ভাণ পত্রিকা
আটত্রিশতম সংখ্যা || ঊনত্রিশতম ই-সংস্করণ || জুন ২০২৩
সম্পাদক :
সম্পাদনা সহযোগী :
প্রচ্ছদ :
নক্সা পরিকল্পক :
অন্যান্য কাজে :
ভাণ-এর পক্ষে:
পার্থ হালদার
কর্তৃক
৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬
( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )
৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) bhaan.kolkata@gmail.com ( ই – মেল )
Reg. No : S/2L/28241
যাপিত নাট্যের দ্বাদশ কিস্তি লিখলেন – কুন্তল মুখোপাধ্যায়
আব্বাস কিরোয়াস্তামির ‘টেস্ট অফ চেরি’ সিনেমা নিয়ে ভাবের অন্তরালে ডুব দিলেন – কিংকু
‘থিয়েটার পুষ্পক’-এর নাট্যোৎসব নিয়ে ভাণ এর প্রতিবেদন – প্রতিবেদক সায়ন ভট্টাচার্য এবং অয়ন্তিকা নাথ
ওয়েব সিরিজ বিমা কেলেঙ্কারি নিয়ে কলম ধরলেন – বৃতা মৈত্র
সূচি
সম্পাদকের কথা
ছুটছ কেন ভাই? কখন থামবে? তুমি ঘুমাও না? তোমার ক্লান্তি নেই? কাফকা জানতেন বোকাদের ক্লান্তি নেই। তবে আমরা কি সব বোকা হয়ে গেছি? ছোটার জন্যে কেন এত ছটফটানি আমরা জানি না। কেবল জানি, ছোটাই আমাদের নিয়তি। ছোটাছুটির মধ্যে মোটামুটি একটা মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা আমাদের পরম।
যদি ছুটতেও হয়, তবে সর্বক্ষণ কেন? একটু কি জিরোতে নেই? এক আঁজলা পানি খেতে নেই? গাছের পানে চাইতে নেই? নদীর কাছে বসতে নেই? সমুদ্রের সঙ্গে কথা কইতে নেই? আকাশ নীলে উড়তে নেই? এসবের সময় কোথায়? অথচ পাতা ঝরার শব্দ শোনার কথা ছিল আমাদের। জোৎস্নার আলোর ঝর্ণা ধারায় স্নাত হবার ইচ্ছে ছিল গভীরে। পাঁজরের দাড়ের শব্দ শুনতে পাওয়া অসম্ভব ছিল না। কে যে দৌড় করিয়ে যাচ্ছে আমাদের, তাকে যে খুঁজব, কোথায় কীভাবে!— সে ফন্দি আঁটতে গেলেও তো দু’দণ্ড ভাবতে হয়! এমনতর ইঁদুর দৌড়ে কী আর ভাবা যায়? যায় না। ভাবা যায় না বলেই চিন্তা হয়।
আমাদের চারপাশের মানুষ-জনদের দৌড় দেখে, অষ্টপ্রহর ব্যস্ত-সমস্ত দেখে, আমি এর নাম দিয়েছি তাড়া-সংস্কৃতি। কথাটার অর্থ সাদামাটা হলেও এর বিস্তার সামান্য নয়। যে তাড়ায় আছে, তার তো তাড়া আছেই। যার নেই সেও মনে করছে যে তার ও ভীষণ তাড়া আছে! কখনো সখনো জেনে বুঝে আধুনিক মানব সভ্যতায় কলকে পেতে সে দেখাচ্ছে, তার ভীষণ তাড়া। যেন তাড়া ছাড়া তাড়াতাড়ি আর কিচ্ছুটি হারাবার নেই আমাদের! যাওয়ার তাড়া, খাওয়ার তাড়া, দেখার তাড়া, গেলার তাড়া, ধরার তাড়া, ছাড়ার তাড়া, পাওয়ার তাড়া, ভোলার তাড়া, দোষের তাড়া, ক্ষমার তাড়া, ফেরার তাড়া, বড়লোক-বিখ্যাতলোক হওয়ার তাড়া— তাড়ার ফিরিস্তি তাড়াতাড়ি ফুরনোর নয়। মোদ্দা হল, সভ্যতার মর্মমূলে কান পাতলে সর্বদা এক অহৈতুকী অবিরাম তাড়ার তাড়না। এত তাড়া, অথচ তার কারণ খোঁজার তাড়া নেই। তাকে ছলে বলে কৌশলে বরণ করার তাড়াই মুখ্য।
বিজি। ভয়ঙ্কর ভয়াবহ ভাবে বিজি সবাই। দেশ দুনিয়া হিজিবিজি হয়ে আছে কিন্তু সেদিকে তাকানোর ফুরসত কোথায়! ছুটি নেই কেবল ছোটা। ‘ছোটা’র ‘বড়া’ হয়ে ওঠার জন্য ছোটা। ছুটি কাটাতেও ছুটতে-ছুটতে যাওয়া। স্পট দেখার তাড়া। স্পটলাইট এ আসার তাড়া। পটাপট ফিরে এসে দৌড়ের লাইনে দাঁড়ানোর তাড়া। মনখারাপের তাড়া। মন ভালো করার তাড়া। মোদ্দা কথা ফুরসত নেই। ছুটি নেই। মেঘের কোলে রোদের হাসি দেখার সময় নেই। একথা বলে ন্যাশনাল, ইন্টার ন্যাশনাল, অতি ন্যাশনাল জবে জবজবানো বন্ধুরা, বড় দুঃখ করে কখনও সখনও। শুধু তারা কেন, ইস্তিরিওয়ালা-সুইগীওলা-প্লাম্বার-ইলেকট্রিশিয়ান-পার্টির দালালেরা রাস্তা দিয়ে হেকে যায়— ‘বৌদি সময় নেই, কাল দেখছি’। কতকাল গত হয় তবু এমন তাড়া, সময় মেলে না। এমন তাড়া-কালচারে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠছি।
তাড়া নিয়ে সাততাড়াতাড়ি লেখার ইচ্ছে ছিল না। লিখতে হলো যখন দেখলাম ধীর-স্থির হবার আগ্রহ ছেড়ে ‘তাড়া’ কেই যখন মানুষ ভূষণ করল। ‘আমার ছুটি নেই’ একথা বলার মধ্যে অবসরের সুন্দর আকুতির বদলে প্রকাশ পেল ‘ব্যস্ততার গৌরব!’। জিউস যেমন অগ্নি বঞ্চিত করে রেখেছিলেন সভ্যতাকে, আজকের এই ব্যবস্থা মানুষের ‘অবসর’ বঞ্চিত করে রেখেছে। মানুষের হয়ে সেদিন প্রমিথিউস লড়াই করেছিলেন। কে হবে আজকের প্রমিথিউস যে কর্মভারের কৃত্রিমতার খুপরি থেকে মানবাত্মার মুক্তি দেবে?— সে মুক্তির সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। কেননা মুক্তির চোর, তাকেই আমরা প্রভু মেনেছি। চুরির মূল্যবান সম্পদের চেয়ে চোরেরই ফেলে যাওয়া উচ্ছিষ্ট(ব্যস্ততা)-কেই আমরা পরম জেনেছি!
এটা হল কেন? কেন মুক্তির চেয়ে বদ্ধ, দখিনা বাতাসের চেয়ে ঘুপচির হাঁসফাঁস মানুষের প্রিয় হল? কেন ছুটির চেয়ে প্রিয় হল রাতদিন ছুটোছুটি! পাঠক ভাবছেন এ তো মানুষের স্বেচ্ছা নির্বাচন নয়। এ তো ব্যবস্থার বাধ্যতা। ঠিকই। এই নির্বাচন না করলে মানুষকে নির্বাসিত হতে হবে। কিন্তু মেনে নিতে গেলে মনেও নিতে হবে নাকি? নারকী বাস্তবতা মেনে নিতে-নিতে নরককেই একমাত্র ভাবতে হবে কেন? দুঃসময়ে কেন স্বপ্ন তিরোহিত হবে? কেন থাকবে না স্বর্গীয় অবসরের জন্য আকাঙ্খা? কেন চাইব না একঘেয়েমি ব্যবস্থাকে ভেতর থেকে সুযোগমতো নাড়িয়ে দেবার আহ্লাদ!
অবসর না পেলে মানুষ নিজেকে হারাতে ভুলে যাবে। নিজেকে পেতে শিখবে না। পাশের মনের ভেতরকে চেনা হবে না। এতো যে জ্ঞান বিজ্ঞান সাহিত্য দর্শন সমাজতত্ত্ব, এতো যে সঙ্গীত নৃত্য থিয়েটার সিনেমা, এতো যে গাছ পালা পাহাড় নদী সমুদ্র আকাশ, এতো যে খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান,এতো যে ভাষা রঙ তল অতল— কীভাবে মানুষ তার স্বাদ নেবে, গন্ধ পাবে, ছন্দে বাঁধবে? এতো যে অন্যায় অসাম্য অবিচার, এতো যে মানবতার হাহাকার, এসবের কাছে পৌঁছাতেও দরকার ছুটি, অবসর, নীরবতা, নির্জনতা। নিজেকে ফিরে পাবার মহামূল্যবান সম্পদ চুরি করেছে এই ব্যবস্থা। বদলে দিয়েছে ব্যক্তিগত অতিব্যস্ততার মেকি অহংকার। যেখানে মানুষ অন্যের থেকে আলাদা এবং একা। যেখানে একা মানুষ তার স্বপ্ন থেকে বিচ্ছিন্ন। সত্ত্বা থেকেও চ্যুত!
আধুনিক বিশহাজারী শ্রমিকের কর্মস্থলে এয়ার কন্ডিশনার। বাড়ির ভাঙা নোংরা বাথরুম ছাড়িয়ে অফিসের ধোপদুরস্ত ওয়াসরুমের দিকে তার দৈনিক অভিযাত্রা। কূটভাষী ঘরোয়া স্ত্রীর ঘ্যানঘ্যানে উপস্থিতির বিপরীতে স্বপ্ন-পরীদের কলিগ রূপে রোমাঞ্চকর উপস্থিতি। শ্রমিককে জোর করে নয় বশ করে রাখে। আট ঘণ্টা শ্রমের দাবির প্রেতাত্মা শিকাগোয় সামান্য অস্বস্তিতে পাশ ফিরে শোয়। তবু অতিপ্রাকৃত এক সুখের খোয়াব-কে প্রাপ্তি মনে হয় পোড়া বাস্তবতার বিপরীতে। লক্ষ দম্পতি হাফ-টাইমে নিজের পার্টনারের সমালোচনা শোনান প্রিয় কলিগকে। সেই সব সুখ ও স্বাধীনতা উপভোগ করাতে বেলা গড়ায়। ছুটির আনন্দের চেয়ে উপভোগ্য হয় রসালো আলাপ। মস্তির আবেগ মস্তিষ্ককে আছন্ন করে রাখে। জীবনের অনুপম আনন্দ থাকে অধরা।
কীভাবে ব্যস্ততায় রাখি আমরা নিজেদের? কোন ব্যস্ততায় ফেসবুক টুইটার ইন্সটাতে নিত্য ভ্রমণের ব্যস্ততা? কী পোশাক পরছি, কী পরবো আগামীতে তৎজনিত ব্যস্ততা! রিল দেখার ব্যস্ততা। রেস্টুরেন্টে ছবি হবার ব্যস্ততা। টিভিতে চিৎকার গেলার ব্যস্ততা। ফোনের অবান্তর কথায় অন্যের কাছে নিজেকে রঙিন করে তোলার ব্যস্ততা। ব্যস্ততার অভ্যাসে ছুটির বোধ লুপ্ত হয়ে গেছে। একমুহূর্ত ফাঁকা থাকতে ভয় হয়। নিজেকে দেখতে ভয় হয়। ফোনটা খুলে দেখতে থাকি, ফর্সা হবার সহজ উপায়, ষাট বছরে কার গর্ভে ভ্রুন এলো, শাশুড়িকে বশে রাখার সহজ টিপস। ঘরোয়া পদ্ধতিতে ট্যান সারানোর উপায়। কিংবা মেষ রাশির কোন ক্ষণ থেকে সিংহ সম পরাক্রমশালী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা!!
বিশ্বজুড়ে বহুদেশে হপ্তায় তিন দিন ছুটির কথা চলছে। কতিপয় দেশে ঘটেছেও ব্যাপার খানা। চারদিন কাজের। তিনদিন নিজের। নিজেদের। চিন্তার, বিশ্রামের, ভাবার, বোঝার, দেখার, শোনার, জানার। প্রিয় মানুষের কাছে পৌঁছানোর। প্রিয় প্যাশনের সঙ্গে থাকার অবসর। আহা!!
এ পোড়া নারকী বাস্তবতায় এমনতর দিন যদি বা আসে, চিন্তা হয়; আমরা কি সে কাঙ্ক্ষিত অবসরকে উপভোগ করতে পারবো? কেননা আমরা যে অক্লান্ত পোকার মতো কেবল মৃত্যুমুখী হেঁটে চলি। আমরা যে জীবনের দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছি। সারমেয়ের পাকস্থলীতে কি ঘি সহ্য হবে?(!)
যাপিত নাট্যের দ্বাদশ কিস্তি লিখলেন - কুন্তল মুখোপাধ্যায়
কুন্তল মুখোপাধ্যায়
আজ শ্রদ্ধেয় কিছু গুণী নাট্যব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য ও সঙ্গলাভের কথা বলি। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ১৯৯৫ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত অতিথি অধ্যাপক হিসেবে পড়িয়েছি। তখন নাট্য বিভাগের ক্লাস হতো রবীন্দ্রভারতীর জোড়াসাঁকো ক্যাম্পাসের তিনতলায়। সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাম দিকে বড় ঘরটা ছিল নাট্য বিভাগের অধ্যাপকদের স্টাফ রুম।
চিত্র :রবীন্দ্রভারতীর জোড়াসাঁকো ক্যাম্পাস
প্রথম দিন পড়ানো শুরু হল সেই সময়ের এম.এ ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠ দিয়ে। অশোক মুখোপাধ্যায় আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে ক্লাসে ইন্ট্রোডিউস করিয়ে বেরিয়ে এলেন। আমি ১৯৭৭ সাল থেকে কলেজে পড়াচ্ছি। সুতরাং ততদিনে পড়ানোর ক্ষেত্রে বেশ ভেটারেন হয়ে গেছি। অশোকদা বলেছিলেন পাশ্চাত্য থিয়েটার পড়াতে , ১৯৩০ থেকে আধুনিক কাল অবধি, তার মানে ব্রেখট, বোয়াল, পিটার ব্রুক, আয়নেস্কো প্রভৃতি। কিন্তু প্রথম ক্লাসে আমি ওদের কাউকে নিয়েই কথা বলিনি, বরং শুরু করেছিলাম ১৯৩০ এর গোটা ইউরোপ তথা বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে। আর তার সঙ্গে গল্পচ্ছলে জানিয়েছিলাম রিচ্যুয়াল থিয়েটারের উদ্ভব, সেইসঙ্গে কেমব্রিজ স্কুল অফ অ্যান্থ্রোপলজি, পারফরম্যান্স থিয়োরি, আলতামিরা, প্রাসাদের পাঁচমারি পাহাড়ের গুহাচিত্রের নাটকীয়তার কাহিনি।
অশোক মুখোপাধ্যায়
যেভাবেই হোক প্রথমদিন থেকেই ছাত্র-ছাত্রীরা আমাকে আপন করে নিয়েছিল। সেদিনের ক্লাসের পরে বিকেলে ওদের আবদারেই বিবেকানন্দ রোডে ভীমনাগের দোকানের পাশে বিখ্যাত দে’ সুইটসের সিঙ্গাড়া আর চা দিয়ে ওরা আমার নবীন বরণ সাঙ্গ করলো। অমিতাভ, দেবু, শুভাশিস, সন্দীপ, গৌতম, সুপর্ণা, শুভশ্রী, বাপী এবং ওদের সঙ্গে গুটি গুটি পায়ে তখন প্রাক্তন ছাত্র আর এক শুভাশীষও হাজির। আমি ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই অমিতাভ, গৌতম বলে উঠল ‘স্যার, ও সুপার্ণাকে পাহারা দিতে এসেছে’। বুঝলাম ব্যাপারটা। ওকেও ডেকে নিলাম আমাদের চায়ের আড্ডায়। আমি নাট্য বিভাগে যেতাম সপ্তাহে দু’দিন। বুধবার (আমার কলেজের ডে-অফ ) আর শুক্রবার দিনের দ্বিতীয় অর্দ্ধে। আমাকে যেসব শিক্ষকদের সঙ্গে পড়ানোয় জুড়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁদের মধ্যে ছিলেন বিভাস চক্রবর্তী, অশোক মুখোপাধ্যায়, মনোজ মিত্র।
বিভাস চক্রবর্তী
এদের মধ্যে মনোজ মিত্র আমার পি.এইচ.ডি-র শশিক্ষক (আমিই মনোজ মিত্রের প্রথম পি.এইচ.ডি ছাত্র), আর বিভাসদা, অশোকদার কাছে কিশোর বয়স থেকেই নাট্য শিক্ষা পেয়েছি। অশোকদার সঙ্গে পাশ্চাত্য থিয়েটার, মনোজদার সাথে নন্দনতত্ত্ব আর বিভাসদার সাথে ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির বিষয়গুলি ভাগ করে পড়াতে শুরু করলাম। এছাড়াও আন্ডার গ্র্যাজুয়েটের মাস কমিউনিকেশনের তাত্ত্বিক দিকটিও আমাকে পড়াতে বলা হল। দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডানদিক বরাবর সোজা কোণের ঘরটিতে (সেটা পেরোলেই বিশাল ছাদ) মনোজবাবু, অশোকদা বসতেন। আর ওই ঘরেই বসতো বাংলা নাট্যজগতের চাঁদের হাট।
মনোজ মিত্র
মনোজবাবুকে মধ্যমণি করে অশোকদা, বিভাস, কণিষ্ক সেন, যোগেশ দত্ত, তড়িৎ চৌধুরী, অবরেসবরে প্রায়ই তাপস সেন, খালেদ চৌধুরী, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, বিষ্ণু বসু, দু-তিনবার কুমার রায় (ততদিনে তিনি অবসর নিয়েছেন), রমাপ্রসাদ বণিক, সৌমিত্র বসু, বিভাগে যোগ দিলেন দ্বিজেনদা, সত্যি সে এক নাট্যব্যক্তিত্বদের মেলা। মুড়ি, সিঙ্গাড়া, ডিমের ডেভিল, চা এবং দরবেশ, সন্দেশ সহযোগে বিশাল আড্ডা বা অ্যারিস্টটলের ভাষায় জিমন্যাসিয়াম, যেখানে নাট্যচর্চার অবারিত দ্বার। তড়িৎদার মুখে ওখানেই জেনেছিলাম আর্ট কলেজের কৃতি ছাত্র জোছন দস্তিদার আর ধনীকন্যা চন্দ্রার প্রেম কাহিনি। সেই বছরই সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার পেলেন নৈঃশব্দের কবি যোগেশ দত্ত। যোগেশ দত্তের কাছে শুনেছি ১৯৬৪ সালে বুলগেরিয়ার সোফিয়ায় বিশ্বযুবছাত্র উৎসবে তাঁর যোগদানের কাহিনি। আর কীভাবে কত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ১৯৮৩ সালে তাঁর উপর নির্মিত হয় তথ্যচিত্র ‘সাইলেন্ট আর্ট অফ যোগেশ দত্ত’, ফিল্ম ডিভিশন অফ ইন্ডিয়ার উদ্যোগে। আলোর জাদুকর তাপস সেনের কাছে শুনেছিলাম লাইট কন্ট্রোলের নিয়ম হচ্ছে সাধারণত দর্শকের পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে কন্ট্রোল করা। পাশে বসে বা উঁচু মগডালে বসে কন্ট্রোল করা ঠিক নয়। পার্শি থিয়েটার প্রথম মঞ্চে সুষ্ঠু আলোর প্রবর্তক। তারপরেই উনি সতু সেনের অবদানের কথা বলতেন। FOH লাইটের প্রবর্তন করেন তাপস সেন। তাপস সেনের ‘colour in art’ নামে একটা লেখা আছে। সেটাতে তিনি রং, পেন্সিল, নাটক এবং তাদের অন্তঃসম্পর্ক নিয়ে লিখেছিলেন। তাপস সেন আলোর গিমিকের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। তাপস সেনের মত ছিল আলোর মধ্যে অন্ধকার, ছায়াকে ধরাটাই আলো প্রেক্ষপনের মূল কাজ। নাটক লেখার কাজে কালজয়ী নাটক বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে মনোজ মিত্র বলতেন, কালকে জয় করা তো দূরের কথা, অতীত বা ভবিষ্যৎ কোনো কালকেই আমরা ধরতে পারবো না, যদি না সমকালকে বুঝতে পারি, ধরতে পারি। সমকালকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে, নাট্যকার তাঁর অনুভবের সমস্ত দরজা, জানালা খুলে রাখবেন, মনটা হবে নিষ্কলুষ— সাদা কাগজের মতো, দেশ-কাল আবারিতভাবে তার উপরে লিখুক— এমন ভাগ্যসাপেক্ষ গা ছাড়া আলসতাতেও কোনো লেখা সম্ভব নয়, নাটক তো নয়ই। লেখকের, নাট্যকারের স্বীয় তাড়না, দায়বদ্ধতাও থাকা দরকার। মনোজ মিত্র বলতেন, আমার কাছে থিয়েটার করা মানে নাটক ভাবা, নাটক লেখা, রিহার্সাল দেওয়া, স্টেজে অভিনয় করা এবং অবশেষে দর্শকের মতামত সংগ্রহ করা পর্যন্ত। মনোজ বাবুর একটা মজার গল্প বলে শেষ করি। ২০০৩-এ UGC লাইব্রেরি গ্রান্ট থেকে ৭৫,০০০টাকা এসেছে সেমিনার লাইব্রেরির বই কেনার জন্য, তা মনোজ বাবু আমাকে দায়িত্ব দিলেন বই পছন্দ করার। ওই টাকায় যেমনটি হয়, সেরকম গোটা ৫০ বই কেনা হলো। তারপর ডিপার্টমেন্টের এক শিক্ষা কর্মীকে, যে আবার আমাদের প্রাক্তন ছাত্র, তাকে একটা ছোট বাঁধানো খাতা দিয়ে বইগুলোর তালিকা তৈরি করা ও একসেশন নাম্বার বসানোর দায়িত্ব দেওয়া হল। এরপরে কেটে গেছে মাস খানেক, আমি একদিন মনোজ বাবুকে জিজ্ঞাসা করলাম, স্যার বইগুলোর একসেশন নং হয়েছে, মনোজ বাবু ডাক দিলেন ওই শিক্ষাকর্মীকে, সে এসে জানালো— হচ্ছে স্যার, তারপর দেখালো একপাতায় ৭টি বই এর নাম নথিবদ্ধ হয়েছে। আমি অবাক এক মাসে ৭টি বই। তখন মনোজ বাবু বললেন, ‘তোমায় খেতে দিলাম একটা ছোট চাঁপা কলা, সেটা খেতে একমাস লাগিয়ে দিলে’। সেই সময় থেকে পাওয়া অমূল্য রত্নখনির সম্ভার থেকে কিছু কথা আজ পাঠকদের জানালাম। পরবর্তীতে আরও বলা যাবে।
ডিজিটাল রেকর্ডিং নিয়ে ব্যক্তিনিষ্ঠ প্রবন্ধ লিখলেন - অরিক্তম চ্যাটার্জি
অরিক্তম চ্যাটার্জি
চাঁপাডালির চাপা কষ্ট ও ডিজিটাল রেকর্ডিং
অর্ঘ শুকিয়ে গেছে। অন্ততঃ মুখ দেখে সেরকমই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে অডিশনের আলোকবৃত্তের ঠিক মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে ই-মেজর স্কেলের পিঠে বেসে এফ-এর কিল মেরে দিয়েছে। নেহাৎ প্রাক-মেট্রোসেক্সুয়াল যুগের বাইশ বছরের জিন্দা জোয়ান; বালি ফেলা কাদা মাঠে খালি পায়ে চোঁচ ফোটা যন্ত্রণা নিয়ে খেলা চালানোর পাস্ট হিস্টরি (অপূর্ব শব্দবন্ধ!) আছে, না হলে নির্ঘাত কেঁদে ফেলতো। আর আমরা যারা তার সঙ্গে এই অ্যাডভেঞ্চারে সামিল হয়েছিলাম, আমাদের মনে হচ্ছে কেউ যেন দশতলা থেকে অতর্কিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পিঠের ওপর ধমাস ধমাস হেডব্যাং করছে। আমাদের টাটা সুমোর ড্রাইভার তারক ডিকি থেকে ড্রাম আর গীটার নামাবার মধ্যপথে মৃণাল সেনের মন্তাজের মতো অনিবার্য ফ্রিজ ফ্রেমে আটকে গেছে। নামাবে না আবার তুলে রাখবে বুঝতে না পেরে আগ্রহী আমোদগেঁড়ে পথচলতি মানবমানসে অভূতপূর্ব সাসপেন্স সৃষ্টি করছে। আর গাড়ীর বনেটের সামনে যে বাড়ির একতলাটি আমাদের এতক্ষণের কাঙ্খিত গন্তব্য বলে বিবেচিত হচ্ছিলো, তার ফেলা শাটার তালা আঁটা। কিন্তু সেটা ব্যাপার নয়। এই আশ্চর্য ট্র্যাজিকমিক দৃশ্যপটের কেন্দ্রে বিরাজিত সেই শাটারের ওপরে সাঁটা সাইনবোর্ডটি, যাতে লেখা আছে ‘দেগঙ্গা স্টুডিয়ো; প্রোঃ গঙ্গা দে’, ও নিচে ছোট হরফে ‘এখানে বিবাহ, উপনয়ন, নিয়মভঙ্গ, অন্নপ্রাশন, প্রিয়জনের জন্মদিন ও শ্রাদ্ধের ছবি সহ পাঁচ মিনিটে পাসপোর্ট ও স্ট্যাম্প সাইজ ছবি শ্রদ্ধা সহকারে তোলা ও প্রিন্ট করে দেওয়া হয়’। প্রিয়জনের শ্রাদ্ধের পাস্পোর্ট ছবি ও তার প্রীতি উৎপাদনের সম্ভাব্য সম্ভাবনার ও প্রয়োজনীয়তার প্রয়োজনের ও তার সাথে ব্যাকরণ কৌমুদির বিভক্তি অধ্যায়ের নিরুপ্য-নিরুপিত সম্বন্ধ আদি অমোঘ দার্শনিক ডেলিবারেশনের মতো নির্মোহ চিত্ত তখন ছিলো না আমাদের, কারণ ততক্ষণে চার জোড়া খুন কি প্যাসি চোখের দিকে তাকিয়ে অর্ঘ যথাসম্ভব নিচু গলায় আমাদের কাছে কৈফেয়ত দাখিলের সুরে বলছিলো ‘আমাকে কিন্তু গানের স্টুডিও’ই বলেছিল!’ সময় বেলা সাড়ে ন’টা। বারাসাত। চাঁপাডালি মোড়। সাল দু’হাজার এক। বা দুই।
আমরা মফস্বলের ছেলে। সন্ধেবেলায় বন্ধ হওয়া সরকারি বাসের অদরকারি স্ট্যান্ডের ধাতব কাঠামোয় বসে আড্ডা দিতাম আর কাকা জ্যাঠাদের দেখলে বিড়ি ট্যাপ করতাম। যাকে বলে নিবিড় আড্ডা। আমরা মার্ক্সীয় সাহিত্যের স্টলে বাঁশ বেঁধে দিতাম, আর সন্ধ্যারতির আলোয় রাধাগোবিন্দ জীউএর মায়াময় চোখে পঞ্চপ্রদীপের শিখার প্রতিফলন উদ্ভাসিত হয়ে উঠলে তার দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরে গুমড়ে ওঠা কবেকার কান্নাটাকে বুকে চেপে রাখতে নিজেরা নিজেরাই শিখে নিতাম। এহেন উত্তরের গলিগালায় গেঁজিয়ে ওঠা আমাদের তিন বন্ধুর কাছে তিনটে সত্যিকারের গীটার ছিলো। তাই আমরাও নিরূপায় হয়ে একটা ব্যান্ড খুলেছিলাম। সাকুল্যে থাকা তিনটি গীটারের মধ্যে আমারটা ছিলো গিভসনের জাম্বো, যার একটা ছোট ইন-বিল্ট পিকাপ ছিলো। অর্থাৎ তার বঙ্কিম তলপেটে একটা ছোট ফুটো ছিলো। রূপোর বিছের মতো সোহাগী গরবে সেটা আগলে রাখতো গীটারভামিনী। সেটার সাথে জ্যাকের মাধ্যমে কোনো বক্স বা অ্যামপ্লিফায়ারের প্রশ্রয়ী পরশ পেলেই বেটির গলা খোলতাই হতো। অন্ততঃ সেরকম একটা চাপা গুমোর তার ছিলো। যদিও কখনো শুনিনি, কারণ সে কুমারী ছিলো দীর্ঘদিন। আমাদের ওই, সাকুল্যে গীটার ছিলো তিনটি। আর কিছু নয়। কাহানি মে ট্যুইস্ট এলো যখন দেখা গেলো অর্ঘর একটি স্পিকার যুক্ত সিডি প্লেয়ার ও টেকনিক্যাল মগজ আছে। সে নীবিড় গরজে তার সিডি স্পিকারে আমার গীটারটা লাগিয়ে দিতেই জোড় পেলো গরবিনী। ঠিক পালটি ঘর নয়, তবে হিল্লে তো হল একটা যাহোক কিছু। নাহলে মুখরতা বিহনে তার জীবনটাই কালি কালি হয়ে যাচ্ছিলো এদ্দিন।
অর্ঘ নিজে বেস বাজাতো। যদিও এ বেসের কেসটা একটু অন্যরকম। সে তার নিতান্ত লোকাল গীটারের চার, পাঁচ আর ছয় নম্বর তারে নানা রকমের ‘লাইন’ বাজাতো। এক জন কর্ড বাজাতো, মূলতঃ এ, সি, ডি, জি মেজর, মাইনর ও তার নানা রকম এদিক-ওদিক। আর আমারটা যেহেতু সিডি বক্সে লাগানোর হিড়িকে একটু জোরে বাজতো, তাই আমি সেই সুর মিলিয়ে কিছু সুর তুলতাম। ড্রামার ছিলো না। পরে এসেছিলো। সে এক ইতিহাস। মফস্বলের ব্যান্ডে ড্রামারের সাপ্লাই-ডিম্যান্ডের জটিল রাজনীতি এক স্বতন্ত্র গবেষণার দাবি রাখে। সে গল্প অন্যত্র। তো যাই হোক, আমরা কিছু দিনের জন্য অন্য ব্যান্ডের এক ড্রামারকে ভাঙ্গিয়ে আনতে পেরেছিলাম।
এবার যেটা বলার, সেটা হলো যে কিছু দিনের মহড়াতেই আমরাদের মনে এই বিশ্বাস দৃঢ় হতে লাগলো যে আমাদের তৈরি করা গানগুলো এত’ই নতুন ও ছকভাঙ্গা যে সবার শোনা উচিত। আমাদের রকস্টার নক্ষত্রে তুঙ্গাভিলাষী বৃহস্পতি যাস্ট আগের ক্ষেত্রে ওয়ার্ম আপ করছে। একটু কর্ম দিলেই ভাগ্য খুলে যাবে। অতএব, রেকর্ড করা দরকার। যাকে বলে ডেমো রেকর্ড করা দরকার। দু’টো গান। সেটা আমাদের বেসিস্ট, যে বাগ্মি হওয়ার সুবাদে আমাদের মারকেটিস্ট-ম্যানাজার’ও ছিলো, পৌঁছে দেবে বড় কোনো মিউজিক লেবেলের অফিসে। যেমন এইচ এম ভি বা আশা অডিও। এখন চাই স্টুডিয়ো।
অর্ঘ জানালো যে বারাসাতে একটি স্টুডিয়োর খোঁজ পাওয়া গেছে। সেখানে সস্তায় রেকর্ড করা যায়। সস্তা বলতে সারা দিনে দু’হাজার টাকায়। সারা দিন বলতে আট ঘণ্টার শিফট, মাঝে এক ঘণ্টার টিফিন। চারজন পাঁচশো করে দিলেই উঠে যায়, তবে ড্রামারের দেবার ইচ্ছে নেই। সে তো আমাদের চায়নি জীবনে, মোরা অভাগারে চেয়েছি। ফলে তার রাজার আদর। তার টাকাটাও আমাদের দিতে হল। আর এক বন্ধুর সুমো গাড়িও ভাড়া করা হল। অনেক হুজ্জুত আছে, তাই সে পাঁচশো নেবে। অর্ঘ মা’র থেকে নিলো, আমি পোস্ট অফিসের এম আই এস এর ইন্টারেস্ট তুললাম, আর অন্যজন লজ্জার মাথা খেয়ে টিউশনির গার্জেনের থেকে এক মাসের অ্যাডভান্স চেয়ে নিলো হাত পেতে। শেষে সেই গ্রীষ্মের সকালবেলায় নির্দিষ্ট দিনে চালালাম পানশি বারাসাত। ব্যাক সিটে উঠলো তিনটে গীটার, ডিকিতে ড্রাম কিট, আর মাঝে আমরা তিনজন। সামনের সিটে কর্ণধার অর্ঘ। সুমো গাড়ির জানলা খুলে দিলাম। সিগারেট ধরালাম। নিজেদের এতদিনে লেজিট ব্যান্ড মনে হল। দ্য ফিউচার ইস রিটেন ইন দ্য স্টার্স। পরের ঘটনা আগেই বলা হয়েছে।
তো অর্ঘর ইনফরমেশন খানিক অসম্পূর্ণ হলেও পুরোপুরি মিথ্যে ছিলো না। দেগঙ্গা স্টুডিওয় শুধু ছবি তোলা নয়, গানের রেকর্ডিংও হতো। আমরা ওখানে ডেমো রেকর্ড করেছিলাম। দু’টো সিডিতে সেগুলো নিয়েও এসেছিলাম রাকেশ দে, (যার মা ঈশ্বর গঙ্গা দে পরে জেনেছিলাম) ছবিও তুলতেন, গানও তুলতেন। মনে আছে মাঝে মাঝে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে ছবি তুলে আবার ফিরে এসে গান রেকর্ড করছিলেন। সেই প্রথম কন্সোল দেখলাম। একটা ডেস্কটপ, তার সামনে একটা কাচের পার্টিশন, তার পেছনে দাঁড়িয়ে সবাইকে গাইতে বাজাতে হতো একে একে। এটা আমরা আবার কোনোদিন করিনি। তাই যথেষ্ট ল্যাজে গোবরে হয়েছিলাম। সেটা ছিলো আমাদের মতো স্বপ্নে বিভোর ব্যান্ডের প্রথম রিয়েলিটি চেক।
যাইহোক, আমাদের বিলুপ্ত ব্যান্ডের ঘ্যানঘ্যানে ইতিহাসে আমাদের নিজেদেরই আর তেমন ইন্টারেস্ট নেই। আর এটা আমাদের এক্সক্লুসিভ ইতিহাসও হয় না। এখানে কাজের কথা দু’টো। এক, কম্পিউটার কৃত তুলনায় ইউজার ফ্রেন্ডলি সফটওয়ারের সহজলভ্যতা ব্যান্ড মুভমেন্টকে সামগ্রিক করতে সাহায্য করেছিলো। আর দুই, ব্যান্ড মুভমেন্ট বাংলা গানের কলকাতা কেন্দ্রিকতাকে চ্যালেঞ্জ করার অসম্ভব কাজটা খানিকটা করে ফেলেছিলো। এই যে গুটি কয় কল্কি-অবতারই এর শিয়রে বসে ক্রিম ডি লা ক্রিমটা খেলো, এবং এই ধাক্কাটাকে পোক্ত হওয়ার পথটিকে আটকে দেওয়া গেলো, তাতে এই সত্যটা হারিয়ে যায় না।
প্রথম থেকেই বাংলা বাণিজ্যিক গানের কলকাতা কেন্দ্রিকতা চোখে পড়ার মতো। পলিডোর, কলম্বিয়া থেকে গ্রামোফোন কোম্পানির আদিযুগ থেকে যেটাকে স্বর্ণযুগ বলে চিহ্নিত করা হয়, তার উৎপাদন প্রক্রিয়া, বিপণন ও বাণিজ্যিকরণের গোটা প্রক্রিয়াটাই কলকাতাকে কেন্দ্রে রেখে হোতো। এবং এই কর্মযজ্ঞের কেন্দ্রে ছিলো কলকাতার স্টুডিওগুলি। যেগুলি অ্যানালগ স্টুডিয়ো। তখনকার স্টুডিও মানে বিশাল ব্যাপার। রেকর্ডিং প্রচণ্ড খরচসাপেক্ষ ও পেছনে রেকর্ড লেবেলের ব্যাকিং ছাড়া তা করা অসম্ভব ছিলো। কোম্পানিগুলির ট্যালেন্ট স্পটার থাকতেন, তারা আর্টিস্ট খুঁজে এনে রেকর্ড করাতেন। তবে ফোক বাদ দিলে তাদের অন্বেষণের ক্ষেত্র কলকাতা ও তার আশপাশের জেলা থেকে তেমন ছড়াতো না। আর শিল্পীরাও এসে থাকতেন কলকাতায়। মিউজিকাল ক্যাপিটালটা সারা রাজ্য ও দেশ ঘুরে কলকাতায় জমা হতো।
বাংলা ব্যান্ডের উত্থান ও ডিজিটাল রেকর্ডিং-এর সম্ভাবনা গোটা প্রক্রিয়াটাকে অনেকটাই ডেমোক্র্যাটাইজ করে। এই মফস্বলে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য স্টুডিওতে রেকর্ড করা গানগুলির পরিণতি কী হল? গেলো কোথায় গানগুলো। এর উত্তর আমরা পরের এপিসোডে খুঁজবো। আর নেবো কিছু মফস্বলের ব্যান্ডের সুলুক সন্ধান। অলমিতি।
আব্বাস কিরোয়াস্তামির ‘টেস্ট অফ চেরি’ সিনেমা নিয়ে ভাবের অন্তরালে ডুব দিলেন - কিংকু
সিনেমা মানে শুধু একটা ঘটনা বলে দাঁড়ি টেনে দেওয়া নয়। তার চেয়ে ঘটনাটা কীভাবে, কখন, কোথায় ঘটছে সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এমন ধারণা থেকেই হয়ত নিজের লেখা ‘টেস্ট অফ চেরি’ ছবিটি বানিয়েছিলেন বিখ্যাত ইরানি চিত্র পরিচালক আব্বাস কিয়ারোস্তমি। আসলে চলচ্চিত্র নির্মাতার কোনও দায় নেই শেষটা নির্দিষ্ট করে দেওয়ার। সিনেমা তো আসলে স্বপ্নের মতো, যার কোনও স্পষ্ট সমাপ্তি নেই। পরিচালক সিনেমার শেষটা ছেড়ে দিয়েছেন দর্শকদের উপর। হাজার হাজার দর্শক, হাজার হাজার অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স। এখানেই সিনেমার আসল বিশ্বায়ন।
জনাব বাদী একজন ইরানি ভদ্রলোক, যে তার ছোট্ট গাড়িতে করে একটা বিশেষ কারণে তেহরানের আশেপাশে পাহাড়ি রাস্তায় ঘুরে বেরাচ্ছেন। চড়াই-উতরাই পেরিয়ে গাড়ি চলছে, চারপাশে ধুলোবালি, মানুষজন কাজ করছে, এক অদ্ভুত ব্যাপার। যেহেতু পুরো সিনেমাটাই একটা জার্নি, রিয়েল লাইফ জার্নি, তাই পরিবর্তনশীল নানানরকম পাহাড়ি ভূমিরূপকে গোটা সিনেমা জুড়ে একটা চরিত্রের মতো ব্যবহার করে গেছেন আব্বাস কিয়ারোস্তমি। লং শটের আধিক্য, বিষয়কেন্দ্রিক একটানা শট কখনও কখনও একঘেয়ে লাগতে পারে, তবে ওটাই কিন্তু সিনেমার আসল মজা। ক্যামেরার মুভমেন্ট কিছু অসামান্য মুহূর্ত ধরেছে, যেগুলো নিস্তব্ধতার মতোই রহস্যময়। চরিত্রের ভেতরে ঢোকার জন্য এই লং শটগুলো খুবই সাহায্য করে। জনাব বাদী যে গাড়িটি চড়ে ঘুরছিলেন, সেই গাড়িটিকেও বিভিন্নভাবে দেখিয়েছেন পরিচালক। নানান কোণ থেকে গাড়িটির চলে যাওয়া, কখনও ডিপ ক্লোজ, কখনও ফার ওয়াইড, নানানরকম পরীক্ষানিরীক্ষামূলক শটস ব্যবহারের ফলে গাড়িটি আর নিছক গাড়ি থাকেনি, একটা চরিত্র হয়ে উঠেছে।
আমরা দেখি, বাদী তেহরানের বাজারঘাটে মানুষের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন, কাউকে খুঁজছেন, রাস্তার কোণে যে পুরুষদের দেখেছেন তাদের বিভিন্ন প্রশ্ন করছেন। তাঁরা তাঁর গাড়ির চারপাশে ভিড় করে, হতবাক হয়ে, সরাসরি ক্যামেরার দিকে তাঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করছেন যে সে কাজের জন্য পুরুষদের চায় কিনা। ‘আপনি শ্রমিক চান? একটি নিন! দুটি নিন!’ এসব কোলাহল থেকে তিনি পাহাড়ে চলে যান, সেখানে তিনি একজন তরুণ কুর্দি সৈনিককে গাড়িতে তুলে দূরবর্তী পাহাড়ে খনন করা একটি অগভীর কবরের কাছে নিয়ে যান। এরপরই এই হতবাক সৈনিকের কাছে তিনি ভয়ঙ্কর প্রস্তাবটি প্রকাশ করেন। পরিকল্পনা হল, সেই রাতে বাদী কয়েকটি কড়া ডোজের বড়ি খাবেন এবং মৃত্যুর অপেক্ষায় কবরে শুয়ে থাকবেন। সৈনিককে কেবল ভোরবেলা ফিরে আসতে হবে, পরীক্ষা করতে হবে যে সে মারা গেছে এবং তারপর তাকে কবর দিতে হবে। বিনিময়ে, লোকটির জন্য একটি মোটা অঙ্কের টানা গাড়ির মধ্যে রাখা থাকবে। কবর দেওয়া হলে সে টাকা নিয়ে চলে যাবে।
সৈনিকটি আত্মহত্যার কারণে আতঙ্কিত হয় এবং পালিয়ে যায়। বাদী এরপর একজন আফগান শিক্ষার্থীকে তার পরিকল্পনায় আগ্রহী করার চেষ্টা করে। সেটাও ব্যর্থ হয়, কারণ ইসলামে আত্মহত্যা নিষেধ বলে সেই শিক্ষার্থী তাকে বারণ করে। এরপর একজন আজেরি বৃদ্ধের সাথে বাদীর দেখা হয়, যিনি কলেজের ছাত্রদের ব্যবচ্ছেদ এবং ট্যাক্সিডার্মি প্রদর্শনের জন্য নিযুক্ত ছিলেন। এই লোকটি তার নিজের যৌবনে আত্মহত্যা করেছিল; সে বাদীকে আত্মহত্যা থেকে বিরত করার চেষ্টা করে, কিন্তু বাদী তার নিজের লক্ষ্যে অটল থাকায় শেষমেশ সে টাকার জন্য কাজটি করতে রাজি হয়ে যায়।
টেস্ট অফ চেরি দেখার সময়ে খুব বেশি ছিমছাম পরিকল্পনা দেখা যায় না। দর্শককে সত্যিকারের বাস্তবতার অনুভূতি দিতেই হয়তো এই কাজটি করা হয়েছে। তাছাড়া ছবিটিতে খুব সচেতনভাবে একরকমের ভিজ্যুয়াল স্টাইল বজায় রাখা হয়েছে যা ছবিটিকে জাগতিক অনুভূতি দিয়েছে। এই অনুভূতির ফলেই বাদীর আত্মহত্যার পরিকল্পনা ছবিটিতে একটি অন্য ধরনের মেজাজ তৈরি করে।
মানুষের জীবনে মৃত্যু খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং বেদনাদায়কও বটে। কথাটি চরিত্রগুলোর জন্যে যেমন সত্য তেমনি ছবিটির জন্যেও সত্য। কিন্তু জগতের অন্য অনেক কাজের মত মৃত্যুবরণ করতেও সাহায্যের দরকার হয় (বাদী চায়নি তার মৃতদেহটি উন্মুক্ত থাকুক)। এই ছবিতে বাদীর মৃত্যু পরিকল্পনাই অন্যান্য চরিত্রগুলোর সাথে সংযোগ স্থাপন করে। চরিত্রগুলো সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে, একজন তরুণ ও একজন বৃদ্ধের চিন্তার পার্থক্য, মুক্তচিন্তার চর্চাকারী থেকে নীতিবাদীর তফাৎ ও একজন সহমর্মী মানুষ ও অন্যের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পছন্দ করে এমন মানুষের ভিন্নতা তুলে ধরে।
সবগুলো চরিত্রকে একই গাড়ির জানালার ফ্রেমে একইভাবে দেখা যায়; যারা বাদীর গাড়িতে করে একই রাস্তা দিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। চরিত্রগুলোকে ছবিতে কোনও ব্যাকস্টোরি দেওয়া হয়নি। ফলে গাড়িতে প্রবেশ করে বাদীর অদমনীয় প্রস্তাব শোনার পরে নিজেদের নীতিবোধ ও যুক্তি ছাড়া নির্ভর করার মতো তাদের অন্যকিছু থাকে না। তাই বাদীর সঙ্গে সঙ্গে আমরাও তাদেরকে অনেক বেশি খোলামেলা রূপে চিনতে পারি যা সাধারণত প্লটনির্ভর ছবিতে দেখা যায় না।
ছবির একপর্যায়ে রূপকার্থে বেশ শক্তিশালী একটা দৃশ্য দেখা যায়। একটা মরুপাহাড়ের নিচে বাদী কিছু সময়ের জন্যে গাড়ি পার্ক করেছিল। সেখানে বসে সে ট্রাক থেকে ফেলে দেওয়া বাতাসের মধ্যে পাথর ও বালির আঘাতে তৈরি হওয়া বালির ঘূর্ণি দেখতে পায়। ধীরে ধীরে এই বালি সমস্ত পরিবেশকে ছেয়ে ফেলে। একটা মিডিয়াম শটে ঘুরপাক খাওয়া ধুলাবালির কারণে বাদীকে ফ্রেমের মধ্যে ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে যেতে দেখা যায়। দৃশ্যটা সুন্দর হলেও বাদীর উপরে ঝরে পড়া ধুলাবালির শটটি তার আত্মহত্যা পরিকল্পনার জন্যে পরিষ্কার একটি রূপক। কিয়ারোস্তামির এরকম প্রচ্ছন্ন দৃশ্যগুলোই তার ছবির নির্লিপ্ত প্রধান চরিত্র দিয়ে এত শক্তিশালী আইডেন্টিফিকেশন তৈরি করার রহস্য। পুরো সিনেমাটি এভাবে তার সংক্ষিপ্ত প্লট থেকে বের না হয়েই সকল ধরনের দার্শনিক উপাদান যুক্ত করেছে।
বাদীর গম্ভীর ও নিজের ব্যাপারে অন্তর্মুখী বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও কিয়ারোস্তামি ভেতর থেকে তার জীবনকে টেনে বের করেছেন। তার অভিব্যক্তিটিকে কাব্যিক বলেও বিবেচনা করা যায়। আবার দর্শকের ভেতরের চিন্তা ও অনুভূতিগুলো তিনি উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছেন যার জন্যে তাকে অতটাও আড়ম্বরপূর্ণ হতে হয়নি। ‘টেস্ট অফ চেরি’-র দ্বিধাবিভক্ত দর্শক ও সমালোচকদের জন্যে কিয়ারোস্তামি বলেছেন—
‘This is not a movie about suicide—it’s about the choice we have in life, to end it whenever we want. We have a door we can open at any time, but we choose to stay, and the fact that we have this choice is, I think, God’s kindness’
সহজ কিন্তু সরল নয়, জটিল কিন্তু জটিল নয়, অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারের সঙ্গে ১৯৯৭ সালের গোল্ডেন পাম বিজয়ী একটি বিশেষ চলচ্চিত্র, ‘টেস্ট অফ চেরি’।
নাট্যের আসরেই দর্শকের প্রয়াণ: স্মরণ অনুষ্ঠানের মর্মস্পর্শী প্রতিবেদন লিখলেন - সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
এক রঙ্গ-শোক — নাট্য-দর্শকের প্রয়াণ!
কাজলদা অনর্গল বলে যাচ্ছেন আর আমরা একমনে শুনে চলেছি। বলছেন, প্রয়াত মঞ্চ-রসিক সমীর চক্রবর্তীর কথা। বলছেন নাটকে তাঁর আকুল ভালোবাসার কথা, সংসার-অসুস্থতা, বয়স পেরিয়ে খালি তাঁর নাটক দেখা বা নাটকের সঙ্গে থাকার কথা, রঙ্গলোকের আলো-ছায়ায় তাঁর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকার কথা। বলছেন রঙ্গমায়ার নিশিডাক তাঁকে পেয়ে বসেছিল। আমরা শুনছি, আমাদের ভেতরে তখন অথৈ বেদনার উথাল…
এই কাজলদা বলতে কাজল চট্টোপাধ্যায়, রঙমুখ দলের নাটককার ও প্রয়োগ-কুশলী। আমাদের এই কথা হল একান্তে।
‘একাকী গায়কের নহে গো গান’… যেমন, তেমনি দর্শক বাদ দিয়ে নাটক-ই বা কেমন? এই মান্য দর্শকের একজন সমীরদা—সমীর চক্রবর্তী চলে গেলেন। চলে গেলেন তিয়াত্তর বছর বয়সে। চলে গেলেন গত ৩০ এপ্রিল, ২০২৩-এ।
চলে যাওয়াটাও কাকতালীয়। একেবারে রঙ্গালয়ে নাটক দেখতে এসে। ওই দিন গড়িয়ার গাঙ্গুলীবাগানে রামগড় কমিউনিটি হলে ছিল সুতানুটি রঙমুখ ও চিত্রাঙ্গদা নাট্য একাডেমি-র যৌথ নাট্যসন্ধ্যা। মঞ্চায়িত হয় ‘দেশভূমি’ ও ‘পিঁপড়া’ প্রযোজনা। সেখানে দর্শকাসনে ছিলেন সমীর চক্রবর্তী। দর্শকাসনে বসেই চলে গেলেন হৃদরোগের হানায়। চলে গেলেন কি! না রয়ে গেলেন রঙ্গলোকের স্থায়ী আসনে…?
এই সমীর চক্রবর্তীকে ঘিরে আয়োজিত হল স্মৃতি-সভা ও ‘থিয়েটারে দর্শক’ শীর্ষক কথন গত ২৯মে, ২০২৩ সন্ধ্যায় ওই কমিউনিটি হলেই। উদযোগে রঙমুখ, সহযোগে চিত্রাঙ্গদা নাট্য একাডেমি। একত্রিত হয়েছিলেন নানা নাট্যজন, নাট্যকর্মী, সহ-নাগরিক ও বিশিষ্টজন। উপস্থিত ছিলেন যশোবান নাট্যবিদ রঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায় ও সম্মাননীয় পূর্বতন পুরপিতা দেবাশীষ মুখার্জী। উপস্থিত ছিলেন নাট্যানুষ্ঠানের দিন যাঁরা তাঁর প্রাণ ফেরাতে প্রাণপণ করেছিলেন, তার ভেতর দু-জন— পার্থসারথি সেন ও অজয় সরকার। আর ছিলেন সমীর-জায়া সুতপা চক্রবর্তী ও তাঁর পরিজনেরা। রঙমুখের পক্ষে হিরন্ময় হালদারের সূচনাগানে স্মরণসভার শুরু। তারপর একে একে শ্রদ্ধার্পণ, স্মৃতি-কথন ও সব শেষে চিত্রাঙ্গদা নাট্য একাডেমির বৃন্দগান। সমগ্র-সংযোজনায় কাজল চট্টোপাধ্যায়।রঙমুখের উচ্চারণে উঠে এল, এমন সভার আয়োজনের সাংস্কৃতিক দায়-এর কথা, নাট্যচর্চার প্রতি সম্মাননা প্রদর্শনের কথা… উঠে এল সেই অমোঘ শব্দবন্ধ, ‘দর্শক থিয়েটারের প্রাণবায়ু’।
‘থিয়েটার পুষ্পক’-এর নাট্যোৎসব নিয়ে ভাণ এর প্রতিবেদন - প্রতিবেদক সায়ন ভট্টাচার্য এবং অয়ন্তিকা নাথ
থিয়েটার পুষ্পক আমাদের চেনা নাম। জন্মলগ্ন থেকেই সে তার পুষ্পক রথ ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে। এই কদিন আগে একটা বড় আয়োজন করেছিল “থিয়েটার পুষ্পক”।
থিয়েটারকে নিয়ে, থিয়েটারকে ভালোবেসে, থিয়েটারের জন্য একটা সুন্দর উদ্যোগ । আদতে মানুষের জন্য একটি থিয়েটারি পরব। নিছক বিনোদনের জন্য নয় ,তার গভীরে মানুষের অন্তর্ঘন করে পাবার জন্য, তাদের সঙ্গে কথা কইতে, তাদের যাতনা-বেদনার সঙ্গী হতে, আর কিছুটা উজ্জীবিত করতে, সাহস পেতে, সাহস দিতে,ঘুরে দাঁড়াতে। উৎসবের নাম দেওয়া হয়েছিল “যদি বন্ধু হও”! পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আর্থিক সহায়তায় থিয়েটার পুষ্পকের এই আয়োজন দুটি পৃথক মঞ্চে ঘটেছিল দুদিন ধরে। ৬ মে তৃপ্তি মিত্র নাট্য গৃহতে দুপুর বারোটা থেকে অন্তরঙ্গ থিয়েটারের আসর বসিয়েছিল থিয়েটার পুষ্পক।
উৎসবের আরম্ভ
এক দিনে আটটি অন্তরঙ্গ নাট্য। শুধু কলকাতার নয় শহরতলী এবং জেলার নাটক নিয়ে হাজির হয়েছিলেন বন্ধু নাট্যজনেরা। তৃপ্তি মিত্র নাটক গৃহে হাজির হয়েছিল, চাকদহ নাট্যজন, সাউথ গড়িয়া আনন্দ মহল ,চণ্ডীতলা প্রম্পটার, সাঁইথিয়া আসর নাট্যম, বিভাবন ব্যারাকপুর সৌপ্তিক, এবং অন্তরঙ্গ থিয়েটারের আদি পুরুষ ‘শতাব্দী’- তার সুবিখ্যাত ‘হট্টমেলার ওপারে’ প্রযোজনা নিয়ে।
উৎসবের দ্বিতীয় দিন: উদ্বোধন
রাহুল দেব ঘোষ এর পরিচালনায় ‘সাক্ষী’ , ধনঞ্জয় আঢ্যর পরিচালনায় ‘স্মরণ সভা’, সুপ্রিয় সমাজদার নির্দেশিত ‘ নাথিং টু সে’ দর্শক মনে যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে। তবু সবকিছুকে যথারীতি অতিক্রম করে গেছে শতাব্দীর ‘হট্টমেলার ওপারে’। সেদিনের শেষ প্রযোজনা ছিল ওটি।
শুধু শতাব্দীর প্রযোজনা দেখবার জন্য নতুন করে হাজির হলেন অনেক দর্শক।গায়ে গায়ে ঘেঁষে বসেও স্থান সংকুলান হলো না।তারই মাঝে বাদল সরকারের এমন সৃষ্টির আস্বাদ পেতে পেতে ভেতর থেকে আহ্লাদিত হয়ে উঠছিলেন দর্শক।
নাটক: তাসের দেশের নাগরিক
একটা নাটক তার সর্বোচ্চ ক্ষমতা নিয়ে অতি অনাড়ম্বর ভঙ্গিতে দামামা বাজিয়ে দিচ্ছিল দর্শকদের অন্তরে। নাটক যে কী করতে পারে, এ বিশ্বাস ফিরে পেতে এ প্রযোজনা বারবার দেখা উচিত।
৮ পুষ্পক পৌঁছে গিয়েছিল তপন থিয়েটারে । “যদি বন্ধু হও“ এর এইদিনের উপস্থাপনায় পুষ্পকের বন্ধুদল হিসাবে ছিল “থিয়েটার পুষ্পক “ছাড়াও আরো পাঁচটি বিশিষ্ঠ নাট্যদল। “বসিরহাট কিংশুক“ , “নান্দীমুখ“, “অনীক”, “থিয়েটার প্ল্যাটফর্ম“ এবং “কসবা অর্ঘ্য“।
নাটক: হট্টমেলার ওপারে
সমাজমানসে নাটকের প্রভাব ও গুরুত্ব ঠিক কতধিক হতে পারে, তার উৎকৃষ্ট নজির সৃষ্টি হয়েছে এদিনের প্রতিটি উপস্থাপনার দ্বারাই। তবে এই প্রসঙ্গে “থিয়েটার পুষ্পক” দ্বারা উপস্থাপিত “তাসের দেশের নাগরিক“ নাটকটির কথা অবশ্য উল্লেখ্য। প্রকৃতি যে আদতে কোনো বিচ্ছিন্ন ইউটোপিয়ার অন্তর্গত স্বপ্নলব্ধ বা ঐশ্বরিক ম্যাজিক বাস্তবতার দান নয়, সে যে আসলে মানব সভ্যতা প্রসূত আর্থ – সামাজিক কাঠামোর সঙ্গে লীন হয়ে থাকা এক চৈতন্য, সেকথা আরও একবার মনে করিয়ে দিলেন নির্দেশক, আলোকপর্ণা গুহ। “জাপান যাত্রী“ – তে রবীন্দ্রনাথ শিল্প – বিল্পবের আগ্রাসী স্বরূপ প্রত্যক্ষ করে বলেছিলেন “মানুষের কারখানা – ঘরের চিমনিগুলো ফুঁ দিয়ে দিয়ে নিজের অন্তরের কালিকে দ্যুলোকে বিস্তার করেছে, সে অপরাধ তেমনি গুরুতর নয় – কেননা, দিনটা মানুষের নিজের, তার মুখে সে কালি মাখলেও দেবতা তা নিয়ে নালিশ করবেন না। কিন্তু, রাত্রির অখণ্ড অন্ধকারকে মানুষ যখন নিজের আলো দিয়ে ফুটো করে দেয় তখন দেবতার অধিকারে সে হস্তক্ষেপ করে। সে যেন নিজের দখল অতিক্রম করে আলোকের খুঁটি গেড়ে দেবলোকে আপন সীমানা চিহ্নিত করতে চায়।” এই দেবতা প্রতিষ্ঠানের অধিষ্ঠাতা নন, সেকথা বলাই বাহুল্য। এই দেবতা সহজের দেবতা, সারল্য ও সৌকুমার্যের দেবতা। রবীন্দ্রনাথ রাত্রির বুকে যে দ্যুলোক বিস্তারি কালিমার ঘনঘটার সম্ভাব্য সাম্রাজ্য বিস্তারের দুশ্চিন্তায় আকুল হয়েছিলেন সে সাম্রাজ্যের আগ্রাসী পদক্ষেপ আজ সমগ্র বিশ্বজুড়ে পদধ্বনিত হচ্ছে। মানুষের ব্যক্তি জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি আজ যেমন মুঠোফোনের পেছনে বসে থাকা কোনো এক অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণকারীর আওতাভুক্ত, তেমনই যন্ত্রের আগ্রাসনে, পুঁজির আরাম অর্জনে মজে থাকা ব্যক্তি মানুষ ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্র থেকে, মানস চৈতন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে সারল্যের থেকে, প্রকৃতির থেকে, সহজের থেকে। আর এই সহজের সবথেকে প্রাচীন ও নবীনা সন্তান ,” শিশু “ , সেই শিশু চৈতন্য ফলভোগ করছে, বিষাদ গ্রস্তাতার ঘূর্ণায়মান চোরা স্রোত ক্রমশ আবর্তিত হতে হতে অতিক্রম করে যাচ্ছে তাদের চেতনাকে, আচ্ছন্ন করে ফেলছে তাদের সহজ, সহজাত বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে। নির্দেশকের চোখ দিয়ে আমরা দেখলাম কী অপূর্ব ভঙ্গিমায় প্রবল সংকটের দিনেও শিশু এবং প্রকৃতি মিলেমিশে যাচ্ছে একে অপরের সঙ্গে। প্রকৃতির প্রাণ সজীবতা যদি আমাদের নিরীক্ষণ করার ক্ষমতা থাকতো, তবে কেমন হতো তার স্বরূপ, তার অভিব্যক্তি, যাপন, সেই অদেখা চিত্রকল্পকেই যেন জীবন্ত করে তুললেন আলোকপর্ণা এই নাটকের মধ্যে দিয়ে। কচি – কাঁচাদের আবেদন ও আবেগে প্রকৃতির প্রাণ প্রতিষ্ঠা ঘটালো এই নাটকের মধ্যে দিয়ে। এমন দুর্দিনে স্ক্রাইস্ক্র্যাপারে আচ্ছন্ন নাগরিক অভিশাপ মাথায় নিয়ে বেঁচে থাকার দিনগুলোতে এর থেকে ভালো উপহার আর কীই বা হতে পারে! জীবনের কাছে নাগরিক যন্ত্রণার এর থেকে বেশি আর কী বা পাওয়ার থাকতে পারে।
অয়ন্তিকা নাথ
‘পুষ্পক’ নাট্য উৎসবের দ্বিতীয় দিনে দুটো অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নাট্য প্রযোজনা ছিল – কসবা অর্ঘ্য-র ‘ম্যাকবেথ বাদ্য’ এবং থিয়েটার প্ল্যাটফর্ম-এর ‘আলাদা’। বাংলা থিয়েটারের এই সময়ের দুই গুরুত্বপূর্ণ নাট্য নির্দেশক মণীশ মিত্র ও দেবাশিস। মণীশ মিত্র-র ‘ম্যাকবেথ বাদ্য’ একক অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করা হয় পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার ট্রাজেডি। একটি চরিত্র জন্ম থেকেই ‘ম্যাকবেথ’ হয়ে ওঠে না, কিন্তু তার মধ্যে ক্ষমতার বীজ আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রকৃতির আদিমতন্ত্রকে সে ব্যবহার করে অমর হওয়ার জন্য, অস্ত্রকে করে তোলে জীবনের অঙ্গ। এইসব কিছুর পরেও মানবতা অমলিন, মানবতার মৃত্যু হয় না – ম্যাকবেথ-রা যুগে যুগে জন্মাবে মরেও যাবে, কিন্তু ‘ম্যাকবেথ বাদ্য’ যেন সাবধান করে আমাদের ভিতরে লুকিয়ে থাকা ‘ম্যাকবেথ’ যেন কখনও প্রাণ না পায়।
সায়ন ভট্টাচার্য
পরের প্রযোজনা ‘আলাদা’, দেবাশিস একদল নতুন ছেলেমেয়েদের ওয়ার্কশপ থেকে এই নাট্যটি তৈরি করেন। দেবাশিস-এর নাট্যের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো তার নির্মাণ, এই নাট্যেও তার অন্যথা হয় নি। একটি ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণকারীরা যা যা জিনিস নিয়ে আসে, সেগুলোই নাট্যের প্রপস সেট সমস্ত কিছুই। একটি ছেলের নাম আলাদা, যার ছায়া মাটিতে পরে না, নেই তার ছায়া। সমাজ তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে কারণ সে আলাদা। এই নাট্যের কাহিনী বলার ধরনটি দর্শকে চমকে দেয় – একজন মানুষকে সবার মতো হতেই হবে, এর বিরুদ্ধে দেবাশিস যেন এক যৌথ অভিযান তৈরি করেছেন তিরিশ জন তরুণ-তরুণীকে নিয়ে গোটা মঞ্চে। এই নাট্য বাংলা থিয়েটারের একটি নতুন পরীক্ষা বলা যেতে পারে।
ওয়েব সিরিজ বিমা কেলেঙ্কারি নিয়ে কলম ধরলেন - বৃতা মৈত্র
বৃতা মৈত্র
ওয়েব দর্শকের দরবারে বিমা কেলেঙ্কারি
বিষয় হিসেবে ক্রাইম যে ওয়েব দুনিয়ার নির্মাতাদের অন্যতম সেরা পছন্দ, সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। নিঃসন্দেহে দর্শক চাহিদাও খানিকটা এর কারণ। সত্যি কথা বলতে কী, বিশ্ব জুড়ে অপরাধের বর্ধিত হারও তো অস্বীকার করার উপায় নেই। সেক্ষেত্রে ওয়েব সিরিজ নির্মাতাদের কাছে রিয়েল লাইফ স্টোরিই যে রসদ হিসেবে উঠে আসবে, সেটাই তো স্বাভাবিক! এহেন অনুষঙ্গেই বিমা কেলেঙ্কারির মতো গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক এক বিষয় নিয়ে এসেছে জনপ্রিয় বাংলা স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম হইচই। সাফল্যের সঙ্গে প্রদর্শিত হচ্ছে ‘দ্য বেঙ্গল স্ক্যাম: বিমা কাণ্ড’।
সমাজে প্রতিনিয়ত মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে দুর্নীতি, আর্থিক কেলেঙ্কারির মতো বিষয়গুলো। সকলেরই জানা, এই সমস্ত ঘটনার পিছনে যারা রয়েছে, তাদের প্রধান শক্তি রাজনৈতিক প্রশ্রয় ও আশ্রয়। সেই কারণেই দিনের পর দিন ধরে দুর্নীতির এই কারবার চালাতে অপরাধীদের বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না।
পরিচালক অভিরূপ ঘোষের এই সিরিজ নিপুণভাবে বিন্যস্ত করেছে ভয়ঙ্কর অপরাধের এই জ্বলন্ত বিষয়টিকে। দুর্নীতি যখন কোনও বৃহত্তর ক্ষেত্রে সংগঠিত হয়, তখন তার আঁচ এসে পড়ে সাধারণ মানুষের গায়ে। চরম ভুক্তভোগী হন তাঁরাই। এখানে সেই বিষয়ভাবনাকেই তুলে ধরেছেন অভিরূপ ঘোষ, তার ওয়েব সিরিজ ‘দ্য বেঙ্গল স্ক্যাম: বিমা কাণ্ড’-এর মধ্যে দিয়ে।
আমরা দেখি, বিমাকাণ্ডের জটিল আবর্তে কিঞ্জল ও সোনামণি, যার মাস্টারমাইন্ড হলো রজতাভ দত্ত! নাহ, ওঁরা ঠিক নন, বলা যায় ওঁদের অভিনীত চরিত্রগুলি।
প্রসঙ্গত, বরাবরই ব্যাতিক্রমী পরিচালক হিসেবে পরিচিত অভিরূপ। ছকে বাঁধা পথের বিপরীতে হাঁটার সাহসটা শুরু থেকেই দেখিয়ে এসেছেন তিনি। ‘কে: সিক্রেট আই’-এর মতো সায়েন্স ফিকশন ছবির হাত ধরে অভিষেকের কেরিয়ার শুরু। পরবর্তীকালে তাঁর কাছ থেকে দর্শক পেয়েছে ‘জম্বিস্থান’, ‘রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজ’, ‘ব্রহ্মদৈত্য’, ‘ব্যাধ’-এর মতো ভিন্নধারার কাজ। আট পর্বের এই ওয়েব সিরিজে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন কিঞ্জল নন্দ, সোনামণি সাহা ও রজতাভ দত্ত।
অভিরূপের ‘দ্য বেঙ্গল স্ক্যাম: বিমা কাণ্ড’-এর হাত ধরেই ওয়েব দুনিয়ায় পা রেখেছেন ছোটপর্দার জনপ্রিয় অভিনেতা সোনামণি সাহা। সোনামণিকে ইতিমধ্যেই দর্শক দেখেছেন ছোটপর্দার হিট মেগা ‘দেবী চৌধুরাণী’, ‘মোহর’ ও ‘এক্কা দোক্কা’-য়। এই ওয়েব সিরিজে বিমা কোম্পানির এজেন্ট মোহনার চরিত্রে রয়েছেন সোনামণি। অপরদিকে নিজ অভিনয়গুণে দর্শকমনে জায়গা করে নেওয়া কিঞ্জলকে সিরিজে দেখা যাবে প্রোটাগনিস্টের চরিত্রে।
তাঁর চরিত্রের নাম সমুদ্র। সমুদ্রও মোহনার মতোই বিমা কোম্পানির একজন এজেন্ট। যদিও, সিরিজের মুখ্য আকর্ষণ নিঃসন্দেহে রজতাভ দত্ত। বিমা কেলেঙ্কারির মূল হোতা বিদ্যুতের চরিত্রে রয়েছেন তিনি। জ্যোতিষে বিশ্বাসী বিদ্যুৎ এই বিমা কেলেঙ্কারির মাস্টারমাইন্ড। তার নেটওয়ার্ক যথেষ্টই বিস্তৃত। অসাধু, জটিল, ক্ষমতালোভী এই চরিত্রটির পিছনে একটা অসংলগ্নতা ও হাস্যরসের ছোঁয়াও রয়েছে। আর এতকিছু একসঙ্গে রজতাভ ছাড়া আর কে হাজির করবেন পর্দায়! অভিরূপের প্রথম ছবি ‘কে: সিক্রেট আই’ থেকেই তাঁর সঙ্গে কাজ করছেন রজতাভ।
পরিচালকের ‘জম্বিস্থান’, ‘ব্যাধ’-এ প্রতিবার ভিন্ন ভিন্ন রূপে ধরা দিয়েছেন তিনি। বলা বাহুল্য, বিদ্যুৎ হয়ে ওঠায় তাঁর মতো একজন পাওয়ার প্যাকড অভিনেতারই দরকার ছিল।
বিদ্যুৎ গ্রামের গোটা বিমা কেলেঙ্কারির নেটওয়ার্ক সাজায়। নির্মমতার পাশাপাশি তার চরিত্রে রয়েছে অদ্ভুত এক কৌতুকের ছোঁয়া। সে জ্যোতিষশাস্ত্র ও ভাগ্যে প্রবল বিশ্বাসী। নিজের স্বার্থে কাউকে হত্যা করার আগে একবারও চিন্তা করে না। এই চরিত্রের সঙ্গে দর্শকদের প্রেম-ঘৃণা–দুই সম্পর্কই গড়ে উঠবে বলে নিজের বিশ্বাস জানিয়েছিলেন রজতাভ স্বয়ং। সেটাই হয়েছে। বাংলা বিনোদনের অপরিহার্য নাম তিনি। তাঁকে নতুন এই অবতারে দারুণভাবে গ্রহণ করেছেন দর্শকবৃন্দ, শোনা যাচ্ছে এমনটাই।
সিরিজের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে সদ্য বিমা কোম্পানিতে চাকরি পাওয়া সমুদ্রকে কেন্দ্র করে। বিমা কোম্পানিতে কাজ করতে এসে তার সঙ্গে পরিচয় হয় মোহনার। ইতিমধ্যেই একটি বড় দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ইনসিওরেন্স কোম্পানির এক গ্রাহক রামকৃষ্ণ মুর্মুর। চিলাপোতা গ্রামের এহেন ঘটনার যাবতীয় বিষয় বিশদভাবে জানার জন্য বিমা কোম্পানির পক্ষ থেকে সমুদ্র ও মোহনাকে পাঠানো হয়। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদ করার পরে নানা অসঙ্গতি খুঁজে পায় তারা। ধীরে ধীরে তাদের সন্দেহ বাড়ে এবং তদন্তের জন্য এই ঘটনার আরও গভীরে ঢুকে যায় দু’জনে। সমুদ্র ও মোহনার বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হয় না যে দুর্ঘটনা নয়, ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে রামকৃষ্ণ মুর্মুকে।
গ্রাম জুড়ে চলতে থাকা এক বিশাল বিমা কেলেঙ্কারির মুখোমুখি হয় তারা। জানতে পারে, এই কেলেঙ্কারির মূলচক্রী বিদ্যুৎ। সমুদ্র ও মোহনা কি পারবে বিদ্যুৎ ও তার গ্যাংয়ের মুখোশ খুলে ফেলতে? নাকি ঝুঁকি নিয়ে রহস্যের জট খুলতে গিয়ে, তারা নিজেরাও জড়িয়ে পড়বে আরও বড় বিপদের আবর্তে! এই যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দর্শক পাবেন ‘দ্য বেঙ্গল স্ক্যাম: বিমা কাণ্ড’-এ। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে রয়েছেন জন ভট্টাচার্য, দেবরাজ মুখোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতা। জনকে সিরিজে দেখা যাবে একজন সিআইডি অফিসারের ভূমিকায়।
পরিচালকের কথায়, ‘বাংলার গ্রামীণ এলাকার প্রেক্ষাপটে বোনা এই সিরিজটি মিথ্যার এক জটিল জালের গল্প। দারিদ্র এবং শিক্ষার অভাবে সাধারণ মানুষের চরিত্রে যে নৈতিক দুর্বলতাগুলি ছায়া ফেলে, তারই প্রেক্ষাপটে বিন্যস্ত এই সিরিজ। সিরিজের নেতিবাচক চরিত্রদের ঘৃণ্য কাজগুলি দর্শকদের বিস্মিত করবে। ভরপুর বিনোদনে ঠাসা এই সিরিজে অপরাধ, রোমাঞ্চ, অ্যাকশন, ড্রামা–এই সব ক’টি উপাদান ভরপুর মাত্রায় রয়েছে’। পরিচালকের কথার রেশ ধরেই বলা যায়, পর্দার এই নাটক পর্বে পর্বে যে ছবি তুলে ধরেছে, তা বাঙালি তথা ভারতবাসীর চেনা অভিজ্ঞতারই অঙ্গ। সেইদিক থেকে এহেন প্রচেষ্টা বিশেষ প্রশংসার দাবিদার।