ভাণ পত্রিকা
ঊনচল্লিশতম সংখ্যা || ত্রিশতম ই-সংস্করণ || জুলাই ২০২৩
সম্পাদক :
সম্পাদনা সহযোগী :
প্রচ্ছদ :
নক্সা পরিকল্পক :
অন্যান্য কাজে :
ভাণ-এর পক্ষে:
পার্থ হালদার
কর্তৃক
৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬
( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )
৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) bhaan.kolkata@gmail.com ( ই – মেল )
Reg. No : S/2L/28241
যাপিত নাট্যের ত্রয়োদশ কিস্তি লিখলেন – কুন্তল মুখোপাধ্যায়
‘অধাঙ্গিনী’ এর ছায়ার গভীরের ছবিকে ছেঁকে তুললেন – দেবদীপ চৌধুরী
শিলাজিতের গায়ক সত্তার সুলুক করলেন – অরিক্তম চ্যাটার্জি
‘আদিপুরুষ’ সিনেমা নিয়ে কলম ধরলেন – অভিষ্যন্দা লাহিড়ী দেব
সূচি
সম্পাদকের কথা
।। সম্পাদকের কথা।।
নানা রঙের অন্যায়ের মাঝখানে আমাদের স্বার্থ-রঙা বসতবাড়ি। আমরা মানে— এক এক জন মানুষ। মানুষ মানে, আপাতত যাদের কালকের ভাতের চিন্তা নেই। আগামী অনেক বছর, তেমন ভূমিকম্প ঘটে না গেলে, ভাত কাপড়ের চিন্তাহীন ‘আমরা’! আমরা মানে যারা মনে করছি, আমি শুধু আমার জন্য নই, কেবল নিজেকে ভালোবাসাতে যাদের নাকি আশ মেটে না, অন্যকে রাঙাতে যার আন্তরিক অভিলাষ। সেই আমরার ‘আমি’দের কথা তুলছি। যে আমি ঘরের সুখকে সামলিয়ে (তুচ্ছ বা ত্যাগ করে নয়) বাইরে অসুখ নিয়ে অসুখী হয়ে থাকে, অন্তত থাকতে ভালোবাসে অথবা আছি বলে দেখিয়ে আরাম পায়, বঙ্গদেশে সামূহিক অন্যায় অবিচার ও অবিরাম নিষ্ঠুরতা নিয়ে কী করছে সে? অন্তত কিছু কি ভাবছে?
একথা উঠলে একথাটিও ওঠে, ‘সবার কথা বলতে পারবো না ভাই। আমি সাধ্য মতো করি’। আর একটি কথাও ওঠে— ‘সাধ তো আছে, কিন্তু কী করবো? সময় কই?’ কিন্তু আমাদের ঠিক কতটা সাধ, ঠিক কতদূর সাধ্য!? আমার যা পারা-করা, তা কি কেবল দশের জন্য? নাকি দশের জন্য আমার ‘করতে পারা আমি’টিই প্রধান— মন এসব জটিল প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে নাস্তানাবুদ হয়। কিন্তু উত্তর মেলে না! তবে ‘কী করে করবো’— বলেন যে বা যারা, তাদের বলা যায়, আপনি বরং সময় বার করার কাজটা করুন। ওটাও দেশের-দশের জন্য কম বড় কাজ নয়!
এই দুর্দিনে মোটের ওপর যাদের একটা নিশ্চয়তা আছে, যাদের দায় বেশি ছিল এই রক্তমাখা ন্যুব্জ থ্যাতলানো সময়টার শুশ্রুষার। যাদের মুখর হবার কথা ছিল মূঢ় ম্লান মূকের হয়ে। মোটকথা যাদের কিছুটা ঝুঁকি নিলেও সম্ভাব্য যে ক্ষতি, তাকে সামলে নেবার মতো পরিস্থিতি আছে— তারাই আজ বড় অস্পষ্ট, আত্মগত, অজুহাত-প্রিয়, বুদ্ধির বৈষয়িক খরচে দড় এবং শেষত পলায়নবাদী। পলায়ন-কে যুক্তিপূর্ণ করে তুলতে বিদ্যাচর্চা অথবা চিন্তার ক্ষমতার ব্যাপক ব্যবহারে পটু হয়ে উঠছি আমরা। হয়ত এটাই ভবিতব্য ছিল। চিন্তার ব্যক্তিবাদী অহংবাদী ধারণাকে তোল্লা দিয়ে টিকে আছে আজকের কমার্স। সেখানে কমন ম্যানের থেকে অনেকবেশি প্রাধান্য ‘একক আমি’-এর। সিনেমা থিয়েটার গল্প উপন্যাস বিজ্ঞান ও ইতিহাস চর্চায় ব্যক্তির জয় গান। সেই ব্যক্তি নায়কের সন্ধানে অসংখ্য অসহায় জনতা, গণতন্ত্রের এঁটো হয়ে অসহনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করে।
ওদিকে আমরা কবিতা করি। আঁকিবুকি করি। ভাঙড়- মুর্শিদাবাদের বাপের ছোঁড়া বোমার আঘাতে আধ-পোড়া ছেলের লাশের দিকে পেছন করে আমরা কবিতা করি। ক্যানিং আর কোচবিহারে গরিব মানুষের গুলি খাওয়া লাল শরীরের ঠিকরে আসা চোখের দিকে না তাকাতে পেরে আমরা আঁকিবুঁকি করি। ফুলগাছের পরিচর্যা করি। পোষা পালিতের লোম উঠে যাচ্ছে বলে উদ্বেগে উজাগর থাকি। ছবি তোলার নতুন প্রযুক্তির লেন্স পেয়ে মন, ময়ূর হয়। অথচ জীবন জীবিকা তুচ্ছ করা গরিবের অনন্ত ঝুঁকি দেখে আমাদের পেখম নিভে যায়। আমরা সবাই এক। সব পার্টি খারাপ। আরকিছু হবার নেই— এইসব কান-পচা ডাইলগ বলতে-বলতে নতুন ইলিশের কাঁটা বাছি আমরা। একে অপরের ওপর রেগে যাই। যাদের ওপর রাগি তাদের নিয়েই বাঁচি। বঙ্গসংস্কৃতির হোতারা বিদেশে অপমানিত অসম্মানিত লাঞ্ছিত হয়ে দেশের গরীব ফ্যানেদের থেকে প্রতিবাদ চান, সহানুভূতি চান। অথচ সেই গরিবের ভোট লুটের গণতন্ত্রের মর্মান্তিক নিধন দেখে মৌনীবাবা হয়ে থকেন, এমন অসহায় আত্মস্বার্থ ওদের আত্মরতির প্রতীকে পরিণত করে।
এরমাঝে সত্যি কি আমরা কিছু করতে পারি না? যা পারি তার চেয়ে একটু বেশি ঝুঁকি কি নিতে পারি না? নিজে না পারলে যে পারে, যারা পারেন তাঁদের পাশে কি দাঁড়াতে পারিনা? পারি যে, তার প্রমাণ তো আমাদের অভিজ্ঞতায় জেগে আছে। আমরা কি সরকারের চোখে চোখ রেখে সত্যি কথা বলতে পারা বন্ধু দেখিনি? গাছ কাটাতে দেবে না বলে পুলিশের লাঠিপেটা হতে দেখিনি দামাল ছেলেমেয়েদের? পুকুর বোজাতে গেলে দুদেল সরকারি পার্টির স্নেহ-ধন্য প্রোমোটারদের বিরুদ্ধে গর্জাতে দেখছি না? পাখি যাতে ফিরে আসে, কালো ধোঁয়া যাতে কম মেশে বাতাসে, ফুসফুস যাতে বাঁচে, শিশু যাতে পুষ্টি পায়, মা পায় অধিকার, মেয়েটি যাতে সম্মান নিয়ে একা বাঁচতে পারে, সেতুর যাতে শুশ্রূষা হয়, হাসপাতালে যাতে পরিকাঠামো থাকে, গরিব যাতে পরিষেবা পায়, সবধর্ম যাতে ভারতের গর্ব-ভূমে বাঁচতে পারে, মানুষ যাতে কাজ পায়, কাজ যাতে কর্মীর সময়-সম্মান চুরি না করতে পারে— এরকম অসংখ্য লড়াইয়ের কোনো একটির জন্যও কি ‘একটু কিছু’ করতে পারি না আমরা? একটু উদ্যোগ? কিছুটা অংশগ্রহণ? কখনও কখনও কি ভুলবশত ও ভালোর জন্য চিৎকার করে উঠতে পারি না আমরা? সরাসরি সত্যিটা বলার জন্য কখনও কি রক্তের গভীরে টাইফুন তৈরি হবে না আমাদের? পরিমাপ পরিধি আর কমফোর্ট জোনের অঙ্ক কষতে-কষতে কেবল একটা তুচ্ছ মৃত্যুর অপেক্ষায় সন্তুষ্ট থাকব আমরা? একদিনের জন্যও কি মৃত্যুকে রঙিন করার বাসনা জাগবে না আমাদের ভেতর ঘরে?
মানুষ কি কেবল স্বার্থপর? আত্ম-প্রেমী? নাকি পরহিতের জন্য একটা অন্তর্লীন আয়োজন থাকে স্বার্থ চিন্তার আড়ালে? যদি থাকে, কেমন তার চেহারা, কী তার আদল? অমর্ত্য সেন, তাঁর পূর্বজ অ্যাডাম স্মিথ সহ বহু অর্থনীতি-চিন্তকদের ভাবনা সূত্র ধরে দেখিয়েছেন কীভাবে স্বার্থ ও পরার্থ অবিমিশ্র হয়ে থাকে। কেমন করে স্বার্থের ভেতর দিয়ে ঘটে যায় স্বার্থহীন কাজ! কখন বৃহৎ সমাজটার জন্য নিজের স্বার্থকে ক্ষুদ্র তুচ্ছ মনে হয়। নিজের গোষ্ঠী বা সংঘের প্রতি আনুগত্যের গভীরে কোন নিয়মে চলে স্বার্থ ও নিঃস্বার্থের মিশেল! পরিবার পরিজনের সঙ্গে বাঁধে স্বার্থ-প্রেমের মিশ্রিত দ্বন্দ্ব! নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ! কীভাবে কখন ক্ষুদ্র যুক্তি বিপুলা নভঃশ্চরে মুক্তি খুঁজে মরে!!
যেন মনে হয়, নানা পরিস্থিতি নির্ভর হলেও মানুষ তার অভ্যাসের সংস্কৃতি দিয়ে অনেকটা বড় হয়ে যেতে পারে, অনেকটা প্রসারিত করতে পারে নিজের হৃদয়। যদি মনে হয়, ভোটের নামে প্রহসন হলো— লিখুন না দুকলম। পাড়ার মোড়ে চেনা দোকানের চাতালে বলুন না, কেন মনে হল একথা আপনার! আপনার চারপাশে জড়িয়ে থাকা নিজের লোকেদের কাছে এই বিষয়টাও কথা হয়ে ফুটুক। যান না চলে এক বিকেলে, যে লড়াইকে আপনি মনে মনে সমর্পণ করেন তাদের কাছে। আপনার ঋণের কথা জানাতে। প্রেমের কথা জানাতে। দিন না সংগ্রামী তহবিলে আপনার একটা শাড়ি বা শার্টের দাম। অনেক তো আছে আমাদের। এক শরীরের লক্ষ আচ্ছাদন। একটু একটু করে প্র্যাকটিশ চাই। তাহলেই একটু করে বদলাতে পারে। আপনার স্বীকৃতি এবং সামর্থ্য। এর সঙ্গে সঙ্গে কিছু ভাবনাও দিন। ভাবনরা কেবল সংসারের চৌহদ্দিতে ঘুরে-ঘুরে কথা কইবে কেন? চিন্তা কেবলই কেন মেয়ে ফিরতে দেরি করলে হবে? চিন্তারা ইতিউতি ট্যুরে যাক। মনিপুর যাক। দেখুক সেখানে কেবল শাড়ি আর নাচ নয়, কেমন গোলা বারুদের হত্যাশালা হয়ে কাতরাচ্ছে মনিপুর!! চিন্তারা গালে হাত দিক। ভাবুক কেন এমন হলো। এইটুকু বড় হলে বড় ভালো হতো। কিন্তু হয় কি?!
যাপিত নাট্যের ত্রয়োদশ কিস্তি লিখলেন - কুন্তল মুখোপাধ্যায়
কুন্তল মুখোপাধ্যায়
২০.০৬.২০২০
ছোটবেলায় দিদিমা-ঠাকুমার কাছে রামায়ণ, মহাভারতের গল্প শোনেনি এমন শিশু আমাদের প্রজন্মে খুব কম ছিল। দিদুর কাছে শুনে রামায়ণ মহাভারত প্রায় আমার মুখস্থ ছিল, তারপর বহরমপুরে বাড়ির পাশেই রাজকুমারী দিদিমণি (দিদুর বয়সী) রোজ সন্ধ্যাবেলায় সুর করে কৃত্তিবাস ও কাশীরাম দাসের লেখা দুই মহাকাব্য পড়তেন, তাও শুনতাম। একটু বড় হয়ে স্কুলের উঁচু ক্লাসে উঠার সঙ্গে সঙ্গে রাজশেখর বসুর রামায়ণ ও মহাভারত পড়া হয়ে গিয়েছিল, এমএ পড়ার সময় ও অধ্যাপনা জীবনের প্রথম পর্যায়ে রামায়ণ ও মহাভারতের অন্য কিছু ব্যাখ্যা জেনেছি, পড়েছি বুদ্ধদেব বসুর মহাভারতের কথা। এই সময় রামায়ণ ও মহাভারত সংক্রান্ত আরও কিছু লেখা ও গ্রন্থ যেমন ইরাবতী কার্ভে, রামশরণ শর্মা, রোমিলা থাপার,ডাঙ্গে, জি.এস.ঘুরে, সুকুমারী ভট্টাচার্য, বি.ডি.সংকল্যার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, পড়ে ফেলেছি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ, কম্বন রামায়ণ , রংগনায়াকম্পার রামায়ণ (পরের দুটোর ক্ষেত্রে শিক্ষক পার্থ চ্যাটার্জীর অনুপ্রেরণা) ও নবনীতাদি-র রামায়ণ সংক্রান্ত ব্যাখ্যা। সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে ততদিনে বুঝেছি রামায়ণ আসলে আর্যায়নের প্রাসঙ্গিকতায় আর্যদের দক্ষিণাত্য বিজয়ের গল্প। অন্যদিকে মহাভারত আর্যদের নিজেদের সংঘবদ্ধতা বা এরিয়ান কনসোলিডেশনের কাহিনী। আবার সুনীল গাঙ্গুলী, মল্লিকা সেনগুপ্ত ও বন্ধুবর নৃসিংহ ভাদুড়ীর লেখা ও চিন্তায় আমার ভাবনার সমর্থন পেয়েছি। এইসব পড়াশোনা ও ভাবনা ‘শূদ্রায়ণ’-এর নাট্যরচনার প্রেক্ষাপট। মহাকাব্য নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আমার অনেক দিনের , বোধহয় ছোটবেলায় পৌরাণিক ও মিথোলজিক্যাল যাত্রাপালা দেখার ফল। দলে এ নিয়ে কথা হল পরিতোষদা, বিতানদা, শ্রুতিনাথ, শংকর, প্রণবদার সমর্থন পেলাম। সুরঞ্জনা তখন সংলাপ এর সঙ্গে একাত্ম , আর ছিল চুমপা, এরাও খুব উৎসাহ দেখাল। মুরারিদা , অঞ্জন দেব, তপন প্রথম থেকেই পাশে এসে দাঁড়াল। সব থেকে বড় পাওনা রবীন্দ্র ভারতী নাট্য বিভাগের একদল ছাত্রছাত্রী (তখন আমি ওখানে অতিথি অধ্যাপক) এসে যোগ দিল প্রোডাকশনে। এদের মধ্যে অমিতাভ, সৌমিতা, সব্যসাচী, মৌসুমী, স্বাতী, রুদ্র ; আর বাইরে থেকে প্রবীর , মৃনাল, মানিক, আমি ও কথাকলি আর অঞ্জনের মাইমের বেশ কিছু ছেলেমেয়ে নিয়ে প্রায় ৪০ জন শিল্পী নিয়ে শুরু হল ‘শূদ্রায়ন’-এর রিহার্সাল। রিহার্সাল থেকে শো নামা অবধি কথা এর পরের বার।
২১.০৬.২০২০
‘শূদ্রায়ন’ রিহার্সাল নামার আগে ঘরে অনেকবার পড়া হয়েছিল। রিডিং রিহার্সাল খুবই জরুরি ছিল এই কারণে যে এর আগে এত ব্ল্যাঙ্ক ভার্স, এত তৎসম শব্দ সমহারে সংলাপ বলার অভ্যাস অনেকের ছিল না। অন ফ্লোর রিহার্সাল শুরু হল অঞ্জনের নেতৃত্বে সৃজনী কলাকেন্দ্রের মঞ্চে। বেলগাছিয়া ভেটিনারি কলেজের পাশে, অধুনা লুপ্ত মঞ্চে। আমি অঞ্জনকে বলেছিলাম যে ঋষি বালকদের আশ্রমে শাস্ত্র ও শস্ত্রচর্চা দুটোই দেখাতে চাই। সেই মতো নাটকের সমস্ত চরিত্র মঞ্চে বিভিন্ন স্পেসে ধ্যানভঙ্গিতে বসে থাকত, আধো আলো অন্ধকারে ঋষি অঙ্গীরা (পরিতোষদা দাড়ি জটা পরে) এসে নারকেল ভেঙে সরস্বতী বন্দনা শুরু করত, সবাই একসাথে শুরু করত সুরঞ্জনার লিড ভয়েসে। তারপরে সবাই শুরু করত ব্যায়ামভিত্তিক শরীরচর্চা, এটা শেষ হত স্বস্তিবরণ উচ্চারণে। শুরুতেই ৪০ জন শিল্পীর সরস্বতী বন্দনার সম্মেলক উচ্চারণ ও পরমুহূর্তে মঞ্চ ভরে সবার শস্ত্রচর্চা এবং ঠিক তার পরেই পালকির মধ্যে সুর্পনখাকে বন্দি করে নিয়ে আসা। (সঙ্গে এই গান….পালকির মধ্যে ভেলকির খেলা দেখবি যদি আয়, আয় খেদুনি ডাইনি বুড়ি খেদি পেঁচি আয়) নাটকটিকে দর্শকের ভালোবাসার কাছে পৌঁছে দিত। খর ও দূষণ অনেকটা শেক্সপীয়রের নাটকের জেস্টার বা ভাঁড়ের মত আচরণ করত, কথা বলত বাংলা চলিত ছন্দে, ফলে একটা মজা তৈরি হত। ‘শূদ্রায়ণ’- এর গল্প লক্ষণ কর্তৃক সুর্পনখাকে প্রত্যাখ্যান, মারীচের উচ্চ জাতে উঠার ব্যার্থ চেষ্টা, আত্মসম্মানের প্রশ্নে সীতার আত্মজিজ্ঞাসা ও অনার্য জনগোষ্ঠীর উচ্চ জাতে স্থান পাবার অলীক স্বপ্নকে ঘিরে কেন্দ্রীভূত । সুর্পনখার চরিত্রে সুরঞ্জনা তার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনয় করেছিল। চুমপা সীতার চরিত্রে শান্ত অথচ প্রতিবাদী স্বরকে উপযুক্ত মর্যাদা দিয়েছিল। মারীচের ভূমিকায় তুলনামূলক নবাগত অমিতাভ, লক্ষ্মণের ভূমিকায় শঙ্কর, খর দূষণ বিতানদা দীপক ও মৌমিতা মিত্রার চরিত্রে, শ্রুতিনাথ ,প্রবহনের ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করত। সঙ্গে ছিল অপুদা, পরিতোষদা, হরপ্রসাদ,রণো, সব্যসাচী, দেবেশ, সুব্রত, প্রবীর, মানিক, প্রণবদা, স্বাতী, মৌসুমী এবং অঞ্জনের মাইমের গ্রূপের ছেলেমেয়েরা । প্রায় ৫৫ অতিক্রান্ত অপুদা যেভাবে মঞ্চে রনোর সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করত তা আজকের অনেকের কাছেই ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। পোশাকের জন্য শ্যামবাজার মোড়ের দোকান থেকে জনতা শাড়ি কিনে ট্রাইবালরা যেভাবে পড়ে সেভাবে পড়া হত। সুর্পনখার ড্রেস একটু রয়াল, অঙ্গীরার উত্তর ভারতের ঋষিদের পোশাক।মঞ্চে লাইভ মিউজিক থাকত, ধামসা, কারানাকারা। মঞ্চ তৈরি করেছিল সুরঞ্জনার প্ল্যানমতো মনিন্দ্র, যা খুব সহজেই শিফট করা যেত । আলো করেছিল জয়ন্ত মুখোপাধ্যায়, মেকআপ ও পোশাক পরিকল্পনা তপন চক্রবর্তী, সংগীত ও আবহ মুরারি রায়চৌধুরী। সৃষ্টির কাজে সকলে নতুন, আগে এমনটি হয়নি, এই উৎসাহ ও প্রেরণা নিয়ে কাজ করেছিল। ১৯৯৮ সালের ১ লা ফেব্রুয়ারি, সরস্বতী পুজোর দিন একাডেমি মঞ্চে এই নাটকের হাউস ফুল শো হয়েছিল, যা পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গের শহরে, গ্রামে, বাংলাদেশে, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে একশ’র বেশি বার অভিনীত হয়েছিল। অভিনয় করতে গিয়ে নানান অভিজ্ঞতার কথা এর পরের বার।
দুই বাংলার জনপ্রিয় ওয়েবসিরিজ ‘কারাগার’-এর তত্ত্বতালাশ করলেন - বৃতা মৈত্র
বৃতা মৈত্র
অকুস্থল আকাশনগর জেল। তারই ভিতর একটি সেল, যা গত ৫০ বছর ধরে বন্ধ। অথচ সেখানেই আচমকা এক বন্দিকে আবিষ্কার করে জেলের এক কর্মী। এই আবিষ্কারের ফলস্বরূপ গণনায় সেলের অন্তর্ভুক্ত কয়েদির সংখ্যা একজন বেড়ে যায়। অবিশ্বাস্য কাণ্ড ! প্রথমে তো সেই কর্মীটিকে, এটা তারই গণনার ভুল–একথা বলে সহকর্মীরা বুলি করতে থাকে। কর্মীটিকে নিয়ে আর একটু মজা করার উদ্দেশ্যে এরপর সকলে মিলে ওই সেলটির সামনে যায় এবং বন্দি লোকটিকে দেখতে পায়।
খবর পেয়ে জেলার ছুটে আসেন। প্রশ্ন ওঠে, গুনতির বাইরে বন্দিটি এলো কোথা থেকে ? যদি রেকর্ডের হিসেবে সে বন্দি না হয়, তাহলে, ছেঁড়া ও ময়লা কাপড়চোপড় পরা বিধ্বস্ত এই লোকটি আসলে কে? সবাই লক্ষ করে, এই কয়েদির আচরণ ও কথাবার্তাও খুবই রহস্যজনক। তার বক্তব্য, মীরজাফরকে খুন করেছিল সে, সেই ট্রায়ালের জন্যই এই জেলে বন্দি হয়ে আছে। তার বক্তব্যের সত্যতা মেনে নেওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব ! তাহলে কী সে একজন প্রতারক ?
অন্যদিকে আমরা দেখি, বেশ কিছুদিন ধরেই জেলের ভিতর অসৎ, অনৈতিক ও নিয়মবিরুদ্ধ ঘটনা ঘটে চলেছে। আর সে খবর ভাইরাল হয়ে যাওয়ার ফলে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্নের মুখে পড়েছেন জেলার মহাশয়। এদিকে জেলারের পরিবারেও রয়েছে বেশ কিছু জটিলতা। তাঁর ছেলেও কোনও এক অপরাধের শাস্তিস্বরূপ জেলবন্দি। জেলারের স্ত্রী ছেলের জন্মদিনে কেক নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে, জেলার তীব্রভাবে বারণ করে। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি এমনিতেই তাঁর পক্ষে প্রতিকূল। তার ওপর স্ত্রীকে অনুমতি দিয়ে, আবার ঝামেলায় জড়াবেন তিনি ? এছাড়াও এখন মহিলাদের জেলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে জেল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু জেলারের স্ত্রী অবুঝ ও নাছোড়বান্দা।
ওয়েব সিরিজে এভাবেই পল্লবিত সৈয়দ আহমেদ শওকি পরিচালিত ‘কারাগার’। হইচই অরিজিনালস-এর নিবেদন, বাংলাদেশের পটভূমিতে তৈরি সিরিজটি শুরু থেকেই এক রহস্যে-রোমাঞ্চে ভরা পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। যেমন কাহিনির মধ্যে রহস্যের ছায়া, তেমনই এক আলো আঁধারি পরিবেশে এগিয়ে চলা গল্প। ভিন্নস্বাদের এই ক্রাইম থ্রিলার দুই বাংলার দর্শক কতটা পছন্দ করেছে, তার প্রমাণ দুটি সিজনের চূড়ান্ত সাফল্য। আর এই সাফল্যকে ঘিরে প্রথম যে নামটি শিরোনামে আসবে, সেটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের প্রথমসারির অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী। চঞ্চল ওপার বাংলার হলেও, দুই বাংলার দর্শকের কাছেই অত্যন্ত জনপ্রিয়।
তিনি একইসঙ্গে সংযত ও উচ্চকিত–দুরকম অভিনয়েই সক্ষম ! প্রসঙ্গত, পরিচালক সৈয়দ আহমেদ শওকির সঙ্গে জুটিতে এর আগে আমরা হইচই বাংলাদেশেরই প্রযোজনা ‘তকদির’-এ চঞ্চলের অভিনয় দেখেছি। ‘কারাগার’-এ ওঁদের চমৎকার বোঝাবুঝি আরও একবার দেখছেন হইচই দর্শক।
চঞ্চল চৌধুরী ছাড়া সিরিজে অভিনয় করেছেন তাসনিয়া ফারিন, আফজল হোসেন, ইন্তেখাব দিনার, এফ এস নঈম, মহব্বত আলি, বিজরি বরখাতুল্লা, শতাব্দী ওয়াদুদ, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, এ কে আজাদ সেতু প্রমুখ। গল্প ও চিত্রনাট্য লিখেছেন নিয়ামতউল্লাহ মাসুম। রোমাঞ্চে ঠাসা, টানটান কাহিনির এই চিত্রায়ন দর্শককে অন্যমনস্ক হওয়ার সুযোগ দেয় না। সিনেমাটোগ্রাফার বরকত হুসেন পলাশের ক্যামেরা চিত্রনাট্যকে নিখুঁতভাবে অনুসরণ করে। পরিবেশ সৃষ্টিতে এক অদ্ভুত আলো-আঁধারি মায়াজাল, যেখানে প্রতি পদক্ষেপে ক্যামেরা বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। আলোর ব্যবহারের মতোই শব্দের প্রয়োগে বিষয়ানুগ থাকেন পরিচালক।
একই কথা বলতে হয় লোকেশনের ক্ষেত্রেও। নিঃসন্দেহে বড়ই যত্নে পর্দায় সৃষ্টি করা হয়েছে এই ‘কারাগার’। অসাধারণ এক টিম স্পিরিট চোখে পড়ে সিরিজের প্রতি পর্বে। দুটি সিজনে মোট ১৪টি পর্বে স্ট্রিমিং হচ্ছে ‘কারাগার’।
'অধাঙ্গিনী' এর ছায়ার গভীরের ছবিকে ছেঁকে তুললেন - দেবদীপ চৌধুরী
“সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে.. “
সহধর্মিণী ,স্ত্রী তিনিই যিনি সহধর্ম ধারণ করে থাকেন। প্রাক্তন স্ত্রী এবং বর্তমান স্ত্রী, কে স্বামীকে কতটা ভালো জানেন, চেনেন, প্রাক্তন হলেই কি প্রাক্তন হওয়া যায় সবটাই যেন এই ছবির থেকে স্পষ্ট। এখানে তো বলেই দেওয়া হল যিনি প্রাক্তন তিনি হয়তো মানুষটাকে খুব ভালো করে চেনেন, বোঝেন, তাঁর প্রত্যেকটা স্বভাবের বিষয় ওয়াকিবহাল।
কিন্তু যিনি বর্তমান তিনি তাঁর ভবিষৎ সহ বর্তমান জানেন। কোনটাকে অস্বীকার করা যায়? কোনটাকেই বা ছোট করা যায়? একই সঙ্গে এই ছবিতে উঠে এসেছে আরও বেশ কয়েকটা দিক। সন্তান হওয়া না হওয়ার সমস্ত দায়ভার যেন মহিলাদেরই। সমাজ এগোলেও, উন্নত হলেও কিছু পুরুষ নিজেদের অক্ষমতা মানতে পারেন না, দায়, দোষ সবটাই চাপান স্ত্রীদের উপর। বাদ দেন না অপমান, হেনস্থা করতেও। নিজেদের পৌরুষ প্রমাণ করতে বাকি রাখেন না কোনও কিছুই।
বিখ্যাত সুমন চট্টোপাধ্যায়(কৌশিক সেন) এবং শুভ্রা চট্টোপাধ্যায়ের (চূর্ণী গাঙ্গুলী) গড়ে তোলা একটি সাজানো সংসার কে শক্ত হাতে টিকিয়ে রাখতে মেঘনা মুস্তাফির(জয়া এহসান)প্রবেশ..
শেষমেশ মেঘনা মুস্তাফির কিংবা শুভ্রা চট্টোপাধ্যায়ের মুখোমুখি হওয়া সবটুকু মিলিয়ে সহধর্মিনী অথবা অর্ধাঙ্গিনীর জয় এটাই প্রকাশ পায়। অম্বরীশ ভট্টাচার্য, শ্রদ্ধেয় লিলি চক্রবর্তী, সৌমিত্র বসু, রায়া ভট্টাচার্য, প্রত্যেকে নিজের চরিত্রে সাবলীল..
পরিচালককে শ্রদ্ধা এরকম পরিবেশনার জন্য।
গুছিয়ে দেওয়া সংসার আর সংসার গোছানো অনেকটা জীবনানন্দের কবিতা আর শরদিন্দুর ব্যোমকেশের মতো।
সবশেষে,
আড়ালে থেকে ভালোবাসতেই পারেন। জন্মদাতা পিতা যখন সন্তান সুখ থেকে বঞ্চিত হন তখন তিনি আড়াল থেকেই ভালোবাসেন। এই পিতৃস্নেহ আদৌ কন্যার কাছে পৌঁছয় কিনা তিনি জানেন না। তবু কন্যাকে মাতৃস্বরূপিণী মনে করেন।
একদা তিনি চরিত্রের দোষে কিংবা রিপুর প্রবর্তনায় স্ত্রী ত্যাগী হলেন। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে একা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন পরস্ত্রী কাতরতা উপভোগে। চরম শারীরিক সুখ , যৌন উদ্দীপনার কাছে হার মানল তার পুরুষত্ব। স্ত্রী ত্যাগী স্বামী হয়ে উঠলেন গর্বিত চরিত্রহীন। দিন রাত জ্ঞান করলেন না। হঠাৎই একদিন স্ত্রী কন্যা সন্তান প্রসব করলেন। পিতৃ পরিচয় পেল কিনা অন্য বিষয় তবু পিতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হবে না সে। একাকী মা কন্যার সমস্ত দায়িত্ব সামলাতে লাগলেন।
হঠাৎই মোহ মুক্ত হয়ে পিতা নিজেকে খুঁজে পেলেন বটে কিন্তু স্বরূপ উদ্ঘাটনে ব্যর্থ পিতা আশ্রয় নিলেন মাতৃজ্ঞান লাভের প্রক্রিয়ায় না। অলক্ষ্যে তিনি তো কন্যা সন্তানের পিতা হয়ছেন তা তো অজানা….
পথভ্রষ্ট পিতা কন্যার স্বরূপ জানতে পারলেন বটে তবুও সন্তান স্নেহ , কিংবা মাতৃশক্তির সম্পূর্ণ আরাধনা সিদ্ধ হলেন না ঠিকই তবু সেই আড়ালে, আবডালে কন্যার মাতৃরূপকে আদর্শ করলেন।
তবুও কন্যা, মাতা, বড়ো অসহায়। মহামায়ার স্বরূপটি আজও অজানা। তাই আজও বহু পিতা পথভ্রষ্ট, চরিত্রহীন… কিন্তু সম্পূর্ণ পিতার স্নেহ প্রকাশে সর্বদা সচেষ্ট। প্রত্যেক সময়ে অসহনীয় পিতৃতন্ত্র দেবীপক্ষের সময়সীমা লঙ্ঘন করছে। আর মহাকাল সেই আদ্যাশক্তি মহামায়া, অসামান্যাকে বিজয় পতাকা উত্তোলনে সঙ্গ দিচ্ছে।
তবুও অজানা , অদেখা পিতৃস্নেহর ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া কন্যা স্নেহ অজানাই আছে…
এশিয়া থিয়েটারের নানা দিক নিয়ে, পঞ্চম পর্ব লিখলেন - সায়ন ভট্টাচার্য
শিলাজিতের গায়ক সত্তার সুলুক করলেন - অরিক্তম চ্যাটার্জি
X = শিলাজিৎ
রাশি দুরকমের – ধ্রুবরাশি আর চলরাশি। ধ্রুবরাশি সে ধ্রুবতারার মতো স্থির ও অচঞ্চল। নিজের অক্ষে থিতু হয়ে সে সতর্ক বিশ্বাসের ঐশ্বর্য জমায়। চলরাশি চির সন্ন্যাসী, অক্ষরের ভেক ধরে সে চলতেই থাকে, তার ঝোলা উপছে পথে পড়ে থাকে বিস্ময়ের পাথরকুচি, কতো মনি কতো মানিক, সে তা জানে না। তার প্রমিত অত্যাচারে অসংখ্য হুডানিটের অনুগল্পের আয়োজন ভরে থাকে কোন কিশোরবেলার বীজগণিতের খাতায় খাতায়। তাকে শুধুই শুধাতে হয় তুমি কে? চল তো রাশি রাশি রাশির মধ্যে বের করি মোকাম তোর কোথায়। আর চলরাশির চলরাশি – যাকে বলে ক্রিম দি লা ক্রিম হল এক্স। এক্স মানে যে চলে গেলো বলে গেলো না, কিন্তু আবেগী ‘যা গেছে তা যাক’ এর উচ্চারণে তার উপ্সথিতির স্পষ্ট অভিজ্ঞান রেখে গেলো।
এক্স মানে যে স্বরবর্ণের পরশ পেলে বর্ণচোরা হয়। এক্স মানে শেষ পঙক্তির অভিনিবেশে মান না বেরনো অব্দি যার অভিমান কাটে না। এক্স মানে যার পরে ইক্যুয়ালস টু বসা নিশ্চিত কিন্তু সেই ইক্যুয়ালস টু’র পর আর কিছুই নিশ্চিত নয়। যে এই নাটকের এই অঙ্কে যা, পরের অঙ্কের অঙ্কশায়িনী হলে কোই ওউর সহি! বাংলা গানের এই চির অনিশ্চয়তার অন্য নাম শিলাজিত।
রহস্যটা কোথায়? গোড়াতেই। কেই এই শিলাজিত, মানে শিলাজিত নামের মানুষটা যে গান গায় বলে দাবি করছে, সে যেগুলো করছে সেগুলো কি গান? ধন্দ চাড়িয়ে দেন শিল্পী নিজেই। ক্যাসেটের ভেতরে লিখে রাখেন, ‘গান গাইতে ইচ্ছে করছে তাই গাইছি, চেঁচাতে ইচ্ছে করলে চেঁচাতাম’। অনেকে বলতেন, ‘সেটাই তো করেছে’। তাতেও এই নির্ঘোষের কিছুই এসে যেতো বলে মনে হয় না। কারণ প্রশ্ন যেটা জাগে সেটা হল গান কি তবে চেঁচানোর মতই একান্ত ইচ্ছাধীন ও স্বতঃস্ফূর্ত! গান নিয়ে আপত্তি নব্বইয়ের অনেক শিল্পী অনেকভাবে জানিয়েছেন, কিন্ত সবার’ই ফর্ম ভাঙ্গার একটা ফর্ম ছিলো।
মানে ভাংচুরের’ও একটা ঘরানা ছিলো। সেই নিরিখে তাদের শ্রোতাদের একটা বিলক্ষণ ভিত্তি ছিলো। যেমন অঞ্জন দত্ত বলেছে একেবারে প্রথম অ্যালবামেই, ‘গলায় আমার নেই তো কোনো রেওয়াজ করার স্বভাব/ এই অভাব আমার থাকবে চিরদিন’, কিন্তু শ্রোতাদের বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে গতানুগতিক ‘মালকোষ বা পিলু ভৈরবীর’ তালিম না থাকলেও এক অন্য ঘরানা সাঙ্গীতিক প্রস্তুতি তাঁর ছিলো, আছে, থাকবেন। তাঁর গানে সেই চিহ্নগুলো আর তার আত্মীকরণের সীমাবদ্ধতার সঙ্কেত স্পষ্ট। কিন্তু এ সব’ই তো গানবাজনার মধ্যে থেকে কথাবার্তা, কারো বার্তা যদি এই পরিধিটাকেই ভেঙ্গে ফেলার হয়, আর তারপর বলা যে, ‘এই যে ভেঙ্গে দিলাম, এটাই আমি, আর এই আমিটাই আমার গান, বাকি সব বাহুল্য’, তবে একটা অস্থিরতা ও অস্বস্তি যুগপৎ তৈরি হয়, বাংলা গানে যে অস্থিরতা ও অস্বস্তির নাম শিলাজিত।
একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলি। ২০০৬ – ২০০৭ এরকম একটা সময়ে আমি একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতাম। ওই অফিসে আমার চেয়ে অল্প সিনিয়র এক সহকর্মী ছিলেন যিনি ভালো গীটার বাজাতেন। ভালো মানে খুব’ই ভালো। পেশাদার। এক সময়ে শিলাজিতের দলে তিনি কিছুদিন বাজানোর একটা সুযোগ পান। তো শো’এর পরে অফিসে ফেরার পরে আমরা, যারা একটু আধটু শখের গান বাজনা করতাম তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন হল’? তিনি বললেন যে শুরুতে তিনি খানিকটা ঘাবড়ে যান, কারণ শিলুদা (যে নামে একটা গোটা জেনারেশন শিলাজিতকে ডাকতো) তাকে বলেন যে ‘ওই কর্ড-ফর্ড নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। তুমি শুধু প্রসেসর থেকে নানা রকম সাউন্ড আমাকে দাও। বাকিটা আমি গেয়ে নেবো’। এটা কতটা সত্যি আমার জানা নেই, কিন্তু শিলাজিতের গানের স্ট্রাকচার বিশ্লেষন করলে এর’ই কাছাকাছি একটা অয়প্রোচ, একটা পদ্ধতি কিন্তু বোঝা যায়। অর্থাৎ একটা কি দুটো কর্ডের জমিতে অত্যাধিক ওঠা-নামা রহিত সুরে কিছু কথা, মানে যা বলার, তা বলে যাওয়া। সেটা কাঠামোগত ভাবে এমনি শিথিল যে দু’একটা পঙক্তি ইচ্ছে মতো জুড়ে বা বাদ দিয়ে দেওয়া যায়। আর কথাও খুব সোজাসাপ্টা, সুরের মতো কবিত্বের সচেতন বাহুল্য’ও সেখানে বর্জনীয়।
এই বাহুল্যবর্জিত ও পুনরাবৃত সুরের’ও কয়েকটি মান্য কাঠামো আছে। খুব সাধারনভাবে র্যাপ নামক নাগরিক ফর্মটির কথা মাথায় আসে। আফ্রিকান-আমেরিকান সংস্কৃতির যে প্রকাশঋদ্ধ ব্যাপ্তি ও গভীরতা আমরা ইস্ট-কোস্ট ওয়েস্ট কোস্ট হিপ হপ বা র্যাপ সঙ্গীতে পাই তার’ই একটা তরল ও লোকাল প্রয়োগের ইঙ্গিত নচিকেতা তার প্রথম ক্যাসেট ‘এই বেশ ভালো আছি’ তে আমাদের দিয়েছিলেন। প্রথম শোনার ধাক্কাটা কেটে গেলে সেটা বেশ জনপ্রিয়’ও হয়েছিলো। হয়তো আট ও নয়ের দশকের সন্ধিলগ্নে অভিবাসী শিল্পী আপাচে ইন্ডিয়ান ও বিশেষ করে বাবা সায়গলের গানের মধ্য দিয়ে কান খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো অনেকের। কিন্তু শিলাজিতের গানে এই র্যাপ সরাসরি আসে না, কিছু প্রথম দিককার গানে রেফারেন্সের মতো আসে। মার্কিন ব্লুজ গানের বিবিধ সমৃদ্ধ ফর্মের মধ্যে একটি আছে যেখানে একটি রিফ বা স্বরসঙ্গতি বাজতে থাকে এবং তার প্রেক্ষাপটে কথাগুলি প্রায় কথা বলার মতো করে বলে যাওয়া হয়। জন লি হুকার যে গায়কীর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। জন লি হুকারের গানের সাথে আমি শিলাজিতের গানের কিছু কাঠামোগত মিল পাই, যদিও আমি নিশ্চিত সেই মিল অচেতনেই হয়ে গেছে, কারণ এই মিলটুকু বাদ দিলে পুরোটাই অমিল। কিন্তু এই ধরণের ফর্মে একটি জমাট ও শাব্দিক পটভূমি লাগে, যার ক্যানভাসে কথাগুলি প্রক্ষিপ্ত হবে ও উচ্চারিত হবে। সেই নির্মাণটির গুরুত্ব সম্পর্কে শিলাজিত সচেতন এবং সেই নির্মিতির ক্ষেত্রে যত্নশীল। এই সাউন্ডস্কেপ তৈরির বোধ থেকে আমার প্রাক্তন সহকর্মীর দাবিটিও খুব অপ্রাসঙ্গিক মনে হয় না।
কিন্তু এর বাইরেও আরেকটি গুরুতবপূর্ণ প্রভাব আছে। গুরুত্বপূর্ণ কারণ সেই ব্যাপারে শিলাজিত নিজেও অত্যন্ত সচেতন এবং সেটিকে তিনি ক্রমে তার আইডেন্টিটি নির্মাণে সুকৌশলে ব্যবহার করেন এবং গানের জগতে তৎসহ কলকাতার সমাজে নিজেকে একজন চিরকালীন আউটসাইডার হিসেবে একটা স্পেস নির্মান করেন, সেটা হল বীরভূমের ঝুমুর গান। সেই সুরের অনুষঙ্গে থাকতো যে লিরিকের বাঁধুনি বা বাঁধুনির অভাব, সেটা নিয়ে আমরা পরের বার কথা বলবো, কারণ সুরের মতোই সেখানে এক রকমের প্রান্তিকতার রাজনীতি সচেতনভাবে বোনা আছে।
‘আদিপুরুষ’ সিনেমা নিয়ে কলম ধরলেন - অভিষ্যন্দা লাহিড়ী দেব
অভিষ্যন্দা লাহিড়ী দেব
আদিপুরুষ: ন্যাতানো বাজি
এতদিনে ‘আদিপুরূষ’ ফ্লপ হয়ে গিয়েছে। সক্কলেই জেনে গিয়েছেন এই সাড়ে চারশো কোটির যাত্রাপালাটা দেখার থেকে না দেখাই ভাল। তবু এই রিভাউটা লিখছি কেন? কেমন যেন মনে হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম এপিক নিয়ে, এত টাকা গচ্ছা দিয়ে যে এপিক লেভেল ফেলিওরটা নামানো হল, সেটা নিয়ে দু’একটা কথা বলা দরকার।
এই ছবিটার দুটো সমস্যা, মাত্র দুটো! তাতেই এতগুলো টাকা জলে চলে গেল! প্রথম সমস্যা হল, সংলাপ। সংলাপ রচয়িতা মনোজ মুন্তাশির শুক্লা খুনের হুমকি-টুমকি পেয়ে নাকি বলেছেন, ছবি জুড়ে কয়েকশো সংলাপের মধ্যে শুধু কয়েকটি সংলাপ নিয়েই কথা হচ্ছে, সেটা তাঁর ভাল লাগছে না। সেই সংলাপগুলো বদলানোও হয়েছে, কিন্তু তাতে কোনও লাভ হয়নি। কারণ, ছবির প্রতিটি সংলাপই আপত্তি তোলার যোগ্য। কোথায় বাল্মীকি রামায়ণ আর কোথায় তুলসীদাসের রামচরিতমানস। এই ছবিতে যে ডায়ালগবাজিটা হল, সেটা শুনলে রামলীলা টুকরিও লজ্জায় অধোবদন হবে। ছবিতে রাজনন্দিনী জানকীর মুখে কলতলার ভাষা, লক্ষণ আর হনুমান তো একেবারে মাওয়ালি। লক্ষণ কেন, কোন দুঃখে যে হনুমানের সঙ্গে দেখা হতেই তাঁকে চারটি পচা ধাঁধা শুধোয়, আর হনুমান যে কেন ভক্তশ্রেষ্ঠ হয়েও রামচন্দ্রকে চিনতেই পারেন না, এসব কথা আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না প্লিজ। গান লিখতে গিয়ে শুক্লাজী তুলসীদাস থেকে আদি শঙ্করাচার্য সকলের উপর কলম চালিয়েছেন। তাতে যে পিণ্ডিটি পরিবেশিত হয়েছে সেটার কথা আর নাই বা বললাম।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী কবিতায় যে ‘ছেলেদের রামায়ণ’ লিখেছিলেন, তাতে সমুদ্রের রাক্ষসী সুরসাকে হনুমান বলেছিলেন, “বুড়ি তুই ভারী ভোজ খাবি, অসুখ না হয় পরে তাই শুধু ভাবি!” তা সেটা ছিল, ‘ছেলেদের রামায়ণ’, আর এটা রামায়ণের ছেলেখেলা, তাই তুলনা টানাটা উচিত হবে না।
এবার আসি দ্বিতীয় সমস্যায়। পরিচালনা। পরিচালক ওম রাওতকে কেউ বলেছিল ভিএফএক্স রামায়ণ বানাতে, তাই তিনি যেখানে পেরেছেন ভিএফএক্স গুঁজেছেন।
ছবিতে একটাও দৃশ্য নেই যেখানে ভিএফএক্স নেই। তাতে যেটা হয়েছে, সেটা হল একটা ভয়ানক জগাখিচুড়ি। ছবির শুরুতে দেখা গেল একজন লোক জলের তলায় বসে ধ্যান করছেন, মাছেরা তাঁর গায়ের কাছে খেলছে-টেলছে। কী হল! রামায়ণে দুর্যোধন কোত্থেকে এলেন! মহাভারতেই আছে না, দুর্যোধন পুষ্কর তীর্থে জলের তলায় লুকিয়ে ছিলেন? তারপর জানা গেল ও হরি! এ যে রামচন্দ্র! কেন যে তিনি জলের তলায় ধ্যান করেছিলেন, কেনই বা সেখান থেকে উঠে ভিএফএক্স ভূতেদের টপাটপ মেরে ফেলতে লাগলেন, আর সেই ভূতগুলোই বা কারা, কোথা থেকে এল, এসব প্রশ্নের কোনও ব্যাখ্যা ছবিতে দেওয়া নেই।
তবে হ্যাঁ পুষ্পকরথটা বাদুড় হয়ে যেতে খুব অবাক হয়েছি। বড় বদখত্ দেখতে বাদুড়টা। সেটাকে আবার হনুমানজী মেরেও ফেললেন। যাহ বাবা! রামচন্দ্র আবার অযোধ্যায় ফিরবেন কী করে? সেতু পেরিয়ে?
ছবিটার সম্ভাবনার কোনও শেষ ছিল না। এত টাকা পয়সা খরচা করে তৈরি বলে কথা। মোটামুটি সকলেই ভাল অভিনয় করেছেন। বিশেষত সেই ল্যাঙড়া ত্যাগীর পর ফের ভিলেন চরিত্রে সইফ আলি খান। ভাল বলা যেত, কিন্তু স্ক্রিপ্টটাই তো পুরো যাত্রাপালা.. তাই আর তিনিও বিশেষ কিছু করে উঠতে পারেননি।
ছবিটা দেখে কালীপুজোর কথা মনে পড়তে পারে, সারা বছর অপেক্ষার পর তুবড়ি কেনা হল, রোদে দেওয়া হল, ওহফ! যা জ্বলবে না! দোতলা আগুন উঠবে! ব্যাস! নেমে গেল বৃষ্টি! বাজিগুলো গুছিয়ে তুলতে তুলতে পুরো ন্যাতা! কোথায় দোতলা! হাঁটুর সমান আগুনও উঠল না! এই সিনেমাও একেবারে তেমনিই!