিরহ অবস্থায় একাকী শয্যায় শয়ন।
পতনেঃ- পতন।
লতায়াংঃ- লতা।
এই সকল বিষয়ে যে হস্ত প্রয়োগ করা হয়, তাকে কর্তুরীমুখ বলে।
৫)ময়ূরঃ- কর্তরীমুখে অনামিকা ও অঙ্গুষ্ঠ পরস্পর সংযুক্ত ও আঙুলগুল প্রসারিত হলে ময়ূরহস্ত হয়। কর্তুরীমুখ হস্ত থেকে ময়ূর হস্তের উৎপত্তি।
ময়ূর
ব্যবহারঃ- ময়ূরের মুখ, লতা, পক্ষী, নদীজল, ললাট তিলক, ইত্যাদি।
প্রয়োগঃ-
“ময়ূরাস্যে লতায়াং চ শকুনে বমনে তথা।
অলকাস্যাপনয়নে ললাটতিলকেষু চ।।
নদ্যুদকস্য নিক্ষেপে শাস্ত্রবাদে প্রসিদ্ধকে।
এবমার্থেষু যজ্যন্তে ময়ূরকর ভাবনাঃ।।”
অর্থঃ-
ময়ূরাস্যেঃ- ময়ূরের ঠোঁট।
লতায়াংঃ- লতা।
শকুনেঃ- শকুন [পক্ষী]।
বমনেঃ- বমন [বমি করা]।
অলকাস্যাপনয়নেঃ- অলকগুচ্ছের অপসরণ।
ললাটতিলকেষুঃ- কপাল তিলক স্থাপন।
নদ্যুদকস্যনিক্ষেপেঃ- নদীর জল নিক্ষেপ।
শাস্ত্রবাদে প্রসিদ্ধকেঃ- শাস্ত্রার্থ বিচার এবং প্রসিদ্ধ বস্তু।
এই সকল বিষয়ে যে হস্ত ব্যবহার করা হয় তাকে ময়ূর বলা হয়।
৬)অর্দ্ধচন্দ্রঃ- অঙ্গুষ্ঠের সঙ্গে আঙুলগুলি ধনুকের মতো বক্রাবস্থায় নত হলে অর্ধচন্দ্র হয়। শম্ভু (শিব) অলংকারের জন্য অর্ধচন্দ্রকে গ্রহণ করেন। শম্ভুর অলংকারের ইচ্ছা জানতে পেরে চন্দ্রফুলের আকৃতিতে অর্ধচন্দ্র রূপে প্রকাশিত হয়। চন্দ্র দেবতা থেকে এর উৎপত্তি। এর বর্ণ হল শ্বেত।
অর্দ্ধচন্দ্র
নাট্যশাস্ত্র অনুসারে,
ব্যবহারঃ- বালতরু, চন্দ্রকলা, শঙ্খ, কলসী, বলয়, বলপ্রয়োগে উন্মোচন, গণ্ড অ ভ্রুবিভ্রমের দ্বারা খেদ, ক্রোধ প্রভৃতির প্রকাশে, কৃশ ও স্থূল বস্তুর নির্দেশে ব্যবহৃত হয়। নারীদের রশনা (নিতম্ব), জঘন, কটি, প্রভৃতির অভিনয়ে এই হস্ত ব্যবহৃত হয়।
অভিনয়দর্পণ অনুসারে,
প্রয়োগঃ-
“চন্দ্রে কৃষ্ণাষ্টমী ভাজি গলহস্তার্থকেহপি চ।।
ভল্লায়ুধে দেবতানামভিষেচন কর্ম্মাণি।
ভুক্পাত্রে চোদ্ভবে কট্যাং চিন্তায়ামাত্মবাচকে।।
ধ্যানে চ প্রার্থনে চাপি অঙ্গনা স্পর্শনে তথা।
প্রকৃতনাং নমস্কারে অর্দ্ধচন্দ্রো নিযুজ্যতে।।”
অর্থঃ-
চন্দ্রে কৃষ্ণাষ্টমী ভাজিঃ- কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথির চন্দ্র।
গলহস্তার্থেঃ- গলাধাক্কা দেওয়া।
ভল্লায়ুধেঃ- বল্লম [ ভল্ল নামক এক অস্ত্র ]।
দেবতা নামভিষেচক কর্ম্মাণিঃ- দেবতার অভিষেক।
ভুক্পাত্রেঃ- ভোজন পাত্র।
উদ্ভবেঃ- উৎপত্তি।
কট্যাংঃ- কটিদেশ।
চিন্তায়াংঃ- ভাবনা।
ধ্যানে চ প্রার্থনেঃ- ধ্যান এবং প্রার্থনা।
অঙ্গানাংস্পর্শনেঃ- অঙ্গস্পর্শ।
প্রকৃতানাংনমস্কারে অর্দ্ধচন্দ্রোনিয়ুজ্যতেঃ- বয়োজেষ্ঠ ব্যক্তি বা অতিথির অভ্যর্থনা কালে, অর্দ্ধচন্দ্র আজ্ঞপ্ত হয়।
এই সকল বিষয়ে যে হস্ত ব্যবহার করা হয় তাকে অর্দ্ধচন্দ্র বলা হয়।
৭)অরালঃ- তর্জনী ধনুকের মতো নত, অঙ্গুষ্ঠ অল্প কুঞ্চিত এবং অবশিষ্ট আঙুলগুলি উন্নত ও পরস্পর বিশ্লিষ্ট ও অল্পবক্র হলে অরাল হস্ত হয়। রাক্ষস, নিভতক বধ, কালকেয় এবং অন্যান্যরা যারা স্বর্গে অশান্তির সৃষ্টি করছিল তাদের ধ্বংস করার জন্য ইন্দ্র অর্জুনকে স্বর্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিছু রাক্ষস সমুদ্রে আত্মগোপন করে ফলে তাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি, মহামুনি অগস্ত্য দেবতাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন এবং অর্জুনকে বধ সমুদ্রতীরে অপেক্ষা করতে বলেন ও সপ্ত-সমুদ্রকে তিনি পান করেন ফলে রাক্ষসরা বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়।
অরাল
নাট্যশাস্ত্র অনুসারে,
ব্যবহারঃ- বল, উদ্ধত, বীর্য, কান্তি, দিব্যবস্তু নির্দেশ, গাম্ভীর্য প্রকাশ, আশীর্বাদ ও অন্যান্য শুভকাজের অভিনয় করা হয়। এছাড়া স্ত্রী লোকের কেশ সংগ্রহ, কেশবিকিরণ, নিজের অঙ্গ উত্তমরূপে দর্শন ইত্যাদি অভিনীত হয়। কৌতুক, বিবাহ, প্রদক্ষিণ, প্রভৃতিতে অরালহস্তের আঙ্গুলের অগ্রভাগ স্বস্তিক হয়ে মণ্ডলাকারে ঘুরবে। প্রদক্ষিণ পরিমণ্ডল, মহাজন ও ভূমিতে রচিত দ্রব্যের অভিনয় করা হয়।
অভিনয়দর্পণ অনুসারে,
প্রয়োগঃ-
“বিষাদ্যমৃতপানেষু প্রচণ্ডপবনেহপি চ।
অরালহস্তঃ কথিতঃ সতু নৃত্যেবিশেষতঃ।।”
অর্থঃ-
বিষাদ্যঃ- গরল।
অমৃতঃ- অমৃত।
পানেষুঃ- পান।
প্রচন্ড পবনেঃ- প্রবল বায়ু।
এই সকল বিষয়ে অরালহস্ত ব্যবহৃত করা হয়।
৮)শুকতুন্ডঃ- অরাল হস্তের অনামিকা বক্র হলে শুকতুন্ড হয়। সদাশিবের সাথে পার্বতী নৃত্য করার সময় এই হস্তমুদ্রা ব্যবহার করেন প্রেমিকের বিতর্ক স্বরূপ। এর বর্ণ লাল।
শুকতুন্ড
নাট্যশাস্ত্র অনুসারে,
ব্যবহারঃ- ‘আমি নই’, ‘তুমি নও’, ‘কোরো না’ ইত্যাদির অভিনয়, আবাহন, বিদায়, অবজ্ঞার সঙ্গে ধিক্কার প্রকাশ পায়।
অভিনয়দর্পণ অনুসারে,
প্রয়োগঃ-
“বাণপ্রয়োগে কুন্তার্থে আলয়স্য স্মৃতিক্রমে।
মর্ম্মোক্ত্যামুগ্রভাবেষু শুকতুন্ডো নিয়ুজ্যতে।।“
অর্থঃ-
বাণপ্রয়োগেঃ- বাণক্ষেপ।
কুন্তার্থেঃ- প্রাস্ অস্ত্র বা কুন্ত।
আলয়স্য স্মৃতি ক্রমেঃ- গৃহের স্মরণ।
মর্ম্মোক্ত্যাম্ঃ- নিঢ়গু বচন।
উগ্রভাবেষুঃ- উগ্রভাব।
এই সকল বিষয়ে যে হস্ত ব্যবহৃত করা হয় তা শুকতুন্ড নামে পরিচিত।
৯)মুষ্টিঃ- হাতের তালুর মধ্যে আঙুল গুলির অগ্রভাগ অঙ্গুষ্ঠ দ্বারা চেপে ধরলে মুষ্টি হয়। বিষ্ণু রাক্ষস মধু এবং কৈটবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময় এই হস্ত ব্যবহার করেন। এর বর্ণ নীল।
মুষ্টি
ব্যবহারঃ- প্রহারে, ব্যায়ামে, যুদ্ধে (প্রতিপক্ষের হস্তধারণে, খন্ড যুদ্ধে), ইত্যাদি।
প্রয়োগঃ-
“ স্থিরে কচগ্রহে দার্ঢ়্যে বস্তাদীনাং চ ধারণে।
মল্লানাং যুদ্ধভাবেহপি মুষ্টিহস্তোহয়মিস্যতি।।“
অর্থঃ-
স্থিরেঃ- স্থিরতা বা দৃঢ়তা।
কচগ্রহেঃ- কেশধারণ।
দার্ঢ়্যেঃ- স্থৈর্য্য প্রকাশ
বস্তাদীনাং চ ধারণেঃ- বস্তু প্রভৃতি ধারণ।
মল্লানাং যুদ্ধভাবেঃ- মল্লদিগের যুদ্ধভাব।
এই সকল বিষয়ে যে হস্ত ব্যবহৃত হয় তা মুষ্টি নামে পরিচিত।
১০)শিখরঃ- মুষ্টি হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি যদি উপরের দিকে থাকে তাহলে ‘শিখর’ হস্ত হয়। যখন চন্দ্র শেখর (শিব) মেরু পর্বতকে ধারণ করে ধনুকের মত কেন্দ্রস্থলে স্থাপন করেন তখন এই হস্ত ব্যবহৃত হয়। এর বর্ণ কালো।
শিখর
নাট্যশাস্ত্র অনুসারে,
ব্যবহারঃ- কুশ, ধনুক ধারণে এবং তোমর (একরকম অস্ত্র), শক্তি প্রভৃতি অস্ত্রের নিক্ষেপে, অধর, ওষ্ঠ, ও পদরঞ্জনে এবং কেশের উর্ধ্বদিকে বিকিরণ প্রভৃতিতে শিখররঞ্জন অভিনীত হয়ে থাকে।
অভিনয়দর্পণ অনুসারে,
প্রয়োগঃ-
“মদনে কাম্মুকে স্তম্ভে নিশ্চয়ে পিতৃকর্ম্মাণি।
ওষ্ঠে প্রবিষ্টরূপে চ রদনে প্রশ্নভাবচনে।।
লিঙ্গে নাস্তীতি বচনে স্মরণেহভিনয়ান্তিকে।।
কটিবন্ধাকর্ষণে চ পরিরম্ভ বিধিক্রমে।
ঘন্টানিনাদেশিখরো যুজ্যতে ভরতাদিভিঃ।।”
অর্থঃ-
মদনেঃ- কন্দর্প।
কাম্মুকেঃ- ধনুধারণ।
স্তম্ভেঃ- স্তম্ভ।
নিশ্চয়েঃ- নিশ্চয়।
পিতৃকর্ম্মাণিঃ- পিতৃশ্রাদ্ধ।
ওষ্ঠেঃ- ওষ্ঠ।
প্রবিষ্টরূপেঃ- অন্তর্ভূত বা প্রবিষ্টাকৃতি।
রদনেঃ- দন্ত।
প্রশ্নভাবনেঃ- কোন প্রশ্ন করিবার ভাব।
লিঙ্গেঃ- লিঙ্গ।
নাস্তীতিবচনেঃ- ‘নাই’ এই কথা বলা।
স্মরণেঃ- স্মরণ।
অভিনয়ান্তিকেঃ- যোগ্য অভিনয়।
কটিবন্ধাকর্ষণেঃ- কটিবন্ধ।
পরিরম্ভাবিধিক্রমেঃ- আলিঙ্গনে।
ঘণ্টানিনাদেঃ- ঘণ্টা বাদন।
উক্ত সকল বিষয়ে শিখর হস্ত ব্যবহৃত হয়।
১১)কপিত্থঃ- শিখর হস্তের তর্জনী বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দ্বারা পীড়িত হয়ে বক্র হলে কপিত্থ হস্ত হয়। সমুদ্রে অমৃত মন্থনের সময় মন্দার পর্বতকে বিষ্ণু তাঁর হস্ত দ্বারা বলপূর্বক টেনে এনেছিলেন। এর বর্ণ কালো।
কপিত্থ
নাট্যশাস্ত্র অনুসারে,
ব্যবহারঃ- অসি, ধনুক, চক্র, বর্শা, গদা, শক্তি ও বজ্র এবং বাণ এই অস্ত্রগুলি, সত্য ও হিতকর কর্ম – এই গুলি কপিত্থ মুদ্রার দ্বারা প্রকাশ পায়।
অভিনয়দর্পণ অনুসারে,
প্রয়োগঃ-
“লক্ষ্ম্যাং চৈব সরস্বত্যাং লটানাং তালধারনে।
গোদনেহপ্যঞ্জনে চ লীলাকুসুমধারণে।।
চেলাঞ্চলাদিগ্রহণে পটস্যৈবাবগুন্ঠনে।
ধূপদীপার্চ্চনে চাপি কপিত্থঃ সম্প্রযুজ্যতে।।”
অর্থঃ-
লক্ষ্ম্যাংঃ- লক্ষ্মী।
সরস্বত্যাংঃ- সরস্বতী।
নটানাং তালধারণেঃ- তালধারণ।
গোদহনেঃ- গোদহন।
অঞ্জনেঃ- [নয়নে] কজ্জল লেপন।
লীলাকুসুমধারণেঃ- লীলা (শৃঙ্গার জনিত ক্রিয়াবিশেষ সময়ে) পুষ্পগ্রহণ।
চেলাঞ্চলাদিগ্রহণেঃ- বস্ত্রাঞ্চল ধারণ।
পটস্যৈবাবগুণ্ঠনেঃ- অবগুণ্ঠন কুঞ্চন।
ধূপদীপার্চ্চনেঃ- ধূপ-দীপাদি দ্বারা আরতি দান।
উক্ত সমস্ত কার্যের প্রয়োগের সময় কপিত্থ হস্ত ব্যবহার করা হয়।
বাকি মুদ্রার ব্যাখ্যা পরের অংশে বর্ণিত হবে।
যাপিত নাট্যের সপ্তম কিস্তি লিখলেন - কুন্তল মুখোপাধ্যায়
কুন্তল মুখোপাধ্যায়
যাপিত নাট্যের সপ্তম কিস্তি
আজ আমাদের যুবক বয়সের এক পাগলামির গল্প বলি। সত্তরের দশকের প্রথম দিকে রঙ্গনায় নান্দীকার সপ্তাহে তিনদিন অভিনয় করত। আমি ছিলাম প্রায় রোজদিনের দর্শক। এইভাবে অজিতেশের অন্ধ-ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম। একদিন আমি আর আমার বন্ধু অর্ণব নিউ এম্পায়ারে ‘ওয়েট আনটিল ডার্ক’ দেখতে গেছি। হাউসফুল। হটাৎ দেখি অজিতেশ দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ঠিক করলাম একটা টিকিট ওঁকে দিয়ে ইন্টারভেল অবধি আমি, পরের হাফে অর্ণব অজিতেশের পাশে বসব। সিনেমা মাথায় উঠেছে, শুধু অজিতেশের পাশে বসব। আমি গিয়ে ওঁকে একটা টিকিট অফার করলাম। কিন্তু উনি দুটো টিকিট চাইলেন। বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে এলাম। পরে কেয়াদির সূত্রে যখন ওঁর কাছে যেতে পেরেছিলাম, আমার সেই হতাশার কথা শুনে ওঁর উচ্চকিত হাসি। আর আমার মুখে বোকার হাসি। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শুরু করেছি তখন আমার আমার থেকে প্রায় তিন বছরের ছোট, স্কটিশ চার্চ কলেজের ইংলিশ অনার্সের জনা পাঁচেক ছাত্র-ছাত্রীর সাথে ভাব হয়েছিল। আসলে এদের একজন আমার স্কুলে আমার জুনিয়র ছিল। অভীক, সুরঞ্জন, চন্দন, ঝর্ণা ,দেবপ্রসাদ- এদের মাধ্যমেই আমার কেয়াদির সঙ্গে আলাপ। ওদের সঙ্গে গিয়ে কেয়াদির ক্লাসও করেছি দু-একদিন। তবে মূলত রঙ্গনায় নান্দীকারের অভিনয়ের আগে গিয়ে কেয়াদির সঙ্গে কথা বলেছি বেশি। আমরা চারটে বা সাড়ে চারটের মধ্যে গিয়ে হাজির হতাম। অনেকদিন নাটক দেখেছি , তবে রোজ নয়। কেয়াদির সঙ্গে কথা হত রোজ । অনেক সময়ে গ্রীন রুমে নাটক শুরুর আগে ,মেক-আপ করতে করতে কেয়াদি আমাদের আর্মস অ্যান্ড দ্য ম্যান, বা শেক্সপীয়ারের নাটক ও সেই সময়ের সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে কথা বলতেন, dramaturg এই শব্দটা আমি প্রথম কেয়াদির মুখেই শুনি। অনেকটা কেয়াদির দ্বারা প্রভাবিত হয়েই আমি উৎপল দত্তের শেক্সপীয়ারের সমাজচেতনা বইটা কিনে ফেলি। কেয়াদির মাধ্যমে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, রুদ্রবাবু, অসিতবাবু, মঞ্জুদি, রাধারমনদার সঙ্গে আলাপ , ওখানেই শুনেছিলাম অজিতেশবাবু নাকি প্রথম জীবনে বহুরূপীর অ্যাডমিশন অডিশনে ভালো ফল করতে পারেননি, গলার কণ্ঠের জন্য। একদিন স্কটিশ কলেজে বিএড বিল্ডিং-এ খোলা চত্বরে কেয়াদির অনুরোধে আমি কাজী নজরুলের সব্যসাচীর কবিতাটি আবৃতি করি। কেয়াদি আমাকে বলেন যে, তোর আবেগ বড় বেশি, আবেগ থাকবে, কিন্তু তাকে যুক্তি দিয়ে স্পষ্ট উচ্চারণে প্রকাশ করতে হবে। আমার সেই বয়সে কেয়াদি আমার কাছে এক দেবীর মতো প্রতিভাত হয়েছিলেন, ওঁর ক্যারিশমা আমাদের নাট্যকর্মে যুক্ত হওয়ায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। কলেজের চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি থিয়েটারের হেলেটাইমার হওয়া সেই সময়ে এক ব্যাতিক্রমী ব্যাপার। তবে ওঁকে মাঝে-মাঝে খুব একলা, উদাস লাগত। ভাবতাম এটা কি ওঁর কাছে জানা সেই melancholy সেই বয়সে এর বেশি কিছু বুঝতাম না। তারপর হটাৎ একদিন দিদি লঞ্চ থেকে পড়ে অনেক দূরে চলে গেলেন, কোন অভিমানে, কার উপর অভিমানে তা এখনও বুঝি না। কেয়াদির কথা ভাবলে এখনও বুকের মাঝে গোপনে বেজে উঠে তাঁর গলার স্বর, চোখ বুজলে দেখতে পাই মঞ্চে তাঁর দৃপ্ত পদচারণা। পরে শোভা সেন, মায়া ঘোষদের সঙ্গ করেছি , স্নেহ পেয়েছি, নন্দিতাদিকে নিজের দিদি বলেই মানি , কিন্তু কেয়াদির সঙ্গে কারোর তুলনা হয়না । মানুষ কি ভুলতে পারে তার প্রথম প্রেরণা, ভালোবাসাকে ?